দ্বিপ্রাহরিক অভিজ্ঞতা
দুপুরে টেবিলে ঝুঁকে লিখছিলাম কবিতা, তুমি ঘরে এসে
দাঁড়ালে টেবিল ঘেঁষে। তোমার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যায়
আমাকে, চুলের ঝর্নাজল তোয়ালের স্পর্শে মুছে
নিচ্ছিলে সযত্নে আর, মনে হ’ল, রঙধনুর ভগ্নাংশগুলো
ফ্লোর থেকে আলতো কুড়িয়ে নিয়ে রাখলে সাজিয়ে
বুক শেলফের এক কোণে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটির কাছে।
পূর্ণিমার মতো শাড়ি বেশ মানিয়েছে তোমাকে দুপুরে আর
ভাবলাম, আমার সামান্য ঘরে কোনও গ্রিক দেবী
সদ্য স্নান সেরে করেছেন নিঃশব্দে প্রবেশ। তুমি
চকিতে পেছনে এসে দু’বাহু জড়িয়ে
আমার গলায় স্মিত স্বরে বললে, ‘পড়ে শোনাও না
কী লিখেছ এতক্ষণ নাওয়া খাওয়া ছেড়ে?’ মৃদু হেসে
সদ্য লেখা অসমাপ্ত কবিতা আবৃত্তি করি, তোমার খুশির
ছোট ছোট ঢেউ
আমাকে দোলায়, পলায়নপর পঙ্ক্তির সন্ধান পেয়ে যাই।
অপরূপ স্তনভার দীপক রাগ সৃষ্টি করে শোণিতে আমার
দুপুরের স্বর্ণকণাগুলো কেবলি গলতে থাকে, আমাদের
দু’জনের ঠোঁটের যুগলবন্দি চলে কিছুক্ষণ
এবং সময়, পরিপার্শ্ব বিস্মরণে ডুবে যায়।
কী এক শব্দের চঞ্চু হঠাৎ ঠোকর মেরে আমার সংবিৎ
নিখুঁত ফিরিয়ে আনে, দেখি
আমার নিকট কিংবা ঘরের কোথাও তুমি নেই। হায়, কোন্
ইন্দ্রজাল তোমাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে
এই দৃশ্যপট থেকে? প্রকৃত ছিলে না তুমি কখনও এখানে।
আমিই করেছি সৃষ্টি স্বপ্নবৎ এই ঘরে তোমাকে দুপুরে।
৬.১.৯৯
নরেন বিশ্বাসকে মনে রেখে
শত ডাকলেও উচ্চস্বরে আর মিলবে না সাড়া কোনওদিন,
কঠিন দেয়ালে মাথা খুঁড়ে মরলেও
তোমার প্রগাঢ় কণ্ঠস্বর
কখনও যাবে না শোনা। আমরা সবাই সমস্বরে বারবার
মিনতি জানাই যদি, তবু
কস্মিনকালেও আর মঞ্জরিত হবে না তোমার কণ্ঠে বাণী,
কবিতার প্রিয় পঙ্ক্তিমালা। এ কেমন
স্তব্ধতাকে আরাধ্য ভাবলে তুমি, গুণী
ডানে বামে অগণিত বয়সের হৈ-হুল্লোড়ে ডুবেছে নিমেষে
কোকিলের গান বারবার,
চতুর্দিকে ছিল বড় ঝগড়া ফ্যাসাদ;
প্রবঞ্চনা, জোচ্চুরি, সন্ত্রাস
মাথা তুলে সুরুচি এবং সংস্কৃতির
সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে নরকের সূত্রপাত করেছিল, তবু
তুমি সত্য আর সুন্দরের, কল্যাণের ধ্যানে ছিলে
মগ্ন দিনরাত্রি, কিন্নরের মতো কণ্ঠে
খেলিয়েছ সুর আর ‘ধন্য ধন্য’ ধ্বনি
জেগেছে উৎকর্ণ ঘরে প্রহরে প্রহরে।
শ্মশান পারেনি বন্ধু তোমাকে পোড়াতে,
তবু এক ভয়ঙ্কর দাউ দাউ চিতা
বুকের ভেতর বয়ে নিয়ে গেছ বিদায়ের অতল আমায়
কাউকে কিছু না বলে সাধকের অপার ক্ষমায়।
০২.১২.৯৮
নাও, টেনে নাও
এতটুকু বাড়িয়ে বলার ইচ্ছে নেই। যা বলছি,
সত্যি সবই। বেশ ক’বছর থেকে আমার দু’হাতে
কিছুটা ইস্পাত গেঁথে আছে, আমার বুকের কাছে
লোহা-লক্কড়ের এটা সেটা দৃঢ় গেঁথে গেছে, গালে
তামার পাতের চাপ বড় বেশি, এবং কপালে জং-ধরা
টিন ফুটে রয় সারাবেলা। যখন রাস্তায় হাঁটি
অথবা বেড়াই পার্কে, তখনও কি কেউ তাজা আলোয় দেখে না
এ শহুরে আমার এমন রূপান্তর? আজ অব্দি কেন কেউ
আমার মুখের এই ভীষণ কালিমা দেখে চমকে ওঠেনি
একবারও? আধখানা যন্ত্র আর অর্ধেক মানব হয়ে আছি!
কোনও বৈদ্য অথবা হেকিম পারবে না কোনওদিন
সারাতে আমার এই ভয়ানক ব্যাধি, হায়। কাউকে কিছু না
বলে যদি এ শহর ছেড়ে ছুড়ে দূরে, বহুদূরে
চলে যাই কোথাও, যেখানে কলকারখানা আর
ভয়ঙ্কর আয়ুক্ষয়ী ধোঁয়ার কালিয়া নেই, গাছ গাছালির
ধ্বংসযজ্ঞ নেই, নেই ধুলোর সন্ত্রাস, তাহলেই
আমার কপাল, গাল, হাত আর বুক থেকে দ্রুত খসে যাবে
টিন, তামা, লোহা আর ধারালো ইস্পাত। সূর্যোদয়ের মতোই
চকিতে উঠবে জেগে আমার প্রফুল্ল নিরাময়। হে পাড়াগাঁ,
মাইল মাইল্ব্যাপী হে সবুজ, হে বিলের পানি, পানকৌড়ি,
মাছরাঙা, হে আমার পাড়াতলী, পদ্মপুকুর জোনাকি, ওগো
সর্ষে ক্ষেত, প্রজাপতি, হে ইঁদারা, ওগো বাঁশবন,
হে ঘুঘুর ডাক, হে রাখাল, মেঠো বাঁশি, যদি আসি
তোমাদের কাছে, তোমরা কি এই রুক্ষ, রিক্ত শহুরে আমাকে
করবে গ্রহণ হেসে বেলাশেষে? নাও,
ধূসর, অসুস্থ লোকটিকে টেনে নাও বুকে সস্নেহে সবাই।
৬.১.৯৯
নিজেকে খুঁড়ছি
নিজেকে খুঁড়ছি সেই কবে থেকে, খুঁড়ে যেতে হবে, যতদিন
মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি। কখনও কখনও
অবসাদ টেনে নিয়ে যায়
নিদ্রার নিস্তব্ধ কুঠুরিতে, অথচ অতল ঘুমে
ডুবেও নিজেকে খুঁড়ি অবিরাম-প্রকাশিত হয় ক্ষণে ক্ষণে
কত কিছু অবলীলাক্রমে।
এই যে দাঁড়িয়ে আছি ঝাউবনে, এখানে তো কখনও আসিনি,
এমন সবুউজ আমি কখনও দেখিনি;
এই জমি, এই দৃশ্যাবলী, এরকম পাখি
এর আগে কোথাও দেখিনি। অকস্মাৎ
সফেদ কাফন-পরা ক’জন তরুণী
বেহালা বাজিয়ে চলে আসে পুকুরের ঘাট থেকে-
তাদের বেদনা নীল মুখ
অচেনা, অদ্ভুত। বেহালার সুরে নেই পার্থিব মূর্ছনা আর
কী খেয়ালে ওরা বাদ্যযন্ত্র ছুঁড়ে ফেলে অকস্মাৎ
হেসে ওঠে, সেই হাসি অথই কান্নার নামান্তর।
নিজেকে খুঁড়ছি শুধু, খুঁড়ে যাব এভাবেই, যদ্দিন বুকের
স্পন্দন থেমে না যায় ততদিন খুঁড়তে থাকব,
নিজের কাছেই এই প্রতিশ্রুতি আমার, যতই
যন্ত্রণার দাঁত, নখ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাক।
নিভৃত কঙ্কাল
‘কী করে ঘুমাও তুমি এমন বিভোর? কিছুক্ষণ
পরেই উঠবে রোদ, দশদিক আলোয় নাইবে, পাখিদের
গানে পার্কে পাড়ার বাগানে
হবে গুঞ্জরিত ক্ষণে ক্ষণে। চোখ মেলে
দেখ, আমি সে কখন থেকে
দাঁড়ানো তোমার ঘরে অর্ভ্যর্থনাহীন। না, আমার
সামান্য কার্টেসি নিয়ে কোনও
মাথাব্যথা নেই। তুমি
আমাকে আনোনি ডেকে এখানে, বস্তুত
নিজেই এসেছি আমি এত্তেলা না দিয়ে, বলে সেই
নিভৃত কঙ্কাল ছেদ টানে হিমার্ত কথায়। বাক্যহারা
ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি কঙ্কালের দিকে।
বিছানায় এসে বসে মুখোমুখি, চোখের কোটরে
চোখ নেই, তবু চক্ষুহীন দৃষ্টি তার
পোড়ায় আমাকে
কখনও, আবার সমবেদনায়
ভারি হয়ে ওঠে ওর কণ্ঠহীন কণ্ঠস্বর। ‘জানি তুমি
বড় ক্লান্ত, ঈষৎ হতাশ হয়তোবা
নানান সার্কাস দেখে। প্রিয় প্রকৃতিও
পারে না বুলোতে কোনও অব্যর্থ মলম
অন্তরের গভীর জখমে আর সুদূর একাত্তরের রক্তমাখা মুখ
আবার নতুন করে জেগে উঠে বিভীষিকা রূপে
পথে পথে, ঘরে ঘরে হানা দেবে ভেবে
এখন তোমার বুকে জমছে তুষার। হে বান্ধব,
শোনো বলি, এখনও সময় আছে, রুখে
দাঁড়াও অস্ত্রের উন্মাদনা, করো ব্যর্থ বর্বরের জয়োল্লাস।
১৫.২.৯৯