Site icon BnBoi.Com

স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেচে আছি – শামসুর রাহমান

স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেচে আছি - শামসুর রাহমান

???

বিকেলের জাফরানি রোদে কলকাতা ক্ষণকাল
রূপচার্চা করে নেয় আনমনে আর
পথে যেতে যেতে খুব কাছ থেকে দেখি
বাগবাজারের চৌরাস্তায় গিরীশ ঘোষের বাড়ি
উদাস দাঁড়িয়ে আছে প্রবীণ স্তব্ধতা গায়ে মেখে। চারপাশে
তার কলরব বয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে; বড় একা,
নিশ্চুপ সে। কখনও কখনও মধ্যরাতে
বোধিদীপ্ত মদ্যপের মতো
নানা কথা বলে যায় অপরের শ্রুতির আড়ালে। কলকাতায়
ভোরের পা পড়লেই সেই বাড়ি স্তব্ধতায় ডোবে।

কোনও কোনও পথচারী নিঝুম বাড়ির
ভাষা বুঝে নেয় কোলাহলের মধ্যেও, শুনে ফেলে
নট আর নটীর সংলাপ আর গিরীশ ঘোষের
সুরাসিক্ত কণ্ঠস্বরে অক্ষরবৃত্তের পঙ্‌ক্তিমালা-
সেই পঙ্‌ক্তিমালা বাগবাজারের ঘরের, বাড়ির, শতকের
সীমানা ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে, সারা বাংলায় ছড়িয়ে যায়।
১১.১২.৯৮

অচিন মানুষ

ঘুমের ভেতর প্রায় রোজই এসে দাঁড়ায় কে এক
অচিন মানুষ; চেয়ে থাকে
প্রগাঢ় আমার দিকে কিছুক্ষণ, জাফরানি-রঙ
আলখাল্লা তার
হাওয়ায় ঈষৎ কাঁপে। বাউল বলেই চিনি তাকে,
হাতে একতারা, কাঁধে ঝোলা।
অনুরোধ করি না, তবুও কণ্ঠে মধুর খেলিয়ে দেয় সুর
অবলীলক্রমে, মুগ্ধতায় স্নান করে দেহমন।

ঘুমের ভেতর স্বপ্নে নাকি বাস্তবেই
এসে যায় সে বাউল আমার নিকট,
বোঝা দায়; শুধু আমি সুর হয়ে যাই
জাফরানি-রঙ আলখাল্লা আর একতারার কম্পনে, এই
বিশ্বাসে উদাস বাউলকে কখনও সাধক গুরু,
কখনও বান্ধব বলি, কখনওবা সখা।
আজ অব্দি একটিও কথা উচ্চারণ
করেন নি তিনি,
কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন
উদার দৃষ্টিতে, সেই দৃষ্টি স্পর্শ করে
অন্তরের পাতাল আমার, কখন যে তার সুর
আমার নিজেরই সুর হয়ে
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমকে আলিঙ্গন করে
তা বোঝার আগেই আমার
গায়ে জাফরানি-রঙ আলখাল্লা, হাতে একতারা,-
এবং আমার দ্বৈত সত্তা নক্ষত্রসভায় নৃত্যপর শুধু।
২৯.১২.৯৮

 অনন্তের কোনও ছলাকলা

এই ছোট ঘর, এই প্রান্তিক বিনীত বুড়ো বাড়ি,
আবেগকম্পিত স্বরে বলে, ‘কখনও যেও না তুমি। এই গলি,
এই পথ সারাক্ষণ বলে, ‘কখনও যেও না তুমি। অনাথ
শিশু নিকেতনের দেয়াল, এই গাছ, শাখাশ্রয়ী পাখি, এই
গোলাপ, চামেলি, গন্ধরাজ, ক্যামেলিয়া
বলে বারবার,
‘আমাদের ছেড়ে তুমি কখনও যেও না। একজন মানবীর
প্রগাঢ় ব্যাকুল দু’টি চোখ বলে, তোমাকে দেব না যেতে, কবি।

আমি তো চাই না যেতে কস্মিনকালেও
এই প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে ছুড়ে অন্য কোনওখানে। নেই সাধ
কোনও লোভনীয় মরীচিকার পেছনে ছুটে বেড়াবার
পুরোনো গল্পের মোহে। এখানেই চিরকাল প্রাণের স্পন্দন,
ঝর্নার, ফুলের, প্রান্তরের, দিগন্তের,
নানান পাখির শোভা পেতে চাই। এখানেই চাই
দেখতে শিশুর হাসি, দয়িতার রূপ, চাই পেতে
বারবার গাঢ় আলিঙ্গন, চুম্বনের আর কবিতার স্বাদ।

অথচ অসীম নাস্তি শাসায় আড়াল থেকে, তীক্ষ্ণ অন্ধকার
কখনও সজীব ভোরবেলা, কখনও বিষণ্ন গোধূলিতে
ভীষণ খামচে ধরে; বিলুপ্তির ভাবনায় ঝটিতি তুষার-কণা ঝরে
মগজের কোষে কোষে। কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ি,
এবং খানিক পরে তোমার ছবির দিকে গভীর তাকিয়ে
কখনও বা কবিতার বই থেকে কয়েকটি পঙ্‌ক্তি
পড়ে ফের জীবনের স্পন্দিত শিরায় হাত রাখি, মনে হয়-
এই ঘর, এই দৃশ্যাবলী, বইপত্র, পদাবলী, এইসব প্রিয় মুখ
থেকে বিলুপ্তির শূন্যতায় কখনও মিশিয়ে দিতে
পারবে না অনন্তের কোনও ছলাকলা।
৬.১১.৯৮

অন্ধকারাচ্ছন্ন খেলা

এরই মধ্যে আমার বান্ধবদের ক’জনকে তুমি
কায়াহীন, ছায়াহীন করেছ হেলায়,
যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন খেলায়। এখন বারান্দায়
বসে আছি একা, বড় একা
ছড়িয়ে আবছা দৃষ্টি কিয়দ্দূরে। স্মৃতির প্যাঁচালো অলিগলি
ভেসে ওঠে- এর চোখ, ওর ঠোঁট, কারও হাত, কারও নাক,
কারও বা মাথার চুল, কিছু ছায়া-ছায়া কথা
মনে পড়ে। কেউ কি রেখেছে আস্তে হাত
আমার নিঝুম কাঁধে? কে আমাকে ব্যাকুল ডাকছে
ব্যালকনি থেকে? কার হাতে কম্পমান
কবিতার পাণ্ডুলিপি পাণ্ডুর জ্যোৎস্নায়? ফাঁকা পথে
কে একলা যাচ্ছে গেয়ে লালনের গান?

তুমি কি বাজাও ডুগডুগি অন্তরালে? সেই ধ্বনি
যে যাবে কেবল সে-ই শোনে। নাকি কোনও
কথাহীন কাহিনীর মায়ায় ভুলিয়ে
নিয়ে যাও দিকচিহ্নহীন পথে প্রত্যাবর্তনের অসম্ভবে?
একদিন আমাকেও তুমি নাস্তির আন্ধারে মুড়ে
নির্বিকার নিয়ে যাবে, কখন জানি না। কিছু হাহাকার আর
ভেজা চোখ পেছনে থাকবে পড়ে। তবে
এখনই করো না চুপিসারে আয়োজন
আমাকে হরণ করবার। আরও কিছুকাল এই
চেনা পৃথিবীতে থেকে নিজের গহনে ডুবে ডুবে
অরূপ রতন খুঁজে খুঁজে আর এই
গাছপালা, এই নদী, ফুল-পাখি, সবচেয়ে বেশি
প্রিয়জনদের মুখ বুকের ভেতর এঁকে নিতে চাই, আরও কিছু
কবিতা লেখায় মগ্ন থাকার সময় চাই হে কঠোর, নাছোড় তস্কর।
২৪.১১.৯৮

অভিন্ন মানুষ

অনেক অনেকক্ষণ ধরে সুদূরে চলেছি হেঁটে; অকস্মাৎ
মনে হ’ল, যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি। চারপাশে
বেবাক একই তো আছে-সেই
ঘরবাড়ি, সেই গাছ, সেই পথ এবং দোকানপাট, একই।

তাহ’লে এই যে সারারাত পথপরিক্রমা আর
বহুদূর যাওয়ার বিশ্বাস
হাত থেকে পাথুরে মেঝেতে ফস্‌কে-পড়া পিরিচের
মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? তাহ’লে কি এতক্ষণ শুধু
ছিল দৃষ্টিভ্রম নাকি নিজেকেই ভীষণ আটকে রাখা
ফাঁকির জন্মান্ধ ঊর্ণাজালে! এ বিভ্রম
থেকে মুক্ত হওয়া
কতটা সম্ভব আজ? দারুণ খরায়
বৃষ্টি হচ্ছে ভেবে পুলকিত আমি, অথচ বাইরে
বেরুলে পুড়তে থাকি চৈত্রের প্রখর চিতাগ্নিতে। অচিরেই
গায়ে ফোস্কা ফোটে,
ঠোঁটে ফেটে রক্ত ঝরে, চতুর্দিক থেকে
রাগী মোষ বাঁকিয়ে দুর্দান্ত শিং ধুলোম্লান পথে
তেড়ে আসে; গাছের পাতারা হয় শুয়োরের কম্পমান দাঁত!
দুপুরের ফতুর পুকুরে ঘুমে-হাঁটা
লোকের মতোই একজন জাল ফেলে;
নানারঙা কত যে মাছের মেলা তার এক্তিয়ারে
আসে আর উৎফুল্ল বাজারে নিয়ে যায়। মেলে ধরে
ক্রেতাদের সমুখে, সবাই বারবার
বিশদ পরখ করে বলে,-
সরাও তোমার মাছ এক্ষুণি, এসব
পচা মাছ কেনার মোটেও সাধ নেই আমাদের।
এ কেমন নিকিরি এখানে বসে আছে গোধূলিতে
নিঃসঙ্গ, বিমর্ষ, অবসন্ন? চুপচাপ, গালে হাত;
বাজারে কিছুই বিকলো না
বলে কি হতাশা তাকে ছুঁয়েছে এখন? কাছে গিয়ে
দেখি সে-তো অবিকল আমার মতোই। তাকে আমি
নিজের যমজ ভাই নিশ্চিত ঠাউরে
নিয়ে হাত রাখব ভায়ের হাতে? টেনে নেব বুকে?
বিস্ময়ের ঘোরে দেখি, আমি আর সে লোকটা অভিন্ন মানুষ।
১৮.১০.৯৮

অরূপ রতন

যখন নেপথ্যে ডুব দিয়ে অতলে কাটাতে চাই
নিজস্ব সময় কিছু, জাল ফেলে, আমার চুলের মুঠি ধরে
ওরা টেনে তুলে আনে কর্কশ জমিনে।
আমার দু’ চোখ ঝাঁ ঝাঁ রোদে ভীষণ ঝলসে যায়;
চিত্তপুর দহনের আড়ালে থাকার
জন্যে সকাতর যাঞ্ঝা করে সবুজের দীর্ঘস্থায়ী আলিঙ্গন।

চারপাশে কী তুমুল চেল্লাচেল্লি, নিরন্তর কাদার অশ্লীল
খেল; দেখি, বেদাগ সফেদ পাঞ্জাবিতে বিষ্ঠা আর
কালি মেখে কত লোক বিকট উল্লাসে ফেটে পড়ে,
চায়ের টেবিল তোফা তপ্ত করে তোলে। তপোবনে
বসবাসকারী ঋষি নই,
নই কোনও বিয়াবান বনচারী ধ্যানী দরবেশ,
তবে নরাধম কোনও পতিত পাষণ্ডও নই,
আমি শুধু এক শব্দ শিকারি প্রেমিক।

এ শহরে আছে একজন, কোমল সোনালি যার
হাত, যে আমার শরীরের ক্লেদ ধুয়ে মুছে ফেলে
প্রেমজলে বলে, ‘কবি, যত ইচ্ছে তোমার গভীরে
দাও ডুব, নিভৃত পাতাল থেকে খুঁজে আনো অরূপ রতন।

আজীবন অক্লান্ত সাধনা ছিল তাঁর

আততায়ী অন্ধকার অতর্কিতে বর্বর, দাঁতাল
হিংস্রতায় গ্রাস করে পূর্ণিমাকে। মহিমার বিনাশে কাদার
কৃমিকীট, সরীসৃপ, পিশাচেরা উল্লসিত হয়। ইতিহাস
যাঁকে খোলা পথে ডেকে এনেছিল গভীর সংকেতে,
তিনি তো নিজেই মহা ইতিহাস। বুলেটের ঝড়
পারেনি মাহাত্ম্য তাঁর কেড়ে নিতে। বরং শোকার্ত অশ্রুকণা-
সমুদয় আজও আকাশের
নক্ষত্রণ্ডলী হয়ে জ্বলে আর গৈরিক প্রান্তরে,
ধূসর দিগন্তে খেয়াঘাটে চারণের কণ্ঠে প্রায়শ ধ্বনিত
দেশজ গৌরব-গাথা তাঁর।

আজীবন অক্লান্ত সাধনা ছিল তাঁর জীবনের
বলিষ্ঠ বিকাশ আর সৌন্দর্যের অকুণ্ঠ বিশদ প্রকাশের।
প্রগতি, কল্যাণ আর সুন্দরের
শক্র যারা, তারাই হেনেছে তাঁকে নব্য এই যেশাসকে, আর
তাঁর চার অনুসারী, বিশ্বস্ত, সাধনাদীপ্ত তাঁরাও কুটিল
নীল নকশা অনুসারে হয়েছেন অনুগামী তাঁর
আমারাতে একই পথে। তখন চৌদিকে
ছিল জানি লোভাতুর হিংস্র সব শ্বাপদের রাত।

সংহার করেও ঘাতকেরা তাঁর দিকে মরণের
আঁধার পারেনি ছুঁড়ে দিতে। তাঁর প্রাণের স্পন্দন
আছে জেগে অগণিত মানুষের বুকে। আমরা কি পুনরায়
হারিয়ে ফেলব পথ? তাঁর নাম, অমেয় খ্যাতির
নির্লজ্জ ব্যবসা দেখে ইদানীং, হায়,
শঙ্কা হয়, এই নাম কখনও ধুলোয় কিংবা পিচ্ছিল কাদায়
হঠাৎ ঢাকা না পড়ে। তাহলে বাংলার
সূর্যোদয় মুখ লুকোবার ঠাঁই খুঁজবে কোথায়?
১২.৮.৯৮

 আনন্দ

আমার বাসার সামনের অনাথ শিশুনিকেতনের
দেয়ালে সেঁটে-থাকা ঝলমলে রোদ দেখে
আজ কী যে ভালো লাগে আমার। আনন্দ
আমাকে জড়িয়ে ধরে আন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। অথচ এই যে
এখন খুশির ঢেউ আমাকে
ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে, তার কোনও বিশেষ কারণ রয়েছে
বললে, ভুল বলা হবে। এই মুহূর্তে
আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলো দিয়ে দিতে পারি
কোনও প্রকৃত পুস্তক প্রেমিককে,
এখন আমি নির্দ্বিধায় আলিঙ্গন করতে পারি
যে-কোনও কুষ্ঠরোগীকে,
এই মুহূর্তে নিষ্ঠুরতম শক্রকেও ক্ষমা করা
অসম্ভব নয় আমার পক্ষে, একজন ঘাতকের সঙ্গে
এক টেবিলে বসে আহার করতেও কুণ্ঠিত হবো না।
আজ যখম ভ্রমণ করছি আনন্দ-ভেলায়, এখন আমি
মৃত্যুচিন্তায় কাতর নই, অদূর ভবিষ্যতে
বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ জলছলছল পাতালে নিমগ্ন হবে ভেবে
বিষাদে মেঘাচ্ছন্ন নয় আমার মন। আহ্‌, কী ঐন্দ্রজালিক
ক্ষমতা এই আনন্দের; ক্ষণিকের জন্যে হলেও মুছে ফেলে
শোকের ছায়া, বিচ্ছেদের বেদনা।

আজ হঠাৎ জানতে পারলাম পীড়া তোমাকে শয্যাগত
করেছে, আগুনের হল্কায় যেন
পুড়ে যাচ্ছে তোমার শরীর। মুহূর্তে আমার আনন্দের দীপ
নিভে গেল অশুভের ফুৎকারে। বিষাদ শ্রাবণের মেঘ হয়ে
ছেয়ে ফেলল আমার চেতনাকে; আনন্দ নিমেষে
গুলিবিদ্ধ পাখির মতো নিষ্পন্দ পড়ে রইল ধুলোয়।
২৭.১০.৯৮

আমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করে

আমার মা তার শত স্নেহার্দ্র চুম্বনে কিছু শব্দ আস্তে সুস্থে
আমার সবুজ শৈশবের আদিপর্বে
অন্তরঙ্গ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ওষ্ঠ, দৃষ্টিপাত
থেকে রোজ নিজের অজ্ঞাতসারে কুড়িয়ে নিয়েছি
ভাষার পরাগ কত আর
স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ফুটেছে কুসুমরূপে শিরায় আমার।

জাগরণে সর্বক্ষণ অবশ্যই, এমনকি গভীর ঘুমের ভেতরেও
মাতৃভাষা গুঞ্জরিত ঠোঁটে; স্বপ্নে দেখি, ‘হাসি খুশি’
খেয়া হয়ে ভাসে মগ্ন চৈতন্যে আমার
এবং ‘সহজ পাঠ’ হাঁসের ধরনে
প্রফুল্ল সাঁতার কাটে ভাবনার ঢেউয়ে ঢউয়ে, আঁধারে আলোয়।
নিজেকেই খুঁজি নিত্য আপন ভাষার নানা রঙে, নানা ছাঁদে।

কখন যে বাংলা বর্ণমালা কবিতার সাজে এল
আমার একান্ত ঘাটে, ভাসালো কলস
রহস্যের ছন্দে ভোরবেলা,
প্রখর দুপুরে আর গোধূলিরঙিন ক্ষণে, প্রগাঢ় নিশীথে,
বুঝতে পারিনি ঠিক, শুধু তার ইঙ্গিতে ঘুরেছি একা একা
মন্ত্রমুগ্ধ দিগ্ধিদিক। মাতৃভাষাকেই
নিশ্চিত প্রাণভোমরা জেনে
নিজেকে ক্ষইয়ে যুগিয়েছি তাকে সর্বদা জীবনসঞ্জীবনী।

বায়েন্নেয় ওরা এই প্রাণভোমরাকে
টিপে মেরে ফেলার চক্রান্তে মেতে করেছিল
হেলায় হরণ প্রাণ চিরতরে কতিপয় রাঙালির
তরুণ নিশ্বাস। সে-নিশ্বাস বয়ে যাবে যুগে যুগে
শহীদ মিনারে, গ্রন্থে, জাতীয় স্মৃতিতে। সর্বদাই
আমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করে বাংলা বর্ণমালা।
১৩.২.৯৯

 আমার ডান হাত

বহুদিন পর কাল রাতে স্বপ্নে এলেন
আমার মা। শুয়ে আছেন তিনি বিছানায়, আমি
বসে আছি শয্যার পাশে। তিনি বারবার
আমার ডান হাতের দিকে তাকাচ্ছিলেন
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে হাত নিজের হাতে নিয়ে
আঙুলগুলোয় আদর বুলোতে বুলোতে
কী যেন বলতে চাইলেন আমাকে। হায়, কতকাল
তাঁর কোনও কথা শুনি না, কত যুগ তাঁকে দেখি না।

এখন তো কালেভদ্রে কেবল স্বপ্নের ভেতর তাঁর সঙ্গে আমার
এই দেখা। দেখি, কখনও তিনি দূরে দাঁড়িয়ে আছেন
সত্তায় নিঝুম নীরবতা জড়িয়ে, কখনও কী যেন
বলতে চান, অথচ অস্পষ্টতায় হারিয়ে যায়
সেসব কথা। কখনও আমার মা চার বেহারার একটি রূপালি
পাল্কিতে চড়ে দূর দিগন্তে মিলিয়ে যান।

কাল রাতে মাকে আমার ডান হাত ধরে
বলতে শুনলাম, ‘তোর এই হাত নিয়ে আমার
দুশ্চিন্তার শেষ নেই রে। তোর চারপাশে
গিজগিজ করছে দুশমন, ওদের
চক্ষুশূল তোর এই ডান হাত, সকালসন্ধ্যা
ওরা এর বরবাদি চায়। তারপর তিনি
আমার ডান হাতটিকে নিয়ে
ভরিয়ে দিলেন স্নেহাশিসে। হঠাৎ অদৃশ্য তাঁর বিছানা।

ঘুম ভেঙে গেলে ডান হাতের দিকে তাকাই,
সেখানে যেন মায়ের স্পর্শ লেগে আছে তখনও।
১৩.৯.৯৮

আমার সাতদিনের অনুপস্থিতি

এবারই তো প্রথম নয়, আগেও গিয়েছি অনেক
বিদেশ বিভুইয়ে, কোনও কোনোবার দিব্যি থেকেছি
মাসের পর মাস আপন গহন এই ঘরের
হৃদয়ের শ্যামল উষ্ণতা থেকে কত না
হাজার হাজার মাইল দূরে। অথচ এবার আমার
মাত্র সাতদিনের অনুপস্থিতি
কেমন বেগানা বিষণ্ন করে ফেলেছে ওকে
যেন হাজার বছর ধরে অজস্র বজ্রকীট খেয়েছে তার স্নিগ্ধতাকে।

যে পুরোনো চেয়ার রোজ আমাকে আশ্রয় দিয়ে
প্রফুল্ল, নতুন হয়ে উঠত, সে কেমন
মুখ ভার করে আছে, যেন কোনও গভীর শোক
রেখেছে বন্দি করে। যে বাংলা অভিধানটি হামেশা
আমার অন্তরঙ্গ স্নেহস্পর্শে পুলকিত হয়ে আমাকে পৌঁছে
দিয়েছে কত অজানা রত্নদ্বীপে, সে আজ বড়ই বিমুখ। রবীন্দ্রনাথ,
শেক্সপিয়া, গ্যয়টে, দস্তয়ভস্কি, রিল্কে, কালিদাস, জীবনানন্দ, কির্কেগার্ড,
গালিব উদাস তাকিয়ে আছেন অনন্তে, যেন মর্মাহত আমার আচরণে!

আর আমার প্রিয়তমা কৃষ্ণকুমারী কবিতার খাতা
কৃষ্ণচূড়া-অভিমানে জ্বলে উঠছে, অথচ আমি যে সুদূর
বিদেশ বিভুঁইয়ে বারবার তারই ঠোঁট থেকে অমৃত
অধীর করেছি পান, গভীর নিশীথের স্তব্ধতাকে ঈর্ষান্বিত করে
বেঁধেছি আলিঙ্গনে কখনও বাস্তবে, কখনও স্বপ্নের মাতাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে
সে তা না জেনেই রেখেছে বন্ধ তার হৃদয়-দুয়ার পাথুরে স্তব্ধতায়।

যদি নিই চিরকালীন বিদায়, হই বিলীন অস্তিত্বহীনতায়
তাহলে কী করবে আমার কৃষ্ণকুমারী প্রিয়তমা এবং আরও কেউ কেউ?

এ কেমন লুকোচুরি খেলা

এ কেমন লুকোচুরি খেলা নিশিদিন? কখনও সে
সহজেই দেখা দেয়, খুব কাছে এসে বসে, হাত রাখে হাতে,
সুধা ঢালে

ঠোঁটে; চোখে চোখে কী-যে মাধুর্য ছড়ায়
যেন অমরতা দিচ্ছে এঁকে ক্ষয়া অস্তিত্বে আমার।

কখনও ভীষণ মেতে ওঠে অবহেলায়, নির্দয় প্রত্যাখ্যানে-
দূর থেকে চলে যায়। করে না ক্ষণিক দৃক্‌পাত, যেন আমি
বড়ই বেগানা কেউ। জ্যোতিচ্যুত একা পড়ে থাকি গৃহকোণে
চুপচাপ, মাঝে মাঝে করি পায়চারি দিশেহারা
নাবিকের দৃষ্টি নিয়ে। তাকাই কাছের পুষ্পহারা,
বস্তুত দুঃখিত, অতি ম্লান কৃষ্ণচূড়া গাছ, ভাসমান মেঘ,
সন্ধ্যার পাখির দিকে। দেখি গলিপথে একজন ঢ্যাঙা লোক
হেঁটে যায়; কখনওবা কবিতার খাতা খুলে বসি।

একদিন অকস্মাৎ চোখে পড়ে-সেই মায়াবিনী
চলেছে আমাকে ফাঁকি দিয়ে মেঘলোকে
ভেসে ভেসে। ‘এসো, এসো একান্ত আমার কাছে, তোমার
জন্যেই
আমার প্রতীক্ষা জাগে বিলের বকের মতো’ বলে গাড় মিনতি
জানাই।
সে মোহিনী নির্দয় হাসির ঢেউয়ে দুলে বলে, ‘শোনো,
পশ্চিম বঙ্গের কোনও খ্যাত প্রবীণ, নবীন
কবির খাতায় বসে কাটাব সময় কাব্যপঙ্‌ক্তি অকৃপণ
বিলিয়ে এবং বাংলাদেশে কতিপয় অনতিতরুণ আর
তরুণ কবির ঘর ছুঁয়ে কিছু চিত্রকল্প, উপমা, রূপক
না চাইতেই দেব উপহার। আজ তুমি মাথা কুটে মরলেও
পাবে না আমার ছোঁয়া। খাতায় যতই
শব্দ লেখো, হবে সবই নিষ্প্রাণ, অসার খড়কুটো।

সকালের রোদের উল্লাস আর বাউল-দুপুর
আমার হৃদয় ছিঁড়ে নাচে; আমার কুয়াশাময়
মাথার ভেতর কয়েকটি ফড়িঙ হারায় পথ, কিছু সাঁকো
ভেঙে পড়ে, জোনাকিরা পারে না ফোটাতে জ্যোতি এবং
আমার
অন্তর্লোক গুমরে গুমরে ওঠে শব্দহীনতায়, এক-আধটা
পঙ্‌ক্তিও দেয় না ধরা। ঘোর অমাবস্যায়, অগাধ পূর্ণিমায়
নিষ্করুণ কণ্টকিত প্রহর যাপন শুধু আর দেখি কত
স্বপ্ন, মনে পড়ে না কিছুই, সবই হিজিবিজি, ক্রূর।

একটি শিশিরভেজা শেয়ালের রক্তঝরা মুখে, নর্দমায়
পড়ে-থাকা ইঁদুরের মৃত দাঁতে, নুলো ভিখিরির খুব নোংরা
ন্যাকড়ায় পলাতকা মায়াবিনী চোখ রেখে বলে,
‘পারো তো এসব থেকে আমার রূপের উৎসটিকে করো
আবিষ্কার।

 একজন কবি

আহ্‌ এত আতশবাজি, মালার বাহার, আলোর প্লাবন
চারদিকে। কেমন একটা মন-মাতানো সুরের
ঘূর্ণিনাচ সবুজ লন, ফুলের গাছ, গাড়ি বারান্দা, আর
বাড়ির পার্নিশকে দোল খাওয়াচ্ছে। নানা-বয়েসী
নর-নারী কবিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। হাসিমুখে
কত কথার গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছেন
তার ওপর। কেউ কবির কোনও কাব্যগ্রন্থের ভুল নাম
বলে প্রশংসার ঢেউ খেলিয়ে দিচ্ছেন। কেউ অন্য কোনও
কবির শস্তা কোনও পঙ্‌ক্তি ভেবে। এই প্রমাদ
মুখ বুজে হজম করলেন কবি। তবে সান্ত্বনা,
ধীমান এক সমঝদার মৃদু হেসে বলেন, ‘আমাদের এই কবি
এমন তরল পঙ্‌ক্তি লিখতেই পারেন না।

বেশ কয়েক বছর এই কবিকে নিয়ে অনেক জ্বলজ্বলে সভা,
জমজমাট আসর অনুষ্ঠিত হল; শহরের বহু সংগঠন
তাকে সামনে রেখে নিজেদের অস্তিত্বে সোৎসাহে
বিস্তর বিজ্ঞাপনের রঙ-জৌলুস মেখে নিল। আহ্‌ এত আতশবাজি
মাইক্রোফোনের পাড়া-কাঁপানো দাপট।

বহু বছর পর সেই কবি সন্ধ্যারাতে বসে আছেন তার
লেখাপড়ার ঘরে একা, অবসন্ন; অসুস্থতা ধেড়ে ইঁদুরের মতো
তাকে কুট কুট করে খেয়েছে। চোখের আলো
নিভে এসেছে প্রায়। অনেকদিন থেকেই
অনেকেই আসা ছেড়ে দিয়েছে বয়েসী কবির বাসগৃহে।
আজকাল কোনও অনুষ্ঠান অথবা উৎসবের
চটকদার আয়োজন নেই তার উপলক্ষে। এখন তিনি
উজাড় বাগানের মতো পরিত্যক্ত, তার কাছে রোজ
আসা যাওয়া করে একমাত্র অতিথি-
অতীত দিনের ক’জন স্মৃতি।
২৭.৮.৯৮

একটি উদ্যানের ইতিকথা

বলব না কোনওদিন, এ-কাজ আমিই শুধু করেছি একাকী
কিছুই ছিল না, আমি এই বিরানায়
নিষ্ফলা মাটিতে এসে বড় একা দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রুক্ষ, বন্ধ্যা জমিনে ছিটিয়ে বীজ, বহুদূর থেকে জল এনে
সরস করেছি মাটি, নতুন জন্মের ঘ্রাণে চতুর্দিক হেসে
উঠেছিল। বলব না, এ কেবল আমার একার সৃজনের রূপটান।

ভাসমান মেঘ বলেছিল, হে শ্রমণ,
তুমি চাইবে না, তবু রুদ্র তাপে ছায়া দেবো,
পেয়েছি ছায়ার বদান্যতা বারবার। জ্যোৎস্না এসে
আন্ধারকে করেছে পূর্ণিমা আর শিশিরের স্নেহ
ফুটিয়েছে ফুল রাশি রাশি
রঙ বেরঙের, এ উদ্যান গড়িনি কখনও একা।

কখনও করিনি স্বত্ব দাবি, ‘আমারই, আমারই’ বলে
কাঁপাইনি কোনও দিক, কোনও পাড়া, এ তোমার, তার,
বস্তুত সবার-এই সত্যটুকু লিখেছি জমিনে,
গাছের পাতায়, সুদূর নক্ষত্রলোকে, রাঙা দিগ্বলয়ে।

বন্ধুগণ, এই লিপি পাঠ করা বড়ই সহজ; দ্বিধাহীন
স্পষ্ট করি উচ্চারণ, এ উদ্যান তোমাদের থাক চিরদিন,
দিকে দিকে প্রবল কীর্তিত হোক তোমাদের অবদান, শুধু
দূরে অন্তরালে বসে ভাবব, বস্তুত উদ্যানের গৌরবগাথায় আজ
আমি তো নিমিত্ত মাত্র। কাউকে কিছু না বলে পথচারীহীন
পথে চলে যেতে পারি, আকাশে সূর্যাস্ত, ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়;
এখন তোমরা ছায়াপ্রতিম আমাকে
দীর্ঘশ্বাস ছাড়াই বিদায় দাও, আমি দ্রুত অপসৃয়মাণ স্মৃতি।
১৪.১২.৯৮

একটি নিবাসে কয়েকটি শতক

বহু রক্তপাত, বহু ধ্বংস আর সৃজনের অন্তরঙ্গ
একটি শতাব্দী অবসিত হলে আরেক শতাব্দী সাবলীল
উদয়ের পথে এসে দাঁড়ায় এবং শুরু হয়
নতুনের জয়ধ্বনি, তবু পুরোনোর কিছু পরাজয় স্মৃতি,
কিছু ঝাঁঝ রয়ে যায়। মানবের দীপ্ত পরিচয়, কীর্তিগাথা
জেগে থাকে; একটি নিবাসে কয়েকটি শতকের বসবাস
আমরা দেখতে যাই কখনও কখনও। গৌরী, তুমি
দ্বিতীয় র্যা মেসিসের অস্থিচর্মসার
প্রাচীন শরীর দেখে মুখ মুহূর্তেই
ফিরিয়ে নিয়েছ জানি সুদূর মিসরে। আর আমি
অন্য কোনওখানে নেফিরেত্তির মূর্তির দিকে বিমুগ্ধ তাকিয়ে
কাটিয়ে দিয়েছি বহুক্ষণ, কল্পনায়
হয়েছি বিভোর। চেতনায়
রৌদ্রজ্যোৎস্না খেলা করে বারবার মিউজিয়ামের
প্রদর্শনী কক্ষে আর সদর সিঁড়িতে।

গৌরী, তুমি আর আমি কখনও হঠাৎ
জাদুঘরে মিলিত হয়েছি,
যদিও যুগলবন্দি সুরে মেতে পাশাপাশি
দু’জন দেখিনি কোনওদিন কোনও মমি
অথবা সুদূর শতাব্দীর তৈজসপত্তর কিংবা অলঙ্কার।

মিউজিয়ামের অডিটরিয়ামে, সিঁড়িতে পেয়েছি
সান্নিধ্য তোমার কালেভদ্রে, বলেছ নানান কথা
স্বপ্ন জাগানিয়া সুরে। তোমার মনের কথামালা
ঝরেছে মুক্তোর মতো। এইসব মুক্তো, হায়,
আমাদের চিরপ্রস্থানের পরে কখনও সঞ্চিত
থাকবে না কোনও জাদুঘরে।
১২.২.৯৯

একদা এখানে

একদা এখানে এই বাড়িতে করত বসবাস
পরম শান্তিতে কতিপয় নিরিবিলি বাশিন্দা, ছিল না কোনও
চেঁচামেচি বাড়িটিতে, কিংবা কোনও দিন অকস্মাৎ
লাগেনি আগুন, ধসে পড়েনি দেয়াল,
বারান্দা অথবা ছাদ তাসের ঘরের মতো। কখনও কখনও
শোনা যেত নূপুরের ধ্বনি আর মালকোষ, বসন্ত বাহার।

বাড়িটার সমুখে উদ্যান ছিল, ছিল কিছু
রঙবেরঙের ফুল, মাঝে মাঝে পাখিদের গানে
পরিবেশ চিত্তহারী ছন্দে ভোরবেলা
দ্বিপ্রহর অপরাহ্নে হতো নৃত্যপর। কখনওবা
তিন চারজন নারী ও পুরুষ চড়ুইভাতিতে
সুস্নিগ্ধ উঠত মেতে উদ্যানে; শিশুর
হাসির তরঙ্গ মাঝে মাঝে
লুটিয়ে পড়েছে ঘাসে, গাছের পাতায়।

কী যে হ’ল একদিন সেই বাড়ি থেকে মুছে গেল
সব কলরব, কার ফুঁয়ে যেন নিভে গেল বাতি,
দরজা জানালা ভাঙাচোরা, ঘরময়
চামচিকা ও বাদুড় । দেয়ালে সুদীর্ঘ বুনো ঘাস।

মাঝে মাঝে অন্ধকারে বাড়িটার বুকচেরা ঘাস
আর বুনোলতাময় জানালায় জোনাকির ভিড়ে
একটি রহস্যময় মুখ জেগে থাকে
প্রগাঢ় সময়হীনতার। কার মুখ? মেলেনি উত্তর আজও।
১৬.১.৯৯

 ওরে নির্বোধ

ওরে নির্বোধ, ওরে হঠকারী পদ্য-লিখিয়ে
কেন তুই শেষে এমন পদ্য লেখার নেশায়
মেতেছিলি এই সূর্য ডোবার একটুকু আগে?
বেশ তো বিকেলে ছিলি হাসিখুশি সুখের ডেরায়,
কেন মিছেমিছি পোড়ালি সে-ডেরা ভরসন্ধ্যায়?
ওরে নির্বোধ, অচল মুদ্রা, কেন রে নিজেকে
ভব্য রাখতে শিখলি না তুই? কেন প্রিয়তমা
নারীর হৃদয় এভাবে ভাঙলি হঠকারিতায়?
ওরে নির্বোধ, ওরে হঠকারী পদ্য-লিখিয়ে
অনেক গুণীর সহবৎ পেলি, তবুও শিক্ষা
হ’ল না তো তোর, মাতালের মতো টলতে টলতে
ঘুরলি বেঠিক পথে আর মুখ থুবড়ে পড়লি
নালা আর খাদে। তোর নামে কত কুৎসা রটলো,
ওরে নির্বোধ, এখনও কি ভুল নিবি না শুধ্‌রে?
সময় তো হায় বেশি নেই আর, এখন সবার,
বিশেষত তোর দয়িতার কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখ।
১৩.৯.৯৮

 কবি

নিশীথ আমাকে তার থমথমে অন্ধকারে একটি গাছের
নিচে দাঁড় করিয়ে নিগূঢ় কিছু কথা
মৃদু বলে নেয়, অবয়বহীন তাকে ছুঁতে গিয়ে
স্তব্ধতার রোঁয়াগুলো আঙুলে জমাট বেঁধে যায়। সন্ধ্যারাতে
হুইস্কি করিনি পান, তবু কেন মাথার ভেতর
নানা ফুল ফোটে আর নক্ষত্র-নারীরা নেচে ওঠে
দুলিয়ে সোমথ স্তন? কার ইশারায়
ক্ষণে ক্ষণে ঝোপঝাড়ে জ্বলে আর নেভে ক’টি কবিতা-জোনাকি?

আমি কি কখনও কোনও কোকিলকে গলা টিপে, হায়,
মেরেছি বিভ্রমে? তবে কেন সুর তুলতে গেলেই বারবার
সুর কেটে যায়, যেন আনাড়ি সাধক একজন
জবুথবু, ম্রিয়মাণ। আমি তো নিজের কাছ থেকে
ক্রমান্বয়ে সরে গিয়ে বাঁশপাতা, বাতাসের চুমোয় অস্থির
ঘাসের সবুজ ডগা, পাখির বুকের
নিবিড় স্পন্দিত ছন্দ হতে চাই। নিঃসঙ্গতা হয়ে
আমাকে বিরান মাঠে, হু হু দিঘি নিয়ে যায়।

কখনও চাঁদের ঠোঁটে আঙুল ঝুলিয়ে
স্মরণে ফিরিয়ে আনি ভুলে-যাওয়া পদাবলী আর
পায়ের বিবর্ণ এক পাটি জুতো খুঁজতে খুঁজতে
নিশীথে বিহান করে ফেলি। কখন যে
ভোরবেলাকার রোদ অলক্ষ্যে বদলে দেয় মনের প্রচ্ছদ,
বুঝতে পারি না। অকস্মাৎ
সৃষ্টির মোরগঝুঁটি মুঠোয় নিঃশব্দে ভরে নাচে
কবরের কালো ঘাস। আমাকে কবিতাসুদ্ধ গিলে
খাওয়ার উদ্দেশে কীটপতঙ্গের দল ধেয়ে আসে।

কবিতার বদান্যতা থেকে

কখনও কখনও এমনও তো হয়, কবিতার বদান্যতা থেকে
দূরে পড়ে থাকি ধু ধু নিষ্ফলা জমিনে। রাশি রাশি
রুক্ষ বালি মুখের ভেতর, হাত বিদ্ধ অজস্র কাঁটায়, চোখ দুটো
রক্তে ভিজে ওঠে বারবার, কিছু দেখা যায় কি না যায়,
বলতে পারি না কিছুতেই। আমার এ হাল দেখে
পাথরেরও বুক ফেটে ঝরবে শিশির,
অথচ কবিতা কাছে এসে
বসে না আমার মুখোমুখি, হাতে হাত
রাখে না, দু’চোখে তার বয় না তারার ঝর্নাধারা।
সময় আমাকে নিয়ে খেলা করে, যেমন বেড়াল
এক গাল হেসে
বানায় বিপন্ন ইঁদুরকে ক্রীড়নক। তাহলে কি
সত্যি সত্যি ক্রীড়নক আমি সময়ের ক্রূর হাতে? নিত্যদিন
করব লড়াই সব প্রতিকূলতার
বিরুদ্ধে ট্রাজিক নায়কের মতো। তীব্র খরাতেও
ফসলের আশায় থাকব ফাটা রক্তভেজা ঠোঁটে। সত্য বটে
কবিতা কখনও এসে কড়া নাড়ে, আবার আসে না বহুদিন।

হয়তো একটি পাখি এসে বসেছে রেলিং এ, অকস্মাৎ
এক টুকরো কাগজ পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে,
একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে পথে, এর
যে কোনও একটি চোখে পড়লেই, কিংবা কারও
চোখের রহস্যময় দৃষ্টি জাগলে স্মৃতিতে, ফের পলাতক।
কবিতা আসবে ফিরে অন্তরঙ্গ পুষ্পিত মুহূর্তে।

বুঝি তাই কবিতার বদান্যতা থেকে নির্বাসিত
হয়েও প্রত্যহ চাতকের মতো প্রতীক্ষায় থাকি।
১৫.১.৯৯

কবির মিনতি

থাকেন আপন মনে নিঝুম স্টাডিতে
নিমগ্ন পুস্তকপাঠে, কখনওবা কবিতা লেখায়। কয়েকটি
কবুতর রোজ তার আতিথেয়তায়
তৃপ্ত ওড়ে কাছের আকাশে
প্রফুল্ল ডানায়, ওড়ে রোদ্দুরের ঢেউ হয়ে। কবুতর
অকস্মাৎ রক্তধারা রূপে বয়ে যায় হাওয়ার চাদরে।

এ কেমন ভ্রান্ত কাল এল, ভাবলেন নিতি বই
থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, মনের নানা স্তরে
নানান ভাবনা ভিড় করে। দৃষ্টিপথে
তার ভাসে সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু, লালাসিক্ত জিভ,
রিক্সাচালকের শ্রমনিষ্ঠ শরীরে-ধরানো ক্ষিপ্ত আগুনের
মরণকামড়; চৌরাস্তায়, অলিতে গলিতে আজ
জাঁহাবাজ, উলঙ্গ অস্ত্রের স্বৈরাচার। এ কেমন
ভুল সময়ের বাঁকে দাঁড়ালেন তিনি? বড় প্রশ্নাকুল কবি।

বেদনার্ত, বিচলিত তিনি গোধূলিতে
পুস্তক, কবিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে বড় একা
নামলেন পথে, হেঁটে হেঁটে অস্ত্রের বাজারে এসে
থামলেন। একে একে সকল সফল
অস্ত্র-বিক্রেতার কাছে করজোড়ে অস্ত্রের বেসাতি
বন্ধের মিনতি জানালেন। সমবেত অট্রহাসির তরঙ্গে
কবির কাতর নিবেদন করুণ খড়ের কুটো,
তবু তার কণ্ঠে আজ কবিতার পঙ্‌ক্তি নয়, প্রার্থনার স্বর।

অস্ত্রের দোকানপাট আরও বেশি জ্বলজ্বলে, মুদ্রাস্ফীতি হয়,
কবির মিনতি শুধু অরণ্যে রোদন। অনন্তর
তাকে মারণাস্ত্রে তৈরি ক্রূসে বিদ্ধ করে
অসংখ্য খঞ্জরে অস্ত্র-বিক্রেতারা মাতে অপূর্ব প্রদর্শনীতে
আলোকসজ্জায়, নৃত্যগীতে মশগুল! ক্রুশবিদ্ধ, অসহায়
কবির বুকের রক্তধারা ঝরে ধূসর ধূলায়, বয়ে যায়
নর্দমায়। কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা শোকগাথা হয়ে ঢাকে
কবির নিষ্পন্দ ক্ষতময় শরীর, দূরের আসমানে ঝোলে
নৈর্ব্যক্তিক চাঁদ, যেন ফাঁসি হয়ে গেছে ওর আর শহরের
গৃহকোণে একা অন্য নব্য কবি লেখে অস্ত্রবিরোধী কবিতা।
১৩.২.৯৯

কাঁটার মুকুট

প্রত্যহ পাথর ছুঁড়ে মারবার লোকের অভাব নেই এই
চৌরাস্তায়্য, অলিতে গলিতে। ডাকলেই বেশ কিছু
লোক জুটে যায়, হৈ-হল্লায়
মেতে ওঠে, করে নিতে চায় হাতের প্রভূত সুখ। কেউ কেউ
বর্জ্য, বিষ্ঠা মেখে দেয় কারও কারও দেহমনে আর
কেউ বা ফাটায় মাথা লাঠির আঘাতে।

নির্যাতনে দড় ওরা, কখনও কখনও
জিহ্বার প্রখর এস্তেমালে ক্লান্তিহীন, তুখোড় মোড়ল
আর তার স্যাঙ্গাতেরা মিথ্যা অপবাদের পেরেক
ঠুকে ঠুকে যাকে ওরা ক্রমে
সেঁটে দেয়, তার রক্তবিন্দুগুলি
তপ্ত ধুলো বালিতে বিলীন নিমেষেই।

লোকটা নিভৃত ঘরে শব্দের আতশবাজি জ্বেলে
অনিন্দ্য শোভার ধ্যানে কাটাতো সময়
আর সঙ্গোপনে গড়ে নিয়েছিল নিজস্ব জগৎ,
দ্যুতি যার পড়তো ছড়িয়ে সবখানে। অথচ সে
বহুরূপী মুখের ঝামটা আর প্রতিবেশীদের তিরস্কার
সয়েছে অনেক, শেষে পরানো হয়েছে তাকে কাঁটার মুকুট!
১২.১২.৯৮

 কাল রাতে

কাল রাতে স্বপ্নের ভেতরে
কী-যে দেখেছিলাম, কিছুই স্পষ্ট মনে নেই। তবে
এটুকু দেখেছি বলে মনে হয়, কয়েকটি পাতাহারা বড়
নগ্ন গাছ পথপ্রান্তে বিশীর্ণ দাঁড়ানো ছিল কংকালের মতো।

সেসব গাছের খুব কাছে
দাঁড়িয়ে আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম কারও
জন্যে নাকি বৃক্ষের সবুজ
পরখ করার কোনও জরুরি তাগিদ ছিল? পথ
ভুলে গিয়ে সেখানে হাজির হওয়া ছিল কি আমার
মনের গহন কোনও স্তরের বাসনা? সম্ভবত
এরকম কিছু নয়, বস্তুত চেয়েছি
নিজেরই অজ্ঞাতসারে তৈরি করে নিতে ছায়া ছায়া কিছু কথা।

কাল রাতে স্বপ্নের ভেতরে আরও আলাদা রকম
গূঢ় দৃশ্যাবলী দেখবার সাধ ছিল;
হয়নি তো দেখা, শুধু ঘোর
স্তব্ধ কুয়াশায়
কে যেন যাচ্ছিল হেঁটে, বুকে তার উদ্ভট হরফে
লেখা ছিল ‘মরণ’ এবং
সে দাঁড়াল ঘুরে, হিম কুয়াশায় ভরা দু’টি চোখের কোটর।
৬. ১.৯৯

কুয়াশায়

ভীষণ কুয়াশা চতুর্দিকে, কাছে দূরে সব কুছি
দৃষ্টির বাইরে, আছে শুধু
প্রবল হোঁচট খাওয়া। মনে হয়, ভেজা মাটি ফুঁড়ে
আসছে বেরিয়ে দ্রুত মানুষ সদৃশ প্রাণী, তবে
প্রকৃত মানব নয়। ওরা চন্দ্র, সূর্য, তারা
চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে, শীতার্ত, রোমশ অন্ধকারে ডুবে যাই।

আমার পাশেই ছিল জ্যোতির্ময়ী একজন, মন্ময় যাত্রায়
সমর্পিতা; যতই বাড়াই হাত, তার
হাত দূরে রয়ে যায় স্পর্শাতীত। মাটি কাঁপে, না কি
নিজেই টলছি খুব। গলা ছেড়ে ডেকে
ওঠার বাসনা তীব্র, অথচ হঠাৎ যেন হারিয়ে ফেলেছি
কণ্ঠস্বর; আমার জীবন আজ শব্দহীন ধু ধু আর্তনাদ।

শূন্যতাই চায় সারাক্ষণ
কখনও অস্ত্রের নাচ হয়ে,
কখনওবা অসংখ্য বৃশ্চিকময় খাদ রূপে, হায়,
আমাকে দখল করে নিতে। শূন্যতার দাঁত
আমার সত্তায় তীক্ষ্ণ বসে যায় বেলা অবেলায়। অকস্মাৎ
রোদ ওঠে, একটি কি দু’টি পাখি কাঁটাঝোপে
গান গায়, চোখ পড়ে নিজের জামার দিকে, এ কি!
সমস্ত শরীর জুড়ে কবরের ভেজা মাটি না কি?

 কে একজন

হল্‌দে পাখির নরম বুকের মতো বিকেল বিশ্রামের
আমেজে বুঁদ ছিল। চোখ বুজে এসেছিল প্রায়, হঠাৎ
সে কী ঠোকর কাদাখোঁচা আর বাজপাখির; ঠোকরে
ঠোকরে বিকেলের পেলব হলুদ অমাবস্যা হয়ে যায়।
অমাবস্যায় হাওয়ার গোর মাস্তানি, বিয়ারের ক’টি
খালি ক্যান ক্ষুধার্ত ধুলোয় গড়াতে গড়াতে ডান
থেকে বামে। জিনস্‌-এর একজন কামার্ত ট্রাউজার
একজন লাজনম্র ভড়কে-যাওয়া শাড়ির দিকে ধায়।
আকাশের কম্পমান নক্ষত্রসমাজ ফ্যালফ্যাল চোখে
তাকিয়ে থাকে; গাছের ডালপালাগুলো বড় বোবা
আর্তনাদে নিথর! একজন ধনকুবের, লাম্পট্যের সেরা
প্রতিকৃতি, হাতের তালেবর দশ আঙুলের দশটি
সুতো নাড়ছে লোভাতুর আন্ধারে। শহর সেই সুতোর জালে
জড়িয়ে গিয়ে ভয়-বিহ্বল হরিণ, বেজায় লুণ্ঠিত এবং ক্রূর
অন্ধকারের থাবা ওকে অন্ধ করে ফেলে। কে একজন,
আহা কী কান্তিমান, হাতে তারাবাতি নিয়ে খেলতে
খেলতে চৌরাস্তায় দাঁড়ায়; দু’চোখে তার স্বপ্নের গোধূলি
এবং চারদিকের ধুলোয় সে গোলাপ আর পদ্ম ফোটায়।
১৯.১২.৯৮

কোনও ইন্দ্রজাল নয়

সকল সময় নয়, মাঝে মাঝে তাকে মাঠে কিংবা
পার্কে দেখা যায়, একা একা
হাঁটেন, ভাবেন কী-যে সে-কথা জানে না কেউ, শুধু
অনুমান করে নেয় যে যার ধরনে। মনে হয়
কারও সঙ্গে বাক্যালাপে নন তিনি তেমন আগ্রহী। বোঝা যায়
বয়স হয়েছে বেশ, স্বাস্থ্যে ঘুণ ধরেছে আগেই।

যতদূর জানি, তিনি কখনও সবুজ গাছ, ঘাস, কখনওবা
নীল পাখি হয়ে যান, কোনও কোনও গাঢ় সন্ধ্যারাতে
জ্বলেন নেভেন জোনাকির রূপে আর
কখন যে পথের কুকুর হয়ে শহরের অলিতে গলিতে
একলা ঘোরেন মধ্যরাতে, পথিক পায় না টের। কখনওবা
প্রজাপতি হয়ে যান চোখের পলকে। এমনও তো হয়, তার
দু’টি চোখ ময়ূরের চোখ, মাথা ঈগলের হয়ে যায় আর
প্রবেশ করেন তিনি নিমেষেই কোনও কুষ্ঠরোগীর ভেতর।

হয়তো আহার করছেন বসে ডিনার টেবিলে
কারও আমন্ত্রণে চারু পরিবেশে, অকস্মাৎ হয়ে যান তিনি
শীর্ণকায় ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক; কখন যে
মৎস্য শিকারির কায়া করেন ধারণ, পুনরায়
জালবন্দি সামুদ্রিক মাছ রূপান্তরে, বোঝা দায়।
এই তো চরম ভোগী তিনি,
পরমুহূর্তেই তার পরম ত্যাগীর ভ্রাম্যমাণ সত্তা ফোটে এই ভাবে।

ভেবো না এসব ইন্দ্রজাল কোনও, এ পক্রিয়া
বাস্তব ডিঙিয়ে যাওয়া অপর বাস্তব
যার স্পর্শে কারও কারও চেতনাপ্রবাহে
পদ্মের মতোই ভাসমান কুললক্ষণ কবির।
১০.১.৯৯

 খাতা আর কলমের বিবাদ

এই যে সারাটা সকাল আমার খাতার একটি খাঁ খাঁ পাতা
আর কলমের মধ্যে শুরু হ’ল রেষারেষি, তুমুল বাকবিতণ্ডা,
কে থামাবে এই হৈ হুজ্জত, এই চোখ রাঙানি, দাঁত-কটমটে
এই লড়াই? খাতার শাদা পাতা চায়, তার ধু ধু শূন্যতা শোভিত
হোক সবুজ লতাপতা, গোলাপ, চামেলি, লাল নীল পদ্ম,
আকাশের উদার নীলিমা, ঘাসবন, আর বাঁশবনের গাঢ় সবুজ
প্রিয়তমার দৃষ্টির কোমলতা, যা দিঘীসদৃশ, আর কোজাগরী
পূর্ণিমার ভরাট স্তব্ধতায়। অথচ আমার কলম আজ ভোরবেলা
শূন্য পাতার এই আবদারকে আজ এক বিন্দু আমল দিতেও
নারাজ। ঘাড় বাঁকিয়ে সে জেদ ধরেছে, খস্‌ খস্‌ করে লিখে
যাবে এমন কিছু পঙ্‌ক্তি যেগুলোয় থাকবে পাড়াগাঁ আর
শহর-ডোবানো হিংস্র খলখলে জল, মরা পশু, কলাগাছের
ভেলায় ভেসে-বেড়ানো, সর্বস্ব-হারানো মানুষ, দুঃখিনী
মায়ের বুকলগ্ন মৃত শিশু, বিপন্ন মানুষের উপচে-পড়া সকল
আশ্রয় কেন্দ্রের সাহায্য প্রার্থী ব্যাকুল, থরথর হাত,-
যেখানে ধর্ম, গোত্র, রাজনৈতিক আদর্শ বিচারের না-হক
বিলাসিতা গরহাজির; প্রলয়প্রতিম বিপর্যয়ে বিপন্ন মানুষ
শুধুই মানুষ। জেদী কলমের কথা শুনে আমার খাতার শূন্য পাতার
চোখ থেকে বেদনাশ্রু ঝরতে থাকে, যেন সে লখিন্দর-হারানো
বেহুলা, খাতার শূন্য পাতার বুকে ফুটতে থাকে কলমের আঁচড়।
১৩.৯.৯৮

 চাদর

গোধূলি রঙের মিহি নির্ভার চাদর গায়ে একজন যোগী
এলেন আমার ঘরে খুব নিরিবিলি। আমি ছাড়া
জানতে পারেনি কেউ; আমার চেয়ার আর কেঠো
খাটকে উপেক্ষা করে মেঝেতে গায়ের
চাদর বিছিয়ে বসলেন। মুখে তার কথা নেই, উদাসীন
দু’টি চোখে যেন বহু শতাব্দী নীরবে
ক্রীড়াপরায়ণ, শীর্ণ, ঋজু শরীরের এক ধরনের দ্যুতি
আমাকে জাগ্রত করে। তাকালেন তিনি
সারি সারি পুস্তকের দিকে, ঠোঁটে তার মৃদু হাসি
ফোটে, সে হাসিতে কী-যে ছিল ঠিক বুঝতে পারিনি।

ছিল কি অবজ্ঞা কিছু? না কি উপহাস? ছদ্মবেশী তামাশার
আভাস ছিল কি কোনও? প্রজ্ঞা-উদ্‌ভাসিত মন তার কখন যে
কোন্‌ ছন্দে দুলে ওঠে, বোঝা দায়। উচ্চারণহীন
কোন্‌ কথা আমাকে বোঝাতে চান তিনি,
কী করে বুঝব এই অবেলায়? তবে কি আমার
সকল পুস্তক-পাঠ, সন্ধান, যা-কিছু
সামান্য অর্জন, সবই ব্যর্থ? বেদনার অস্তরাগ
আমাকে দখল করে। যোগী টেবিলের কাছে এসে আস্তে
আমার সকল পাণ্ডুলিপি, অমুদ্রিত কবিতা সংগ্রহ হাতে
তুলে নিয়ে একে-একে পুড়িয়ে ফেলেন। মুখে তার
সুহাস কাঠিন্য আর বলেন নিষ্পৃহ কণ্ঠস্বরে,-
‘ভেঙেচুরে নিজেকে নতুন করো বারবার, বাহুল্যের ঝুঁটি
ছেঁটে ফেলে বুকে নিয়ে প্রকৃত শাঁসের অরুণিমা সৃজনের
পথে হাঁটো নিত্যদিন, ফোটাও মৃত্যুর ঠোঁটে সজীব কুসুম’।

অনন্তর যোগী তার চাদর আমার গায়ে জড়িয়ে নিভৃতে
বেরিয়ে গেলেন হেঁটে, উন্মুক্ত শরীরে কাঁপে রৌদ্র আজ জ্যোৎস্নার ঝালর।
২২.১১.৯৮

ছয়তলা বাড়ি

ছয়তলা বাড়ি, বড় একা, চুপচাপ
দাঁড়িয়ে রয়েছে, রুক্ষ দরবেশ যেন। মাঝে মাঝে
ওর খুব কাছে যাই, প্রবেশ করি না। প্রবেশের
পথ নেই, সিঁড়ি নেই কোনও।

বারবার কাছে গিয়ে দেখি, আলো নেই,
মানবের সংলাপের পাই না হদিশ
কান পেতে রাখলেও। সেখানে বাশিন্দা আছে কিনা,
বোঝা দায়। কখনও কখনও
আলো জ্বলে ওঠে, অকস্মাৎ দপ করে নিভে যায়। ভ্রন্তিবশে
পাখিও বসে না জানালায় কিংবা ছাদে।

এতবার ছয়তলা বাড়িটার খুব কাছে গিয়ে
দাঁড়িয়েছি, অথচ কখনও
অন্য কোনও পথিকের সাক্ষাৎ মেলেনি। কী আশ্চর্য
যখনই সেখানে যাই, ভোরবেলা, প্রখর দুপুর,
অথবা বিকেলবেলা, নিমেষে সন্ধ্যার
গাঢ় ছায়া নেমে আসে। মনে হয়, আমার পা দু’টো
চকিতে জমিনে কবরস্থ, আমি কেমন আলাদা হতে থাকি।
ছয়তলা বাড়িটার অন্তঃস্থল থেকে
রহস্যের কণ্ঠস্বর ছাড়া
আজ অব্দি অন্য স্বর শুনতে পাইনি।
১৯.১২.৯৮

জীবনের মতোই

একটি পূর্ণিমা-চাঁদ জেগেছিল হৃদয়ে আমার
দু’বছর নয় মাস আগে। সেই চাঁদের কোণায়
মালিন্য দিচ্ছে কি লেপে কিংবা কোনও ফেউ চেটে
পুটে দ্রুত করছে সাবাড়? আমি কখনও তোমার
সদ্য-লাশ ডিঙিয়ে জুয়োর ধোঁয়াময় টেবিলের
চতুর খিলাড়ি হবো কিংবা কোনও মদের আড্ডায়
সোৎসাহে শামিল হবো স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে কেন
পূর্ণিমায় যখন তখন লাগে কালিমার দাগ?

অকুণ্ঠ কবুল করি, আমার স্খলন আছে কিছু;
তোমার নালিশ তীর-বেঁধা পক্ষিণীর আর্তনাদ
হয়ে ঘোরে আমার মাথায়। যত দাও অপবাদ,
যত কষ্ট দাও, জানি সেই কষ্ট দ্বিগুণ তোমাকে
পোড়ায়, রক্তাক্ত করে দিনরাত। এ-কথা নিশ্চিত
জীবনের মতোই তোমাকে আজও তীব্র ভালোবাসি।
৭.২.৯৭

 জ্যোৎস্নাভেজা রাতে

অকস্মা ঘাসসুদ্ধ মাটি ফুঁড়ে জেগে ওঠে পুরোনো করোটি
জ্যোৎস্নাভেজা রাতে; কোজাগরী পূর্ণিমার রাত ছিল?
বহুকাল পরে যেন তার ইচ্ছা হ’ল পেতে এই পূর্ণিমার
আর কিছু দখিনা হাওয়ার
ঈষৎ পেলব স্পর্শ। এ করোটি কার
জানবে না কেউ খুব সহজে কখনও। এমনকি ঝানু কোনও
গোয়েন্দার পক্ষেও সম্ভব নয় আজ
এ বিষয়ে তেমন নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়ে যাওয়া।

চাঁদিনী পিপাসু এই পুরোনো করোটি বলবে কি
স্বেচ্ছায় কাহিনী তার ঘাস, মাটি, ভাঙাচোরা ইট,
ঝরা পাতা, টাকের মতোই
ন্যাড়া ক্ষেত, মেঠো ইঁদুর এবং থৈ থৈ
দিঘির নিকট? একজন আলাভোলা লোককবি
করোটির কাছে গিয়ে নীরবে দাঁড়ান;
করোটি বিজনে ঢেলে দেয় আস্তে সুস্থে জ্যোৎস্নাভেজা
কণ্ঠস্বরে কয়েকটি গূঢ় শ্লোক, মনে হয় তার।

রাত ক্রমে গাঢ় হয়, লোককবি হঠাৎ কুড়িয়ে নেন মাটি
থেকে কিছু খড়কুটো, তারপর হাতে আসে তার
কর্দমাক্ত সে করোটি, তিনি পূর্ণিমা চাঁদের দিকে
দৃষ্টি রেখে কিছু খড়কুটো দিয়ে ঘষে মেজে তুলে
ধরেন দু’হাতে, করোটির অভ্যন্তর থেকে ভেসে
আসে এক শোকার্ত প্রণয়গাথা আর
নিষ্ঠুর পশ্চাৎপদ সমাজের পাশব জুলুম। করোটির
চোখের খোঁড়ল থেকে অঝোরে রক্তাশ্রু ঝরে জ্যোৎস্নাভেজা মাঠে।
লোককবি দেখেন নিজের মাথা এবং করোটি
এক হতে থাকে, তার শরীর নিমেষে
হাওয়ায় মিলিয়ে যায় আর কবির মাথার খুলি
বড় কর্দমাক্ত, একা ঢুকে পড়ে ঘাসময় মাটির গভীরে।
১৩.৯.৯৮

ডাগর দুপুরে

দুপুর ডাগর হতে না হতেই ঘুম পায় আজকাল।
বয়সের দোষে? হবে হতেই তো পারে, কত সূর্য, কত চাঁদ
বিলিয়ে উদার আলো আমার শরীরে
নিঃশব্দে আমাকে নিয়ে গেছে
স্যাঁতসেঁতে আঁধারের দিকে। পাকা ফলের মতোই
আমাকে বানিয়ে ফেলে সময়ের ফুঁয়ে তাড়াতাড়ি
ঝরে পড়বার যোগ্য করেছে নিভৃতে। বুঝি তাই ইদানীং
ঝিমুনি দখলদার, মেঘ থেকে এক কালো ঘোড়া নেমে আসে।

চকিতে ঘোড়া কি পিঠে বয়ে নিয়ে যাবে ঝিমোনো আমাকে
মেঘ থেকে আরও অধিক মেঘের অন্তরালে,
রেখে দেবে জগৎ-সংসার বহির্ভূত উদ্যানের
ঝরাপাতাদের ভিড়ে? সেই সব মরা
পাতাদের ভিড় ঠেলে কাদের মুখের
হাসি কিংবা দাঁত খিঁচুনির ঝলসানি
ঢুলঢুল চোখে আমি দেখব সেখানে? মৃতদের
নিবাস এমন হবে জেনে
নিজেকে মিথ্যার কুহকের ফাঁদে ফেলে
ঘুমের শিশিরে ভিজে থাকব আড়ালে পড়ে ডাগর দুপুরে

আড়মোড়া ভেঙে দেখি ঘরে কখন যে বিকেলের
পেলব রোদ্দুর সঙ্গে হরিয়াল, চাতক, ডাহুক
সপ্রেমে এসেছে নিয়ে, কিছুই পাইনি টের। এই সব কোমল প্রাণীর
সভায় ঘোষক নেই, সভাপতি নেই
বাকবিতণ্ডা কি খেয়োখেয়ি নেই, চিত্তহারী রূপ
হাঁসের মতোই শান্ত রূপালি ডানার শোভা ছড়িয়ে রয়েছে।
১৩.১.৯৯

দীপা হকের স্মরণে

ভোরবেলাকার রোদ, পর্যটক মেঘ, বাগানের
রঙবেরঙের ফুল, তোমার ধূসর ম্যাক্সি বেয়ে-ওঠা কালো
পিঁপড়েটা তোমাকে মাঝে মাঝে কী বলার
আগ্রহে উঠত মেতে? উহাদের মাতৃভাষা তোমার বোধের
অন্তর্গত ছিল বলে দিগন্তের ওপারের রেখা সমুদয়
তোমার নিকটে এসে নিমেষেই হয়ে যেত ক্রীড়াপরায়ণ।

কোন্‌ রঙ, কোন্‌ রেখা খেলা করছিল
সে-রাতে তোমার ভাবনায়, জানত না কেউ, কেউ
জানবে না কোনওদিন, হয়তো নিজেও তুমি স্থির
জানতে না। রঙের, রেখার
অচিন অস্পষ্ট খেলা অবচেতনের
কুয়াশায় চলছিল তোমারই অজ্ঞাতসারে; বুঝি
সতেজ জীবনকেই আখেরে জিতিয়ে
দিতে চেয়ে বারবার ভেঙেছ কখনও
আপন সত্তাকে
কোনও নির্বাচিত রঙে, কখনওবা অচেনা রেখায়!

খেলায় নিশ্চিত পরাজয় জেনেছ, তবুও
অধরে ফুটিয়ে শত হাসির কুসুম চেলে গেই ঘুঁটি ছকে
ক্রূর ছায়াটির মুখোমুখি বসে তুমি দীপান্বিতা ক্যানভাসে
তোমার উজ্জ্বল রঙ আর রেখায় জীবন হেসে
উঠেছিল সুনিশ্চিত, অথচ সে হাসির রোদ্দুর
ঢাকা পড়ে যায় মেঘ, বয়ে যায় হিমেল নিঃশ্বাস। নিরন্তর
হে মরণ, তুমি কি নিজেই তীব্র শিল্প হতে চেয়ে
শিল্পীকে হরণ করো দ্বৈরথে আহ্বান করে তাকে?
৭.১.৯৯

 দুই পক্ষ

তার জন্মদিনটির ললাটে প্রথম আলো চুমো এঁকে দিলে
এক পক্ষ বলে-
বহু ভোরবেলাকার, দুপুরের, গোধূলির রঙ মেখে সত্তায়
আখেরে
সত্তর বছরে পা রাখল এই অসুস্থ লোকটা।
জ্বালিয়েছে ঢের এতকাল,
জানি না জ্বালাবে আর কতদিন, কতকাল প্রত্যহ পুড়িয়ে
করবে কয়লা, খাক হাড় আমাদের। লিখেছে বেহুদা পদ্য
রাশি রাশি, বাজিয়েছে বাঁশি, বলে লোকে,
বেলা অবেলায়-বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, তরুণ, তরুণী
পিছনে ঘুরেছে তার, ডুবেছে ভ্রান্তির প্রতারক জলাশয়ে।

লোকটা প্রথার তাজ ধুলোয় লুটিয়ে দেয়, করে
পদাঘাত অচলায়তনে; গোঁয়ার মুঠোয় নিয়ে
নেতির চুলের মুঠি ছুঁড়ে ফেলে দূরের ভাগাড়ে। প্রশ্নহীন
আমরা যে-পথে চলি, সে-পথে পড়ে না ওর কোনও পদছাপ
কোনওদিন, ভাষা তার উদ্ভট, গলিজ।
আফিম সেবনে খুব নেশা ক্লান্ত, নিদ্রাতুর মহফিলে আগুনের ফুল
ছিটিয়ে করেছে দিশেহারা আমাদের
যখন তখন। অবিলম্বে এইবুড়ো আপদের বিলুপ্তি আমরা
চাই।

হাতে মালা নিয়ে অন্য পক্ষ বলে আনন্দিত স্বরে-
সপ্রাণ থাকুন তিনি বহুকাল আমাদের আনন্দ-উৎসবে,
প্রত্যহ উঠুক বেজে তাঁর বাঁশি, উদ্ভাসিত হোক
চতুর্দিক অনিন্দ্য সুরের পূর্ণিমায়। আমরা পেয়েছি তাঁকে
আমাদের দুঃখের নিশীথে আর শোকের আন্ধারে
বারবার পাশে,
উৎফুল্ল ছিলেন তিনি আমাদের আদিগন্ত জয়োল্লাসে। ভাষা
তাঁর জীবনের স্পন্দনের ভাষা, আমাদের
হৃদয়ের ধ্বনি আর চেতনাপ্রবাহে তাঁর সেকাল একাল
ভাবীকাল বয়ে যায়। পড়ুক শক্রর মুখে ছাই,
চাই তিনি সত্তর পেরিয়ে বহুদূর হেঁটে যান
অমিত তারুণ্যে দীপ্ত। পলাশ, কনকচাঁপা, ঘাসফুল, পাতাবাহারের
শোভা, মাঠ, দিঘি, নদী, নক্ষত্র, জোনাকি,
অগণিত সূর্যোদয় তাঁকে নিত্য স্বাগত জানাক।
২৮.১০.৯৮

 দ্বিপ্রাহরিক অভিজ্ঞতা

দুপুরে টেবিলে ঝুঁকে লিখছিলাম কবিতা, তুমি ঘরে এসে
দাঁড়ালে টেবিল ঘেঁষে। তোমার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যায়
আমাকে, চুলের ঝর্নাজল তোয়ালের স্পর্শে মুছে
নিচ্ছিলে সযত্নে আর, মনে হ’ল, রঙধনুর ভগ্নাংশগুলো
ফ্লোর থেকে আলতো কুড়িয়ে নিয়ে রাখলে সাজিয়ে
বুক শেলফের এক কোণে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটির কাছে।

পূর্ণিমার মতো শাড়ি বেশ মানিয়েছে তোমাকে দুপুরে আর
ভাবলাম, আমার সামান্য ঘরে কোনও গ্রিক দেবী
সদ্য স্নান সেরে করেছেন নিঃশব্দে প্রবেশ। তুমি
চকিতে পেছনে এসে দু’বাহু জড়িয়ে
আমার গলায় স্মিত স্বরে বললে, ‘পড়ে শোনাও না
কী লিখেছ এতক্ষণ নাওয়া খাওয়া ছেড়ে?’ মৃদু হেসে
সদ্য লেখা অসমাপ্ত কবিতা আবৃত্তি করি, তোমার খুশির
ছোট ছোট ঢেউ
আমাকে দোলায়, পলায়নপর পঙ্‌ক্তির সন্ধান পেয়ে যাই।

অপরূপ স্তনভার দীপক রাগ সৃষ্টি করে শোণিতে আমার
দুপুরের স্বর্ণকণাগুলো কেবলি গলতে থাকে, আমাদের
দু’জনের ঠোঁটের যুগলবন্দি চলে কিছুক্ষণ
এবং সময়, পরিপার্শ্ব বিস্মরণে ডুবে যায়।

কী এক শব্দের চঞ্চু হঠাৎ ঠোকর মেরে আমার সংবিৎ
নিখুঁত ফিরিয়ে আনে, দেখি
আমার নিকট কিংবা ঘরের কোথাও তুমি নেই। হায়, কোন্‌
ইন্দ্রজাল তোমাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে
এই দৃশ্যপট থেকে? প্রকৃত ছিলে না তুমি কখনও এখানে।
আমিই করেছি সৃষ্টি স্বপ্নবৎ এই ঘরে তোমাকে দুপুরে।
৬.১.৯৯

 নরেন বিশ্বাসকে মনে রেখে

শত ডাকলেও উচ্চস্বরে আর মিলবে না সাড়া কোনওদিন,
কঠিন দেয়ালে মাথা খুঁড়ে মরলেও
তোমার প্রগাঢ় কণ্ঠস্বর
কখনও যাবে না শোনা। আমরা সবাই সমস্বরে বারবার
মিনতি জানাই যদি, তবু
কস্মিনকালেও আর মঞ্জরিত হবে না তোমার কণ্ঠে বাণী,
কবিতার প্রিয় পঙ্‌ক্তিমালা। এ কেমন
স্তব্ধতাকে আরাধ্য ভাবলে তুমি, গুণী
ডানে বামে অগণিত বয়সের হৈ-হুল্লোড়ে ডুবেছে নিমেষে
কোকিলের গান বারবার,
চতুর্দিকে ছিল বড় ঝগড়া ফ্যাসাদ;
প্রবঞ্চনা, জোচ্চুরি, সন্ত্রাস
মাথা তুলে সুরুচি এবং সংস্কৃতির
সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে নরকের সূত্রপাত করেছিল, তবু
তুমি সত্য আর সুন্দরের, কল্যাণের ধ্যানে ছিলে
মগ্ন দিনরাত্রি, কিন্নরের মতো কণ্ঠে
খেলিয়েছ সুর আর ‘ধন্য ধন্য’ ধ্বনি
জেগেছে উৎকর্ণ ঘরে প্রহরে প্রহরে।

শ্মশান পারেনি বন্ধু তোমাকে পোড়াতে,
তবু এক ভয়ঙ্কর দাউ দাউ চিতা
বুকের ভেতর বয়ে নিয়ে গেছ বিদায়ের অতল আমায়
কাউকে কিছু না বলে সাধকের অপার ক্ষমায়।
০২.১২.৯৮

নাও, টেনে নাও

এতটুকু বাড়িয়ে বলার ইচ্ছে নেই। যা বলছি,
সত্যি সবই। বেশ ক’বছর থেকে আমার দু’হাতে
কিছুটা ইস্পাত গেঁথে আছে, আমার বুকের কাছে
লোহা-লক্কড়ের এটা সেটা দৃঢ় গেঁথে গেছে, গালে
তামার পাতের চাপ বড় বেশি, এবং কপালে জং-ধরা
টিন ফুটে রয় সারাবেলা। যখন রাস্তায় হাঁটি
অথবা বেড়াই পার্কে, তখনও কি কেউ তাজা আলোয় দেখে না
এ শহুরে আমার এমন রূপান্তর? আজ অব্দি কেন কেউ
আমার মুখের এই ভীষণ কালিমা দেখে চমকে ওঠেনি
একবারও? আধখানা যন্ত্র আর অর্ধেক মানব হয়ে আছি!

কোনও বৈদ্য অথবা হেকিম পারবে না কোনওদিন
সারাতে আমার এই ভয়ানক ব্যাধি, হায়। কাউকে কিছু না
বলে যদি এ শহর ছেড়ে ছুড়ে দূরে, বহুদূরে
চলে যাই কোথাও, যেখানে কলকারখানা আর
ভয়ঙ্কর আয়ুক্ষয়ী ধোঁয়ার কালিয়া নেই, গাছ গাছালির
ধ্বংসযজ্ঞ নেই, নেই ধুলোর সন্ত্রাস, তাহলেই
আমার কপাল, গাল, হাত আর বুক থেকে দ্রুত খসে যাবে
টিন, তামা, লোহা আর ধারালো ইস্পাত। সূর্যোদয়ের মতোই
চকিতে উঠবে জেগে আমার প্রফুল্ল নিরাময়। হে পাড়াগাঁ,
মাইল মাইল্ব্যাপী হে সবুজ, হে বিলের পানি, পানকৌড়ি,
মাছরাঙা, হে আমার পাড়াতলী, পদ্মপুকুর জোনাকি, ওগো
সর্ষে ক্ষেত, প্রজাপতি, হে ইঁদারা, ওগো বাঁশবন,
হে ঘুঘুর ডাক, হে রাখাল, মেঠো বাঁশি, যদি আসি
তোমাদের কাছে, তোমরা কি এই রুক্ষ, রিক্ত শহুরে আমাকে
করবে গ্রহণ হেসে বেলাশেষে? নাও,
ধূসর, অসুস্থ লোকটিকে টেনে নাও বুকে সস্নেহে সবাই।
৬.১.৯৯

নিজেকে খুঁড়ছি

নিজেকে খুঁড়ছি সেই কবে থেকে, খুঁড়ে যেতে হবে, যতদিন
মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি। কখনও কখনও
অবসাদ টেনে নিয়ে যায়
নিদ্রার নিস্তব্ধ কুঠুরিতে, অথচ অতল ঘুমে

ডুবেও নিজেকে খুঁড়ি অবিরাম-প্রকাশিত হয় ক্ষণে ক্ষণে
কত কিছু অবলীলাক্রমে।

এই যে দাঁড়িয়ে আছি ঝাউবনে, এখানে তো কখনও আসিনি,
এমন সবুউজ আমি কখনও দেখিনি;
এই জমি, এই দৃশ্যাবলী, এরকম পাখি
এর আগে কোথাও দেখিনি। অকস্মাৎ
সফেদ কাফন-পরা ক’জন তরুণী
বেহালা বাজিয়ে চলে আসে পুকুরের ঘাট থেকে-
তাদের বেদনা নীল মুখ
অচেনা, অদ্ভুত। বেহালার সুরে নেই পার্থিব মূর্ছনা আর
কী খেয়ালে ওরা বাদ্যযন্ত্র ছুঁড়ে ফেলে অকস্মাৎ
হেসে ওঠে, সেই হাসি অথই কান্নার নামান্তর।

নিজেকে খুঁড়ছি শুধু, খুঁড়ে যাব এভাবেই, যদ্দিন বুকের
স্পন্দন থেমে না যায় ততদিন খুঁড়তে থাকব,
নিজের কাছেই এই প্রতিশ্রুতি আমার, যতই
যন্ত্রণার দাঁত, নখ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাক।

 নিভৃত কঙ্কাল

‘কী করে ঘুমাও তুমি এমন বিভোর? কিছুক্ষণ
পরেই উঠবে রোদ, দশদিক আলোয় নাইবে, পাখিদের
গানে পার্কে পাড়ার বাগানে
হবে গুঞ্জরিত ক্ষণে ক্ষণে। চোখ মেলে
দেখ, আমি সে কখন থেকে
দাঁড়ানো তোমার ঘরে অর্ভ্যর্থনাহীন। না, আমার
সামান্য কার্টেসি নিয়ে কোনও
মাথাব্যথা নেই। তুমি
আমাকে আনোনি ডেকে এখানে, বস্তুত
নিজেই এসেছি আমি এত্তেলা না দিয়ে, বলে সেই
নিভৃত কঙ্কাল ছেদ টানে হিমার্ত কথায়। বাক্যহারা
ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি কঙ্কালের দিকে।

বিছানায় এসে বসে মুখোমুখি, চোখের কোটরে
চোখ নেই, তবু চক্ষুহীন দৃষ্টি তার
পোড়ায় আমাকে
কখনও, আবার সমবেদনায়
ভারি হয়ে ওঠে ওর কণ্ঠহীন কণ্ঠস্বর। ‘জানি তুমি
বড় ক্লান্ত, ঈষৎ হতাশ হয়তোবা
নানান সার্কাস দেখে। প্রিয় প্রকৃতিও
পারে না বুলোতে কোনও অব্যর্থ মলম
অন্তরের গভীর জখমে আর সুদূর একাত্তরের রক্তমাখা মুখ
আবার নতুন করে জেগে উঠে বিভীষিকা রূপে
পথে পথে, ঘরে ঘরে হানা দেবে ভেবে
এখন তোমার বুকে জমছে তুষার। হে বান্ধব,
শোনো বলি, এখনও সময় আছে, রুখে
দাঁড়াও অস্ত্রের উন্মাদনা, করো ব্যর্থ বর্বরের জয়োল্লাস।
১৫.২.৯৯

 নিরালা শহীদ

লোকটা তো বুঝতেই পারলো না কী করে যে সূর্যাস্তের ঠোঁট
তাকে খুব চেপে ধরেছিল-
তবে কী একেই বলে মরণকামড়? লোকটা কী
হিরণপয়েন্টে যেতে চেয়েছিল মাতাল ভেলায় চেপে একা?
গোধূলিতে হরিণের জলপান দেখবার সাধ
জেগেছিল অকস্মাৎ মনের গহনে?

ছিল না বন্দুক সঙ্গে, কাতুর্জের বাকশো বইবার
ইচ্ছাকে বাতিল করে এসেছিল, যদিও সুন্দরবনে বাঘ
আগুনের গোলার মতোই
লাফিয়ে উঠতে পারে, জানা ছিল তাও।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার ঘাড়ে
লাফিয়ে পড়েনি,, টুঁটি ছিঁড়ে রক্তপান
করেনি, বরং ভেলা ঢেউয়ে ঢেউয়ে হেসেছে জ্যোৎস্নার। চাঁদ তাকে
নিরিবিলি সঙ্গ দিয়ে নিয়ে গেছে বনের কিনারে, অকস্মাৎ
কবিতার আঙ্গুল হৃদয়ে আল্‌পনা আঁকে আর
সপ্ততন্ত্রী আলোড়িত হয়।

লোকটা নিথর হয়ে আছে ভাসমান
ভেলায় নিঃসঙ্গ তার নিঝুম শরীর ঢলঢলে
জ্যোৎস্নার কাফনে মোড়া। ঢেউগুলো ছলছল পড়ছে জলজ
কিছু সুরা, গন্তব্যবিহীন যাচ্ছে সৌন্দর্যের নিরালা শহীদ।
২১.১১.৯৮

পরিত্যক্ত পঙ্‌ক্তির কথা

ছিলাম নিজেরই ঘরে নিরিবিলি, রাত আড়াইটা, অন্ধকার
ছিল না তেমন গাঢ়, বরং ফিকেই বলা চলে। অকস্মাৎ
চোখে পড়ে-চার দেয়ালের বুক ফুঁড়ে আটটি পুরোনো হাত
প্রায় পচে-যাওয়া, সবুজাভ,
বেরিয়ে এসেছে আর হাতগুলো কেমন বাচাল হয়ে ওঠে,
যদিও অবোধ্য সেই ভাষা। আমার ভয়ার্ত হওয়া
ছিল খুবই স্বাভাবিক, অথচ সহজে আমি তাদের নিকটে গিয়ে হই

প্রশ্নাকুল, জ্ঞানান্বেষী শিক্ষার্থীর মতো
জেনে নিতে চাই ওরা কারা, কেন আজ
গভীর নিশীথে একজন অতি সাধারণ লোকের নিবাসে
এরকম রহস্যজনক আবির্ভাব? সবুজাভ
গলিত আটটি হাত কলরব থামিয়ে আমার দিকে আসে
ওদের আঙুল থেকে নক্ষত্রের কণা,
চাঁদের রূপালি ধুলো ঝরে, পচা মাংস থেকে
কৃমির বদলে নানা সতেজ ফুলের জন্ম হয়। বলে ওরা,
এবার ওদের ভাষা বোঝা যায়, ‘আমরা তোমার
অলিখিত কবিতার পরিত্যক্ত কিছু পঙ্‌ক্তি, কবি,
অবহেলা আর উপেক্ষায় আজ আমাদের হয়েছে এ হাল।

কিসের ঝাঁকুনি যেন আমাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়-
তবে কি চেয়ারে বসে ঘুমের গুহায়
কাটিয়েছি এলোমেলো কিছুক্ষণ? সমুখে লেখার
খাতাটা রয়েছে খোলা, শাদা পাতা কাটাকুটিময়।
২৯.১০.৯৮

 পারবে কি রুখে দিতে

এ শহর, আমার এ জন্মশহর উঠেছে হেসে,
লেগেছে বাসন্তী রঙ তার
ধূসর সত্তায় আজ। কোকিলের কী ব্যাকুল ডাক
কবির হৃদয়ে নিমেষেই জাগায় কাঙ্ক্ষিত চিত্রকল্প, কোকিলের ডাক
উৎফুল্ল তরুণ তরুণীর প্রাণে আনে সুন্দর ও কল্যাণের
স্নিগ্ধ রূপ উৎসব-ছন্দিত এই বকুলতলায়। কোকিলের
গান নিবেদিত তানে শহীদ মিনারে
সশ্রদ্ধ ছড়ায় বসন্তের আভা, অগণিত ফুল।

আমিও কৃতজ্ঞতায় করেছি গ্রহণ
বসন্তের সানুরাগ দান জীবনে আমার আর
চেতনাকে প্রজ্বলিত রেখেছি সর্বদা
শুভবাদী আলোর শিখায়। জীবনের অস্তরাগে
যৌবনের পদধ্বনি আজও বারবার
আমাকে প্রবল টানে ঝড়ক্ষুব্ধ পথে,
আর হিংস্র হাওয়ায় আগলে রাখি দীপ,
সন্ত্রস্ত মাথায় নাচে ঘাতকের শাণিত কুড়াল।

কখনও নিইনি অস্ত্র হাতে; কোনও পাখি,
প্রজাপতি কিংবা কোনও কীটকেও
করিনি হনন কোনওদিন, অথচ আমার এই
প্রাণের পূর্ণিমা
দপ্‌ করে নেভাবার জন্যে তালেবানি অমাবস্যা ধেয়ে আসে।
এই যে রমনার মাঠে, বকুলতলায়
এখন রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহী কবির বসন্তের গান
আর কোকিলের কুহুতান ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে,
সে দীপ্ত আনন্দধ্বনি পারবে কি রুখে দিতে কবন্ধ সন্ত্রাস?
পারবে কি ভবিষ্যের কোনও সূর্যোদয়ে?

প্রকৃতির রূপ

জানলার বাইরে তাকাও, দেখে না ও আকাশ,
ভাসমান মেঘ, গাছের পাতার নাচন, পাশের বাড়ির
কার্নিশে পায়রা যুগল, তারপর তোমার খাতার পাতায়
তৈরি হবে কবিতার পঙ্‌ক্তি; রোদ হাসবে, দোয়েল
শিস বুলোবে হাওয়ায়, চাই কি আমার মুখ
ভেসে উঠবে তোমার পঙ্‌ক্তিমালায়; বললে তুমি
ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলিয়ে। তোমার সুহাস
কণ্ঠস্বরে কৌতুকের ভঙ্গি ছিল। প্রকৃতির প্রতি আমার
অনুরাগ তোমার অজানা নয়। চোখ-মন-জুড়ানো
রূপ প্রকৃতির, এই সত্য সবার কাছেই উদ্‌ভাসিত। আমি বারবার
প্রকৃতির কাছে ফিরে যাই, তা-ও মিথ্যে নয়। অথচ
এই প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রুদ্র রূপ, যেমন মোহিনী,
নিরীহ, কোমল, শান্ত নদী হঠাৎ কখনও কখনও
কী ভয়ঙ্কর ফুঁসতে থাকে। তোমার মধ্যেও এই দু’টি রূপের খেলা।
১৩.৯.৯৮

প্রতিরোধ করবার পালা

এ নিয়ে কমসে কম সাত আটবার
মাটিতে পড়েছি মুখ থুবড়ে, অথচ কিছুতেই
ঝিমুনি যাচ্ছে না চোখ থেকে। এদিকে যে শরীরের
কোনও কোনও অংশ থেকে
ঝরছে রক্তের ফোঁটা, টলছে পা দু’টো,
সেদিকে খেয়াল নেই। তবে বেশ বুঝতে পারছি,
ডান বাম দু’দিক থেকেই বেধড়ক খাচ্ছি মার
বারবার, এ নিয়ে কমসে কম সাত আটবার।

আমার কসুর কী-যে বুঝতে পারিনি।
কখনও দিইনি ছাই কারও বাড়া ভাতে, কিংবা কারও
ওপরে ওঠার সিঁড়ি সরিয়ে ফেলিনি ঠাট্রাচ্ছলে,
অথবা ঈর্ষায় পুড়ে। আমি তো আপন মনে শুধু
একা ঘরে বাজিয়েছি বাঁশি
জ্যোৎস্না রাতে এবং নিঝুম অন্ধকারে। কারও কোনও
ক্ষতি করবার সাধ্যি নেই
এই বংশীবাদকের জেনেও যে যার খুশি মতো
কিল ঘুষি চড়
করেছে বর্ষণ রোজ আমার ওপর।

এতকাল পর যেন কোনও জাদুবলে
আখেরে আমার চোখ থেকে ঝরে গেছে
ঝিমুনি এবং আমি আর
মাতালের মতো টলছি না, পড়ছি না
মাটিতে কিছুতে কোনও আক্রমণে। এবার আমার
জেগে ওঠবার, কিল চড় ঘুষি প্রতিরোধ করবার পালা।
১২.১২.৯৮

ফের উড়ে যা

হায়রে এমনই পোড়া কপাল বান্ধব তোর, এই
ঘিনঘিনে কাদা জলে আটকা পড়লি। জানতাম,
তুই ধবধবে ডানা মেলে
নীলিমায়, মেঘে মেঘে অবাধ ওড়ার
সাধ বুকে পুষে রেখেছিলি। সবচেয়ে
উঁচু কোনও পর্বত শিখরে
ক্ষণকাল ঠাঁই নিয়ে নানা দৃশ্যাবলী
দেখবি দু’ চোখ ভরে, স্বপ্ন ছিল তোর।

চিত্তহারী মোহন উড়াল ছিল তার। অকস্মাৎ
চারপাশ থেকে
অনেক বিষাক্ত দাঁত নখ তেড়ে এসে
বিঁধল ডানায়, তুই বোবা আর্তনাদে
কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে
প্রায় নিশ্চেতন পড়ে গেলি কাদাজলে,
লা-ওয়ারিশ পুঁটুলি যেন। যে ডানায়
মানস সরোবরের জলধারা বয়ে
যাওয়ার নিশ্চিত কথা ছিল, যে চঞ্চুতে সরস্বত
চুম্বনের পদ্মমধু ঢেলে দিতে কী প্রবল আগ্রহী ছিলেন,
সে ডানা, সে চঞ্চু আজ পাকেচক্রে কাদায়্য গড়ায়।

এ শক্রতা, এ পতন মুখ বুজে মেনে নিবি তুই?
আটক থাকবি কৃমিপ্রসূ কাদাজলে সারাক্ষণ ওরে
চেয়ে দ্যাখ, উল্লাসের মতো রোদ ছড়িয়ে পড়েছে
সবখানে, ডানায় মেখে নে
রৌদ্রঝর্না-ধারা ফের উড়ে যা দূরের নীলিমায়
চোখে নিয়ে নিত্য আবিষ্কারের বিভাস।
২৬.১২.৯৮

 বিনিময়

ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক দৃষ্টিতে একই দিকে
তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার অসুস্থ চোখ দুটো
হাঁপিয়ে উঠেছিল। আমার ছিপের ফাৎনাটা
মাঝে মাঝে কাঁপছিল, কিন্তু ডোবার কোনও
লক্ষণই দেখতে পাইনি। ফাৎনা ভাসতে থাকুক
লেকের পানিতে, আমি না-হয়
খানিক বেড়িয়ে আসি এদিক সেদিক থেকে। পাশের
ছায়াঢাকা পথের অন্তরঙ্গ ডাক আমাকে উন্মন করে।

পথের দু’দিকের গাছগুলোকে মনে হয় আত্মীয়;
হাঁটতে থাকি, দৃষ্টি বুলোই ধুলোয়, দূরের নীলিমায়।
দু’জন তরুণী হাত ধরে স্মিত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে,
একটি নারীকণ্ঠে সন্তানকে কাছে ডাকার
আনন্দধ্বনি, অদূরে এক মনোহারী দোকান থেকে
শিশুতোষ খেলনা কিনছেন একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, তার
মুখে ছড়ানো তৃপ্তির হাসি। সদর রাস্তার কিনারে
একজন নুলো ভিখিরি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে, গালভরা
খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ওর পাশে ছেঁড়া শাড়ি পরা এক যুবতী।
যুবতী এক খিলি পান পুরে দেয় নুলোর মুখে,
নুলো ভিখিরির চেহারায় ফোটে অনুরাগের ছটাময়
দরবারি বসন্তবাহার। দৃশ্যাবলীর নানা রঙ নিয়ে ফিরে আসি।

লেকের কিনারে এসে দেখি, ফাৎনাসুদ্ধ ছিপটি
কোথায় তলিয়ে গেছে, জানতে পারিনি। অথচ কষ্ট হ’ল না
এক রত্তি। নিজেকে কী এক বৈভবে
ভরপুর মনে হয়, দৃশ্যাবলী সেতার হয়ে অন্তরে বাজতে থাকে।
৩১.১০.৯৮

বিনীত মুদ্রায়

এরকম তাড়াহুড়ো, হুটোপুটি সাজে না তোমাকে। আগে তুমি
ছিলে না এমন বাস্তবিক;
মৎস্য শিকারির মতো প্রতীক্ষায় থাকতে সুস্থির,
যদিও অন্তরে হতো তোলপাড় প্রহর প্রহরে।

এখন কিসের প্ররোচনা হামেশাই
তোমাকে করছে তাড়া? আয়ুর সুতোয় বেশি টান
পড়ছে বলে কি তুমি সম্প্রতি কাতর খুব? বুঝি
তাই এরকম তাড়াহুড়ো। যতদূর
জানা আছে, আগে তুমি গৌতম বুদ্ধের মতো ধ্যানে
থাকতে নিটোল মগ্ন প্রায়শই, সেই হেতু তোমার খাতার
শূন্য পাতা শব্দে শব্দে উঠত সেজে আর
আজ শূন্যে হঠাৎ বাড়িয়ে হাত মুঠোয় যা পাও
তা-ই তড়িঘড়ি
পুরে দাও সফেদ কাগজে। ওরা মরা মাছি, না কি
গুঞ্জরণময় দীপ্ত ভ্রমর, যাচাই করবার, হে আমার প্রিয় সখা,
এতটুকু নেই ফুরসৎ।

মন বলে, হয়তো এখনও আছে কিছুটা সময়-
নিজেকে খনন করে বারবার কয়লা, কাঁকর,
কাচ, নুড়ি ছেনেছুনে প্রকৃত হীরের
জ্যোতিতে দীপিত হয়ে বাঁচো এ সংসারে স্মিত বিনীত মুদ্রায়।
২১.১০.৯৮

ভোরবেলার জন্যে

প্রতিদিন ভোরবেলার জন্যে কী তীব্র প্রতীক্ষা আমার।
কোনও কোনও মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে
কিছতেই ঘুম আসে না আর। বিছানায়
এপাশ ওপাশ করতে থাকি, যেমন ঢেউয়ে এদিক ওদিক
দুলতে থাকে নৌকা। বারবার
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, আকাশ আলোর রেখা খুঁজি।

খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে যায়, ভোরবেলার
প্রথম আলো শুধু আকাশে ফোটে না,
আমার মনেও ছড়িয়ে পড়ে ময়ূরের কলাপের মতো। নিজেকে
দেখতে পাই আকাশের রেশমি মেঘের
বিছানায় এবং তুমি আমার পাশে পেলব শুয়ে আছ,
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
কখন যে দু’জন মেঘলোকে সঙ্গমের মোহনায়
যুগ্মতায় লীন হয়ে যাই, বলতে পারব না।

তুমি নেই, অথচ তোমাকে প্রত্যহ ভোরবেলার প্রথম আলোয়
এভাবেই পেয়ে যাই, যেমন
কবিতার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়
রোদের ঝলক মেশা কুয়াশায় কখনও কখনও।

ভোরবেলার আলো দেখার জন্যে, পাখির
গান শোনার জন্যে, মেঘের শয্যায় তোমাকে নিবিড়
পাওয়ার জন্যে আমি অপেক্ষা করি পরম ব্যাকুলতায়।
এখনও যে রোজ সকালবেলার সঙ্গে
আমার দেখা হয়, এ তো পরম সৌভাগ্য
এই অভাজনের জন্যে। প্রত্যুষের জন্যে আমার এই প্রতীক্ষা
শেষ হবে হঠাৎ একদিন, যেদিন আমার রোগক্লিষ্ট শরীর
বিছানায় পড়ে থাকবে নিষ্পন্দ, নিষ্প্রাণ। সেদিনও
ভোরের আলো আমাকে দেখবে নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে,
আমি ওকে, কাউকেই দেখব না, কিছুই দেখতে পারব না।
৬.১.৯৯

 মায়ামৃগ

সকলেই চেনে না কবিকে, কেউ কেউ চেনে তাকে
প্রচণ্ড হৈ-হল্লা, ভিড়ে অথবা বিজনে
কখনও সখনও। কেউ চিনলেও দূরে সরে যায়
কিছুই না বলে, কেউ কাছে এসে খানিক দ্বিধায়
নাম জেনে নিতে চায় পরখ করার
বাসনায়, প্রকৃতই এ লোকটা কি তিনিই যিনি
কোনও সিঁড়ি কিংবা সাঁকো ছাড়াই দূরের নীলিমায়
চলে যান সহজে বেড়ান হেঁটে নক্ষত্রের অসীম উদ্যানে?

যার এই পর্যটন বারবার কখনও আকাশে,
কখনওবা অশেষ রহস্যময় জলজ পাতালে,
তিনিই তো, পথচারী জেনে যায়, ছায়াপথ বেয়ে পুনরায়
মাটিতে আসেন নেমে, জড়িয়ে ধরেন বুকে তার
ক্ষেতের সোনালি ধান। ভেজা তাজা ঘাস আর নবান্নের ঘ্রাণ
তাকে দিয়ে লিখায় নিভৃতে
পৌঁষের প্রহরে কত গান এবং কবিতা। তাকে ঘিরে
পথিকের কৌতূহল মিটলেই মৃদু হেসে ভিড়ে মিশে যায়।
সকলেই চেনে না কবিকে, কেউ কেউ চেনে তাকে। অভিনেতা,
সফল ঔপন্যাসিক, ব্যান্ডশিল্পী , এমন কী টিভির ঘোষক
বস্তুত হ্যামিলনের বাঁশিঅলা; রাম ও রহিম
তাদের পেছনে ধায় খরা ও বর্ষার, দ্রুত পায়ে পায়ে ঘোরে।
তা ঘুরুক, নন্দিত তাদের ঘিরে সর্বত্র বাড়ুক কলরব,
ক্ষতি নেই। সকলেই চেনে না কবিকে,
কাঙ্ক্ষিত এমন তথ্য। নিঃসঙ্গতা ছাড়া
সাধকের সিদ্ধি ধু ধু নিঃসীম প্রান্তরে শুধু মায়ামৃগ, হায়!
২৫.১২.৯৮

 লিখতে বসব

লঘু পায়ে ভোর এল, বারান্দায় রোদের ঝলক
শুয়ে আছে কাৎ হয়ে তরুণীর ভঙ্গিমায়, যেন
ওর স্তনে প্রজাপতি এসে বসে আলগোছে, ঘুম
ভাঙবে না; কোথাকার এক পাখি মৃদু লেজ নেড়ে
শিস দেয়; মুগ্ধতায় নিমজ্জিত আমি; মেঘদল
ভেসে যায়, ছুঁয়ে যায় হৃদয় আমার; এইমাত্র
এক ঝাঁক কবুতর আসমানে-দৃশ্যটিকে বলি;
দৃষ্টি থেকে অন্তরালে যাও, আমাকে লিখতে হবে।

সধূম চায়ের কাপ এক পাশে সরিয়ে তক্ষুণি
বলপেন হাতে তুলে নিই। অকস্মাৎ তুমি ভেসে
উঠবে মনে, সৌন্দর্যে জড়ানো টাঙ্গাইল, আমি সাত
তাড়াতাড়ি খুব অনিচ্ছায় তোমাকেও আপাতত
চলে যেতে বলি, আমি লিখব এখন। কবিকেও
নিজের প্রতিই হয়ে যেতে হয় এমন নিষ্ঠুর!
৮.২.৯৭

লোকটার ঘুমের ভেতর

এসেছে সে বহুদূর থেক এই মাঠের কিনারে
গোধূলিতে, জামায় বিস্তর ধুলোবালি, রুক্ষ চুল, চোখ দুটো
জবা-লাল। জিরোবার ঠাঁই
পাবে কি এখন কিয়দ্দূরে? গাছতলা হাতছানি
দেয়, ক্লান্তি কুয়াশা ছড়ায়
শরীরে, মগজে; মাথা রেখে
শিমুল তলায় সে ঘুমায়, স্বপ্নে তার
আঁকাবাঁকা কালো রেখা, বেগুনি গোলক,
মত্ত ঘোড়া, শাদা-লাল, কাটা মুণ্ডু ভেসে ওঠে আর
কে এক রূপসী কাঁদে মৃতের নিঝুম মাহফিলে।

লোকটার ঘুমের ভেতর মনে হয়, যেন সে-ও
প্রাচীন কালের মৃত কেউ, যার কোনও স্মৃতি নেই,
আনন্দ, বেদনা-কিছু নেই; কেবল নিষ্পন্দ বসে-
থাকা আছে, আছে
মৃতের মিছিল দেখা। কতিপয় লোক,
নেকড়ের মতো মুখ ওদের, খুবলে নিচ্ছে দ্রুত
মেধাবী পুরুষ আর রূপবতী বিদুষীর মুখ। ‘বলোতো কেমন আছো?’
-চকিতে জিজ্ঞেস করে আস্তে হেঁটে চলে যান নিঃসঙ্গ ধীমান।

লোকটা স্বপ্নের অভ্র দু’হাতে ছড়িয়ে
ঘুমের ভেতর হাঁটে, হেঁটে যেতে থাকে পৃথিবীর
উল্টো পিঠে। অকস্মাৎ চোখে পড়ে তার
নিজের ফতুর মৃতদেহ পড়ে আছে বনপথে,
বোঝে না কেন যে বিরানায় ওর মৃতদেহ ঘিরে
ক’জন ধীমান বীণা বাজিয়ে বিলাপ করছেন অবিরল।

লোকটার সুরসাধনা

দুর্মর এক অস্থিরতা লোকটাকে, বলা যেতে পারে,
পেয়ে বসেছিল। নিজের ভেতর কেমন
ওলট-পালট বোধ করত। কোনও কোনও সময়
মনে হতো ওর, উন্মত্ততা ধেয়ে আসছে ষাঁড়ের মতো,
যার শিঙে বিদ্ধ হওয়া ছাড়া গতি নেই। লোকটা
দিনদুপুরে হাজার তারার চিৎকার শুনত,
দেখত জ্যোৎস্নার উথাল-পাথাল গাঙ। কখনও কখনও
নিশুত রাতে চৈত্র দুপুরের আর্তনাদে লোকটা বিয়োগান্ত
পল্লীগাথা হয়ে যেত। সে ওর ভেতরে নগর পতনের
আভাস অনুভব করত নতুনভাবে।

সুর তুলতে চাইত সে, অথচ ওর কণ্ঠে ছিল না সুর,
একে একে বাঁশি, বীণা সেতার, সরোদ,
গিটারের কাছে সুর ভিক্ষা করে শুধু বিফলতার
মুখ দেখতে দেখতে লোকটা নিস্তব্ধতার ধ্যানে
মগ্ন হ’ল আর কী আশ্চর্য, এখন কোনও কোনও
গভীর রাতে ওর চোখ, কান, নাক, আঙুল,
কপালের শিরা এবং সবচেয়ে বেশি বুক থেকে
এক অনিন্দ্য সুর জেগে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধতাকে বিহ্বল করে।
১৪.১২.৯৮

শহরে আছেন একজন

শহরে আছেন একজন কবি, যাকে আমি চিনি কিছুকাল
আগে থেকে। তার কাছে মাঝে-মাঝে যাই,
পোহাই ঘনিষ্ঠতার মধুর রোদ্দুর, আর কোনও কোনও দিন
কথোপকথনে বেশ কেটে যায় কিছুটা সময়। চোখে পড়ে
স্মরণীয় নানা দৃশ্য-ফুলের গাছকে
আলিঙ্গন করেন সাদরে কবি কখনও কখনও,
বলেন রোদের, জ্যোৎস্নার সঙ্গে কথা, মেঘ তাকে
ছুঁয়ে যার বারবার। দোয়েল, ময়না
কাঁধে এসে বসে তার, সুরের ধারায়
ভেসে যান তিনি কল্পলোকে। কোনও কোনও মধ্যরাতে
অপ্সরার গান শোনা যায় তার ঘরে। পরীদের,
কাছের গাছের আর ঘাসের সবুজ ভাষা আর
অনেক দূরের নীলিমার, নক্ষত্রে গূঢ় ভাষা
ভালোই বোঝেন তিনি, অথচ পাশের
নিঝুম বাড়ির যে-তরুণী গলায় দিয়েছে দড়ি,
পারেননি করতে পাঠ কবি তার হৃদয়ের ভাষা।
২৭.১০.৯৮

শাদা কাগজ নিয়ে

শাদা কাগজের হিমশূন্যতা অনেকক্ষণ তাকে
ভীষণ বিদ্রূপ করে। মনে হয় তার-
কে এক সফেদ প্রেত শব্দহীন বিকট হাসির তোড়ে ঘর
কাঁপিয়ে তুলছে ঘন ঘন; এই টেবিল চেয়ার খাটসুদ্ধ
সারা ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে যেন, প্রেত
নয়তো নিঃসঙ্গ, ওর সঙ্গে নন্দি-ভৃঙ্গি জুটে যায় যথারীতি।

ঘর ছেড়ে সে কি চলে যাবে এই ডামাডোল থেকে
দূরে অন্য কোনওখানে? যাবে কি গাছের কাছে যাবে ঘাসবনে?
অথবা লেকের ধারে শুয়ে আকাশের রূপ দেখে
জুড়োবে চোখের জ্বালা? প্রেতের পীড়ন থেকে বাঁচা যাবে তবে।
ঠাঁই-নাড়া হয় না সে। চেয়ারেই বসে থাকে অটল, অনড়;
অকস্মাৎ দৃষ্টিপথে ওর
আশ্চর্য আলোর নাচ প্রস্ফুটিত, এ যে ঘর জুড়ে ক্রমাগত
নেচে চলেছেন সুফী কবি রুমি। বিস্ময়-বিহ্বল দু’টি চোখে
সে কেবল চেয়ে থাকে নিষ্পন্দ, নির্বাক। বহু যুগ যুগান্তর,
মনে হ’ল তার, কেটে গেল চোখের পলকে; কবি
ওর কাঁধে হাত রেখে কী যে বললেন আলোর স্বরে, সে-ভাষার
কিছু বুঝল সে আর কিছুটা অবোধ্য রয়ে যায়।

সুফী কবি ঘূর্ণিনাচে মিশে গেলে পর সে সংবিৎ
ফিরে পায়, শাদা কাগজের বুক খুব কাছে ডাকে তাকে, সেই
আমন্ত্রণে যেন শুভ ইন্দ্রজাল ছিল,
মন্ত্রমুগ্ধ সে কলম তুলে নেয় হাতে আর প্রেত নন্দি-ভৃঙ্গিসহ
নীরবে পালিয়ে যায়। শাদা, শূন্য কাগজ ক্রমশ
ডালপালা, ফুল, পাতা, প্রজাপতি আর পাখি সমেত উদ্যান হয়ে ওঠে।
৩.১১.৯৮

শুভবাদী দিগন্তের দিকে

এখানে তো অনেক বছর আমি কাটিয়ে দিলাম,
অনেক বছর দম-আটকানো পরিবেশে; পথ
চলতে খেয়েছি শুধু কর্কশ ঠোকর, পা দুটোয়
রক্তচিহ্ন সারা গায়ে যন্ত্রণার দাঁতের জহর
নিয়ে সেই কবে থেকে এক ফোঁটা ঘুমোতে পারি না
সারা রাত। দেয়ালে কীসব হিজিবিজি
অক্ষরের বুনো মাতলামি ফুটে ওঠে, কয়েকটি
অস্পষ্ট বেয়াড়া মূর্তি বিভীষিকাময়
নাচ জুড়ে দেয় আর হঠাৎ কখনও
দেয়ালের ডান দিকে কারা লোভাতুর
বিকটি মুদ্রায় নীল, লাল, সবুজ, খয়েরি আর হলুদ পাখির
মুণ্ডু ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিব্যি হাপুস হুপুস খেতে থাকে।
অনেক বছর ধরে এখানে বসত করে এই
মাটি এই গাছপালাকেই একান্ত আপন
বলে জানতাম। এর ফুল, এর ফল
এবং সোনালি ফসলকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি বারবার
আর কী তন্ময় হয়ে শুয়েছি পাখির গান, পাল-তোলা নায়ে
বসে কিয়দ্দূর থেকে দেখেছি রূপালি চর। দীপ
জ্বেলে অন্ধকারে কত পথভ্রষ্ট পথিককে দেখিয়েছি দিশা,
প্রতিদানে চাইনি কিছুই
কোনওদিন, কেবল চেয়েছি কিছু আলো জ্বালাবার অধিকার।

ডান দিক থেকে ওরা নানা ছদ্মবেশে এসে আমার হাতের
দীপ কেড়ে নিতে চায়, পুরাতন ঘায়ের পট্রির
মতো অতীতকে ব্যবহার করে বর্তমানকেও
ঘেয়ো নুলো বানিয়ে রাখার
জবর খায়েশে ওর পথঘাটে ঘন ঘন বাজার সাজায়
জেল্লাদার ভঙ্গিমায়। সেই সব দাঁতালের দাঁত
নখেরে চেয়েও ঢের বেশি ধারালো, বিষাক্ত আর জাঁহাবাজ
অস্ত্রের রোমশ ধমকের কাছে বড় অসহায় আজ জ্ঞান।
ডান দিক থেকে তেড়ে আসা সন্ত্রাসের জয়োল্লাস
আমাকে নিষিদ্ধ করে শহরে ও শহরতলীতে, চুপচাপ
সয়ে যেতে হয় কুবাক্যের ঝড়ঝাপ্টা, হম্বি-তম্বি। এই প্রিয়
সোঁদা মাটি কামড়ে থাকতে হবে আরও কিছুকাল। মনে হয়,
সত্তর বছর ধরে স্বদেশেই নির্বাসনে আছি। অমাবস্যা
কেটে গিয়ে মানবিক পূর্ণিমায় দিকগুলি নেয়ে
উঠবে কখন, তার প্রতীক্ষায় শুভবাদী দিগন্তের দিকে
গভীর তাকিয়ে থাকি হাতে নিয়ে কবিতার মালা।
১৩.১.৯৯

শূন্যতার উদ্দেশে

শূন্যতা আমাকে রোজ প্রচণ্ড শাসায়, ক্ষণে ক্ষণে
তাকায় পাকিয়ে চোখ, যেন গিলে খাবে,
অস্তিত্ব ফেলবে মুছে এই
মৃত্যুর যমজ সহোদর। সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের
কাছ থেকে আর
রঙধনু থেকে কিছু বর্ণ নিয়ে খাঁ খাঁ শূন্যতার
গলায় পরাতে চাই শব্দমালা, যাতে
ওর ঔদ্ধত্যের দাঁত নখ
ঈষৎ সংযত থাকে। আমার স্বপ্নরা বারবার
তার কাছে যায়,
সাজায় নানান সাজে তাকে, মাঝেমাঝে
বন্দনার মোহে মজে থাকে ষড়ঋতুর আভায়।

শূন্যতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি জেগে থাকে সারাক্ষণ,
তবু তার উপহাস তুচ্ছ করে নৈবেদ্য সাজাই।
২০.১১.৯৮

Exit mobile version