অরূপ রতন
যখন নেপথ্যে ডুব দিয়ে অতলে কাটাতে চাই
নিজস্ব সময় কিছু, জাল ফেলে, আমার চুলের মুঠি ধরে
ওরা টেনে তুলে আনে কর্কশ জমিনে।
আমার দু’ চোখ ঝাঁ ঝাঁ রোদে ভীষণ ঝলসে যায়;
চিত্তপুর দহনের আড়ালে থাকার
জন্যে সকাতর যাঞ্ঝা করে সবুজের দীর্ঘস্থায়ী আলিঙ্গন।
চারপাশে কী তুমুল চেল্লাচেল্লি, নিরন্তর কাদার অশ্লীল
খেল; দেখি, বেদাগ সফেদ পাঞ্জাবিতে বিষ্ঠা আর
কালি মেখে কত লোক বিকট উল্লাসে ফেটে পড়ে,
চায়ের টেবিল তোফা তপ্ত করে তোলে। তপোবনে
বসবাসকারী ঋষি নই,
নই কোনও বিয়াবান বনচারী ধ্যানী দরবেশ,
তবে নরাধম কোনও পতিত পাষণ্ডও নই,
আমি শুধু এক শব্দ শিকারি প্রেমিক।
এ শহরে আছে একজন, কোমল সোনালি যার
হাত, যে আমার শরীরের ক্লেদ ধুয়ে মুছে ফেলে
প্রেমজলে বলে, ‘কবি, যত ইচ্ছে তোমার গভীরে
দাও ডুব, নিভৃত পাতাল থেকে খুঁজে আনো অরূপ রতন।
আজীবন অক্লান্ত সাধনা ছিল তাঁর
আততায়ী অন্ধকার অতর্কিতে বর্বর, দাঁতাল
হিংস্রতায় গ্রাস করে পূর্ণিমাকে। মহিমার বিনাশে কাদার
কৃমিকীট, সরীসৃপ, পিশাচেরা উল্লসিত হয়। ইতিহাস
যাঁকে খোলা পথে ডেকে এনেছিল গভীর সংকেতে,
তিনি তো নিজেই মহা ইতিহাস। বুলেটের ঝড়
পারেনি মাহাত্ম্য তাঁর কেড়ে নিতে। বরং শোকার্ত অশ্রুকণা-
সমুদয় আজও আকাশের
নক্ষত্রণ্ডলী হয়ে জ্বলে আর গৈরিক প্রান্তরে,
ধূসর দিগন্তে খেয়াঘাটে চারণের কণ্ঠে প্রায়শ ধ্বনিত
দেশজ গৌরব-গাথা তাঁর।
আজীবন অক্লান্ত সাধনা ছিল তাঁর জীবনের
বলিষ্ঠ বিকাশ আর সৌন্দর্যের অকুণ্ঠ বিশদ প্রকাশের।
প্রগতি, কল্যাণ আর সুন্দরের
শক্র যারা, তারাই হেনেছে তাঁকে নব্য এই যেশাসকে, আর
তাঁর চার অনুসারী, বিশ্বস্ত, সাধনাদীপ্ত তাঁরাও কুটিল
নীল নকশা অনুসারে হয়েছেন অনুগামী তাঁর
আমারাতে একই পথে। তখন চৌদিকে
ছিল জানি লোভাতুর হিংস্র সব শ্বাপদের রাত।
সংহার করেও ঘাতকেরা তাঁর দিকে মরণের
আঁধার পারেনি ছুঁড়ে দিতে। তাঁর প্রাণের স্পন্দন
আছে জেগে অগণিত মানুষের বুকে। আমরা কি পুনরায়
হারিয়ে ফেলব পথ? তাঁর নাম, অমেয় খ্যাতির
নির্লজ্জ ব্যবসা দেখে ইদানীং, হায়,
শঙ্কা হয়, এই নাম কখনও ধুলোয় কিংবা পিচ্ছিল কাদায়
হঠাৎ ঢাকা না পড়ে। তাহলে বাংলার
সূর্যোদয় মুখ লুকোবার ঠাঁই খুঁজবে কোথায়?
১২.৮.৯৮
আনন্দ
আমার বাসার সামনের অনাথ শিশুনিকেতনের
দেয়ালে সেঁটে-থাকা ঝলমলে রোদ দেখে
আজ কী যে ভালো লাগে আমার। আনন্দ
আমাকে জড়িয়ে ধরে আন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। অথচ এই যে
এখন খুশির ঢেউ আমাকে
ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে, তার কোনও বিশেষ কারণ রয়েছে
বললে, ভুল বলা হবে। এই মুহূর্তে
আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলো দিয়ে দিতে পারি
কোনও প্রকৃত পুস্তক প্রেমিককে,
এখন আমি নির্দ্বিধায় আলিঙ্গন করতে পারি
যে-কোনও কুষ্ঠরোগীকে,
এই মুহূর্তে নিষ্ঠুরতম শক্রকেও ক্ষমা করা
অসম্ভব নয় আমার পক্ষে, একজন ঘাতকের সঙ্গে
এক টেবিলে বসে আহার করতেও কুণ্ঠিত হবো না।
আজ যখম ভ্রমণ করছি আনন্দ-ভেলায়, এখন আমি
মৃত্যুচিন্তায় কাতর নই, অদূর ভবিষ্যতে
বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ জলছলছল পাতালে নিমগ্ন হবে ভেবে
বিষাদে মেঘাচ্ছন্ন নয় আমার মন। আহ্, কী ঐন্দ্রজালিক
ক্ষমতা এই আনন্দের; ক্ষণিকের জন্যে হলেও মুছে ফেলে
শোকের ছায়া, বিচ্ছেদের বেদনা।
আজ হঠাৎ জানতে পারলাম পীড়া তোমাকে শয্যাগত
করেছে, আগুনের হল্কায় যেন
পুড়ে যাচ্ছে তোমার শরীর। মুহূর্তে আমার আনন্দের দীপ
নিভে গেল অশুভের ফুৎকারে। বিষাদ শ্রাবণের মেঘ হয়ে
ছেয়ে ফেলল আমার চেতনাকে; আনন্দ নিমেষে
গুলিবিদ্ধ পাখির মতো নিষ্পন্দ পড়ে রইল ধুলোয়।
২৭.১০.৯৮
আমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করে
আমার মা তার শত স্নেহার্দ্র চুম্বনে কিছু শব্দ আস্তে সুস্থে
আমার সবুজ শৈশবের আদিপর্বে
অন্তরঙ্গ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ওষ্ঠ, দৃষ্টিপাত
থেকে রোজ নিজের অজ্ঞাতসারে কুড়িয়ে নিয়েছি
ভাষার পরাগ কত আর
স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ফুটেছে কুসুমরূপে শিরায় আমার।
জাগরণে সর্বক্ষণ অবশ্যই, এমনকি গভীর ঘুমের ভেতরেও
মাতৃভাষা গুঞ্জরিত ঠোঁটে; স্বপ্নে দেখি, ‘হাসি খুশি’
খেয়া হয়ে ভাসে মগ্ন চৈতন্যে আমার
এবং ‘সহজ পাঠ’ হাঁসের ধরনে
প্রফুল্ল সাঁতার কাটে ভাবনার ঢেউয়ে ঢউয়ে, আঁধারে আলোয়।
নিজেকেই খুঁজি নিত্য আপন ভাষার নানা রঙে, নানা ছাঁদে।
কখন যে বাংলা বর্ণমালা কবিতার সাজে এল
আমার একান্ত ঘাটে, ভাসালো কলস
রহস্যের ছন্দে ভোরবেলা,
প্রখর দুপুরে আর গোধূলিরঙিন ক্ষণে, প্রগাঢ় নিশীথে,
বুঝতে পারিনি ঠিক, শুধু তার ইঙ্গিতে ঘুরেছি একা একা
মন্ত্রমুগ্ধ দিগ্ধিদিক। মাতৃভাষাকেই
নিশ্চিত প্রাণভোমরা জেনে
নিজেকে ক্ষইয়ে যুগিয়েছি তাকে সর্বদা জীবনসঞ্জীবনী।
বায়েন্নেয় ওরা এই প্রাণভোমরাকে
টিপে মেরে ফেলার চক্রান্তে মেতে করেছিল
হেলায় হরণ প্রাণ চিরতরে কতিপয় রাঙালির
তরুণ নিশ্বাস। সে-নিশ্বাস বয়ে যাবে যুগে যুগে
শহীদ মিনারে, গ্রন্থে, জাতীয় স্মৃতিতে। সর্বদাই
আমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করে বাংলা বর্ণমালা।
১৩.২.৯৯
আমার ডান হাত
বহুদিন পর কাল রাতে স্বপ্নে এলেন
আমার মা। শুয়ে আছেন তিনি বিছানায়, আমি
বসে আছি শয্যার পাশে। তিনি বারবার
আমার ডান হাতের দিকে তাকাচ্ছিলেন
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে হাত নিজের হাতে নিয়ে
আঙুলগুলোয় আদর বুলোতে বুলোতে
কী যেন বলতে চাইলেন আমাকে। হায়, কতকাল
তাঁর কোনও কথা শুনি না, কত যুগ তাঁকে দেখি না।
এখন তো কালেভদ্রে কেবল স্বপ্নের ভেতর তাঁর সঙ্গে আমার
এই দেখা। দেখি, কখনও তিনি দূরে দাঁড়িয়ে আছেন
সত্তায় নিঝুম নীরবতা জড়িয়ে, কখনও কী যেন
বলতে চান, অথচ অস্পষ্টতায় হারিয়ে যায়
সেসব কথা। কখনও আমার মা চার বেহারার একটি রূপালি
পাল্কিতে চড়ে দূর দিগন্তে মিলিয়ে যান।
কাল রাতে মাকে আমার ডান হাত ধরে
বলতে শুনলাম, ‘তোর এই হাত নিয়ে আমার
দুশ্চিন্তার শেষ নেই রে। তোর চারপাশে
গিজগিজ করছে দুশমন, ওদের
চক্ষুশূল তোর এই ডান হাত, সকালসন্ধ্যা
ওরা এর বরবাদি চায়। তারপর তিনি
আমার ডান হাতটিকে নিয়ে
ভরিয়ে দিলেন স্নেহাশিসে। হঠাৎ অদৃশ্য তাঁর বিছানা।
ঘুম ভেঙে গেলে ডান হাতের দিকে তাকাই,
সেখানে যেন মায়ের স্পর্শ লেগে আছে তখনও।
১৩.৯.৯৮