ওদের হাতে কচ্ছপের করুতম লাশ
কোন অতলের উষ্ণতম আহার্যে নিশ্বাস
ফেলতো ওরা তখোন যে ঐ কচ্ছপের ঘ্রাণে
এখনো যারা সুন্দরের স্বচ্ছতম দাস
কেউ কি জানে? কেউ কি তারা জানে?
ওদের চোখে জলের কুহক, আমরা বলি নদী
দু তীর ঘেঁষে কত না দাহ, কত না সম্বোধি
কত না কালো চিহ্ন আর কত না বাঁচা মরা!
শিকারী ওরা সেই নদীতে এখনো জোড়া জোড়া
ভাসতে দেখে কচ্ছপ, না শিল্প? না কি সংহতির ভ্রূণ?
ওদের হাতে বর্শা ফলা, মহাকালের তুণ
জলের স্রোতে ভাসছে কত মৃত্যু আর ঘুণ
ওদের ওরা বিদ্ধ করে, বিদ্ধ করে আর
শিকার করে শিকার করে কালো জলের প্রাণী
আমরা যাকে নদীর কালো তিলক বলে জানি!
ওদের কাছে তারা কেবল চিহ্ন, বেঁচে থাকা।
কচ্ছপের পিঠের পরে দুইটি হাত রাখা
দেখেছিলাম কোথায় কোন শিকারী ওরা কবে
নৌকা নিয়ে যারা দুপুর জলেরই উৎসবে
উষ্ণ হতো সমুদ্যত হাতের দুটি শিরা
বর্শা নিয়ে দাঁড়াতো-সেই সূক্ষ্ম শিকারীরা।
কচ্ছপের শিকারী ওরা কালো জলের ভীড়ে
নদীর কটিদেশের কালো চিকন দুটি হাড়ে
বাঁধতে সেতু কর্ম আর ধর্ম জোড়া দ্বিধা
এখন সেই জলেই যেনো জলের অসুবিধা
কচ্ছপের হারের মতো সহজতম হার
হারিয়ে গেছে আদিজগৎ প্রাণের অভিধার।
তবুও হাতে বর্শা ফলা, তবুও অন্ধকার
শিকার করে নদীর গ্রীবা কচ্ছপের হার
ঐতো ওর চলছে, দেখি এখনো টানটান
ওদের হাতে বর্শা ফলা ওদের হাতে প্রাণ।
*
ঘুমোবার আগে
আমার কাছে আগুন ছিল না
আমি চাঁদের আগুনে
শাদা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসেছিলাম কুয়াশায়।
–কে ওখানে?
শীতরাতে পউষ পাখির গলা শোনা গেলো জ্যোত্সায়,
–কে ওখানে?
পাখির কণ্ঠের গানে
কুয়াশায় আমি কালো জ্যোৎস্না ঘুরে হঠাৎ তখোন
চাঁদের আগুনে পুড়ে
ছুঁয়ে দিতে উদ্যত হলাম।
অসৃয়মাণ তুমি?
তোমাকে না ছুঁতে পেরে
আমি নিজ নিয়তির অন্তর্গত রোদনকে বোললাম, দ্যাখো
আমি আর কাঁদতে পারবোনা!
*
আশ্রয়
তুমি শুভ্রা, তুমি শস্যশীলা, তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে কে কণা
অনিদ্র মাধুরী!
হোক উপহাস্য তবু তুমি প্রেম, তুমি প্রচলিত ভণ্ডামী নও!
তুমি প্রেমহীন পুরুষের ক্লান্তিবোধ নও,
তুমি কুমারীর কালো খোঁপা খুললেই কাঁপাও কুসুম!
তুমি ব্যাৎসায়ন পড়োনি তবু
ব্যাৎসায়ন-অধিক সূক্ষ্ম কামকলা অভিজ্ঞা সুন্দরী!
তুমি অনুর্বরা নও, কালো মৃত্তিকার মূলে মিলিত কুমকুম তুমি!
বেঁচে থাকো অভিলাষ যৌবনের সাতমহল শুদ্ধ হাততালি!
তুমি নর্তকী যখোন নাচে তার তীব্র তমস্য হরণ ছন্দ, তুমি তামসিক!
তুমি জ্যোত্স্নায় সাতশো সুন্দর শাদা দুরস্ত ঘোড়ার খুরে খুরে
উন্মাতাল নাচ!
সমাজের সব ডাইনীদের খলপনা থেকে তুমি বেরিয়ে এসেছে আজ
তমসার ভ্রূণ ভেঙে বেরিয়ে এসেছো তুমি সদ্যজাত ভোর।
তুমি নব সকালের নব রৌদ্রযুগ!
তোমরা ভিতরে গেলে গর্বিত গহন সারি সারি সুরম্য প্রাসাদ
দেখি আমি মর্মর খিলান ছাঁদ ঢের
মসলিন তাঁতের খটাখট কানে আসে যেনো তুমি তাঁত
যেনো তুমি কুয়াশার চেয়ে মিহি মসলিনে ফের
ফিরে আসা নব শিল্পকলা।
আমাদের প্রপিতামহীরা যাকে বাদশাজাদীর মতো শরীরে সাজিয়ে সময়ের
ঘুমে ঢুলু ঢুলু আহা ডাকতো নোনারু কণ্ঠে আয় চাঁদ আয়!
আমি তোমার গ্রীবার গ্রামে আজ ফিরে পেলাম ব্যথায়
বিলুপ্ত বৃক্ষের সেই সুরভিত পাতার সুঘ্রাণ!
আমার অরণ্য বিদ্যা তুমি হে বনানী হে আমার আম্রকানন
হাটুরে পায়ের চিহ্ন লেগে থাকা হে আমার ঘরে ফেরা পথ
তুমি ধান ভানো, গান গাও, আজো কোলে শিশু ডেকে আনো!
আজো শীতরাতে তুমি কুয়াশায় ক্ষুধিত চাঁদের মতো বাঁকা জটিদেশ,
হায় তুমি, হায় অবিরাম রাতে ভেসে আসা উষ্ণ ছিপ নৌকা আমার!
তুমি আমাকে দহন দিয়ে এই যে সহন শান্তি অমরতা দিলে
এই তো মানুষ চায়, যুগে যুগে এই তার জেগে থেকে ঘুমোবার সাধ!
*
সে আর ফেরে না
বহুদূরে ট্রেনের হুইসেল, যায় দিন যায়!
বোনের মোন এক লাজুক পাড়া গাঁ তার
ডাক শুনে থাকে অপেক্ষায়।
তবু ভাই ফেরে না, ফেরে না!
ডাকবাকসে ধু ধু শীত জমে ওঠে বিদায়ী জ্যোৎস্নায়
বৃক্ষের কোটর থেকে শেষবার পনেরো দিনের মতো
উড়ে যায় বাদামের পাতার আড়ালে গোল চাঁদ
চারিদিকে ভেঙে যাওয়া ভুল অন্ধকারে যেন তারপর
মনে পড়ে যায় তার
সেই যে গিয়েছে ভাই দীর্ঘ দু’বছর
পরিচিত পথের রানার এসে দাঁড়ায়নি পোস্টম্যান
চিঠি নিয়ে ব্যস্ত সাইকেলে!
লাজুক পাড়াগাঁ তার নিসর্গের বারান্দায় তবু বসে থাকে অপেক্ষায়
ইস্টিশনে বহুদূরে ট্রেনের হুইসেল
যায় দিন, দিন চলে যায়।
*
তুমি ভালো আছো
হৃৎপিণ্ড থেকে দুটি দুঃখময় জাগরণ চোখের গোলকে এনে
দেখছি তোমাকে, তুমি ভালো আছো?
বুকের বাঁ পাশ থেকে কারুকার্যময় একটি দীর্ঘনিশ্বাস আমি
নিদ্রাহীন আত্মার উপর তুলে চোখ খুলে দেখছি তোমাকে তুমি।
ভালো আছো?
বন্যা বিতাড়িত ভীত জলের প্লাবন খাওয়া মানুষের মতো আমি
দেখছি তোমাকে, তুমি ভালো আছো?
বাইরে বিবস্ত্র যুগ, হাহাকার, বাইরে তমসা
বাইরে বাগানে ওরা বসে আছে গোলাপের নামে সব অবগোলাপের দল!
বাইরে কোথাও কোনো মেঘ নেই, নষ্ট নির্মেঘ রাত্রি কাঁদছে।
কুকুএ!
নেবুর পাতার মতো নিদ্রাহীন আমার নির্জন বুকে বইছে
বাতাস!
মুহূর্তে কোথাও যেনো খুলে গেলো খুনের দরোজা; তুমি
ভালো আছো?
পৃথিবীতে আজ বড় অবিশ্বাস!
কখনো কান্নার কাছে মুখ নিয়ে মানুষ দেখিনি!
সৌর মাইল দূরে কান পেতে কম্পমান আত্মার ভিতরে আজ
অলৌকিক
দেখছি তোমাকে, তুমি ভালো আছো?