- বইয়ের নামঃ স্বপ্নেরা ডুকরে উঠে বারবার
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আছে একজন
বহুদিন পর অকস্মাৎ অপরাহ্নে চা-খানায়
বন্ধুরা আমাকে দেখে চমকে ওঠেন, যেন কোনো
প্রাচীন যুগের প্রেত দিলো হানা তাদের ডেরায়। প্রত্যেকের
মুখে উদ্বেগের কাঁটা, তিন জোড়া চোখ
শুধু প্রশ্ন হয়ে
সেঁটে থাকে আমার শরীরে। বন্ধুদের কৌতূহল
মেটাবার জন্যে বলি, ‘আছে
একজন, যার সৌন্দর্যের অপরূপ
দেয়ালি আমাকে খুব ঝলসে দিয়েছে
তন্দুরী রুটির মতো। ইদানীং আমি
সত্তায় বেড়াচ্ছি বয়ে কামনার অজস্র নাছোড় মৌমাছির
কামড়ের দাগ,
যে মৌমাছি ঝাঁক বেঁধে ওড়ে সারাক্ষণ
তার ওষ্ঠে, বুকের উদ্যানে আর নাভির মদির সরোবরে।
আজও তিনি
ছিল না বিষয়বুদ্ধি এতটুকু; তাই ঘর ঠিক
না করেই একপ্রস্থ আলখাল্লা পরে অর্ধাহারে,
অনাহারে বনের স্বর্গীয় মোষ গেলেন তাড়াতে।
ছিল না বিষয়জ্ঞান, তবু জ্ঞানকেই সাজালেন
প্রেমের আভায়। ডেরাছুট ঘুরেছেন পথে পথে
সহায় সম্বলহীন চরাচরে ঈশ্বরের ঘর
বানাবার কী তীব্র মোহন আকর্ষণে। জানি তিনি
রাজার অধিক রাজা, কিন্তু জোটে কাঁটার মূকুট।
যখন অনাথ শিশু শূন্য এনামেলের পাত্তর
মেলে ধরে পথচারীদের দিকে, তখন তাঁকেই
দেখি সেই শিশুর ভিতরে; কোনো শিল্পী নিঃসঙ্গতা
আর যন্ত্রণায় কান্না বয়ে বেড়ায় যখন, দেখি
তিনি ক্রূশকাঠ পিঠে নিয়ে চলেছেন হেঁটে একা।
ধর্ষিতা নারীর চোখে তাঁর চোখ, নিষ্ঠুর, গোঁয়ার
চাবুকের অন্ধ দাগ যে দাসের পিঠে জেগে থাকে,
তিনি সেই দাস হয়ে অত্যন্ত একাকী কষ্ট পান।
ছিল না বিষয়বুদ্ধি এতটুকু, বস্তুত বোকাই
বলা যায়। আত্মরক্ষা জরুরি জেনেও কোনোকালে
গড়েননি সশস্ত্র বাহিনী, মেষপালকের মতো
শুধু কতিপয় মেষ নিয়ে গাধায় সওয়ার হয়ে
কখনো, কখনো নগ্ন পদে যোজন যোজন পথ
হেঁটেছেন; একরত্তি সোনারূপ নয়, শুধু বাণী
ব্যাকুল ছড়িয়ে দিয়েছেন মরুভূমিতে, প্রান্তরে,
নদীতীরে বিনিময়ে দাগি চোর আর খুনেদের
সঙ্গে শতাব্দির কলঙ্কের মতো পেরেকে পেরেকে
হয়েছেন বিদ্ধ আর আজও এশিয়ার বুভুক্ষায়
জীবন্ত কংকাল হন, স্বৈরাচারী বুটের তলায়
হাতীর কিমতি দাঁতে তৈরি শিল্প সামগ্রীর মতো
পাঁজরের হাড় তার গুঁড়ো হয় দিকে দিকে, আর
বেদনার্ত আফ্রিকায় বেকসুর ঝোলেন ফাঁসিতে।
আমার দুচোখে বেঁধে
আমার দু’চোখে বেঁধে রেখেছি প্রতিমা। তার রূপ
কেমন নিশ্চুপ
কানায় কানায় ভরা সরোবর। আমার হৃদয়ে ঢেউ ওঠে,
যখন অধরে তার ফোটে
পারস্য গোলাপ-কুঁড়ি। প্রায়শ কুড়াই অসামান্য স্মৃতিকণা
নীরব সাধনে, ভুলব না
তাকে ভুলব না কোনো দিন।
আছে তো চোখেই বাঁধা, তবু কেন হয়ে যাই আর্ত ভায়োলিন?
উৎসব-রাতে হঠাৎ
উৎসব রাতে গিজগিজে ভিড়ে মনে হলো আমি
বড় অসহায়, একা।
মনের ভেতর হঠাৎ ভ্রমর সুর তুলে বলে-
কতকাল পরে দেখা।
শরীরে তোমার জড়িয়ে নিবিড় সুনীল আকাশ
অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলে,
এবং বিউটি পার্লারে রচা খোঁপা বেলফুলে
ঈষৎ সাজিয়ে নিলে।
মোমের মতোই গলে যায় খুব দেহমন জানি
নীল আগুনের আঁচে,
সেই ভয়ে আমি আড়ালে ছিলাম রাত্রিছায়ায়,
যাইনি তোমার কাছে।
তোমাকে নিত্য মনে রাখি কিনা, প্রশ্নটা শুনে
ছিলাম নিরুত্তর;
কী করে জানাই, তুমি নেই তাই হৃদয় আমার
শোকাগ্নিময় থর।
ঘরে ফিরে গিয়ে যখন শরীর থেকে নীলাকাশ
চুপে নিয়েছিলে খুলে,
তখন হঠাৎ একাকী প্রহরে পড়েছিল টান
তোমার মর্মমূলে?
বারান্দাটায় একা বসে ভাবি, কেঁপেছিল কোন্
সে-ভাষা তোমার ঠোঁটে?
হৃদয়ে আমার দূর অতীতের গোলাপ-পাগল
বুলবুলি গেয়ে ওঠে।
দেখলাম তুমি ভাড়াটে এ ফ্ল্যাটে দাঁড়ালে আমার
সামনে ছড়িয়ে হাসি।
এ কেমন দাহ শিরায় শিরায়, আমি নই আজও
মঠবাসী সন্ন্যাসী।
তোমাকে অধীর ছুঁতে গিয়ে দেখি তোমার বদলে
শূন্যতা আছে ফুটে।
শ্বাসকষ্টের ধকল সইবো, কাটবে জীবন
অতীতের কণা খুঁটে।
নেপথ্যে কার রটনা তোমার প্রাক্তন রূপ
হয়েছে খানিক ফিকে,
সত্যি বলতে, আমিও চলেছি অতিশয় দ্রুত
অস্তাচলের দিকে।
উৎসব-রাতে মনে হয়েছিল তোমাকে দখল
করেছে বিষণ্নতা
এবং আমার মনে সেঁটে থাকে এঁটোময় পাতে
মাছির মতন কথা!
অনিশ্চয়ের প্যাঁচা প্রগল্ভ তৃতীয় প্রহরে,
কাঁপে সত্তার ভিত।
আমার ভেতর উঠল কি জেগে বীতংসঘেরা
মরালের সঙ্গীত?
একদা এক কবিতা
একদা এক কবিতা, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতে
পাখাঅলা ঘোড়ার লাগাম,
বেরিয়েছিল একটি ডালিমের খোঁজে,
যা সারিয়ে তুলবে অসুস্থ রাজাকে। একদা এক কবিতা
মায়াবিনীদের স্মৃতি-ভোলানো গান উপেক্ষা করে
ভুরু থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল মতিচ্ছন্নতার ছায়া।
প্রান্তরের পর প্রান্তর পেরিয়ে, ডিঙিয়ে
পাহাড়ের পর পাহাড়
সন্ধ্যেবেলা সে পাখাঅলা ঘোড়াটাকে থামায়
গাছতলায়, জিন থেকে নেমে ডালে ঘোড়ার
লাগাম বেঁধে সে ঘুমায়। ছায়া গ’লে গ’লে
পড়ে ওর চোখে-মুখে স্তব্ধতার সর-পড়া ঠোঁটে, ঘোড়ার লেজে
কুণ্ডলি পাকিয়ে-থাকা জগমোতির হারে। তার পাশ দিয়ে
বয়ে যায় ঝরণা, ঝরণাধারায় ভাসে অসংখ্য গোলাপ।
যখন ওর ঘুম ভেঙে যায় ভোরবেলা
দূর উদ্যানের স্মৃতি বয়ে-আনা পাখির গানে,
সে তার ব্যর্থ অভিযানের কাহিনীগুলো আবৃত্তি করে
মনে-মনে, তারপর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে, কখনো
ঝরণার নুড়ির ওপর দিয়ে দুলকি চালে
যাত্রা শুরু করে, কখনো টগবগিয়ে চলে সবুজ উপত্যকায়,
কখনোবা রঙিন মেঘের পেলবতায়
ঢেউ তোলে পাখাঅলা ঘোড়ার ক্ষুর। কখনো
ওর চোখে এসে লাগে সুদূর ডুমুর পাতার
ঝলক, নাকে দরিদ্রের খড়-ছাওয়া ঘরের বলক-আসা ভাতের ঘ্রাণ।
সেই কবিতা, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতের মুঠোয়
রাশি রাশি নক্ষত্র, লক্ষ্য করে
দূরের মেঘে কিসের কুণ্ডলি, ঘোড়াটা ভড়কে যায়
বেধড়ক, পালাতে চায় উল্টো দিকে।
সে লাগাম টেনে ধরে জোরে, কলকারখানার ধোঁয়া
ওর চারদিকে, চোখে কাঁদানো গ্যাসের দুঃসহ জ্বালা।
কারা যেন তাকে পরিয়ে দেয় কোমরবন্ধ,
আর সেখানে সে দেখতে পায়
খাপে-ঢাকা তরবারি। যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ,
হাতের মুঠোয় রাশি রাশি নক্ষত্র, সে কিছুতেই ভেবে পায় না
এই অস্ত্র তার কী কাজেই বা লাগবে?
পাখাঅলা ঘোড়াটা ঘুরতে থাকে দিগ্ধিদিক।
ঘন অরণ্যের দিকে এগোতে এগোতে সে ডান দিকে
ফেলে দেয় কোষবদ্ধ অসি আর বাঁ দিকে
শপথের মতো দৃঢ় কোমরবন্ধ। আবার ছুটে চলে রোগহর
ডালিমের উদ্দেশে, যার প্রতীক্ষায় আছে রাজ্যের সবাই।
দিন যায়, রাত কাটে, এভাবে চলতে চলতে
একদিন সে অভীষ্ট উদ্যানের
প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, ওর কানে ভেসে আসে
অমর্ত্য গান, সে-গান কোনো পাখির
না নারীর, শনাক্ত করা মুশকিল। অথচ সেখানেই
দশদিক থেকে টর্নেডোর মতো তেড়ে আসে হা রে রে রে
দস্যুদল বল্লম আর অসি উঁচিয়ে
ওর দিকে, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতে পাখাঅলা ঘোড়ার লাগাম।
এই আচমকা আগ্রাসনে দিশেহারা সে
কোমরে হাত রাখে, কিন্তু সে মুহূর্তে ওর মনে ছিল না
সেখানে না আছে কোমরবন্ধ, না কোনো
তীক্ষ্ণ তরবারি। তার কাঁধের পূর্ণিমার চাঁদ আর
হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে ছুটে আসে ঝাঁক ঝাঁক তীর,
বল্লম, আর ওর অস্তিত্বের
ক্ষতগুলো থেকে ঝরতে থাকে অবিরত
বর্বরদের চম্কে দেয়া গোলাপ, সাদা, লাল, হলদে, সবুজ।