- বইয়ের নামঃ সে এক পরবাসে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অগ্নিবলয়ের পাখি
এখানে থাকার তার প্রয়োজন আছে। অনাবিল
রোদ্দুরে হাওয়ায়
এখনো সে থাকে যদি ভালো হয়, বড় ভালো হয়।
কাজ তাকে তরঙ্গে তরঙ্গে নিয়ে যায়-দিন নেই, রাত নেই,
কখনো সে হাঁটে শহরের পীচঢালা পথে,
কখনো বা নিঝুম গ্রামের
আলপথ বেয়ে।
আকাশে ওড়ায় কবুতর নিষাদের দৃষ্টি থেকে বহুদূরে।
নিজের বাড়ির সিঁড়ি থেকে আর রাজপথ থেকে
ঘষে ঘষে রক্ত তুলে নিতে হবে, অশ্রুজলে ধুয়ে
সেপথ, যে পথে শহীদের ক্ষত থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে
পড়েছে অঢেল লহু। সমন্নুত পতাকার মতো
সে যাবে সম্ভ্রমে হেঁটে পুষ্প বর্ষণের
বিখ্যাত প্রহরে, চোখে তার খুশি, হরিণের লাফ।
সেদিন সভায় বলপেনে লেখা তার চিরকুট
আমার নিকটে আসে দোয়েলের মতো
শিস দিতে দিতে, তাতে আজ শ্রাবণ দুপুরে খেয়ে যেও
অথবা বিকেলে এসো চায়ে
লেখে নি সে; কতিপয় নিভৃত অক্ষরে
নক্ষত্রের মতো
জ্বল জ্বল করছিল দূর ভবিষৎ। আমি দ্রুত মনে মনে
অনুবাদ করে নিচ্ছিলাম পাঠান্তর।
আমার প্রেমিকা নয়, বান্ধবীও নয়; তবু চাই
থাকুক সে সভায় মিছিলে।
অগ্নিবলয়ের পাখি আগুনে পাখা না ঝাপটালে
কী করে চকিতে হবে কণ্ঠস্বর আগামীর, শাশ্বতের গান?
এখন থাকার তার প্রয়োজন রোদ্দুরে, হাওয়ায়,
তার কণ্ঠে বেজে উঠতে দাও অস্ত্র শানানোর ভাষা।
অসুস্থ কবিকে নিয়ে
‘অসুস্থ কবিকে নিয়ে কত আর পারা যায় বলে
কেউ কেউ ডেটল, ওষুধ ইত্যাদির
গন্ধ থেকে দূরে চলে যায়। কবি, তুমি
আর মন খারাপ করো না। শুয়ে থাকো একা-একা
স্বপ্ন ভর করা বালিশের নরমে আবিষ্ট মাথা
রেখে, যে মাথায় সূর্যাস্তের পেখম এবং ফোটে
গোলাপ, রজনীগন্ধা রাশি রাশি, বাজে বাঁশি আর
বন দোয়েলের
পাখায় পিছলে পড়া জ্যোৎস্না
কেবলি গড়াতে থাকে। শুয়ে থাকো নিভৃতে নিশ্চুপ,
শ্বাসকষ্ট হলে হোক, চোখে
অশ্রু জল আসতে দিও না। কার সঙ্গ পেতে চাও?
এমন কেউতো নেই যে ভরাতে পারে এরকম নিঃসঙ্গতা!
তুমি কি উগরে দিচ্ছো স্মৃতি? রক্তবমি করলেও
স্মৃতির আঙুরলতাগুলি
দেবে না নিস্তার; নিদ্রা যাও চুপচাপ
শিশুর ঘুমের মতো ছাঁচে?
আয়নাটা খুঁজছো বুঝি? দেখে নিতে চাও
এক ফাঁকে তোমার আজকার মুখ? থাক থাক
না-ই বা দেখলে; তুমি একটি বেগানা
লোককে, যীশুর মতো যার
মুখ আপাতত তেলছুট চুল আচড়াতে চাও
পরিপাটি? তুমি কি অসুস্থ বাস্তবিক?
এ কার রহস্যময় ছায়া
দাঁড়ানো তোমার দরজায়? নচিকেতা
তোমার ভেতরে এসে তোমার সত্তাকে
দেয় না ঘুমোতে। অথচ এখন
তোমার ঘুমানো প্রয়োজন। ঝরুক তোমার চোখে শুকনো পাতা।
কারো চুল, চোখ, ঠোঁট, বুকের উদ্দেশে
বাড়িও না শীর্ণ হাত। রোদ-জ্যোৎস্না হাওয়া,
কখনো বৃষ্টির ছাঁট এসে
খেলবে তোমার সঙ্গে। হাওয়া বিলি কেটে
দেবে চুলে, কাল্পনিক জ্বরে পুড়ে গেলে চওড়া কপাল,
জ্যোৎস্না প্রলেপ বুলিয়ে দেবে চন্দনের।
যে তোমাকে ছেড়ে যাবে, তার কথা কেন দিন নেই
রাত নেই ভাবো? চুপ চাপ পড়ে থাকো,
যেন তুমি এই পৃথিবীর কেউ নও
মিশে থাকো গোধূলির বিষণ্ন আলোয়।
সাত পাঁচ ভেবে কেন খামোকা নিজেকে কষ্ট
দিচ্ছো? সে এখন কোথায় রয়েছে কোন সাজে
লাস্যময়ী? কবি সম্মেলন
এখানে তুমি না থাকলেও
চলবে, ভেবো না অনর্থক। উস্খুস্
কোরো না হে কবি, কবিতার খাতা আর
না-ই বা খুঁজলে, নিরিবিলি
ঘুমাও এখন ছেলেবেলাকার শান্ত নদীটির মতো।
শব্দ আর ছন্দ যত খুশি
থাকুক বিবাদে মেতে, কী দরকার তোমার সে দাঙ্গা
ঠেকানোর? লিখো না কিছুই তুমি আর
দ্যাখো শুধু চেয়ে দ্যাখো, নিরন্তর ব্যথা তুলে নাও;
অন্যেরা লিখুক।
আলো-ঝরানো ডানা
রোজকার মতো আজো ঘুম ভাঙালো
ভোরবেলা। হাওয়ার সঙ্গে নারকেল গাছের পাতার খেলা
দেখলাম দু’চোখ ভরে। একটা পাখি
এসে নাচানাচি শুরু করলো ডালে, শিস্ও দিলো
দু’একবার। এই মুহূর্তে মনে হলো, কোনো শোক নেই
পৃথিবীতে; কোনো হতাশা অথবা
বিক্ষোভের কারণের কথাও মনে করতে পারলাম না। চারদিকের
শোভা আমাকে রাখলো আচ্ছন্ন করে।
এই মুহূর্তে স্তোত্র রচনা করতে পারি গাছের পাতায়
মিশে-যাওয়া রোদের, পাখির শিষের বিষয়ে। বাথরুমে
ট্যাপ থেকে টপটপানো পানি, আলনায় ঝোলানো
উপহার-পাওয়া পাঞ্জাবি, ফ্যানের হাওয়ায় ওড়া
পেঙ্গুইনের আধ-পড়া পেপার ব্যাকের স্তুতি গাইতে পারি।
আমার পক্ষে অসম্ভব নয় হৃদয়জোড়া
ভালোবাসার জয়, সামনের দিকে প্রসারিত
নির্জন পথ কিংবা সেই মন-কেমন-করা ঘর, যেখানে
আমার প্রিয়তমা বসত করে, গুন গুন করে গান গায়,
যেখানে ঝরে যায়
অনেক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার মুকুল, রুক্ষ জমিনে
ফুটে-ওঠা স্মিত ফুল, তার কপালে লুটিয়ে-পড়া চুল, ওর
দ্বিধা-জড়ানো খানিক দাঁড়িয়ে থাকা সিঁড়ির ধাপে,
স্তব রচনা করা।
আমার যে-মেয়ে বিদেশে গোছাচ্ছে সংসার, যাকে
দীর্ঘকাল দেখিনি, কিংবা সেই ছেলে, যাকে মৃত্যু ছিনিয়ে
নিয়ে গেছে আমার বুকের
পাঁজর খসিয়ে তাদের নিয়ে বিধুর কিছু লেখার
বেদনা আমি সইতে পারি সহজেই। দু’জনের
মধ্যে যে চিরকালীন দূরত্ব বিদ্যমান, তাকে সরিয়ে
ফেলার ব্যর্থতা অন্ধকারে আবৃত বৃষ্টির দিন যে তোলপাড়
সৃষ্টি করে মনের গহনে, যে বুলবুলি কোনোদিন
এসে বসবে না আমার ঘরের ঘুলঘুলিতে,
এসব কথাও মঞ্জরিত হতে পারে আমার খাতার পাতায়।
কিন্তু আজ ভোরবেলা আমি নিজেকে সরিয়ে
নিচ্ছি এসব থেকে। আজ বৃক্ষ, পাথর আর
নক্ষত্রের স্তবগান গাইবো না। আমি উচ্চারণ করবো
সেই মানুষটির নাম, যাকে আমি
কোনোদিন দেখিনি অথচ মনে হয় দীর্ঘকাল সে
জড়িয়ে আছে আমার দিন যাপনে,
আমার নিভৃত স্বপ্নে, যে আমার সঙ্গে কথা বলে বারবার
অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বরে। তার ঠোঁটের নড়া, হাসি
এবং চোখের আগুন আমার মুখস্থ,
অথচ তাকে কোনোদিন চোখেও দেখিনি।
এইতো আমি দেখছি পুরকালের বীরের ভঙ্গিতে
কোনো দুর্বার ইঙ্গিতে সে কোনো ভোজসভায় নয়,
হেঁটে যাচ্ছে ধুন্ধুমার যুদ্ধক্ষেত্রে, স্পষ্ট দেখছি সে
ছুটে চলেছে উদোম গায়ে। মেঘের গর্জনের মতো
সাহস আর অন্তহীন দেশপ্রেম ছাড়া
তার কোনো অস্ত্র নেই। সে ছুটে চলেছে শক্রদের
নির্মম ব্যুহের ভেতরে। তার যাত্রা ছিল
ফিরে না আসার মহিমা-খচিত।
ওর মা কাতর কণ্ঠে মিনতি জানিয়েছিলেন,
নুর নুর, বাছা আমায়, আয় ফিরে আয়।
কিন্তু সে ফিরে আসেনি। ফিরে আসার জন্যে
অমন করে কেউ কোথাও যায় না
বুনো বরাহের দঙ্গলে।
ওর বর্ষীয়ান পিতা, যিনি বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিতে
পা রেখেছিলেন ঢাকার মাটিতে,
তিনি নুর নুর বলে ডাকেন, কিন্তু এক থমথমে নিস্তব্ধতা ছাড়া
তিনি কোনো সাড়া পান না। তিনি এই পাথুরে
শহরের উপেক্ষিত
দরিদ্রমণ্ডলীর একজন, অথচ তাঁর মাথায়
জ্বল জ্বলে সোনার মুকুট, যা পরিয়ে দিয়েছে
তাঁর হৃদয়ের নুর। সেই মুকুটের দিকে তাকানোর
সময় কোথায় এই নষ্ট ভ্রষ্ট শহরের?
দু-দুটো বর্ষা বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশকে ধুইয়ে,
কিন্তু আমি সত্যি দেখতে পাচ্ছি, নেকড়ের দাঁতোর মতো
বুলেট ঝাঁঝরা ঐ যুবার বুকের রক্ত প্রবল
বর্ষার অবিরল জলও রাজপথ থেকে আজো
মুছে ফেলতে পারেনি। প্রবালের মতো জ্বলছে চাপ চাপ
রক্ত আর দেখছি ওর দুই কাঁধে
গজিয়ে উঠেছে আলো-ঝরানো ডানা। আমাদের
চোখ কখনো কখনো ঝলসে ওঠে সেই আলোয়।
না, তাকে ওরা হত্যা করতে পারেনি। তা হলে
কে অমন আলো-ঝরানো এক জোড়া
ডানা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘে মেঘে, হেঁটে চলেছে
রাজপথে? ওর চোখে নক্ষত্রের নীড়, বাহুতে
অনির্বাণ বরাভয়। নুর, নুর, নুর, হোসেন বলে
ডাকছে রাজপথ, নদীনালা, গাছপালা, নীলকণ্ঠ
বাংলাদেশ। কখন আবার দশদিক
ওলোট পালট করে জেগে উঠবে নতুন যৌবন?
একই রাগিণীর বিভিন্ন আলাপ
১
অসুস্থতা ঈগলচঞ্চুর মতো ঝুঁকে থাকে আমার উপর,
ঠোকরায় প্রায়শই।এখানে আমার কোনো স্থায়ী
ডেরা নেই, এ-কথা স্মরণ
করিয়ে দেয়ার জন্যে সে এসে দুরন্ত
ডানার ঝাপটে চোখ মুখ ঢেকে দেয়। তারপর অকস্মাৎ
জানলা কাঁপিয়ে চলে যায় দূরে, ঘাম দিয়ে জ্বর
ছাড়ে, যেন কোনো ধোপা কাপড়ের মতো
নিঃড়ে নিঃড়ে আমাকে শুকোতে দেয় রোদ্দুরে, হাওয়ায়।
ভয়াবহ তিলে তিলে নিঃস্পন্দ অন্তিমে পৌঁছে যাওয়া,
তারও চেয়ে ভয়ানক বার্ধক্যের দুর্বহ ভারের
চাপ বুকে নিয়ে
নিরাশ্রিত পড়ে-থাকা এক কোণে, ইচ্ছে হয় লিখি
এপিটাফ, কিন্তু আজো কলম বেয়াড়া। কী আশ্চর্য, মাঝে মাঝে
ভীষণ নিষ্ঠুর বলে যাকে মনে হয়, যে আমার
হাড়মাস চিবিয়ে চিবিয়ে
ছুঁড়ে দিতে চায় আস্তাঁকুড়ে, অন্যের প্রণয়াচিহ্ন, তীব্র, গাঢ়,
নিয়ে দেখা দেয় অবলীলাক্রমে, তারই জন্যে আজো পুড়ে পুড়ে
বেঁচে থাকবার সাধ হয়।
২
দোতালার সিঁড়ির পিছনের ধাপেই ভালোবাসা, ধরা ছোঁয়ার
বাইরে। আমার বিষণ্ন হাতে
কোনো বাঁশি নেই, তবু হাসি ঝুলিয়ে মুখে পিছনে না
তাকিয়ে নামার
অর্ফিয়ুসী-চেষ্টা। স্যান্ডেলের শব্দে এই শতকের
শেষ অব্দের ছন্দ; ভালোবাসার চোখ আমার দুলে-ওঠা
ঝাঁকড়া চুলে অথবা পিঠে
নিবদ্ধ ছিল নাকি অন্য কোথাও, কে বলবে? রাস্তা খুঁজি,
নিজকে বলি, একা-একা কোথায় যাও?
ভালোবাসা আমার কাঁধে আলতো রাখে
হাত, এরকম ভ্রম পাখা
ঝাপটায়। কোত্থেকে অবিশ্বাস্য সুন্দর এক পাখি
ডাকাডাকি ছাড়াই আমার কাঁধটিকে বানায় ডাল। পালকের নরম
ঈষৎ গরম ছড়ায় গালে, কানে এবং গানে
গানে নিমেষে নিয়ে যায় হাফিজের কালের
গোলাপ বাগানে। বিচ্ছিন্নতা কোনো কথা না বলে
হাঁটতে শুরু করে আমার হাত ধরে।
ভালোবাসা দাঁড়ানো যৌবনের মদিরতায়।
একবারও ফিরে তাকাইনি, যদি সে গোলাপের
সৌরভের মতো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। এখানে
তাকে পাওয়ার আশা নিছক
কুহক হয়ে নেচে বেড়ায়। অথচ সিঁড়ির
পিছনের ধাপেই ছিল। তার হেঁয়ালি
বোঝার আশা দিয়েছি ভাসিয়ে
ভঘঘুরে মেঘের ছায়ায়।
সে আমার ছিল না খ্রীষ্টপূর্ব সন্ধ্যায়,
যে আমার নয়, তাকে হারাবার ভয় কেন সবসময়
নিষাদ-তাড়িয়ে হরিণের মতো দিগ্ধিদিক
ছোটাছুটি করে? এই দুপুর থাকবে না, সন্ধ্যা ডুবে যাবে,
রাত্রিও যাবে,
একটু একটু করে আমাকে খাবে ঠুকরে ডোম কাকা।
যথাসর্বস্ব
বিলিয়েও পারবো না যেতে সেই ঝর্ণাতলায়,
যেখানে তার আবাসভূমি,
যাকে তুমি বলে ডাকে আমার হৃদয়ের তন্তুজাল!
পাওয়ার আগেই হারাতে চলেছি তাকে। কাকে বলে পাওয়া?
আমাকে আপাদমস্তক পরিয়ে নিঃসঙ্গতা কিছুক্ষণ
কোনো কথা না বলেই থাকবে দাঁড়িয়ে কী খেয়ালে,
কে জানে? আমার মাংসের দেয়ালে বিছের কামড়,
সে চলে যাবে সন্ধ্যেবেলা। আমাকে মাড়িয়ে শহরের
সকল যান, মানুষ ছুটে যাবে। কীসের টানে
এখনো আরামপ্রদ স্টেশন ভেবে জায়গাটাকে বুকের খুব
কাছের কিছু বলে মেনে নিই? মুখ নিচু করে স্যান্ডেল ঘষি
পাথরে
শেষটায় ভোলার চেষ্টায় ব্যর্থ না-লেখা কবিতার
গুঞ্জরণ নিয়ে পা বাড়াই। পাবো কি দেখা
আবার কখনো? জলমগ্ন বিশাল ঝিনুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে
এসেছে যে থৈ থৈ যৌবন নিয়ে, অনেক পথ পেরিয়ে এসে
যার দিকে ফিরে তাকাতে পারিনি। আমার পাশাপাশি
হাসি মুখে হাঁটতে থাকে বিচ্ছেদ, তাকায় আকাশ-উপচানো
নক্ষত্রের দিকে আর সেই মনোহর পাখিটা আমার নিশাচর
কাঁধে বসে চঞ্চু ঘষে ঘষে কবিতার প্রস্রবণ জাগাতে চায়।
৩
যখন তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসলাম,
হঠাৎ তখনই তুমি চলে যাচ্ছো আমার দৃষ্টির
অন্তরালে; এরকমই হয়, হতে থাকে চিরদিন।
তোমাকে যেতেই হবে সুগভীর নক্ষত্র নিবিয়ে?
আমার অজানা নয় দুঃসময়; কতবার তার
অগ্নিঝড় স্বপ্নমুগ্ধ ঘরদোর সব তছনছ
করে উড়িয়েছে ভস্মরাশি চতুর্দিকে। এরকম
সময়েও তোমার চোখের পাখি শুনিয়েছে গান।
আমার একটু স্পর্শে চমকে উঠছো, ঢিল-পড়া
সরোবর যেন আর তোমার পায়ের পাতা ছুঁয়ে
পায়ে ভেবে নিয়েছি আমিও দ্বিপ্রহরে স্বপ্নে ভেসে
যেতে পারি অবলুপ্ত কার্থেজের চিত্রিত জাহাজে।
যখন তোমার হাতে চুমো খেয়েছি প্রথম, তুমি
দ্রুত হাত সরিয়ে কেমন স্তব্ধতায় ডুবে গিয়ে
বসেছিলে। আজো সেই দুপুরের জ্বলজ্বলে স্মতি
নূপুরের ধরনে ধ্বনিত গাঢ় বর্ষার তিমিরে।
তোমার কোমরে পাক দিয়ে ওঠে নদী বাঁকে বাঁকে,
এবং যখন হাসো রাজহংসীর মসৃণ ডানা থেকে
ঝরে যায় জলকণা নিরিবিলি; তোমার মুখশ্রী
প্রাচীন বাংলার রূপ হয়ে জ্বলে প্রেমিকা আমার।
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে, বলো তুমি
কী এমন দেখ এই চোখে, এত বিশ্রী। চোখ মেঘে
যখন তাকাও তুমি আমার উদ্দেশে, মনে হয়
কোনোখানে তোমার অধিক কোনো আততায়ী নেই!
৪
আজকাল গোলাপের চাষ কমেছে কি বেড়েছে, জানি না;
জীবনের রলরোলে শুধু মনে পড়ে;
দিয়েছিলে তুমি স্মিতা একটি গোলাপ, তাজা, টকটকে।
মনে হলো নিভৃত ফুটন্ত রক্তগোলাপের ছলে
তোমার হৃদয় দিলে তুমি কম্পিত আমার হাতে।
সে মুহূর্ত চিরস্থায়ী হলে, বলো কোন্ ক্ষতি হতো?
কোথায় লুকাবো তাকে ভেবে পায়চারী করে ক্লান্ত;
পকেটে দিলাম ঠাঁই। গোলাপ মুষড়ে পড়ে সাত
তাড়াতাড়ি, ছিল না খেয়াল। শুধু দেখি তোমাকেই
কেমন বিহ্বল চোখে; তুমি ছাড়া অন্য সব কিছু
ঝাপ্সা কাঁচের মতো লেগেছিল। পুষ্পতত্ত্ববিদ্ যা ইচ্ছে বলুন, জানি
সে গোলাপ হৃদয়ের ভেতরেই প্রিয় আয়ুষ্মতী।
দ্বিধা তো থেকেই যায়। অন্য কারো উদ্দেশে গচ্ছিত
সে অর্ঘ এসেছে হাতে বলে অত্যন্ত কর্কশ।
কণ্ঠস্বর আমাকে পীড়ন করে ক্ষণে ক্ষণে, হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খায়
নিষ্ঠুর ঈগল এক, মাথা কোটে অন্তর্গত দুর্বার উন্মাদ।
দ্বিধা তো থেকেই যায়; যখন চোখের মণি দুটো গলে গলে
নীরেট পাথর, চতুর্দিকে নাচে গোলাপের প্রেত!
চিৎকার চিৎকারে দশদিক ছিঁড়ে খুঁড়ে দিই আর
নিজই নিজের মুণ্ড চিবিয়ে খাবার
ইচ্ছেটাকে চাবকাতে থাকি, আদিম মানুষ বশ
মেনে যায়, অজান্তে পকেটে হাত দিয়ে অকস্মাৎ
বের করে আনি সেই উপহার, নিষ্পাপ গোলাপ।
মনে হয়, যেন আমি ভুল করে ছুঁয়েছি অঙ্গার।
তোমাকে একলা ছেড়ে (তুমি কি নিশ্চিত একাকিনী?)
চলে যাবো বহু দূরে পুড়ে পুড়ে।
যাবো একা, বড় একা, নিরাশায় ডোবা রাত্তিরকে অধিক প্রসন্ন করে
থাকবে নিঃসঙ্গ ঝুলে আসমানে আধখানা চাঁদ।
গ্রিক বণিকের ম্লান স্মৃতিসৌধ জোনাকির ভিড়, চকিতে পড়বে মনে
তোমার চোখে কালো কত শত দূর শতাব্দীর।
৫
চাই কিনা চাই শেষ অব্দি দূরত্বের ধূসরিমা
ভেতরে বিরাজান। নৌকো
ঘাটে ভেড়াবার প্রয়াসের উপরে শীতল জল
প্রবল গড়িয়ে পড়ে; মনে হয়, নিজের মৃত্যুর
আগে কোনো মুহূর্তে সে-মুখ
দেখবো না, যায় সেই শরমের আবীর রাঙানো ভঙ্গিমায়
নির্ভরতা আছে; জানি, একটু একটু করে আমি
স্ব ধ্বনি, সব ঘ্রাণ, সব গান, সব দৃশ্য থেকে দূরে সরে যাবো,
নিশি-পাওয়া মানুষের মতো একই দিকে
হবো ভ্রাম্যমাণ, যদি তাকে ভ্রমণের
সঙ্গে তুলনীয় ভাবি। যাকে এতকাল দেখে
কেটেছে আমার বেলা, আসলে সে অন্য কেউ, তার
সঙ্গে কোনো জানাশোনা নেই, অথচ সে
আমার নিজেরই তৈরি। তখন নিজকে প্রতারিত,
বঞ্চিত, কী শূন্য লাগে। খুব তাড়াতাড়ি
চলে যাবো নাকি? গোরস্তানে যারা ধরিয়ে নিঃস্পৃহ
সিগারেট চোখ স্বাভাবিকভাবে চৌদিকে বুলিয়ে
নেয় অনুভূতিহীন, নিশ্চেতন,
তাদের কারুর মতো থাকবো এখনো
নিরর্থক জীবনের জিন্দানে বন্দির স্বপ্ন নিয়ে?
কথা ছিল না
কথা ছিল না
কথা ছিল না এখানে এভাবে এসে দাঁড়াবার।
কথা ছিল না এখানে দাঁড়িয়ে নিজস্ব ভাবনাগুলোকে
নিপুণ অশ্বারোহীর মতো বাগ মানিয়ে
খেলা দেখাবার। খুব যে একটা কসরৎ করেছি,
বলা যাবে না। যেখানে রৌদ্র দরকার, সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছি
বিকেল বেলার রোদ আর যেখানে
ছায়া জরুরি, সেখানে মেঘ থেকে কর্জ এনেছি ছায়া।
একটু হাওয়া বইয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল,
বৃষ্টির শব্দ মিশিয়ে ভাবনাগুলোকে
মুখর করে তোলার উদ্যম থেকে বিরত থাকার
কোনো চেষ্টাই করিনি।
আমার কথা ছিল ঝরে-যাওয়া নক্ষত্র কুড়িয়ে এনে
মনের মতো একটি মালা গেঁথে তাকে পরিয়ে দেবার,
আমার তো কথা ছিল ঝর্ণাতলার আহত হরিণের আর্তনাদ শুনে
চমকে ওঠা, যেখানে রঙ বেরঙের পাখি
খুঁটে খুটে খায় স্বপ্নবীজ। কথা ছিল অতল জলরাশির ফেনা
ছেড়ে
উঠে আসা জল কন্যার ভাষাহীন ভাষা
শোনার আশায় সমুদ্র তীরে ছুটে যাবার। স্বপ্নে বুঁদ হয়ে
বস্তু জগতের প্রতি উদাসীনতার ডিঙি ভাসিয়ে
ভাটিয়ালী গাওয়া অথবা বনবাদাড়ে
একা-একা ঘুরে বেড়িয়ে গোধূলির ঘণ্টাধ্বনি শোনার কথা
ছিল আমার।
অথচ আমি জল পায়রার ডানার অজস্র ঝাপটানি,
বন দোয়েলের শিস, স্থলপদ্মা আর
পাতার মর্মর আর ডাঙার পাথরে হেলান দেয়া
জলকন্যার চাউনি, যা শুনিয়ে ফেলে আত্মা, বহু যুগের
ঘোড়ার কংকাল দু’পায়ে মাড়িয়ে
আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি স্পন্দিত বুকে তোমাদের
মাঝখানে।
আজো কিছুতেই একথা আমার কাছে স্পষ্ট নয়,
সে কোন শক্তি আমাকে অসুস্থতার নাছোড় বেষ্টনী থেকে,
মধ্যরাতের পাখির বিলাপ,
নক্ষত্ররাজির কুহক, স্তব্ধতার ঢলাদি আর
আকাশের বুক থেকে মাটির দিকে ঝুঁকে-থাকা আধখানা
চাঁদের ঢুলুনি থেকে মুক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এখানে।
এখন আমার আর ফেলার পথ নেই। অঙ্গারের
উপর দিয়ে হলেও
হেঁটে যেতে হবে আমাকে, জীবন যত রক্ষ্ণতা বিছিয়ে দিক
পথে, এগিয়ে যেতেই হবে, যত নারকীয় হোক
পায়ে চলার পথ, থামতে পারবো না কিছুতেই।
যে আমার সর্বক্ষণের ভাবনায় জেগে থাকে
ফুটন্ত গোলাপের মতো,
যে আমার হীরের ঝালর সাজানো ঘোড়ার পিঠে
সওয়ার হয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘনীভূত করে
সান্নিধ্যের মধুধারাকে,
যে পছন্দ করে আমার নির্জনতায় হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে,
ভয় পায় জনসমুদ্রে আসতে,
তাকে আমি দ্বিধার টিলা থেকে নামিয়ে
নিয়ে এসেছি এখানে।
আগুন, আগুন, আগুন বলে সবাই
চিৎকার করে উঠেছে দশ দিক কাঁপিয়ে; অনেকে দুঃস্বপ্ন থেকে
জেগে উঠে ঝাঁপ দিয়েছে নদীতে,
অনেকে ভৌতিক স্তব্ধতাকে আলিঙ্গনে করে,
ভেসে গেছে কোথায়, আগুনের ঝড়ে পুড়ে খাক হয়ে গেছে
ঘাটে-বাঁধা নৌকো, রাশি রাশি
শস্যদানা, শত শত কবুতর, গাছের সবুজ পাতা।
আগুনের তাপে ঝলসে যাওয়া মুখ নিয়ে,
জিঘাংসার কুণ্ডলী এক লাফে পরিয়ে
ছুটে এসেছি এখানে।
হন্তারকের ঝাঁক যখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে
চতুর্দিকে, তখন কিছু লোক
তা তা থৈ থৈ নাচের চূড়ায় তুলে দিয়েছে
ওদের উল্লাসকে, নিরন্নের দল যখন হাহাকারের সমুদ্রে
হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন কিছু লোক স্বৈরাচারের অঙ্গের চাদর
আহলাদের সঙ্গে খানিক স্পর্শ করার জন্যে বেজায়
হুটোপুটি জুড়ে দিয়েছে। যখন শহীদদের মা-বোনেরা
উজাড় বুকের শূন্যতা নিয়ে বসে আছেন
মর্মর মূর্তির মতো, তখন কিছু লোক
খুনীদের বিলানো বকলেস গলায় এঁটে
একালের মহত্ত্বকে কামড়ে চকচকে চোখ তুলে দেখছে
কেউ ওদের উদ্দেশে জয়ডঙ্কা বাজাচ্ছে কিনা।
যখন অত্যাচারীর হিস হিস চাবুকের ছোবলে
নীল হয়ে যাচ্ছে আমার শহরের পিঠ,
যখন জালিমের সাঁড়াশি উপড়ে ফেলছে
আমার শহরের চোখ, যখন পালিশ করা বুটের লাথিতে
ভেঙে যাচ্ছে আমার শহরের পাঁজর,
তখনও কি আমাকে ভাবতে হবে বিশুদ্ধ কবিতার
আবৃত স্তনের কথা? এ শহরের বুক যখন ছিঁড়ে যাচ্ছে শ্বাপদদের
নখরের হিংস্রতায়, তখনও কি আমাকে বাঁশিতে তুলতে হবে,
বসন্তবাহার?
স্বদেশ, তুমি তোমার বীর সন্তানদের মরতে দেখেছো
ধুলো-ওড়া প্রান্তরে, নদীতীরে, রাজপথে।
স্বদেশ তুমি দেখেছো কী করে গরম রক্ত টপকে পড়ে
তোমার সন্তানদের বুক থেকে আঙুরের রসের মতো।
স্বদেশ তুমি গোলাপবনে রক্তবন্যা বয়ে যেতে দেখেছো।
স্বদেশ, মা আমার, মাগো,
আর কত শহীদ চাও তুমি আর কত রক্ত ঝরলে
তোমার উদরে জন্ম নেবে সবার ক্ষুধা মেটানো শস্যকণা?
মা আমার, মাগো,
এই পবিত্র স্থানে আমাদের সবার মাথার উপর
হাত রাখো তুমি, যেন ভয়ে আমরা পিছিয়ে না যাই
রণে ভঙ্গ দিয়ে, যেন আমাদের
কোনো মুহূর্তেই মনে না হয় নিঃসঙ্গ আমরা,
বৃথা পচবে না আমাদের শরীর
কবরের বিষণ্ন অন্ধকারে। স্বদেশ, মা আমার,
আজ এই আশ্বাস তুমি আমাদের দাও।
কী করে অন্য কোথাও
কী চমৎকার এই রাত। ভিড় এড়িয়ে, অনেকগুলো
কনফেকশনারি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, অষুধের দোকান আর
রেস্তোরাঁ পেরিয়ে একা একা পথ হাঁটতে
লাগছিল ভালো। আলোর চ্যাঁচামেচিতে উচ্চকিত রাস্তার
ধার ঘেঁষে আমার চলা। কখন যে
ছায়াচ্ছন্ন, পরিচ্ছন্ন চওড়া গলিতে ঢুকে পড়েছি, ঠাওর
হয়নি, কোনো কোনো বাড়ির ফুলের গন্ধে বাতাস ঈষৎ
মাতাল, আকাশ ধানমণ্ডির লেকে ঝুঁকে
দেখছে নিজের মুখ, আর্ত ইতিহাসের আবছা আদল। ঝিনুক
খুঁজতে এখানে আসে না কেউ। ঢিল ছুঁড়ে ছোট ছোট
ঢেউ দ্যাখে কখনো ঘুরে-বেড়ানো বালক। কী যেন
খুঁজতে খুঁজতে হাওয়ার ঠোকর-খাওয়া কিছু পালক
কুড়িয়ে নিই আলগোছে। কী দ্রুত বুড়িয়ে
যাচ্ছি, তবুও আজকাল বুকের ভেতর মদির
আগুন, পলাশ রাঙানো ফাল্গুন, আত্মাকে
চমকিয়ে-দেয়া স্বপ্নপোষ্য, গানে-পাওয়া কোকিল।
ঘামে ভেজা কার্তা হ্যাঙারে ঝুলিয়ে জড়িয়ে
ধরি বিশ্রামের আঙুরলতা। কোথাও একটি কথা নেই,
কপালে হাত বুলিয়ে দেয় না কেউ,
মাথার ওপর শ্বেতবসনা হুরির মতো সিলিং ফ্যান
নাচছে ঘুর্ণিনাচ! রক্তচাপ তেজী না-লেখা কবিতার কণাসমূহ
রাগী বেজীর দাঁতে বিদ্ধ হচ্ছে ক্রমাগত। সাপের ফণা
সেগুলো পুনরুদ্ধারের স্পৃহায় বিকশিত।
এই চমৎকার রাতে তোমাকে মনের চোখে দেখতে পাই
বলে আমাকে সারাক্ষণ
এক গুঞ্জরণ ঘিরে রাখে; তুমি ভালোবাসো আমাকে-
এই ভাবনা পালতোলা জলযান হয়ে
আমার হৃদয়ের নির্জনতম নদীর বুক চিরে চলমান।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে মোগল আমলের
বুলবুলের গজলছাওয়া গুলবাগ; সেখানে তোমার
আয়ত চোখের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দেয়া চাওয়া,
ত্রস্ত ভঙ্গিতে ছুটে যাওয়া ফোয়ারার কাছে। ঝাউগাছে
হাওয়ার ঝলক। করে যেন তুমি আর আমি
পূর্ণিমা চাঁদের নিচে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম হাতে হাত ধরে।
হঠাৎ দুজনের মাঝখানে
এসে দাঁড়ায় স্বপ্নভঙ্গের ঢ্যাঙা ছায়া।
কার ঘাড় ধাক্কা খেয়ে প্রবেশ করছি দুঃস্বপ্নে?
মাংস আর ত্বকহীন কতিপয় আঙুল
সাঁড়াশির মতো বসে যাচ্ছে গলায়, হঠাৎ এক ঝটকায়
সরিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস
নিতে চাই, কে যেন লোহার নখে ছিঁড়ে খুঁড়ে
বের করে আনছে দপ্ দপানো কলজে। বাতাসে
তোমার কণ্ঠস্বর একবার বেজে উঠে
দুমড়ে-মুচড়ে কোথায় হারিয়ে যায়। তার পেছনে
ছুটতে ছুটতে এমন পথে পৌঁছে যাই,
যার কোনো আরম্ভ নেই, শেষও নেই। কিছু প্রতিধ্বনি
কেবল মাথা কোটে শ্যাওলা ঢাকা প্রাচীনতায়।
বন্ধ দরজা থেকে বন্ধ দরজায় দৌড়ে গিয়ে ক্রমাগত
কড়া নাড়ি শব্দহীন। সাড়া দেবে কে?
কে খুলে দেবে কপাট
এই বেগানার জন্য, যার সারা শরীরে ঝুলছে জলপায়রা
আর দোয়েলের গলিত নাড়ি-ভুঁড়ি আর শত শত মৃত চোখ?
ওরা কয়েকজন আমার ঘরে হুড়মুড়িয়ে
ঢুকে শোনালো সুবচন-
‘এই দুনিয়া সরাইখানা,
আজ আছো তো কাল নেই। তোমার পাপের ঘড়া
কানায় কানায় উঠেছে ভরে। এবারে
কপাল পুড়বে তোমার’।
আমাকে ওরা শোনালো কবরের কথা,
থুতু ছিটোতে ছিটোতে বললো গোর-আজাবের কথা, মাটির
নিচের কিলবিল-করা
পোকা-মাকড়দের কথা। একটানা ঘ্যানর ঘ্যানর
বলে গেল মৃত্যুর কথা, মৃত্যুর কথা, মৃত্যুর কথা। এটা
ওদের বোধের বাইরে, যে তোমার স্পর্শ পেয়েছে,
পেয়েছে তোমার বুকজোড়া সপ্তবর্ণ ভালোবাসা
সে কেন মৃত্যুর পাঁচালি শুনতে চাইবে।
আমার পরিমাপহীন গুনাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে
ওরা বললো, ‘তোমার ঠাঁই হবে
হাবিয়া দোজখে’।
এক ঝাঁক মৌমাছি,
সোনালি মাতাল, ওদের গঞ্জনা গুঞ্জরণে ডুবিয়ে
শুনিয়ে গেল তোমার মধ্যরাত্রির মেঘময় কথা, ভোরবেলার
শিশিরস্নিগ্ধ কথা আমার কানে কানে। মনে পড়লো
তোমার ঠোঁট, যার মধু শতাব্দীর পর শতাব্দী
পান করলেও নিঃশেষিত হবে না। ভাবি,
যে দেখেছে সন্তের পুণ্যের মতো তোমার কালো গভীর চোখ
আর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ঝর্ণাধারার মতো
হাসি, অনিন্দ্য মুখের আদল, মৃত্যুর পরে
সে কী করে বেহেশত ছাড়া অন্য কোথাও যাবে?
ঘড়ি
আমার চরম শক্র ঘড়ি, সময়কে অবিরল
প্রবল শাসন করে টিক টিক্ ধ্বনি
দিয়ে আর আমাকে কেবলি
ঠেলে দেয় মরু শেয়ালের গায়ের রঙের মতো
অন্ধকারে। অসহায় আমি
গড়িয়ে চলেছি শোকে ঢালু বেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া নুড়ির ধরনে।
‘চটপট উঠে পড়’, বলে ঘড়ি আমার উদ্দেশে প্রহরীর
কায়দায়, ‘তোমার সময় হলো এ ড্রইংরুমের
নিবিড় আশ্রয় ছেড়ে যাবার। এবার
পথে নেমে যাও, আর কত কাল তার মুখোমুখি
থাকবে বসে? খানিক তাকিয়ে
তোমার মুখের দিকে পথ চলি, সুসময় ঝরে যায় পথে।
এখন আমার বুকপকেটে তোমার হাতচিঠি
দোয়েলের শিস, বেবি ট্যাক্সির জঠরে
বসে ভাবি, আমার জীবন যেন তোমার নিকট
অলিখিত তমসুক। ঘড়ি
আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জানায়, তোমার
জীবন ফুরিয়ে এলো, ওহে, এ সামান্য কথা ভুলে বসে আছো?’
কী করে যে সারা মাথা চকিতে সাজানো
হয়ে গেল কাশফুলে, কাঁকড়ার প্রখর
পদচ্ছাপে ভরে গেল মুখ
কিছু তো জানি না। অগোচরে প্রৌঢ়ত্বের
চিতা পুড়ে হলো ছাই, তবুও তোমাকে খুব কাছে
পাবার বাসনা আজো কিছুতে নেভে না।
সব কিছু এত দ্রুত অস্তাচলে যায়,
ঠাওর হয়নি আগে। কব্জিতে কৌতুকপ্রিয় ঘড়ি
চোখ মেলে মিটি মিটি হাসে
ভাঁড়ের ভঙ্গিতে; তার মুখ
ভীষণ পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। অভিমানে দূরে
ছুঁড়ে ফেলে দিলে বুঝি স্বস্তি বোধ হবে?
প্রকৃত গেরস্ত নই, অথচ নাছোড় শক্র নিয়ে দিনভর
রাতভর চলে গেরস্থালি।
সে যত রাঙায় চোখ, আমি তত বিষণ্নতা থেকে,
ভয় থেকে দূরে থাকি একা হেমন্তের
মধ্য দিয়ে যেতে যেতে। হৃদয়ের পবিত্র আগুনে
মদির আলস্যে ঘড়ি গলে গলে যায় গোধূলিতে।
চলে যাওয়া যার রীতি
কখনো তোমার দেহ বেজে ওঠে,
যেন অনিন্দ্য বীণা।
ছুঁতে গেলে একি চোখের পলকে
হয়ে যাও মেঘলীনা।
আমার স্বপ্ন যাচ্ছে জড়িয়ে
তোমার কৃষ্ণ চুলে;
কিছু লেগে থাকে, কিছু ঝরে যায়
চুল দাগ যবে খুলে।
মেঘের ছায়ায় রেখেছি মনের
গোপন ইচ্ছে গুলি।
মেঘ উড়ে গেলে মুঠো মুঠো শুধু
ভস্মের কণা তুলি।
বয়স এখন দস্যুর মতো
পরমায়ু দ্রুত কাড়ে
হৃদয় আমার গলে পুড়ে খাক
তোমার স্বৈরাচারে।
একটু দাঁড়াও, মুদ্রিত হোক-
মনে কিছু কিছু স্মৃতি
কেন তার পথ আগলে দাঁড়াই,
চলে যাওয়া যার রীতি?
মুখস্থ বলি তোমাকে এখনো
একেবারে ক্রটিহীন।
কিন্তু তবুও শরীরে আমার
ঢেলে দাও কেরোসিন।
অবমাননার শেকলে বন্দি
পড়ে আছি এক কোণে।
জাঁহাবাজ শিখা চাটুক আমাকে
এ ছিল তোমার মনে।
মনের কোটরে কেউটে ঘুমায়,
কখন জাগাবে তাকে?
তোমার দু’চোখ লেগে থাকে দেখি
ঝাউবৃক্ষের শাখে।
বিশ্বেস করো, তোমাকেই ভাবি,
ভাবছি অহর্নিশ।
অমৃত চেয়েছি তৃষ্ণা মেটাতে,
উগরে দিয়েছো বিষ।
পারবে কি কেউ আমার মতোন
পোড়াতে নিজের ঘর?
পারবে ছিন্ন করতে নিজেরই
মুণ্ডু এবং ধড়?
চলো ফিরে যাই
সদর রাস্তায় নিয়ে এসেছি তোমাকে;
আসতে চাও নি তুমি, আমার নাছোড়পনা দেখে
দিয়েছো সম্মতি, কিন্তু এত নির্যাতন
হবে, হবে এমন হেনস্থা চারদিকে, যদি জানতাম আগে
তোমাকে বেআব্রু করে হাটে
দাঁড় করাবার সাধ শুকনো মঞ্জরীর মতো ঝরে
যেতো অগোচরে, যদি আস্থার দেয়ালে
ফুঁটো তৈরী এখনো না হয়ে থাকে, বলি,-
যখনই তোমার গায়ে পড়েছে আঁচড় কারো, আমি
হয়েছি আহত ভয়াবহ ভাবে, আরোগ্যশালায়
এমন ওষুধ নেই, যার প্রভাবে জখম
সেরে যাবে তাড়াতাড়ি। চেয়ে দ্যাখো, তারা মণ্ডলীর
নিচে দূরে কদমতলায়
বসেছে গোপন সভা, সেখানে তুমিই সভানেত্রী; জুঁই ফুল
হয়ে জ্যোৎস্না ঝরে যায় কার্পণ্য-রহিত ব্যবস্থায়;
চলো ফিরে যাই।
চুপ
চুপ,
চুপ, চুপ,
চুপ, চুপ, চুপ,
কোনো শব্দ নয়, কথা নয়।
এমনকি ফিসফিসানিও
চলবে না। চুপ থাকো ইঁদুরের চেয়েও
শতগুণ বেশি, সব চুপচাপ,
একেবারে নিঝুম, নিশ্চুপ।
গাছ, তুমি একটিও পাতা নাড়াবে না,
মাছ, তুমি কাটবে না কোনো বুড়বুড়ি
অথবা দেবে না লাফ, সাফ বলা হচ্ছে দিনরাত।
দোয়েল, তোমার শিস মুলতবি রাখো,
ভ্রমর, তোমার গুনগুনিয়ে
ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। বৃষ্টি তুমি
বাজাবে না ঘুঙুর কখনো, লেখকের বেয়াদব
লেখনী স্থবির হোক, কেউ কোনোখানে
রা কাড়ার সুযোগ পাবে না। জোরে শোরে
বিশ্বস্ত কুলুপ এঁটে দেয়া হয়েছে অনেক আগে
সকলের মুখে; বাছা-বাছা
কজন স্বনামধন্য ছাড়া কারো মুখ খুলবার
অধিকার নেই।
চুপ, চুপ,
কালবৈশাখীও চুপ থাকবে এখন।
চুপচাপ গোরস্থান আরো বেশি নিথর, নিশ্চুপ
থাক; চুপ, চুপ।
যে যাই বলুক,
সুদূর দিগন্ত-চেরা ঝড় শোনে না বিষেধ,
কেউ কোনোকালে
পারে না নিষিদ্ধ করে দিতে
আকাশের ডাক আর
উদ্দীপ্ত মানুষ চিরকাল
মুখ বুজে থাকবে না, গর্জনের তরঙ্গে তরঙ্গে
নিমেষে পড়বে ধসে দুর্ভেদ্য দেয়াল,
কেউ চুপ থাকবে না আর।
জন্মদিন হাসে
যে রোদ আমাকে চুমো খেয়েছিল সুদূর মাটির ঘরে,
প্রথম বারের মতো, তার কোনো রূপান্তর নেই;
কেবল নিজেই আমি কী দ্রুত বদলে যাচ্ছি, খেই
কোথাও পাচ্ছি না খুঁজে। কোনো কোনোদিন চরাচরে
বেদনার বুক চিরে আনন্দ বেরিয়ে আসে, জন্মদিন হাসে;
হঠাৎ আয়নায় কোন্ অচেনাকে দেখে মিশে যাই দীর্ঘশ্বাসে!
কোত্থেকে একটি স্বপ্ন-বিতরণী পাখি কানে কানে
বলে যায়, পালিও না, ভগ্নকণ্ঠ হলেও সাজাতে হবে পৃথিবীকে গানে।
তোমার কবিতা
খোয়ানো কবিতা খুঁজে ভোরবেলা এলোমেলো করে
দিয়েছি টেবিল।
কোথায় যে গেল রক্ত গোলাপের ছায়া,
আকাশের এক মুঠো নীল।
তোমার আয়ত চোখ, মুখ, স্তনচূড়া,
মাথার চুলে ভেজা ঘ্রাণ
লিখিয়ে নিয়েছি সেই হারানো কবিতা,
সে তোমারই দান।
দুপুরে এগিয়ে দিলে নিজের কবিতা
আমার তন্ময় করতলে
নত হয়ে অক্ষরে অক্ষরে দেখি উন্মোচিত হৃদয় তোমার,
একূল ওকূল ভাসে নিভৃতির জলে।
তৃষ্ণার্ত পাখির মতো আমি চাই পানি
কণ্ঠে তুলে নিতে;
কবরস্থানের পুষ্পহাসি হয়ে তোমার কবিতা
জেগে থাকে আমার স্মৃতিতে।
দীর্ঘ ভ্রমণের পর
দীর্ঘ ভ্রমণের পর শ্রান্তি মোহিনীর মতো ভঙ্গি
অঙ্গে এঁকে অলস আঙুলে
দেখায় নিভাঁজ শয্যা, কানে কানে বলে, আর নয়,
এবার বিশ্রাম করো, কোনো কোলাহল
নেই কোনোখানে,
দায় আর ফুটে নেই গোলাপের মতো, যা তোমাকে
টেনে নেবে পথে সর্বক্ষণ, দরজাটা
বন্ধ থাক, এবার ঘুমাও।
সত্যি ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত আমি আজ, উদ্যম রহিত;
কোনো কা, এমনকি কারুকাজ করা
অত্যন্ত কঠিন মনে হয়, উৎসাহের
ভাণ্ডার উজাড় হলো অবশেষে? তাহলে নিঃসাড়
নিঃস্পন্দ থাকবো পড়ে এক কোণে একা
বৃদ্ধ অর্জুনের মতো হীনবল যে ভুলেছে গান্ডীবে টংকার
তোলার কৌশল? দেখ, দু’পায়ে আমার
ফুটেছে চুণির মতো রক্তবিন্দু। মুছে যাবে কবে?
শ্রান্তি কিংবা ভ্রান্তি দিক পেতে সিল্ক মসৃণ চাদর,
কাউকে জড়িয়ে আমি নিমজ্জিত হবো না নিদ্রায়।
দুর্ভোগ
তবে কেন সম্প্রতি এমন অবহেলা? কেন তুমি
আড়চোখে তাকিয়ে আমার দিকে দূরে সরে যাও,
ঝরে যাও, যেরকম মুঠো থেকে সহজে পিছলে
যায় মাছ বার বার? অদূরে দাঁড়িয়ে, হেসে ওঠো
ফিক করে, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা বলে আমার খাতার
কিছু পাতা ছিঁড়ে ফেলো কুটি কুটি। আমি তো তোমারই
মুখের আদল চির উর্বশী শরীর আজীবন
তন্নিষ্ঠ ফোটাতে চেয়ে নিজেকে মারাই নিত্যদিন।
তবু কেন এমন রহস্যময় ব্যাভার তোমার
প্রায়শ প্রত্যক্ষ করি? কখনো সহজে দাও ধরা,
আবার কখনো মনে হয় যোজন যোজন দূরে
বর্ণিল অলিন্দে হেঁটে যাও ক্লিওপ্যাট্রার ধরনে।
পায়নি নিস্তার কেউ তোমার অদ্ভুত ছলনার
নির্দয় ছোবল থেকে, ভুগিয়েছো জীবনানন্দকে।
দেয়ালে আমার পিঠ
দেয়ালে আমার পিঠ, আর সরে দাঁড়ানো
কিছুতে সম্ভব নয়; দেখছো না খর
জ্যোৎস্না আর গোলাপের ওপরেও হয়েছে চাপানো
ভারী আয়কর!
নিশ্চুপ শাদায়
সাধ জাগে, এ দেয়ালটার আড়ালে কী আছে, দেখি।
কেউ কি এলিয়ে চুল বসে আছে একা-নাকি কেউ
গুমরে গুমরে কাঁদে বাদামি দু’হাতে মুখ ঢেকে?
কেউ কি সরোদে সুর তুলে নিজেকে আনন্দ ধ্বনি
করে কিংবা লেখার টেবিলে ঝুঁকে মন ছেড়ে দেয়
কত শব্দ-হরিণের গলায় বুলিয়ে দিতে হাত।
ভাবি, হয়তোবা নারী ও পুরুষ তুচ্ছ-সুমধুর
কথোপকথনে মেতে আছে, কিছু মান-অভিমান,
অকস্মাৎ অস্তিত্বের আঁশ খাড়া করে ফুঁসে ওঠা,
তা-ও আছে, আছে চুম্বন এবং আলিঙ্গন।
বুঝি শিশু হামাগুড়ি দিয়ে সুপ্ত বেড়ালের দিকে
ক্রমশ এগোয় নাকি কেউ কারো গলা কেটে ফেলে
নির্বিকার চিত্তে ধুয়ে নেয় হাত সফেদ বেসিনে?
মনে হয়, অন্তরালে কারা যেন দেশ উজাড়ের
নক্শা আঁকে চুপিসারে, অবরুদ্ধ পালাবার পথ;
বোঝা দায়, নজর আটকে থাকে নিশ্চুপ শাদায়।
পুরানো কবরস্তান
কোনো কোনো জিনিশ রয়েছে, যা অত্যন্ত অনিশ্চিত,
হিশেবে পড়ে না, আগে থেকে বলবার কিছু নেই।
পুরানো কবরস্তান মাঝে মাঝে হানা দেয় মনে,-
তার মাটি আর ঘাস, গোরখোদকের প্রাত্যহিক
খাঁটুনি আমাকে টানে; কোনোদিন সেখানে আমার
গোর হবে কিনা আমি বলতে পারি না। রাত্রিবেলা
জোনাকিরা বংশপরস্পরা রক্ষা করে; অন্ধকারে
ভিখিরিরা ভিড় করে, আগরবাতির ধোঁয়া, ঘ্রাণ
পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠে আসমানে; ডানা-অলা কেউ
ছুঁয়ে যায় আলতো আমাকে, দিগন্তের কানে ঝরে
অস্পষ্ট গুঞ্জন আর বড় স্তব্ধ মৃতের বাজার।
ক্ষুধার আগুন নেই, নেই ধার কর্জের কার্যক্রম;
পুরানো কবর চায় নতুন বারিন্দা স্থানাভাবে,
অকস্মাৎ বৃষ্টিধারা মুছে ফেলে কিছু কিছু স্মৃতি।
পুরুষানুক্রমে
প্রায় পনের-ষোল বছর ধরে
সে দেখে আসছে নিজিশটাকে দেয়ালে টাঙানো।
গরিব ঘরের পুরানো অলংকার ভেবে
সে এতকাল ছুঁয়েও দেখে নি।
একদিন সে বস্তুটিকে নামিয়ে আনল মাটিতে।
ওর মনে হলো, মর্চে-পড়া
এক অস্ত্র তার মুঠোয়। ঘষে ঘষে
খসিয়ে ফেলল জং। চকচকে
হয়ে ওঠে সে কোন দূর পূর্বপুরুষের হাতিয়ার, যা হাতে নিয়ে
সে নাচে পূর্ণিমা-রাতে ঢাকের তালে তালে।
ওর দিন কাটে মাঠের কাজে। লাঙল ঠেলে
চিরে ফেলে মাটির বুক, বীজ বোনে,
সে, রৌদ্রর আঁচে ভাজা ভাজা,
নিড়ায় আগাছা আর দ্যাখে ওই আসছে আল বেয়ে
গামছা-বাঁধা ডাল-ভাত টুকটুকে লঙ্কা নুন নিয়ে নথ-পরা বউ।
ভাবে, কখন আসবে পূর্ণিমা রাত, যখন সে
নাচবে ঢাকের তালে তালে আর হস্তধৃত হাতিয়ারের
ফলা ক্ষণে ক্ষণে ঝলসাবে বন্য প্রাণীর চোখের মতো?
বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা
তুমি কি আমাকে এই মুহূর্তে ডাকছো খুব কাছে?
এখন তোমার কণ্ঠ থেকে বেরুচ্ছে না
কোনো শব্দ কিছুতেই। ওরা জালে আটকে রেখেছে
তোমার শব্দের পাখিদের, চোখ বেঁধে
রেখেছে আড়ালে, পাছে তুমি দেখে ফ্যালো
হঠাৎ আমার মুখ। এইতো কয়েক ঘণ্টা আগে দেখা হলো,
অথচ তোমাকে কত যুগ
দেখিনি। আমার
হৃদয় মাড়িয়ে যাও, তবু আমি আর্তনাদ করি না কখনো
ভুলেও, স্বপ্নেরা কলকলে আগুনের স্পর্শ লাগা
মৌচাকের মৌমাছির মতো
মরে থাকে চারদিকে। দ্যাখো আমাদের ভালোবাসা
নাম্না গাছটিকে আষ্টেপৃষ্টে
জড়িয়ে রেখেছে এক সাপ চক্রান্তের
কুণ্ডলীর মতো। বলো দেখি,
কী করে বাঁচাই একে ছোবলের বিষক্রিয়া থেকে?
এখানে আসবে তুমি শেষবেলা গায়ে
মেখে, চোখে নিয়ে
হরিণীসুলভ কবিতার খুব গাঢ় কোমলতা, বলেছিলে।
কী করে আসবে বুকে নক্ষত্রের মৃত্যু, নির্ভরতা,
নিরাপত্তাহীনতার করোটির জানাজার স্মৃতি
বয়ে, এ সড়ক বেয়ে? এতো দূর পথ, বারুদের গন্ধময়,
টিয়ার গ্যাসের জ্বালা সর্বত্র ছড়ানো,
পুলিশের হুইসিল, ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া,
কী করে আসবে তুমি পথচারীদের চোখে-মুখে
নাচিয়ে শাড়িরে জয়োল্লাস?
গোলাপ মুঠোয় দ্রুত ম্লান হয়ে যায় বলে
গোলাপ অনিনি। তুমি আসবে কি আসবে না, এই
দ্বিধা বার বার
কামড়ে ধরেছে, তাই রজনীগন্ধার পরিবর্তে আমি একা
হতাশা কিনেছি আর উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি সন্ত্রাস,
কতবার আমরা চালান হয়ে গেছি
গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে শ্বাপদের
মতো অন্ধকারে; আমাদের বেচে দেয়
ওরা অগোচরে
সামাজ্যবাদের কাছে। পুনরায় ঘাতকেরা শান্তির নিবাসে
ধানমণ্ডি লেকের এপারে।
বুলেটের ঝড় তোলে; ঘৃণা দিয়ে ওদের তাণ্ডব
থামানো যাবে না। বেচে আছি অস্ত্রহীন অসহায়,
ফ্যাসিবাদীদের মুখোমুখি। ফুল আর জ্যোৎস্না দিয়ে
বেপরোয়া ঘাতকের সঙ্গে আজ লড়াই করবো,
ওদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে কল্পনায়
সাজাবো রঙিন সেনা, কী করে সম্ভব?
এ সড়কে যেতে যেতে ভাবি,
কতবার এখানে চলেছে নির্যাতন পাশবিক,
কতবার বয়ে গ্যাছে রক্তস্রোত, তর তাজা ঘ্রাণ
এখনো ফোটায় গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত গোলাপ এখানে।
এ সড়কে কতবার পিতার বুকের হাহাকার,
থেঁতলানো সন্তানের মাথা নিয়ে বুকে
আর্তনাদ করেছেন মাতা,
স্বামীকে হারিয়ে কত বিপন্ন মহিলা হয়েছেন
উন্মাদিনী জীবনের প্রখর দুপুরে, কতবার অগণিত
বিশ্বাসঘাতক এ সড়কে ইশারায় আশ্রয়ের
একাগ্র আশ্বাস দিয়ে কত জীবনকে অঙ্গারে হাঁটিয়ে নিয়ে
পৌঁছে দিয়েছ খুনীদের আস্তানায়। এ সড়কে বেঈমান
সময়ের ধূর্ত ঘাড় মুচড়ে দিয়েছে রোদে-পোড়া সব হাত।
চলো না আমরা হাঁটি এ সড়কে পাশাপাশি, একটু দাঁড়াই,
চোখ ভরে দেখে নিই, শুনি
অশ্রুত অনেক গাঁথা বীরত্বের। রক্তাক্ত পায়ের ছাপ রেখে
সাজাই ফুলের তোড়া শহীদের পবিত্র উদ্দেশে।
যদি ওরা ডালকুত্তাদের
ভীষণ লেলিয়ে দেয় আমাদের দিকে, পরস্পর
চুম্বনে চুম্বনে মুছে দেবো ভয় ডর
সকল হিংস্রতা, এ রকম আলিঙ্গনে
মৃত্যু অনেক শ্রেয় নির্যাতিত মানুষের বর্ণনা করার
মতো শিল্প আমরা দু’জন
রেখে যাবো, বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা উত্তরাধিকার,
তুমি আসবে তো? দ্যাখো, সূর্য তার শেষ বর্ণচ্ছটা
তোমার আসার পথে বিছিয়ে দিয়েছে, যেন পারস্য গালিচা।
মানুষের মহামিলনেই মুক্তি, তুমি আসছো তো?
আমাকে দেখিয়ে ওরা বলবে সবাই, দ্যাখো যায়,
স্মৃতি স্বপ্ন বিলিয়ে বেড়ানো কবি যায়, মাথার ভেতর যার
হিরন্ময় লতাগুল্ম, গোলাপের বন, কণ্ঠস্বর কী স্পর্ধায়
আকাশকে ছোঁয়, যায় মানুষের হাটে,
কবি গিয়ে মিছিলের কাতারে দাঁড়ায়। মড়কের
ব্যাপক ভৌতিক হাহাকারে
তবকের মোড়কে নিঃশব্দে প্রেম এসে
থতোমতো খেয়ে ঠাঁই খোঁজে আমাদের হৃদয়ের ঝর্ণাজলে।
মানব বন্ধনে ভালোবাসা পেয়ে যাবে
প্রগতির সমঅধিকার, তার চোখে তৃষ্ণা, নক্ষত্রের গান।
এ সাহস পেলে হে কোথায়, অনেকেই প্রশ্ন করে। হেসে বলি,
আমার বুকের মুধ্যে ঘুমন্ত সিংহের মতো ছিল। চতুর্দিকে
আগ্নেয়াস্ত্র বড় বেশি ধমকাচ্ছে বলে
সে-ও চোখ পাকিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে এখন।
উন্মত্ত নির্মম ঝড়ে শৃংখলিত হতে পারে ক্ষণকাল, তবু
থামবে না তার মৃত দিনরাত্রি ঝাঁকানো গর্জন।
নিশ্চুপ থেকো না আর চলে এসো, অন্য কোনো পথ
নয়, এ পথেই চলে এসো হাওয়ায় উড়িয়ে চুল
জোর কদমের তালে তালে দুলবে তোমার স্তনভার, তুমি
মাধুর্যের নদী হয়ে বয়ে যাবে, যা আমার খুব
ভালো লাগে, যতোক্ষণ তুমি ছুঁয়ে না যাও আমাকে, ততোক্ষণ
পোড়া-খাওয়া মানুষের ভিড়ে ঝোড়ো হৃদপিণ্ড এবং
প্রতীক্ষা থরোথরো।
বিকেল তোমার ভালো লাগে
এই মাত্র বিকেল নেমেছে শান্ত, যেন উপত্যকায় শব্দহীন
গোলাপি এরোপ্লেনের অবতরণ।
আঙুরের মতো টসটসে কোমলতা চতুর্দিকে,
তোমার মধ্যে কী এক পরিবর্তনের ঝালর।
এই বিকেল চুমোয় চুমোয়
আচ্ছন্ন করে তোমাকে, তুমি নিজেকে সমর্পণ করো
বিকেলের হাতে, অনেক কিছু করার ইচ্ছে
তোমার ভেতরে নক্ষত্রের মতো জ্বলতে থাকে, অথচ কিছুই
করা হয় না। হাতের চিরুনি হাতেই
লগ্ন, নিশ্চল; চুল
ফুঁসতে থাকে জ্যৈষ্ঠের মেঘের মতো, তুমি
আয়নার সামনে নিঃসাড়। চুল আঁচড়ানো
স্তব্ধতায় স্থির, বিকেলে
গদ্য কবিতার চাল।
কখনো ছুটে যাও বারান্দায়, অবিন্যস্ত; আকাশ
ঝুঁকে থাকে তোমাকে
স্পর্শ করবে বলে। বাতাস জড়িয়ে ধরে
তোমাকে আঙুরলতার ধরনে আর
আমার আলিঙ্গনহীন আলিঙ্গন ছায়ার মতো
ঝোলানো রেলিঙ-এর ধারে। তোমার শরীরে
সেই ছায়া কাঁপতে কাঁপতে লেপ্টে যায় তোমার
অজ্ঞাতসারে, চাঞ্চল্য তোমাকে সার্কাস-সুন্দরীর
মতো নাচায়। বিকেল ওস্তাদ আলী আকবর খানের
পুরিয়া ধানেশ্রী হয়ে চুমুকে পান করে তোমার দেহলাবণ্য
বিকেল বললেই মনে পড়ে রেশমি রোদমাখা বটগাছ
এমন একটি বাড়ি যার প্রধান দরজার
ওপর পাথুরে সিংহ, চোখ-পাকানো, টানটান পেশী,
যে কোনো মুহূর্তে হতে পারে প্রাণবন্ত।
তুমি ছটফটিয়ে সময় কাটাও যেন
জালে আটকা পড়েছে হরিণী। কিছুতেই
ভেবে পাও না, কী তুমি করবে
এই মুহূর্তে যখন বিকেল বাঁশির সুর হয়ে
তোমাকে ডেকে যায় ঝাউবনের অযাচিত স্মৃতি নিয়ে। ঘর ছেড়ে
পা বাড়ানো আর না বাড়ানোর ভাবনায়
চেয়ারে বসে পা দোলাও
কিছুক্ষণ, তোমার দু’টি কাজল সাজানো চোখে
কোন দূর শতাব্দীর সঞ্চিত মায়া
মঞ্জুরিত। যে চুম্বন আমি মুদ্রিত
করে দিতে চাই তোমার ঠোঁটে বারংবার
আমার অনুপস্থিতিতে সেগুলোর অপচয়ের দাগ লেগে থাকে
বিকেলের গালে। তোমার পায়ের ঠোকরে
ওড়ে চুম্বনের ছাই। এই মন কেমন করা বিকেলে
আমার জন্যই তোমার মন উড্ডয়ন প্রিয়
পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে কিনা,
জানি না।
প্রজাপতির মতো যার গোঁফ, সেই ফেরিঅলা
ডেকে যাচ্ছে এখন, তুমি তার ডাকের প্রতি
উদাসীন শুয়ে আছো বালিশে চুল এলিয়ে,
চুল উড়ছে পাখার হাওয়ায়। এই বিকেল গান গায়,
তার সুরে পাতা ঝরে। অস্থিরতা তোমাকে বেশিক্ষণ
থাকতে দেয় না বিছানায়। আমার কথা যাতে মনে
না পড়ে, সেজন্যে বইয়ের পাতা উল্টে পাল্টে
রেখে দাও টেবিলে, আদর করো সন্তানকে। তবু আমি
তোমার ভুলে-থাকার মেঘময়তাকে
উড়িয়ে ডেকে উঠি, যেমন তেজী নাবিক ‘ঐ যে শ্যামল মাটি
যাচ্ছে দেখা’ বলে উল্লাস ছুঁড়ে দেয় হাওয়ায়।
কতকাল ধরে এই বিকেল একটা ম্যুরাল এঁকে চলেছে
তোমার সত্তায়। রঙের নিচে চাপা
পড়ছে কত রঙ, সবাই দ্যাখে ত্বকের বাহার। দেখে নিতে চাই
সেই মুহূর্তটিকে, যখন তুমি কনে-দেখা আলোয়
ফ্রক ছেড়ে প্রথম শাড়িতে লুকোতে চেয়েছিল থরোথরো
তোমার মুকুলিত যৌবন এবং যে-রাতে
তোমার রুসমত হয়েছিল, আয়নায় ভেসে উঠেছিল
উপটন আর বেলফুলের ঘ্রাণময় নথ-পরা মুখ; সোহাগ রাতে
নক্ষত্রগুলো খুব নিচে ঝুঁকে তোমাদের ওপর
জাল বিছিয়ে দিয়েছিল কিনা, ঢোলকের বোল শুনে
চাঁদ নৌকা হয়ে বাসরে ভেসে
এসেছিল কিনা, জানতেই হবে। নইলে সিন্ধুশকুনের
ঝাঁক আমাকে ঠুকরে ঠুকরে কোপ্তার গোশত করে ফেলবে।
বিকেল তোমার ভালো লাগে; অসহ্য এই ভালো-লাগা
তোমাকে বের করে আনে ঘর থেকে, তুমি পা বাড়াও
কোলাহলের সামনে। তখন লালসার লকলকে জিভের
লেহন থেকে
হিংসার বিষদাঁত আর খুনী নখ থেকে,
ঘেন্নার নিষ্ঠীবন আর থকথকে পিচুটি থেকে কী করে
আড়ালে রাখবো তোমাকে?
তখন আমার পাশে অথবা মুখোমুখি
তুমি থাকো না, যেমন নিঃস্পন্দ শরীরে
থাকে না শ্বাস প্রশ্বাস।
বিচ্ছেদের ভার
দুঃখ হলো, বড় দুঃখ হলো তোমাকে ওভাবে হেঁটে
যেতে দেখে মঞ্চের উদ্দেশে। জানতাম
পরাস্ত দেবদূতের মতো
তোমার ডানায় অপবাদের কর্দম, তাল তাল, নিয়ে তুমি
অপ্রস্তুত আসবে নেমে। ইচ্ছে হয়েছিল
আগলে দাঁড়াই পথ, এখানে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।
ততক্ষণে তুমি পৌঁছে গ্যাছো
মাইক্রোফোনের মুখে, যেমন একাকী পাখি ফাঁদে।
যে আশংকা সেই কবে থেকে কুরে কুরে
খাচ্ছিল আমাকে, অবশেষে তা ই হলো, অমাবস্যা করে গ্রাস
আমাকে হঠাৎ, তুমি ঠিক ঝাউপাতা
হয়ে কেঁপে কেঁপে লোক হাসালে সভায়।
জানতাম তুমি পড়বে না সে কবিতা, দ্যুতি যার রূপবতী
তন্বীর দৃষ্টির মতো, যার নিরালায়
অমর্ত্য ফুলের স্মিত সুবাস ছড়ানো থাকে, যার
টোকা শুনে খুলে যায় স্বর্গের কপাট। কণ্ঠস্বর
হৈ-হল্লায় ডুবে যাবে ভেবে ভুল নির্বাচনে নিজেকে জড়ালে
অবলীলাক্রমে, গলা ফুলিয়ে সরিয়ে
কোকিলকে খুব দূরে ডেকে এনে কাদাখোঁচাটিকে
নাচালে তুমুল।
একলা দাঁড়িয়ে মঞ্চে তুমি
তোমার নিজস্ব কথা বলতে পারোনি, আমাকে যে
ভালোবাসো, বেহিশেবী জুয়াড়ীর মতো
আমার উদ্দেশে ফেলো সব দান, সে কথাও হায়
মুলতুবি রেখেছিলে, লোকলাজ গিলে খেলো তোমাকে এবং
তাচ্ছিল্যের ফুঁয়ে ওড়ে আমার একান্ত অশ্রুপাত।
এ রক্তক্ষরণ ফুসফুসে নিয়ে বসে আছো একা
চুপচাপ কবিতা মেলায়
তা আমার জানা আছে কিছু;
আর দশজন জানতে ও চাইবে না, মেলা ভেঙে
গেলে পরে যে যার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে,
তুমি আর আমি পাশাপাশি হেঁটে যাবো। আমাদের
নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই, শুধু
বিচ্ছেদের ভার বওয়া আছে, আছে হ্রস্ব পর্যটন।
ভালোবাসা ছাড়া
মেঘে মেঘে বেলা কম হয়নি, অত্যন্ত অভিমানী
আর্কিডেরা মুষড়ে পড়েছে। নিষাদের
তীরের ফলায় বিদ্ধ ষাটটি হরিণ গোধূলিতে
পা ছুঁড়ে, কাঁপিয়ে দশদিক
আর্তনাদ করে; হৃদয়ের তলদেশ
থেকে বাণী জেগে ওঠে-ভালোবাসা ছাড়া আমি বাঁচতে চাই না।
আমাকে জাগিয়ে রাখো তুমি, শুনি ঝিঁ ঝিঁ
পোকাদের ডাক, মাঝরাতে
জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছি বড় একা
এবং আমার ভালোবাসা ফাটা শার্সি ধরে ঝুঁকে
ফেলছে চোখের পানি নীরবে অঝোরে;
জানতেও পারো না কখনো। প্রৌঢ়ত্বের সাহারায়
বয় না সুস্নিগ্ধ হাওয়া, বালুকণা চোখে
লেগে রয়। অঙ্গারের বিছানায় পুড়ে পুড়ে ছাই
হয়ে যাই সারারাত। তোমার শরীরে
অদৃশ্য চন্দন-প্রলেপের
সুবাস জড়ানো তুমি নিশ্চিন্ত ঘুমাও।
আমার দু’চোখে কাঁটা বিঁধে থাকে, পলক পড়ে না।
আমরা কি কিছুদিন থাকতে পারি না
একসঙ্গে কোথাও, যেখানে
আমাদের কোনো পরিচয় থাকবে না, কোনো পাখি
কৌতূহলে ক্ষিপ্ত হয়ে দেবে না ঠোকর
বারবার আমাদের সান্নিধ্যকে? নির্মেঘ আকাশ
সাজবে আকর্ষণীয় সাজে, দূর থেকে
আসবে ভেসে গান সামুদ্রিক ঝকঝকে
বিছানায় যখন থাকবো শুয়ে পরস্পর মদির জড়ানো
নাকে নাক ঘষবো, যেমন পাখি পাখিনীর
চঞ্চু নিয়ে খেলা করে, আর
তোমার কপালে নেমে-আসা চুল দেবো
আলতো সরিয়ে, কালো দু’চোখ তোমার
আকাশে উড্ডীন পাখি যেন সন্ধ্যেবেলা, জাল থেকে
বহুদূর পলায়নপর, নিরাপদ
নীড়ের সন্ধানে দিশেহারা; আমার আত্মাকে চিরে
কেউ স্বরহীনতায় উঠবে ডেকে হুহু,
তখন তোমাকে আরো জোরে আলিঙ্গনে
বাঁধবো নির্জনতায়। আমাদের যুগ্মতাকে ছুঁয়ে
যাবে চুপিসারে
ঝাউয়ের মর্মর, আদিগন্ত তোমার ভালোবাসায়
কেমন রঙিন হয়ে উঠবে প্রহরগুলি, নিমেষে যযাতি
হবে পুরূরবা; হায়, কখনো কি আসবে সেদিন?
ডুবুক তোমার মধ্যে আমার সকল স্বপ্নতরী,
তোমার তাচ্ছিল্যে বাসনার রক্ত গোলাপকে দখল করুক
কীটরাশি, আমার কবিতাগুলি সমাহিত হোক
হৃদয়ে তোমার। যদি ছুঁতে পাই, যৌবনের ওষ্ঠ থেকে চুষে
নিতে পারি চুম্বনের স্বাদ মাঝে মাঝে ধুনরির
মতো যদি তীব্র ধুনে নিতে পারি তোমার শরীর
তাহলে কি বলা যাবে পেয়েছি তোমার
ভালোবাসা? এসে গেছে আমার মুঠোয় অমরতা?
বলো, কেন এমন হয় না,
কোনোদিন আসবে না বিদায়ের প্রহর, আমার
হৃদয়ের চোখ
ফেটে নামবে না অশ্রুধারা, যেতে-যেতে
অকস্মাৎ তুমি ফিরে আসবে আবার, মিলনের মুদ্রা তৈরি
করে দ্রুত লুকিয়ে আমার বুকে মুখ
বলবে, ‘যাবো না;’ এই ধ্বংসাবশেষকে
বানিয়ে তুলবে অলৌকিক অট্রালিকা।
ভালোবাসা ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না,
পারবো না কস্মিনকালেও।
ভুল হতে পারে
লুকাতে গিয়েও আমি লুকাতে পারি নি। গোধূলিতে
ক’জন হননপ্রিয় লোক
আমার চুলের মুঠি ধরে হুড় মুড়
বের করে আনে
ঝোপঝাড় থেকে বলে, নে কাদা চেটে নে’। অসহায়
চেয়ে দেখি অমাবস্যা চতুর্দিকে, প্রেতনৃত্য চলে
প্রহরে প্রহরে। লোকগুলো ঝটপট
পরে নেয় ঘাতকের কর্কশ মুখোশ,
শানায় খঞ্জর বার বার। তালতাল
কাদায় কেবল খাবি খাই, লাথি মারে চামচিকা।
নরখাদকের ভঙ্গি ঘাম চিকচিকে
শরীরে তাদের, চোখে মুখে
হননের অসুস্থ উল্লাস। কাদামাখা
ঠোঁট কাঁপে আমার সর্বদা
তৃষিত পাখির ক্ষীণ চঞ্চুর ধরনে, অন্য কেউ
মনে হয় নিজেকে, ছায়ার
সহচর, পরাজয় অনিশ্চিত জেনে
হঠাৎ শরীরে ঝাঁকি দিয়ে কাদা থেকে
মুখ তুলে সটান দাঁড়াই, অমাবস্যা ফুঁড়ে রোগা
চাঁদ এসে চুমো খায় নরকংকালের স্তূপে, আমি
জয়চিহ্ন এঁকে দিই প্রতিটি গোলাপে। শত শত
গোলাপ সুন্দরী থাকে বীরের অধীর প্রতীক্ষায়।
ভুল হতে পারে, তবু
বিশদ বলার মতো কিছু একটা রয়েছে জানি।
ভূমিকম্প
খবরটা এভাবেই মুখে মুখে রটে পাড়া থেকে
পাড়ায়, এই যে শুনেছেন,
না ভোর না রাত এরকম সময়েই কেঁপেছিল
খাট, যেন বুড়ো মানুষের
কাশির দমক, মাথা টলমল, তার আগে
গাছ ছেড়ে পাখিরা আকাশে
উড়ে গেল, বেড়াল পা ঝাড়া দিয়ে জেগে
উঠেছিল সাত তাড়াতাড়ি। বহুদিন এরকম
ভূমিকম্প হয় নি বস্তু। কী-যে ভয়
পেয়েছিল লোকজন বাসকির ফণার দোলায়।
যখন আমার দিকে তুমি
তাকাও দু’চোখ মেলে, হৃদয়ের ভেতর মহলে
ভূকম্পন অনুভূত হয়, ক্রমাগত ভাঙচুর
হতে থাকে; দরজা, খিলান, ঝাড়বাতি ভীষণ গুঁড়িয়ে
যায়, এ খবর আমি ছাড়া কেউ রাখে না কখনো।
মর্গে আছে
হাওয়া ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পাঠায় মেঘকে নিরুদ্দেশে।
আকাশ কি পুড়ে হবে ছাই? এই সোমত্থ দুপুর
গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা হবে, জ্বলবে না কুপি আজ
অসংস্কৃত খোলা ঘরে। কুকুর ক্রন্দনরত ফাঁকা
উঠোনে, শ্মশানে ভাঙা হাঁড়িটার পাশে বুঁদ হয়ে
পড়ে আছে ক্লান্ত ডোম, ভাসমান গলাকাটা চাঁদ।
ডুঁহু ডুঁহু ডাক ঘোরে আশেপাশে; ডোবা থেকে উঠে
আসে নড়বড়ে পদক্ষেপে সবুজ কংকাল, তার
নিঃসঙ্গতা চুঁইয়ে পড়ছে পানি। যাবে সে কোথায়?
পায়ে লেগে বেজে ওঠে স্খলিত নূপুর, সময়কে
চিরে টেন যায় যাত্রীহীন; কার মন ভালো নেই?
এ সওয়াল মাথা কোটে মাটির দেয়ালে। যাও, যাও
এবার ফিরিয়ে আনো তাকে। কাকে? দিকগুলি খুব
একরোখা নিরুত্তর। মর্গে আছে যুবতী ডোমিনী।
মৃত্যু উৎসবে
শ্বাপদের চেয়ে শতগুণ বেশি
এখন হিংস্র যারা,
মানুষের তাজা কলজে চিবিয়ে
খেতে চায় আজ তারা।
ড্রাগন-বীজের ভেতর থেকেই
বের হয় কংকাল;
যুদ্ধং দেহি তলোয়ার হতে,
নাচে অবিরত ঢাল।
প্রতিপক্ষের যোদ্ধার বেশে
এসেছে অন্ধকারে;
ঘোর আক্রোশে ওরা ঝাঁক ঝাঁক
বল্লম ছুঁড়ে মারে।
অশুভের হাতে গচ্ছিত রেখে
বিবেকের পুঁজিপাটা
তেড়ে আসে শুধু হুঙ্কার ছেড়ে,
ছড়িয়ে বক্র কাঁটা।
হয়তো ওরাই নিজেরা অশুভ,
ডেকে আনে ক্রন্দন।
চক্ষুবিহীন চক্ষে তাকায়,
জনপদ হয় বন।
প্রপিতামহের রক্ত শিরায়
মিশিয়ে দিয়েছে বিষ,
সে বিষের খল ক্রিয়ায় আমরা
মরছি অহর্নিশ।
হা পোড়া কপাল, অস্ত্র ছাড়াই
এখানে লড়তে হবে;
গেয়ে যেতে হবে প্রাণের দীপক
মৃত্যুর উৎসবে।
যখন তোমার সঙ্গে
যখন তোমার সঙ্গে কথা বলি টেলিফোনে, ভয়ে
ভয়ে থাকি, পাছে অকস্মাৎ ছেদ পড়ে
তোমার কথার ট্যাপেস্ট্রিতে।
বলা তো যায় না,
যন্ত্রের ব্যাপার, ক্ষ্যাপামির খ্যাতি তার
এ শহরে আজকাল বড়ই ব্যাপক।
টেলিফোনে ভেসে এলে কখনো তোমার
কণ্ঠস্বর, মনে হয় যোজন যোজন দূরে তুমি;
কথারা মেঘের মতো ছুঁতে গিয়ে ছোঁয় না আমাকে।
এ রকম ভঙ্গি ফোটে কথায় তোমার,
যেন কেউ আড়ি পেতে আছে, নিচ্ছে টুকে অন্তরালে
তোমার সকল কথা। আবীর তোমার গালে ছড়িয়ে পড়েছে,
ভেবে নিতে পারি; কখনো বা
অনুমান করি, ব্রত নিয়েছো নীরব থাকবার। মিনিটের
পর কত মিনিট নিথর কেটে যায়,
স্তব্ধতা ওঠে না বেজে এস্রাজের সুরে। অর্ন্তগত
হরিণকে বেঁধে
রেখেছো রজ্জুতে, তার খুরে উড়বে না
রাঙা ধুলো; ইচ্ছে হয় কথা দিয়ে তোমাকে সাজাই,
কিন্তু আমি নিজেও নির্বাক, ছন্নছাড়া
যন্ত্রের ভেতরে যদি পারতাম নিভৃতে চালানা
করে দিতে কিছু জ্যোৎস্না অথবা রোদ্দুর।
টেলিফোন রেখে বসে পড়বো ঠিক কবিতা লিখতে,
কেননা আমার মন নাছোড় খারাপ হয়ে যাবে।
রুক্ষ বৃক্ষ
শীতার্ত নিষ্পত্র বৃক্ষমূলে কে পাতে আসন, বলো?
ভুলে কেউ বসে, বয় দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলো ছলো।
হু হু ডাল; ঘন্টাধ্বনি বাজে কোথাও ধূসর দূরে,
রুক্ষ বৃক্ষ মর্মরিত অবচেতনের সুরে সুরে।
রেললাইনের কাছে
রোজ আমি রেললাইনের ধারে রেললাইনের কাছে যাই
সন্ধ্যেবেলা। খানিক দাঁড়াই,
আশেপাশে দৃষ্টি মেলে দেখি কী কী আছে-
বনকুসুমের শোভা, ঝোপঝাড়, কতিপয় গাছে
গহনতা কী নিবিড় উপবিষ্ট; এখানে এসেছি কতবার,
অথচ কখনো কোনো রেলগাড়ি আসা কি যাবার
সময়ে দেখি নি। শুধু রেললাইনের খাঁ খাঁ ভাব বুকে নিয়ে
ফিরে গেছি একা একা। জায়গাটা বিলিয়ে
যাচ্ছে ক্রমাগত স্তব্ধতার কাশফুল। একজন খর্বকায়
লোক স্যুটকেশ হাতে আস্তে হেঁটে যায়
রেললাইনের পাশে, পেছনে পেছনে কে রমণী রূপ
জ্বেলে পথ চলে কেমন নিশ্চুপ।
ভাবি, ওরা কে জানে কোথায়
যাবে, হয়ত কিছু পরে হঠাৎ হারিয়ে যাবে ঘন কুয়াশায়।
এখানে কে আসতে বলেছিল এ বেলাশেষে
এরকম জনহীনতায়, যেখানে প্রায়শ ভেসে
আসে পথ হারানোর সুর,
যেখানে নিঠুর
দরদী সে কবে চাবি ফেলে চলে গেছে অন্তরালে?
আমি মুক্তো খুঁজি মজা খালে।
পরকীয় প্রেমের মতই কষ্ট বুকে লেগে থাকে;
কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে, জলজ উদ্ভিদ যেন। আর্ত পাখি ডাকে
বারবার; আমার কি কোথাও যাবার নেই? ফিরে
আসা কাছে শুধু এক নির্জন কুটিরে,
যেখানে ক্ষতের মতো বাতি
জ্বলে, কারো পদধ্বনি শোনার আশায় কান পাতি
কী উদ্গ্রীব। একদিন ট্রেনের শব্দ কানে
আসে, ছুটে গিয়ে দেখি রেললাইনের চিহ্ন নেই কোনোখানে।
শুধু একা একা
এখানে এ জনশূন্যতায় বসা যায় কিছুক্ষণ। দ্যাখো, সূর্য
শ্মশানের মাতাল ডোমের মত ঝিমুচ্ছে এখন।
যখন এসেই তুমি পড়েছ এখানে,
তাহলে কী হবে বুকে দ্বিধার পাথর নিয়ে এমন নিশ্চুপ
হয়ে গেলে? এসো, বসি এই নদীতীরে।
কিছু কথা, কিছু নীরবতা আপাতত আমাদের ঘিরে থাক।
ভয় নেই, হে মেয়ে, তোমাকে ভোগ করার লালচে
এখানে আসি নি। যদি হাত ধরি আলগোছে, ছুঁই
স্তন কিংবা চুমো খাই, তাহলে কি তোমার ভাষায়
এ সব নিছক ভোগে অনূদিত হবে?
মনে হয়, এই বুঝি তুমি ছেড়ে ছুড়ে
তোমার সকল আবরণ জলকন্যা হয়ে নেমে
যাবে কালো গহন নদীতে
ভাষাহীনতায়, হতবাক চেয়ে থাকব দূরে,
ডাকব স্বরহীন কণ্ঠস্বরে, তুমি তাকাবে না ফিরে
একবারও। কুয়াশার জাল
সরিয়ে বিস্ময়ে দেখি, এখানে কোথায় কেউ নেই।
আমি শুধু একা একা বকে যাচ্ছি, চোখে লাগে শ্মশানের ধোঁয়া।
শুরু
জানালার বাইরে দৃষ্টি চালান করে
সে ভাবলো, একী কাণ্ড, বেলা তো কম হলো না,
এখনো তার শুরু করাই হয় নি
মাথায় জোর তুষার ঝড়, দাঁতে ক্ষয়,
হাতের শিরাগুলো মুখ ভ্যাংচায় লাগাতার,
অথচ সে আজো শুরুই করতে পারে নি।
হতাশা বাদুড় হয়ে ঝুলতে থাকে, খুঁজে নেয়
অন্ধকার; চুল ছিঁড়ে, হাত কামড়ে
কোনো সমস্যারই কূলকিনারা করতে না পেরে
সে ভীষণ একলা। ফলাফলের কোঠায়
শূন্য তাকিয়ে আছে
নিঝুম উদাসীনতায়। এবার কী করে
ঠিকঠাক শুরু করা যায়, এই ভাবনা
তাকে বসিয়ে রাখে
অনেকক্ষণ। কোত্থেকে কালবোশেখির
ঝড় হঠাৎ সব কিছু
ওলট পালট করে ফেলে, তরী তীরে এসে
পৌছুনোর আগেই হলো ভরাডুবি।
কোথাকার এক পাখি ঘরের কোণেই ছড়ায়
স্বর্গীয় সুর, অনেকদিন
অপেক্ষা করা হলো। কপাল ঠুকে শেষবারের মতো
চেষ্টা করা যাক, হয়তো পাখির গান শুনে
অথবা খাটে লুটিয়ে-পড়া
জ্যোৎস্নালতা দেখে সে এতদিনে পারবে
শুরু করতে। এখন তার স্বপ্ন আর বাস্তবের
টুকরো টাকরা সম্বল করে শুদ্ধতা-মোড়া
পাখি ওড়ানো; আজ গেল, কালও গেল,
কিন্তু শুরু করাটাই এখন বাকি।
সে আসুক
কতকাল আর ঠ্যাকা দিয়ে রাখা যায় ভীষণ পতনশীল
ঘরবাড়ি? এদিকটা সামলাও যদি,
সামলাতে পারো যদি,
সামলাতে পারো কায়ক্লেশে, অথচ ওদিক দ্রুত
হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। ক্ষয়গ্রস্ত
অতীতের ভিত, একালের পলাস্তারা ঝরা পাতা,
ভবিষ্যের খিলান অস্পষ্ট অতিশয়। বাসিন্দারা অনেকেই
উদাসীন; কেন তুমি নিরর্থক এই ভগ্নস্তূপে
বসে আছো গানহীন পাখির মতোন
কোন্ সে আশায়? দূরে কুয়াশায় কারা হেঁটে যায়?
ওরা কি শবানুগামী? কনকনে শীতে
জমে গেছে মাতমের ধ্বনি। কেউ কি পারে না ফের উৎসবের বোল তুলে
এ কাল সন্ধ্যায় জ্বেলে দিতে আলো?
কী করে বাঁচবে কেউ এভাবে এখানে,
যেখানে মেধার দ্যুতি নেই, গুমরানি আছে, গান নেই; দশদিকে
মূর্খের প্রলাপ শুধু, অবলুপ্ত জ্ঞানের প্রলেপ?
যে শতকে ঘরে ঘরে রিরংসার নৃত্য অবিরাম, ভালোবাসা
দরজার বাইরে দাঁড়ানো, আস্তে হাত থেকে খসে যায়
স্নিগ্ধতার উৎফুল্ল মুকুল,
চোর ডাকাতের সঙ্গে এক দড়িতেই ফাঁসি দেয় মহত্বকে
অত্যন্ত কর্কশ দস্যু এবং সত্যের গলা বার বার চেপে
ধরে কদাকার হাতে মিথ্যাচার, সে নিষ্ঠুর, বড় ভয়াবহ
শতকেও অসহায়, সন্ত্রস্ত মানুষ পথ হাঁটে,
খায় দায়, ভালোবাসা পেতে চায়, লুকিয়ে চুরিয়ে ধুলোমাখা
সেতার কী ব্যগ্র খোঁজে, বাঁচবার তীব্র সাধ বুকে লগ্ন তার।
কেউ কেউ ভগ্নকণ্ঠে বলে, ‘সে আসুক’। কে সে যার
প্রতীক্ষায় টেরাকাটা মূর্তির ধরনে সকলেই
স্তব্ধ হয়ে আছে দিগন্তের দিকে চেয়ে এমন উৎসুক? কারো
অন্য কোনো উৎসাহ, উদ্যম নেই যেন
বিরতিহীন এই প্রতীক্ষা ব্যতীত। তুমি, হ্যাঁ তুমিও গালে
হাত দিয়ে দেয়ালে ঠেকিয়ে পিঠ নিশ্চুপ, নিঃসাড়
হয়ে আছো, প্রায় বজ্রাহত। এদিকে তো পুনরায়
প্রাগৈতিহাসিক জন্তু, অতিকায়, ভয়ঙ্কর, মুখের গহ্বরে
তার নিচ্ছে পুরে একে একে
সৃজনের যাবতীয় উপাদান অকাতরে। তবু প্রেতজব্দ মানুষেরা
ভাবলেশহীন; ফিসফিসে কণ্ঠে বলে-
‘একটু অপেক্ষা করো, জ্বালো না প্রদীপ, সে আসুক’।
কে সে? কে সে? অলৌকিক কেউ? আসবে ময়ূরপঙ্খী
ভাসিয়ে গহীন গাঙে? সে কি
হাওয়াই জাহাজ থেকে প্যারাসুটহীন
নামবে জমিনে নীলিমার উল্কি নিয়ে রঙিলা সত্তায় তার? এ সওয়াল
কখনো উতলা করে কাউকে কাউকে,
অথচ জবাব নেই এখনো কোথাও। আছে শুধু স্থবিরতা,
জরাক্লিষ্ট রাজা যেন। হাতে দেশলাই
নিলে কেউ সকলেই বলে সমস্বরে, ‘শোনো, আরো
কিছুকাল দেখা যাক, সে আসুক’। বুঝি ওরা অন্ধকার
চাদরের মতো ব্যবহার করে যেতে ভালোবাসে।
না কি আজ হঠাৎ এদের কেউ প্রতীক্ষার গালে
চড় মেরে ফস্ করে জ্বেলে দেবে দীপ? নাচবে নক্ষত্রমালা।
সে এক পরবাসে
যা কিছু আমার প্রিয় সব ছেড়ে ছুড়ে পরবাসে
এসেছি হঠাৎ, বড় ফাঁকা লাগে, বড় একা-একা।
কারো বসে-থাকা, চকচকে চোখ তাকানো এবং
নিঝুম আনত মুখ, নতজানু কেউ; সন্ধ্যারাতে
মায়ের জরিয়ে ধরা, সুরা
পড়ে ফুঁক দেয়া এই আমার সত্তায়,
বেদনার ছায়া মুখে কনিষ্ঠ কন্যার আস্তে সুস্থে
সুটকেশ নিপুণ গোছানো, উদাসীন কারো অব্যক্ত বচন,
এসব সে কবে ঘটেছিল মনে হয়।
দুপুরে বন্ধুর দেয়া স্যান্ডুইচ, কোকাকোলা; সাত তাড়াতাড়ি
হেঁটে যাওয়া টিউব ষ্টেশনে, পড়ি বিজ্ঞাপন, পাতালে
দেয়ালে
ইয়েটস-এর পংক্তিমালা, চমকানো। কখন পৌঁছুবো
পিকাডেলি সার্কাসে? নেমেছে ঝুপ সন্ধ্যা, ফুটপাতে
হেঁটে যেতে যেতে দেখি এ কি এখানেও
আধখানা চাঁদ, আকাশের কানে দুল।
কত জনপদ আর সমুদ্র, পর্বত
ডিঙিয়ে চাউনি তার, চুম্বনের ঘ্রাণ,
হাতের ব্যাকুল ছাপ ছুঁয়ে যায় বার বার। ফিরে
আবার পাবো তো তাকে যেমনটি চাই? যদি ফেরা
না হয় কখনো আর? মৃত কবিসংঘ দেখে রাতে
আটাশে এডিংটন ড্রাইভে উদ্দীপ্ত ফিরে আসা।
মনে পড়ে দূরে ফেলে-আসা গলি, মিনি
সুপার মার্কেট অতি সাধারণ, বাসার কাছেই
খুর্বুটে দোকানদার, যার টকটকে লাল দু’টো
চোখ সিগন্যাল বাতি, হাসি আন্তরিক; প্রেমে-পড়া ঘুর ঘুর
তরুণ কুকুর মহল্লার, বাতিজলা রাতের কলোনী আর
পথিকের আসা-যাওয়া, যুগল কবর,
টিএসসি সড়ক দ্বীপ, মুখর কবিতা পরিষদ।
ছায়াচ্ছন্ন সিঁড়ি, টুকরো কথা, হাসি মনে পড়ে, মনে পড়ে।
শামসুর রাহমান সঙ্গেই আছেন সর্বক্ষন; চুপচাপ
প্রায়শঃই, মাঝে-মধ্যে গল্প, কখনো মাতেন তর্কে, গানে,
থিয়েটারে সিনেমায় যান,
বৃটিশ মিউজিয়ামে পড়েন ঈষৎ ঝুঁকে ক্ষীণায়ু কীটস-এর
উজ্জ্বল চিরায়ু পাণ্ডুলিপি,
হেঁটে যান মিসরীয় যুগে, অতীতের সামগ্রীতে
বেজে ওঠে শব্দহীন কলবর, শনেন কাব্যিক
অনুভবে।
ছিঁড়ে খান খান করি অমোঘ স্মৃতির তন্তুজাল।
তবু এক হাহাকার তাকে করে ম্রিয়মাণ, বুকে
গহন তলানি জুড়ে কবিতার কলকলানি কেবল,
অথচ নিষ্ঠুর হিমে জমে যায় শব্দের স্পন্দন।
দেখি তার অসহায়তার ছায়া দ্রুত আমাকেও
করে গ্রাস, সম্ভাবনাময়
আত্মহত্যা কম্বল সরিয়ে দেখে নেয়
চকিতে আমার মুখ, ভীত
ভীষণ সিঁটিয়ে থাকি বিছানায় তার ছায়াতলে।
হঠাৎ পাওয়া
এইতো তুমি একটু আগে
ছিলে আমার পাশে;
তোমার সুবাস স্মৃতির মতো
হৃদয় জুড়ে ভাসে।
তোমার মুখে কিসের ছায়া
নাছোড় ঝুলে আছে?
জানলা ওঠে ঝনঝনিয়ে
চিড় ধরেছে কাচে।
মিছেমিছে মনোভারে
ডুবছো বালির নিচে;
আমিও পারি দৌড়ে যেতে
হেসে তপ্তপীচে।
নেই যে মানা রঙ-তামাসায়
আজো উঠতে মেতে,
তোমার সঙ্গে বিকেলবেলা
পারি ফুচ্কা খেতে।
বয়স বটে ষাটের কোঠায়
চিবুক ধরে থাকে,
মন চলে যায় ছেলেবেলার
সুদূর নদীর বাঁকে।
এলেবেলে ভয়তো আছেই,
বলে অচিন পাখি।
তোমার কথা ভেবে ভেবে
শান্ত বসে থাকি।
ঢুলুনি হায় পেয়ে বসে,
তাড়াই মনের মাছি;
তোমার ছুঁতে পারি বলেই
বেঁচে বর্তে আছি।
বেঁচে থাকার মধ্যে কত
ঝুট ঝামেলা জোটে,
তবু কিছু হঠাৎ-পাওয়া
তারার মতো ফোটে।