এমন ঠেলতে ঠেলতে
আজ
তুমি আমাকে
এমন ঠেলতে ঠেলতে
এ কোথায় নিয়ে এসেছ ঢাকা,
হে শহর আমার?
তোমার কনুই আমাকে
পৌঁছে দিয়েছে, বলা যায়,
প্রায় উপকণ্ঠে।
তোমার পুরানো সৌন্দর্যে
অভিভূত আমি
ভালোই ছিলাম, একথা
অস্বীকার করব কী করে?
নানা ফাটল-খচিত এক বাসায়,
ইঁদুর, ছুঁচো, চামচিকা আর মাঝে-মধ্যে
আরশোলার ওড়াউড়ি
হয়ে গিয়েছিল গা-সওয়া।
হেমন্তে চড়ুই দম্পতি
বাসা বাঁধত ঘরের ভেতরে।
খড়কুটোয় নোংরা হতো মেঝে,
কখনো-সখনো পাখির সংসারের
কণা এসে পড়ত মাথায়,
মাথা নেড়ে মেনে নিতাম
সেই উপঢৌকন। কোনো কোনো
অতিথি বলতেন, ‘বেশ আছেন কবি।
আমি কাঠের বর্গার
ফাঁক-ফোকরের দিকে
দৃষ্টি মেলে দিয়ে একটু হেসে
সায় দিতাম তাঁদের উক্তিতে।
হ্যাঁ, বেশ ছিলাম, ঢাকা, শহর আমার,
কলতলার জটলা, নড়বড়ে চা-খানা
আর মাতালের চিৎকারে শিউরে ওঠা
রাতের গলিতে, ফিল্মি গানের ভেসে-আসা কলিতে
মৌজে-থাকা মাস্তানদের
আড্ডার হৈ-হল্লা
আর তেহারির ঘ্রাণে, ডাস্টবিনের
আশপাশে কুকুর, বেড়ালের
সম্মেলনে, দিব্যি ছিলাম।
কিন্তু তুমি আমাকে
হঠাৎ পাঠিয়ে দিয়েছ
তোমার হৃদয় থেকে অনেক দূরে।
নির্বাসিত কবির মতো
আমি দিন কাটাই,
রাত্রি যাপন করি,
অথচ আমার মন পড়ে থাকে তোমার
পুরানো রূপের গভীরে।
আজ রাত্তিরে কিছুতেই
আমার ঘুম আসছে না। নিঝুম
পাড়া, হয়তো কোথাও কোনো
ছিঁচকে চোর ওৎ পেতে আছে,
আমার জানলার পাশে নারকেল
গাছে দেবদূতের দোলা। কেন জানি না
নিজের গোটা জীবন
উঠল দুলে
আমার দৃষ্টিপথে। কত চড়াই-উৎরাই,
পুকুরে মাছের ঘাই, সকালবেলা
মোরগের ডাক, পাখির শিস,
নীল প্যাডে চিঠি, দুপুরে
ভাঙা মন্দিরের ছায়া,
ঘোড়ার গাড়িতে নগর ভ্রমণ,
মধ্যরাতে টেলিপ্রিন্টারের শব্দ,
কবিতার কচ্ছপ কামড়, প্রেমের রাজ্যে
জব্দ, অর্ধচন্দ্র খেয়ে বিদায়, অকস্মাৎ ধুমধাড়াক্কার
ফুলশয্যা, অনিয়ন্ত্রিত জন্ম;
মার্কস আর ফ্রয়েডের সহাবস্থানে আস্থা,
সামরিক শাসনে কারো আস্থা কারো বা অনাস্থা, রেড বুকের
সূত্র আওড়ানো, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার
হুইল চেয়ারে সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা।
খানাখন্দে মানবতার হুমড়ি খেয়ে পড়া,
শিকারির গুলিতে পালকখসা গণতন্ত্রের পতন,
শিরাস্ত্রাণের উত্থান!
ঢাকা, হে শহর আমার,
ঠেলতে ঠেলতে আমাকে
এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি?
তোমার চতুঃসীমা থেকে,
একেবারে বাইরে ফেলে দেবে না তো?
পড়বে না জেনে বুক শেল্ফ
হাতড়ে বেড়াই, তাকে তুলে-রাখা
গুরুমুখী লাল বইয়ে
ধুলোর আস্তরণ, মগজে ভ্রমণের গুঞ্জন, অন্ধকারে
দৃষ্টি ছড়িয়ে ভাবি,-
আমার প্রতিবেশে
থরেথরে শত ফুল ফুটবে কবে?
এমন দিনে
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ যথারীতি;
এ মাহ ভাদরে
ভরা এ শহরে
সারাদিনমান বৃষ্টি শুধু বৃষ্টি একটানা আর আসমানে
মেঘের কুচকাওয়াজ, তেড়ে-আসা কসাক সওয়ার
যেন ঝোড়ো হাওয়া,
হাজিরা খাতায় সই করেননি সূর্যদেব আজ। এ ভবের
হাটে কাকে সত্য বলে মানি? গলিতে জোয়ার এলো,
ভিজে জাব ক্ষয়রুগী রিক্শা-অলা চড়া ভাড়া হাঁকে,
বস্তি ডোবেঁ অকাল বন্যায়, ব্যাঙ ডাকে মাঝে-মাঝে,
ভরা সাঁঝে শিশুর কান্নার রোলে মুখ-গোমরা আকাশ আরও
বেশি মুখ কালো করে।
টিপয়ে চায়ের কাপ, ধোঁয়া;
দিন কাটে ছায়া নিয়ে। বৃষ্টির ধোঁয়ায় আমি স্মৃতিভারাতুর
আর মধ্যবিত্ত মনে চুপিসারে হামাগুড়ি দেয় ছদ্মবেশী
বুর্জোয়া-বিলাস। একরোখা বৃষ্টি পড়ে
চতুর্দিকে, রবীন্দ্রনাথের গান অবিরাম হানা দেয় মনের কোটরে-
পাগল আমার মন জেগে ওঠে। টেলিফোনে শুনি
ক্লান্ত কণ্ঠস্বর
তোমার, রাত্রির দুঃস্বপ্নের ভাষা করে
ভর স্বরে, বললে, ‘ভুলে যেতে চাই, তবু
বৃষ্টির সুরের মতো স্মৃতি আমাকে রয়েছে ঘিরে
রাত্রিদিন। আসমান কয়লার খনি,
ময়লা গলিতে ভেজে উন্মাদিনী, বাতাস হাজার
নেকড়ের আর্তস্বর, সে মুহূর্তে নিজেকে কেমন
অবান্তর মনে হলো উৎসব রাত্রির ক্লিন্ন উচ্ছিষ্টের মতো।
তোমার গলায় বাজে অতীতের স্খলিত নূপুর, দুলে ওঠে
নিবু নিবু ঝাড়লণ্ঠনের শোভা। মনে মনে বলি,
হে মেয়ে কী খোঁজো তুমি পলায়নবিলাসী ছায়ার
সঙ্গে নিত্য সহবাসে? এ বৃষ্টির দিনে
রভসে গোঙাও কেন বিগত যুগের ভস্মরাশি বুকে নিয়ে?
বরং ক্যাসেট প্লেয়ারে আমির খাঁর মেঘ রাগে যাক
ভেসে যাক হৃদয়ের একূল-ওকূল।
টেলিফোন ভরা বর্ষাখচিত গলায়
শোনাল আমাকে,-
‘কেন তুমি শিরায় স্পর্শের
অস্থির উৎসব জ্বেলে দিতে চাও বারবার? কেন
আমাকে বসাতে চাও মদন মণ্ডপে? আমার তো
ভিন্ন অধিষ্ঠান।
তক্ষুণি আমার চোখে
এক জোড়া সুতীব্র সবুজ চোখ জ্বলে ওঠে আর
নাকে লাগে বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে ভেসে আসা দূর
লাশকাটা ঘরের উৎকট গন্ধ, বিবমিষা জাগে!
এসেছি দাফন করে
কেউ কি শুনতে পাচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসা
বনপোড়া হরিণীর
আর্তনাদ? সর্ষেক্ষেত, আসশ্যাওড়ার
ঝোপ, মাছরাঙা
আর পানকৌড়িময় বিল,
প্রান্তর পেরিয়ে-আসা ধ্বনি ক্রমাগত
আছড়ে পড়ছে এ শহরে
রাজপথে, গেরস্ত পাড়ায়, কলোনিতে
দেয়ালে দেয়ালে, কারাগারে,
অত্যন্ত সতর্ক
প্রহরী বেষ্টিত ছাউনিতে, পরিখায়
কেউ কি শুনতে পাচ্ছে? নাকি এ আমার
মনেরই খেয়াল? অতিশয় ন্যালাক্ষ্যাপা
কবিত্বের ব্যাপার স্যাপার?
এই তো শুনছি স্পষ্ট এবং নির্ভুল-
কে যেন কুয়াশাময় কণ্ঠে ‘সত্য, সত্য’ বলে যাচ্ছে ডেকে
একটানা, অথচ সাধের
সত্য অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে
সে কবে হয়েছে দেশান্তরী। সে আবার আসবে কি
ফিরে কোনো দিন
ভীষণ উড়নচণ্ডে, ভ্রষ্ট, গৃহত্যাগী
পুত্রের মতন?
‘সুন্দর, সুন্দর, ওরে সুন্দর কোথায় গেলি’ বলে
নেকড়ের গায়ের রঙের
মতো অন্ধকারে কেউ বুকফাটা আওয়াজে ডাকছে
যেরকম মৃণাল সেনের
ফিল্মে ছেলে-হারানো মা উজাড় ভিটায়
ফসলবিহীন
ক্ষেতে ও প্রান্তরে সন্তানের নাম ধরে
ডাকে, ডাকে, ডাকে; সে কোথায়
সুন্দর রয়েছে পড়ে; তার শব নিয়ে কী ভীষণ টানাটানি,
খাবলাখাবলি
করছে শেয়াল আর কুকুরের পাল,
যেমন আকালে করে ওরা আদমসন্তান নিয়ে।
‘কায়ক্লেশে যাচ্ছিলাম ভদ্রাসনে। উল্টো দিক থেকে
ক’জন নধর ভদ্রলোক-
কেউ পান চিবুতে চিবুতে, কেউ কেউ সিগারেট
ফুঁকুতে ফুঁকুতে,
কেউবা মাটিতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে-
আমাকে জিগ্যের করলেন,
‘কোত্থেকে এলেন? আমি সূর্যাস্তের দিকে
দৃষ্টি মেলে বলি,
সাত হাত জমিনের নিচে
এসেছি দাফন করে বিবেকের মৃতদেহটিকে।