চিরিত্রলিপি
অধ্যাপক ক্লাসরুমে রবি ঠাকুরের জীবনদেবতা নিয়ে
ইনিয়ে বিনিয়ে
বরাদ্দ বক্তৃতা করছেন,
যেন রঙবেরঙের তালি দেয়া জামা,
কেউ কেউ শাঁসালো মক্কেল, কেউ ধামা
ধরেছেন বড় সাহেবের। শুক্রবার
মসজিদে একনিষ্ঠ ইমাম খোৎবা পড়ছেন,
শুনতে ইমানদার ভক্তিভরে সফেদ টুপিতে মাথা ঢেকে;
অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ় ভোরবেলা থেকে
সন্ধ্যে অব্দি চার ফেলে প্রায়শই রুই আর কাতলা শিকার
করছেন। বছর না ঘুরতেই তিন লাফ
দিয়ে ঠিক তিনবার বাড়ল সোনার দাম, তবুও সোনারু
নিত্য গড়ে কিমতি গয়না রাশি রাশি, দিচ্ছে ঝাড়
প্রথামতো ঝাড়ুদার, রাস্তা হচ্ছে সাফ
প্রতিদিন। ফিল্মের নায়ক পরচুলা পরছেন,
বাঁকা তলোয়ার নিয়ে জোর লড়ছেন
পাহাড়ি টিলায় কিংবা কক্সবাজারের দীর্ঘ বিচে,
কখনো এলাহি লম্ফ দিয়ে সাত মহলের নিচে
পড়ছেন নিখুঁত অক্ষত। কতিপয়
বক্তৃতাবাগীশ নড়ছেন চড়ছেন অদৃশ্য সুতোর টানে,
মনে হয়
দেখছে সবাই চমৎকার পাপেট শো সবখানে।
অথচ এখনো আমি সুড়ঙ্গের ভেতরে একাকী
আমার নিজের মুখোমুখি বসে থাকি
অন্ধকারে। কিছু ধড়িবাজ, যেন জন্মান্ধ বাদুড়, অট্রহাসি
হেসে বলে, ‘বাজাও হে বাঁশি
নটবর যত খুশি প্রহরে প্রহরে’,
এবং আমার ওষ্ঠে বিষপাত্র ক্ষিপ্র চেপে ধরে।
ডাক
পলাশতলীর বাঁকে কর্মিষ্ঠ মুনিষ
মহিষ তাড়িয়ে নিয়ে যায়
মাঠে, শোনে দ্বিপ্রহরে কখনোবা দোয়েলের শিস
গাছে ঠেস দিয়ে, সানকিতে আঙুলের নকশায়
ছবি দেখে, দিঘিতে আঁচিয়ে হাত মুখ
ক্ষেতে ফের নিড়ানির কাজ করে, যদিও অসুখ
বহুদিন থেকে। দিনশেষে ঘরে ফিরে হুঁকো টানে।
বউ, যার শরীরে আমন
ধানের সুবাস, যাকে মাঝে মধ্যে প্রবল ফাল্গুন
দোল দিয়ে যায়, জ্বালে সাঁঝবাতি, মন
হয় উচাটন বাঁশঝাড় দেখে। বাউলের গানে
ধুলায় এসেছে নেমে আরশি নগর।
মুনিষকে সালংকরা গণিকার মতো
অবিরত
ডাকে সেই দূরের শহর।
তোমার চলে যাবার পর
তোমার চলে যাবার পর
থরথর হৃদয়ে রঙ্গন ফুলের গাছে আমি
গচ্ছিত রেখেছি আমার কিছু
অনুভব। রৌদ্রে পুড়বে না, হাওয়ায়
উড়ে যাবে না কিংবা শ্রাবণের বৃষ্টির পেরেকে
হবে না বিদ্ধ। অথচ রঙ্গন আর আমার অনুভূতি
কেমন একাত্ম
তোমার চলে যাবার পর।
একটি গাছের সঙ্গে আমার এই সংযোগ
কী গভীর, কেউ তা জানে না। একটি স্বপ্নের মতো
তাকে লালন করে চলেছি
দিনের পর দিন। যদি কখনো
আবার ফিরে আসো এ শহরে, এই ফ্ল্যাট বাড়িতে
যদি আনো কোনো বিকেলে, কবে
আলগোছে ছুঁয়ে দেখো, তুলে নিও আমার
অনুভবের কয়েকটি গরাগ উঠোনের
রঙ্গনগুচ্ছ থেকে।
কথা দিচ্ছি, আমার হৃদয় টুঁ শব্দটি করবে না!
দূর থেকে তোমার নিকট
পথঘাট ভিজে জাব, ট্যাক্সির ওয়াইপার মাথা
নাড়ে মাতালের মতো। দূর থেকে তোমার নিকট
পুনরায় এসে গেছি, যেমন নাগর
জড়িয়ে ফুলের মালা হাতে
সেজে-গুঁজে আসে রূপজীবীর কোঠায়,
যদিও তোমার সঙ্গে হয়নি দীঘল সোহবত।
সেবার তো নিঃস্ব হয়ে, বলা যায়, প্রত্যাবর্তনের
সুর গুনগুনিয়ে করেছিলাম প্রস্থান
উল্টে-যাওয়া কলসের উদাসীনতায় ভরপুর,
বিদ্যুল্লতা স্মরণ করিয়ে
দেয় বার বার, স্মৃতি বৃষ্টির ছাঁটের মতো লাগে
চোখে-মুখে, ক্ষয়ে যায় বয়সের ভার।
কলকাতা হঠাৎ তুমি রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে
গড়িয়াহাটের ব্রিজে বল্লে কানে কানে,
‘এতদিন পর কেন এলে?
আমি তো কবেই মুছে ফেলেছি তোমার
চুম্বনের বাসী দাগ আর
আলিঙ্গন ছায়া বৈ তো নয়।
দ্যাখো, দ্যাখো, আমার চোখের নিচে কী গভীর কালি।
মাইরি, এ মধ্য বয়সের গোধূলিতে
কী পেলে গঙ্গার ধারে, বিকেলের চৌরঙ্গীর ভিড়ে?
তোমার হৃদয়ে যারা পা ঝুলিয়ে বসে আছে তারা-
অনেকেই কবিতার গ্রীবায়, ঊরুতে নাভিমূলে
স্বাক্ষর রাখার লোভে রঙচটা কাঠের টেবিলে
হাতের সকল তাস ফেলে খেলে যাচ্ছে ক্রমাগত,
তোমাকে প্রকৃত কতটুকু মনে রাখে?
পরিচয় গাঢ় কিন্তু চিনতে পারি না। শুনে ফেলি
মধ্যরাতে স্বপ্নের ঈষৎ উল্কি-আঁকা
কলকাতার কণ্ঠে মদির ছেনালি,
যেন তার গলার ভেতর
থেকে এক কামবিদ্ধা বিড়ালিনী কিছু ধ্বনি
মসৃণ উগরে দিচ্ছে। বুঝি
আমার সত্তার গহনতা
থেকে উঠে-আসা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা
এবং মেঘনার তীব্র ঘ্রাণ,
বনদোয়েলের শিস, কলাপাতা শাপলার হুটোপুটি তার
ক্ষয়াটে বর্তুল ফোমে-গড়া স্তনে ভিন্ন শিহরণ
জাগাল আবার।
কলকাতার বুকের ভেতর কলকল,
কলকাতার বিষণ্ন ধূসরতায় নীলপদ্ম ফোটে, দিনভর রাতভর।
ক’দিনইবা আছি? এখন তো পা রাখার জায়গা নেই
তোমার হৃদয়ে;
জানি আমি প্রেমিকের স্বীকৃতি পাব না কোনো দিন।
এবার চুম্বন কিংবা আলিঙ্গন নয়
তোমার মুখের লালা ভেজা সপ্সপে
গহ্বর আমাকে গিলে ফেলার আগেই
স্বৈরিণী জেনেও
তোমার কপালে আমি পরিয়ে সোহাগে
স্খলিত প্রহরে শ্বেত চন্দনের টিপ
সফেদ রুমাল নেড়ে নেড়ে
চলে যাব চুপচাপ ঘরমুখো বেগানা পুরুষ।
পাঁঠা সংকীর্তন
সেদিন হঠাৎ তাকে দেখে, সত্যি বলতে কী, গাটা
গুলিয়ে উঠল খুব, এমন প্রচণ্ড বিবমিষা
কখনো হয়নি আগে। অতি মনোহর রাম পাঁঠা
তাকে বলা যায় সহজেই। পালাতে চাইলে দিশা
মেলা ভার, বেড়ে কান্তিমান শিঙ দুটো নেড়ে নেড়ে,
ঘাড় থেকে ঝুলে-পড়া সোনালি আঁশের মতো লোম
প্রদর্শন করে সকলের নেক দৃষ্টি নেয় কেড়ে
অচিরাৎ, ক্রমশ ছাগল হয়ে ওঠা কিছু ডোম
তার নিত্য সহচর। প্রকৃত প্রস্তাবে বড় খাসা
এই জীব, বলে লোকে। পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি
উঁচু এই রাম পাঁঠাটার থমথমে মাথা ঠাসা
লোকগাথা আর শত কল্প-কাহিনীতে। যে-বিরিঞ্চি
বাবা ওকে দীক্ষা দিয়ে ভবনদী দিয়েছেন পাড়ি,
অনুমান করে অনেকেই, ওরই থুথু ছিটানোর
ভঙ্গিতে অতিষ্ঠ হয়ে বিশ্ব ছেড়ে সাততাড়াতাড়ি
আছেন পরম সুখে স্বর্গলোকে বন্ধ করে দোর,
পাছে সেই ঢুঁ মেরে বেড়ানো এঁড়ে জীব দেয় হানা
সেখানেও। বংশ গৌরবের ঘোরে খুর-অলা পাটা
পায়শই ঠোকে ঘাসে এবং মাটিতে একটানা
পঁচিশ মিনিট মুগ্ধাবেশে সেয়ানা সে রামপাঁঠা।