আমার সাতদিনের অনুপস্থিতি
এবারই তো প্রথম নয়, আগেও গিয়েছি অনেক
বিদেশ বিভুইয়ে, কোনও কোনোবার দিব্যি থেকেছি
মাসের পর মাস আপন গহন এই ঘরের
হৃদয়ের শ্যামল উষ্ণতা থেকে কত না
হাজার হাজার মাইল দূরে। অথচ এবার আমার
মাত্র সাতদিনের অনুপস্থিতি
কেমন বেগানা বিষণ্ন করে ফেলেছে ওকে
যেন হাজার বছর ধরে অজস্র বজ্রকীট খেয়েছে তার স্নিগ্ধতাকে।
যে পুরোনো চেয়ার রোজ আমাকে আশ্রয় দিয়ে
প্রফুল্ল, নতুন হয়ে উঠত, সে কেমন
মুখ ভার করে আছে, যেন কোনও গভীর শোক
রেখেছে বন্দি করে। যে বাংলা অভিধানটি হামেশা
আমার অন্তরঙ্গ স্নেহস্পর্শে পুলকিত হয়ে আমাকে পৌঁছে
দিয়েছে কত অজানা রত্নদ্বীপে, সে আজ বড়ই বিমুখ। রবীন্দ্রনাথ,
শেক্সপিয়া, গ্যয়টে, দস্তয়ভস্কি, রিল্কে, কালিদাস, জীবনানন্দ, কির্কেগার্ড,
গালিব উদাস তাকিয়ে আছেন অনন্তে, যেন মর্মাহত আমার আচরণে!
আর আমার প্রিয়তমা কৃষ্ণকুমারী কবিতার খাতা
কৃষ্ণচূড়া-অভিমানে জ্বলে উঠছে, অথচ আমি যে সুদূর
বিদেশ বিভুঁইয়ে বারবার তারই ঠোঁট থেকে অমৃত
অধীর করেছি পান, গভীর নিশীথের স্তব্ধতাকে ঈর্ষান্বিত করে
বেঁধেছি আলিঙ্গনে কখনও বাস্তবে, কখনও স্বপ্নের মাতাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে
সে তা না জেনেই রেখেছে বন্ধ তার হৃদয়-দুয়ার পাথুরে স্তব্ধতায়।
যদি নিই চিরকালীন বিদায়, হই বিলীন অস্তিত্বহীনতায়
তাহলে কী করবে আমার কৃষ্ণকুমারী প্রিয়তমা এবং আরও কেউ কেউ?
এ কেমন লুকোচুরি খেলা
এ কেমন লুকোচুরি খেলা নিশিদিন? কখনও সে
সহজেই দেখা দেয়, খুব কাছে এসে বসে, হাত রাখে হাতে,
সুধা ঢালে
ঠোঁটে; চোখে চোখে কী-যে মাধুর্য ছড়ায়
যেন অমরতা দিচ্ছে এঁকে ক্ষয়া অস্তিত্বে আমার।
কখনও ভীষণ মেতে ওঠে অবহেলায়, নির্দয় প্রত্যাখ্যানে-
দূর থেকে চলে যায়। করে না ক্ষণিক দৃক্পাত, যেন আমি
বড়ই বেগানা কেউ। জ্যোতিচ্যুত একা পড়ে থাকি গৃহকোণে
চুপচাপ, মাঝে মাঝে করি পায়চারি দিশেহারা
নাবিকের দৃষ্টি নিয়ে। তাকাই কাছের পুষ্পহারা,
বস্তুত দুঃখিত, অতি ম্লান কৃষ্ণচূড়া গাছ, ভাসমান মেঘ,
সন্ধ্যার পাখির দিকে। দেখি গলিপথে একজন ঢ্যাঙা লোক
হেঁটে যায়; কখনওবা কবিতার খাতা খুলে বসি।
একদিন অকস্মাৎ চোখে পড়ে-সেই মায়াবিনী
চলেছে আমাকে ফাঁকি দিয়ে মেঘলোকে
ভেসে ভেসে। ‘এসো, এসো একান্ত আমার কাছে, তোমার
জন্যেই
আমার প্রতীক্ষা জাগে বিলের বকের মতো’ বলে গাড় মিনতি
জানাই।
সে মোহিনী নির্দয় হাসির ঢেউয়ে দুলে বলে, ‘শোনো,
পশ্চিম বঙ্গের কোনও খ্যাত প্রবীণ, নবীন
কবির খাতায় বসে কাটাব সময় কাব্যপঙ্ক্তি অকৃপণ
বিলিয়ে এবং বাংলাদেশে কতিপয় অনতিতরুণ আর
তরুণ কবির ঘর ছুঁয়ে কিছু চিত্রকল্প, উপমা, রূপক
না চাইতেই দেব উপহার। আজ তুমি মাথা কুটে মরলেও
পাবে না আমার ছোঁয়া। খাতায় যতই
শব্দ লেখো, হবে সবই নিষ্প্রাণ, অসার খড়কুটো।
সকালের রোদের উল্লাস আর বাউল-দুপুর
আমার হৃদয় ছিঁড়ে নাচে; আমার কুয়াশাময়
মাথার ভেতর কয়েকটি ফড়িঙ হারায় পথ, কিছু সাঁকো
ভেঙে পড়ে, জোনাকিরা পারে না ফোটাতে জ্যোতি এবং
আমার
অন্তর্লোক গুমরে গুমরে ওঠে শব্দহীনতায়, এক-আধটা
পঙ্ক্তিও দেয় না ধরা। ঘোর অমাবস্যায়, অগাধ পূর্ণিমায়
নিষ্করুণ কণ্টকিত প্রহর যাপন শুধু আর দেখি কত
স্বপ্ন, মনে পড়ে না কিছুই, সবই হিজিবিজি, ক্রূর।
একটি শিশিরভেজা শেয়ালের রক্তঝরা মুখে, নর্দমায়
পড়ে-থাকা ইঁদুরের মৃত দাঁতে, নুলো ভিখিরির খুব নোংরা
ন্যাকড়ায় পলাতকা মায়াবিনী চোখ রেখে বলে,
‘পারো তো এসব থেকে আমার রূপের উৎসটিকে করো
আবিষ্কার।
একজন কবি
আহ্ এত আতশবাজি, মালার বাহার, আলোর প্লাবন
চারদিকে। কেমন একটা মন-মাতানো সুরের
ঘূর্ণিনাচ সবুজ লন, ফুলের গাছ, গাড়ি বারান্দা, আর
বাড়ির পার্নিশকে দোল খাওয়াচ্ছে। নানা-বয়েসী
নর-নারী কবিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। হাসিমুখে
কত কথার গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছেন
তার ওপর। কেউ কবির কোনও কাব্যগ্রন্থের ভুল নাম
বলে প্রশংসার ঢেউ খেলিয়ে দিচ্ছেন। কেউ অন্য কোনও
কবির শস্তা কোনও পঙ্ক্তি ভেবে। এই প্রমাদ
মুখ বুজে হজম করলেন কবি। তবে সান্ত্বনা,
ধীমান এক সমঝদার মৃদু হেসে বলেন, ‘আমাদের এই কবি
এমন তরল পঙ্ক্তি লিখতেই পারেন না।
বেশ কয়েক বছর এই কবিকে নিয়ে অনেক জ্বলজ্বলে সভা,
জমজমাট আসর অনুষ্ঠিত হল; শহরের বহু সংগঠন
তাকে সামনে রেখে নিজেদের অস্তিত্বে সোৎসাহে
বিস্তর বিজ্ঞাপনের রঙ-জৌলুস মেখে নিল। আহ্ এত আতশবাজি
মাইক্রোফোনের পাড়া-কাঁপানো দাপট।
বহু বছর পর সেই কবি সন্ধ্যারাতে বসে আছেন তার
লেখাপড়ার ঘরে একা, অবসন্ন; অসুস্থতা ধেড়ে ইঁদুরের মতো
তাকে কুট কুট করে খেয়েছে। চোখের আলো
নিভে এসেছে প্রায়। অনেকদিন থেকেই
অনেকেই আসা ছেড়ে দিয়েছে বয়েসী কবির বাসগৃহে।
আজকাল কোনও অনুষ্ঠান অথবা উৎসবের
চটকদার আয়োজন নেই তার উপলক্ষে। এখন তিনি
উজাড় বাগানের মতো পরিত্যক্ত, তার কাছে রোজ
আসা যাওয়া করে একমাত্র অতিথি-
অতীত দিনের ক’জন স্মৃতি।
২৭.৮.৯৮
একটি উদ্যানের ইতিকথা
বলব না কোনওদিন, এ-কাজ আমিই শুধু করেছি একাকী
কিছুই ছিল না, আমি এই বিরানায়
নিষ্ফলা মাটিতে এসে বড় একা দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রুক্ষ, বন্ধ্যা জমিনে ছিটিয়ে বীজ, বহুদূর থেকে জল এনে
সরস করেছি মাটি, নতুন জন্মের ঘ্রাণে চতুর্দিক হেসে
উঠেছিল। বলব না, এ কেবল আমার একার সৃজনের রূপটান।
ভাসমান মেঘ বলেছিল, হে শ্রমণ,
তুমি চাইবে না, তবু রুদ্র তাপে ছায়া দেবো,
পেয়েছি ছায়ার বদান্যতা বারবার। জ্যোৎস্না এসে
আন্ধারকে করেছে পূর্ণিমা আর শিশিরের স্নেহ
ফুটিয়েছে ফুল রাশি রাশি
রঙ বেরঙের, এ উদ্যান গড়িনি কখনও একা।
কখনও করিনি স্বত্ব দাবি, ‘আমারই, আমারই’ বলে
কাঁপাইনি কোনও দিক, কোনও পাড়া, এ তোমার, তার,
বস্তুত সবার-এই সত্যটুকু লিখেছি জমিনে,
গাছের পাতায়, সুদূর নক্ষত্রলোকে, রাঙা দিগ্বলয়ে।
বন্ধুগণ, এই লিপি পাঠ করা বড়ই সহজ; দ্বিধাহীন
স্পষ্ট করি উচ্চারণ, এ উদ্যান তোমাদের থাক চিরদিন,
দিকে দিকে প্রবল কীর্তিত হোক তোমাদের অবদান, শুধু
দূরে অন্তরালে বসে ভাবব, বস্তুত উদ্যানের গৌরবগাথায় আজ
আমি তো নিমিত্ত মাত্র। কাউকে কিছু না বলে পথচারীহীন
পথে চলে যেতে পারি, আকাশে সূর্যাস্ত, ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়;
এখন তোমরা ছায়াপ্রতিম আমাকে
দীর্ঘশ্বাস ছাড়াই বিদায় দাও, আমি দ্রুত অপসৃয়মাণ স্মৃতি।
১৪.১২.৯৮