ব্যবধান
একদা আমাকে তুমি দিয়েছিলে ঠাঁই মমতায়।
আমিও তোমাকে
দিনের সোনালী ছটা রাত্রির মায়াবী কত নিমগ্ন প্রহর
করেছি অর্পণ। আজ আমি তোমার সান্নিধ্য থেকে দূরে
পড়ে আছি অসহায়। তুমি ডাকলেও
পারি না নিকটে যেতে। আমাদের মাঝখানে মরু
শত মরীচিকা আর অজস্র নিশীর্ণ হাড় নিয়ে
ব্যাপ্ত রাত্রিদিন, মাঝে মাঝে
তোমার আভাস পাই অগণিত ওষ্ঠে। বেলা যায়,
বেলা যায়, সময় আমাকে দেয় প্রবীণের সাজ।
যদি কাছে যাই কোনোদিন মনের খেয়ালে, তবে সত্যি
বলো,
সুদূরের সেই
যুবাকে পাবে কি খঁজে এই ভাঙাচোরা মুখচ্ছদে? দেখ
আমি
কী রকম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
ভিজছি বৃষ্টিতে ক্রমাগত। শুষে নেয়
মেদমজ্জাজলের দংশন।
মধ্যরাতে ঝুঁকে থাকে
সূর্যাস্তে পাখির ডানা ক্লীর ছবি, দু’চারটে গাছ
অশ্রুপাত করে, কালো মখমলী নিঃসঙ্গ বেড়াল
কুড়ায় আলস্যকণা। নিরালা চায়ের শূন্য কাপ
টেবিলের অত্যন্ত নেতানো তাপ নেয়, এলোমেলো
খাতার পাতায় দীর্ঘশ্বাস; হাওয়া বয়, বল পেন
মৃতের মতোই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, বুকে বোবা
বহুক্ষণ, চক্ষু স্থির, যেন আমি দেখি না কিছুই
কিছুই যায় না শোনা। সন্ধ্যায় বস্তুত আমার
কোথাও যাবার নেই। ব্যথিত দোয়েল ফিরে গেছে,
কালপুরুষের প্রত্যাখ্যান বেজে ওঠে স্তব্ধতায়।
কোথাও যাবার নেই, একটি অচিন পাখি খুব
আসে আর যায়, তার ছায়া যেন ফিসফিসে স্বরে
দেয়ালকে কিছু বলে। তারপর আমার উপর
মধ্যরাতে ঝুঁকে থাকে সমিধলোলুপ নীরবতা।
মরমী পুস্তক
একটি বালক তার রঙিন মার্বেল খুঁজে খুঁজে
প্রায় দিনশেষে
কৈশোরের ঘাটে এসে বসে। জলস্নেহ কাছে ডাকে,
তিনবার দিল ডুব সূর্য ডোবার আগেই।
কিশোরের স্নাত
চিকন শরীরে পলক না পড়তেই
যুবকের সুঠাম শরীর,
জল ছেড়ে ওঠে জ্বলজ্বলে তরবারি।
যুবক নিয়ত হাঁটে একা একা অচিন উদ্যানে,
কে এক অধরা তাকে গহন ভাষায়
দূরে ডেকে নেয়,
হৃদয়ের রত্নরাজি যত্নভরে দেখায় এবং
নিভৃত উদ্যানেশ্বারী সপ্তপদী চালে
বিভ্রম জাগায়। পর্যটনপ্রিয় যুবা
একজন প্রৌঢ়ের ভেতরে যাত্রা করে, বিপরীতগামী এক
উদাস পথিক তাকে হেসে মরমী পুস্তক দেয় উপহার।
একটি গাছের নিচে বিকেলের সুমন্ত আলোয়
মুগ্ধ প্রৌঢ় করে পাঠ মরমী পুস্তক,
ভাবে সে সন্ন্যাস নেবে, চাখবে অশেষ
নির্জনতা, ফলমূল খেয়ে করবে জীবন ধারণ।
নিজেকে বিভক্ত করে কয়েকটি ভাগে অগোচরে-
এ ওকে টানতে থাকে নিজের নিকট;
কেউ লোকালয়ে যায়, কেউ ধায় বিজন ভূমিতে,
দ্রুমতলে দ্রুত তালে নেচে ওঠে মরমী পুস্তক।
মাঝি
ছিলাম তন্দ্রার ঘাটে, চোখ ঢুলু ঢুলু,
অকস্মাৎ বেনো জল। শ্মশানের কাঠ
ভেসে এসে বলে,
‘ধরো’; বুকে নিয়ে ভাসমান। অন্ধ জলে
অবিরল হাবুডুবু খাই।
ওপারে তন্দ্রার ঘাটে ব’সে আছে বেজায় একাকী
খেয়া মাঝি, নৌকো দোলে, ভাঙা দাঁড় হাহাকার বয়,
অসিত চাদরে ঢাকা বিশুষ্ক শরীর, ঘাড়ে তার বিষণ্ন
করোটি।
মাতৃডাক
ছিল না নদী, পাহাড় অথবা প্রান্তর; শস্যের ক্ষেতের
ঢেউ পড়েনি চোখে, বাউলের গান
যায়নি শোনা। এই শহরে শহীদ মিনারে
কতিপয় নারী, যেন শস্যক্ষেত, বিকেলের
নিস্তেজ আলোয়। শহীদ মানিকের মা, একাত্তরের
বীর প্রতীকের মা মাইক্রোফোনের
সামনে দাঁড়ানো এই প্রথমবারের মতো
বক্তার ভূমিকায়। বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা
তাঁর ওষ্ঠে শ্যামা পাখি,
বললেন তিনি মমতার শ্যামল স্বরে-
‘বিশ বছর মা ডাক শুনিনি আমি
তোমরা সবাই আমার সন্তান,
তোমাদের মুখে মা ডাক শুনতে সাধ হয়।
নিমিষেই জনসমাবেশে মাতৃডাকে বাঙ্ময়,
গাছপালা, উদ্যান, পথরেখা, নদী-নালা, ব্রিজ দূরের
আকাশ
‘মা, মা’ বলে ডেকে ওঠে।
মানুষ
লোকটা বিকেলবেলা দু’ভুরুর মাঝখানে সোনালি-হলুদ
আয়োজন নিয়ে হেঁটে যায়, বসে হ্রদের কিনারে
নিরিবিলি; আঁজলায় তুলে
নেয় জল পিপাসার ধূসরতা মুছে
ফেলার তাগিদে। ডালে-বসে-থাকা পাখি
ডেকে ওঠে, যেন বিস্মৃতির
আবরণ কোমল সরিয়ে
শোনাবে কাহিনী কোনো। পথিকের ক্লান্তি ঝ’রে গেলে
অকস্মাৎ কতিপয় ডাকাবুকো লোক
ঘিরে ধরে তাকে। জোরে শোরে শব্দ করে
সব পাখি আর শান্ত গাছদের পাতা। বুঝি ওরা
ভয়ানক ক্ষুব্ধ আর ভীষণ আহত।
‘কী তোমার নাম’ প্রশ্ন ক’রে ওরা খুব কটমট
তাকায় নিশ্রামরত পথিকের দিকে।
‘নগণ্য মানুষ আমি’, ব’লে সে নীরব হ’য়ে থাকে,
প্রসন্নতা-ছাওয়া দৃষ্টি মেলে দেয় হ্রদের গভীরে।
‘তোমার নাম ঠিক ঠিক ব’লে দে এক্ষুণি,
নইলে আজ বেঘোরে হারাবি প্রাণ’ ব’লে একজন
জাঁহাবাজ বুকে তার চকিতে ঠেকায়
বন্দুকের নল।
‘সামান্য মানুষ আমি, এর চেয়ে বড় পরিচয়
নেই কোনো এই অধমের। সদুত্তর নয় ভেবে
গর্জে ওঠে ভয়ঙ্কর রাগী মারণাস্ত্র, গোধূলির
রঙের মতোই রক্তধারা অবিরাম করে উচ্চারণ, ‘মানুষ,
মানুষ।
মুদ্রিত করেছি ভালবাসা
যদি বলি কবিতার দিকে মুখ রেখে কাটিয়েছি
কতকাল, মিথ্যা বলা হবে? যে কোনো ছুতোয় তার
বুকে ঝুঁকে থাকি অপলক, বসি গিয়ে বৃক্ষচূড়ে
কপোত-কপোত যথা-মাথায় থাকুন মাইকেল-
তার প্রতি ভালবাসা মুদ্রিত করেছি সারাবেলা।
কপোতাক্ষ নদীটির তীরে বসে মনে হয়, হায়,
প্রকৃত কবিতা আজও আমার নিকট থেকে দূরে
সরে আছে পর্দানশিনের লাস্যে; আমার ব্যথিত
হৃদয়ের চিতাগ্নিতে এইমাত্র ছিটিয়ে দিয়েছি
কিছু জল; ধোঁয়া ওঠে, কী ভীষণ চোখ জ্বালা করে!
কমিউনিস্ট ইস্তাহার, বলা যায়, নব্য প্রেরণায়
মুখস্ত করেছি; তবু অক্ষরের কেয়ারিতে দেখে
গোলাপের পেলবতা, পক্ষীর কটাক্ষ, ভ্রমরের
আড়িপাতা, কবিতাকে যত্রতত্র করেছি চুম্বন।