মায়াবিনী মূলে
রোজকার মতো আজও ভোরবেলা তোমাকে ছাড়াই
জেগে উঠি এই বাসী শয্যায়। তুমি নেই তবু
মিছে হাতড়াই, বাঁদিকে আমার শূন্যতা থেকে
ছায়ার মতোই কী যেন জন্ম নিল মনে হয়-
জায়মান সেই বস্তুর প্রতি তাকাতেই দেখি
ছায়ার চেয়েও অধিক ছায়াটি চকিতে মিলায়।
টুথব্রাশ মুখে জানালার ধারে একলা দাঁড়াই,
নিজেকে কেমন ন্যালাক্ষ্যাপা আর ভারি জবুথবু
লাগে, যেন আমি একতাল ঘুম। হাওয়া যায় ডেকে
ফিসফিসে স্বরে বারান্দাটায়, একি বিস্ময়,
কারো চেনা নাম। যা ছিল আমার চারপাশে মেকি
এবং ঠুনকো সাদা গোলাপের গাথা হয়ে যায়।
আমার ভুরুতে স্বপ্নের ছায়া। দরজায় এসে
দাঁড়ালে কি তুমি? সামনের দিকে এগোতেই চোখে
থান কাপড়ের মতো শুভ্রতা হয় মরীচিকা।
এখানে তোমার না-থাকার বুনো আন্ধার দিয়ে
করি আচমন। এই তো হঠাৎ ভেসে আসে সুর
বাথরুম থেকে, তুমি কি গাইছ শাওয়ারটা খুলে?
তোমার শরীর নিমেষে রচিত সে সুরের রেশে।
আমি তাকে বাঁধি বাহুতে নিবিড় অতীতের ঝোঁকে,
কিন্তু আমার আশ্লেষে এ কি শরীরের শিখা
ছায়া হয়ে গলে, জল হয়ে ঝরে। দৃষ্টি সরিয়ে
দেখি ডুমুরের পাতা উড়ে যায়, ঝরে অতিদূর
ডোবায় এবং তুমিহীনতার মায়াবিনী মূলে।
যখন অনেকে সগৌরবে
যখন অনেকে সগৌরবে বাণিজ্যেতে ছুটে যায়
অথবা সাধের চাকরির অলৌকিক
গুহায় প্রবেশ করে প্রত্যহ, তখন
আমি এক রূপসীর নিরিবিলি গুলবাগে যাই।
যখন অনেকে করজোড়ে গদগদ কণ্ঠস্বরে জাঁরেল
আমলা তোষণে মেতে ওঠে কিংবা নতজানু হয়
দীপ্র শিরস্ত্রাণের সমুখে, তখন
আমি সেই সুন্দরীর রূপবর্ণনায় মগ্ন হই।
যুদ্ধের মাহাত্ম্য আমি কস্মিনকালেও
করি না প্রচার, পরাক্রান্ত বীরদের গাথা লিখে নাম কিনে
ধন্য হতে চাইনি কখনো, আমি শুধু
গৃহকোণে বসে একা অক্ষর সাজাই এক নারীর উদ্দেশে।
যখন অনেকে দিনরাত্রি ম্যামনের স্তব করে
প্রাণপণে, ম্যামনের স্বর
তাদের অতৃপ্ত কণ্ঠে করে ভর, তখন আমার
কণ্ঠস্বর সবার অলক্ষ্যে কন্দর্পের কণ্ঠস্বর হয়ে যায়।
যখন অনেকে জয়োল্লাসে অতিশয় মত্ত হয়ে,
যেন যদুবংশ, কুচকাওয়াজের দৃপ্ত ভঙ্গিমায়
সমস্ত শহর করে প্রদক্ষিণ, তখন একাকী আমি গূঢ়
বেদনার পথে হেঁটে প্রিয়তমার উদ্দেশে করি অশ্রুপাত।
যখন অনেকে খুব ঝুঁকে স্থুলকায়
জাবেদা খাতার রঙবেরঙের হিশেব-নিকেশ
করে নিত্য, তখন নেহাৎ বেহিসেবী আমি, হায়,
অগোচরে কাগজে শিশিরবিন্দু, ঘাস, মেঘ, চুমো জড়ো করি।
যখন অনেকে ক্রূরতার মদিরায় বুঁদ হয়ে রয়,
তখন সবুজ গ্লাসে সুন্দরীতমার
ঢেলে-দেয়া পানিতে চুমুক
দিয়ে আমি আকুল তৃষ্ণায় আবেহায়াতের স্বাদ পেতে থাকি।
পুণ্যবানদের মতো আমার কপালে, হা কপাল,
একনিষ্ঠ নামাজ পাঠের দাগ নেই,
অথচ আমার
হৃদয়ে বেড়াই বয়ে কত দহনের চিহ্ন সারাদিনমান।
শহুরে বাগানে
শহুরে বাগানে রাঙা প্রত্যুষে
রূপসী কুড়ায় শিউলী ফুল।
নুয়ে-পড়া তাকে দেখেছি তো ঠিক?
নাকি এ আমার চোখের ভুল?
গত রাত্রির স্বপ্নের ঢেউ
অবয়বে তার এখনো বয়।
তন্বী বুকের যুগল চূড়ায়
গোলাপ-জাগানো সূর্যোদয়।
এত ভোরে এই নির্জনে তার
চুপিসারে আসা হয়নি ঠিক;
মনে মনে বলি, তাকে ঘিরে থাক
সকল সময় মাঙ্গলিক।
গ্রীবা জুড়ে তার অতিশয় সাদা
কুয়াশার মতো রয়েছে কী-যে।
নাভিমূলে লাগে শিশিরের ছোঁয়া
পায়ের পাতাও উঠেছে ভিজে।
চুলে ভিড় করে শত প্রজাপতি,
কিটদেশে দোলে হাওয়ার মালা।
গোলাপি শিখার মতো যৌবন
হৃদয়ে ছড়ায় চৈত্রজ্বালা।
হঠাৎ একটি কালো ঘোড়া এসে
পিঠে নিয়ে ওকে মিলায় মেঘে।
ক্ষুরের শব্দ প্রতিধ্বনির
মতো চেতনায় রইল জেগে।
খোঁপা খসে যায় বেগানা রাতের
নিঝুম তৃতীয় প্রহর শেষে,
স্তন থেকে তার ডাগর গোলাপ
উড়ে যায় কোন্ নিরুদ্দেশে।
দূর থেকে দেখি রাঙা প্রত্যুষে
শিউলি গাছের অশ্রুপাত।
হাওয়ার দুয়ারে এক যেন নিয়ত
অদৃশ্য হাতে করে আঘাত।
ধু-ধু শূন্যতা গোঙায় কেবলি,
চারদিকে নেই কোথাও কায়া।
শিউলী তলায় ছায়ার মতন
হাতে কেউ শুধু কুড়ায় ছায়া।
সকাল-সন্ধ্যা আবার ব্যাকুল
চোখ খোঁজে তাকে দিগ্ধিদিক।
মনে মনে বলি, তার সত্তায়
নিয়ত ফুটুক মাঙ্গলিক।
স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার
এবারও সে, ফয়সল, আসেনি, অথচ কথা ছিল
আসবে, বসবে নকশাময়, রঙচটা
খাটে আর
ধরবে সস্নেহে হাত বর্ষীয়ান মহিলার, সতৃষ্ণ তাকাবে
আড়চোখে গৃহকোণে দাঁড়ানো সুন্দরী
তরুণীর দিকে, চশমার কাচ মুছবে খানিক
সফেদ রুমালে,
পানি খেতে চেয়ে গ্লাস ধরবার ছলে
এক ফাঁকে ছুঁয়ে নেবে তার কম্পিত আঙুল যার
ঈষৎ সবুজ
শালের আড়ালে মূক হয়ে আছে প্রগলভ যৌবন, খোলা ছাদে
বলবে অনেক কথা তরুণীর কানে কানে, চুমো
খাবে তাকে খইয়ের যতন
নক্ষত্র ছিটানো আকাশের নিচে স্পন্দিত শরীরে।
না, এসব কিছুই ঘটেনি এই শীতে। ফয়সল কথা দিয়ে
আসেনি নিষ্প্রভ ঘরে। অসুখের খর
জিভ চেটেপুটে
খেয়েছে বেবাক পলস্তারা, দেয়ালের কুলুঙ্গিতে
ব্যর্থতা নিয়েছে ঠাঁই, হতাশা মৌরসীপাট্রা পায়
বিবর্ণ খিলানে। সাধাহ্লাদে ভরপুর
স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার তৃতীয় প্রহরে
রবীন্দ্রনাথের
ক্ষুধিত পাষাণে অতীতের রূপসীরা যে-রকম। কৃষ্ণসার
হরিণেরা তন্বীর হাতের তেলো থেকে
আকাঙ্ক্ষার তৃণ মুখে নিয়ে
পলাতক বহুদূরে। সিংহভুক্ত হরিণের ভগ্নাংশের মতো
জায়গায় সে বসে থাকে বড় একাকিনী।
নিঃশব্দে সকাল-সন্ধ্যা প্রতীক্ষায় কাটায় সময়
ঝিঁ ঝি-ডাকা রাতে
হ্যারিকেন হাতে ঠায় সে দাঁড়িয়ে থাকে,
পাছে ফয়সল ফিরে আসে
প্রতিশ্রুতি রক্ষার তাগিদে ডাকিনীর
ছড়ানো চুলের মতো অন্ধকারে। নির্বিকার পথ অকস্মাৎ
কেমন নির্দয় আর ব্যঙ্গপরায়ণ হয়ে ওঠে,
তবু সে তরুণী সরায় না
চোখ পথ থেকে, রূপ তার অন্ধকারকে পরায়
অপরূপ সৌন্দর্যের সাজ।
ফয়সল কিংবা তার মতো অন্য কেউ
তারা কি কখনো কথা দিয়ে ফিরে আসে কোনও দিন?