- বইয়ের নামঃ হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপ্রেমের কবিতা
এক্ষুণি বলে ফেলা দরকার, নইলে খুব বেশি
দেরি হয়ে যাবে। সত্যাসত্য নিয়ে ঝাক্কিঝামেলা,
তর্কাতর্কি মূলতুবি রেখে
বোধোদয়ের বাগান থেকে
পরগাছাগুলোকে একটু হাত লাগিয়ে
উপড়ে ফেলা যাক
সময় আমাকে তাড়া করে। গাছে লটকানো
হিস্পানি গিটার জপায়, স্বীকারোক্তি চাই।
এতদিন যে তাসের ঘর তৈরি হয়েছিল
আমার মনের খেয়ালে, বৈরী হাওয়ার ফুৎকারে
তা লহমায় ভূমিসাৎ। অগ্নিবলয়ের এপার থেকে
দেখলাম, একটা জতুগৃহ গলে গলে
মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সেই
অগ্নিকাণ্ডের তাণ্ডবমুক্ত একটি পাথরে
তোমার নাম উৎকীর্ণ করতে গিয়ে বানানের
বিসমিল্লায় গলদ, চৌদিকে হাহা হিহি।
করজোড়ে তোমার কাছে মাফ চাই। কবুল করি, এতদিন
তোমাকে নিয়ে যে ছাইভস্ম লিখেছি বার বার, তার
কোনো মাথামুণ্ডু নেই, কোনো বুনিয়াদই নেই।
মিথ্যার নকল নক্ষত্রখচিত কাঁচুলি নিয়ে খেলা করাই
আমার দ্বিতীয় স্বভাব, এতদিনে তোমার
অজানা থাকার কথা নয়,
তোমার যে হাত কখনো স্পর্শ করার
সুযোগ কিংবা সাহস আমার হয়নি,
তোমার যে ঠোঁট কখনো যুক্ত হয় নি আমার ওষ্ঠে,
তাদের কলুষিত করেছে আমার মিথ্যা বয়ান।
আমার এমনই বসিব, কল্পনা আমাকে ফুসলিয়ে
তিলকে তাল বানিয়ে নিয়েছে। ভালোবাসার
কাঙাল আমি, তোমার মধুর সৌজন্যকে
তরজমা করে নিয়েছি প্রেমে এবং আমার বেহুদা
বেশরম কলম, অতিরঞ্জনে বেজায় দড়, তোমাকে
পর্বে পর্বে বিব্রত করেছে। এই মুহূর্তে ওর গালে চড়
কষাতে ইচ্ছে করেছে; কেননা সে ছন্নছাড়া,
অবাস্তব স্তবকের রচয়িতা।
আমার কলমের বেহায়াপনায়, রংবাজিতে
আমি নিজেই তাজ্জব।
তোমাকে প্রবাল সিঁড়ি থেকে নামিয়ে আমার
কল্পনাজীবী লেখনী আমার বাঁ পাশে
বসিয়ে দিয়েছে জ্যোৎস্নাধোয়া দোলনায়।
তুমি আমার আলিঙ্গনে
ছিপছিপে নৌকোর দোলা, এরকম একটা ছবি
ফোটে তার কয়েকটি আঁচড়ে।
তুমি আমাকে কখনো এমন কিছুই বলোনি,
যাতে মনে হতে পারে তোমার হৃদয়ে
আমার উদ্দেশে ছিল ভালোবাসার বিচ্ছুরণ।
রৌদ্র-জ্যোৎস্না, পানিতে টইটুম্বুর দীঘি
আর হাওয়ায় স্পন্দিত গাছের পাতার ঝিলিমিলি
যা কিছু জপিয়েছে আমাকে
তাকেই তোমার উচ্চারণ ঠাউরে
আমি খুশিতে ডগমগ
যদি তুমি ভুলে যাও আমার বলপেনের
অপরিণামদর্শী উচ্ছলতা, তাহলে আমার
অপরাধের বিষবৃক্ষ উৎপাটিত শেকড়বাকড় সমেত।
যদি বলো, এই বেল্লিককে ছুঁড়ে ফেলে দিই
শ্মশানঘাটের দাউ দাউ চিতায়
অথবা মাছের মড়ক লাগা বুড়িগঙ্গায়।
এতকাল আমার যে অক্ষরমালা
তোমার গলায় পরিয়েছি বলে ঢি ঢি
পড়ে গ্যাছে পাড়ায় পাড়ায়, আসলে তার
একটি মুক্তোও সাচ্চা নয়,
এটা কেউ একবারও ভেবে দেখলে না।
তুমি ছাড়া কে ওদের বলে দেবে যে, যদি কেউ
জলাশয় ভেবে মরীচিকার পেছনে ছুটে মরে দিশেহারা
তবে ভ্রষ্ট পথিকের আর্তনাদের জন্যে
মৃগতৃষ্ণিতাকে দায়ী করা অন্যায়।
কী আনন্দ পায় ওরা বেবুনিয়াদ ছায়ার মহল বানিয়ে?
যারা আমাকে সাতবার
মাটিতে পুঁতে ফেটে পড়ে অট্রহাসিতে
আর গায়েব লাঠিসোটা নিয়ে
লড়াই করে আমার ছায়ার সঙ্গে দিনভর, রাতভর,
আমার হাতে স্বরচিত মিথ্যার কাঁচুলি দেখেই তারা ঠাউরে
নিয়েছে সত্যের নগ্নতার সঙ্গে আমার মাঝামাখি।
আমার এই স্বীকারোক্তির পর
কেউ আর তোমাকে দেখে মুখ টিপে হাসবে না,
বিব্রত হবে না তুমি
আমার লজ্জা আর পাপ উন্মোচন করে
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি তোমাদের সবাইকে মুক্তি দিলাম।
মনগড়া ভুল স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে থেকে
চড়ায় মুখ থুবড়ে রক্ত ভেজা বুকে
কীভাবে বেঁচে থাকা যায়
ভালোবাসার চৌচির খরায়, এখন থেকে
এটাই আমার অনুশীলন।
হঠাৎ লেখার টেবিলে আমার কলম
স্যামসনের মতো পেশী ফুলিয়ে, ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে
গরগরে স্বরে করলো উচ্চারণ-
‘আমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দিয়ে
কার কার মুখ বন্ধ করতে চাও, কবি?’
আমার স্বস্তিতে ধরায় ফাটল
প্রায়শ ঘরেই থাকি, গৃহকোণে বসে বই পড়া,
কবিতা আবৃত্তি করা কিংবা লেখা, গান শোনা, কখনো জানালা
থেকে আকাশের নীল, ভাসমান মেঘ, বৃষ্টি ছপছপে পথে
কারো হেঁটে যাওয়া দেখা বড় ভালো লাগে।
আমি কারো সাতে পাঁচে নেই
ভেবে স্বস্তি পাই, কিন্তু ওরা লহমায়
আমার স্বস্তিতে
ধরায় ফাটল বারবার রাস্তায় টিয়ার গ্যাস
ছুঁড়ে, ছুড়ে বুলেটের ঝাঁক
অনিচ্ছায় শান্তিপোষ্য আমি হয়ে যাই দিশেহারা, ঘরছাড়া
এবং আমাকে ওরা ঠেলে দেয় দ্রোহী মিছিলের
উজ্জ্বল কাতারে।
এ শহরে আছে একজন অপসৃত সময়ের অপরূপ
সৌন্দর্য খচিত নারী, যার সান্নিধ্যের সুধা আজো
আমাকে মাতিয়ে রাখে, যার হাতে হাত
রেখে মনে হয় এরকম
ভঙ্গিমায় চিরকাল থাকা যায়, এমনকি ঘোর প্রলয়ের
তাণ্ডব উপেক্ষা করে! কিন্তু ওরা ধর্মঘটী ছাত্র শিক্ষকের, শ্রমিকের
মিছিলে ভীষণ মৃত্যু হানে,
এবং তখনই সুন্দরীর হাত থেকে কম্পমান বিচ্ছিন্ন আমার হাত
অকস্মাৎ তুলে নেয়
রক্তে লেখা অক্ষরে সজ্জিত এক তুমুল পতাকা।
আমিতো আমার কবিতাকে নিত্যদিন
গোলাপ বাগান করে রাখতে চেয়েছি। রাশি রাশি পরগাছা
যাতে সেই বিশুদ্ধ উদ্যানে জাঁহাবাজ
মাস্তানের মতো নষ্টামিতে মেতে না উঠতে পারে,
সেদিকে রেখেছি দৃষ্টি; কিন্তু হাজার হাজার ভারী বুটের আঘাতে
হয়েছে দলিত সে বাগান। কি আশ্চর্য, কোথাও দেখি না আর
গোলাপের চারা,
চতুর্দিকে বড় জায়মান কী ভীষণ্ণ ফনিমনসার বন!
আমি কি বলেছি
একবারও আমি কি বলেছি আসবো না আগামীতে
তোমাদের কাছে আর? উত্তোলিত হাতের মুঠোয়
লাগবে না নীলিমার ছোঁয়া?
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখে কোনোদিন
পদযাত্রা করবো না? তবে
কেন এত কানাঘুষো তোমাদের চায়ের আসরে
বস্তুত আমাকে নিয়ে? আমিতো বলিনি আসবো না,
মেলাবো না কণ্ঠ তোমাদের কণ্ঠস্বরে। তবু কেন
কথায় কথায়
কাঁটার ঝিলিক রাত্রিদিন? হায়, আমার নসিব,
এখনো ধোঁয়াচ্ছে ঘোর সংশয় নিয়ত।
এই যে আমাকে, হে বন্ধুরা, এত দিন কাছে পিঠে
দেখতে পাচ্ছো না, এর মানে এ নয় যে আমি দূরে
সরে গেছি তোমাদের কাছ
থেকে, আপাতত
গা এলিয়ে আশমানে চোখ রেখে দেখে
নিচ্ছি তারাদের মাইফেল। বহুদিন
আকাশের দিকে তাকানো
ঝিমানো ঝিলের মতো অবসর ছিল না আমার।
এই যে এখন জনসভা, হট্রগোল ছেড়ে ছুড়ে নিরালায়
গোলাপ, চামেলী, জুঁই নিয়ে, বই নিয়ে
মেতে আছি প্রায় সারাক্ষণ, তা বলে ভেবো না আমি
পলাতক। ভেবো নাপ আমার
অঙ্গীকার সরোবরে ডুবিয়ে মাছের
বুড়বুড়ি, ফাৎনার কম্পন আর পাতা ভেসে-যাওয়া
দেখে দেখে জীবন কাটিয়ে দেবো। এটা সত্য বটে,
পাখির চোখের অভ্যন্তরে
কোন্ রহস্যের খেলা চলে তার অন্বেষণে আজ দীর্ঘ বেলা বয়ে যায়।
কে আমি? কোথায় যাব? ইত্যকার প্রশ্নেরও ঠোকর
খেতে হয়, এর মানে এ নয় যে দানবের দাপটের কথা,
সংহার মূর্তির কথা ভুলে গেছি, সকল কিছুই
জ্বলন্ত লোহার সদ্য ছ্যাঁকের মতোই
দগদগে হয়ে আছে স্মৃতির কপালে।
এই যে মধুর এক মহিলার মুখ মনে করে
প্রহরে প্রহরে জ্বলি একা, তার উদ্দেশে সাজাই
অক্ষরের অর্ঘ্য রাত জেগে,
এর অর্থ যদি এ রকম প্রকৃত দাঁড়িয়ে যায়,
ভাবি না দেশের কথা, দশের দুর্দশা
বিষয়ে চরম উদাসীন আমি, তাহলে মিথ্যাকে
রাশি রাশি প্রশ্রয়ের মালা
পরিয়ে হুল্লোড় করা ছাড়া আর হবে না কিছুই।
এখন থমকে আছে সব, মনে হয়। অতিশয় ক্লান্ত আমি,
ব্যধির মুঠোয় বন্দি। জানি না কখন
আবার মুক্তির হাওয়া হাড়ে আনবে ফিরিয়ে তেজ,
অস্তিত্বে উঠবে জ্বলে বিদ্রোহী দেয়ালি
নিমেষে উপেক্ষা করে সব ভাঙচুর। শুধু জানি,
থমকে দাঁড়ানো মানে সকল সময় একেবারে
থেমে যাওয়া নয়, দেখে নিও
প্রয়োজন হলে কোনো হাঁক ডাক শোনার আগেই
আবার আসবো চলে প্রতিবাদী মিছিলে মিটিঙে।
আমিতো বলিনি আসবো না; আপাতত
স্বপ্নের চুমকিগুলি নেড়ে চেড়ে খানিক জিরিয়ে
নিতে চাই। আসবোই, ছুটে আসবোই।
শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যদিও
ঘুমিয়ে পড়েছে তবু চেতনার গভীর ভূস্তরে
একটি জাগর পাখি ক্রমাগত গান গেয়ে যায়।
আরো কিছু সময়
আরো কিছু সময় আমাকে দিলে, প্রিয়তমা, খুব
বেশি ক্ষতি হবে কি তোমার?
মালা-থেকে-খসা মুক্তো যেন
তোমার সময়,
প্রত্যহ ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। দু’চারটে
বেশি মুক্তো নির্দ্বিধায় তুলে দাও যদি
আমার ঝুলিতে, পৃথিবীর
বিখ্যাত আহ্নিকগতি থেমে যাবে, এমন তো নয়। থাক থাক
কোনো নড়বড়ে অজুহাতে অথবা যুক্তিকে ক্রাচে
দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই আর মুক্তি চাই
অনুপস্থিতির স্বৈরাচার থেকে; এসো
আমার নিকট সব তুচ্ছতার জঞ্জাল পুড়িয়ে। কেন তুমি
বুঝতে পারো না হায় প্রতীক্ষায় দিনরাত হাওয়ায় হাওয়ায়
উড়িয়ে দেয়ার মতো প্রচুর সময় নেই আমার মুঠোয়?
এই যে এখনো হাওয়া টেনে নিতে পারে ফুসফুস,
এখনো দু’চোখ
বাগান, পুকুর, পাখি, গ্রীষ্মের দুপুরে, নিরিবিলি গৃহকোণে
সুস্নিগ্ধ সুরাই কিয়দ্দূরে বিষাদের প্রতিমূর্তি একা ঘোড়া
দেখে নেয়; নিঝুম বৃষ্টির শব্দ, দোয়েলের গান
কানে আসে আজো,
এ এক পরম আশার্বাদ; কিন্তু কত অনিশ্চিত
আর ক্ষণস্থায়ী। চলে যেতে পারতাম
এই তো সেদিন দূরে, বহুদূরে, জীবনের অদৃশ্য ওপারে
পরিযায়ী পাখির ধরনে ছায়া রেখে
কারো কারো মনের দেয়ালে। যদি এক
বছর আগেও
নিতাম বিদায়, তবে হতো না তোমার সঙ্গে দেখা
কোনো কালে। এ আমার হাত, ওষ্ঠ, বুক
ঈর্ষাযোগ্য হতো না কখনো
দেবদূতের; তবু স্বস্তিহীন, শান্তিহীন দিন যায়, রাত
কাটে মনগড়া রত্নখচিত দেয়ালে
কোন্ সে দেশের বোধিদীপ্ত পাখিদের গান শুনে।
কী লাভ এভাবে বেঁচে থাকা ধুঁকে ধুঁকে,
হতাশার দিকে ঝুঁকে বুকে
নিয়ে অপ্রাপ্তির অমানিশা?
বরং এখনই এসো, প্রিয়তমা, শুষে নাও জিভে
অথবা নিঃশ্বাসে
হৃৎপিণ্ড আমার, যাতে সেখানে স্পন্দিত
না হয় কখনো আর তোমাকে পাওয়ার
দারুণ দহনময় মধ্যাহ্ন-আকাঙ্ক্ষা নিত্যদিন।
অথচ বাঁচাই কাম্য ততদিন, যতদিন তুমি
রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় হেঁটে যাও, তুলে নাও আলগোছে
নুয়ে উঠোনের গাছ থেকে ফুল, এবং তোমার
চুল ওড়ে খোলা পথে কিংবা ঘরে ফ্যানের হাওয়ায়।
এখন তো যে কোনো ছুতোয়
একরোখা কোনো চৌকিদারের ভঙিতে
মৃত্যু এসে লাঠি ঠোকে আমার চৌকাঠে,
আমার নিঃশ্বাস দ্রুত ক্রোক, করে নেবে বলে ভীষণ শাসায়
অন্তরাল থেকে, বিশেষতঃ
যখন থাকো না তুমি পাশে। বস্তুতঃ তোমার উপস্থিতি লেখে
জীবনের নাম
আমার নিঃশ্বাসে, তাই তোমাকেই চাই
চুম্বনে, নিবিড় আলিঙ্গনে আর তুমি তো জানোই, প্রিয়তমা,
আমার আয়ুর সীমা সরহদ কত সংকুচিত।
আলো অন্ধকার
বৃষ্টির সেহ্রা পরে ফ্ল্যাটবাড়িটা দাঁড়ানো
রাস্তার ধারে। তোমার ড্রইরুমে
আমরা দুজন গল্প করছি এটা সেটা নিয়ে, মাঝে মাঝে
পড়ছি কবিতা। কখনো জীবনানন্দের
দারুচিনি দ্বীপের ভেতর আমার প্রবেশ,
কখনো বা আলিঙ্গনরহিত অঙ্গে অঙ্গে
ইয়েটস-এর শাদা পাখির পাখার ঝাপট
আর সমুদ্রের ফেনা ছুঁয়ে যাওয়া। এক সময় চায়ে
চুমুক দিতে দিতে
ছন্দ বিষয়ে তোমার কৌতুহল চড় ইয়ের আঙ্গিক।
আমার কাছ থেকে তুলে নিচ্ছিলে জবাব,
যেমন পাখি ফলমূল
চঞ্চু দিয়ে। টিপয়ে শূন্য চায়ের কাপ আর
স্ন্যাকস-এর ভগ্নাংশ; তখনো
বৃষ্টির বাজনা থামে নি। সোফায়
গা এলিয়ে হঠাৎ তুমি বললে, ‘ধরা যাক তোমার
ডান হাত আমার হাতে এসে নীড় বাঁধলো
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধরনে, তখন কী করবে তুমি?’
চমকে উঠলাম। আমিতো সেই কবে থেকে
প্রবেশ করতে চাই তোমার একলা ভেতরে,
জাগিয়ে তুলতে চাই তোমার
অত্যন্ত ভেতরকার তোমাকে আর তোমার সত্তায় সরাসরি
মিশিয়ে দিতে চাই আমার সত্তা।
জীবনানন্দের কাব্যসম্ভার থেকে
চোখ তুলে তুমি তাকালে
আমার মধ্যবিত্ত সংস্কারে আরণ্যক ঝড় জাগিয়ে।
তোমার দৃষ্টি এবং হাসিতে ক্রমাগত
কাঁপতে থাকে কয়েক শতাব্দীর আলো-অন্ধকার।
একটি মুক্তো
“একটি স্বপ্নের পথে হেঁটে গিয়েছি সমুদ্রতীরে”,
বলে তুমি দিয়েছিলে স্বপ্নটির নিখুঁত বর্ণনা।
কী যে নাম সমুদ্রের ছিল না তোমার জানা, শুধু
ঝাউবীথি, গোধূলি, ক’জন ভদ্রলোক ছিল চেনা।
একটি ঝিনুক তুমি দিলে বাড়িয়ে সবার হাতে
একে একে, হতশ্রী ঝিনুকটিকে ওরা দূরে ছুঁড়ে
ফেলে দিলো অবহেলে। সযত্নে কুড়িয়ে নিয়ে তার
বুক চিরে বের করি একটি অনিন্দ্য মুক্তো শেষে।
দিনান্তে আমার করতলে মুক্তো দেখে সকলেই
বড় বেশি ঈর্ষাতুর হয়ে নাল ঠুকে বাঁকা চোখে
তাকালো আমার দিকে, তুমি আস্তে সুস্থে হেঁটে
দাঁড়াল আমার বাম পাশে। কনে-দেখা আলো চুমো
খেলো আমাদের, অকস্মাৎ তুমি হলে স্বয়ম্বরা-
মেতে থাকে পরস্পর বিবাহের অধিক বিবাহে।
কাউকে দেখতে পেলাম না
মজুরের ঘামের ফোঁটার মতো সকালবেলার আলো
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে আমার ঘরে। টেবিলে
আর কে, নারায়ণের আত্মকথা ‘আমার দিনগুলি’
যেটি গত রাতে পড়ে শেষ করেছি।
আমার কবিতা খাতা
একটি অসমাপ্ত কবিতা
বুকে ধারণ করে
প্রতীক্ষায় আছে আমার কলমের
আঁচড়ের। কবিতাটি লতিয়ে উঠেছে
তোমাকে ঘিরে। কি আশ্চর্য, আজকাল
আমার প্রায় প্রতিটি কবিতা জুড়ে
তোমারই আসা-যাওয়া।
মেঝেতে যমজ স্যান্ডেল অপেক্ষমাণ
আমার পায়ের জন্যে। জানলার লাগোয়া
নারকেল গাছে একটি কি দুটি পাখি,
মাঝে মাঝে গানে সাজায় প্রতিবেশ।
রাস্তার ওপারে হতে চলেছে একটি বাড়ির
ইট, বালি, কুপিয়ে-তোলা মাটি, লোহার শিকময়
উঠোনে কয়েকজন নারী পুরুষ, যারা
একটু পরেই পুরোদমে লেগে যাবে ইট ভাঙার কাজে।
তিনটি গাছ এখনো দাঁড়ানো সেখানে,
কে জানে কখন পড়বে মুখ থুবড়ে
বৃক্ষ ঘাতকের কুঠারের দাপটে।
কয়েকজন ছেলেমেয়ে ইউনিফর্ম পরে
রওয়ানা হয়েছে মর্নিং ইস্কুলে,
যেন ভাসমান এক বাহারি বাগান।
পাড়ার সেই মেয়েমানুষ, যার মাথায় ছিট,
গান গায়, ওর গানে নদীর ঢেউ, শূন্য নৌকা,
আর ধানের শীষের দুলুনি, কখনো কখনো
ওর সুরে সর্বস্ব-হারানো বিলাপ। গ্রীষ্মের সকালে
হাওয়া, হঠাৎ কিছু পাওয়ার খুশি চায়ের চুমুকে,
গত রাতের স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া। মনে পড়ে,
কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম, দাঁড়িয়ে আছি
সামন্ত যুগের গোধূলিকালীন এক রাজবাড়ির সিংদরজায়।
জানতাম তুমি আছো সেই বাড়ির রহস্যময়
কোনো প্রকোষ্ঠে। কণ্ঠস্বর যদ্দূর সম্ভব
উচ্চগ্রামে চড়িয়ে ডাকলাম তোমাকে,
তুমি এলে না। ভিক্ষুক এলেও তো মানুষ
একবার দরজা খুলে দ্যাখে।
স্বপ্নের ভেতরেই আমার ভীষণ মন খারাপ।
আমি কি পাগলা মেহের আলীর মতো
সেই আধভাঙা রাজবাড়ির
চারপাশে ক্রমাগত চক্কর কাটতে লাগলাম?
নাকি দীর্ঘশ্বাস হয়ে মিলিয়ে গেলাম নিশান্তের
হাওয়ায়?
সকালবেলা আমার ভারি ভালো লাগার কথা,
অথচ আমার মন আজ সীসার মতো ভারী।
এক ধরনের দার্শনিকতা আমাকে খামচে-খুমচে,
ঘাড় ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিধ্বনিময়
প্রকাণ্ড সব গুহায়। রাতের স্বপ্নটিকে
তুড়ি মেরে উড়িয়ে মনোভার কমাবার
চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।
ভাবনার হার ধরে অন্য মোড়ে
নিয়ে গেলাম ভুলিয়ে ভালিয়ে।
সেই মুহূর্তে নিজেকে ভাবতে দিলাম,
তুমি বসে আছো শুধু আমারই প্রতীক্ষায়,
কায়মনোবাক্যে আমারই কথা ভাবছো, একথা ভাবতেই
আমার সমগ্র সত্তা কদম ফুল,
ভাবতে ভালো লাগছে, তুমি আমার জন্যে
ফুঃ বলে তুচ্ছ করতে পারো যা কিছু কাঙ্ক্ষণীয়।
আর আনন্দে ডগমগ সারা ঘর।
এই বিভ্রান্ত যুগে তোমার অনুপস্থিতিকেই
উপস্থিতি বলে জেনেছি!
হঠাৎ একটা বিকট অট্রহাসিতে আমার ঘর থরথর,
যেমন ভূমিকম্পে হয়। কিন্তু সেই ঠা ঠা হাসিকে
অনুসরণ করে টাল সামলে
কাছে পিঠে কাউকে দেখতে পেলাম না।
কালেভদ্রে একটুখানি
কালেভদ্রে একটুখানি দেখার জন্যে
ঘুরে বেড়াই যত্রতত্র, দাঁড়িয়ে থাকি
পথের ধারে।
রোদের আঁচে গা পুড়ে যায়
যখন তখন,
জল-আঁচড়ে আত্মা থেকে রক্ত ঝরে;
দূর দিগন্ত আস্তেসুস্থে রক্ত চাটে।
স্কুটার থেকে নামো যখন
রোদ-ঠেকানো চশমা চোখে,
যখন তোমার শরীর জুড়ে
তাড়ার ছন্দ নেচে ওঠে,
‘ঐ যে এলো, ঐ যে এলো’ বলে ছুটি
তোমার দিকে
একটু খানি দেখার জন্যে,
কুশল বিনিময়ের জন্যে।
‘কখন এলে? নিরালা এই প্রশ্ন ঝরে,
শিউলি যেন তোমার ফুল্ল অধর থেকে।
ইচ্ছে করে বলি হেসে,
‘দিল্লীজোড়া গোধুলিতে
গালিব যখন ছিলেন বেঁচে।
কিন্তু এখন আগামী এক শতক-ছোঁয়া
হাওয়ায় কাঁপে তোমার খোলা
চুলের শিখা।
তখন ও কি সেই সময়ে থাকবো আমি?
গহন কোনো দুপুরবেলা
চোখে নিয়ে কৃষ্ণচূড়ার মোহন আভা
ব্যাকুল ছুটে আসবো আবার তোমার কাছে?
যখন তুমি ধূসর দূরে বসে থাকো,
হিস্পানী এক গিটার বাজে
করুণ সুরে মনের ভেতর,
যখন তোমার হৃৎকমলে চুপিসারে
ভ্রমর কালো ছায়া ফেলে,
পানিমগ্ন শিলার মতো
অবচেতন নড়ে ওঠে ঠারে ঠোরে,
আমার বুকে ধাক্কা লাগে, দদ্মবেশী
আদিবাসী বিস্ফোরিত আর্তনাদে।
যখন তোমার আঁটো স্তনে
জ্যোৎস্না কোমল শুয়ে থাকে,
রহস্যময় একলা গাছে নিভৃতে ফল
পাকতে থাকে।
যখন তোমার গালে জমে রাতের শিশির,
কবন্ধ পাঁচ অশ্বারোহী ছুটে বেড়ায় তেপান্তরে।
আলতো তোমার হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে
হঠাৎ রোদের ঝলক-লাগা
ঝর্ণাধারার মতো তোমার
গলার আওয়াজ শোনার জন্যে,
খুচরো কিছু চুমোর জন্যে,
দুটি বাহুর বন্দরে ঠাঁই পাওয়ার জন্যে,
কালেভদ্রে একটুখানি দেখার জন্যে
আর কতকাল ভিক্ষু হয়ে
পুড়বো রোদে?
ভিজবো একা জল-বাজানো পথের মোড়ে?
কেন তোমাকে ভালোবাসি?
দৈবাৎ এক রাতে ভুলক্রমে তোমার সঙ্গে আমার
অদৃশ্য যোগাযোগ। এমনই আকস্মিক
সেই ঘটনা, আজো কেমন ধন্দ লাগে। বস্তুত
মধুর এক ধাক্কা খেয়ে পথচলা
মেঘের আলপথে।
একটি ভুলের কুঁড়ি বিকাশের বাঁশির তানে
চমৎকার এক ফুল হয়ে
দুলে উঠবে সত্যের মুখোমুখি, কে জানতো?
কে তুমি? কী তোমার প্রকৃত নাম ধাম, বয়সই বা কতো?
কাদের ঘরের বউ? না-কি অনূঢ়া? তোমাকে দেখতে
কী রকম, কিছুই জানতে পারি নি।
কথা হয়েছিল সামান্যই, খুচরা পয়সার মতো।
আমাদের সংক্ষিপ্ত, আবছা কথোপকথনের বিষয় ছিল
কবিতা, সেই মোহন অমৃত-গরল যা হামেশা
খলখলিয়ে ওঠে আমার রক্তের ভেতরে।
ফলে, মারাত্মক অসুখেও
হাসপাতালের বেডে অপ্রতিরোধ্য
শব্দগুচ্ছ দ্রাক্ষাপুঞ্জের মতো
ঝুলে থাকে সিলিন্ডারে।
স্যালাইনের বদলে
আকণ্ঠ পান করি প্রহরে-প্রহরে
প্রাণ নিঙড়ানো শব্দরস।
প্রথমবারের মতো আমাদের দেখা হলো
প্রতিশ্রুত রেস্তোরাঁয়; তখনো শুধু তোমার কণ্ঠস্বর
ছাড়া আর কিছুই পরিচিত নয় আমার। তোমার
চমক-লাগানো উপস্থিতি আমাকে নিয়ে গেল
সেই উপত্যকায়, যেখানে ভাসমান মেঘের মতো
মেষপাল চরে বেড়ায়, গাছের ছায়ায় নিরিবিলি
শুয়ে থাকে নিতম্বিনী গয়লানী, সুকান্ত মেষপালক তার
বাঁশিতে তোলে বঞ্চনা ও ছলনা-ভোলানো তান,
শিশুরা জড়ো হয় চারপাশে,
অশ্বশাবক ছুটে বেড়ায় ইতস্তত,
হাওয়ায় দোলে
গুচ্ছ গুচ্ছ আপেল, গমের শীষ।
তোমার বিষয়ে কিছু না জেনেই যাকে বলে
প্রথম দৃষ্টিতে প্রেমে-পড়া, সেই আশ্চর্য
ঘটে গেল আমার অজান্তেই। তোমার সুন্দর
চকচকে দু’টি চোখ আমার ভাবান্তরের প্রতি
সমর্থন জোগালো খঞ্জনা হয়ে। নীলিমায় আমার ওড়া-উড়ি।
সেই মুহূর্তেই আমার স্বপ্নিল আকাঙ্ক্ষাগুলি
জড়িয়ে গেল তোমার সিল্কমসৃণ চুলে,
তোমার চোখের উজ্জ্বলতায়
পরিশুদ্ধ হলো আমার বিবর্ণ ব্যর্থতা,
সাফল্যকে কলাপ
মেলতে দেখলাম তোমার
হাতের নড়ায়। সময় বেশি না গড়াতেই
যে কথা বলতে চেয়েছি এবং চাইনি,
কখন যে হঠাৎ বলা হয়ে গেল
তোমার কানে কানে,
অথবা যা’ অব্যক্ত থেকে যাবে আমৃত্যু। এবং
আমার স্পর্শের স্মৃতি তুমি সানন্দে
সঞ্চয় করেছো, মেঘ যেমন বিদ্যুল্লতা।
তোমার আমার মধ্যে যখন তৈরি হলো পরিচয়ের
সেই বাগান, যেখানে দাঁড়ালে মনে হয়
মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই
বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না আমাদের, এখনই
ঝাঁকুনি খেয়ে বুঝলাম, বাগান তছনছ করার
আয়োজনকে মুকুট পরানোর বিষয়ী লোকজনের
কমতি নেই। কিন্তু তোমার এতো কাছাকাছি
এসে গেছি, যে আমারও তো উপায় নেই
ফেরার। আর ওরা কি জানে না আমি
সেই পাখির মতো যে উজাড় বাগানকেও
নিজের অবলম্বন বলে গ্রহণে সক্ষম,
যার ঠোঁটে রাংঝাল চাপিয়ে দিলেও
থামে না গান, যার বাসনার ডালগুলো
মুচড়ে দিলেও সেখানে ফুলের উৎসব দিনভর রাতভর।
অবিশ্যি সুন্দরী তুমি, কেবল আমার চোখেই নয়,
সবার কাছ থেকেই তোমার সুন্দর্য উঁচুদরের
নর্তকীর নাচের মতো
কিংবা সঙ্গীতসিদ্ধ গুণীর তানের মতো
আদায় করে নেবে স্তুতির স্তবক।
অথচ এ-ও তো সত্য তোমার মতো অথবা
তোমার চেয়েও অধিক সুন্দরী আছেন
এই শহরেই। আমি কি তোমার
রূপের সরোবরে ডুব দিয়েই
একে ভালোবাসা বলে শনাক্ত করেছি?
তোমার মদির চোখ, গোধূলি-রঙিন গ্রীবা,
জীবন স্পন্দিত টসটসে ঠোঁট অর্থাৎ
তোমার সৌন্দর্যে সচকিত হয়েও
শুধু সেজন্যেই আমার অনুরাগের আংটি
পরিয়ে দিই নি তোমার আঙুলে।
তোমার হাসি, যা হতাশাকে করে তোলে দীপান্বিতা,
আমাকে নিয়ে গ্যাছে সেই ঘাটে,
যেখানে ফোটে মনোজ কহলার।
না, কেবলমাত্র সেজন্যেও
ভালোবাসি না তোমাকে।
কেন তোমাকে ভালোবাসি, এ প্রশ্নের
মিলবে না কোনো সদুত্তর। একটা ঝাপ্সা জবাব
ত্বরিত-গতি তলোয়ার মাছের ধরনে
আমার আশেপাশে সাঁতার কাটে, কিন্তু আমার
করায়ত্ত নয় এমন কোনো জাল যা দিয়ে
আটকে ফেলা যায় তাকে।
ততোদিন তাকিয়ে থাকতে হবে
ওর আসা-যাওয়ার দিকে,
যতোদিন না মৃত্যু এসে
বুজিয়ে দেয় আমার দু’চোখ!
কেবল মৃত্যুই পারে
এ-কথা নিশ্চয় তুমি কখনো ভুলেও বলবে না-
‘ভালোবাসতেই হবে, এই মুচলেকা লিখে দাও,
বলে আমি ভন্ ভন্ করেছি তোমার চারপাশে
নিরালায় বরং দিয়েছি স্বাধিকার তোমাকেই
আমাকে গ্রহণ কিংবা বর্জনের। যদি কোনোদিন
ইচ্ছে হয়, চলে যেও; কখনো কোরো না বিবেচনা
পরিণামে কী হবে আমার। চন্দনার ঠোঁটে পেলে
তোমার খবর, কবরের মাটি স্বেচ্ছায় ছোঁবো না।
আমার গায়ের তাপ যদি হয় এক শো পাঁচের
কিছু বেশি, তবু মূর্চ্ছা যাবো না, ঘুরবো স্বাভাবিক।
ট্রেনের টিকিট কেটে অন্য কোনোখানে পাড়ি দেয়া
যাক ভেবে খুব তাড়াহুড়ো করে হোল্ডল বাঁধি না।
আমাকে একলা ফেলে চলে গেলে আমি মরে টরে
যাবো না, স্বীকার করি। অন্তত তোমার কাছ থেকে
মিথ্যা বচনের সহযোগিতায় করুণার কণা
কুড়ানোর বিন্দুমাত্র সাধ নেই। নিন্দুকের দল
যা ইচ্ছে রটাক, তুমি বিব্রত হয়ো না এতটুকু।
মানুষ তাকেই ভালোবাসে যাকে ত্যাগ করে যেতে
পারে মূক যন্ত্রণায়। ভেবে নিও, আমার এ ক্ষীণ
পদচিহ্ন যা ছিল তোমার অনুগামী, ঘাসে ঢাকা
পড়ে গ্যাছে; আমার সম্মুখ হতে অপসৃত হলে
তুমি, ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলবে সকল কিছু,
এমন জপালে পাখি কান দিও না কস্মিনকালে।
কেবল মৃত্যুই পারে মেয়ে তোমাকে ভুলিয়ে দিতে।
তাঁর পেছনে
নানা জনের নানা কথা,
কেউ কারো কথা শুনছে বলে
মনে হলো না। শুধু একটা কলরব
সারা ঘর জুড়ে। বহু কণ্ঠস্বরের
মধ্যে আমার গলার আওয়াজ
সাঁঝ বেলার আলোর মতো আবছা।
আমি থমকে দাঁড়ানো, জখমি, তেজী
ঘোড়ার মতো আন্দোলন বিষয়ে
কিছু বলতে চাইলাম। নামী দামী
নেতারা মুখে ঐক্যের বুলি নিয়ে
অনৈক্যের বহু মুণ্ডু-অলা ষাঁড়টিকে
ছেড়ে দিয়েছেন ময়দানে; এই সুযোগ যিনি
এদেশের হর্তা কর্তা বিধাতা,
তিনি গণতন্ত্রকে দিব্যি
ঘোল খাইয়ে ছাড়ছেন। নিজে
তিনি সাচ্চা ধার্মিক কিনা তা শুধু
আলেমুল গায়েবই বলতে পারেন,
তবে নিজের তখতটিকে সামলে সুমলে,
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমের তাগিদে
ধর্মের কল নাড়াতে চাইছেন
জোরেশোরে। কিন্তু তার কি জানা নেই
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে?
এসব কথা বলতে চাইছিলাম উচ্চকণ্ঠে,
কিন্তু আমার গলা থেকে কোনো আওয়াজ
বেরুচ্ছিল না। ক্লান্ত হয়ে জনশূন্য ঘরে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেবিলে মাথা রেখে;
হতাশার কুয়াশা
আমাকে জড়িয়ে রেখেছে।
হঠাৎ চমকে উঠে দেখি, কে যেন
হাত রেখেছে আমার কাঁধে।
তাকে কখনো দেখেছি বলে
মনে হলো না, অথচ অনেক চেনা সেই মুখ।
তাঁর হাতে জ্বলজ্বলে একটি পতাকা,রক্তের মতো লাল!
জোরালো কণ্ঠে বললেন তিনি-,
তোমরা এভাবে অরণ্যে রোদন করবে,
একে অন্যের কুশ পুত্তলিকা পোড়াবে,
হতাশার আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণে
বুঁদ হয়ে থাকবে পরাজয়ের নেশায়,
এ জন্যেই কি রাজবন্দিরা বছরের পর বছর
জীবন ক্ষইয়ে দিচ্ছেন জেলে?
এ জন্যেই কি আমরা বুকের রক্ত দিয়ে
স্বদেশের ধুলোমাখা পা
ধুয়েছি বার বার?
এ জন্যেই কি সেজে গুজে নওশা হবার বয়সে
আমরা বরণ করেছি শাহাদত?
কেন তুমি এমন নীরব, নিঝুম হয়ে আছো?
আমার কণ্ঠস্বর কোথাও পৌছয় না,
আমি বললাম তাঁর চোখে চোখ রেখে।
‘এ নিয়ে ভাবনা করো না,
বজ্র বয়ে বেড়াবে তোমার কণ্ঠস্বর,
আর সেই আওয়াজ পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে।
কানে আসে তাঁর গমগমে উত্তর।
তারপর সেই শহীদ মাথা উঁচিয়ে
হাওয়ায় নিশান উড়িয়ে
জোর কদমে চললেন এগিয়ে।
আমি তাঁকে অনুসরণ করবো কি করবো না
ভাবছি এবং চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই দেখি
তাঁর পেছনে
গনগনে এক জনসমুদ্র।
তাদের কথা
বনেদি ঘরের কেউ নই, বলা যায়
অত্যন্ত অগণ্য আমি। গোলাপ, রজনীগন্ধা অথবা চামেলি
কারো সমতুল্য নই, থাকে না আমার প্রতীক্ষায়
কখনো ড্রইংরুমে কোনো ফুলদানি
পায়ের নিচেই থাকি সবার এবং
পিঁপড়ে, পোকামাকড়েরা মাঝে মাঝে
করে খুনসুটি।
যখন যুবক যুবতীরা,
যাদের সত্তায়, প্রেম রঙধনু হয়ে
জ্বলে, যারা ঘাসের ওপর বসে, কথা
ফুরুলে তাকায় এ আমার একরত্তি
অস্তিত্বের দিকে; বুঝতেই পারো সামান্য ঘাসের
ফুল ছাড়া অন্য কিছু নই।
অথচ তোমরা আমাকেও নিশ্চিহ্ন করার প্রায়
সব আয়োজন শেষ করে
এনেছো বস্তুত।
খুব হালকা উড়ে উড়ে রঙের বাহার আর খুশি
ছড়িয়ে বেড়াই সবখানে।
এ আমার খেলা; যদি বলো
বাঁচার আনন্দ, মেনে নেবো তর্কহীন।
আমাকে ধরার জন্যে খুকুমণিদের
দল আর কখনো কখনো
খেয়ালী বয়স্ক মজাদার কেউ কেউ
নাওয়া খাওয়া ছেড়ে
আমার পেছনে ছোটে। আমি যে রঙিন প্রজাপতি
এ কথা নিশ্চয়
না বললেও চলে; জানি, ঘর,
বারান্দা, বাগান, ঝোপঝাড় আর মাঠ থেকে দ্রুত
আমার সকল রঙ মুছে ফেলবার
সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে
ফেলেছো তোমার দেশ-দেশান্তরে ধীমান বন্ধুরা!
আমি কারো সাতে পাঁচে নেই, তর তর
গাছ বেয়ে উঠি,
নেমে আসি ঘাসে বার বার, কখনো বা দালানের
ছাদে যাই, রোদ শুকি, ছায়া পান করি আর এদিক ওদিক
চোখ রেখে ছোটাছুটি করার খেলায়
মেতে থাকি। যতদূর জানি,
একবার এক দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ কবি আমার মাথাটা
চুলকিয়ে দেয়ার বাসনা
প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ছোট অসামান্য কবিতায়।
তোমরা আমাকে, এই কাঠবিড়ালিকে,
পৃথিবীর ঘ্রাণময় গাছের কোটর, রৌদ্রছায়া
থেকে মহরুম করবার বলিহারি
নেশায় মেতেছো।
এই যে আমাকে দ্যাখো, নদী
নালায় সাঁতার কাটি, সর্বদা চাঞ্চল্যে ভরপুর,
কখনো কখনো মাছরাঙা
ছোঁ মেরে, ওপরে তুলে নিয়ে পরিপাটি
ভোজ সেরে নিতে চায়। প্রায় প্রত্যহই
জেলে জাল ফেলে
জীবিকার টানে, তোলে যতক্ষণ পারা
যায়, আমরাও বেঁচে থাকবার সাধ
নিয়ে করি বসবাস জলজ পুরীতে। আমাদের
সহজে সবংশে ধ্বংস করবার জন্যে লেগে গ্যাছো
আদাজল খেয়ে; ভাবি, পাবে কি নিস্তার
পদ্মা আর মেঘনার, তিস্তার, মিসিসিপি, গঙ্গা,
হোয়াংহো ভলগার মৎস্যকুল?
ভোরবেলা আমার গানের সুরে ঘুম
ভাঙে তোমাদের,
আমার রঙিন পাখা থেকে ঝরে কত
স্বপ্নের মুকুল অবলীলাক্রমে, আমি
এবং আমার ঝাঁক ঝাঁক সঙ্গী মধুর সঙ্গীতে
ফাল্গুনকে ডেকে আনি, আশপাশ মুড়ে দিই, পুষ্পল সজ্জায়,
অথচ তোমরা আমাদের লুপ্ত করে
বিষাক্ত রাসায়নিক পদ্ধতির নিপুণ প্রয়োগে
বসন্তকে নিস্তব্ধ করার
নাছোড় চক্রান্তে নিয়োজিত।
(সকলে মিলে) ঘাসফুল, প্রজাপতি, মাছ,
পাখি কি কাঠবিড়ালি, যাকে ইচ্ছে বিলুপ্তির দিকে
ঠেলে দাও; কোনো খেদ নেই।
এ এক ভীষণ পরিহাস,
স্বয়ং তোমরা নিজেরাই নিজেদের
নির্মুল করার কী ব্যাপক খর প্রতিযোগিতায়
লিপ্ত ইদানীং।
তোমার চিঠির একটি বাক্য
আখেরে দক্ষিণ বাংলার সুদূর গ্রাম থেকে
এল সেই চিঠি, যার জন্যে প্রতিদিন
ডাকবাক্স খুলেছি দু’ বেলা
বালকের পাখির বাসা হাতড়ানো অধীরতায়।
চিঠিটা অনেক আগেই
পৌছুনোর কথা, অথচ এল
অনেকদিন পরে,
যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী
পাড়ি দিয়ে এসেছে। চিঠিটাকে
লুকিয়ে চুমু খেলাম
বার বার, বলা যায়,
মহাসমারোহে।
সেই চিঠিতে তোমার কার্পণ্যের কাঁটাগুলো
আমাকে খোঁচালো অনেকক্ষণ।
আনন্দে লাফিয়ে উঠবো নাকি
ব্যথিত মুখে বসে থাকবো,
মনস্থির করা গেল না কিছুতেই।
আমার জখমি হৃদয় লাগাবার মতো মলম
কোথাও নেই ভেবে
নিশ্চুপ বসে থাকলাম।
তোমাকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয়,
লিখেছো তুমি।
কীসের ভয়? কেন ভয়? তার
কোনো উল্লেখ কিংবা ইঙ্গিত ছিল না কোথাও।
বাক্যটি নেড়ে চেড়ে দেখার সময়
দৃষ্টি পথে ঝিকিয়ে ওঠে আমার অতীত এবং বর্তমান।
মনে পড়লো আম্র মেহমান নেওয়াজ
মরহুম আব্বার কথা।
আমাকে তিনি তাঁর দরাজ সরাইখানার
একজন অতিথি
বলেই ভাবতেন।
আমাদের পুরানো বাসায় কখন আসি আর
কখনই বা বেরিয়ে যাই,
তিনি ঠাত্তর করতে পারতেন না
সহজে। আমাকে ঘিরে তাঁর
স্বপ্নগুলো ক্রমাগত গুঁড়িয়ে
যাচ্ছিল বলে আমাকে নিয়ে
ভারি ভয় ছিল আব্বার।
ছোটবেলায় আমি যখন ছটি ঘরে,
তখন আমার একটা মারাত্মক অসুখ
হয়েছিল; বাঁচার আশা ছিল না এতটুকু,
সেই তখন থেকেই
আমাকে নিয়ে আম্মা যে ভয়
পেয়েছিলেন, এখনো, এত বছর পরেও তা কাটেনি।
আমার গৃহিণীরও আমাকে নিয়ে বড় ভয়।
পাখিও বাসা বানায়,
অথচ আমাকে দিয়ে এখনো তা হয়নি।
যার মন এমন উডু উডু, যে চাকরির পোক্ত তরী
কুলে ভেড়ার আগেই স্বেচ্ছায় তড়িঘড়ি ডুবিয়ে দেয়,
তার বিষয়ে ভয় কখনো যায় না অস্তাচলে।
আমার যাঁরা শুভাথী, তাঁরা
আজকের আমার শরীর সম্পর্কে সারাক্ষণ
ভয়ে ভয়ে থাকেন,
পাছে হঠাৎ একদিন সটান
তাঁদের কাঁধে চড়ে
পৌঁছে যাই গোরস্তানে।
যেসব কবি ঈর্ষা করেন আমাকে,
তাঁদেরও ভারি ভয় আমাকে নিয়ে,
পাছে তাদের খ্যাতির টগবগে ঘোড়াকে
ডিঙিয়ে আমাকে উড়িয়ে
নিয়ে যান বহুদূরে যশের ফেরেশ্তা।
শক্রপক্ষ খামখাই আমার ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে
আমাকে ধরাশায়ী করার বড়াইয়ে ফেটে পড়েন।
এবং আমাকে নিয়ে স্বৈরাচারী সরকারেরও বড় ভয়।
কখন আমার কলম বেমক্কা উগরে দেয়
ওদের ভিতটলানো পংক্তিমালা,
ওরা তা নিয়ে ধন্দে থাকে দিনভর, রাতভর!
তোমার জন্মদিন
মোরগের গর্বিত ঝুঁটি, স্বপ্নে-দেখা
রক্তিম ফুলের উন্মীলন, অন্ধকার ঠেলে
ঘোষণা করে, আজ তোমার জন্মদিন।
আমার হৃদয়ের রোদের ঝলক
পবিত্র, ভাস্বর আয়াতের ছন্দে জানায়,
আজ তোমার জন্মদিন।
জানলার পাশে দাঁড়ানো
গাছের ডালে বসে-থাকা পাখির শিস
স্তব্ধতাকে চমকিয়ে শোনালো,
আজ তোমার জন্মদিন।
ঘরে হঠাৎ ঢুকে-পড়া ভ্রমর গুন্গুনিয়ে
বলে গেল আজ তার জন্মদিন,
যার চোখে চোখ রাখলে মনে হয়-
পৃথিবীতে নেমে এসেছে স্বর্গসিঁড়ি।
আজ নার্সের অ্যাপ্রনের মতো সারসের শরীর
আরো বেশি শাদা আজ উজ্জ্বল,
সূর্যের আবীর আরো বেশি রঙিন হয়ে
প্রতিবিম্বিত দিনের গালে, নদী আরো বেশি নদী;
আজ ফুলের স্তবকগুলো আনন্দের, রবীন্দ্রনাথের গান
অধিক রাবিন্দ্রিক এবং
আকাশের অধিক দূরের আকাশ।
আয়ুষ্মতী শব্দটি প্রকৃতির কণ্ঠে
উদারা মুদারায় বাজতে থাকে অষ্টপ্রহর।
তোমার জন্মদিন দেখছে, আমি সেই কবে থেকে
টেবিলে ঝুঁকে উদ্যমকে ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোয়
রূপান্তরিত করে একটি কবিতা লিখছি,
যার পর্বে পর্বে তোমার সুগন্ধি নিঃশ্বাস,
স্তনের ওঠা-নামা আর চুলের ছায়া।
আমার অসমাপ্ত কবিতাকে
দুরন্ত হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে
দূরের ফ্ল্যাটে গিয়ে চুপিসারে
গুঁজে দিতে চায় তোমার ব্লাউজের ভেতর।
তোমার জন্মদিন আমার চুলে
আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে সকালবেলা,
পায়ের কাছে জাগিয়ে তুলছে একটি ঝর্ণা।
আজ তোমার জন্মদিন। কী উপহার
কিনবো তোমার জন্যে? শাড়ি-টাড়ি? না কি
ফুলের তোড়া? অথচ এই সবকিছুই বড় মামুলি।
কী সেই উপহার, যার তুলনায় হীরের নেকলেসও
অতিশয় তুচ্ছ? হৃদয়,
যা আমি আগেই অর্পণ করেছি তোমাকে
কোনো এক দুপুরে অতীত বর্তমান মুছে-দেয়া বিহ্বলতায়।
তবু আর কিছু নয়, কেবল এই ধুক পুক করা
বুক নিয়ে দাঁড়াতে চাই
তোমার সামনে। আমাদের সম্পর্কের ওপর
ফুল ঝরুক, ঝরুক স্বর্গশিশির।
তোমার জন্মদিন সবার অগোচরে কী উন্মুখ
চুমো খাচ্ছে আমাকে তোমার মতোই।
দেখা যায় কিনা
কী যে হয়েছে তাঁর, ইদানীং কোনো কিছুই
তেমন স্পষ্ট দেখতে পান না, না হাতের কাছের
চায়ের পেয়ালা, না দূরের গাছপালা। অনেকটা
আন্দাজে ঠাওর করে নেন। হাসপাতালে যাই যাই
করেও যাওয়া হলো না আজ অব্দি।
রোয়াকে বসে থাকেন, যতক্ষণ না উড়ে যাওয়া ঝাঁক ঝাঁক
পাখির পাখায় লাগে সাঁঝবেলার
আগেকার আবীর সেই রঙ দেখে তাঁর মনে পড়ে
বাসর ঘর, একটা লাজরাঙা টুকটুকে মুখ,
উপ্টান আর মেহেদীর ঘ্রাণ।
তিন কূলে কেউ নেই তাঁর। অথচ একদা ছিল
অনেকেই। তিনি তিল কুড়িয়ে তাল
করতে গাধার খাটুনি খেটেও সংসারের চেহারা
তেমন পাল্টাতে পারেন নি। বরং হারিয়েছেন
গৃহিনীকে; বড় ছেলেটা বায়ান্নোয়
বাংলা হরফের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে নিজে বাঁচে নি।
মেজো ছেলে উণসত্তরে রাজপথে
জনতরঙ্গের সঙ্গে হলো একাকার। ছেলের লাশ
ফেরত পান নি পিতা। বাকী তিন ছেলের দিকে
তাকিয়ে টেনে ধরেন শোকের লাগাম।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঘরের মায়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো তাঁর
দুই ছেলে। বিজয় ছিনিয়ে অনেকেই আপন ঘরে
এল ফিরে, কিন্তু তার দুই ছেলে
কখনো ফিরে আসে নি। তাঁর শুকনো চোখে
পাথরের আদল,
তিনি এখন প্রায় টেরাকোটার মূর্তি!
মেজাজে তিনি হরতালী নন, তবে মনেপ্রাণে চান
যারা হরতাল করে তাদের ঘরে যেন জ্বলে আনন্দের বাতি।
সাতাশিতে তাঁর বয়স দাঁড়ালো দুই কম চার কুড়ি।
কনিষ্ঠ ছেলেটাকে আগলে রাখেন
সারাক্ষণ, রাখেন চোখে চোখে। জানেন, গণআন্দোলনের
আওয়াজ কী দুর্বার আকর্ষণ করে
তাঁর পুত্রদের, যেমন সাতসমুদ্র তের নদীর ঢেউ
নাবিককে। থাকুক, অন্তত কনিষ্ঠ পুত্র তাঁর থাকুক,
মনে মনে জপেন তিনি। কিন্তু ঘর আর পিতার বুক
অন্ধকার করে চৌদিক ঝলসে-দেয়া প্রায়-অপার্থিব
আলোর সংকেতে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র
ছুটে যায় মিছিলে। ফিরে এসে জনকের বুক
শবেবরাতে দীপাবলী দিয়ে সাজায় না।
এবার তিনি আদিম মানুষের মতো
ডুকরে ওঠেন। তাঁর সত্তা-চেরা আর্তনাদে
বাংলাদেশের নিসর্গ নিঃঝুম কান্নায় কম্পমান।
অস্তিত্বের সমস্ত কান্না সেচে ফেলে
তিনি বসে থাকেন রোয়াকে, এখন তিনি ডাঙায়
তুলে-রাখা নৌকো। তাঁর চোখ থেকে
রোশনি ক্রমাগত বিদায় নিচ্ছে, তবু কপালে হাত ঠেকিয়ে
দেখতে চাইছেন তাঁর তেজী ছেলেরা
যে সমাজবদলের কথা বলতো দীপ্র কণ্ঠস্বরে
তার চিহ্ন আজ খুব আব্ছা হলেও
কোথাও দেখা যায় কিনা।
দ্রুত মুছে দেবো
সদ্য সন্ধ্যা সাঁঝের সজ্জা ছেড়ে
শরীরে জড়ালো রাতের রেশমি শাড়ি।
এক লহমায় আমাকে অবাক করে
অপরূপ শোভা পেয়ে যায় ফ্ল্যাটবাড়ি।
কলিংবেলের ডাকে সাড়া দিয়ে দেখি,
দাঁড়িয়ে রয়েছো দরজার পাশে একা।
ভুলেও ভাবিনি হবে আচানক রাতে
আজকেই ফের তোমার সঙ্গে দেখা।
খোদার রহম, প্রসন্ন ভাগ্যতারা,
কোথায় বসাবো কিছুতে পাই না ভেবে।
এদিক ওদিক চেয়ে থাকি অসহায়,
জানি ক্রটি হলে তুমি ক্ষমা করে দেবে।
বাসন্তী রঙ তোমার শরীর জুড়ে
মেতেছে দৃষ্টি-জুড়ানো খেলায় আজ।
হৃদয়ে আমার সাত সাগরের দোলা,
কী ফুল ফোটায় সত্তায় ঋতুরাজ।
ইলেকট্রিকের আলোয় কর্ণমূলে
লাজুক হাসিতে কাঁপলো স্বর্ণদুল।
আমি নিশ্চুপ; তুমিও অথৈবচ;
কানে ফুটে আছে স্বর্গীয় দু’টি ফুল।
চলেছি দু’জন রিকশায় শিশুরাতে,
সামনে ছড়ানো তোমার ফেরার পথ।
হঠাৎ কোথায় উধাও একটু দুল?
বল্লে, ‘চুমোর অপূর্ব খেসারত।
আমাকে খোঁচায় অস্বস্তির কাঁটা,
নিজেকে কেবলি মনে হয় অপরাধী।
খুঁজে পেলে দুল নিজেরই শাড়ির ভাঁজে,
আমি মনে মনে স্বস্তির সুর সাধি।
‘কী সুখ পাচ্ছো আমাকে মথিত করে?
কী হবে এমন যাত্রার পরিণতি?
আখেরে কীভাবে চিহ্নিত হবো আমি?
তোমার প্রশ্নে থামে প্রমোদের গতি!
কম্পাসহীন নাবিকের মতো ভাসি;
ঝড়ে ভেঙে গেলে সুদৃশ্য মাস্তুল,
স্রোতে হাবুডুবু খেয়ে বলবো না, ‘হায়,
আমাদের প্রেমে ছিল ভয়ানক ভুল।
বাসুকির মতো ফণা তুলে ঢেউগুলি
করুক আঘাত, পাবো না কখনো ভয়।
তোমার এ-হাত লগ্ন থাকলে হাতে
কোনো সংঘাতে মানবো না পরাজয়।
দুঃসময়ের কৃষ্ণপক্ষে আছি;
বিশ্বব্যাপ্ত ধ্বংসের ঝাঁপতালে-
যখন অনেকে আত্মবিনাশে মাতে,
আমরা দোহার সাজবো না কোনোকালে।
পৃথিবীর সব বৃক্ষ আজকে যদি
বজ্রদগ্ধ হয় হোক প্রিয়তমা,
আমরা ছড়িয়ে প্রেমের পুষ্পরেণু
দ্রুত মুছে দেবো অকল্যাণের অমা।
নাম ধরে ডেকে যাবো
একবার বাগে পেলে আমাকে মাটিতে ফেলে যারা
আদিম হিংস্রতা নিয়ে খোঁচাবে বল্লমে, নিষ্ঠীবন
ছিটোবে বিস্তর মুখে এবং চুলের মুঠি ধরে
হিড় হিড় টেনে নিয়ে যাবে গোরস্তানে কিংবা হৈ হৈ
নাচবে আমাকে ঘিরে, কী অবাক কাণ্ড, তুমি আজ
তাদেরই শিবিরে মক্ষিরাণী হয়ে আছো সগৌরবে।
দৈবক্রমে দেখা হলো আমাদের বিপন্ন বেলায়,
সবকিছু জেনে শুনে একটি গোলাপ, হৃদয়ের
রক্তসেচে ফুটে-ওঠা, দিলাম তোমার করতলে
নির্দ্বিধায়। তুমিও আমার চোখে চোখ রেখে কী-যে
আবৃত্তি করলে হে মধুরতমা টীকাভাষ্যহীন,
ফুটলো অপূর্ব মুদ্রা অন্তরঙ্গ আঙ্গিকে নীরবে।
কথা বলি পরস্পর, মাঝে মাঝে নেপথ্যে ভ্রমণ
অবেলায়, হাতে তুলে নিই হাত, তোমার ঠোঁটের
কোমলতা পাইটের কখনো হঠাৎ আলগোছে।
আমাদের কোথায় যে নিয়ে যাবে শেষ তক এই
চোরা টান; আপাতত বুঝি না কিছুই শুধু চেয়ে
থাকি সারাক্ষণ মুগ্ধাবেশে তোমার মুখের দিকে।
এরকম তাকিও না, বলে তুমি কপট শাসনে
জ্বলে ওঠো একরাশ নক্ষত্রের মতো, পরে ফের
আমার পাঁজর ঘেঁষে চলে এসে নিমেষে বুঝিয়ে
দাও কাকে বলে ভালোবাসা। তোমার ত্বকের মৃদু
উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায় কী মদির।
নীরবতা গান হয়ে ওঠে, অপরূপ উন্মীলন।
তুমিতো দুপুরে আছো, গোধূলিতে আমি। কখন যে
সত্তা চিরে বেজে ওঠে মরাল সঙ্গীত, জানা নেই।
আমরা দু’জন অসহায় চলেছি বিরূপ স্রোতে
ভেসে, তীর খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত চোখ, তবু আশা রাখি
অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও হয়তো উদ্ধারের রূপে
উঠবে জেগে অকপটে দুর্নিবার তোমার পূর্ণিমা
এভাবে কি যাবে দিন চিরদিন? ভয়ে ভয়ে থাকি,
স্থানাভাবে পথে পথে ঘুরি চুপিসারে, মাঝে মাঝে
সব কিছু তাচ্ছিল্যের ফুঁয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে চলি
হাত ধরে এ শহরে। কখনো কখনো ভাবি, তুমি
আমাকে নিভিয়ে কোনোদিন হঠাৎ যাবে কি চলে
উজাড় বাগান ছেড়ে হে আমার সর্বশেষ ফুল?
যদি যাও, কেয়ামত হয়ে যাবে। পারমাণবিক
ভস্মস্তূপে নিমজ্জিত আমি চাইবো চিৎকারে সাড়া
জাগাতে, অথচ সেই আর্তনাদ শোনার মতন
কেউ বেঁচে থাকবে না আর। হাশরের ময়দানে
কেউ কারো ফরিয়াদ শুনতে চায় না, তবু জেনো
খুঁজবো তোমাকে, নাম ধরে ডেকে যাবো নিরন্তর।
নিভিয়ে এক ফুঁয়ে
আকাশ যেন আজ ঠান্ডা ভারী কাঁথা,
ময়লা ফুটো দিয়ে মারছে উঁকি তারা;
পায় না মনে ঠাঁই ঘরে ফেরার টান,
কলিংবেল দিলো ঝাঁকুনি সন্ধ্যাকে।
পাশের ঘরে এই কবিকে তাড়াতাড়ি
লুকিয়ে রেখে তুমি বিদায় চেয়ে নিলে।
তোমার ব্যবহারে কেমন মায়া ছিলো,
নিষ্ঠুরতা বলে তাকে পারিনি ধরে নিতে।
বুকের ঝাড়বাতি নিভিয়ে এক ফুয়ে
আমাকে ফেলে তুমি ক্ষিপ্র চলে গেলে।
আমার স্বপ্নের পাপড়ি সমুদয়
ছিড়েছো কুটি কুটি, হুতুশে তাই মন।
অথচ কিছু আগে দুজনে হাতে হাত
রেখেছি অনুরাগে, ওষ্ঠে নিয়ে ঠোঁট
ভুলেছি লহমায় জগৎ সংসার।
কার সে ঝট্কায় গিয়েছো দূরে সরে।
তখন কাছ থেকে বুকের ওঠা নামা,
ঠোঁটের নড়া আর চোখের ঝলকানি
দেখেছি তন্ময় এবং তোমাকেই
ব্যাকুল পান করে কেটেছে সারা বেলা।
আমাকে রেখে গেছো এ শীতে অসহায়,
একলা বসে দেখি অস্তাগামী চাঁদ,
আড়ালে শুনি মৃদু পাখির ডানা ঝাড়া।
হৃদয়ে ধূলিঝড় প্রহর গুণি শুধু।
কখন তুমি ফিরে আসবে জানি না তা।
কোথায় বসে আছো কেমন হুল্লোড়ে?
কথার হাইফেনে, বিদ্রূপের তোড়ে
পড়ে কি মনে তাকে, এসেছো ফেলে যাকে?
তোমার সত্তায় পূর্ণ অধিকার
প্রতিষ্ঠিত হায় হলো না প্রিয়তমা।
তোমার বরতনু আমার খর তাপে
মাখন হয়ে আজো গলেনি একবারও।
যখনই কাছে আসো, আলিঙ্গনে বাঁধো,
হঠাৎ জেগে ওঠে তীব্র কোলাহল।
নিষাদ তীর ছোঁড়ে আমার দিকে, তুমি
আমাকে বারবার আড়াল করে রাখো।
কিন্তু কতকাল থাকবে আবডাল?
আমি কি তস্কর অথবা আততায়ী?
নিজেকে মিছেমিছি অন্তরালে ঢাকি,
হৃদয় ঘায়ে ঘায়ে রক্তজবা হয়।
যখন পুনরায় আসবে তুমি আর
আমার চোখে মুখে নামবে নিরিবিলি
তোমার মসৃণ চুলের কালো ঢল,
বক্ষে নেবো টেনে, কখনো ছাড়বো না।
হন্তারক এই যুগের তমসায়
আমাকে একা ফেলে যেও না তুমি ফের;
না দাও যদি তুলে প্রেমের হাতে ফল,
ইহজীবনে আর ছোঁবো না তণ্ডুল।
মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায়
আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি ভিড়াক্রান্ত সদরঘাটের
টার্মিনাল ছেড়ে।
যখন দাঁড়াবে ডেকে, হাওয়ায় উড়বে
শ্যাম্পুকরা রেশম-মসৃণ চুল, তখন তোয়ার
মুখ কোন্ দিকে, কোন্ ভঙ্গিতে স্থাপিত,
জানবো না। সৌন্দর্যখচিত সেই মুখ
তখন কি আমার সত্তার উল্টোদিকে
ফেরানো বিষণ্নতায় ছাওয়া? নাকি আমার দিকেই
প্রসারিত চুম্বনের প্রতীক্ষায় থরথর? তুমি
কখনো উচ্ছল জলরাশি
দেখবে, কখনো আসমানে লেগে থাকা
চিতার স্তিমিত আগুনের মতো কিছু আবীরের
ছোপ; যদি আরো কিছুক্ষণ
সেখানে নজর রাখো, দেখবে পাখিরা
ডানায় আমার যন্ত্রণার ভস্ম মেখে উড়ে যাচ্ছে অতিশয়
দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ের লোভে, কে জানে কোথায়।
‘আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি’, এই
ছোট বাক্যে খৃষ্ট পূর্বকালের করুণ দীর্ঘশ্বাস, মরুচারী
কায়েসের দশদিক দীর্ণ-করা উদ্ভ্রান্ত, পবিত্র, ব্যক্তিগত
আর্তনাদ, ফরহাদ-রচিত অনিন্দ্য নহরের
উন্মথিত কান্না আছে আর
হঠাৎ শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের ঘ্রাণ, ঝরাপাতা
আর মৃত দোয়েলের পালকের ফিস্ফিসসে শিহরণ আছে,
তুমি কি জেনেছো? সন্ধ্যেবেলা
তোমার এ যাওয়া
যেন ঢাকা শহরের সব রূপ রস গন্ধ নিয়ে
চলে যাওয়া। কাল ভোর থেকে
কোনো রাগরাগিণী কলাপ মেলবে না,
এবং প্রেমিক-প্রেমিকারা
‘ভালোবাসা’ শব্দের বদলে বারংবার
‘ঘৃণা’ উচ্চারণ করে নিজেরাই বিস্ময়ের ঘোরে
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হবে। লুটেরা, ছিঁচকে চোর দেখে
পুলিশ চম্পট দেবে করতলে প্রাণ ভোমরাটা
রেখে, গেরস্তেরা দিনদুপুরেও ভয়ে
প্রকাশ্য রাস্তায় বেরুবে না,
রাস্ট্রাদূতগণ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক
চুক্তিপত্রে সই করা থেকে
নিয়ত বিরত থাকবেন!
পানি কেটে যাচ্ছে জলযান। হঠাৎ ফেনিল
ঢেউ এসে ঢুকে পড়ে ফ্ল্যাট বাড়িটার ছোট ঘরে,
ছিঁটে লাগে চোখে মুখে, কবিতার বই
টেবিলে শুইয়ে রেখে ভাবি সেই জলযানটির
কথা, যাকে দেখিনি কখনো, যে তোমাকে
নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে তোমার। সে মুহূর্তে মনে হলো
আমার এ মুখের ওপর
ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ কালো চুল। আজ রাতে কিছুতেই
ঘুম আসবে না; সারারাত
তোমার রেশমি চুল আঙুলে জড়িয়ে নিরিবিলি
খেলবো, কখন পূর্বদিক রাঙা হয়ে
উঠবে আবীরের ছোপে, যেমন ঈষৎ
লজ্জায় তোমার গাল। অলৌকিক পঞ্চ ডাল থেকে
যুঁই চামেলীর মতো ঝরে যাবে হৃদয়ে কবিতা,
তুমি আর কবিতা নিমেষে একাকার। ছিটিয়ে স্মৃতির পানি
জলযান যাচ্ছে চলে আমার হৃদয় ভেদ করে।
সূর্যোদয়ে আহত আলোর মৃত্যুচিহ্ন দেখে ফেলে
আমার আপন কবিতার খাতা মরাল সঙ্গীত
গেয়ে ডুবে যাবে
সুদূর মানস সরোবরে নাকি বিদ্রোহ বিদ্রোহ
বলে রুদ্র রোষে ফেটে পড়বে, চৌদিকে
ব্যাপক ছড়িয়ে দেবে মোহন আতশবাজি। তুমি
কেবিনে ঘুমুবে গুটিসুটি
অথবা নামবে ঘাটে, বহুদিনকার
বন্ধ জানালাটা খুলে দিয়ে গাছগাছালির স্তব্ধ শ্যামলিমা
মেখে নেবে চোখে, তখন কি মনে পড়বে তোমার
বেকার কবির কথা যে সংঘের ভেতরে থেকেও
চকিতে কেমন একা, ভীষণ একলা হয়ে যায়।
তুমি চলে যাবার পরেই শুরু হলো একটানা
টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি, যেন গাছের সবুজ পাতা, ছাদের কার্ণিশ
থেকে ঝরে অবিরল ব্যথিত রাজধানীর অশ্রুজল।
তুমি নেই বলে কিছুতেই শহরের
ক্রন্দন থামে না। গুলীবিদ্ধ চখার চৌদিকে চখী
চক্রাকারে উড়ে উড়ে কাঁদে যে ধরনে
অবিকল সে রকম আর্তনাদ করে এ শহর,
মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায়।
তুমি চলে যাবার পরেই
টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি, এ শহর
কেমন হতশ্রী হয়ে গ্যাছে, দেখে যাও একবার।
আসবে কদিন পরে? অপেক্ষায় আছি নিত্যদিন,
যেমন প্রকৃত
মোমিন থাকেন প্রতীক্ষায় ঈদের চাঁদের জন্যে রমজানে।
আমার নিকট থেকে কতদূরে চলে গ্যাছো শরীরে জড়িয়ে
আসমান। কতকাল কেটে গেল, তবু
আসোনি এখানে ফিরে স্যুটকেস হাতে,
কপালে খয়েরি টিপ, অনিদ্রার ছাপ
টাঙ্গাইল শাড়ীটির ভাঁজে। প্রেমের দেবতা বুঝি
ফৌত হয়ে গেছেন হঠাৎ
গুপ্ত ঘাতকের হাতে। নইলে কেন আজ
দিগঙ্গনা জুড়ে
দিয়েছে বিলাপ আর আমার প্রেমের
পদাবলী কেবলী আছড়ে পড়ে, মাথা কোটে শিলাতটে?
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাথা
শুভার্থীরা হামেশা আমার উদ্দেশে এইমতো
নসিহত বর্ষণ করেন, ‘মাথা গরম কোরো না হে,
যা দিনকাল পড়েছে,
একটু সামলে সুমলে চলো।
এমন কি যিনি আমার হৃদয়ে
হাল্কা সুমা রঙের ম্যাক্সি-পরা
শরীর এলিয়ে হাই তোলেন বিকেলবেলা,
পছন্দ করেন ঘাসফড়িং, সরোবর এবং
প্রবাল সিঁড়ির স্বপ্ন দেখতে,
তিনিও নিত্য আমাকে পরামর্শ দেন
অগ্নিবলয়ের পাশ কাটিয়ে
কুলফি বরফের মতো কবিতা লিখতে।
কারণ, যার মাথা গরম,
সে নিজে পোড়ে সর্বক্ষণ
আর যারা তার কাছের মানুষ,
তারাও পুড়তে থাকে, যেন চিতার কাঠ।
ঠাণ্ডা মাথায় যারা কাজ করে,
তাদের তরক্কির রোশনিতে
পাড়ার পাঁচজনের চোখ যায় ধাঁধিয়ে।
সফল আমলারা উপর-অলাদের
সঙ্গে আমড়াগাছি করে
এত উঁচুতে উঠে যান যে,
হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারেন
আকাশ, হেঁটে যেতে পারেন
সুদূর মেঘের গালিচায়; কেননা,
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাদের মাথা।
আর যারা খুন করে ঠাণ্ডা মাথায়,
তাদের বিজয় রথের গতি রোধ করবে,
এমন সাধ্যি কার?
মাথা ঠাণ্ডা রাখতে যাদের জুড়ি নেই,
তারপর হরতালের সময় হয়
নানা ফন্দিফিকির এঁকে
অফিসে ছোটে,
নয় ভিসিআরে ফিল্ম দেখে আয়েসী
সময় কাটায়, হরতালীদের
মুণ্ডুপাত করে অষ্টপ্রহর, ব্রিজ কিংবা
তিন তাসের খেলায় মাতে,
অথবা আজ্ঞাবহ আদূরে কণ্ঠে ইনিয়েয় বিনিয়ে
কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে রুটিন মাফিক
নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি আর
স্বাধীনতা দিবসকে ডেকে নিয়ে যায়
নামী দামী নারী-পুরুষ শোভিত বঙ্গভবনের
দরবারে, বসায় শানদার সোফা এবং চেয়ারে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যাদের মাথা,
তারা কখনো ক্ষুদিরাম হয়ে
ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ায় না
স্বাধীনতার প্রত্যুষের মতো
মুখমণ্ডল নিয়ে।
মর্চে পড়া সমাজের হাহাকারে ওদের
হৃদয় এতটুকু কেঁপে ওঠে না।
দেশ যখন উত্তপ্ত তামার মতো,
তখন তারা আসাদ হতে পারে না,
হতে জানে না নূর হোসেন।
ভাগ্যিস্, এই পোড়া দেশের
সব্বার মাথা এখনো একেবারে
ঠাণ্ডা হয়ে যায় নি
হিমাগারে সংরক্ষিত শবের মতো।
সমারেশদার জন্যে শোকগাথা
সমরেশদা, কী করে জানবো বন্ধু রশীদ করীমের ভাড়াটে
ফ্ল্যাটবাড়িতে সেই রাতেই হবে
আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা? কী করে জানবো
আর কোনোদিনই স্মৃতির সহায়তা ছাড়া
দেখবো না আপনার অবিশ্বাস্য সুন্দর
হাসি উদ্ভাসিত মুখ?
চারজনের নরক গুলজার করা আড্ডা। আপনি, জিল্লুর,
খোদ মেহমান নেওয়াজ গৃহকর্তা আর আমি। কখন যে নগ্নিকা
সন্ধ্যার আব্রু ঢাকা পড়লো রাত্রির জমকালো আলোয়ানে,
টের পাই নি। অবিশ্যি আসরের মুল গায়েন
ছিলেন আপনি আর আমরা স্বেচ্ছায়
মেনে দিয়েছিলাম, দোহারের ভূমিকা। যখন কথার
রেণুসমূহ ঝরে পড়েছিল আপনার
ভেজা-ভেজা ঠোঁট থেকে, ভাবছিলাম কত নারীর
মন জয় করেছে এই হাসি, কথা বলার ঢঙ এবং
মুখাবয়ব। ইরানী এক মহিলা কবি বিষয়ে
বলতে গিয়ে, লক্ষ করলাম, আপনার চোখে হাফিজের গজল,
উজ্জ্বল দু’টি বাহু, আর
যৌবনদীপ্ত উদ্ধত বুক আর কবরে-নুয়ে-পড়া
গোলাপের ছায়া। তখন আপনার ক্লান্তি গ্যাছে অস্তাচলে।
সমরেশদা, একসময় আমাদের সেই আসর ছেড়ে
চলে গেল জিল্লুর, বাড়ি ফেরার
তাড়া ছিল ওর। কথাবার্তার ফাঁকে এক সময়
হঠাৎ বললেন আমাকে, ‘আসুন, এখন থেকে আমরা
একে অন্যকে তুমি বলি, কী জানেন, আপনি, কথাটার
মধ্যে দূরত্ব বেশ ঘাড় বেঁকিয়ে বসে থাকো
আপনি, সমরেশদা, আমাকে তুমি বলতে গিয়ে, মনে পড়ে,
বেশ কয়েকবার হোঁচট খেলেন। যখন ‘তুমি’ আপনার
কণ্ঠে সাবলীল খেলা শুরু করলো,
তখনও আমি সংকোচে বিহ্বল, খানা-খন্দে পড়ে যাওয়া
মানুষের মতো লুটোপুটি খাচ্ছি। বহু চেষ্টা করেও
আমার আপনাকে আর তুমি বলা হলো না।
সমরেশদা, কী করে মেনে নেবো আপনার মতো
একজন তারুণ্যে টগবগে মানুষ
আর নেই কলরবময় কলকাতায়, অন্য কোথাও নেই?
কী করে মেনে নেবো মৃত্যুর এই প্রহারকে,
যা আপনাকে নিমেষে চূর্ণ করেছে অভ্রগুড়োর মতো?
হায়, এখন আপনি
বিলীন পঞ্চভূতে এবং জীবন্ত শুধু অগণিত শব্দের সংসারে।
আপনারা আত্মা কি বিবর থেকে বেরিয়ে
উড়ে গ্যাছো উর্ধ্বলোকে প্রজাপতির মতো? এখন আপনি
অনেক দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত; উপন্যাসের
কিস্তি শেষ করার তাগিদ নেই নাছোড় সম্পাদকের
তরফ থেকে, তাড়া নেই অর্থ উপার্জনের,
আপনি এখন মুক্ত ভনভনে স্বাক্ষরশিকারিদের
হৈ-হল্লা থেকে, সমালোচকদের হুল-ফোটানো কলমের
খোঁচা থেকে, স্খলনের অপবাদ
বয়ে বেড়ানো থেকে। মৃত্যু ঢালের ধরনে
আড়ালে রেখেছে আপনাকে বহুরূপী ঝুটঝামেলা থেকে।
এমন এক সময় ছিল, যখন মৃত্যুভয়ে
আমার রক্তে তুষার জমে যেতো। মৃত্যুর ওপর
ভীষণ্ন রাগ হতো আমার,
কেননা বহু মহাত্মা, মনীষী আর শিল্পীকে
শিকার করেছে সেই নির্বিকার
নিষাদ, আপনিও রেহাই পেলেন না তার
তীর থেকে। এখন বুঝি, বৃথা এই ভয়, ক্রোধ কিংবা ঘৃণা।
এর কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না,
অপ্রতিদ্বন্দ্বী দাবাড়ুর মতো সে খেলে চলেছে
নিজের খেলা। আমরা যারা ওর বোড়ে,
তারা ঘায়েল হচ্ছি নির্ধারিত কালে। তাই, বাটি থেকে
সমস্ত দুধ মাটিতে পড়ে গেলে
যেমন কপালে করাঘাত করলে কোনো লাভ নেই,
তেমনি নিষ্ফল মৃত্যুর বিরুদ্ধে অপটু অভিনেতার মতো
তর্জন গর্জন করা। শেষ অব্দি মেনে নিতেই হয়
যে-কোনো চলে-যাওয়া প্রতিবাদ ফেনা হয়ে উবে যায় হাওয়ায়।
একদা আপনি সওয়ার হয়েছিলেন
আগুন রঙের এক বলীয়ান ঘোড়ায়। তার
দাপটে কেঁপে উঠেছিল
ধনিক গোষ্ঠীর ভিত। কিন্তু কী যে হলো একদিন
স্বেচ্ছায় সেই ঘোড়ার জিনচ্যুত হলেন। সে রাতে এর কারণ
জানতে চেয়েছিলাম আপনার কাছে। কে না জানে
আধুনিক বাংলা গদ্যশৈলীর
আপনি এক প্রধান স্রষ্টা। আপনি সেই গদ্যের
কলাকৌশল গলায় খেলিয়ে
উত্তর দিতে চেষ্টা করলেন। মাফ করবেন,
আপনার উক্তিতে মাধর্য ছিল যত বেশি,
যুক্তি ছিল ততটা কম। আপনাকে মনে হচ্ছিল
সেই ক্লান্ত পাখির মতো যে
আটকে গ্যাছে আগুনধরা সরোবরে। সমরেশদা,
হয়তো আপনার কাছে
আগুন রঙের ঘোড়ার নিঃশ্বাসের আঁচ অসহ্য ঠেকেছিল!
আমার এই তুচ্ছ লেখা কি বিবেচিত হবে
শোকগাথা হিসেবে? এখন যে বলপেন দিয়ে দিখছি,
তার চোখে শোকের কুয়াশা কোথায়? কোথায়
সেই হাহাকার তার গলায়
যা শুনে ডুকরে উঠবে প্রতিটি পংক্তি? সমরেশদা,
কী ব্যর্থ আর অসহায় এই লোক,
যে আপনার যোগ্য একটি শোকগাথাও আজ
রচনা করতে পারলো না।
নিজেকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া কী-ই বা আর
করতে পারে সে? হাতের কলমটাকে টুকরো টুকরো করে
ভেঙে ফেলা ছাড়া কী আর
করার আছে তার? কখনো হয়তো কোনো নির্ঘুম রাতে
আপনার কোনো লেখা পড়ে, কোনো কথা ভেবে
অথবা গ্লাশে চুমুক দেয়ার ভঙ্গি মনে করে
আমার অন্তরাত্মা হু হু করে উঠবে,
কেউ জানবে না।
সমরেশদা, আজ বাতাসের কানে মুখ রেখে
আপনাকে আর্তস্বরে ‘তুমি’ বলে ডাকছি, এই দুনিয়ার
দর্পণ ভেদ করে কি আমার এই ডাক
পৌঁছুচ্ছে তোমার কাছে? পৌঁছুক আর না-ই পৌঁছুক,
এই প্রথমবারের মতো আপনাকে তুমি বলে সম্ভাষণ করলাম,
অথচ তা’ শোনার জন্যে তুমি আর নেই।
সৌন্দর্যের গহনে ডুবুরী
দিনভর রাতভর তোমার উদ্দেশেই আমার এই ডাক,
গলা-চেরা, বুক-ছেঁড়া। আসা না আসা
তোমার খেয়ালের বৃত্তে ঘূর্ণ্যমান, কোনো পাখি যদি
স্বপ্নঝিলিক, আশার খড়কুটো আমার ঘরে
না ঝরায়, তবু ডেকে যাবো,
যতদিন না তুমি আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াও।
সে কবে তোমাকে দেখলাম;
তুমি এসে বসলে আমার পাশে, সবুজ ঘাসে
লুটিয়ে পড়েছে তোমার ঘাসফুল-রঙ শাড়ির আঁচল,
তোমার হাসির ঢেউ,
আমার ভেতরে নৌকার দোলা, তোমার খোলা
চুল নিয়ে খেলছে হাওয়া, স্বপ্নছাওয়া চোখ তুলে
কী যেন বললে তুমি, কিছু শুনতে না পেয়ে
আমি তোমার সৌন্দর্যের গহনে ডুবুরী।
তোমার নরম হাত আমার মুঠোয়।
আমি কোনো গোলাপ
কিংবা স্বর্ণচাঁপাকে স্পর্শ করিনি। মনে হলো,
তোমার সকল কিছুই স্পর্শাতীত।
মুখের ওপর রোদের ঝলক, বাসী
ধু ধু বিছানায় আমার ধড়ফড়িয়ে ওঠা, চোখ রগ্ড়ে
বারবার স্বপ্নের ছেঁড়া
মসলিন সেলাই করবার পরিণামহীন চেষ্টা।
ভীষণ তেষ্টায় আমার চোখ জুড়ে,
গলা জুড়ে, বুক জুড়ে বালি, কেবল বালি।
চকিতে মনে পড়ে, তোমার হেকারতের হ্যাঁচকা টানে
টালমাটাল আমি
দেখেছি আমার স্বপ্নের সওদাকে গড়াতে
সদর রাস্তায়।
টুকরো টুকরো ছবি ভাসে, ডোবে। খণ্ডগুলোকে
জোড়া দিতে অপারণ আমি
অমিলের বেড়াজালে আটকা। যাকে দেখেছিলাম
শেষরাতের স্বপ্নের অভ্রের
আভাময় মাঠের মাঝখানে, সেকি তুমি? তার কালো
চুল কি নিতম্ব অব্দি নেমে-আসা
ঝর্ণা নাকি বিউটি পার্লারে রচিত খাটো স্তবক?
আর তার আয়ত সুন্দর চোখ? ঈষৎ বাদামি নাকি
নীল ঢেউয়ের ঝলকানি-লাগা? অথবা
মৃত্যুর মতোই ঘন কালো? তোমাকে আর
তাকে মেলাবার আমার
সকল আয়োজন শুধু, পণ্ড হতে থাকে।
তোমাকে বাস্তবিকই কখনো দেখেছি কি দেখি নি,
এই ধন্দ আমাকে নিয়ে লোফালুফি করে লাগাতার।
বুকের ধুক ধুক আর হৃৎপিণ্ডের রক্তের দাপাদাপি
আর সীমাছাড়ানো অস্থিরতা নিয়ে
আমি কিছু শব্দকে ‘আয় আয়’ বলে ডেকে বেড়াই
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। অনন্তর
যে প্রতিমা গড়ে ওঠে আমার হাতে,
তাকে দেখে অনেকে বলে ওঠে সোল্লাসে, ‘সাবাস কবি,
কেমন করে, এই অসম্ভব সুন্দরকে
আনলে মর্ত্যলোকে?’ মাঝে-মধ্যে আমারও
অবাক হবার পালা। অথচ এই আমি
বহুদিনের নাছোড় অস্থিরতা
এবং অনেক নির্ঘুম রাত্রির বিনিময়েও তোমাকে
আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে অক্ষম। এর ব্যর্থতার
ঝুলকালি মুখে নিয়ে চৌদিকে
মানুষের মেলায় হাঁটবো কী করে?
মনকে প্রবোধ দিই, আমাকে না বলেই তুমি চলে যাবে,
বিশ্বাস করি না। তুমি সাড়া দাও
আর নাই দাও, আমি দিনরাত্তির ডেকেই যাবো
অকাল বসন্তের ব্যাকুল
কোকিলের মতো। গলায় রক্ত চল্কে দেয়া এই ডাক
তোমাকে কি কখনো নামিয়ে আনতে পারবে না
তোমার উদাসীনতার মিনার থেকে? তুমি কি
শীগগীরই একদিন এসে
আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে না, এই যে আমি?
আজ শুধু অন্ধকারে হারড়ে বেড়ানো, নিজের সঙ্গে কথা বলা।
শোনা যায়, কখনো কখনো মর্মর মূর্তিও
বেদীর স্থানুত্ব বিসর্জন দিয়ে
তার রূপের সাধককে বাঁধে নিবিড় আলিঙ্গনে।
কোন্ দিকে পড়বে তোমার পদচ্ছাপ,
তা দেখার জন্যে প্রতীক্ষায় কখনো আমি
পাথরের নুড়ি, কখনো প্রজাপতি, কখনো বা দোয়েল।
হাসপাতালের বেড থেকে
কী-যে হলো ক’দিনেই এমন বেহাল।
অ্যাম্বলেন্স আসেনি এখনো। প্লিজ, টেলিফোন করো
আবার; অস্তিত্ব আগাগোড়া
করুণ রঙিন মেঘে মোড়া, চৈতন্যের ছেঁড়া সুতো
দিয়ে জোড়া। ফুসফুসে প্রদাহ, দু’চোখ
বুজে আসে, ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট, সন্ধ্যা না সকাল
বোঝা দায়; মাঝে মধ্যে কানে
আসে ফিস্ফিসে কণ্ঠস্বর।
কে যে কোন্ কাজে যায়,
কী সে কিছু কমবে যন্ত্রণা
এ ভাবনা সকলের। কেবল শিশুরা ভাবলেশহীন, বেশ
ক্রীড়াপরায়ণ।
হয়তো বোঝে, খারাপ একটা কিছু ঘটে
গ্যাছে পাটখড়ির মতন লোকটার।
যা কিছু আমার প্রিয়, ব্যক্তিগত, বইপত্র, পাণ্ডুলিপি আর
না দেখা প্রুফের তাড়া, উদ্বিগ্ন স্বজন-
সবকিছু থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন চলেছি।
অ্যাম্বলেন্স এসে গ্যাছে। স্ট্রেচারে শুইয়ে দাও, দেখো
যেন কষ্ট না হয় রোগীর।
প্রায় অচেতন;
এমন কি বিকারের ঘোরেও চকিতে মনে পড়ে,
এসেছো আমার ঘরে। যে মুখ ভোলার
প্রশ্ন অবান্তর, খুঁজি তাকে বারম্বার। সিঁড়ি বেয়ে
নামছে স্ট্রেচার, অ্যাম্বুলেন্স থেকে দেখি
স্বপ্নময়তায় রয়েছো দাঁড়িয়ে ঝুল বারান্দায়।
সেখানে ছিলে কি তুমি বাস্তবিক? না কি অন্য কেউ
অন্য গ্রহবাসিনী, সুদূর, একাকিনী?
যাচ্ছি দ্রুত; বিদায়, বিদায়।
২
‘এক্ষুণি এক্স-রে করা দরকার, ফুস্ফুসে কতটা ফ্লুইড
জমেছে দেখতে হবে বলে
ডাক্তার উদ্বেগে
তাকান আমার দিকে। পরে
প্লেট দেখে গুম্ হয়ে বলেন, ‘প্রচুর
অবহেলা করেছেন, বীজাণুর খেলা
চলেছে গোপনে বহুকাল।
মনে মনে বলি, মানি চক্ষুষ্মান আপনি ডাক্তার
অথচ দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেল আপনার
চাঁদের পিঠের মতো গর্তময় দুঃখচিহ্নগুলি,
সে এক মধুরতমা, সাম্প্রতিক, নিষ্ঠুর আঁচড়ে
করেছে জখম বারবার
আমাকে, কোনোই দাগ তার পড়লো না
এক্সরের প্লেটে কিংবা আপনার চোখে!
৩
হাসপাতালের বেডে একা। শ্বাপদের আঁচড়ে, কামড়ে
ছেঁড়াখোঁড়া বাবুই পাখির বাসা আমি।
খুব ফিকে জামরঙা শাড়ি, রোদ-চশ্মা-পরা তুমি
আস্তে সুস্থে হেঁটে
আমার তন্দ্রার তীরে এলে। মৃদু কণ্ঠস্বর শুনে
জেগে উঠি। তোমার চুলের গন্ধে সুরভিত স্বপ্নেরা আমার।
কেউ কেউ ছিল
কেবিনে এবং হাইহিল জুতোর ব্যস্ততা বাজে।
আমার মাথার বালিশটা ঠিকঠাক
গুছিয়ে দেবার জন্যে এলে কাছে। রোগীর নির্দোষ
অজুহাত নিয়ে
প্রথমবারের মতো প্রাণ ভরে নিলাম তোমার
নরম বুকের ঘ্রাণ। এখন আমার যাত্রা তোমার অতল
অন্তরের অধিক অন্তরে;
ভাগ্যিস, আমার
ভীষণ অসুখ করেছিল।
৪
গাছপালা যেখানে দাঁড়ানো
ছিল, সেখানেই আছে। লম্বা বারান্দাটা
প্রসারিত, যেন দীর্ঘ স্মৃতিপথরেখা।
একটি কি দু’টি শালিক চড়ুই ওড়াউড়ি করে
এখানে সেখানে,
দুপুরে ডাকতে থাকে বুকে রক্ত তুলে
অবোধ কোকিল,
সবুজের ছোঁয়া লাগা মাঠ,
দূরে ইস্পাতের মতো চকচকে ঝিমধরা ঝিল,
আকাশে চক্কর-কাটা শঙ্খচিল ওরা
আমাকে তোমার মতো ফেলে
অকস্মাৎ চলে
যায় নি কোথাও।
৫
‘কাল চলে যাবো’ বলে তুমি
দাঁড়ালে বেডের ধারে। অবরুদ্ধ আমার গলায়
অগোচরে কী একটা দলা
কেমন পাকিয়ে ওঠে। নিরুত্তর চেয়ে থাকি
তোমার সুন্দর হস্তধৃত
সাহিত্যপত্রের দিকে। তুমি
নির্দয়ত’ হবে ভেবে দয়া করে আমার বিরুদ্ধে হুলময়
ঝকঝকে ম্যাগাজিন দাও নি, যা তোমার নিজেরই
সম্পাদিত; তোমার পড়ে নি মনে কীটস্-বিরোধী ব্ল্যাকউড
ম্যাগাজিনটির কালো কীর্তি ঘুণাক্ষরে?
অথবা ভাবো নি একবারও
সবচে’ নির্দয় খেলা সাত তাড়াতাড়ি
আমাকে একলা ফেলে রেখে
তোমার অমন চলে যাওয়া।
তোমার নিকট
দয়া নয়, দয়াবতী, ভালোবাসা চাই;
যদি পারো আমার মুমূর্ষ ওষ্ঠ সঞ্জীবিত করো
স্বর্গের শিশিরে।
৬
সারাক্ষণ ছটফট করি, উল্টে-ধাওয়া আরশোলা।
মাঝে মধ্যে নানাবিধ শব্দ কানে আসে,
রাত্রির নিজস্ব শব্দ আছে কতিপয়, যা শুনলে
এমন কি খুব অসুখেও
গা’ অত্যন্ত ছম ছম করে।
সারারাত নিদ্রাহীনতায় কাটে, ভোরে
চোখ জ্বালা করে, কেউ মরিচের গুড়ো
ছাড়য়ে দিয়েছে চোখে। অস্থিরতা বাসা
বেধেছে সত্তায়, কছিতেই স্বস্তি নেই। খাদ্যাতঙ্ক
করেছে দখল আর টলটলে লিকুইড ফুড্ও
ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করছে জঠর।
প্রত্যুষ আমার প্রিয় চিরকাল, কালো
রাত কাটে উজ্জ্বল ভোরের প্রতীক্ষায়।
অথচ প্রত্যুষ কেন এরকম বিবমিষা আনে?
তুমি নেই পাশে,
বুক পুড়ে খাক,
বুক পুড়ে খাক।
হৃদয়ের চোখ সয়লাব
পানিতে পানিতে,
তবুও নেভে না কেন বুকের দহন?
৭
কতকাল ছুঁই না তোমাকে। কতকাল তোমার অধর থেকে
আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ বিচ্ছিন্ন এবং
কাঁপে না তোমার স্তন বনকপোতীর
মতো থর থর
আমার মুঠোয়।
আমার নিঃশ্বাসে নেই বিষ,
স্পর্শে যার গোলাপের বুকে
ছড়িয়ে পড়বে কীট। এখন মধুরতমা নির্দ্বিধায় এসে
তোমার মসৃণ চুলে আমার ফ্যাকাশে মুখ ঢেকে
খেতে পারো তীব্র চুমো। জীবন আমাকে
বাঁচার ছন্দেও দোলা দিয়েছে শিখিয়ে
পুনরায়। শুধু একবার এসে দেখে যাও এই আরোগ্যশালায়।
দিনভর রাতভর, বল’ যায়, তোমার কথাই
ভাবি, মনে মনে কত মূর্তি বানাই তোমার আর
পূণ্যবানগণ অকস্মাৎ অতিশয়
আতশি মেজাজে
পৌত্তলিক ভেবে
আমাকে অন্তত দিনে সাতবার পাঠাতে পারেন
জাহান্নামে। দিন্ তারা যে কোনো বিধান,
মাথা পেতে নেবো;
অথচ তোমারই স্পর্শ এ ব্যাধিতে আমার নিদান।
৮
খানিক আগেই রোজকার
নার্সের ইঞ্জেকশন দেয়া
হয়ে গ্যাছে; বিকেলে শহীদ নূর হোসেনের পিতা
বিনীত এলেন ফলমূল, এক বুক
লুকোনো শোকের রেশ, ইতিহাস নিয়ে। দর্শনার্থী একে একে
সকলেই চলে যান বিভিন্ন সময়ে। আসমানে
কতিপয় তারা, দূরে বাড়িগুলি একাকার, ইউক্যালিপ্টাস,
সারি সারি, সতর্ক প্রহরী, একাকিত্বে
আমি ইজিচেয়ারে ছায়ার্ত বারান্দায়
আধ-শোয়া, আম-জাম গাছের পাতার
অভ্যন্তর থেকে গোলগাল চাঁদ উঁকিঝুঁকি দ্যায়,
যেমন নাইওরে
যাবার সময়
নববধূ পাল্কির পর্দাটা
লাজুক সরিয়ে।
আমার কাতর ক্লান্ত ফুসফুসে অবিরত ঝরে
চাঁদের আবীর।
রাতে বাড়ে, চোখ বুজে আসে, বহুদূরে
কে জানে কোথায় তুমি শুয়ে আছো, তোমার স্তনের চাপে নক্শা
ফোটে নম্র বিছানার চাদরে, বালিশে
ছড়ানো রেশমি চুল, ঠোঁটে
নিঃশ্বাস আমার কবিতার;
তোমার শরীর জুড়ে আমার স্বপ্নের কী মদির আলিঙ্গন,
লবণাক্ত, স্বেদবিন্দুময়।
৯
রাত কটা বাজে? ঘড়ি দেখবার সামর্থ্য উধাও। নিস্তব্ধতা
ওৎ পেতে আছে চারদিকে;
যখন অনেকে
যে যার শয্যায়
ঘুমের প্রলেপে মজে থাকে,
কায়ক্লেশ ক্রমাগত বেড়ে যায় আমার এবং
শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ডাকিনীর বিশীর্ণ আঙুল
ছড়ায় যন্ত্রণা-বিষ। পুরনো নিউজ রীলে দেখা
অসউইজের নাৎসী বন্দি নিবাসের উৎপীড়িত
বাসিন্দার মতো আমি দেখতে এখন। প্রাণপণে
মানুষ থাকতে চাই, তবু
আমার ভেতর থেকে ভয়ানক কষ্ট-পাওয়া পশু
ভীষণ চিৎকার করে যখন তখন।
অন্ধকারে সশ্রদ্ধ আবৃত্তি করি মেয়ে
মৌলানা রুমির সুবচন-
‘প্রেমের ব্যাধির চেয়ে অধিক যন্ত্রণাময় ব্যাধি নেই কোনো!