লিখতে বসব
লঘু পায়ে ভোর এল, বারান্দায় রোদের ঝলক
শুয়ে আছে কাৎ হয়ে তরুণীর ভঙ্গিমায়, যেন
ওর স্তনে প্রজাপতি এসে বসে আলগোছে, ঘুম
ভাঙবে না; কোথাকার এক পাখি মৃদু লেজ নেড়ে
শিস দেয়; মুগ্ধতায় নিমজ্জিত আমি; মেঘদল
ভেসে যায়, ছুঁয়ে যায় হৃদয় আমার; এইমাত্র
এক ঝাঁক কবুতর আসমানে-দৃশ্যটিকে বলি;
দৃষ্টি থেকে অন্তরালে যাও, আমাকে লিখতে হবে।
সধূম চায়ের কাপ এক পাশে সরিয়ে তক্ষুণি
বলপেন হাতে তুলে নিই। অকস্মাৎ তুমি ভেসে
উঠবে মনে, সৌন্দর্যে জড়ানো টাঙ্গাইল, আমি সাত
তাড়াতাড়ি খুব অনিচ্ছায় তোমাকেও আপাতত
চলে যেতে বলি, আমি লিখব এখন। কবিকেও
নিজের প্রতিই হয়ে যেতে হয় এমন নিষ্ঠুর!
৮.২.৯৭
লোকটার ঘুমের ভেতর
এসেছে সে বহুদূর থেক এই মাঠের কিনারে
গোধূলিতে, জামায় বিস্তর ধুলোবালি, রুক্ষ চুল, চোখ দুটো
জবা-লাল। জিরোবার ঠাঁই
পাবে কি এখন কিয়দ্দূরে? গাছতলা হাতছানি
দেয়, ক্লান্তি কুয়াশা ছড়ায়
শরীরে, মগজে; মাথা রেখে
শিমুল তলায় সে ঘুমায়, স্বপ্নে তার
আঁকাবাঁকা কালো রেখা, বেগুনি গোলক,
মত্ত ঘোড়া, শাদা-লাল, কাটা মুণ্ডু ভেসে ওঠে আর
কে এক রূপসী কাঁদে মৃতের নিঝুম মাহফিলে।
লোকটার ঘুমের ভেতর মনে হয়, যেন সে-ও
প্রাচীন কালের মৃত কেউ, যার কোনও স্মৃতি নেই,
আনন্দ, বেদনা-কিছু নেই; কেবল নিষ্পন্দ বসে-
থাকা আছে, আছে
মৃতের মিছিল দেখা। কতিপয় লোক,
নেকড়ের মতো মুখ ওদের, খুবলে নিচ্ছে দ্রুত
মেধাবী পুরুষ আর রূপবতী বিদুষীর মুখ। ‘বলোতো কেমন আছো?’
-চকিতে জিজ্ঞেস করে আস্তে হেঁটে চলে যান নিঃসঙ্গ ধীমান।
লোকটা স্বপ্নের অভ্র দু’হাতে ছড়িয়ে
ঘুমের ভেতর হাঁটে, হেঁটে যেতে থাকে পৃথিবীর
উল্টো পিঠে। অকস্মাৎ চোখে পড়ে তার
নিজের ফতুর মৃতদেহ পড়ে আছে বনপথে,
বোঝে না কেন যে বিরানায় ওর মৃতদেহ ঘিরে
ক’জন ধীমান বীণা বাজিয়ে বিলাপ করছেন অবিরল।
লোকটার সুরসাধনা
দুর্মর এক অস্থিরতা লোকটাকে, বলা যেতে পারে,
পেয়ে বসেছিল। নিজের ভেতর কেমন
ওলট-পালট বোধ করত। কোনও কোনও সময়
মনে হতো ওর, উন্মত্ততা ধেয়ে আসছে ষাঁড়ের মতো,
যার শিঙে বিদ্ধ হওয়া ছাড়া গতি নেই। লোকটা
দিনদুপুরে হাজার তারার চিৎকার শুনত,
দেখত জ্যোৎস্নার উথাল-পাথাল গাঙ। কখনও কখনও
নিশুত রাতে চৈত্র দুপুরের আর্তনাদে লোকটা বিয়োগান্ত
পল্লীগাথা হয়ে যেত। সে ওর ভেতরে নগর পতনের
আভাস অনুভব করত নতুনভাবে।
সুর তুলতে চাইত সে, অথচ ওর কণ্ঠে ছিল না সুর,
একে একে বাঁশি, বীণা সেতার, সরোদ,
গিটারের কাছে সুর ভিক্ষা করে শুধু বিফলতার
মুখ দেখতে দেখতে লোকটা নিস্তব্ধতার ধ্যানে
মগ্ন হ’ল আর কী আশ্চর্য, এখন কোনও কোনও
গভীর রাতে ওর চোখ, কান, নাক, আঙুল,
কপালের শিরা এবং সবচেয়ে বেশি বুক থেকে
এক অনিন্দ্য সুর জেগে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধতাকে বিহ্বল করে।
১৪.১২.৯৮
শহরে আছেন একজন
শহরে আছেন একজন কবি, যাকে আমি চিনি কিছুকাল
আগে থেকে। তার কাছে মাঝে-মাঝে যাই,
পোহাই ঘনিষ্ঠতার মধুর রোদ্দুর, আর কোনও কোনও দিন
কথোপকথনে বেশ কেটে যায় কিছুটা সময়। চোখে পড়ে
স্মরণীয় নানা দৃশ্য-ফুলের গাছকে
আলিঙ্গন করেন সাদরে কবি কখনও কখনও,
বলেন রোদের, জ্যোৎস্নার সঙ্গে কথা, মেঘ তাকে
ছুঁয়ে যার বারবার। দোয়েল, ময়না
কাঁধে এসে বসে তার, সুরের ধারায়
ভেসে যান তিনি কল্পলোকে। কোনও কোনও মধ্যরাতে
অপ্সরার গান শোনা যায় তার ঘরে। পরীদের,
কাছের গাছের আর ঘাসের সবুজ ভাষা আর
অনেক দূরের নীলিমার, নক্ষত্রে গূঢ় ভাষা
ভালোই বোঝেন তিনি, অথচ পাশের
নিঝুম বাড়ির যে-তরুণী গলায় দিয়েছে দড়ি,
পারেননি করতে পাঠ কবি তার হৃদয়ের ভাষা।
২৭.১০.৯৮
শাদা কাগজ নিয়ে
শাদা কাগজের হিমশূন্যতা অনেকক্ষণ তাকে
ভীষণ বিদ্রূপ করে। মনে হয় তার-
কে এক সফেদ প্রেত শব্দহীন বিকট হাসির তোড়ে ঘর
কাঁপিয়ে তুলছে ঘন ঘন; এই টেবিল চেয়ার খাটসুদ্ধ
সারা ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে যেন, প্রেত
নয়তো নিঃসঙ্গ, ওর সঙ্গে নন্দি-ভৃঙ্গি জুটে যায় যথারীতি।
ঘর ছেড়ে সে কি চলে যাবে এই ডামাডোল থেকে
দূরে অন্য কোনওখানে? যাবে কি গাছের কাছে যাবে ঘাসবনে?
অথবা লেকের ধারে শুয়ে আকাশের রূপ দেখে
জুড়োবে চোখের জ্বালা? প্রেতের পীড়ন থেকে বাঁচা যাবে তবে।
ঠাঁই-নাড়া হয় না সে। চেয়ারেই বসে থাকে অটল, অনড়;
অকস্মাৎ দৃষ্টিপথে ওর
আশ্চর্য আলোর নাচ প্রস্ফুটিত, এ যে ঘর জুড়ে ক্রমাগত
নেচে চলেছেন সুফী কবি রুমি। বিস্ময়-বিহ্বল দু’টি চোখে
সে কেবল চেয়ে থাকে নিষ্পন্দ, নির্বাক। বহু যুগ যুগান্তর,
মনে হ’ল তার, কেটে গেল চোখের পলকে; কবি
ওর কাঁধে হাত রেখে কী যে বললেন আলোর স্বরে, সে-ভাষার
কিছু বুঝল সে আর কিছুটা অবোধ্য রয়ে যায়।
সুফী কবি ঘূর্ণিনাচে মিশে গেলে পর সে সংবিৎ
ফিরে পায়, শাদা কাগজের বুক খুব কাছে ডাকে তাকে, সেই
আমন্ত্রণে যেন শুভ ইন্দ্রজাল ছিল,
মন্ত্রমুগ্ধ সে কলম তুলে নেয় হাতে আর প্রেত নন্দি-ভৃঙ্গিসহ
নীরবে পালিয়ে যায়। শাদা, শূন্য কাগজ ক্রমশ
ডালপালা, ফুল, পাতা, প্রজাপতি আর পাখি সমেত উদ্যান হয়ে ওঠে।
৩.১১.৯৮
শুভবাদী দিগন্তের দিকে
এখানে তো অনেক বছর আমি কাটিয়ে দিলাম,
অনেক বছর দম-আটকানো পরিবেশে; পথ
চলতে খেয়েছি শুধু কর্কশ ঠোকর, পা দুটোয়
রক্তচিহ্ন সারা গায়ে যন্ত্রণার দাঁতের জহর
নিয়ে সেই কবে থেকে এক ফোঁটা ঘুমোতে পারি না
সারা রাত। দেয়ালে কীসব হিজিবিজি
অক্ষরের বুনো মাতলামি ফুটে ওঠে, কয়েকটি
অস্পষ্ট বেয়াড়া মূর্তি বিভীষিকাময়
নাচ জুড়ে দেয় আর হঠাৎ কখনও
দেয়ালের ডান দিকে কারা লোভাতুর
বিকটি মুদ্রায় নীল, লাল, সবুজ, খয়েরি আর হলুদ পাখির
মুণ্ডু ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিব্যি হাপুস হুপুস খেতে থাকে।
অনেক বছর ধরে এখানে বসত করে এই
মাটি এই গাছপালাকেই একান্ত আপন
বলে জানতাম। এর ফুল, এর ফল
এবং সোনালি ফসলকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি বারবার
আর কী তন্ময় হয়ে শুয়েছি পাখির গান, পাল-তোলা নায়ে
বসে কিয়দ্দূর থেকে দেখেছি রূপালি চর। দীপ
জ্বেলে অন্ধকারে কত পথভ্রষ্ট পথিককে দেখিয়েছি দিশা,
প্রতিদানে চাইনি কিছুই
কোনওদিন, কেবল চেয়েছি কিছু আলো জ্বালাবার অধিকার।
ডান দিক থেকে ওরা নানা ছদ্মবেশে এসে আমার হাতের
দীপ কেড়ে নিতে চায়, পুরাতন ঘায়ের পট্রির
মতো অতীতকে ব্যবহার করে বর্তমানকেও
ঘেয়ো নুলো বানিয়ে রাখার
জবর খায়েশে ওর পথঘাটে ঘন ঘন বাজার সাজায়
জেল্লাদার ভঙ্গিমায়। সেই সব দাঁতালের দাঁত
নখেরে চেয়েও ঢের বেশি ধারালো, বিষাক্ত আর জাঁহাবাজ
অস্ত্রের রোমশ ধমকের কাছে বড় অসহায় আজ জ্ঞান।
ডান দিক থেকে তেড়ে আসা সন্ত্রাসের জয়োল্লাস
আমাকে নিষিদ্ধ করে শহরে ও শহরতলীতে, চুপচাপ
সয়ে যেতে হয় কুবাক্যের ঝড়ঝাপ্টা, হম্বি-তম্বি। এই প্রিয়
সোঁদা মাটি কামড়ে থাকতে হবে আরও কিছুকাল। মনে হয়,
সত্তর বছর ধরে স্বদেশেই নির্বাসনে আছি। অমাবস্যা
কেটে গিয়ে মানবিক পূর্ণিমায় দিকগুলি নেয়ে
উঠবে কখন, তার প্রতীক্ষায় শুভবাদী দিগন্তের দিকে
গভীর তাকিয়ে থাকি হাতে নিয়ে কবিতার মালা।
১৩.১.৯৯