পুতুল পূরাণ
পুতুলটি সে, হাল আমলের যুবক, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে
নিছক খেয়ালবশে আনল কিনে। সে বিবাহিত
নয়, ওর ঘর হয় না মুখর কোনো শিশুর
হাসির ঝরণাধারায়। পুতুলটি ওর, যুবকের, হারানো
শৈশবকে আকর্ষণ করে
মধ্যদুপুরে অথবা বিকেল-জেলের জমকালো আলোর জাল
গুটিয়ে নেয়ার মুহূর্তে। পুকুরে মেঘের ছায়া,
জানালা থেকে দেখা
কিছু গাছগাছালি আর গলির মোড়ে আস্তাবলে
ঘোড়ার ঘাসবিচালি,
ভেজা ছোলা খাওয়া, কোচোয়ানের চোখে ঘোড়দৌড়ের
ছবি, জখমি ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘ চুল খেলিয়ে
এলিয়ে থাকা হুরীর
থই থই জওয়ানী, নড়বড়ে টুলে বসে
দো-আনির চা খাওয়া, গলির ভেতরে জুয়াড়ির
আসা-যাওয়া-যুবককে
দাঁড় করিয়ে দেয় বাল্যকালের মুখোমুখি। আপাতত
সুখী নয় সে, মাথা রাখে বিষাদের ডালে।
ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিনে আনা পুতুল, মানে
একটা মেশিন, ভোরবেলা হঠাৎ
নড়ে ওঠে চমৎকার ভঙ্গিতে, যুবকের ভালো লাগে এই সঙ্গীকে।
মনে হয়, রঙধনু ছড়িয়ে পড়ে
ঘরে, যখন সেই মেশিন ঘুরে বেড়ায় আশেপাশে
দম দেয়া ছাড়াই। ছোট আর রঙিন খেলনার মতো
মেশিনের সঙ্গে তার খেলা, বলা যেতে পারে,
সারাবেলা। মেশিনটাকে বারবার দেখা নানা
কোণ থেকে, একটু স্পর্শ করা
আদর-ঝরানো আঙুলে শিশুর মতো দুলিয়ে দুলিয়ে
ঘুম-পাড়ানো, ছড়া কাটা,
পুতুলকে ঘিরে সাইকেডেলিক ছবি দেখা
হয়ে ওঠে যুবকের নাছোড় নেশা। বস্তুত বিবাহিত
সে এই মেশিনময় প্রহরের সঙ্গে।
খেলাচ্ছলে মেশিনটাকে ফিডিং-বটল দিয়ে সে
দুধ খাওয়ানোর ভান করে
কখনো কখনো, আবার ওষুধও খাইয়ে দেয় ঘনঘোর
বর্ষার দিনে, যেন সর্দিতে
ভুগছে তার পুতুল। মাঝে মধ্যে নৃতত্ত্ব অথবা দর্শনে বই
তুলে দেয় মেশিনের হাতে, জপাতে চেষ্টা করে
মার্কস আর এঙ্গেলস-এর
নাম, পুতুলের মনোরঞ্জনের জন্যে ক্যাসেট প্লেয়ারে
বাজায় পপ গান, বোঝায় পাখি-পড়ার মতো
কেউ টেড হিউজ কে-ইবা টম গান। তারপর নিজেই হেসে ওঠে
ঘর কাঁপিয়ে, বেরিয়ে পড়ে কালো মখমলের জ্যাকেট
চাপিয়ে গায়ে, মধ্যরাতে ফিরে আসে স্খলিত পায়ে।
যুবকের আদর আপ্যায়নে
মেশিন, তার রঙিন খেলনা, পুতুল , বাড়তে থাকে
দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দিনের পর দিন
রাতের পর রাত; প্রথমে একটু একটু করে,
পরে লাফিয়ে লাফিয়ে। মেশিনের আকারের
তুলনায় ঘর যেন দেশলাইয়ের বাক্স। অকস্মাৎ ছাদ ফুঁড়ে
বেরিয়ে পড়ে মেশিনের মাথা; হাত
দেয়াল ভেদ করে অশত্থের শাখার মতো
প্রসারিত হয় পৌরপথে। স্তম্ভিত যুবক টিপ করে
মাথা ঠেকায় মাটিতে মেশিন-পুতুলের
উদ্দেশ্যে, যেমন গুহামানব
মাথা নত করত, হতো নতজানু বিশাল কোনো
বৃক্ষ কিংবা পাহাড়ের সামনে। যুবক
তার এই ভয়ংকর পুতুল নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না।
এখন মেশিন ওর দিকে তাকায়
একনায়কের দৃষ্টিতে, ভীষণ ধাতব হাতে তুলে নেয়
যুবকটিকে, তারপর শুরু করে অবিরাম লোফালুফি
যেন দক্ষ অ্যাক্রোবেটের
করতলে একটা চাকতি কিংবা বল। একদিন
অমাবস্যা রাতে মেশিন
মুখে পুরে নেয় প্রভু যুবককে, খেলাচ্ছলে
গিলতে থাকে এবং সেই যুবক
মর্মমূল-ছেঁড়া চিৎকার করতে গিয়েও
পারে না, দ্রুত বিলীন হতে থাকে নিঃসীম একাকিত্বে।
প্রতিবাদী কবিতার সংকলন
দীর্ঘকাল পর, মনে হলো, শুনতে পেলাম দেয়ালের শিস
শহরের অন্ত্যজ পাড়ায়। আবর্জনা,
ড্রেনের উগরে-দেয়া কুট গন্ধ সত্ত্বেও মেজাজে
রুক্ষতার রোঁয়া তীব্র গজিয়ে ওঠেনি। আসমানে কবুতর।
বিকেলে চায়ের স্বাদ নিতে চেয়ারে হেলান
দিয়ে পড়ছিলাম নিভৃতে
প্রতিবাদী কবিতার সংকলন। রক্তে জ্বালা ধরে
মানবতা আর সভ্যতার লাশঘেরা হাহাকার শুনে। কিছু
চিত্রকল্প বিপ্লবীর মতো
আমাকে ঝাঁকুনি দেয় শক্ত হাতে, আমার সত্তার
দিকে চেয়ে থাকে স্বপ্নময় চোখ মেলে। ভেসে ওঠে
দৃষ্টিপথে চাবুকের দাগময় হাজার হাজার
নগ্ন পিঠ, চকচকে বিশুদ্ধ বুটের লাথি-খাওয়া
সম্ভ্রমের মুখ-থুবড়ে-পড়া থাকা দেশ-দেশান্তরে।
পঙ্ক্তিমালা ঈগলের মতো উড়ে ঠুকরে ঠুকরে
খাচ্ছিল আমার হৃৎপিণ্ড, করোটির
ভেতরের স্নায়ুপুঞ্জ। অকস্মাৎ পাড়া-কাঁপানো কান্নায় ফিরে
প্রতিবাদী কবিতার সংকলন
থেকে চেনা প্রতিবেশে। কান্না শুনে বুকের ভেতর
আদিম যুগের সন্ধ্যা নামে,
জেগে ওঠে বলি-দিতে-নিয়ে-যাওয়া কুমারীর বন বনান্তরে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়া করুণ চিৎকার। কিছুক্ষণ
চুপ থেকে, পায়রার ওড়াউড়ি দেখে
আবার বুলোই চোখ বৈশাখী ঝড়ের মতো পঙ্ক্তিময় বইয়ে।
পুনরায় কান্না ভেসে আসে, খুব কাছ থেকে
নারীসত্তা দীর্ণ করা কান্না, যেন বা ঢেউয়ের ভেঙে
পড়া শিলাতটে; পুরুষের তর্জন গর্জন শুনে মনে হয়
দানবের বসবাস নয় শুধু পুরাণের প্রাচীন পাতায়,
ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে খুঁজি সে কান্নার উৎস,
জানাই সরোষ প্রতিবাদ,
কিন্তু আমি ফ্ল্যাটে ক্ষুব্ধ, ভব্যতার খাঁচায় কয়েদ হয়ে থাকি,
হাতে প্রতিবাদী কবিতার সংকলন।
প্রতীকী চিত্রের মতো
ভোরে চোখ মেলে দেখি ঘরের দেয়ালে
রোদ্দুরের নক্শা ঝুলে আছে
প্রতীকী চিত্রের মতো আর
নারকেল গাছের ডালটা,
আলোর লেবাস-পরা, জানলার গ্রিলে
সবুজ চুম্বন আঁকে। হাওয়া দিচ্ছে; ডালটার সঙ্গে, ইচ্ছে হলো,
হ্যান্ডশেক করি, যে-ইচ্ছের গ্রীবাটিকে খুব
সন্তর্পণে খর্ব করে রাখি
কতিপয় লোকের বেলায়।
গর্বের ব্যাপার নয়, তবু
এ রকম অন্তত নিজের কাছে ফিসফিস করে
বলতেই হয়,
যেমন পুরাণে আছে গর্তে মুখ রেখে একজন
অন্তরালে বলেছিল কথা।
হঠাৎ বিছানা ছেড়ে দাঁড়াই ঘরের মাঝখানে;
কোনো পাখি কিংবা কোনো ফুল
কবিতার পক্ষে বেশি সহায়ক ভাবতেই শুনি
বুকের ভেতর
দোয়েল কোকিল ডেকে ওঠে, ফোটে গোলাপ, অর্কিড।
অথচ এখন আমি নতুন পাখির খোঁজে আর
অভিনব ফুলের সন্ধানে
ঘরের নিভৃত কোণে কাটাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ঘুরে আসি
শহরের চেনা,
অচেনা অনেক রাস্তা থেকে, দূর গ্রাম,
গ্রহ-গ্রহান্তর থেকে, আখেরে দেয়ালে
দৃষ্টি রেখে বসে থাকি, যদি
ইট আর সিমেন্টের ত্বক ফুঁড়ে কোনো
সম্পূর্ণ অঞ্জাত ফুল অথবা অচেনা
পাখি বের হ’য়ে আসে, যদি
কারো অঞ্জলিতে পেয়ে যাই
দেবদূতদেরকেও ঈর্ষাতুর করে তোলা কোনো
নব্য সওগাত।
একটি পুরোনো চিঠি পড়ার সময়
দেখি খোলা দরজায় জলকন্যার ধরনে শুয়ে
আছে কবিতার পঙ্ক্তি, লেজের সোনালি
আঁশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ে স্বপ্নমুক্তো, আর
আমার অনেক আগেকার
যূথচারী পুর্বপুরুষের স্মৃতি। ভাবি
অপসৃত হবার আগেই
প্যাডে তুলে রাখা ভালো। কী যেন বলতে
চাইল সে, কবিতার পঙ্ক্তি, অথচ ওষ্ঠের কাছে
শত পাথরের নুড়ি এসে
করে ভিড়; কিছুই না বলে
জলকন্যা দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে
আমার ভেতরে এক পবিত্র আগুন
ধরিয়ে নিমেষে চলে গেল। সারা ঘরে হাহাকার
বেহালার করুণ সুরের মতো ঝরে,
এবং টিবিলে ঝুঁকে কয়েক দিনের
পাতাজোড়া কাটাকুটি থেকে
একটি নিঃসঙ্গ হরিণকে মৃগনাভিসুদ্ধ বের
করে নিয়ে আসি, দেখি তার টলটলে
চোখে কাঁপে জন্ম-জন্মান্তর।