- বইয়ের নামঃ হরিণের হাড়
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অদৃশ্য ছোরা
পর্যটনে কেটেছে সময়; হেঁটে হেঁটে কায়ক্লেশে
নিঃসঙ্গ ধূসরপ্রান্তে এসে গেছি। বসে থাকি একা,
অতীতের হাত কাঁধে, আমার চোখের জ্যোতি নিভে
যেতে চায়। সম্প্রতি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিশুত
রাতের গহন বাণী অক্ষরের আড়ম্বরহীন
আয়োজন ধরে রাখি। প্রাতঃকালে আকর্ষণ কমে
রচিত বাক্যের প্রতি। যেন আমি সম্পর্ক-রহিত
কবিতার সঙ্গে, ছন্নছাড়া আচরণে মেতে থাকি
কিছুক্ষণ, স্বাভাবিক মানুষের মতো পুনরায়
সমাজে প্রবেশ করে সমাজের বাইরের কেউ
হয়ে যাই খোলা আকাশের নিচে কিংবা বন্ধ ঘরে।
ভয়ঙ্কর চাদর আমাকে ঢাকে, অদৃশ্য ছোরার
ফলা থেকে রক্ত ঝরে, লুট হয় আমার নিঃশ্বাস;
খাতার পাতার সব অক্ষরে শোণিত চিহ্ন ফোটে।
অলৌকিক আলোর ভ্রমর
আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি? হায়েনা রাত্রিকে
দাঁতে ছিঁড়ে হেসে ওঠে, পথে শত শত
ট্রাক থেকে উপচে পড়ে লাশ।
যারা বেঁচে আছে তারা সব
শবের মতোই, হয়তো বা ভস্মমূর্তি, টোকা দিলে
ঝ’রে যাবে, কোথাও বাতির চোখ নেই।
দুঃসময় ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে ছোটে ইতস্তত,
তার চাবুকের ঘায়ে আর্তনাদ করে এ শহর
বাংলার রূপসী নদী, গ্রাম, শস্যক্ষেত সমুদয়;
মেঘের কিনারা থেকে চুঁইয়ে পড়ে অবিরল বিষাদের জল
এবং সন্তানহারা জননীর মতো শোকস্তব্ধ মুখে আজও
ব’সে আছে রাত্রিদিন আমার এদেশ।
ভঙ্গুর দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে পঙ্গু আর অন্ধের মিছিল,
শহরে ও গ্রামে দীর্ঘ থেকে
দীর্ঘতর হয় বিভ্রান্তির বহুরূপী ছায়া, ক্রূর
শক্রদের হট্ররোল বাড়ে ক্রমাগত আর মিত্রেরা নিঃসাড়,
চন্দ্রাহত রেস্তোরাঁয় অসার বচসা,
অজ্ঞানতা গ্রাস করে দশ দিক; মূঢ়তার মেঘে
ঢাকা প’ড়ে যায়
অগণিত শহীদের মুখ।
ঘাতকেরা আমাকে খুঁড়তে বলে আমারই কবর,
সম্ভবত সুসময় দেখা আর হ’লো না আমার।
শহীদেরা আজ শুধু অসহায় নাম, যা এখন কেউ আর
আবৃত্তির যোগ্য বিবেচনা
করে না তেমন?
বুঝি তাই মধ্যরাতের নূর হোসেনের কবরের
সোঁদা মাটি ফুঁড়ে কান্নাপ্রায়
আওয়াজ বেরোয়া-
“তবে কেন আমার তরুণ বুকে হায়েনার দাঁত বিদ্ধ হ’লো
তবে কেন আমার স্বপ্নেরা আজ শেয়ালের মলে
মিশে যায় অবলীলাক্রমে?
তবে কেন হায় মুক্তিযুদ্ধ শকুনের চঞ্চুতে কয়েদি হয়?”
বাংলার কবি আমি নগণ্য, গরিব;
আহত আমার ডানা, উড়তে অক্ষম
মেঘলোক; আমার হৃদয় পড়ে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো পড়ে,
প্রিয় নূর, তোমার বুকের রক্ত নিরন্তর। আমার কবিতা
ভিজে ওঠে বার বার, ধুলো মুছে যায়,
স্বচ্ছ হয় পবিত্র চোখের মতো আর এবাদতে
আকাশকে ছোঁয়, পুনরায়
তোমার সাহসে জ্ব’লে ওঠে
আমার শব্দের পথে, বাড়ির কার্নিশে, নিসর্গের বুদোয়ারে,
তারুণ্যের বুকে, শুভ সমাবেশে অলৌকিক আলোর ভ্রমর।
আগন্তুক
কাঁধে মধ্যরাত্রিকে ঝুলিয়ে,
ফুসফুসে নিয়ে
অতিক্রান্ত পথের ধূসর দীর্ঘশ্বাস
বাড়ি ফিরি একা। সিঁড়ি ভেঙে
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে
বন্ধ ঘরে ঢুকে দেখি-আমার চেয়ারে
অচেনা কে একজন ব’সে আছে, উশ্কো-খুশ্কো গালে
ক’দিনের না-কামানো দাড়ি,
দু’ভুরুর মধ্যখানে অমাবস্যা নিথর, গহন।
কী নাম? প্রশ্নের পিঠে আগন্তুক শূন্য ঠোঁট থেকে
‘ব্যর্থতা’ শব্দটি
কেমন গড়িয়ে দিয়ে আমার সম্মুখে তুলে ধরে
এক সিট হলুদ কাগজ,
গাঢ় কালো কালিতে কী যেন লেখা, দ’লে-
মুচড়ে সে কাগজ ছুঁড়ে দিই বাজে কাগজের
ঝুড়িতে না প’ড়ে। অকস্মাৎ রূপান্তরে
আগন্তুক একটানা শব্দহীন, খরা-ঝলসিত ঠাঠা হাসি।
আমরা ক’জন শুধু
নিজের সঙ্গেই আজ সারাদিন খেলি কানামাছি
কী জানি কিসের ঘোরে। মাঝে-মধ্যে কেমন অদ্ভুত
মনে হয় নিজেকে নিজেরই কাছে। কী ক’রে যে আছি
ভুল ইতিহাস শুনে, মূঢ়দের প্রগতির দূত
ভেবে নিয়ে; ঐ তো ওরা সর্বক্ষণ পেছনের দিকে
টেনে নিতে চায়, মনে ছড়ায় আঁধার মুঠো মুঠো।
এসব মুখের কোনো বাস্তবতা নেই, ওরা টিকে
আছে মিথ্যা পুঁজি ক’রে কুড়িয়ে ভ্রান্তির খড়কুটো।
কোথায় উদ্ধার ব’লে এমনকি ঘুমের ভেতরে
ভীষণ চিৎকার ক’রে জেগে উঠি, প’রে নিই ঠুলি
দু’চোখে আবার। শুনি কারা প্রকাশ্যে আমারই ঘরে
অস্ত্রে দিচ্ছে শান জোরে; আমার গলায় অত্রগুলি
নির্ঘাত বসাবে কোনোদিন নীল নক্শা অনুসারে,
আমরা ক’জন শুধু গেয়ে চলি তারে নারে নারে।
আমার এ শহরের চোখ
কোথাও ছিল না বৃষ্টিধারা, এ আমার শহরের
অশ্রুপাত; কেঁদে কেঁদে শহরের চোখ দু’টো লাল
আর অতিশয় ফোলা কেন
পারে না বলতে কেউ। কেন তার বুক ঠেলে এত
কান্না ওঠে প্রহরে প্রহতে
এ শহর নিজেও জানে না। আমি শুধু কবিতায়
কিছু অশ্রুকণা জড়ো করি অবেলায় ছোট ঘরে
অরক্ষিত, একা।
কখন জানালা দিয়ে প্রজাপতি ঘরে ঢুকে পড়ে
ফুলের পাপড়ির মতো, বসে
আমার গ্রীবায়, যেন সে অশ্রয়প্রার্থী, অসহায়,
নিজেকে বাঁচাতে চায় নিপীড়ন থেকে। এখন সে
কম্পমান, যেমন চারার পাতা দুরন্ত হাওয়ায়।
আমি কি পারব দিতে ওকে বরাভয়?
লুকিয়ে রাখব তাকে স্বপ্নের ভেতর,
আমার নিমগ্ন কবিতার ক্যামোফ্লোজে?
যা বলি বিশ্বাস করো-ফুরফুরে চড়ুই অথবা
মাছরাঙা, নিভৃত কোকিল,
দ্যুতিময় মাছ, বৃক্ষলতা, ফলমূল, ফুল
এখন কেউই নিরাপদ নয় আর।
যখন বয়স ছিল উনিশ কি বিশ,
তখন থেকেই আমি লিখছি কবিতা
প্রায় ভূতগ্রস্ততায়। কত রাত শব্দের সন্ধানে
প্রত্যুষের কাকের আওয়াজে
চমকে উঠেছি, আধা বোঁজা চোখে স্বপ্নের নগ্নতা
লেপ্টে গেছে কতবার। আমার প্রতিটি
কবিতাকে ওরা সারিবদ্ধ কয়েদীর মতো দাঁড়
করিয়ে ফুলেটবিদ্ধ করে আজ গোধূলিবেলায়
আমার আপন ভালবাসা
সজীব ফলের মতো গহন সবুজ পত্রালিতে
আচ্ছাদিত। কখনও কখনও তার চোখে
চোখ রেখে মনে হয়, এই রূপ কোথাও দেখিনি
কোনো কালে; এমনকি আমি তার চলে যাওয়ার ছায়ার
সঙ্গে প্রেমে ম’জে আছি। ‘এইতো এসেছি
ব’লে সে যখন দাঁড়ায় সম্মুখে, তার দিকে
ঘাতকের হাত প্রসারিত দেখে ভয়ে কেঁপে উঠি।
ক’দিন বা আছি আর? তারপর অনন্তের পথে
ছায়া হ’য়ে হেঁটে যাওয়া, হেঁটে যাওয়া, শুধু হেঁটে যাওয়া।
অথচ এখনই বন্ধ দরজাটা ঠেলে
ভেতরে আসতে চায় হন্তারক নরকের কুকুরের মতো
দাঁত নখ ভেজাতে শোণিতে। আমার এ শহরের
চোখ ভরা রক্তাশ্রুতে রাত্রিদিন; কে দেবে মুছিয়ে
তার চোখ চুমোর জ্যোৎস্নায়, কে সে? বলতে পারি না।
তার পদধ্বনি বাজল কি আজ দিগন্তের বুকে
গুণীর তানের মতো? আমার শঙ্কিত কাঁধে দৃঢ়তা অর্পণ
ক’রে বলে উঠবে কি, এ শহরে মৃত্যুর উৎসব বাঁচবে না?
শহর ঘুমিয়ে ছিল পরিশ্রান্ত শ্রমিকের মতো।
কবি তার সদ্য লেখা কবিতার পঙ্ক্তিমালা জিভে
খেলিয়ে খেলিয়ে বিছানায় গেছে, স্বপ্নের ভেতর
নদীর কিনারে ব’সে গোণে ক’টি সারস নেমেছে
বালুচরে। নতুন কবিতা তাকে দেয় না ঘুমোতে
মাঝে মাঝে, দপ দপ করে চোখে, শিরায় শিরায়।
অকস্মাৎ ২৪টি ঘন্টা বেজে ওঠে দেশ জুড়ে,
কবি শোনে ছন্দোময় ভোরে লেখার টেবিলে ব’সে।
সাহস শব্দটি আজ বিশাল হরফে লেখা হ’ল
সারা দেশে, স্বাধীনতা ২৪টি অনিন্দ্য গোলাপ
হ’য়ে ফোটে জনতার হৃদয়ে এবং খলখল
অন্ধকার কেটে চলে নিরন্তর আলোর তরণী।
ঘন্টাধ্বনি প্রতিবাদী কবিতার মতো জাগরণী
মহামন্ত্র শোনায়, নিমিষে শহরে চোখ থেকে
ঘুম মুছে যায়, চেয়ে দেখে ২৪টি মুখ তাজা
ভোরবেলাকার মতো। নদীতে পা ধুয়ে কবি হেঁটে
যায় কিয়দ্দূরে নিতে আলোকিত প্রকৃত নিশ্বাস,
২৪ সংখ্যাটি যে ইন্দ্রজালে হ’লে ইতিহাস।