যায়নি কোথাও
হঠাৎ গুলির বর্ষা, ধোঁয়াবিষ্ট বাড়ি, আর্তনাদ ছাদ বেয়ে
মেঘে ওঠে, এলোমেলো পদশব্দ, মূক রক্তধ্বানি,
মেঝেতে চামচ, ভাঙা চায়ের পেয়ালা,
চন্দ্রাকৃতি কমলালেবুর কোয়া দেয়ালে প্রবেশ করে ভীত।
তবু কেউ অপরাহ্নে হাঁটুরে ঠেকিয়ে
চিবুক নীরব বসে আছে, তার হাতে প্রেমিকের
স্পর্শ খেলা করে, ভাবে মৃত্যুর মুহূর্তে ভালবাসা
বড় বেশি প্রয়োজন; তার কোলো মাথা
রেখে শোয় তৃষ্ণার্ত পুরুষ।
কবিতার পঙ্ক্তি খোঁজে আনত চোখের কামরূপে
স্মৃতি স্বপ্নাচ্ছন্ন পাখি, মাথার ভেতরে গান গায়,
সুরে কালাকাল বাজে। একটি ফড়িং
বইয়ের ওপর দেয় প্রাণের উত্তাপ, তারপর আলগোছে
তরুণীর স্তনের সুঘ্রাণ নিতে যায়।
পুরুষ আবৃত্তি করে মনে-মনে যেখানে কোকিল
আর গাইবে না গান, ফুটবে না ফুল, বাগানে কি
পথপ্রান্তে, ফসলের সজীবতা মুছে যাবে, প্রেম
চরম নিষিদ্ধ হবে, সেখানে আমার
নিঃশ্বাস নিশ্চিত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে লহমায়
মূঢ়দের খেলাচ্ছলে। পুরুষকে দলে পিষে একপাল
বাইসন ছুটে যেতে থাকে।
স্বপ্নে তার ভ্রমরের ঝাঁক, সে পবিত্র বন্ধ দরজার
সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, ভুল তীর্থযাত্রী, দ্বিধান্বিত,
কারা তাকে সরে যেতে বলে ক্রুদ্ধ স্বরে। প্রতিবাদহীন
একা
হেঁটে যায়, হেঁটে যায়; প্রকৃত সে যায়নি কোথাও।
রক্ত খেকোদের সামনে
চা খেতে-সংবাদপত্র পড়ি।স্থুলাক্ষরের হেডলাইন
সন্ত্রাসীর মতো চোখ রাঙিয়ে
দাঁত খিঁচিয়ে আমাকে তাড়া করে, আমার দিকে
উঁচিয়ে ধরে স্টেনগান। বিপন্ন উদ্বাস্তুর মতো
ব’সে থাকি খোলা আকাশের নিচে,
ভূমিকম্পে ধসে-পড়া আমার হাত
একটি অস্পষ্টস্মৃত কাহিনীর সূচনা এবং সমাপ্তি।
বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে
একটু জিরিয়ে নেব, স্বপ্নের ডানার নিচে
নিদ্রাশিত দ্বীপের মতো থাকব, তার জো নেই।
আমাকে ক্রমাগত তাড়িয়ে বেড়ায়
এক পাল রক্তলিপ্সু শিকারী কুকুর, যাদের দাঁতে
অসংখ্য প্রাক্তন হত্যাচিহ্ন। পালাব কোথায়?
এই বয়সেও তারুণ্য আমার শিরায় জিপসি-নৃত্য,
পলাতকের ভূমিকা আমার পৌরুষকে ভেংচি কাটে।
এই দেখ, আক্রান্ত গোধূলিতে নিরস্ত্র আমি
রক্ত খেকোদের সামনে কেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছি
হাতে নিয়ে কবিতার খাতা। ঘোর অমাবস্যায়
আমার কবিতা জ্যোৎস্নাস্নাত পাখি এবং
অসত্য আর অন্যায়ের আর বর্বরতার ঋতুতে
জাগর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।
শব্দ
সেই কবে থেকে শব্দ আমাকে স্বস্তি দেয় না,
মস্তিতে রাখে বন্দী, ঘুমোতে দেয় না শান্তিতে, ক্রুদ্ধ
পাখির মতো
একটানা ঠোকরাতে থাকে সকাল সন্ধ্যা, ঘোরায়
অবিরত বনবাদাড়ে, আলো আঁধারে,
তৃষ্ণায় জিভ বেরিয়ে-আসা মাছে, যেখানে
গ্রাম্য বধূর লাশ পশুর লোভের করাতে অপভ্রংশ,
সনাক্ত করণের পরপারে। শব্দ আমাকে হাতছানি দিয়ে
ডেকে নিয়ে নাকানি চুবানি খাওয়ায় খানাখন্দে।
কখনো কখনো প্রতিশোধ আমার মধ্যে
লকলকে আগুন, হঠাৎ
কোনো কোনো শব্দের গাল পুড়িয়ে দিই, কান
মুচড়ে দিই, যেমন কোনো যন্ত্রী সুর বাঁধার সময়
বাদ্যযন্ত্রের কান। আবার কখনো
লাঠির ডগার ঘোরাই বনবন, তপ্ত কড়াইয়ে ভাজি,
করাই সেবন কবিরাজী তেতো বড়ি, নেহাইয়ে ফেলে
বার বার মারি হাতুড়ির বাড়ি, কাস্তে দিয়ে কর্কশ কাটি।
রাত্রির জঠরে দাঁড়ানো শেয়ালের চোখ থেকে,
বরজাশ্রয়ী পানপাতা থেকে, অনূঢ়ার স্তন থেকে, ঈগল
আর সাপের অমীমাংসিত বিবাদ থেকে, ভোরের
স্পর্শ-লাগা
ডিমের কুসুম থেকে, সন্ন্যসীর পিঙ্গল জটা, অমিততেজ
শহীদের বুকের গোলাপ ফুটো, মগরেবে হঠাৎ-দেখা
সিজদারত মানুষের চন্দ্রাকৃতি, সুরাইয়ের ছায়া,
পূর্বপুরুষদের অস্পষ্ট পদধ্বনি আর
বল্লমবিদ্ধ গলার আর্তনাদ থেকে টপকে পড়ে শব্দ।
শব্দ ত্র্যারিয়েলের রেশমপ্রতিম
পাখার আন্দোলনের সত্য।
শব্দ জলাভূমির ধারে গোধূলিতে
ক্যালিবানের আলস্যময় শয়নের সত্য।
অর্ধপশু অর্ধমানবের রোমশ হাতে
নির্জন জল ঝকঝকে আয়নার মতো
টুকরো টুকরো হয় এবং আমি বেলা অবেলায়
জোড়া লাগনোর খেলায় মেতে উঠি।
শ্রোতা
বিকেল বেলা এখানে এসেই লোকটা কেমন
ভ্যাবাচ্যাকা। এত হৈ চৈ, অথচ কেউ কারও কথা
শুনছে ব’লে মনে হচ্ছে না। শব্দগুলো
ইট পাটকেলেত মতো ঠোকাঠুকি করছে অবিরত।
লোকটা শত চেষ্টা ক’রেও কারও দৃষ্টি
ওর দিকে ফেরাতে না পেরে
মুখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণে। সারা মুখে ভর
সন্ধেবেলার
অন্ধকার, মাথার ভেতর অন্ধ পাখির ঠোকর।
এখনই অন্ধ বন্ধ কোনো না পাখা,
লোকটা নিজেকে প্রবোধ দেয় চারপাশে
স্তব্ধতার মনোজ জাল ছড়িয়ে। লোকটার মাথা
ক্রমাগত মেঘ স্পর্শ করার বাসনায় স্পর্ধিত হয়।
ওদের কিছু কথা শোনাবার ছিল লোকটার,
কিন্তু কেউ কোনো কথা শোনার
ব্যগ্রতাকে নাচায়নি চোখের তারায়
পরিণামহীন হৈ-হল্লাই ওদের অধিপতি।
লোকটা আখেরে বলতে-চাওয়া কথাগুলো
বুকের ভেতর গুছিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়াল এক
ভিড়
গাছপালার মধ্যে। ওর মুখে মুক্ত উচ্চারণ; গাছ, পাখি,
নির্জনতা আর বাংলা লিরিকের মতো চাঁদ তার শ্রোতা।
সামান্যই পুঁজি
গর্ব করবার মতো কিছু নয়, সামান্যই পুঁজি।
রোদ আনতে চাঁদিনী ফুরায়; তার চুলে, নাভিমূলে
বৃষ্টি মেখে দিলে প্রাণে বয়ে যায় খরার পবন।
বাড়ির সম্মুখে সন্তর্পণে পদচ্ছাপ রেখে গেলে
কোমল হরিণ কোনো বাজে না গভীর রাতে বাঁশি।
অভ্র দিয়ে শান্তির কুটির বানানোর বাসনায়
কামলার মতো খাটি সারাদিন, তবু অসমাপ্ত
দেয়ালে গজায় বুনো ঘাস। কবে থেকে ব’সে আছি
নতমুখে, মহাজন তাগাদা শোনায়, নিদ্রাছুট
নিশীথে আমাকে ঠোকরাতে থাকে অশান্তির পাখি।