তিনজন
জ্যোৎস্নার আদর খেয়ে চিতাবাঘ শোভার ভেতর
নিভৃতে ঘুমায়। অকস্মাৎ খস্ খস্
শব্দে লাফাবার ভঙ্গি রচিত, দু’চোখ
ফস্সরাসের কণা ছড়ায়, আঁধার শিহরণের নববধূ,
পেশী টান টান, জ্যোৎস্না পান ক’রে তার
সমগ্র সত্তায় মদিরতা জেগে ওঠে, পরিপক্ক নিশীথের
মাংস দাঁতে গেঁথে খুঁজে নেবে
ঝোপের আড়াল, পাবে শব্দ-শিকারীর হরফের
মমতা এবং বাংলা কবিতার বুকে
চোখের আগুন তার রত্ন দশকের পরপারে।
দুর্ধর্ষ শিকারী কালো বন্দুকে উঁচিয়ে ধরে সেই
চলমান ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের দিকে।
কবির কলম বন্দুকের মুখটিকে মূক ক’রে
দিতে চায়; গুলির আওয়াজ ফেটে পড়ে, ঘন ঘন
আর্তনাদ, বিষাদ ভাসতে থাকে রুপালি প্লাবনে;
কলম এবং কবি রক্তস্নাত, শিকারীর পদতলে নিঃস্পন্দ,
নিথর।
তোমারই পদধ্বনি
এই লেখা উঠে এসেছে তোমার স্বদেশের বুক থেকে,
এই খেলা উঠে এসেছে এ দেশের প্রতিটি নদী থেকে,
যে সব নদী তরঙ্গায়িত হতো তোমার শিরা উপশিরায়,
এই খেলা উঠে এসেছে সেসব ক্ষেত থেকে,
যাদের ফসলের ঢেউ ধারণ করতো তোমার হৃদয়।
এই লেখা উঠে এসেছে তোমার প্রাণের স্বদেশের
গাছের শেকড়, পাখির বাসা, মাছের চোখ,
কৃষকের চঞ্চল লাঙল, শ্রমিকের শ্রমনিষ্ঠ হাত,
শত শত শহীদের জনক জননীর বিলাপ
বিচ্ছেদকাতর পক্ষিণীর মতো জীবন সঙ্গিনীর দীর্ঘশ্বাস,
আর
সন্তানের আর্তনাদ থেকে।
এই লেখা উঠে এসেছে সেই সিঁড়ি থেকে,
যেখানে পড়েছিলো ঘাতকের গুলিবিদ্ধ তোমার লাশ,
এই লেখা উঠে এসেছে তোমার বুক জোড়া রক্তাক্ত
গোলাপ থেকে
বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নব পরিণীতার
মেহদি-রাঙা হাত এবং
শিশুর নেকড়ে খোবলানো শরীর থেকে।
তোমার দিকে ওরা ছুঁড়ে দিয়েছিলো মৃত্যু,
কিন্তু ওরা জানতো না,
কোনো কোনো মৃত্যু জীবনের চেয়েও সতেজ মহিমান্বিত,
তোমার মৃত্যুর কাছে কোটি কোটি জীবন আজো নতজানু,
তোমার গুলিবিদ্ধ শরীর এখনো
রাজপথ-উপচে-পড়া মিছিলের সামনে।
যেখানে সমাজ বদলে ফেলার প্রেরণাময় বাঙ্ময় হয়
কোনো তরুণ কণ্ঠ, সেখানে বেজে ওঠে তোমার কণ্ঠস্বর,
যেখানে বুলেটের আঘাতে ঢলে পড়ে কোনো সংগ্রামীর
শরীর,
যেখানে আবার লাফিয়ে পড়ে তোমার দীর্ঘ, ঋজু দেহ,
যেখানে প্রতিবাদে উত্তোলিত হয় বাহুর অরণ্য,
সেখানে সবচেয়ে উঁচু তোমার সূর্যঝলসিত হাত।
এমন কোনো হাই-রাইজ দালান নেই এই শহরে,
যা তোমার উচ্চতাকে খর্ব করতে পারে।
এইতো আমরা দেখছি রৌদ্রময় মাঠে মধ্যবয়সী
কৃষকের সঙ্গে তুমি লাঙল ঠেলছো কড়া-পড়া হাতে,
এইতো তুমি খালি পায়ে এবড়ো খেবড়ো জমিনে হেঁটে
হেঁটে
গুণ টানছো নদীতে, দাঁড় বাইছো মাঝির সঙ্গে,
কারখানার চাকা ঘোরাচ্ছো মজুরের সঙ্গে
কাদায় দেবে-যাওয়া চাকা ঠেলে তুলছো গাড়িয়াল
ভাইয়ের
হাতে হাত লাগিয়ে;
সুন্দর ও কল্যাণের স্বপ্ন দেখছো
ওডেসিউসের মতো বেরিয়ে পড়েছো নব অভিযানে।
আদর্শবাদী তরুণের স্বপ্নে মিশে গিয়ে। এইতো তুমি
কসাইখানাকে ফুলের বাগান বানানো যার সাধনা,
তুমি সেই সাধনার অকম্পিত শিখা।
তোমাকে ওরা অবজ্ঞায়, অপমানে, অবহেলায়
ঠেলে দিয়েছিলো এই বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে
এক কবরে, অথচ আজ চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে
তোমারই পদধ্বনি, আলো-জাগানো ভাস্বর পদধ্বনি।
দাঁড়াও
দাঁড়াও এখনই তাকে সাজানো মঞ্চের মাঝখান
থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। আরো কিছুকাল তার
পার্ট বলে যেতে দাও। খানিক থমকে যাওয়া মানে
বেবাক বিস্মৃতি নয়, যদি তুমি লোভী বেড়ালের
মতো এরকম ঘুর ঘুর করো সারাক্ষণ, তবে
কীভাবে সে সামলে সুমলে নিয়ে আবার বাগানে
যাবে স্মিত ভোরবেলা, চারা গাছটাকে মমতায়
ঈষৎ নাড়িয়ে দেবে? দেখে নেবে রাঙা পাখিটাকে
এক ফাঁকে? এখনো কাপড়ে তার গোলাপ তোলার
কিছু কাজ বাকি, নাতনির সঙ্গে খেলবার
সাধ নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে। দূরে স’রে
দাঁড়াও, ফেলো না তার বুকে মুখে শীতল নিঃশ্বাস।
পুরাণের পাখি
না রাজু, তোমাকে আমরা ঘুমোতে দেব না।
এই যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তোমার শিয়রে
প্রতারিত, লুষ্ঠিত মানুষের মতো,
আমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই যে তোমাকে
ঘুমোতে দেবে।
জেগে থাকতেই ভালবাসতে তুমি
এই নিদ্রাচ্ছন্ন দেশে; অন্ধকারে দু’টি চোখ সর্বক্ষণ
জ্বলত পবিত্র দীপশিখার মতো,
সেই চোখে আজ রাজ্যের ঘুম।
না রাজু, তোমার এই ভঙ্গি আমাদের প্রিয় নয়,
এই মুহূর্তে তোমার সত্তা থেকে
ঝেড়ে ফেলো নিদ্রার ঊর্ণাজাল।
তোমার এই পাথুরে ঘুম আমাদের
ভয়ানক পীড়িত করছে;
রাজু, তুমি মেধার রশ্মি-ঝরানো চোখ মেলে তাকাও
তোমার জাগরণ আমাদের প্রাণের স্পন্দনের মতোই
প্রয়োজন।
দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুব করেছে তোমাকে।
টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া
তোমার রক্তের কণ্ঠস্বরে ছিল
পৈশাচিকতা হরণকারী গান। ঘাতক-নিয়ন্ত্রিত দেশে
হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি,
মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক
উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কণ্ঠে,
তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার
মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা
তাই ওরা, বর্বরতা আর অন্ধকারের প্রতিনিধিরা,
তোমাকে, আমাদের বিপন্ন বাগানের
সবচেয়ে সুন্দর সুরভিত ফুলগুলির একজনকে,
হনন করেছে, আমাদের ভবিষ্যতের বুকে
সেঁটে দিয়েছে চক্ষুবিহীন কোটরের মতো একটি দগদগে
গর্ত।
শোনো, এখন যাবতীয় গাছপালা, নদীনালা,
ফসলের ক্ষেত, ভাসমান মেঘমালা, পাখি আর মাছ-
সবাই চিৎকারে চিৎকারে চিড় ধরাচ্ছে চরাচরে, ‘চাই
প্রতিশোধ।‘
নক্ষত্রের অক্ষর শব্দ দু’টি লিখে দিয়েছে আকাশে
আকাশে।
যে-তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষণ্নতায়, সে নও তুমি।
প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু ক’রে আজও নতুন সভ্যতার
আকর্ষণে
হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে,
তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে
নিঃশঙ্ক মুদ্রায়,
ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,
তুমি বার বার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের
পাখি।