নিরালা শহীদ
লোকটা তো বুঝতেই পারলো না কী করে যে সূর্যাস্তের ঠোঁট
তাকে খুব চেপে ধরেছিল-
তবে কী একেই বলে মরণকামড়? লোকটা কী
হিরণপয়েন্টে যেতে চেয়েছিল মাতাল ভেলায় চেপে একা?
গোধূলিতে হরিণের জলপান দেখবার সাধ
জেগেছিল অকস্মাৎ মনের গহনে?
ছিল না বন্দুক সঙ্গে, কাতুর্জের বাকশো বইবার
ইচ্ছাকে বাতিল করে এসেছিল, যদিও সুন্দরবনে বাঘ
আগুনের গোলার মতোই
লাফিয়ে উঠতে পারে, জানা ছিল তাও।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার ঘাড়ে
লাফিয়ে পড়েনি,, টুঁটি ছিঁড়ে রক্তপান
করেনি, বরং ভেলা ঢেউয়ে ঢেউয়ে হেসেছে জ্যোৎস্নার। চাঁদ তাকে
নিরিবিলি সঙ্গ দিয়ে নিয়ে গেছে বনের কিনারে, অকস্মাৎ
কবিতার আঙ্গুল হৃদয়ে আল্পনা আঁকে আর
সপ্ততন্ত্রী আলোড়িত হয়।
লোকটা নিথর হয়ে আছে ভাসমান
ভেলায় নিঃসঙ্গ তার নিঝুম শরীর ঢলঢলে
জ্যোৎস্নার কাফনে মোড়া। ঢেউগুলো ছলছল পড়ছে জলজ
কিছু সুরা, গন্তব্যবিহীন যাচ্ছে সৌন্দর্যের নিরালা শহীদ।
২১.১১.৯৮
পরিত্যক্ত পঙ্ক্তির কথা
ছিলাম নিজেরই ঘরে নিরিবিলি, রাত আড়াইটা, অন্ধকার
ছিল না তেমন গাঢ়, বরং ফিকেই বলা চলে। অকস্মাৎ
চোখে পড়ে-চার দেয়ালের বুক ফুঁড়ে আটটি পুরোনো হাত
প্রায় পচে-যাওয়া, সবুজাভ,
বেরিয়ে এসেছে আর হাতগুলো কেমন বাচাল হয়ে ওঠে,
যদিও অবোধ্য সেই ভাষা। আমার ভয়ার্ত হওয়া
ছিল খুবই স্বাভাবিক, অথচ সহজে আমি তাদের নিকটে গিয়ে হই
প্রশ্নাকুল, জ্ঞানান্বেষী শিক্ষার্থীর মতো
জেনে নিতে চাই ওরা কারা, কেন আজ
গভীর নিশীথে একজন অতি সাধারণ লোকের নিবাসে
এরকম রহস্যজনক আবির্ভাব? সবুজাভ
গলিত আটটি হাত কলরব থামিয়ে আমার দিকে আসে
ওদের আঙুল থেকে নক্ষত্রের কণা,
চাঁদের রূপালি ধুলো ঝরে, পচা মাংস থেকে
কৃমির বদলে নানা সতেজ ফুলের জন্ম হয়। বলে ওরা,
এবার ওদের ভাষা বোঝা যায়, ‘আমরা তোমার
অলিখিত কবিতার পরিত্যক্ত কিছু পঙ্ক্তি, কবি,
অবহেলা আর উপেক্ষায় আজ আমাদের হয়েছে এ হাল।
কিসের ঝাঁকুনি যেন আমাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়-
তবে কি চেয়ারে বসে ঘুমের গুহায়
কাটিয়েছি এলোমেলো কিছুক্ষণ? সমুখে লেখার
খাতাটা রয়েছে খোলা, শাদা পাতা কাটাকুটিময়।
২৯.১০.৯৮
পারবে কি রুখে দিতে
এ শহর, আমার এ জন্মশহর উঠেছে হেসে,
লেগেছে বাসন্তী রঙ তার
ধূসর সত্তায় আজ। কোকিলের কী ব্যাকুল ডাক
কবির হৃদয়ে নিমেষেই জাগায় কাঙ্ক্ষিত চিত্রকল্প, কোকিলের ডাক
উৎফুল্ল তরুণ তরুণীর প্রাণে আনে সুন্দর ও কল্যাণের
স্নিগ্ধ রূপ উৎসব-ছন্দিত এই বকুলতলায়। কোকিলের
গান নিবেদিত তানে শহীদ মিনারে
সশ্রদ্ধ ছড়ায় বসন্তের আভা, অগণিত ফুল।
আমিও কৃতজ্ঞতায় করেছি গ্রহণ
বসন্তের সানুরাগ দান জীবনে আমার আর
চেতনাকে প্রজ্বলিত রেখেছি সর্বদা
শুভবাদী আলোর শিখায়। জীবনের অস্তরাগে
যৌবনের পদধ্বনি আজও বারবার
আমাকে প্রবল টানে ঝড়ক্ষুব্ধ পথে,
আর হিংস্র হাওয়ায় আগলে রাখি দীপ,
সন্ত্রস্ত মাথায় নাচে ঘাতকের শাণিত কুড়াল।
কখনও নিইনি অস্ত্র হাতে; কোনও পাখি,
প্রজাপতি কিংবা কোনও কীটকেও
করিনি হনন কোনওদিন, অথচ আমার এই
প্রাণের পূর্ণিমা
দপ্ করে নেভাবার জন্যে তালেবানি অমাবস্যা ধেয়ে আসে।
এই যে রমনার মাঠে, বকুলতলায়
এখন রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহী কবির বসন্তের গান
আর কোকিলের কুহুতান ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে,
সে দীপ্ত আনন্দধ্বনি পারবে কি রুখে দিতে কবন্ধ সন্ত্রাস?
পারবে কি ভবিষ্যের কোনও সূর্যোদয়ে?
প্রকৃতির রূপ
জানলার বাইরে তাকাও, দেখে না ও আকাশ,
ভাসমান মেঘ, গাছের পাতার নাচন, পাশের বাড়ির
কার্নিশে পায়রা যুগল, তারপর তোমার খাতার পাতায়
তৈরি হবে কবিতার পঙ্ক্তি; রোদ হাসবে, দোয়েল
শিস বুলোবে হাওয়ায়, চাই কি আমার মুখ
ভেসে উঠবে তোমার পঙ্ক্তিমালায়; বললে তুমি
ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলিয়ে। তোমার সুহাস
কণ্ঠস্বরে কৌতুকের ভঙ্গি ছিল। প্রকৃতির প্রতি আমার
অনুরাগ তোমার অজানা নয়। চোখ-মন-জুড়ানো
রূপ প্রকৃতির, এই সত্য সবার কাছেই উদ্ভাসিত। আমি বারবার
প্রকৃতির কাছে ফিরে যাই, তা-ও মিথ্যে নয়। অথচ
এই প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রুদ্র রূপ, যেমন মোহিনী,
নিরীহ, কোমল, শান্ত নদী হঠাৎ কখনও কখনও
কী ভয়ঙ্কর ফুঁসতে থাকে। তোমার মধ্যেও এই দু’টি রূপের খেলা।
১৩.৯.৯৮
প্রতিরোধ করবার পালা
এ নিয়ে কমসে কম সাত আটবার
মাটিতে পড়েছি মুখ থুবড়ে, অথচ কিছুতেই
ঝিমুনি যাচ্ছে না চোখ থেকে। এদিকে যে শরীরের
কোনও কোনও অংশ থেকে
ঝরছে রক্তের ফোঁটা, টলছে পা দু’টো,
সেদিকে খেয়াল নেই। তবে বেশ বুঝতে পারছি,
ডান বাম দু’দিক থেকেই বেধড়ক খাচ্ছি মার
বারবার, এ নিয়ে কমসে কম সাত আটবার।
আমার কসুর কী-যে বুঝতে পারিনি।
কখনও দিইনি ছাই কারও বাড়া ভাতে, কিংবা কারও
ওপরে ওঠার সিঁড়ি সরিয়ে ফেলিনি ঠাট্রাচ্ছলে,
অথবা ঈর্ষায় পুড়ে। আমি তো আপন মনে শুধু
একা ঘরে বাজিয়েছি বাঁশি
জ্যোৎস্না রাতে এবং নিঝুম অন্ধকারে। কারও কোনও
ক্ষতি করবার সাধ্যি নেই
এই বংশীবাদকের জেনেও যে যার খুশি মতো
কিল ঘুষি চড়
করেছে বর্ষণ রোজ আমার ওপর।
এতকাল পর যেন কোনও জাদুবলে
আখেরে আমার চোখ থেকে ঝরে গেছে
ঝিমুনি এবং আমি আর
মাতালের মতো টলছি না, পড়ছি না
মাটিতে কিছুতে কোনও আক্রমণে। এবার আমার
জেগে ওঠবার, কিল চড় ঘুষি প্রতিরোধ করবার পালা।
১২.১২.৯৮