বহু প্রতীক্ষার পর
আজ নয়, অন্য কোনওদিন এসো, আজ
ভিন্নতর কাজ আছে; একজন জাঁদরেল সমালোচকের
সঙ্গে কিছু জরুরি আলাপ আছে। হয়ত এক্ষুনি
এসে পড়বেন তিনি; কখনও নিকট
আগামীতে অবসর মুহূর্তে তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কথার
জাল বোনা যাবে-
এইটুকু ব’লে তাকে তাড়াতাড়ি প্রায়
দরজা থেকেই কেঠো হাসি হেসে দিলাম বিদায়। নীরবে সে
চলে গেল হেঁটে আর সুস্নিগ্ধ হাওয়ায়
ঝুলে থাকে ওর পায়েলের অনুরণন কেবল।
অত্যন্ত দুঃখিত, আজও তোমাকে সময়
দিতে পারছি না কিছুতেই; দেরিদা বিষয়ে সদ্য কেনা বই
এখন আমাকে তীক্ষ্ণ কামড়ে ধরেছে। কথা দিচ্ছি,
কাল শুধু তোমাকেই করব অর্পণ সবটুকু
সময় আমার, ক্ষমা করো আজ। মুখ ভার ক’রে
আস্তে হল্কা-ছড়ানো দুপুরে পথে নেমে যায় সে বাতাসে আঁচল উড়িয়ে।
কী ক’রে দেখাই মুখ আজকে তোমাকে? কবিসভা
এই তো এখনই টেনে নিয়ে যাবে আমাকে নিগূঢ়
ইশারায় বকুলতলায়। আজ সত্যি, সত্যি, সত্যি
বলি, তুমি এসো দয়াময়ী শীঘ্র শারদ পূর্ণিমা-রাতে। আমি
থাকব তোমার পথ চেয়ে সুনিশ্চয়। কথা শুনে
সে, প্রেমের কবিতা, ব্যথিত দু’টি চোখে দূর দিগন্তে বিলীন।
অনন্তর দিন যায়, রাত যায়, ব্যাকুল প্রতীক্ষা
আমার হৃদয় কুরে কুরে খায়, ক্রমান্বয়ে বাড়ে
অস্থিরতা; অথচ আমার ঘরে ঝলসে ওঠে না
শাড়ি তার। অভিমান তাকে বহুদূরে
সরিয়ে রেখেছি; ভাবি, সে, প্রেমের কবিতা, কখনও
ভুলেও আমার কাছে আসবে না আর। এখন তো
হৃদয়ে আমার ফণিমনসার উঁকিঝুঁকি আর গিরগিটিদের
আসা-যাওয়া। অকস্মাৎ এক বর্ষাঘন নিশীথের
তৃতীয় প্রহরে তার পায়েল উচ্ছল বেজে ওঠে
আমার নিভৃত ঘরে, উদ্দীপ্ত প্রেমের কবিতাকে
বসাই নিবিড় মুখোমুখি, আলিঙ্গনে
বাঁধি আর প্রগাঢ় চুম্বন আঁকি ভেজা ঠোঁটে, সফল সঙ্গমসুখ পাই।
২৯.৫.৯৭.
বহুজন
বন্ধু রশীদ করীমের একটি কক্তি মনে রেখে
ওহে মেঘে মেঘে বেলা কম তো হ’ল না
শামসুর রাহমান, অথচ এখনও
তোমার প্রকৃত পরিচয়
এ ভবের হাটে বাটে পেয়েছে কি কেউ?
তোমার নিজের ধারণার সূত্র ধ’রে জানা যায়-
কোনও কোনওদিন ভোরবেলা হঠাৎ ভাঙলে ঘুম
নিজেকে আদিম কোনও মানুষের মতো
লাগে, বেলা গড়িয়ে পড়লে
খানিক, ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজলেই বসন্ত বাহার
হ’য়ে যাও মনোমুগ্ধকর প্রত্যাশায়। তুচ্ছতার
প্ররোচনা কখনও মেজাজে আগুনের কিছু স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়,
কখনও সখনও গৃহিণীর সঙ্গে বাধে খিটিমিটি।
অপরাহ্নে যখন তোমার পৌত্রী ডাকে
মমতাকোমল ছোট্র হাত নেড়ে দেখাতে ছবির বই তার,
দুলে দুলে ছড়া কাটে, মেঘাচ্ছন্ন হৃদয়ে তোমার
লহমায় রঙধনু হেসে ওঠে উচ্ছল নৈঃশব্দ্যে।
সায়াহ্নে হঠাৎ কী-যে হয়, একটি খরখরে ছায়া
তোমাকে দখল করে। অনেকের মধ্যে প্রাণবন্ত কলরবে
মেতেও তোমার ভেতরের বড়ই নিঃসঙ্গ মানুষটি
সবার নিকট থেকে দূরে বহুদূরে রয়ে যায়।
যখন আসে না ঘুম কোনও কোনও রাতে
অকারণে কিংবা সদ্য কোনও কবিতা লেখার পর
তৃপ্তি অতৃপ্তির দ্বিধাদ্বন্দ্বে দোল খেয়ে কিছুক্ষণ
আন্ধার অথবা তারাময় আসমানে
তাকাও তৃষিত চোখে, কখনও আনন্দে আন্দোলিত
বর্ণিল উৎসব হও, কখনও অজ্ঞাত ভীতি চকিতে তোমার
কণ্ঠনালী চেপে ধরে, নীরবে দু’চোখে থেকে কখনও-বা শুধু
ছল ছল জল ঝরে এবং আগামীকাল ভোরে
কোন খেলা হবে শুরু মনে, তুমি নিজেই জান না;
বস্তুত একজনের ভেতরেই বহুজন করে বসবাস।
৯.৪.৯৭
ব্যর্থতায় খেদোক্তি
রোজ নয়, মাঝে মাঝে অতিদূর লোকশ্রুত এক
ভাস্করের উপকথা ভেসে ওঠে স্বপ্নের ধরনে।
আমি তো ভাস্কর নই, টেরাকোটা অথবা পাথর
কুঁদে কোনওদিন
করি নি নির্মাণ কোনও অনিন্দ্য প্রতিমা। এই আমি
শব্দের সামান্য অন্বেষক, ক্লান্তিহীন; মেঘ ফুঁড়ে-
বেরুনো আলোর ছটা, শ্রাবণের মেঘভার, ঘাসের শিশির,
রাধাচূড়া, সন্ধ্যার পাখির উড়ে-যাওয়া,
চেনা গলিটার ধুলো, পাশের বাড়ির
দুপুরের ঝিমধরা ছাদের কার্নিশ, পায়রার মৃদু প্রেম,
পথিকের খুব একা পথ চলা, রুদ্র মিছিলের
তুমুল আওয়াজ আর দয়িতার হাসির সোনালি
ঝর্ণাধারা, নিবিড় চুম্বন থেকে শব্দ ব্যাকুল কুড়িয়ে
প্রতিমা নির্মাণ করি নিজেকে পুড়িয়ে বারবার।
যখন জ্বরের ঘোরে ঝাপ্সা প্রলাপ বকি, তখনও শব্দের
ভ্রমরেরা বিছানার চারদিকে গুনগুন গান জুড়ে দেয়; মগজের
কোষে কোষে চোখে মেলে কত যে সুরের সুরধুনী।
শব্দের প্রতিমা গ’ড়ে কাটিয়ে দিয়েছি
পঞ্চাশ বছর, তবু সেই ভাস্করের মতো
একান্ত নিজেরই সৃষ্ট প্রতিমার প্রেমে
অন্তহীন ম’জে স্বেচ্ছা-অনাহার আর অনিদ্রায়
করি নি জীবন বিসর্জন।
২৪.৫.৯৭.
ভিক্ষা
একজন ভিখিরী একটি টাকা অথবা আধুলি ভিক্ষা চায়
আজকাল, একজন রাজনীতিবিদ
ভোট ভিক্ষা করে গণমানুষের কাছে, একজন
আইবুড়ো মেয়ে নিত্য বর প্রার্থনায়
কাটায় সকালসন্ধ্যা নিভৃতে শহুরে বারান্দায়,
একজন বৃদ্ধ আরও পরমায়ু চান
আকাশের দিকে জরাগ্রস্ত হাত মেলে দিয়ে রোজ।
একজন খুনী নরহত্যা
করার পরেও দিব্যি ফাঁসির দড়িকে ফাঁকি দিতে
ফাঁক-ফোকরের খোঁজ পেতে চায় আর
একজন জীর্ণ কবি কয়েকটি ছত্র লিখে কালকে পরাস্ত
করতে শুধু নিজের বোধির কাছে নতজানু হয়।
৮.৯.৯৭
ভূতলবাসীর কথা
সে ভূতলবাসী একজন, ছন্নছাড়া,
বিবিক্ত, বিষণ্ন, সূর্যালোকে সহজে যায় না দেখা
তাকে, নিত্যসঙ্গী তার ইঁদুর, বাদুড়। বাক্যালাপ
নেই কারও সঙ্গে, মাঝে-মাঝে কেবল নিজের সঙ্গে
কথা বলে একা একা মৃদুস্বরে। অন্যেরা সে-কথা
শুনলেও সহজে যাবে না বোঝা
ভূতলবাসীর সন্ধ্যাভাষা। নেই কারও
সাতে পাঁচে, ব’সে থাকে এক কোণে লোকটা একাকী।
এরকমও হয়, কালেভদ্রে নিজের আস্তানা ছেড়ে
সে বেরিয়ে আসে জ্যোৎস্নাভেজা মধ্যরাতে,
হেঁটে হেঁটে জনশূন্য মাঠে গিয়ে শোয় অকাতরে,
নভোমগুলের রূপ দেখে।
চোখে তার অশ্রুকণা চিক চিক করে। অকস্মাৎ
কোত্থেকে তিনটি পক্ষীরাজ ঘোড়া এসে
মাঠে জুড়ে দেয় নাচ। কেবল একটি পক্ষীরাজ
ভূতলবাসীর ম্লান শার্টের কলার
মুখে চেপে দোলা দেয় বারবার গাঢ় মমতায়,
একটি বেহালা নাচে শূন্যে তালে তালে।
সর্বদা সে নিশ্চেষ্ট, উদ্যমহীন, আকাঙ্ক্ষার ডালে
ছেঁটে ছেঁটে নিশ্চিহ্ন করেছে
সবার অলক্ষ্যে তবু তার কাছে আসে
অলৌকিক পাখি, মৎস্যকনা, রত্নদ্বীপ, পক্ষীরাজ,
শূন্যের উদ্যান; সে-তো তিমিরবিলাসী, তবু নিঃসঙ্গ আড়ালে
নতুন আলোর আরাধনা করে সকল সময়।
৮.১০.৯৭