Site icon BnBoi.Com

সৌন্দর্য আমার ঘরে – শামসুর রাহমান

সৌন্দর্য আমার ঘরে - শামসুর রাহমান

 অতিথি

আমাকে অবাক ক’রে ভোরবেলা একটি পাপিয়া এসে বসে
বারান্দায়, তাকায় আমার দিকে আর

নিশীথের অনিদ্রার কথা বলে বেদনার্ত স্বরে। আমি তার
দীর্ঘ অনিদ্রার অন্তরালে
একটি কাহিনী খুঁজি। অথচ সে অতিরিক্ত কিছুই বলে না,
বরং দু’চোখ তার আমার ভেতরকার কথা
নিগূঢ় সন্ধান করে। পাপিয়ার কৌতূহল ফিকে
করবার বাসনায় তার কাছে নিজের পদ্যের জন্যে সুর
যাঞা করি; খাতা খুলে অসমাপ্ত কবিতার দিকে
চোখ রাখতেই
বারান্দার অতিথি উধাও
লহমায়; দূর থেকে ভেসে আসে পিউ কাঁহা ধ্বনি।
১৮.১১.৯৭

 অথচ রবীন্দ্রনাথ

লিখছি টেবিলে ঝুঁকে একটি কবিতা বিকেলের
নিভৃত আভায়, চোখ তুলে
দেখি এক পাখি, হল্‌দে মখমল যেন
ওর শরীরের সবটুকু, শুধু শাদা
লাল; নাম জানি না পাখির।
একটি পঙ্‌ক্তির দু’টি শব্দ বদলের
জন্যে অসমাপ্ত কবিতায় বলপেন ছোঁয়াতেই
পাখি উড়ে যায়, ছেঁটে ফেলি তিন ছত্র।

কিছুক্ষণ কাটাকুটি ক’রে অনিবার্য উপমার ভাবনায়
ডুবে থাকি, হঠাৎ নজরে পড়ে এ কি
দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথ এ ঘরে, ঈষৎ নুয়ে-পড়া
উদ্ভাসিত দুপুরের মতো। খানিক এগিয়ে তিনি
দাঁড়ালেন লেখার টেবিল ঘেঁষে, আমার অপূর্ণ
সৃষ্টি দেখে তাঁর ঠোঁটে ফোটে প্রশ্রয়ের
হাসির ঝলক। আজ পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণ
নয়, তবু কেন এই আবির্ভাব ছোট ঘরে? ভেবে সারা হই।

কী নির্বোধ আমি! বাংলার ঘরে ঘরে নিত্যদিন
তাঁর আসা-যাওয়া, তিনি সর্বদা আছেন
আমাদের চেতনা প্রবাহে মিশে রঙে আর
গানে গানে, কবিতায়। তাঁর পদস্পর্শ ক’রে কুণ্ঠিত দাঁড়াই
এক পাশে; কখন যে রাত
এসে গেল চুপিসারে, টের
পাইনি এবং অকস্মাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে
দেখার মতোই দেখি রবীন্দ্রনাথের মেটেরঙ আলখাল্লা
থেকে ঝরে অবিরাম নক্ষত্রের কণা। কিছু কণা
খুব দ্রুত কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যে ব্যাকুল বাড়াই দু’টি হাত।

অথচ রবীন্দ্রনাথ ছায়াপথে নিঃসঙ্গ যাচ্ছেন মিশে, যেন
শান্তিনিকেতনে শালবনে।
১.৭.৯৭

অ্যালেনের জন্যে এলিজি

অ্যালেন, তোমার শেষশয্যা প্রথার শাসন মেনেই
রচিত হয়েছে, সমাধিস্থ হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল না কোনও দ্রোহ।
অ্যালেন, তোমাকে কখনও দেখিনি, অথচ আজ আমি
একান্ত আপন কারও বিয়োগ বেদনায় বিদীর্ণ। আমি
একেবারেই তোমার মতো নই ব’লেই হয়তো
তোমার জন্যে আমার পঙ্‌ক্তিমালা স্পন্দিত হচ্ছে
করুণ সুরে। অনন্তের বিউগলের নিঃসীম, নির্জন ধ্বনির ভেতর দিয়ে
অন্তর্ধান হ’ল একজন কবির। একটি শোকবার্তার মেঘময়তায়
নত মাথায় দাঁড়িয়ে গেলেন নানা দেশের কবি। শোকপ্রবাহে
কিছুক্ষণের জন্যে আমেরিকার বৈশ্বিক, বৈশ্যিক বহুরূপী সন্ত্রাস ভেসে যায়।

অ্যালেন, স্বজন আমার, তুমি তো জানতে
একজন কবির মৃত্যু হ’লে নিসর্গ কেমন বেদনা-বিহ্বল হয়।
মরণ তোমাকে হরণ করার পর গ্রীনউইচ পল্লী, নিউ ইয়র্কের
নিগ্রো স্ট্রিটনিচয়, তোমার নিজস্ব ত্র্যাপার্টমেন্ট, আড্ডাবাজ কাফে,
টমকিন্স স্কোয়ার, পার্ক, মুর্যমুখী, মকিং-বার্ড, ব্লেকের রুগ্ন গোলাপ,
তোমার ছোট হার্মোনিয়াম আর যশোর রোড-সবাই করে বিলাপ।
অ্যালেন, কী ক’রে যে দেখতে পেলাম একজন নুলোকে
চাঁদের সাইকেলে চ’ড়ে ঘুরে বেড়াতে মেঘের ফুটপাথে,
তুমি নিশ্চয় বুঝবে; তুমি নিখাদ বিশ্বাস করবে,
আমি অজ্ঞাত এক কুষ্ঠরোগীর বীজাণু-খোবলানো
বিপন্ন মাথায় সন্তের জ্যোতির্বলয় দেখেছি।
অ্যালেন, এই আমি এক গলির ঝলসিত গ্রীষ্মের দুপুরে
কর্কশ অন্ধকারে শহরের করোটির পুষ্পহীন চত্বরে
জেনারেটারের ক্রেংকারে শুনতে পাচ্ছি দেবদূতের গান।

অ্যালেন, তুমি কবিতায় লাভাস্রোত বইয়ে দিয়েছ; কত শব্দ
নিয়ে এসেছ আকাশের কারখানা থেকে। অজস্র
মোটরকারের গোরস্তান, এলএসডির সাইকেডেলিক জগৎ,
সাধুর ওম মন্ত্র, গাঁজার অন্তর্টান, শ্মশানের শ্যামা, লালন সাঁই
জুগিয়েছে তোমাকে কবিতার কণা। নিজের পুরনো জ্যাকেট, ট্রাউজার্স,
তরুণ বন্ধুর নগ্ন শরীর, ঘরের জানালা কিংবা বেসিন-
যেখানেই সপ্রেম হাত রেখেছ,
শব্দ কখনও পাথরের নুড়ি, কখনও আগুনের
টুকরো, কখনও-বা প্রজাপতির পাখনা হ’য়ে বেরিয়ে এসেছে;
শব্দ নিয়ে তুমি শৈব নৃত্যে মেতেছ, অ্যালেন।

অ্যালেন, হে সতীর্থ আমার, হে ফাঁপা, পতিত সংস্কৃতির নান্দীকার,
তুমি জ্বালা-ধরানো চড় কষিয়েছ নষ্ট সমাজের গলিত গালে,
অগ্নিশলাকা বিদ্ধ করেছ পুঁজিবাদের
নধর ভুঁড়িতে। তোমার কবিতা ‘চোপ ওর’ ব’লে
শাসিয়ে দিয়েছে বিধ্বংসী বোমাবাজ শাসকদের। জেনেছ,
শ্যামল বৃক্ষরাজির আত্মাহুতি, বিষক্রিয়ায়
অতিশয় কাতর নদীর যন্ত্রণার বিনিময়ে হাজার হাজার টনের
কাগজ দৈনিক বমি করছে আহত সভ্যতার খবর এবং
সকল মহাসাগরের মৃত্যুর আশঙ্কায়
আতঙ্কে পোড়া কাঠ হ’য়ে সন্তানের জন্মরোধের অঙ্গীকার করেছ।

অ্যালেন, হে প্রিয় কবি, বিদায়, তোমাকে বিদায়;
মৃত্যুকালীন তোমার অশ্রুকণাগুলো এখন
অনন্তের বুদ্বুদে বিলীন। তোমার অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই,
যদি বলি আজ তোমার কাব্যগ্রন্থে ধ্বনিত হচ্ছে দিব্যোন্মদ
ব্লেকের কণ্ঠস্বর, ঝরছে নিউ ইয়র্কের রোদ, শীতকুয়াশা আর
টলটল করছে বাংলাদেশের পদ্মপাতার জল। বিদায়, হে বন্ধু বিদায়।
১০.৫.৯৭

আমার আঁজলা পূর্ণ হোক

এমন কুয়াশা আগে কখনও নামেনি চতুর্দিকে
আমার ঘনিষ্ঠ ছাঁদে। আজ বেলাশেষে
প্রতারক জালে বন্দী হ’য়ে
মোহগ্রস্ত চোখে দেখি কে এক অস্পষ্ট ছায়াবৃতা
ঘোড়ামুখী নারী দূরে একাকী দাঁড়িয়ে
কী মন্ত্রে আউড়ে দেয় মায়াবী সঙ্কেত। আমি সেই
ছায়ার পেছনে গিয়ে খাদের কিনারে
পৌঁছে যাই; ক’জন পিশাচ নীল নক্‌শা অনুসারে
আমাকে রক্তাক্ত ক’রে খাবলে খুবলে
জন্মন্ধ খাদের নিচে পশুর আহার্য ক’রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
ঘোড়ামুখী নারী, সমস্ত শরীরে বিষকাঁটা,
অতিকায় বাদুড়ের রূপে ওড়ে চক্রাকারে, আমি
অসহায় প’ড়ে থাকি কাঁটাবিদ্ধ, একা
ভীষণ দুর্গন্ধময় খাদে নিজ দোষে। হায়, যাকে
অন্ধকারে রেখে মোহে ম’জে
ছলনার পেছনে ছুটেছি
অকালে অন্ধের মতো, সে-ই তো উদ্ধার
আমার, অথচ তারই হৃদয় বিদীর্ণ ক’রে ছাই
উড়িয়েছি জীবনে আমার। কোন্‌ দোয়েলের গান
আবার করবে যুক্ত দু’জনের হাত?


কী এক দুর্মর ঘোরে দেখি বিষাদ আমাকে নেয়
সম্পূর্ণ দখল ক’রে। দেখি
মায়াকোভস্কির মেঘচারী ট্রাউজার্স,
জীবনানন্দের কাশফুল-ধুতি ওড়ে
গোধূলি মেঘের স্তরে স্তরে।
বিষণ্ন দস্তয়ভস্কি জুয়োর টেবিলে হেরে গিয়ে
বারবার শেষে জিতে নেন অমরতা,
এবং কীটস্‌-এর বুক-ছেঁড়া উষ্ণ রক্তধারা
ব’য়ে যায় ওডে ও সনেটে;
রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লাকে চুম্বন করে রিল্কের গোলাপ।

যার শুদ্ধ ক্ষমাময় শুশ্রূষায় লহমায় সেরে যেতে পারে
আমার অসুখ, সে কি আমার শরীর থেকে বিষকাঁটা তুলে
নেবে নির্দ্বিধায়? তার হৃদয়ে আবার
ফুটবে কি ফুল প্রতি মুহূর্তেই আমার উদ্দেশে? তার ওষ্ঠে,
আর তার যমজ স্বর্গীয় ফলে পূর্ণ অধিকার
কখনও পাব কি ফিরে? স্খলনের ক্ষণিক তিমির
ধুয়ে মুছে যাবে নাকি উদার আলোয়? যদি নেপথ্যে ইয়েটস্‌
করেন নিবিড় সুপারিশ, তবে দয়িতার তীরে
সহজে ভিড়তে পারে পুনর্বার আমার আহত
ভ্রষ্টতরী; নেরুদা থাকেন চেয়ে সমুদ্রের দিকে। আমি তার
পাশে ব’সে দেখি দূরে রুমির আস্তিনে জ্বলে চাঁদ,-
আমার আঁজলা আজ পূর্ণ হোক মরমীর জ্যোৎস্না-মদিরায়।
২৯.১২.৯৭

আমার আপন টেলিফোন সেট

আমার আপন টেলিফোন সেটটিকে
প্রত্যহ সস্নেহ দেখি। কখনও আলতো তুলে নিই
রিসিভার, কখনও-বা নিবিড় আবেগে
চেপে ধরি; সর্বক্ষণ নয়,
কখনও কখনও
সে খুব কঞ্জুস হয়ে ওঠে।

টেলিফোন মাঝে মাঝে বড়ই ব্যাকুল
কণ্ঠস্বরে শোনায় আমাকে
বসন্ত বাহার কিংবা বিধুর বেহাগ, দরবারি। তার দূর
ব্যালকনিটি বাসনা আর স্বপ্নময়তাকে
নিভৃতে ফুটিয়ে তোলে এবং গাছের মর্মরিত
পত্রালি আমার হৃদয়ের ধ্বনি হয়ে
আর পাখিদের নাচানাচি
আমার আনন্দ রূপে সকাল বিকেলে
তার বুকে ঠাঁই পেয়ে যায় অগোচরে।

টেলিফোন কখনও আমাকে
ফাল্গুনের উদ্ভাসিত গৌরবে সাজায়
নিমেষে সাদরে, কখনও-বা মাথায় পরিয়ে দেয়
কাঁটার মুকুট, যন্ত্রণায় হৃদয়ের
তন্ত্রী ছিঁড়ে যেতে চায়। আমার আপন টেলিফোন
ভোরবেলা ভাঙায় গভীর ঘুম তার,
কখনও জাগিয়ে তোলে সুখস্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন
থেকে, কথা ঢালে কানে ষড়জে নিখাদে।

কখন যে টেলিফোন সেট নিজেরই অজ্ঞাতসারে
শুরু করে স্বপ্ন দেখা আর
দিব্যি মগ্ন হয় আত্মকথনে এবং
আমার সুন্দরী দয়িতা প্রেমে গলে
একজন কবির তুখোড় প্রতিদ্বন্দ্বী বনে যায় ঠারে-ঠোরে
ফুল্ল ফোয়ারার মতো; নক্ষত্র পাড়ায় ওর নিয়ত উড়াল।
১২.৩.৯৭

আমার একটি দুঃস্বপ্ন

ঘুমন্ত এই শহরের প্রতিটি দরজায়
আমি আজ বেপরোয়া করাঘাত করে চলেছি
বেখবর নাগরিকদের জাগিয়ে তোলার জন্য।
এখনও আমার শরীরে দুঃস্বপ্ন, কৃষ্ণ গহ্বর,
বন্য হিংস্র লতা, চোরাবালি এবং
গন্ধক আর গরম সীসার তীব্র গন্ধ।

দোহাই আপনাদের, এই গন্ধে ফিরিয়ে
নেবেন না মুখ; বন্ধ দরজা খুলে দয়া ক’রে
শুনুন আমার কথা। না, আমি কোনও
কৃপা ভিক্ষা করতে আসিনি, সামান্য খুদকুঁড়ো অথবা
সিকি-আধুলি প্রাপ্তির আশায় নয়
আমার এই ব্যাকুল করাঘাত। এই যে দেখছেন
আমাকে আলুথালু বেশ, উশ্‌কো খুশ্‌কো চুল;
না-কামানো খোঁচা দাড়ি, আমি অধীর
একজন বার্তাবহ ছাড়া কিছুই নই। দুঃস্বপ্ন
আমার ভেতর পুরে দিয়েছে এক ভয়াবহ বার্তা।

আপনারা কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন না
কোনও পদশব্দ? দেখতে কি পাচ্ছেন না
ভয়ঙ্কর একপাল না জন্তু-না মানুষ
তেড়ে আসছে চৌদিক থেকে? ওদের দাঁত-নোখে
লেগে আছে পুরনো আর নতুন রক্তচিহ্ন,
মানুষের হাড় দিয়ে ওরা পেটাচ্ছে কান-ফাটানো
ঢাকঢোল, ঘুরঘুট্রি অন্ধকারে ওদের
বসতি, আলোর ঝলকানিতে তিমিরবিলাসী
বাশিন্দাদের অস্তিত্ব ঝলসে যায় বলেই
ওরা আমাদের স্বাধীনতার অনন্য শিখাটিকে
নিভিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোঁট পাকাচ্ছে,
কিন্তু আমাদের হৃদয়ে সেই শিখা সূর্যোদয় হয়ে
জ্বলছে। ওরা কীভাবে নেভাবে
কোটি কোটি হৃদয়ের দেদীপ্যমান সূর্যোদয়?
দুঃস্বপ্নের সংবর্তে আমি শুনেছি
শকুনের মতো ওদের নখর বলছে, ওরা সাম্প্রদায়িক;
নেকড়ের চোখের মতো ওদের চোখ বলছে, ওরা হিংস্র ঘাতক;
মন্ডুকের মতো ওদের লাফালাফি বলছে,
ওরা কূপমন্ডুক আর কুসংস্কারের উপাসক;
ওদের পশ্চাদগামী অপযাত্রা বলছে, ওরা প্রগতি-বিরোধী।

দুঃস্বপ্নের ভেতরে আমি শুনেছি ওদের অশুভ নিঃশ্বাস,
ওদের দানবিক পদশব্দ। হে ঘুমন্ত নাগরিকবৃন্দ,
আপনাদের প্রতিটি দরজায়
করাঘাত করে চলেছি অবিরাম;
দোহাই আপনাদের, একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠুন,
আমার দুঃস্বপ্নকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবেন না।
১০.৪.৯৭

আমার মানস-সরোবর

আমার মানস-সরোবর কয়েকটি পাখি ভাসে,
নরম সাঁতার কাটে, ডুব দেয়, ডানা ঝাড়ে আর
পিঠের পালকে মাথা গুঁজে নিদ্রা যায়
কখনও সখনও, দ্যাখে রৌদ্রছায়া, ঘাস,
গাছপালা, আকাশের উদার নীলিমা;
কখনওবা ভয়ার্ত তাকায় কাছে-দূরে।

কী-যে হয়, আচানক কতিপয় লোক,
উদ্ভট পোশাক গায়ে, খল দৃষ্টি, বড় হিংস্র ভঙ্গি;
কুৎসিত লোমশ হাত বাড়ায় কোমল
পাখিদের দিকে, টুঁটি চেপে
ধরার নাছোড় তাড়নায়। পাখিগুলো
প্রবল ঝাপ্টিয়ে ডানা উড়ে যেতে চায় শূন্যতায়।

আমি কি পারব এই বিবেকবর্জিত দস্যুদের
নিরস্ত করতে আজ রক্ত গোধূলিতে?
পারব কি উপদ্রুত কিন্তু অনুপম
পালক সজ্জিত প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখতে?

যদি ব্যর্থতার কালি আমার মুখের
রেখাবলিকেই আরও কালো এবং করুণ করে,
তাহ’লে মানস-সরোবর শূন্য আর দ্যুতিহীন
হয়ে যাবে, অপরূপ জল
হবে কর্দমাক্ত, আমি নিজে
ভীষণ নিষ্প্রভ এক উদ্ভিদে রূপান্তরিত হব!

কী ক’রে নীরবে নেব মেনে
নিজের এমন পরিণতি? এই ক্রূর দুর্বিপাকে
গোলাপ, ভ্রমর, কুন্দকলি, জোনাকি এবং শ্যামা
সবাইকে সৌন্দর্য-বিধ্বংসী
লোকদের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিরোধ
গ’ড়ে তোলবার দৃঢ় আহ্বান জানাব।
১২.৪.৯৭

আলোকপুরী

সর্বদা-ক্ষুধার্ত এক মাংসাশী পাখিকে প্রায়শ
আমি তো আপনকার মাংস কেটে কেটে খেতে দিই
একটু একটু ক’রে। ওর অনুমতি ছাড়া আকাঙ্ক্ষিত আলোকপুরীতে
প্রবেশ নিষেধ জেনে নিজের শোণিতধারা দিয়ে
কয়েকটি পঙ্‌ক্তি লিখে পাখিটির দিকে তুলে ধরি। হেলাভ’রে
দেখে নিয়ে একটু কেশে দেয় সে বাড়িয়ে
পাইপের মতো চঞ্চু তার। আমি মাংস কেটে খেতে দিয়ে ভাবি,
এভাবেই এই আমি এতদিনে হয়েছি কঙ্কাল।

কিয়দ্দূর থেকে এক অর্ধ-উজবুক অর্ধ-উন্মাদের হাসি
ভেসে আসে; আমার শরীরের আর মাংস অবশিষ্ট নেই দেখে
পাখি পথ ছেড়ে দেয় শেষে। আমি কিছু দূর
হেঁটে গিয়ে দেখি এক অন্ধকার সিঁড়ি
বহু নিচে নেমে গেছে, পাতালে বুঝি বা। সিঁড়িময় চামচিকা,
বৃশ্চিক, কাঁকড়া আর ইঁদুর, বাদুড়। মাঝে-মাঝে ক্ষণিক জোনাকি-জ্যোতি যেন
চোখে পড়ে; আখেরে আলোকপুরী যদি
না-ই দেখি, তাহ’লে কী হবে?
৯.৮.৯৭

আষাঢ়ের প্রথম দিনে

আমি নেই ঝর্ণাতলে দাঁড়ানো, কিংবা নেই ঘাসের
বালিশে শুয়ে কোনও বাগানে। আমার ওপর ঝরছে না
ফুলের সুগন্ধি পাপড়ি। আমার কাছাকাছি পাখিদের
নাচানাচি কেউ দেখতে পাবে না এখন। আমি নিজের
ছোট ঘরে বসে আছি কাঠের চেয়ারে। আষাঢ়ের প্রথম
দিন আজ, অথচ বাইরে রগচটা রোদের বাজখাঁই আওয়াজ।
বিকেলবেলা অথবা অভিমানী সন্ধ্যায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি
নামবে কিনা জানি না। ইলেকট্রিক তারে আটকে-পড়া হাওয়ায়
মৃদু কম্পমান কাটা ঘুড়ির মতো আমার হৃদয় তাকায়
শূন্যতায়। কিছুদিন আগেও তুমি এখানে আসতে রাত্রিকে
শাড়ির ঝলসানিতে উৎসুক ক’রে পরিবেশকে সোনালি
আভায় চমকে দিয়ে অবয়বের সৌন্দর্যে। তুমি এখানে পা রাখার
সঙ্গেই আমার সামান্য ঘর হয়ে উঠত অমরাবতী, নেমে-আসা
নক্ষত্রেরা বাজত নূপুর-রূপে। এখন তুমি আর আসো না ব’লেই
এই ঘর সন্ন্যাসীর নাঙাগুহা; ঘরের চার দেয়াল আর ছাদ ফুঁড়ে
ঝরতে থাকে কর্কশ ভস্মরাশি, মরুভূমির কংকালগন্ধি
বালি। এই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর হুহু কাঁদছে আষাঢ়।
১৫.৬.৯৭.

এই সড়কে অনেক হাত

এই সড়কে আমার দৃষ্টিপথে মুহূর্তে ঝলসে ওঠে
অনেকগুলো মুষ্টিবদ্ধ হাত। সেসব
হাত থেকে হীরকদ্যুতির মতো ঝরছে শপথ, যেন জীবন
সারি সারি হাতের ভেতর পুরে দিয়েছে
অপূর্ব এক বোধ, যা নিমেষে বদলে দেয় প্রাক্তন
দৃষ্টিভঙ্গি। রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর
বারান্দা থেকে ঝুঁকে-দাঁড়ানো সব মানুষ
বিস্মিত চোখে তাকায় সেসব উত্তোলিত হাতের দিকে।

এই হাতগুলোর নিপুণ চাঞ্চল্যে কলকারখানার চাকা ঘোরে,
এই খেটে-খাওয়া হাতগুলো অবিরত গড়ছে
চোখ-ধাঁধানো পুঁজি। এই হাতগুলো রোদ আর
জ্যোৎস্নার চুমোয় পাবলো নেরুদার কবিতা হ’য়ে দিনরাত
ঝলসাতে থাকে; ট্রাম্পেটের মতো।
এই সব হাত কখনও শ্রমের ক্লান্তি ভুলে থাকার জন্যে
দিশি মদে চুর হ’য়ে ঘরে ফেরে, কখনও
সপ্রেম ফুল গুঁজে দেয় নারীর খোঁপায়,
এই সব হাত সস্নেহে বুকে টেনে নেয় ছেলেমেয়েদের,
এই সব হাত সূর্যকে স্পর্শ করতে চায়, অন্ধকার রাতে
হ’য়ে উঠতে চায় কালপুরুষ।

এই হাতগুলো এখন প্রধান সড়কে, ওরা এখন
দ্রুত অগ্রসরমান পতাকা। ওরা আগেই জেনে গেছে,
একদা যাদের যন্ত্রণায় সড়ক, বস্তি, কলোনি,
অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবীর শান্তির নীড় ভেসেছে রক্তে,
যাদের আলখাল্লায় রক্তচিহ্ন, তারাই আজ মতলববাজ রাজনীতিকদের
দহলিজে কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছে, ধর্মের বুলি ঝেড়ে
মানুষকে কুসংস্কারের পিঁজরাপোলে ঢুকিয়ে
হিংস্র আর অমানবিক ক’রে তুলতে চায়। সড়কে উদ্‌ভাসিত
হাতগুলো প্রতারণার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেই
মুক্তিযুদ্ধের সূর্যোদয় অন্তরে নিয়ে মে-দিনের গৌরবদীপ্ত
ডাক হ’য়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই আছড়ে পড়ছে
প্রতিক্রিয়াশীলতার সব খোঁড়লে।
২৩.৪.৯৭

এক পালকের পাখি

বিবর্ণ হাতলহীন একটি চায়ের কাপ পাঁচ মুখে ঘুরে
চলটে-ওঠা বেশ নড়বড়ে টেবিলের
মাঝখানে স্থির হয়ে বসে। এক কাপের ইয়ার
পাঁচজন যুবক নরক গুলজার
ক’রে রাখে প্রায়শ দু’বেলা
নিজেদের পাড়ার ঘনিষ্ঠ চাখানায়।

এক পালকের পাখি ওরা; প্রত্যেকের
উশ্‌কো-খুশ্‌কো চুল ঘাড়ে নেমে আসা, গালে
ক’দিনের না-কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি,
নোংরা নোখ, হাতা-গোটানো ময়লা
শার্ট গায়ে, কারও ট্রাউজার্স,
কারও বা পাজামা, কেউ কখনও কখনও উচ্চৈঃস্বরে
ফিল্মি গান গায় টেবিলকে
তবলা বানিয়ে, কেউ কেউ নিপুণ বাজায় সিটি। রোজগারে
মন নেই কারও, যেন ওরা মেঘচারী, নিরুদ্বেগ
দিন যায়, রাত কাটে জনকের সরাইখানায় মাতৃস্নেহে।

একদিন সে পাড়ায় ছিমছাম ফ্ল্যাটে
একজন নবীনার আবির্ভার রূপবতী বসন্তের মতো
পাঁচ যুবককে তরঙ্গিত করে; রাতারাতি যেন যাদুবলে
বিন্যস্ত ওদের চুল, পরিচ্ছন্ন গাল,
জামা পরিপাটি, নবীনার দৃষ্টি কাড়বার লোভ
প্রত্যেকের মনে লকলকে হ’য়ে ওঠে,
এক পালকের পাখি ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে।
বিবর্ণ হাতলহীন একটি চায়ের কাপ আর
ঘোরে না এখন পাঁচ মুখে। চাখানায়
সহজে আসে না কেউ, কাঁধ ধ’রে হাঁটাহাঁটি নেই।

পাঁচজন যুবকের মধ্যে কেউ নবীনার মন
শেষে জয় করেছিল কিনা, জানা নেই। কিছুকাল পর সেই
তরুণী হঠাৎ কোথায় যে চলে গেল
অসমাপ্ত লিরিকের মতো। অনন্তর চাখানায়
ফিরে আসে ঢেউ, পুনরায়
বিবর্ণ হাতলহীন একটি চায়ের কাপ ঘোরে
পাঁচজন যুবকের ঠোঁটে, মাথাভর্তি অবিন্যস্ত চুল,
গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে
ইস্ত্রিহীন ম্লান জামা, মলিন পাজামা, ট্রাউজার্স,
অথচ কোথায় যেন একটি ফাটল রয়ে গেল।
১৮.৩.৯৭

একজন যুবকের কথা

গভীর রাতের নেশা চটে গেলে ভোরের হাওয়ায়
যুবক ধরায় সিগারেট, অলিগলি
পেরিয়ে হঠাৎ কী-যে মনে এলো তার, ঢুকে পড়ে
খানকা শরীফে,
যেখানে লোবান পোড়ে, জ্বলে সুগন্ধি আগরবাতি
দিনরাত, ব’সে অনেকের সঙ্গে এক কোণে সময় কাটায়।

এওতো খোঁয়ারি এক, ভাবে সে যুবক
শীতল দেয়ালে দিয়ে ঠেস, এখনও নিজেকে লাগে
কী ভীষণ ফাঁপা আর ফাঁকা। তাহ’লে কোথায়
খুঁজব মনের মুক্তি-এই প্রশ্ন পাখির মতোই
ঠোকরায় তাকে বারবার; জিজ্ঞাসু, অস্থির যুবা
ছায়াচ্ছন্ন খানকা শরীফ ছেড়ে রোদালো রাস্তায় উঠে আসে।

পথে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরে যুবক
কতিপয় লম্বা চুল দাড়ি গোঁফধারী
কেমন মস্তিতে চুল লোকের উন্মুক্ত আস্তানায়
যোগ দেয় ভক্তির তন্ময়তায় ম’জে, ওদের জিকির চোরা টানে
তাকে এ ভবের হাট থেকে কোথায় ভাসিয়ে
নিয়ে যায়, বোঝে না সে কিছুই ব্যাপক ধোঁয়াশায়!

জিকির নিস্তব্ধ হ’লে ছিলিমের ধোঁয়ার সুতীব্র গন্ধে ফের
যুবকের সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা জেগে ওঠে
ছায়াঢাকা বটমূলে। উজাড় পকেট,
ছিলিমে দেবে কি টান? এখানে কি মনের মানুষ
আছে কোনওখানে-যুবা প্রশ্ন করে মনে মনে আর
নিজেকেই লাগে পুনরায় বড় শূন্য, বড় ফাঁপা।
অনন্তর আস্তানায় ধোঁয়াজাল ছিঁড়ে
যুবক আশ্রয় নেয় শহরের নিভৃত উদ্যানে; পুরু ঘাসে
মাথা রাখে, গোধূলি বুলায় হাত ওর
অশান্ত মাথায়, হাওয়া চুলে বিলি কাটে, ভেসে আসে
ফুলের সুঘ্রাণ, যুবকের মন মুক্তির সন্ধান পেয়ে যায়
কবিতায়, নারীর হৃদয়ে আর মানুষের আনন্দমেলায়
২২.৩.৯৭

একটি কবিতাসন্ধ্যা এবং তুমি

আজ সন্ধ্যেবেলা যাদুঘরের ছোট মিলনায়তনে
আমার কবিতাপাঠ ছিল। কবিতা খুব ভালবাসো,
অথচ তুমি আসো নি। বলার মতো বলতে পারি নি ব’লেই
অভিমানের গাঢ় নীল শিখা জ্বেলে অন্তরে
ব’সে রইলে অন্ধকার ঘরে নিঃসঙ্গতাকে আঁকড়ে ধ’রে। আমি
ডানাভাঙা একটি দোয়েলকে
কংক্রীটে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখলাম
ধোঁয়াশায়। আম্র খুব কষ্ট হ’তে থাকে; আকাশ থেকে
খ’সে পড়লে কয়েকটি তারা, চাঁদকে
একটা হিংস্র শকুন ছিঁড়তে শুরু করে। আকাশজোড়া আর্তনাদ।

সেই আর্তনাদে মিলনায়তন কাতর; তুমি আসো নি,
চতুর্দিক কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন। অথচ কোনও
বিদ্যুৎবিভ্রাট ছিল না। কবিতা পড়তে গিয়ে
হোঁচট খেলাম বারবার, যেমন খঞ্জ
বিব্রত হয় পথ চলতে। চেনা শব্দগুলো মনে হ’ল অচেনা।
তুমিহীনতায় মঞ্চে ব’সে একটিও প্রেমের কবিতা পড়তে পারি নি
কবিতাসন্ধ্যায়; আমার হস্তধৃত
বইয়ে পাতাগুলো, বিশ্বেস করো, পোড়োবাড়ি হ’য়ে গেল। আমার
নিজেরই কবিতা চাপা ক্ষোভ আর অভিমানে আসর ছেড়ে
চলে গেল যেন মহরমের মিছিলে বুক চাপড়াতে!

এরপর কেটে যাবে বহুকাল। আমাকে কখনও
কোনও কবিতাসন্ধ্যায় দেখা যাবে না আর;
হয়তো তুমি কোনও এক অলস বিকেলে বইয়ের দোকান থেকে
উপন্যাস আর কাব্যগ্রন্থ কিনে ছিমছাম বেরিয়ে আসবে, তখন
আমার হতচ্ছাড়া, বেঢপ একটি কবিতা
তোমাকে বিনীত জিগ্যেশ করবে,
‘কিছু মনে করবেন না প্লিজ, অনেকদিন পর দেখা, কেমন আছেন আপনি?
আঁচল গোছাবে, তারপর তোমার মধুর কিন্তু বিস্মিত কণ্ঠের প্রশ্ন, ‘কে তুমি?’
আমার কবিতা তার মলিন ফতুয়ার আলগা-হ’য়ে-আসা
বোতাম ঠিক করতে করতে দিনান্তের ভিড়ে করুণ মিলিয়ে যাবে।
২৪.৫.৯৭.

একটু আরো কষ্ট স’য়ে

একটু আরও কষ্ট স’য়ে কাছে গেলে পৌঁছে যাব,
একটু আরও হাঁটলে পরে পেয়ে যেতাম যা চেয়েছি।

যাত্রারম্ভে সঙ্গী ছিল অনেকজনই দলেবলে;
অনেক হেঁটে, খেটে খুটে এতটা পথ
পেরিয়ে এলাম। সদর রাস্তা, অলিগলি,
নদীতীরে, বনবাদাড়ে ঘুরে ফিরে লক্ষ্য খুঁজি।

সঙ্গী ছিল অনেক তেজী সজীব তরুণ,
পথের মাঝে পা দিল কেউ মোহন ফাঁদে;
কেউ কেউ দূরে জলাভাবে ছলাকলার মায়াহ্রদে
ঝাঁপিয়ে প’ড়ে কোথায় যেন ডুবে মরে।
কাউকে কাউকে চোরাবালি হঠাৎ পুরো গিলে ফেলে,
বাঁকা বিপথ কারও কারও দিশা ভোলায় বেলাশেষে।

পথের শেষে না পৌঁছেই মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে,
ক্লান্ত লাগে, আমার বড়ই একা লাগে;
ব’সে পড়ি পথের ধারে, ঘুমের আঠায় বুজে আসে
চোখের পাতা। পথের শেষে না পৌঁছেই
এদিকে হায় আমার নিজের রসদ ফুরায় অবশেষে।
তবু আমি ভয় পাই না, ফুরায় না তো মনোবল।

ফলমূল আর গাছের পাতা খেয়ে টেয়ে, কচি কচি
ঘাস চিবিয়ে, ঘামের ফোঁটা চেটে চুটে
ক্লান্তি মুছে সাতসকালে, দিনদুপুরে, গোধূলিতে,
আঁধারে আর জ্যোৎস্নারাতে চলব পথে শেষ অবধি।
পৌঁছে গিয়ে হাত বাড়াব অভীক্ট সেই বীণার দিকে, যদি পারি
তারে তারে সুর জাগাতে দেহমনে চিরঅমা নামার আগে।

বাকি আছে একটু আরও হুমড়ি খেয়ে না গড়ালে
খাদের নিচে, দেরী হলেও পেয়ে যাব হাতের মুঠোয় যা চেয়েছি।

আখেরে হায় সিসিফাসের শ্রমের মতোই যদি আমার
সকল কষ্ট বিফলে যায়, তবু মনে উড়বে না কো খেদের ছাই;
এ ব’লে এই আলাভোলা মনকে কিছু প্রবোধ দেব-
ভবের হাটে কতজনাই ঘোরে ফেরে, ক’জনা পায় আসল রতন?
২৮.৩.৯৭

কবি ব’লে বড়ই বিরক্ত

এ আমার কী হয়েছে আজকাল? যেদিকে তাকাই
মনে হয় অন্ধকার দাঁত নোখ বের ক’রে চোখ
পাকায় কেবল, বুঝি একটু পরেই
আমাকে ফেলবে গিলে। রাস্তার দু’পাশে
বাড়িগুলি অশ্রুপাত করে আর আমি
অশ্রুজলে ভিজে সপসপে এক বিষণ্ন ধীবর,
যার ছেঁড়া জালে কোনও মাছ ধরা পড়ছে না আর,
উঠে আসে শুধু কিছু বিষলতা, হাড়ের ভগ্নাংশ।

আসলে এই যে আমি একজন কবি-
বিষয়টি ভীষণ বিরক্তিকর এখন আমার
কাছে, যেন কুকুরের লেজে ঢ্যাঁড়া বেঁধে
দিয়েছে পাড়ার দুষ্ট বালকেরা মজা লুটে নিতে।

কবি ব’লেই তো
আমার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে বিপন্ন বসন্ত আর
উজাড় বাগান, সারি সারি ভয়াবহ
কংকালের জিন্দাবাদ ধ্বনি,
পুরাতন ঘাতক দলের হিংস্র লাঠির মিছিল।
কবি ব’লেই তো, অনেকের
সহাস্য মতানুযায়ী খামোকা শিউরে উঠি ক্ষণে
ক্ষণে রজ্জুকেই সর্প ভেবে, আমার নিজস্ব কিছু
পূর্বাভাস শুনে উপহাসে মেতে
ওঠেন আপনজন, পাড়াপড়শিরা থাকে খুব উদাসীন।
যখন সবাই রাতে ঘুমায় গভীর নিজ নিজ
বিছানায়, ভাসে স্বপ্নে, স্বপ্নহীনতায়;
আমি নিজে প্যাঁচার মতন জেগে থাকি প্রায়শই,
হিজিবিজি আঁকি শূন্যে, দেখি
কোন্‌ দূরে বিধবা বালিশ সিক্ত করে অশ্রুজলে,
জানালার ব্যথিত পর্দায় প্রস্ফুটিত
হাহাকার। কোথা ক্ষুধার্ত শিশু কেঁদে ওঠে, বেকার পুরুষ
কামে তপ্ত হ’য়ে আলিঙ্গনে বাঁধে
আপন নারীকে তার, চাঁদখেকো ছায়া
স্ফীত হ’তে হ’তে পুরোপুরি গ্রাস করে শহরকে।

স্পষ্টত বলতে গেলে, এই আমি কবি ব’লে নিজে
বড়ই বিরক্ত হই ইদানীং নিজেরই উপর; একা-একা
পথ হেঁটে গেলে মনে হয়
কে যেন ছায়ার মতো আমাকে অনুসরণ করে
সারাক্ষণ, আড়ি পেতে শোনে
যা আমি আবৃত্তি করি মনে-মনে, সুচতুর জাল
পেতে রাখে সম্মুখে আমার;
দাড়িতাকে গোপনে চুম্বন করি যখন, তখন
সে ঈর্ষায় জ্ব’লে যুগ্মতার চিত্রটিকে কখনঅ ছিঁড়তে
কখনও পুড়িয়ে ছারখার ক’রে দিতে চায় আর
এই কবি যন্ত্রণাকাতর প্রায় ক্রুশবিদ্ধ কবি
শব্দের পেছনে ছোটে বনবাদাড়ে, খাদের পাড় ঘেঁষে
ঢুকে পড়ে নরখাদকের কালো গুহায় এবং
জেনেশুনে বাড়ায় নিষ্কম্প হাত বিষধর সাপের খোঁড়লে।
১১.৪.৯৭

কবিতার প্রতি

আজকাল যখন তখন তুমি চকিতে ফিরিয়ে নাও মুখ;
আমি কি করি নি স্তব প্রত্যহ তোমার? করি নি কি
তোমারই উদ্দেশে যাত্রা অবিরত তুচ্ছ
করে পথশ্রম কিংবা ক্লান্তি? অজস্র সুতীক্ষ্ণ কাঁটা
ফুটেছে আমার দু’টি পায়ের পাতায়,
সারা পথ সেজেছে রক্তের আল্পনায়
বারবার এবং ঝলসে গেছে মুখ অগ্নির ছোবলে আর
নিষ্করুণ দৃষ্টি-বর্শা বুকে পেতে নিয়েছি স্বেচ্ছায়।

কেবল তোমার দেখা পাওয়া
ছাড়া অন্য কিছুর প্রত্যাশা
কখনও করি নি কোনওদিন, উন্নতির
মই বেয়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টায় কাটে নি
আমার সময় আর নিজেকে সরিয়ে
রেখেছি ইঁদুর-দৌড় থেকে,
বিত্তের বৈভব লুটে নিতে
হুজুগে মাতি নি আমি কস্মিনকালেও। তোমাকেই
আমার সকল স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, উদ্যম শুধু করেছি অর্পণ;
প্রতিক্ষণ তোমার আসার প্রতীক্ষায়
ব্যাকুল হৃদয়ে পথ চেয়ে থাকি ষড়ঋতু জুড়ে।
তবু কেন তোমার এরূপ নিরূপতা ক্ষণে ক্ষণে?

ঠায় বসে থাকি না নিজের ঘরে সকল সময়,
মাঝে মাঝে পথে, মাঠে, বনবাদাড়ে, প্রান্তরে,
নদীর কিনারে হাঁটি একা একা, যদি
প্রকৃত তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কোনওখানে।
২৪.৩.৯৭

 ক্রিসমাস ট্রি

বেশ কদিন ধরে ছিলাম ত্রঁটেল মাটিতে
আপাদমস্তক লেপ্টে-থাকা কচ্ছপ যেন।
ঈষৎ নড়তে চড়তে চাই,
চাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে,
অথচ থকথকে কাদা
আটকে রাখে, পেয়ে বসে স্থিবিরতার ঝিমুনি।

তোমার আমার চুক্ষমিলনের জন্মবার্ষিকী আজ। চকিতে
ভোরবেলার আলোঝর্ণার স্পর্শে কাদামাখা পিঠ
চড় চড় করে, গাছের পাতা কানে ঢালে
সবুজ ধ্বনি, পাখির গান চোখ থেকে
সরায় শুকনো কাদার ভগ্নাংশ। কাদার টুকরোগুলো
স্বপ্নকণা হ’য়ে জ্বলতে থাকে। সবার অলক্ষ্যে দিনটি
লাল চঞ্চুতে নীল পদ্ম নিয়ে আমার ছোট ঘরের
সরোবরে এক রাজহাঁস; আহ্‌, এ কী আনন্দধারা ধমনী জুড়ে!

কেউ না জানুক, গোধূলিজড়ানো আকাশ আর হৃদয় জানে-
তোমার আমার প্রথম দেখার মুহূর্তটির
জন্মবার্ষিকী আজ। নিঃশ্বাস-কাড়া ডিজেলের কালো ধোঁয়া,
যানজটের দমবন্ধকরা গুমোট আর সন্ত্রাসীর অন্ত্রের ধমক
উজিয়ে কোত্থেকে
কয়েকটি প্রজাপতি উড়ে এলো এই নীরব, বড় নির্জন জন্মোৎসবে
আমার ঠোঁটে মিলনবেলার চুম্বন আঁকতে। কখন যে
ধমনী থেকে ঝংকার, একমুঠো চকচকে মুদ্রার মতো শব্দ, টের পেলাম
শরীর থেকে কাদার শক্ত খোলস জয়োল্লাসে
ফেটে চৌচির হওয়ার পর।

আমাদের প্রথম দেখার জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা
জানায় তরুণ রোদ, তরুণী জ্যোৎস্না,
স্বর্ণচূড়া তোমার জন্যে উপটৌকন পাঠায়
নিজের হাতেবোনা লাল চেলী; কালপুরুষ ছড়িয়ে দেন
তার বিখ্যাত সুদূর হাসি এই অখ্যাত জন্মোৎসবে।
জীবিকার নাছোড় ত্র্যালবাট্রস গলায় নিয়ে
ঘেমো রাস্তায় ঘোরাঘুরি, হুমকি আর
বিদ্রূপের কাঁটা-ছড়ানো পথে হাঁটাহাঁটি সেরে নিজের
লেখার টেবিলের নির্জনতাকে আলিঙ্গন ক’রে
সত্তায় চকিতে হ’য়ে ওঠা এই আমিকে দেখে
অন্তঃপ্রেরণার ঝর্ণাটানে আমাদের নিবিড় প্রথম দেখার
জন্মবার্ষিকীকে সাজাই অপরূপ অদৃশ্য সাজে।

আমাদের প্রথম দিনের মুহূর্তগুলোকে জ্যোৎস্নাস্নাত
জলকন্যাদের মতো সাঁতার কাটতে দেখে বিস্মিত
তাকিয়ে থাকি। আমি হই ক্রিসমাস ট্রি এবং
আমাকে জড়িয়ে থাকে অনেক আশ্চর্য রঙিন বাল্ব।
আমার দিকে ছুঁড়ে-দেওয়া সব ইটপাটকেলকে
পুষ্পসার বানিয়ে হাসি; আহ্‌ কী আনন্দধারা জগৎ জুড়ে!
১৫.৫.৯৭

 ঘর ছেড়ে

ঘর ছেড়ে কদাচিৎ বাইরে বেরোন ভদ্রলোক,
কী ক’রে যে সর্বক্ষণ একই ঘরে নীরবে থাকেন
শুয়ে-ব’সে; মাঝে মাঝে চলে পায়চারি
কয়েক মিনিট আর তাকান বাইরে,
জানালার কাছে গিয়ে চোখে
পড়ে তার-যাচ্ছে হেঁটে একটি কি দু’টি
লোক, কার কোথায় যে ঠিকানা, কে জানে! দূর থেকে
ভদ্রলোক কাছে টেনে নিতে চান যেন নিসর্গকে।

বহুদিন পর অকস্মাৎ
গহন সন্ধ্যায় এক সেই ভদ্রলোক তার রক্তের ভিতর
করেন চাঞ্চল্য অনুভব;
অজানা অপ্রতিরোধ্য টানে বেরিয়ে পড়েন তিনি
ঘর ছেড়ে, হেঁটে যান তারাদের চাঁদোয়ার নিচে
গন্তব্যবিহীন, ফেরেননি ঘরে কোনওদিন আর।
৬.১১.৯৭

 চক্ষুবিশেষজ্ঞ ব’লে দেননি

এসব কিছু যে হবে, ঘন ঘন ঘটতে থাকবে চক্ষুবিশেষজ্ঞ ব’লে
দেননি আমার চক্ষু পরীক্ষা করার পর। এখন কী-যে
হয়েছে, গরগর-করা গ্রীষ্ম দুপুরে দেখি ঘরের ভেতর
শ্রাবণের মেঘ নেমেছে। বুকশেলফের বইগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ
ভূর্জপত্র, দুলছে পাঠশালার শিক্ষার্থী যেন; বাল্ব কদম ফুল।
এক চিলতে বারান্দায় বাগদাদের নিগৃহীত দার্শনিক
ইবনে রুশদ মোড়ায় ব’সে তন্ময় শুনছেন লালন সাঁই-এর
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। দরজায় দিকে আবছা
তাকাতেই চোখে পড়ে আফ্রেদিতি, যার প্রস্ফুটিত
নগ্নতায় সামুদ্রিক ফেনার ফুরফুরে চাদর,
চকিতে দুর্গার
সংহারমূর্তি ধারণ ক’রে তেড়ে আসে আমার দিকে।
জ্বালাধরা চোখ বন্ধ করতে পারি না। একজন ডাকপিয়ন
ঘরের ভেতর ঢুকে প’ড়ে হাতে গুঁজে দেয় হরফবিহীন চিঠি এবং
সেই চিঠি তক্ষুণি পড়ার জন্যে শাসাচ্ছে নাছোড়,
জাঁহাবাজ এক সান্ত্রী; পড়ার ভান ক’রে আওড়াই
এমন একটি কবিতা যা’ কস্মিনকালেও দেখিনি কোথাও কিংবা
পড়িনি। এই দৃশ্য মুছে যেতেই আমাকে লক্ষ্য ক’রে পাথর
ছুঁড়ছে কাবিল, আমার বুক চিরে বেরোয়া আর্তনাদ।
কখন যে রাত হয়, টের পাই না। আসমানের চাঁদটাকে
খুবলে খুবলে খায় নেকড়ের পাল আর বেদনার্ত দৃষ্টি
মেলে সক্রেটিস কম্পিত হাতে আমার দিকে এগিয়ে দেন
হেমলকের ভয়ঙ্কর-নীল পেয়ালা। চতুর্দিক থেকে অনেকগুলো
কাঁসার বাটির ধুন্ধুমার আওয়াজের মতো বহু লোকের
হাসি আমাকে বিঁধতে থাকে। সুফি মনসুর হাল্লাজের
রক্তের জাগ্রত বুদ্বদে দেয়ালে মুদ্রিত হয় সত্য শব্দটি
সত্যের মতোই ভাস্বর। রক্তাঙ্কিত সত্যকে অগণিত নোংরা নোখ
আঁচড়ে আঁচড়ে তুলে ফেলতে চায় তুমুল হিংস্রতায়।
ছন্নছাড়া দাবদাহ আমাকে পোড়াচ্ছে অষ্টপ্রহর, আমি
ঝর্ণাধারার কোমল ধ্বনি শোনার জন্যে অঝোর বর্ষণে স্নাত
হওয়ার জন্যে উন্মুখ, প্রতীক্ষা-কাতর আমার এই ছোট ঘরে।
১৭.৬.৯৭

 চিৎকার

মাঝে মাঝে ভীষণ চেঁচিয়ে উঠি আমি
স্বপ্নে জাগরণে আর আমাকে ব্যাকুল প্রশ্ন করে প্রিয়তমা-
‘কবি, তুমি এমন চিৎকার করো কেন
বেলা-অবেলায়?’

তাজা রক্ত দেখলেই আমার এমন হয়, এত
রক্ত আর নেকড়ের দাঁত আমি দেখেছি স্বদেশে
আমার ভেতরকার কেউ
প্রবল চিৎকারে আজ ফেটে পড়তে চায়।
৯.৯.৯৭

ছায়া

গাছের ছায়ার দিকে একজন লোক
তন্ময় বিছিয়ে রাখে চোখ
কিছুক্ষণ, যেন ছায়া কিছু কথা বলবে নরম স্বরগ্রামে
লোকটাকে। বহু হাঁটাহাঁটি হ’ল, খানিক বিশ্রামে
এখন নিমগ্ন থাকা যায়
অপরূপ এই হলদে বিকেলবেলায়,
ভাবে সে নীরবে ঠাঁই নিয়ে,
নিরিবিলি মিশে গিয়ে
ছায়ার ভেতর। মেঘ, রোদ, পাখি, স্পন্দমান পাতা
দেখে তাকে; ঘাসের বালিশে রাখে মাথা
লোকটা, পাজামা বেয়ে ওঠে
দু’চারটে পিঁপড়ে আর হাওয়ার আরাম লাগে ঠোঁটে,
খোঁচা খোঁচা দাড়িময় গালে
এবং কপালে।

বৃক্ষটির ছায়ার ভেতর থেকে আরও বেশি গভীর ছায়ায়
লোকটা প্রবেশ করে, নিজে ছায়া-প্রায়
হয় ক্রমে। কিছুক্ষণ ধ’রে তার মাথার ভেতর
জমছে ছায়ার নানা স্তর।
সন্ধ্যা নামে, গাঢ় হয়, কয়েকটি জোনাকি সেখানে
জ্বলে আর নেভে, লোকটা কি কারও টানে
ফের হেঁটে যাবে বহুদূর? আপাতত আকাশের তারা গুণে
আর স্বপ্ন বুনে
আস্তে সুস্থে কাটাবে সময় আরও কিছুক্ষণ আর
নীড়েফেরা পাখিরা ভাববে কোনও পিছুটান নেই লোকটার।
৯.১১.৯৭

জ্বরের ঘোরে

সকাল বিকশির, আমার জ্বরতপ্ত কপালে নরম রোদ হাত রাখে,
যেমন রাখতেন মা। স্মৃতিপাখি মাধুর্যে স্নান সেরে মাথার
ভেতর গান গায়। কিছুকাল থেকে জ্বরের পালা নিয়মিত চলছে।
জ্বালাময় চোখ, বিস্বাদ মুখ, খাদ্যে অরুচি, তেতে-ওঠা শরীর
প্রায়শ ভোগাচ্ছে। এরই মধ্যে রকমারি শব্দ ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে
ব্যালে-নাচ শুরু করে আমাকে ঘিরে। কাকে ছেড়ে কার রূপ দেখি
ভেবে পাই না। চোখের লেন্সের গভীরে ওদের ধ’রে রাখি। কখনও

ওদের দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। ক’দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে, আর
আজকাল বৃষ্টিধারা দেখলেই আমার মায়ের কবরের কথা মনে পড়ে।
তাঁর কবরের ওপর বৃষ্টির বর্শাগুলো বিদ্ধ হচ্ছে ভাবলে কেমন কষ্ট পাই।
জানি, তাঁর অস্তিত্ব এখন আমার চেতনাপ্রবাহ ছাড়া অন্য কোথাও নেই
একরত্তি, তবু মন বর্ষাকাতর সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার মা একটা খুদে
ঘড়ি বিছানায় নিয়ে ঘুমোতেন ঠিক সময়ে জেগে ওঠার জন্যে, যাতে
তাহাজ্জতের নামাজের ওক্ত পালিয়ে না যায়। আজ আম্মার মৃত্যুর
প্রায় ছয় মাস পর ছাড়া অন্য কোথাও নেই
একরত্তি, তবু মন বর্ষাকাতর সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার মা একটা খুদে
ঘড়ি বিছানায় নিয়ে ঘুমোতেন ঠিক সময়ে জেগে ওঠার জন্যে, যাতে
তাহাজ্জতের নামাজের ওক্ত পালিয়ে না যায়। আজ আম্মার মৃত্যুর
প্রায় ছয় মাস পর পুঁটুলির ভেতর থেকে সেই বন্ধ ঘড়িটি বের করার সঙ্গে
সঙ্গে সে সপ্রাণ হ’য়ে ওঠে। আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে মায়ের হাতের
স্পর্শ পাওয়ার জন্যে তৃষিত হই। হায়, জড়বস্তু স্পর্শের উষ্ণতা ধারণ
করতে অক্ষম। সে স্মৃতিহীনতায় চিরনিদ্রায় নিমজ্জিত। চোখ ফেরাতেই
মা-কে দেখতে পাই খাটে, অন্তহীন নিঃসঙ্গতায় নিঃস্পন্দ, নিস্তব্ধ। নানা
শব্দের ভ্রমর চারদিকে উড়ছে, ওদের গুঞ্জরনে বর্ষারাতে অভিসারিকার
হৃদয়ের ধ্বনি। ভ্রমরগুলোকে ছোঁয়ার জন্যে হাত বাড়াই। ওরা আমার বশ
মানবে তো প্রভাত-পদ্মের উন্মীলনে? আমি পায়ে হেঁটে মেঘনা নদী
পার হচ্ছি, দু’পায়ে ঢেউগুলো মাছের গান হ’য়ে বাজে কানে, কয়েকটি পাখি
আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় পূর্বপুরুষদের
ছায়াচ্ছন্ন ঘাটে। চেনা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, খানিক জিরিয়ে
উড়ে চলি ভৈরবের সেতুর ওপর দিয়ে। আমার মুখের
তপ্ত জমি মদির ফসলে তরঙ্গিত দয়িতার ঠোঁটের স্পর্শে। আমি কি
ঘরময় নূপুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি? এই আওয়াজ হৃদয়ে মুদ্রিত
করার বাসনায় আমি উন্মুখ এখন। আমি লড়ছি, যেমন যেমন পাহাড়ি হরিণ লড়ে
পর্বতশৃঙ্গে গাছপালার হঠাৎ-আগুন এবং তুষার-ঝড় থেকে নিজেকে রক্ষা
করার জন্যে। শব্দভ্রমরসমুদয় পারে আমার অস্তিত্বের ভিত অক্ষুণ্ন রাখতে। যদি
এখন ওরা আমার বশ্যতার গন্ডিতে ধরা দেয়, তবেই আমার রোগমুক্তি,
আমার ভাল-লাগার সীমানা-না-মানা উড়াল মনগড়া অমরাবতীতে।
১৪.৭.৯৭

 টেলিফোনে তুমি

টেলিফোনে তুমি সেদিন সন্ধেবেলা
কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে প্রিয়তমা।
বুঝতে পারিনি তোমার ভেতরে কত
ক্ষোভ, কত ব্যথা আর হাহাকার ছিল জমা।

তোমার হৃদয় গোলাপ বাগান জেনে
ছিলাম ব্যস্ত একাকী নিজেরই মনে।
তোমার গোলাপ ছিন্ন হয়েছে শুধু
এবং আমিও বিদ্ধ কাঁটার বনে।

যে যুগে আমরা করি আজ বসবাস,
তার সন্ত্রাসে জীবনের ভিত কাঁপে।
তুমি কি কখনও দেখনি আমার মুখ
কেমন দগ্ধ প্রাক্তন অভিশাপে?

চৌদিকে কত ভীষণ দৃশ্য দেখি,
জ্যোৎস্না রাতের প্রহরও মাতমে কাটে।
তবুও অনেক ভাঙা সেতু পার হ’য়ে
ক্যামেলিয়া হাতে বসেছি তোমার ঘাটে।

কখনও সখনও রুক্ষ চলার পথে
ঝড়ঝাপটায় যদি ভুল হ’য়ে যায়
হয়ো না ক্রুদ্ধ অথবা হতাশাময়,
আজও তোমাকেই জীবন আমার চায়।

হঠাৎ যখন মৃত্যুর ছায়া কাঁপে,
তোমার কথাই খুব বেশি ক’রে ভাবি।
যতদিন বেঁচে আছি অনিত্য ঘরে,
আমার হৃদয়ে থাকবে তোমার দাবি।

টেলিফোনে তুমি যেদিন কেঁদেছ, আমি
কুড়িয়ে নিয়েছি তোমার চোখের মোতি।
ঝ’রে-পড়া সেই অক্ষয় মোতিগুলো
আমার তিমিরে ছড়াক নিয়ত জ্যোতি।
২৭.১১.৯৭

তবুও মানব

অর্ধপশু, অর্ধনর প্রাণীদের বহ্নুৎসবে লক্ষ লক্ষ টন
জ্ঞান বিজ্ঞানের বই হ’ল ভস্মীভূত,
তাণ্ডবে লাঞ্ছিত গুণী, অনেকে নিহত, সভ্যতার চিহ্নগুলি
লুপ্ত একে-একে অতি দ্রুত।

তবুও মানব থেকে যায় কোথাও আড়ালে আবডালে,
সংখ্যায় যদিও বেশি নয়। পূর্ণিমার
আশ্রয়ে পুরুষ তার রমণীর হাতে হাত রাখে,
শোনায় কবিতা তাকে, টেনে নেয় বুকে
মানবিক বোধে, ঘর বাঁধে
পৃথিবীকে সুন্দরের মহিমায় নিয়ে যাবে ব’লে।

গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে মানুষের বার্তা রটে যায়
ক্রমান্বয়ে; সুচারু নিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা শারদ অগাধ রোদে হাঁটে
মরালের মতো। মানুষের শান্তি আর
কল্যাণের জন্যে কত মানব শান্তির বাণী লেখে।
১৬.৯.৯৭

তার খাতা

লোকটার ঢের বয়স হয়েছে, শরীরে দু’তিনটে রোগ বেশ
জাঁকিয়ে বসেছে। থাকে সে এই শহরের একটি গলির
ভেতর এক কোণে, নিরিবিলি। সামাজিকত টানে না তাকে।
পাড়ার কারও সঙ্গেই ওঠা বসা নেই। সে যে আছে
এখানে, এ-কথা পাড়ার পাঁচজন দিব্যি ভুলে থাকে।
মাঝে-মাঝে দূর থেকে অবাক হ’য়ে দেখে লোকটাকে।
হয়তো ওকে নিয়ে কখনও সখনও ওদের মধ্যে খুচরো আলাপ
চলে কিছুক্ষণ। সে কান পাতে না কারও কোনও কথায়।

লোকটা নাকি ভাসমান মেঘ, গাছের সবুজ পাতা,
ঘাস, পিঁপড়ে, পাখি, মধ্যরাতের রাতা, রোদ্দুর
আর বৃষ্টিধারার সঙ্গে কথা বলে। একবার একজন
তরুণীকে সে নাকি আচমকা বলেছিল, ‘আপনার
শরীরের নিম্নাংশ অবিকল মৎস্যকন্যার মতো।‘
তরুণী চমকে উঠে দূরে সরে গিয়েছিল। তারপর
সারা ঘরে ফিসফিস, হাসির হুল্লোড়। ব্যাপারটা
হাসির খোরাক হবে, লোকটা ভাবেনি। একজন
তরুণীর শরীরে মাছের লেজ ঝলসে উঠলে সে কী
করতে পারে। কেউ-কেউ তাকে মানসিক হাসপাতালে
যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছে দু’একবার। সে
নির্বিকার তাকিয়ে রয়েছে দেয়ালের দিকে।

লোকজনের কথা অথবা আচরণে ক্ষুব্ধ হয় না সে।
আজকাল প্রায় সারাক্ষণ নিজের ডেরাতেই থাকে নিজের
সঙ্গে। পথের কিছু কুড়ানো নুড়ি নিয়ে খেলা করে
আপন মনে আর নুড়ির ভেতর দেখে নেয় গোটা এক বিশ্ব।
মাঝে-মাঝে একটা মোটা খাতায় খুব রাত জেগে কী সব
যেন লেখে। সেসব কারও চোখে পড়েনি কোনওদিন।
তার মৃত্যুর পরে কোনও উৎসুক ব্যক্তি জিনিসপত্তর
ঘাঁটতে-ঘাঁটতে খাতাটার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতেও পারেন।
৯.১০.৯৭

তিনি বলবেন

অনেকগুলো গোলাপ এসে জড়ো হয়
একটি বিষণ্ন সিঁড়িতে, বলে, আমরা ফুটিনি কোনও বাগানে
অথবা ঝিঁ ঝিঁ-ডাকা বিরানভূমিতে,
আমরা প্রস্ফুটিত একটি উদার, সহিষ্ণু বুকে,
যে-বুকের বিশালতা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের
চেয়েও অধিক বিশাল;
যে-বুকের গভীরতা সঙ্গোপসাগরের চেয়েও অধিক গভীর।
আমাদের জন্ম হয়েছে বুকের ক্ষতরূপে সেজে ওঠার জন্যে।

সেই গোলাপগুচ্ছ বলে, আমাদের চোখে অশ্রুধারা নেই,
আমাদের দৃষ্টিতে ভরা আগুনের ফুলকি,
যা সর্বক্ষণ জ্বালা ধরাবে ঘাতকদের পিটপিটে চোখে,
আমাদের পাপড়িতে কোনও পেলবতা নেই,
ওরা প্রত্যেকে একেকটি লাল পাথর, যাদের বৃষ্টিতে দিশেহারা
ঘাতকেরা মৃত্যু ভিক্ষা করবে
প্রতি মুহূর্তে মরণের কাছে। পৃথিবীর সবচেয়ে হীন,
কুৎসিত জীব ব’লে লানতের বকলেস ঝুলবে ওদের গলায়।

তিনি সেই বিশালকায় পুরুষ, এক-বু
গোলাপ নিয়ে দাঁড়াবেন, তাঁর মাথা ছোঁবে মেঘমালা,
গলায় বাজকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলবেন,-
হায়, ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেয়নি দেখতে
গ্রীষ্মের আমবাগানের ছায়া, বৈশাখী ঝড়;
হায়, ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি
বর্ষার ভরা নদী আর কদম ফুল;
হায়, ওরা আমাকে ভালো ক’রে দেখতে দেয়নি শরতের
নীল আকাশের নিচে হাওয়ায়-দোলানো কাশফুল;
ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি
হলুদ হেমন্তের ফসল, মেঠো ইঁদুর, আর কুয়াশার বিষণ্ন জাল;
ওরা একুশ বছর আমাকে ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি
বাংলার শীতের পাখি আর রকমারি নক্‌শি পিঠা,
হায়, ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি বসন্ত-পলাশ,
শহীদ মিনারের অগণিত পুষ্পার্পণ,
এবং একুশের ছায়ানটের অনুষ্ঠান, বইমেলা।

তিনি তাঁর ইতিহাসচিহ্নত তর্জনী উঁচিয়ে বলবেন-
আমার চামড়া, হাড়, মাংস, মেদ, মজ্জা সমেত ফিরে এলাম কি
এলাম না, সেটা কোনও কথা নয়। আমি তোমাদের মধ্যে ছিলাম,
আছি, থাকব কৃষকের হাসিতে, শ্রমিকের পেশীর ঝলকে, মেঘনার
মাঝির গুণ টানায়, শঙ্খচিলের উড়ালে, পদ্মার ইলিশের
ঝলসানিতে, ছাত্রছাত্রীর উৎসবে, রাজনৈতিক কর্মীর অঙ্গীকারে,
কবির স্বপ্নকাননে পথ চলায়, প্রত্যূষের বৃষ্টিভেজা পথের দিকে চেয়ে থাকায়,
হঠাৎ ভাতশালিখ দেখে নেচে-ওঠা শিশুর জল্লাসে।
১২.৮.৯৭

তোমার না-আসাগুলো

তোমার না-আসাগুলো ক্রুশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণা
হ’য়ে ঝরে মনে নিশিদিন। এ-ও জানি
অনেকেই নানা যন্ত্রণায় ভোগে দিনরাত আর
নিজেদের ভাগ্যকে অভিসম্পাতে করে
জর্জরিত; কেউ কঠিন অসুখে
ভুগে ভুগে হতাশার নিশিডাকে অন্ধ বিলে ডোবে,
অনেকেই জঠর-জ্বালায় বকে প্রায়শ প্রলাপ,
কেউ কেউ ক্ষোভে
মাথা ঠোকে বধির দেয়ালে, কেউ কেউ
কী জানি কিসের ঘোরে করে বিষ পান, ঝোলে ফাঁসির দাড়িতে!

কাউকে কাউকে লালসার আগুনের লকলকে
জিভ প্ররোচিত করে কুমারীর স্নিগ্ধ মুখে ছুঁড়তে এসিড,
কারও কারও অন্তর্গত উলঙ্গ সন্ত্রাস
শান্তিপ্রিয় মানুষের ঘরে বোমা মারে,
লাগায় আগুন আর তোমার না-আসা
অবিরত পোড়ায় আমাকে

অথচ যখন কেউ আমাকে কখনও প্রশ্ন করে,
স্বদেশে আমার সবচেয়ে প্রিয় কী, তখনই
নির্দ্বিধায় করি উচ্চারণ অন্তরের সবটুকু ভাল-লাগা
মিশিয়ে তোমারই নাম। তোমার না-আসাগুলো এই
মুহূর্তে স্মরণে আনে তোমার হাসির
আভা যা নতুন চরে ভোরবেলাকার
নরম রোদের মতো ছড়ানো কখনও, কখনও-বা
জ্যোৎস্না-ধোঁয়া মেঘনার রূপালি মৃদু ঢেউ।

এই তো ক’দিন আগে তোমার ব্লাউজ নাকি ত্বক
বিলিয়েছে সুঘ্রাণ আমাকে,
তোমার স্তনের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমাকে মাতাল
করেছে, তোমার ঠোঁট প্রজাপতির স্পন্দন হয়ে
ছুঁয়েছে আমাকে আর আজ
সেই তুমি কীভাবে যে আছো আমার বিষণ্ন ঘাটে
নৌকা না ভিড়িয়ে, বলো? কতকাল আর তোমার না-আসাগুলো
এভাবে আমার দেহমনে ঠুকে যাবে কালো পেরেক কেবল?
৮.৪.৯৭

দরজায় কে যেন

পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে অসুস্থ
একটা কাকের ঝিমুনি,
কে যেন গলিপথে পুরনো দিনের সুর
গুনগুনিয়ে যাচ্ছে হেঁটে।
অদূরে বারান্দায় বোবা যুবতী
খোঁপায় সাজায় রক্তগোলাপ।
ওর চোখ, দু’টি হাত কেমন
বাঙ্ময় হয়ে ওঠে গোধূলি-রঙে;
আকাশ আর দিগন্তের নিজের কিছু কথা
শোনায় ঠোঁট না কাঁপিয়ে।

আমি এই পড়ন্ত বেলায় আমার
লেখার টেবিলে ঝুঁকে লিখছি; বিছানার
শাদা চাদরে প’ড়ে থাকে
সুর্মা রঙের এক পালক-আলেফ। বন্ধ
দরজায় কে যেন ধাক্কা দেয়,
চমকে উঠি জোর করাঘাতে।
লেখা থামিয়ে শব্দ শুনি একবার, দু’বার, তিনবার,
বেশ কয়েকবার।
শব্দটি কালো, গাঢ় কালো,
কখনও খুব কাছে আসে, কখনও
কোথাও দূরে বিলীন।
১৫.৬.৯৭.

নাক্ষত্রিক আড্ডা

কোনও কোনও মধ্যরাতে ইচ্ছা হয় তারাদের রূপালি আড্ডায়
গিয়ে বসি, গল্প করি নক্ষত্র-পুরুষ আর কতিপয় দীপ্ত
নক্ষত্র-নারীর সঙ্গে। যেহেতু সর্বদা স্বল্পবাক আমি, তাই
চুপচাপ গা এলিয়ে দিয়ে
শুনব তাদের কথা, শুনব নিবিড় হ’য়ে কোনও কোনও তারা-কুমারীর
অনুপম ঝর্ণা-হাসি। তখন আমার কাছে তুমি
যদি চলে আসো, ডাকো আমাকে নির্ভয়ে ইশারায়,
তক্ষুণি তোমার হাত ধ’রে
চলে যাব নক্ষত্রের সুদূর ডেরায়। কত মধ্যরাত, হায়,
তুমিহীনতায় কাটে, কখনও আসো না ব’লে আমি
কেবলি হারাতে থাকি নাক্ষত্রিক আড্ডার সুষমা।
২৭.১১.৯৭

নীলুফারের গান

যখন তুমি তোমার কণ্ঠে সুরকে
ছন্দিত চাঞ্চল্যের নর্তকীতে রূপান্তরিক করো,
যখন তোমার কণ্ঠে ঝর্ণাধারা বয়, যখন
তোমার কণ্ঠে কখনও শারদ নীলাকাশ, অজস্র
কাশফুলের শুভ্রতা, বসন্তের পুষ্পল মহিমা
প্রকাশিত, যখন তুমি সুরে সুরে
ফোটাও জ্যোৎস্নার কুসুম, সারা দিনের
খাটুনির শেষে ঘরে-ফেরা আমি ক্লান্তি ভুলে
ভাসি অতুল সুর-সাগরে। তোমার গানের
ঢেউ আমাকে বানিয়ে তোলে এক উৎসব।

তোমার গান আমাকে নিয়ে যায়
খোলা প্রান্তরে, ফসলের
ঢেউ-খেলানো মাঠে, ছায়াচ্ছন্ন
দীঘির ঘাটে, বাড়ির পাছদুয়ার দিয়ে আসা
গ্রামীণ তরুণীর হাসিঝলসিত
বাঁশঝাড়ের নিচে। সাঁঝ-নামা
বিষণ্ন কুয়োতলায় ঝুঁকে-পড়া
চাঁদকে তুমি গানে গানে বানাও তৃষ্ণার্ত পথিক।

তুমি যখন সুরের স্বপ্ন বুনে দাও চারদিকে,
তোমার জল ছল ছল সুরে পা ফেলে
রাধা তার শ্যামের সঙ্গে
মিলনের জন্যে যায় নীল যমুনায়।
তুমি যখন গান গাও সুন্দর অতিথি
এসো এসো ব’লে, তখন কে যেন
আসতে থাকে অনেক দূর থেকে অথবা
যখন যাক না নিশি গানে গানে গুঞ্জরিত হয়
তোমার কণ্ঠস্বরে, তখন
নিশীথ অধিকতর নিশীথ হ’য়ে ওঠে।
তোমার গান নববধূর প্রাণে নাইওরের
ইচ্ছাকে প্রবল পুষ্পিত ক’রে তোলে।
১২.৮.৯৭

পাগলা বাবুলের গান

গেরুয়া বসনধারী পাগলা বাবুল
যখন বাউল গান গায় গভীর তন্ময়তায়
একতারা বাজিয়ে, আঙুলে
ফুটিয়ে সুরের বনফুল
নেচে-নেচে, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে

পাগড়ি-বাঁধা মাথা
ছেঁউড়িয়া, ফরিদপুরের গঞ্জ-গ্রামে,
শহর ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি
আর রমনার বটমূলে
আবার লালন সাঁই আসরে নামের পুরোদমে।

পাগলা বাবুল গলা ছেড়ে গান গাইলেই আমার অন্তরে
দীঘির বৈকালী ঘাটে গ্রাম্য বধূটির
কলস ভাসানো,
নতুন শস্যের ঘ্রাণ, ক্ষেতের আইল,
পথের রঙিন ধুলো, নিঃসঙ্গ লোকের পথ হাঁটা,
ডুরে শাড়ি-পরা কিশোরীর কাঁচা আম খাওয়া,
ভাসমান নৌকা আর ঘুঘুর উদাস
ডাক জেগে ওঠে। মনে হয়,
নিঝুম মহীন শাহ ভরা নদীর ধরনে মাথা নাড়ছেন।
এবং পাগলা বাবুলের একতারা
যখন সুনীল আকাশকে ছুঁতে চায়,
ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মাথা আর নেচে-নেচে
যখন সে অগণন মানুষের মাঝে মানুষের গান গায়
আমি শুদ্ধ আলোর ভিতরে যাত্রা করি।
৯.৯.৯৭

পুতুল

এক মুঠো মাটি নিয়ে, একটু পানি মিশিয়ে
ছোট্র একটা পুতুল গড়তে সারা দিন সারা রাত
ছটফটিয়ে কাবার ক’রে দিলাম, অথচ
কিছুতেই পুতুলের মুখের কোনও ছাঁদ-ছিরি ফোটেনি।
অসম্পূর্ণ পুতুলটিকে নানা কোণ থেকে দেখার
চেষ্টায় কেটে গেল ঝাড়া কয়েক ঘন্টা; তৃপ্তি
হয় না। ভাঙার তুমুল নেশা পেয়ে বসে আমাকে;
হঠাৎ টুকরোগুলো আমার নিষ্ঠ আঙুল আর
নরুনের যুগলবন্দীতে আবার
পুতুল একটা আদল পেয়ে যায় আখেরে
সবার অলক্ষ্যে। আমি সারিন্দা হই, হই আতশবাজি।
বসন্ত-হাওয়া, গাছের পাতা, চার দেয়াল করে নান্দনিকতার নান্দীপাঠ।

গভীর রাতে, যখন চাঁদের হাত নদীকে নাচায়,
সেই পুতুল আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে
ফিসফিসিয়ে, শোনাতে চায় প্রাচীন এক
দ্রাবিড় কন্যার কাহিনী, যে পুতুলের
মতো সুন্দর হ’তে চেয়েছিল অমাবস্যা রাতে
বিরূপ প্রেমিকের শুভ দৃষ্টিতে স্নাত হাওয়ার জন্যে।
১২.৫.৯৭

বস্তুত এ নির্বাসন

ক্রুদ্ধ রাজহংসীর ধরনে গতকাল গোধূলিতে
আমাকে কঠোর স্বরে বলেছিলে ‘তোমার কবিতা
শুনব না, পড়ব না কোনওদিন আর। শব্দগুলো
অগ্নিকণা, পুড়ছিল কান মন। কী ছিল আমার অপরাধ?
আমার কবিতা কেন জাগাল এমন
বিতৃষ্ণা তোমার মনে? আমার নিরীহ শব্দাবলি
অঞ্জলি উজাড় করে তোমাকেই বিস্তর করেছে
নিবেদন পুষ্পদল, ছড়িয়েছে সৌরভ তোমার দেহমনে।

তুমি ক্রুদ্ধ রাজহংসী হ’লে,
চঞ্চুর আঘাতে ভালবাসা আমার লুটিয়ে পড়ে
ধুলোয় রক্তাক্ত, অসহায়। একদিন প্রমাদের
মরীচিকা অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল
আমার একটি পদ্য এবং তোমার
মধ্যে, ফলে অভিমানে, ক্ষোভে
আমার সকল কবিতাকে তুমি সরিয়ে রেখেছ
দৃষ্টি আর শ্রুতি থেকে দূরে, বহুদূরে।

বস্তুত এ নির্বাসন আমাকেই দিয়েছ সায়াহ্নে,
মেনে নিতে বড়ো কষ্ট হয়, যদি তোমার সিদ্ধান্তে
সর্বদা অনড় থাকো, তাহলে আমিও
আমার কলমটিকে পাঠাব গহন বনবাসে।
১২.৪.৯৭

বহু প্রতীক্ষার পর

আজ নয়, অন্য কোনওদিন এসো, আজ
ভিন্নতর কাজ আছে; একজন জাঁদরেল সমালোচকের
সঙ্গে কিছু জরুরি আলাপ আছে। হয়ত এক্ষুনি
এসে পড়বেন তিনি; কখনও নিকট
আগামীতে অবসর মুহূর্তে তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কথার
জাল বোনা যাবে-
এইটুকু ব’লে তাকে তাড়াতাড়ি প্রায়
দরজা থেকেই কেঠো হাসি হেসে দিলাম বিদায়। নীরবে সে
চলে গেল হেঁটে আর সুস্নিগ্ধ হাওয়ায়
ঝুলে থাকে ওর পায়েলের অনুরণন কেবল।

অত্যন্ত দুঃখিত, আজও তোমাকে সময়
দিতে পারছি না কিছুতেই; দেরিদা বিষয়ে সদ্য কেনা বই
এখন আমাকে তীক্ষ্ণ কামড়ে ধরেছে। কথা দিচ্ছি,
কাল শুধু তোমাকেই করব অর্পণ সবটুকু
সময় আমার, ক্ষমা করো আজ। মুখ ভার ক’রে
আস্তে হল্‌কা-ছড়ানো দুপুরে পথে নেমে যায় সে বাতাসে আঁচল উড়িয়ে।

কী ক’রে দেখাই মুখ আজকে তোমাকে? কবিসভা
এই তো এখনই টেনে নিয়ে যাবে আমাকে নিগূঢ়
ইশারায় বকুলতলায়। আজ সত্যি, সত্যি, সত্যি
বলি, তুমি এসো দয়াময়ী শীঘ্র শারদ পূর্ণিমা-রাতে। আমি
থাকব তোমার পথ চেয়ে সুনিশ্চয়। কথা শুনে
সে, প্রেমের কবিতা, ব্যথিত দু’টি চোখে দূর দিগন্তে বিলীন।

অনন্তর দিন যায়, রাত যায়, ব্যাকুল প্রতীক্ষা
আমার হৃদয় কুরে কুরে খায়, ক্রমান্বয়ে বাড়ে
অস্থিরতা; অথচ আমার ঘরে ঝলসে ওঠে না
শাড়ি তার। অভিমান তাকে বহুদূরে
সরিয়ে রেখেছি; ভাবি, সে, প্রেমের কবিতা, কখনও
ভুলেও আমার কাছে আসবে না আর। এখন তো
হৃদয়ে আমার ফণিমনসার উঁকিঝুঁকি আর গিরগিটিদের
আসা-যাওয়া। অকস্মাৎ এক বর্ষাঘন নিশীথের
তৃতীয় প্রহরে তার পায়েল উচ্ছল বেজে ওঠে
আমার নিভৃত ঘরে, উদ্দীপ্ত প্রেমের কবিতাকে
বসাই নিবিড় মুখোমুখি, আলিঙ্গনে
বাঁধি আর প্রগাঢ় চুম্বন আঁকি ভেজা ঠোঁটে, সফল সঙ্গমসুখ পাই।
২৯.৫.৯৭.

বহুজন

বন্ধু রশীদ করীমের একটি কক্তি মনে রেখে

ওহে মেঘে মেঘে বেলা কম তো হ’ল না
শামসুর রাহমান, অথচ এখনও
তোমার প্রকৃত পরিচয়
এ ভবের হাটে বাটে পেয়েছে কি কেউ?

তোমার নিজের ধারণার সূত্র ধ’রে জানা যায়-
কোনও কোনওদিন ভোরবেলা হঠাৎ ভাঙলে ঘুম
নিজেকে আদিম কোনও মানুষের মতো
লাগে, বেলা গড়িয়ে পড়লে
খানিক, ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজলেই বসন্ত বাহার
হ’য়ে যাও মনোমুগ্ধকর প্রত্যাশায়। তুচ্ছতার
প্ররোচনা কখনও মেজাজে আগুনের কিছু স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়,
কখনও সখনও গৃহিণীর সঙ্গে বাধে খিটিমিটি।

অপরাহ্নে যখন তোমার পৌত্রী ডাকে
মমতাকোমল ছোট্র হাত নেড়ে দেখাতে ছবির বই তার,
দুলে দুলে ছড়া কাটে, মেঘাচ্ছন্ন হৃদয়ে তোমার
লহমায় রঙধনু হেসে ওঠে উচ্ছল নৈঃশব্দ্যে।
সায়াহ্নে হঠাৎ কী-যে হয়, একটি খরখরে ছায়া
তোমাকে দখল করে। অনেকের মধ্যে প্রাণবন্ত কলরবে
মেতেও তোমার ভেতরের বড়ই নিঃসঙ্গ মানুষটি
সবার নিকট থেকে দূরে বহুদূরে রয়ে যায়।
যখন আসে না ঘুম কোনও কোনও রাতে
অকারণে কিংবা সদ্য কোনও কবিতা লেখার পর
তৃপ্তি অতৃপ্তির দ্বিধাদ্বন্দ্বে দোল খেয়ে কিছুক্ষণ
আন্ধার অথবা তারাময় আসমানে
তাকাও তৃষিত চোখে, কখনও আনন্দে আন্দোলিত
বর্ণিল উৎসব হও, কখনও অজ্ঞাত ভীতি চকিতে তোমার
কণ্ঠনালী চেপে ধরে, নীরবে দু’চোখে থেকে কখনও-বা শুধু
ছল ছল জল ঝরে এবং আগামীকাল ভোরে
কোন খেলা হবে শুরু মনে, তুমি নিজেই জান না;
বস্তুত একজনের ভেতরেই বহুজন করে বসবাস।
৯.৪.৯৭

ব্যর্থতায় খেদোক্তি

রোজ নয়, মাঝে মাঝে অতিদূর লোকশ্রুত এক
ভাস্করের উপকথা ভেসে ওঠে স্বপ্নের ধরনে।

আমি তো ভাস্কর নই, টেরাকোটা অথবা পাথর
কুঁদে কোনওদিন
করি নি নির্মাণ কোনও অনিন্দ্য প্রতিমা। এই আমি
শব্দের সামান্য অন্বেষক, ক্লান্তিহীন; মেঘ ফুঁড়ে-
বেরুনো আলোর ছটা, শ্রাবণের মেঘভার, ঘাসের শিশির,
রাধাচূড়া, সন্ধ্যার পাখির উড়ে-যাওয়া,
চেনা গলিটার ধুলো, পাশের বাড়ির
দুপুরের ঝিমধরা ছাদের কার্নিশ, পায়রার মৃদু প্রেম,
পথিকের খুব একা পথ চলা, রুদ্র মিছিলের
তুমুল আওয়াজ আর দয়িতার হাসির সোনালি
ঝর্ণাধারা, নিবিড় চুম্বন থেকে শব্দ ব্যাকুল কুড়িয়ে
প্রতিমা নির্মাণ করি নিজেকে পুড়িয়ে বারবার।

যখন জ্বরের ঘোরে ঝাপ্‌সা প্রলাপ বকি, তখনও শব্দের
ভ্রমরেরা বিছানার চারদিকে গুনগুন গান জুড়ে দেয়; মগজের
কোষে কোষে চোখে মেলে কত যে সুরের সুরধুনী।
শব্দের প্রতিমা গ’ড়ে কাটিয়ে দিয়েছি
পঞ্চাশ বছর, তবু সেই ভাস্করের মতো
একান্ত নিজেরই সৃষ্ট প্রতিমার প্রেমে
অন্তহীন ম’জে স্বেচ্ছা-অনাহার আর অনিদ্রায়
করি নি জীবন বিসর্জন।
২৪.৫.৯৭.

ভিক্ষা

একজন ভিখিরী একটি টাকা অথবা আধুলি ভিক্ষা চায়
আজকাল, একজন রাজনীতিবিদ
ভোট ভিক্ষা করে গণমানুষের কাছে, একজন
আইবুড়ো মেয়ে নিত্য বর প্রার্থনায়
কাটায় সকালসন্ধ্যা নিভৃতে শহুরে বারান্দায়,
একজন বৃদ্ধ আরও পরমায়ু চান
আকাশের দিকে জরাগ্রস্ত হাত মেলে দিয়ে রোজ।
একজন খুনী নরহত্যা
করার পরেও দিব্যি ফাঁসির দড়িকে ফাঁকি দিতে
ফাঁক-ফোকরের খোঁজ পেতে চায় আর
একজন জীর্ণ কবি কয়েকটি ছত্র লিখে কালকে পরাস্ত
করতে শুধু নিজের বোধির কাছে নতজানু হয়।
৮.৯.৯৭

ভূতলবাসীর কথা

সে ভূতলবাসী একজন, ছন্নছাড়া,
বিবিক্ত, বিষণ্ন, সূর্যালোকে সহজে যায় না দেখা
তাকে, নিত্যসঙ্গী তার ইঁদুর, বাদুড়। বাক্যালাপ
নেই কারও সঙ্গে, মাঝে-মাঝে কেবল নিজের সঙ্গে
কথা বলে একা একা মৃদুস্বরে। অন্যেরা সে-কথা
শুনলেও সহজে যাবে না বোঝা
ভূতলবাসীর সন্ধ্যাভাষা। নেই কারও
সাতে পাঁচে, ব’সে থাকে এক কোণে লোকটা একাকী।

এরকমও হয়, কালেভদ্রে নিজের আস্তানা ছেড়ে
সে বেরিয়ে আসে জ্যোৎস্নাভেজা মধ্যরাতে,
হেঁটে হেঁটে জনশূন্য মাঠে গিয়ে শোয় অকাতরে,
নভোমগুলের রূপ দেখে।
চোখে তার অশ্রুকণা চিক চিক করে। অকস্মাৎ
কোত্থেকে তিনটি পক্ষীরাজ ঘোড়া এসে
মাঠে জুড়ে দেয় নাচ। কেবল একটি পক্ষীরাজ
ভূতলবাসীর ম্লান শার্টের কলার
মুখে চেপে দোলা দেয় বারবার গাঢ় মমতায়,
একটি বেহালা নাচে শূন্যে তালে তালে।

সর্বদা সে নিশ্চেষ্ট, উদ্যমহীন, আকাঙ্ক্ষার ডালে
ছেঁটে ছেঁটে নিশ্চিহ্ন করেছে
সবার অলক্ষ্যে তবু তার কাছে আসে
অলৌকিক পাখি, মৎস্যকনা, রত্নদ্বীপ, পক্ষীরাজ,
শূন্যের উদ্যান; সে-তো তিমিরবিলাসী, তবু নিঃসঙ্গ আড়ালে
নতুন আলোর আরাধনা করে সকল সময়।
৮.১০.৯৭

 ভোরবেলা এবং একজন মৃতা

ভোরবেলা চেয়ারে রয়েছি ব’সে বড় একা, মৃদু
ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যায় বয়েসী শরীর। কাল রাত
কেটেছে আমার ক্ষ্যাপা জাগরণে।
কবিতা লিখব ব’লে কখনও টেবিলে
থেকেছি নিঝুম ঝুঁকে, কখনও করেছি পায়চারি
ঘরে আর বারান্দায়, অকস্মাৎ একটি লাইন
মগজে ঝিকিয়ে উঠে কেমন বেগানা হ’য়ে আঁধারে হারায়।
বস্তুত ক’দিন ধরে এই মতো হচ্ছে, খাতা কবরস্তানের
নিশুত রাতের শূন্যতায় মাখা আর
আমার ওপর ঝড়ঝাপ্টা যাচ্ছে ব’য়ে।
ভোরবেলা যখন তোমার কথা ভাবি, সব কিছু কি রকম
ওলট পালট হয়ে যায়, কবিতা লিখতে না পারার হা-হুতাশ
নিমেষে গায়েব হয়। অথচ তোমার সঙ্গে কখনও আমার
কোথাও হয়নি দেখা, শুধু
এইটুকু জানি, হে তরুণী, একজন
কর্মিষ্ঠ সৈনিক ভেঙে-পড়া দালানের হা-হা ধ্বংসস্তূপ থেকে
সযত্নে তুলেছে টেনে ফেলে-যাওয়া প্রাণহীন শরীর তোমার।
তুকি কি কলেজ ছাত্রী? তুমি কি আগের দিন গোধূলিবেলায়
আকাশের দিকে
তাকিয়ে ভেবেছ প্রেমিকের কথা নাকি
পরীক্ষার ফল নিয়ে ছিল দুর্ভাবনা? এমন ক্ষুর্ধাত ছিল
সুঠাম দালান, তুমি পেয়েছিলে টের কোনওদিন?
২৩.১১.৯৭

 মানুষের এই মেলায়

এমন তো হয়, কোনও কোনও সময়
নিজেকে দেখি এক টানেলে নিঃসঙ্গ হেঁটে চলেছি
ক্রমাগত। অন্ধকার আমার সারা শরীরে
দাঁত বসাচ্ছে ডালকুত্তার মতো। চিৎকার করতে চাইছি
মেঘফাটানো স্বরে, অথচ কে যেন গলা চেপে
ধরেছে। আমার নিজের পায়ের জুতোর সন্ত্রস্ত আওয়াজ ছাড়া
অন্য কোনও শব্দ পশে না কানে। আমার
সামনে অথবা পেছনে কেউ নেই; আমি
বাস্তবিক এগোচ্ছি নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি,
বোঝা দায়। এভাবে কি পৌঁছে যাব কোনও বধ্যভূমিতে?

গোধূলিবেলায় নিজেকে কেমন বেকুব
দাঁড়ানো পাই ফায়ারিং স্কোয়াডে; অনেকগুলো রাইফেল
তাককরা আমার দিকে; ভাবলেশহীন আমি
দেখি অদূরে অনেক পিঁপড়ে এগিয়ে যাচ্ছে
একটি মৃত পাখির অনাড়ম্বর সৎকারের উদ্দেশে।
চকিতে বন্দুকের ঝাঁক
রজনীগন্ধার ঝাড় হ’য়ে দুলতে থাকে
চোখের সামনে এবং আমাকে সাদর বরণ ক’রে নেয়
কাঠবিড়ালি, ময়ূর, মাছরাঙা, বৃক্ষশ্রেণী,
পলাশ, নীলপদ্ম, ঘুঘু, ডাহুক আর বুলবুল।

এখন আমি অনেক শিশু, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ় আর
প্রাণবন্ত বৃদ্ধের সংসর্গে আছি। বিস্মিত দেখি
আমাদের ঘিরে নাচছে অনেক নক্ষত্র; মানুষের
এই মেলার কখনও আমি নক্ষত্র, কখনও
সরোদ-বাজতে থাকি উত্তর দক্ষিণে এবং
পূর্ব-পশ্চমে। কে আমাকে আটকে রাখতে পারবে?
৬.৭.৯৭

মার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে

কী ক’রে যে তোমাকে শুইয়ে দিতে পেরেছি এখানে
শীতল মাটির নিচে? মা, তুমি নিথর নিদ্রা মুড়ি
দিয়ে আছো; ফাল্গুনের রোদ
বিছানো কাফন-ঢাকা শরীরে, তোমার
উন্মোচিত মুখ স্পর্শ করি শেষবারের মতন।
বজ্রের আওয়াজ কর্জ ক’রে
যদি ডাকি বারবার, তবু তোমার এই ঘুম
ভাঙবে না কোনওদিন, কোনওদিন আর।

নির্বিকার গোরখোদকের কোদালের
মাটি-খোবলানো ঘায়ে দ্বিপ্রহরে আমার পাঁজর
বোবা আর্তনাদ করে। নিঃসীম অনন্তে
তোমার নিঃসঙ্গ যাত্রা করেছি ধারণ অনুভবে
প্রত্যেকের অগোচরে। হঠাৎ কবরস্তানে ব্যাকুল কোকিল
ডেকে ওঠে রৌদ্র চিরে, নিঝুম দুপুর
আরও বেশি স্তব্ধতায় সমাহিত। মার কবরের
পাশে ব’সে এবং দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ
মার আদরের মতো প্রশান্তির স্নেহ পাই; মাটি
ক্রন্দনের প্রতি উদাসীন বুকে টেনে নেয় তাঁকে।

মানুষের কী স্বভাব! এখানেও কতিপয় লোক কিয়দ্দূরে
তুমুল বচসা করে না জানি কী নিয়ে!
টাকাটাড়ি? দলাদলি? কবর-বাঁধানো বিষয়ক
জটিলতা? মাঝে মাঝে নিভৃত কোকিল ডেকে ওঠে।

বলতে বুক পোড়োবাড়ি হ’য়ে যাচ্ছে, তবু
বলছি মা, তোমার আমার দেখা হবে না কোথাও
কোনওকালে; আমিও তোমারই মতো অস্তিত্ববিহীন
হয়ে যাব কোনওদিন, শুধু
মাঝে মাঝে ধুধু স্মৃতিকণারূপে ছুঁয়ে
যাব কি যাব না কারও কারও ভুলো মন!
মা তোমার শিয়রে গোলাপ রেখে হৃদয়ে সায়াহ্ন
নিয়ে পথ হাঁটি, প্রাণে ঝরে মরা পাতা,
মৃদু হাওয়া বন্দিনীর শীতল ফোঁপানি,
চোখ বড় বেশি জ্বালা করে।
৭.৩.৯৭

যিনি শয্যাগত

জানালায় প্রত্যুষের হাত; একটি অচিন পাখি লেজ নেড়ে
আসে আর যায়। সারা ঘরে দীর্ঘস্থায়ী
ব্যাধির প্রবীণ গন্ধ; যিনি শয্যাগত,
তার শালে কয়েকটি মাছি আফিমখোরের মতো
ধূসর ঝিমোয়। বিছানার
পাশে কছু কবিতা, দর্শন আর সমাজতত্ত্বের বইপত্র।

নড়ে চড়ে উঠে চোখ খুলে তাকাতেই
যেন ক্রমে রুয়োর বিষণ্ন রাজা স্পষ্ট হয় সংকীর্ণ শয্যায়;
বলেন না কিছুই, কেবল
আলগোছে তাকিয়ে দেখেন চারদিকে, একপাশে
প’ড়ে থাকা বিশীর্ণ অলস তার হাত বুঝি কোনও
বিরল সম্মানে ঝলসিত হ’তে প্রতীক্ষা-কাতর!

প্রতিভার মতো রোদ ঘরে আসে, শয্যাগত যিনি
তার কণ্ঠনালী পান করে রোদ, যেন কিছু সতেজ বীয়ার।
প্রতিভা এবং ব্যাধি কণ্ঠলগ্ন হয়ে পরস্পর
করে বসবাস,
এ-কথা কতটা সত্য জানা নেই, তবু তিনি ব্যাধির শেকলে
বন্দী বহুকাল, ব্যাধিক্ষেত্রে ধুঁকে ধুঁকে
নিজেকে দর্পণ ক’রে আলোয়, তিমিরে
কত যে কুসুম তিনি ফোটালেন মোহন মেধায়।

মাঝে মাঝে তিনি ঘুমঘোরে
দেখেন বিজন মাঠে এক পাল পাগলা কুকুর
তাকে লকলকে জিভ বের ক’রে তাড়িয়ে বেড়ায়,
কখনও আবার কতিপয়
ক্ষুধার্ত মানুষ,
শতচ্ছিন্ন কোর্তা-পরা, ছিঁড়ে খাচ্ছে তাকে জয়োল্লাসে।

নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবেন-
এই তো এখনই কাদা খ’সে খ’সে পড়বে, হাতের
বদলে কাদার টুকরোগুলো ইতস্তত
খাকবে ছিটানো, আঙুলের স্থানে কিছু
পাটখড়ি দেখা যাবে হয়তো বা, তবে কি কেবল
কবিতাই পরিত্রাণ, এই প্রশ্নে নিবিড় জড়িয়ে গিয়ে তিনি
জানালার বাইরে রোদ্দুরে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে নেন।
২৭.৯.৯৭

যেমন সালিম আলি

শুরুতে অন্ধকারে উঁকিঝুঁকি,
পরে অস্থির ডানা-ঝাপটা,
শেষে কাগজে এসে ব’সে পড়া;
কখনও একটু আধুট
নড়াচড়া,ঈষৎ ওলোট পালট। নিজের লেখা
পঙ্‌ক্তিমালার দিকে ব্যাকুল
তাকিয়ে থাকি, যেমন সালিম আলি
গভীর নিরীক্ষণ করতেন পাখিদের

আমি চাই না আমার কবিতা
শুধু আটকে থাকুক বইয়ের
পাতায়, আমার প্রবল সাধ,-
রচিত পঙ্‌ক্তিমালা
উড়াল দিক দূর দিগন্তে,
স্পর্শ করুক মেঘমালা; গাছপালা এবং
পাখপাখালির সঙ্গে কথা বলুক, কোকিল
হ’য়ে ডাকুক মানুষের অন্তরে প্রহরে প্রহরে।

আমি চাই আমার কবিতা প্রজাপতি রূপে
চুম্বন করুক প্রিয়তমাকে,
নিঃসঙ্গ মানুষের মন থেকে
সরিয়ে দিক
বেদনার গহন ছায়া,
ক্ষুধার্তদের সানকিতে ঝরুক
রকমারি খাবার হ’য়ে
হারিয়ে-যাওয়া শিশুকে ঠিক
পথ দেখিয়ে নিয়ে যাক মায়ের আলিঙ্গনে।
আমি চাই কবিতা মিছিলের যুবার
সাহসের দীপ্তি হ’য়ে ছড়িয়ে যাক সবখানে,
শহীদের মাথার পেছনে আমার কবিতা হোক জ্যোতির্বলয়।

এ-ও তো হয়, হঠাৎ কোনওদিন পথের পাশে
আহত পাখির ছিন্নভিন্ন পালকগুচ্ছ দেখে আমার
কবতার খাতার কাটাকুটিময় কয়েকটি
মৃত পঙ্‌ক্তির কথা মনে প’ড়ে যায়। নিশ্চয়ই
কোনও জখমি কিংবা মুমূর্ষু পাখি দেখে
সালিম আলি শিউরে উঠতেন।
৩০.৫.৯৭.

শাদা শূন্য পাতা

সেই কখন থেকে আমার লেখার টেবিলে
লম্বা চওড়া একটা শাদা কাগজ অনিকেত, রুক্ষ
সন্ন্যাসীর মতো অলস শুয়ে আছে খাঁ খাঁ অক্ষরহীন;
আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে যেন। সকাল ও দুপুরকে
এক কাঠঠোকরা ঠোকরাতে ঠোকরাতে
ঠেলে দেয় প্রগাঢ় গোধূলিতে। এমন হ’তে থাকলে
তোমার কাছে প্রার্থনা করি কবিতা। যখন আমি তোমাকে
বলি, ‘কবিতা দাও’, তুমি বিস্ময়ে খানিক বাক্যহারা
তাকাও আমার দিকে, ভাবো ঠাট্রা মশ্‌করা
করছি। আমার কাতরতা উপেক্ষার ধূসরতায় গড়ায়।
‘এই আমি কী ক’রে কবিতা দেবো তোমাকে’, তুমি প্রশ্ন করো।
গাছের পাতা থেকে পিছলে-পড়া রোদ, যাযাবর মেঘ, বৃষ্টিভেজা
গলিপথ, দেয়ালে ব’সে লেজ-দোলানো
মসৃণ পাখি আমাকে কবিতা দেয় কখনও কখনও, তাহ’লে
তুমি কেন তোমার অমন ঐশ্বর্যকে পাঠাবে না এই অপেক্ষমাণ
বন্ধ্যা পাতায়? আমার ব্যাকুলআত কি তৃষিত
পাখির মতো চঞ্চু গুঁজে প’ড়ে থাকবে কাঁকড়াময় নিঃসাড় বালিতে?
আমার শূন্য শাদা পাতা মেলে ধরেছি তোমার সামনে, সাড়া দাও।

আমার ব্যাকুলতা তোমাকে স্পর্শ ক’রে অনন্তের
কিছু বদ্বুদ তুলে নিতে চায় করতলে;
আমার ব্যাকুলতা তোমার ঠোঁটের কাছে এগিয়ে যায়
চুম্বনকে অমরতায় অনূদিত করার আশায়। আমার
এই-আমিকে উন্মোচিত করেছি
তোমার ঘনিষ্ঠ উষ্ণতায়। এমন উন্মোচনকে তুমি কি
শাদা পাতায় গৌরবহীন মূকে ভিখারী ক’রে রাখবে সকল সময়?
৬.৭.৯৭

শিকার

একটি সোমত্ত নৌকা, দক্ষ মাঝি দু’জন আরোহী, থরথর
পানির উপরিভাগে ঢেউয়ের আঘাতে
ক্ষণে ক্ষণে। বন্দুকের নলে
মৃত্যু চোখ পিটপিট করে চরমুখী
এক ঝাঁক পাখি দেখে। অকস্মাৎ গুলির ধমকে
স্তব্ধাতার বুক কাঁপে, চরে রক্তলেখা
সাপের ধরনে এঁকে বেঁকে যায়, বাঁকানো টুপির
পাশে জাগে পালকের মসৃণ উল্লাস।

রক্তাপ্লুত পাখিগুলি যাবে শহরের
কিচেনে সুখাদ্য হ’তে। যে মহিলা আমাকে নন্দনতত্ত্ব খুব
সহজে শিখিয়েছেন চোখে
কখনও নিবিড় বনজ্যোৎস্না ডেকে এনে
কখনও বা কী সুদূর বৈজয়ন্তী রূপটান এনে,
তিনি অবলীলাক্রমে রন্ধনশিল্পের
সেরা নিদর্শন
সযত্নে পরিবেশন করবেন টেবিলে, তখন
প্লেটে হত পাখিদের প্রণয়ের ভাষা
আর্তনাদ হ’য়ে উঠবে কি লহমায়?
৭.১০.৯৭

সর্বত্র সে আগন্তুক

বুঝি না কেন যে কোনও কোনওদিন মনে হয়, যেন
বহুকাল পর ফিরে এসেছি নিজেরই
নিবাসে বেগানা আগন্তুক একজন। এটাই কি
ঠিক বাড়ি? ভুল করিনি তো? দ্বিধান্বিত
বাজাই কলিংবেল; মনে হ’ল কাজের লোকটি
গেট খুলবে কি খুলবে না, ইতস্তত করছিল।

আখেরে আমার পরিচিত কেউ ভেবে
প্রবেশাধিকার দেয় আমাকে নীরবে। যারা ছিল
আমার আপনজন, তারা এল চোখে মুখে নিয়ে
সংশয়ের ছায়া, ওরা কেউ
বস্তুত চেনে না এই অতিথিকে, যদিও আমার
কোণের পড়ার ঘরে ঢোকার আবছা
অনুমতি দেয় ইশারায়। এই যে চেয়ার, এই
লেখার টেবিল, বই, খাতা
আমারই তো? না কি অন্য কারও? বুক শেলফ
থেকে বই টেনে নিয়ে খুলে দেখি আমার নিজেরই
স্বাক্ষর বাদামি পাতাটির এক কোণে উপস্থিত
তারিখ সমেত আর বিষণ্ন দেয়াল যেন অশ্রুপাত করে।

এ বাড়ির সবার কাছেই
কেমন অচেনা আমি এবং আমিও
স্মৃতি বিস্মৃতির গোধূলিতে ব্যথিত দাঁড়িয়ে একা
অচেনার ভিড়ে আর দেয়ালে ঝোলানো
ফটোগ্রাফে ঐ যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে মধুর
হাসছেন, তিনিও আমাকে
অপরিচয়ের রুক্ষ বলয়ে রাখার অকম্পিত
শপথ আউড়ে চলেছেন নিত্যদিন!

এখন আপন ঘরে বই হাতে বেগানার মতো
বসে আছি, তবু মনে হয়-
ধ্বনিহীন অগণিত ভায়োলিন-বিছানো পথের
মাঝখানে থেমে দূর দিগন্তের দিকে
বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি; হঠাৎ শ্যাওলা-ঢাকা এক
পথচারী আমার নিকটে এসে জেনে নিতে চায়
জটিল ঠিকানা, নিরুত্তর
আমি শ্যাওলার ঘ্রাণে কেমন সবুজ হতে থাকি।
আমার নিজেরই কোনও ঠিক
ঠিকানা নেই যে জানা কী ক’রে বোঝাই লোকটিকে?

মুখের ভেতর নিশান্তের হাওয়া খেলা করে আর
গিলে ফেলি নক্ষত্রের কণা; বিবমিষা জাগে, বমি করি কিছু
রঙধনু-রেণু, আর বিস্তর বমিতে ভাসি, কারা
হেসে ওঠে দিকগুলি বিপুল ফাটিয়ে। আমি এই শহরের
কোথাও কাউকে আদৌ চিনি না এবং
আমাকেও হাটে বাটে ঘরে বাইরে চেনে না কেউ।
১৮.৪.৯৭

সে

একটি তরুণী দেখি গলিটির দুপুরে অগাধ রোদ্দুরের নিস্তব্ধ ভিতর দিয়ে
একা হেঁটে চলেছে, কোথায় যাবে, জানলার শার্সি ধ’রে
ভাবি; অচেনা সে
আমার তবুও কেন জানি অজানা শ্যামলী সেই
তরুণীর জন্যে প্রাণে মমতার সোঁদা ছায়া নামে। ভাবি, সে কি
এভাবেই হেঁটে হেঁটে কোনওদিন পিচ্ছিল আন্ধারে
করবে প্রবেশ, না কি অগাধ পূর্ণিমা
করবে বর্ষণ তাকে গাঢ় অনুরাগের পরাগ
ছিটিয়ে সত্তায়? আপাতত
সে থাক আমার এই কিছু হরফের সেবাশ্রমে।
৮.৯.৯৭

 সে এক বাঁশিঅলা

এই যে এখন গভীর রাতে প’ড়ে আছি
বেঘুম খাটে বড়ই একা, কিসের জন্যে? চতুর্দিকে
দেখছি কেন কাদামাখা অনেক হাড়ের নাচানাচি?
কেন আমার চোখের ভেতর এলোমেলো কাঁটা গজায়
এই প্রহরে? দেয়াল জুড়ে কত কী-যে উঠছে ফুটে-
কিছু চিনি, কিছু আমার অচেনা খুব। ছায়াবাজি চলছে যেন
বন্ধ ঘরে মধ্যরাতে। বুকের মধ্যে কালো জালে
আটকে-পড়া ব্যথিত এক পাখি কাঁদে নিঝুম সুরে।

এই তো দেখি আমার দিকে হাত বাড়াল নিরিবিলি
কে যেন খুব স্নেহভরে; কিন্তু এ কী হাতের কোমল
মুদ্রা উধাও সাইকেডেলিক গোধূলিতে। আমার কথা
করুণ স্বরে ইতস্তত ঘোরে ফেরে; হাতের চেটোয় নেচে ওঠে
আশরফিরা, হারায় আবার ধূলিঝড়ে, জানালাটায়
বাদুড় এসে ঝুলে থাকে, ক্যাকটাসে হায় আগাগোড়া
ঘর ছেয়ে যায়। উড়োপুড়ো মনে আমার এক্কেবারে
কয়লা খনির আঁধার-ছেঁড়া হীরে জ্বলে যখন তখন।

এই তো আমি বয়েসী এক কেমন মানুষ মনে প্রাণে
সমর্পিত পদ্য লেখায়, মনপাতালে
পুরোপুরি ছন্নছাড়া, স্বপ্ন কত গড়ি ভাঙি, আবার গড়ি।
পাহাড়ে কেটে নয়া নহর সৃষ্টি করি, খোলামেলা
সাঁতার কাটি গহীন গাঙে, পাতাল থেকে তুলে আনি
মুঠোয় ভ’রে রত্ন কিছু। সমুদ্দুরের জল ছিটানো
রূপসীদের সঙ্গে কত ফিস্‌ফিসিয়ে কথা বলি,
প্রায়শ এই ছোট ঘরে জ্বরের ঘোরে হিজিবিজি কীসব বকি।

লোকে বলে, আমার মাথায় বিপজ্জনক ভাবনাগুলো
বসত করে মৌমাছিদের মতই আজো। কুয়োবাসী সবার কাছে
আমি বটে চোখের বালি, ওরা কেবল কুৎসা রটায়
আমার নামে হাটে মাঠে। যে বাঁশিতে ফুঁ দিলে রোজ তরুণেরা
ঢেউয়ের মতো ছুটে আসে আমার দিকে, সে বাঁশিটা
শক্র ওদের ব’লেই সেটা বিনাশ করার ঘন কালো যজ্ঞে মাতে।
আমার বাঁশি ঘাসে ঘাসে রোদের ঝিলিক, মেঘনা নদীর
ঝোড়ো বুকে ঢেউয়ের গান, আমার বাঁশি আকাশ জোড়া রঙের সাঁকো।
২.৫.৯৭

সৌন্দর্য আমার ঘরে

সৌন্দর্য আমার ঘরে চলে আসে কখনও সখনও
চুপিসারে, বসে মুখোমুখি,
মাঝে মাঝে ঠারে-ঠোরে কথা
বলে কিনা, সহজে যায় না বোঝা, আর
কখনও তাকায় যেরকম ঝিল থেকে
মুখ তুলে পরিতৃপ্ত তরুণী হরিণী।

সৌন্দর্যের কোনও মান-অভিমান নেই, নেই উষ্মা
তর্কের ঊর্ধ্বেই থাকে সর্বক্ষণ, কলহে মাতে না
কোনওদিন। তার আসা-যাওয়া
সর্বদা নিভৃতে অমাবস্যা, পূর্ণিমায়, অকস্মাৎ
চৈত্রের দুপুরে কিংবা শারদ সন্ধ্যায়, মধ্যরাতে; বস্তুত সে
কখনও ধারে না ধার বাঁধা-ধরা কোনও
প্রহরের অথবা ঋতুর,
এমনই খেয়ালী তার আগমন অথবা প্রস্থান।

নিরর্থক সব কিছু জেনেও যখন দেখি খরখরে দুপুরে
গাছতলা ছায়ার প্রলেপে মুগ্ধতায়
নিমজ্জিত, বিকেলে পাখির ঝাঁক আকাশে আল্পনা
হ’য়ে ওঠে, পরিচিত ব্যালকনিটিতে
কেউ এসে বসে, রবিশঙ্করের সেতারের সুর
ভেসে আসে কিয়দ্দূর থেকে, মনে হয়
সুন্দর নাস্তির ছায়া ঈষৎ সরিয়ে
অন্তত রচনা করে ক্ষণকাল নিজস্ব আবছা ব্যাকরণ!

কী ব্যাকুল প্রতীক্ষায় থাকি প্রতিক্ষণ,
কখন সুন্দর এসে দাঁড়ায় এখানে নিরিবিলি
পোড়-খাওয়া আমার সত্তায়
চকিতে জাগিয়ে দিতে ঝর্ণাধারা। তাই
দরোজা উন্মুক্ত রাখি সর্বদাই, যদি
সব পাখি ঘুমিয়ে পড়ার পরে আমার এ ঘরে
নিস্তব্ধ প্রহরে ফের কাউকে কিছু না ব’লে স্বপ্ন উড়ে গেলে
নয়টি বীণার সুরসভা ব’সে যায় অমলিন কুয়াশায়।
১৮.৩.৯৭

Exit mobile version