প্রবাদকে মিথ্যে করে দিয়ে
লোকটাকে বহুক্ষণ ধরে ওরা ভীষণ পীড়ন
করছিল; ওর ত্রস্ত চক্ষুদ্বয় সূর্যের কিরণ
দেখতে পারবে কিনা পুনরায়, এমন সন্দেহ মনে উঁকি
দিচ্ছিল আমার, তাই ঝুঁকি
নিয়ে কাছে গিয়ে বলি, আসলে সে নয়
দোষী, মানে ধৃত অর্ধমৃত এই লোকটার ভুল পরিচয়
ফেলেছে বিপদে তাকে। সে-যে নয় আমি, এ-কথা কসম খেয়ে
নিশ্চিত জানাতে পারি। যুক্তি-তর্কের দাঁড় বেয়ে
বেয়ে ক্লান্ত হয়েও ওদের কে প্রকৃত অপরাধী
আমি না সে লোকটা, বোঝাতে ব্যর্থ হই। ফরিয়াদি
সেজে আমি যত বলি সে-তো জন্ম বোবা-
তত ওরা ‘আরে তোবা তোবা’
বলে তার কোমরে পেঁচিয়ে দড়ি সগৌরবে নিয়ে
যায় ঠেলে ঠুলে জেলে প্রবাদকে মিথ্যে করে দিয়ে।
প্রামাণ্য চিত্রের অংশ
ভাদ্রের দুপুর চিল্লাচ্ছে পুরানো ঢাকার
কলতলার
ঝগড়াটে যুবতীর মতো। একটার পর একটা বাস
ক্রমাগত ছুটে যাচ্ছে, বাস-এ চড়তে গিয়ে যাত্রীদের নাভিশ্বাস
উঠছে ভীষণ। দূর থেকে দেখলাম
লোকের ভিড়ে তাঁকে। তিনি রীতিমতো
গলদঘর্ম, ভ্যাবাচ্যাকা, যেন আহত
চিল। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও সময়কে চড় কষিয়ে-যাওয়া বাসে ঠাঁই
পাচ্ছেন না। ‘ও ভাই
কন্ডাক্টারের নেই। মনে হয়,
হয়তো এবার ভিড় ঠেলে
কনুই চালিয়ে উঠে পড়বেন, অথচ এই বাসটাও
উধাও তাঁকে ফেলে।
বাসের পর বাস আসে, যায়,
হাত নেড়ে নেড়ে ক্লান্ত তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক ঠায়।
তিনি, আবদুস শহীদ, খাপরা ওয়ার্ডের বিপ্লবী,
আজ এ কেমন ছবি
তাঁর! শোণিতে শর্করার কোলাহল, দ্রুত তন্তুক্ষয়,
একদা স্বপ্নের বীজময়
উর্বর চোখের নিচে দুঃসময়ের কালি নিয়ে রাস্তার ধারে
ভাদ্রের দুপুরে বন্দি, পরিত্যক্ত। বারের বারে
তাকাচ্ছেন পথের দিকে,
হয়তো অনেক দূরের কিছু ফিকে
স্মৃতি রক্তচক্ষু কোকিলের মতো গান গেয়ে
উঠছে নাছোড়ে, তিনি চলেছেন খেয়া বেয়ে
ভাটির টানে। বৈঠায় শ্যাওলা জমে,
আজও কালবেলায় অমোঘ জাল ফেলে কেন তাঁকে টেনে
নেয় না যমে?
বাসের পর বাস আসে যায়,
ধূসর বিপ্লবী এখনো আছেন দাঁড়িয়ে পথে অসহায়।
তাঁর প্রতি বস্তুত ভ্রূক্ষেপ নেই কারো। ধারালো অস্ত্রে
জং ধরলে, রঙচঙে মখমলের বস্ত্রে
তাকে রাখলেও বাড়ে না গৌরব তার,
একথা ভালোই জানেন তিনি, আবদুস শহীদ। যতক্ষণ থাকে ধার
ততক্ষণই অস্ত্রের প্রতি অটুট সতর্ক মনোযোগ,
হোক সে শেয়াল, নেকড়ে বাঘ কিংবা ঘোগ।
ভাবি নিশ্চয় এবার তিনি, খাপরা ওয়ার্ডের বিপ্লবী, রাস্তার
মাঝখানে সটান দাঁড়িয়ে ছুটন্ত বাসটার
ঘাড় ধরে গলায় ঠাটা বাজিয়ে বলে উঠবেন, ‘হেই,
আমাকে এভাবে ফেলে যাবার অধিকার কারো নেই।
প্রেতের নিকট থেকে
রাত এক্কেবারে চুপ মেরে গেছে। ধরে নিচ্ছি,
এ মুহূর্তে তুমি গা এলিয়ে
দিয়েছ শয্যায়,
বালিশে ছড়ানো চুল, যে বইটা পড়ছিলে তার শব্দশোভা
স্মৃতিতে প্যাস্টেল চিত্র। তুমুল ঘুরছে চকচকে
পাখার তিনটি ব্লেড। বাম পাশে ঘুরে তুলে নিলে
হাতঘড়ি, জ্বলে রাত বারোটা, আয়ত
চোখে জ্বালা, ঘুম বিছানার চারদিকে থই থই, ধু-ধু চোখে নেই,
বারবার শুধু মনে পড়েছে তাকে, যে তোমার প্রিয়
স্বপ্ন চেটেপুটে
দিয়েছে গা ঢাকা লুটেরার মতো। তুমি
অতীতের মঞ্জরী ফুটিয়ে চিদাকাশে
তার অবয়বহীন মাথা বুকে টেনে নিয়ে পোড়াচ্ছ নিজেকে।
একটি প্রেতের কাছে তোমার হৃদয়
এখনো গচ্ছিত রেখে অস্তিত্বে লালন করো ধোঁয়াটে শ্মশান।
রাত্রির ভেতরে রাত্রি গড়ায় কেবলি, যেন কালো উন্মাতাল
ঢেউয়ের ভেতরে ঢেউ; জেঁকে আসে ঘুম
তোমার শরীরে রাত দেড়টায়। ঝিঁ ঝিঁ পোকা শূন্যতার গায়ে
লেপ্টে থেকে ক্রমাগত ডেকে যায় আর
তখন তোমার দরজার কিয়দ্দূরে একজন
দীর্ণ কবি, তোমাকে যে তার প্রিয় প্রেমের কবিতা
ব্যাকুল শোনাতে দীর্ঘ সময় নিয়েছে,
রয়েছে দাঁড়িয়ে ঠায় সেই কবে থেকে। তুমি তাকে
তোমার অধর, স্তন শ্রোণীর লুণ্ঠনকারী পুরুষের মোহে
দেখতে পাওনি। হোশ-হাওয়াসবিহীন
বেখাপ্পা কবির দিকে চটুল তাকিয়ে
অকস্মাৎ রাত্রি হো হো হেসে ওঠে বেশরম গণিকার মতো।
বন্ধ দরজার ঔদাস্যের গূঢ় নিস্তব্ধতা থেকে
কুড়িয়ে স্বপ্নের ছাই জবুথবু কবি
হেঁটে যায় বড় একা রাত্রির হাওয়ায়। জপছেন
কানে কানে তার একজন
মরমী সাধক-বারবার
কী ঘর বানাও তুমি শূন্যের মাঝার? মগজের
ভেতরে গুঞ্জন তার। ফিরে গিয়ে নিজস্ব ডেরায়
রাত জেগে খাতার পাতায়
সারি সারি অক্ষরের গায়ে ভোরের আবীর নিয়ে
প্রেতের নিকট থেকে কেড়ে নিতে চায় ছায়াময় জয়োল্লাস।
ভূপ্রদক্ষিণ
জর্নাল নিখোঁজ ঝড়ে, দিনক্ষণ মনে নেই; ছুট
কাটাতে প্রবাসে ছিঁড়েছিলাম বাদামি, সাদা রুটি
ক্যাফেটারিয়ায়, কফি খেয়ে গাইডের সঙ্গে গিয়ে
উঠেছিল নেচে প্রাণ অঞ্জলিতে ঝরনাজল নিয়ে।
দুপুরে ঢাকায় ফ্ল্যাটে শুয়ে অকস্মাৎ মনে পড়ে-
শুল্ক বিভাগের বেড়া ডিঙিয়ে প্রাচীন সে নগরে
তোমার স্তনের ডৌল দেখে নিয়ে সতেজ আপেলে
পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি দেখি সিস্টিন চ্যাপেলে।
মানুষকে নিয়ে
আকাশকে আকাশ বলেই চেনা যায়। পাহাড়কে
পাহাড় না বলে অন্য কিছু
বলবার কোনো মানে আমি খুঁজে পাই না, যদিও
নদীকে উপমা দিয়ে সাজানো তেমন
কঠিন ব্যাপার নয় কস্মিনকালেও তবু নদী
অবিকল নদী থেকে যায়।
কখনো-সখনো কোনো কোনো
মানুষকে ডুমুরের ফুল বলা হয়,
কিন্তু তাতে ডুমুর গাছের অভিধার
হেরফের হয় না কিছুই।
সিম্পাঞ্জিকে শিম্পাঞ্জি অথবা
বাঁদরকে বাঁদর হিসেবে যদি শনাক্ত করেন
কেউ তবে যথার্থই হবে। অরণ্যের ডোরাকাটা
বাঘ গর্জনা না করলেও
তাকে বাঘ বলা যাবে দ্বিধাহীন। মেনী বেড়ালকে
বনের বাঘের মাসি বলে জানি, অথচ বেড়াল
বেড়ালই সঠিক।
কিন্তু যত ফ্যাসাদ, ঝামেলা অদ্যাবধি
মানুষকে নিয়ে। সত্যি বলতে কি, মানুষ বিষয়ে
কোনো স্থির সিদ্ধান্তের ঘাটে
বিশ্রাম নেয়ার পথ জানা নেই। আজ যাকে তুমি
ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে
জানে না এমন কেউ বলে জানো, কাল
সে ভীষণ ধড়িবাজ হয়ে দেখা দেবে অকস্মাৎ। রবিবার
যার হাত খুব সাদা প্রতিভাত হবে,
সোমবার তার হাতে মানুষের শোণিতের ছোপ
দেখে তুমি শিউরে উঠবে। আর বন্ধু যে কখন
শক্রর নিখুঁত ভূমিকায় নেমে যাবে
তার সঙ্গে তুমি অষ্টপ্রহর থেকেও ঘুণাক্ষরে
কখনো পাবে না টের। অন্যদের চায়ের আসরে
যে তোমাকে পাঠাবে হাবিয়া
দোজখে হাজারবার, সেই একই লোক তোমার টেবিলে
এসে বেদনার ভারে কেঁদে বেদানার
দানার মতোই লাল করে ফেলবে দু’চোখ তার। এরকম
জন্ম-অভিনেতা
খুঁজে মেলা ভার। কোনো কোনো
লোককে মানুষ নাকি হায়েনা বলবে, এ বিষয়ে
তোমাকে বেজায় ধন্দে থেকে যেতে হবে চিরকাল।