কক্ষণো ছাড়ব না
মানুষের হাটে হেঁটে যেতে যেতে
কবি বললেন, আমাকে বাৎলে দিন-
কবন্ধ এই কপট সমাজে
শিল্পের কাছে কার কতটুকু ঋণ?
কথামালা তার ঢেউয়ের মতোই
পাথুর দেয়ালে ভীষণ আছড়ে পড়ে।
বেলা-অবেলায় খঞ্জের মতো
মাথা নিচু করে কবি ফিরে যান ঘরে।
কিন্তু কোথায় এমন আঁধারে
নান্দনিক সে কবির বাড়ির পথ?
থিকথিকে পচা কাদা সবখানে,
ডুবে গেছে তার বিদ্যুৎপ্রভ রথ।
মেধা ও মনন গ্যাছে বনবাসে,
প্রকৃত মানুষ সবখানে আজ মৃত।
আদর্শ পচে আগাড়ে-ভাগাড়ে,
সে কটু গন্ধে শ্মশান-শেয়াল প্রীত।
সমাজবাদের পাট তুলে দিয়ে
কত বিপ্লবী ছড়ায় ব্যাপক বিষ।
ক্রান্তিলগ্নে বড় দোটানায়
খঞ্জনা নাচে, শ্যামা পাখি দেয় শিস।
এই নাচ আমি দেখব এবং
কুড়াব নীরবে শ্যামার সুরের কণা।
বর্ণমালায় রঙধনু মেখে
আঙ্গিক গড়া কক্ষণো ছাড়বো না।
কালবেলায় ক্রুশকাঠে
তোমাদের ডাক শুনেই ঘর থেকে
বাইরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। অথচ
চৌকাঠে মাথা ঠুকে গেল,
কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে, রক্ত মুছে
আবার পা বাড়ালাম। তখন কে এক পাখি কোত্থেকে
ডেকে উঠল নিষেধের সুর ঝরিয়ে।
আমি সেই নিষেধের ঢেউ উজিয়ে
অনুসরণ করলাম তোমাদের মিলিত কণ্ঠস্বরকে,
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিহত হয়ে ফিরে আসতে হলো
আমাকে, যেমন আসে তট থেকে তরঙ্গ। আমার কপালের ফোঁটা ফোঁটা
রক্ত দেখেও তোমরা
বিশ্বাস করতে পারলে না তোমাদের গন্তব্যই
আমার গন্তব্য। তোমাদের ভেতর থেকে
কেউ আমার দিকে আড়চোখে তাকাল,
কেউ কেউ ছুড়ে দিলো বিদ্রূপের পাথর, কেউবা
ঠোঁটে অনুচ্চারিত
জুড়াস শব্দটিকে নাচাল কিছুক্ষণ। তোমরা তাচ্ছিল্য আর
উপেক্ষায় আমাকে, বলা যায়,
বিতাড়িত করলে, স্পষ্টতই জানিয়ে দিলে
তোমাদের পথে আমার পদচিহ্নের
কোনো ঠাঁই হবে না।
এই কি আমার অপরাধ যে আমি
তোমাদের গলায় গলা মিলিয়ে ডুমুরপাতা
আর আকন্দ গাছে শিহরণ জাগিয়ে
দিইনি ডাক? দোর এঁটে কখনো অক্ষরবৃত্তের
কখনো মাত্রাব্ত্তের পর্বে পর্বে ছায়া আর জ্যোৎস্না
পুরে, নর্দমার গাদ ঘেঁটে হীরে
বের ক’রে সময় কাটিয়ে তোমাদের তীর্থরেণু
গায়ে মাখিনি বলেই কি
আমাকে ফিরে যেতে হলো মুখ অন্ধকার করে?
তোমরা কি আমাকে ডাকবে না আর,
যে ডাক শুনে আমার
হাড় থেকে ত্বক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে শৈবের রোদ,
যে ডাক শুনে আমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে
দিগন্তের দিকে ছুটে যাবে যৌবনের উল্লাস?
তোমাদের পথে পদচিহ্ন
আঁকার জন্যে আমাকে কি নাজেরাথের সেই
অমৃত পুরুষের মতো ঝুলতেই হবে কালবেলায় ক্রূশকাঠে?
কেউ তা জানে না
কোনো কোনো দিন খুব ঝোঁক চাপে লোকটার মাথায় হঠাৎ
এঁদো গলি ছেড়েছুড়ে দূর দূর করে
কাক আর কুকুর তাড়িয়ে আঁস্তাকুড়,
ধোঁয়াটে চা-খানা, বোবা রেশনের তালাবন্ধ দোকান এবং
অন্ধ ডোবা অনেক পেছনে
ফেলে চলে যাবে
বহুদূরে যেখানে দাঁড়ালে দেখা যায়
মহাপুরুষের হৃদয়ের মতো দরাজ আকাশ, বুক ভরে
নেয় যায় শরীর চেতিয়ে-তোলা সতেজ বাতাস। মাঝে-মাঝে
লোকটার ভারি ইচ্ছে হয়
সেখানে একলা বসে চুষে চুষে খাবে পাকা আম।
গুমোট রাত্রির পর ভোর হ’লে লোকটা ঝুপড়ির
দোর খুলে পা বাড়ায় পথে।
পাড়াটা বেজায় চোখ পাকানো বাঁকানো শিঙ ষাঁড়ের মতন
মনে হয়। ক’কদম আগে বাড়তেই
ডালপুরি আর তেহারির তেলতেলে গন্ধ লাগে
নাকে, তাকে কেউ কি পেছন থেকে ডাকে?
পেরিয়ে মেথরপট্রি অন্য এক গলির ভেতর
ঢুকে ফের বেরিয়ে কী ভেবে
তাড়াতাড়ি পথ হাঁটে, জানালার ধারে
দাঁড়ানো, তরুণী, বারান্দায় ঝোলে জাফরানি শাড়ি। রাতে তাড়ি
গিলেছিল খুব, দিল বাগ বাগ ছিল,
মনে পড়ে। বেলা বাড়ে, সূর্য জ্বালা ধরায় চামড়ায়।
এ সময়, হাঁটতে হাঁটতে
একাকী লোকটা ভাবে ঠাণ্ডা কামরায় জিরোনো
ছিল ভালো। হাতের চেটোয় কপালের
ঘাম মুছে খোঁজে ছায়া, যেমন ফিল্মের
পোড়া-খাওয়া, ধনীর সুন্দরী দুলালীর ছ্যাঁক-খাওয়া
পথশ্রান্ত বেকার নায়ক।
ঝাঁ ঝাঁ ভাদুরে দুপুরে
লোকটার চোখে তাজা খোওয়াবের ফুলঝুরি ছড়িয়ে চকিতে
মেঘের আড়ালে চলে গেল
একজন জলপরী; সেও হলো অনুগামী
যে পাখাহীন পাখি, অথবা আস্তাবলের বেতো
ঘোড়া পক্ষীরাজ রূপান্তরে। মেঘ আর
মানুষের সখ্য এ রকম, ভাবেনি সে কোনও দিন
এর আগে। রঙিন বুদ্বুদ কত মুখ, চালচুলো, খড়কুটো,
সোনালি-রুপালি মাছ লাফায় চৌদিকে, কে কোথায়
চুমু খায় নিবিড় আশ্লেষে, বোঝা দায়।
কতকাল, কত হরতাল, কত পার্বণ ফুরাল,
ফেরেনি সে কখনো এখানে আর ভাড়াটে ঝুপড়িতে
এঁদো গলিটায় লাঠি ছোরা, স্টেনগান আর বোমার শহরে।
গৃহিণী পাথর তার, ভাগ্য খেলে কানামাছি। লোকটা কোথায়
আছে কোন হালে
মেঘে মেঘে, নির্জন গৃহায় নাকি মায়াবী গাছের ডালে ঝুলে
বাবুই পাখির মতো বাসা বেঁধে একা
কেউ তা জানে না।
ক’দিন পরেই
ক’দিন পরেই
আমার জীবন হবে গোধূলিতে শস্যহীন ক্ষেত, কুয়াশায়
হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া ঘণ্টাধ্বনি। কিছু
পোড়া কাঠ, শূন্য কৌটো, একটি কি দু’টি
প্লাস্টিকের ক্লিপ, আপেলের টুকরে ইতস্তত
থাকবে ছড়ানো আশেপাশে। সেদিন দুপুরবেলা
তোমার শয্যায় পাশে বসে স্বপ্নের জগৎ থেকে
ভেসে-ওঠা অমন রহস্যের চোখ রেখে
চকিতে পড়ল মনে ক’দিন পরেই
তুমি চলে যাবে দূরে, কুড়িয়ে স্মৃতির ধানশীষ
পরিযায়ী পাখির মতন
এবং আমাকে ঘিরে ঘুরবে তখন হানাকার।
সেদিন দুপুরে
বলেছিলে, ‘আমার যে-হাত সাবলীল স্পর্শ করে
তোমাকে কখনো, জেনো সে-হাত এঁকেছে চুম্বন,
সে ঠোঁটও আমার নয়। তবে কার?’ আমি কি তোমার
ছায়ার পুতুলটিকে দিঘিতে ভাসিয়ে তৃপ্ত হবো?
কয়েকটি দিন,
যেন অনাস্বাদিত চুম্বন, কাটে বড় এলোমেলো,
আমার হৃদয় ঝড়বিক্ষুব্ধ সারস;
আমার কবিতাগুলি তোমার নিভৃত শুয়ে-থাকা,
বসে থাকা, বই-পড়া, হাত নড়া দ্যাখে
উপনিষদের
দ্বিতীয় পাখির মতো এবং তোমার বিরূপতা
চাবুকের কালসিটে দাগ হয়ে সেঁটে থাকে আমার সত্তায়।
আমি সেই বেদনার্ত স্থানটিতে পানি ঢেলে ঢেলে
করবো শুশ্রূষা
মধ্যরাতে, যেমন বালক করে আহত পাখিকে,
মাঝে-মধ্যে চুমো খাব। ক’দিন পরেই
স্বর্গচ্যুত আদমের মতো শূন্য প্রহরে প্রহরে
গোঙাবো কেবলি।