ফের উড়ে যা
হায়রে এমনই পোড়া কপাল বান্ধব তোর, এই
ঘিনঘিনে কাদা জলে আটকা পড়লি। জানতাম,
তুই ধবধবে ডানা মেলে
নীলিমায়, মেঘে মেঘে অবাধ ওড়ার
সাধ বুকে পুষে রেখেছিলি। সবচেয়ে
উঁচু কোনও পর্বত শিখরে
ক্ষণকাল ঠাঁই নিয়ে নানা দৃশ্যাবলী
দেখবি দু’ চোখ ভরে, স্বপ্ন ছিল তোর।
চিত্তহারী মোহন উড়াল ছিল তার। অকস্মাৎ
চারপাশ থেকে
অনেক বিষাক্ত দাঁত নখ তেড়ে এসে
বিঁধল ডানায়, তুই বোবা আর্তনাদে
কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে
প্রায় নিশ্চেতন পড়ে গেলি কাদাজলে,
লা-ওয়ারিশ পুঁটুলি যেন। যে ডানায়
মানস সরোবরের জলধারা বয়ে
যাওয়ার নিশ্চিত কথা ছিল, যে চঞ্চুতে সরস্বত
চুম্বনের পদ্মমধু ঢেলে দিতে কী প্রবল আগ্রহী ছিলেন,
সে ডানা, সে চঞ্চু আজ পাকেচক্রে কাদায়্য গড়ায়।
এ শক্রতা, এ পতন মুখ বুজে মেনে নিবি তুই?
আটক থাকবি কৃমিপ্রসূ কাদাজলে সারাক্ষণ ওরে
চেয়ে দ্যাখ, উল্লাসের মতো রোদ ছড়িয়ে পড়েছে
সবখানে, ডানায় মেখে নে
রৌদ্রঝর্না-ধারা ফের উড়ে যা দূরের নীলিমায়
চোখে নিয়ে নিত্য আবিষ্কারের বিভাস।
২৬.১২.৯৮
বিনিময়
ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক দৃষ্টিতে একই দিকে
তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার অসুস্থ চোখ দুটো
হাঁপিয়ে উঠেছিল। আমার ছিপের ফাৎনাটা
মাঝে মাঝে কাঁপছিল, কিন্তু ডোবার কোনও
লক্ষণই দেখতে পাইনি। ফাৎনা ভাসতে থাকুক
লেকের পানিতে, আমি না-হয়
খানিক বেড়িয়ে আসি এদিক সেদিক থেকে। পাশের
ছায়াঢাকা পথের অন্তরঙ্গ ডাক আমাকে উন্মন করে।
পথের দু’দিকের গাছগুলোকে মনে হয় আত্মীয়;
হাঁটতে থাকি, দৃষ্টি বুলোই ধুলোয়, দূরের নীলিমায়।
দু’জন তরুণী হাত ধরে স্মিত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে,
একটি নারীকণ্ঠে সন্তানকে কাছে ডাকার
আনন্দধ্বনি, অদূরে এক মনোহারী দোকান থেকে
শিশুতোষ খেলনা কিনছেন একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, তার
মুখে ছড়ানো তৃপ্তির হাসি। সদর রাস্তার কিনারে
একজন নুলো ভিখিরি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে, গালভরা
খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ওর পাশে ছেঁড়া শাড়ি পরা এক যুবতী।
যুবতী এক খিলি পান পুরে দেয় নুলোর মুখে,
নুলো ভিখিরির চেহারায় ফোটে অনুরাগের ছটাময়
দরবারি বসন্তবাহার। দৃশ্যাবলীর নানা রঙ নিয়ে ফিরে আসি।
লেকের কিনারে এসে দেখি, ফাৎনাসুদ্ধ ছিপটি
কোথায় তলিয়ে গেছে, জানতে পারিনি। অথচ কষ্ট হ’ল না
এক রত্তি। নিজেকে কী এক বৈভবে
ভরপুর মনে হয়, দৃশ্যাবলী সেতার হয়ে অন্তরে বাজতে থাকে।
৩১.১০.৯৮
বিনীত মুদ্রায়
এরকম তাড়াহুড়ো, হুটোপুটি সাজে না তোমাকে। আগে তুমি
ছিলে না এমন বাস্তবিক;
মৎস্য শিকারির মতো প্রতীক্ষায় থাকতে সুস্থির,
যদিও অন্তরে হতো তোলপাড় প্রহর প্রহরে।
এখন কিসের প্ররোচনা হামেশাই
তোমাকে করছে তাড়া? আয়ুর সুতোয় বেশি টান
পড়ছে বলে কি তুমি সম্প্রতি কাতর খুব? বুঝি
তাই এরকম তাড়াহুড়ো। যতদূর
জানা আছে, আগে তুমি গৌতম বুদ্ধের মতো ধ্যানে
থাকতে নিটোল মগ্ন প্রায়শই, সেই হেতু তোমার খাতার
শূন্য পাতা শব্দে শব্দে উঠত সেজে আর
আজ শূন্যে হঠাৎ বাড়িয়ে হাত মুঠোয় যা পাও
তা-ই তড়িঘড়ি
পুরে দাও সফেদ কাগজে। ওরা মরা মাছি, না কি
গুঞ্জরণময় দীপ্ত ভ্রমর, যাচাই করবার, হে আমার প্রিয় সখা,
এতটুকু নেই ফুরসৎ।
মন বলে, হয়তো এখনও আছে কিছুটা সময়-
নিজেকে খনন করে বারবার কয়লা, কাঁকর,
কাচ, নুড়ি ছেনেছুনে প্রকৃত হীরের
জ্যোতিতে দীপিত হয়ে বাঁচো এ সংসারে স্মিত বিনীত মুদ্রায়।
২১.১০.৯৮
ভোরবেলার জন্যে
প্রতিদিন ভোরবেলার জন্যে কী তীব্র প্রতীক্ষা আমার।
কোনও কোনও মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে
কিছতেই ঘুম আসে না আর। বিছানায়
এপাশ ওপাশ করতে থাকি, যেমন ঢেউয়ে এদিক ওদিক
দুলতে থাকে নৌকা। বারবার
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, আকাশ আলোর রেখা খুঁজি।
খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে যায়, ভোরবেলার
প্রথম আলো শুধু আকাশে ফোটে না,
আমার মনেও ছড়িয়ে পড়ে ময়ূরের কলাপের মতো। নিজেকে
দেখতে পাই আকাশের রেশমি মেঘের
বিছানায় এবং তুমি আমার পাশে পেলব শুয়ে আছ,
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
কখন যে দু’জন মেঘলোকে সঙ্গমের মোহনায়
যুগ্মতায় লীন হয়ে যাই, বলতে পারব না।
তুমি নেই, অথচ তোমাকে প্রত্যহ ভোরবেলার প্রথম আলোয়
এভাবেই পেয়ে যাই, যেমন
কবিতার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়
রোদের ঝলক মেশা কুয়াশায় কখনও কখনও।
ভোরবেলার আলো দেখার জন্যে, পাখির
গান শোনার জন্যে, মেঘের শয্যায় তোমাকে নিবিড়
পাওয়ার জন্যে আমি অপেক্ষা করি পরম ব্যাকুলতায়।
এখনও যে রোজ সকালবেলার সঙ্গে
আমার দেখা হয়, এ তো পরম সৌভাগ্য
এই অভাজনের জন্যে। প্রত্যুষের জন্যে আমার এই প্রতীক্ষা
শেষ হবে হঠাৎ একদিন, যেদিন আমার রোগক্লিষ্ট শরীর
বিছানায় পড়ে থাকবে নিষ্পন্দ, নিষ্প্রাণ। সেদিনও
ভোরের আলো আমাকে দেখবে নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে,
আমি ওকে, কাউকেই দেখব না, কিছুই দেখতে পারব না।
৬.১.৯৯
মায়ামৃগ
সকলেই চেনে না কবিকে, কেউ কেউ চেনে তাকে
প্রচণ্ড হৈ-হল্লা, ভিড়ে অথবা বিজনে
কখনও সখনও। কেউ চিনলেও দূরে সরে যায়
কিছুই না বলে, কেউ কাছে এসে খানিক দ্বিধায়
নাম জেনে নিতে চায় পরখ করার
বাসনায়, প্রকৃতই এ লোকটা কি তিনিই যিনি
কোনও সিঁড়ি কিংবা সাঁকো ছাড়াই দূরের নীলিমায়
চলে যান সহজে বেড়ান হেঁটে নক্ষত্রের অসীম উদ্যানে?
যার এই পর্যটন বারবার কখনও আকাশে,
কখনওবা অশেষ রহস্যময় জলজ পাতালে,
তিনিই তো, পথচারী জেনে যায়, ছায়াপথ বেয়ে পুনরায়
মাটিতে আসেন নেমে, জড়িয়ে ধরেন বুকে তার
ক্ষেতের সোনালি ধান। ভেজা তাজা ঘাস আর নবান্নের ঘ্রাণ
তাকে দিয়ে লিখায় নিভৃতে
পৌঁষের প্রহরে কত গান এবং কবিতা। তাকে ঘিরে
পথিকের কৌতূহল মিটলেই মৃদু হেসে ভিড়ে মিশে যায়।
সকলেই চেনে না কবিকে, কেউ কেউ চেনে তাকে। অভিনেতা,
সফল ঔপন্যাসিক, ব্যান্ডশিল্পী , এমন কী টিভির ঘোষক
বস্তুত হ্যামিলনের বাঁশিঅলা; রাম ও রহিম
তাদের পেছনে ধায় খরা ও বর্ষার, দ্রুত পায়ে পায়ে ঘোরে।
তা ঘুরুক, নন্দিত তাদের ঘিরে সর্বত্র বাড়ুক কলরব,
ক্ষতি নেই। সকলেই চেনে না কবিকে,
কাঙ্ক্ষিত এমন তথ্য। নিঃসঙ্গতা ছাড়া
সাধকের সিদ্ধি ধু ধু নিঃসীম প্রান্তরে শুধু মায়ামৃগ, হায়!
২৫.১২.৯৮