স্বপ্ন গুঁজে দেয়
তোমরা আমাকে বুঝি পোষমানা পশু
বানিয়ে রাখতে চাও খাঁচার ভেতর? এ জীবনে
যা কিছু গৌরবময় তার প্রতি উদাসীন নিত্য
খুঁটব আহার্য আর নিজেরই পুরীষে রাত্রিদিন
দেব গড়াগড়ি, মাছি বসবে শরীরে
যখন তখন, তাড়াবার ইচ্ছাটুকু নির্বাপিত,
জমবে আত্মায় শুধু আলস্যের ক্লেদ-
এই তো তোমরা চাও, হে আমার প্রাণের স্বজন।
আমার স্বপ্নের চারপাশে ছারপোকা ঘোরে, মৃত
নক্ষত্রের ছায়া ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে কথা বলে
কবিতার মেরুন খাতার কানে কানে। সেই কবে
কাঁদতে ভুলেছি বলে ফাঁকা দৃষ্টি মেলে
চেয়ে থাকি সবুজ ডোবায়
নিজের মুখের দিকে। একটি বিষণ্ন পাখি কেঁদে উড়ে
যায়।
আমার বুকের ডান দিক থেকে বারুদের ঝাঁ ঝাঁ
গন্ধ ঝরে যায়,
আমার দু’চোখে রক্তছিটা শব্দহীন কলরব করে আর
করতলে দুঃস্বপ্নের কাকের করোটি
নেচে ওঠে বারে বারে। কোকিলের গানের আশায়
কান পাতি, ঘাতকের পদধ্বনি মেরুদণ্ডে হিম মেখে দেয়।
আত্যস্ত কঠিন আজ প্রকৃত কবির মতো কণ্ঠে
অসত্যের কোলাহল থামিয়ে সত্যের
পূর্ণিমায় চতুর্দিক উদ্ভাসিত করা। ক্ষিপ্র নেকড়ের কাছে
সিংহের চকিত আত্মসমর্পণ অতি
শোচনীয় দৃশ্য বটে। রক্তে নেই তারাবাতি-দ্যুতি,
তাৎপর্যের আভা ক্রমাগত বহু দূরে সরে যায়।
তোমরা দেখছ যাকে এমন বিপন্ন গোধূলিতে,
সে-তো আমি নয়।
কোথাও সোনালী ঘন্টা বাজে, জাগরণ; খাঁচার ইস্পাতি
শিক
বেঁকে যায় একে একে, খুলে যায় দ্বার,
যেন সূর্যোদয়,
এবং শেকল খসে, ছটে যাই বর্শার মতোই
উদ্দাম, স্বাধীন; পায়ে মেঘ চুমো খায়,
নিরায় শিরায় ভোরবেলাকার রৌদ্র রং ময়ূরের নাচ।
ডানাঅলা কে বার্তাবাহক অগোচরে
আমার মুঠোয় কিছু স্বপ্ন গুঁজে দেয়।
হরিণের হাড়
বেশ কিছুদিন থেকে প্রেরণা ফেরারী; যেন আমি
লুণ্ঠিত কাঙাল, একা-একা
ঘুরি ইতস্তত দিশাহারা। এখন কোথায় গেলে
আবার উঠবো ভ’রে কানায় কানায়?
আখেরে বনের চারু হরিণের নিকট গেলাম
দিনান্তের অস্বচ্ছ আলোয়। তখন সে
পাতা থেকে ঝ’রে-পড়া সপ্নের সবুজ
খাচ্ছিলো চিবিয়ে, চমকিত তাকায় আমার দিকে।
আমি যে নিষাদ নই, অসহায় প্রার্থী একজন,
টের পায়, দোলায় শিঙের কারুকাজ,
ঝরে সৌন্দর্যের কণা চারদিকে। গূঢ় স্বরে বলে,
‘আজ নয়, অন্য কোনোদিন তুমি এসো পূর্ণিমায়।
শান্তি নেই, নিদ্রাহীনতার অন্ধকার
টানেলে আমাকে এক বুড়ো
গেঁথে নেয় তীক্ষ্ণ শিকে, উল্টে আগুনে পোড়ায়
সারা রাত; ব্যর্থ শব্দ লেগে থাকে ঠোঁটে, মরা মাছি।
পূর্ণিমায় বনে যাই, খুঁজি সেই হরিণের সানন্দ ভঙ্গিমা,
আমার পায়ের নিচে পাতা বেজে ওঠে,
হঠাৎ অদূরে দেখি প’ড়ে আছে ঝোপের কিনারে
জ্যোৎস্নার রঙের মতো কতিপয় হাড়। হরিণের?
দ্যুতিময় কী যেন প্রবেশ করে আমার ভেতর
অকস্মাৎ, সৃজনের আলোড়নে হই
ক্রিসমাস গাছ, সব ঠোঁট থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি
মুছে যায়, যখন আমাকে
গাছপালা, পাখি আর জোনাকিরা করে
সম্ভ্রমে কুর্নিশ, মেঘ এসে
আমার চরণ ছোঁয়, আতিথ্য জানায় নক্ষত্রের দরবারে,
অন্তরালে নেচে ওঠে স্বপ্নবৎ হরিণের হাড়।
হৃদয়
সেদিন একালবেলা আয়নার সমুখে দাঁড়াতেই
হাত থেকে টুথব্রাশ খ’সে যায় আর
হঠাৎ বেরিয়ে আসে আমার হৃদয়,
ঠাঁই নেয় জানালার গ্রিলে, যেন পাখি,
উড়ে যাবে ঘন কুয়াশায়। গোধূলির
আকাশ রঙিন কাঁথা, মেঘ সেলাইয়ের
কাজে মগ্ন একজন; আমার হৃদয়
তার বুকে ঝুলে থাকে, যেন নষ্ট চাঁদ।
হৃদয়বিহীন আমি চাঁদ খেয়ে ফেলি ফালি ফালি
ক’রে আর আমার ভক্ষক নাম রটে চরাচরে।