কবিতা লিখতে গিয়ে
কবিতা লিখতে গিয়ে প্রায়শ হোঁচট খাই আজ, ধন্দ লাগে
বার বার, আর অমাবস্যা নামে খাতার পাতায়
যখন তখন, তুমি সাক্ষী। কী ক’রে ফিরিয়ে আনি
পূর্ণিমাকে? জানি না সে মন্ত্র, শুধু ক্ষ্যাপা বাউলের
মতো ঘুরি গেরুয়া রঙের লুপ্ত লিরিকের পথে।
অন্ধত্ব আসন্ন জেনে আলোর ঝর্ণায় স্নান করি অবিরাম।
বাগানের ফুল ছেঁড়া হচ্ছে অবিরত, মাস্তানের
মরশুম চতুর্দিকে। ইদানীং ঘাতকেরা নির্ধারণ করে
আমাদের ভবিষ্যৎ নীল নক্শা টেবিলে ছড়িয়ে।
শতাব্দীর গোধূলিতে মহত্বের ধড় থেকে মুন্ডু ছিঁড়ে নিয়ে
লোফালুফি চিলে চন্ডালের আস্তানায়; এভাবেই
সব কিছু সকলের সহনীয় হ’য়ে যায়, অমাবস্যা বলে
নির্বোধের সমাবেশে। বসন্তের পিঠে
হঠাৎ বসিয়ে ছোরা কে দুর্বৃত্ত ধুলো ছুঁড়ে দিয়েছে চম্পট।
বর্বর পোড়ায় মনীষীর জ্ঞানলিপি হাড়হিম
শীতরাতে উত্তাপের লোভে।
এই শতাব্দীর সেরা গ্রন্থগুলি গণ শৌচাগারে
নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তবু আমি কেন কবিতার জন্য
নিজেকেই করি ক্ষয়, ধুলোয় মেশাই; তুমি বলেছিলে
বটে,
ধৈর্য হারিয়ো না; তাই আজও হাতে
রয়েছি কলম ধ’রে। সর্বক্ষণ ভয়-যদি কেউ এ তাণ্ডবে
আমার কলম কেড়ে নেয়।
কোনো তরুণকে
উজ্জ্বল তরুণ তুমি দিয়ো না সর্বদা নিষ্ঠীবন,
বিদ্রূপের বাছা বাছা তীর ছুঁড়ে তোমার সম্মুখে
কম্পমান কাকতাড়ুয়ার দিকে। তরুণ, একদা
তারও ছিল, যা তোমার আজকাল বন্দনীয় সাজ।
চারটি দশক প্রেমিকার ওষ্ঠ ছিল চুম্বনের প্রতীক্ষায়,
যখন তখন সে-ও আঙুলের ডগায় ফোটাতো
চেষ্টাহীন নক্ষত্রের ফুল, মাটি খুঁড়ে জাগিয়েছে
প্রস্রবণ, অলৌকিক দ্রাক্ষা রসে ভেসে গেছে তার
বুক বার বার আর ফসল তোলার গানে সে-ও
হ’য়ে উঠেছিল ক্রমে কিন্নরের যোগ্য প্রতিযোগী।
দ্রোহে তার হয়েছে চৌচির কত বিগ্রহের মুখ;
তরুণ, সদলবলে যাও যদি যেতে চাও তাকে
ফেলে রেখে বিরানায় ভিন্ন মৃগয়ায়। অতঃপর
ভুলেও কোরো না দাহ তার কোনো কুশপুত্তলিকা।
খনন
কে এক খননপ্রিয় লোক চলেছে নিয়ত খুঁড়ে
অগোচরে, খননের নিঝুম আওয়াজ
কানে আসে; যদি যাও তার কাছে দেখে নিতে কাজ
তার, দেখবে বসে আছে কর্মহীন, যেন কোনো কুঁড়ে
সমাসীন নিরালায়। সরে এলে তুমি
পুনরায়, বিনীত সে শব্দ উঠেবে বেজে
তোমাকে চমকে দিতে। অবারিত মাঠ, তৃণভূমি
শস্যের সম্ভাবনায় সেজে
ওঠে বুঝি সুবর্ণ রেখায়; বহুকাল থেকে সেই
অক্লান্ত খননপ্রিয় লোক
প্ররোচনাহীন আমাকেই
করেছে দখল ঠিক আমার অজ্ঞাতে। খননের তীব্র ঝোঁক
আমার ভেতরকার কাঁচা মাটি থেকে
তুলে আনে অক্ষরের নানা মূর্তি। চাদ্দিক আভায় যায়
ঢেলে।
গোলাপ বাগানে
কত সাধ করে হরফের নীড় সাজিয়ে ছিলাম; তড়পানো
পান্ডুলিপি, বাবুই পাখির বাসা যেন, খর তুফানের তোড়ে
এঁটেল মাটিতে গড়াগড়ি যায়, খড় সমুদয়
কুড়িয়ে আবার জড়ো করি, বিষাদের চোখ জ্বলে
নিরালায়।
এখনই কি উদ্যমের সোনালি প্রন্তর ছেড়ে অসহায় চলে
যাব কালো কুটিরে একাকী, অবনত? মুখ ঢেকে
রাখব হাঁটুতে ক্লান্ত, শস্যহারা কৃষকের মতো? প্রত্যাশার
শব পোড়ে ধোঁয়াটে শ্মশানে, ভয়ে চোখ বন্ধ করব না
আর।
কলকলে জলে ধুয়ে যাবে জেনেও বালক নদীতীরে গড়ে
সাধের বালির ঘর; আমিও কি অনুরূপ খেলা
নিয়ে মেতে আছি নিত্যদিন প্রতারক ভরসায়
শব্দের অতীত শব্দ ছুঁয়ে ছেনে? আমি এই খেলা ছাড়ব না।
আমার ললাটে আজ যৌবনের ভস্মটিকা, রক্তে হিমঝড়
অত্যাসন্ন, কে এক কংকালসার, ভয়ঙ্কর লোক
নিঃশব্দে আমাকে হাত ধ’রে টেনে নিতে চায় হু হু
হাড়ের উদ্যানে, আমি তার সহযাত্রী হ’তে অস্বীকার করি।
পুনরায় সকালবেলার রোদ চিকচিক করে মেরামত-করা
হরফের নীড়ে আর অস্ফুট শব্দের শিশু গলা
বাইরে বাড়িয়ে দেয়। এই আয়োজন সঙ্গে নিয়ে
স্বপ্নঙ্কিত পতাকা উড়িয়ে যাব আকাঙ্ঘিত গোলাপ বাগানে।
জমে দীর্ঘশ্বাস
লোকটা পুরানো এক কবরের কাছে ব’সে থাকে
প্রতিদিন, মাঝে-সাঝে ঘাস টানে, ধুলোর হরফে
কী-যে লেখে হিজিবিজি, ফুঁ দিয়ে ওড়ায়। কেউ তাকে
উত্যক্ত করে না, শুধু বালকেরা কখনো সখনো
কিছু বলাবলি করে, ফন্দি আঁটে ঢিল ছুঁড়ে দেবে
দৌড় মহল্লার দিকে। তার উদাসীনতায় কোনো
চিড় টিড় ধরে না ব’লেই ওরা এলেবেলে ভেবে
চলে যায়, তৃপ্তি খোঁজে চানাচুর, মালাই বরফে।
লোকটা হঠাৎ একদিন কোথায় যে অগোচরে
উদাস প্রস্থান করে। তাকায় না ফিরে, হেঁটে যায়
সহায় সম্বলহীন; কেঁপে ওঠে কবরের ঘাস
বুঝিবা বিচ্ছেদে, আজ কারো কোনো বেহালার ছড়ে
জাগবে না সুর, ছন্দপতনের রেশ কবিতায়
ফোটে আর পথের ধূসর হাতে জমে দীর্ঘশ্বাস।
ডালিমগাছ
তরুণী ডালিমগাছ রৌদ্রশুক্র করছে ধারণ
অসংকোচে, প্রসূনকে নদীজলে ভাসিয়ে দেবে না।
আকণ্ঠ রয়েছি ডুবে নিরাশায়, গাছটির দিকে
তবু চেয়ে থাকি, যেন আমার না-লেখা কবিতার
ফুল ফুটে আছে তার ডালে। বিপদে রয়েছি খুব,
নিজগৃহে ভাত রেঁধে প্রফুল্ল হাওয়ায় খেয়েদেয়ে
শান্তির বালিশে মাথা রাখা দায়। মানুষের মুখ
ক্রমাগত গরিলার মুখ হয়ে যাচ্ছে, চতুর্দিকে
ঘাতকের মজলিশ, তাদের নিশ্বাস বিষ ঢালে
বায়ুস্তরে আর সুন্দরের গলা চেপে ধরে ওরা
বাঘনখ প্রসারিত ক’রে। দেবদূত নর্দমায়
খাবি খায়, চাঁদের কলঙ্ক বেড়ে যায় প্রতিদিন।
পারি না কোথাও যেতে, ভূতলবাসীর মতো দিন
কাটে আতঙ্কিত, রাত্রি দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতায়।
উদ্ধারের পথ রুদ্ধ? শবাহারী পশুর উল্লাস
কানে আসে ক্ষণে ক্ষণে। অকস্মাৎ বরাভয় জাগে
বৃক্ষদের শ্যামল মুদ্রায়, বিজয়ীরা সমাগত-
ডালিমগাছের ডালে ফলগুলি হতেছে ডাগর।