দরজায় কে যেন
পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে অসুস্থ
একটা কাকের ঝিমুনি,
কে যেন গলিপথে পুরনো দিনের সুর
গুনগুনিয়ে যাচ্ছে হেঁটে।
অদূরে বারান্দায় বোবা যুবতী
খোঁপায় সাজায় রক্তগোলাপ।
ওর চোখ, দু’টি হাত কেমন
বাঙ্ময় হয়ে ওঠে গোধূলি-রঙে;
আকাশ আর দিগন্তের নিজের কিছু কথা
শোনায় ঠোঁট না কাঁপিয়ে।
আমি এই পড়ন্ত বেলায় আমার
লেখার টেবিলে ঝুঁকে লিখছি; বিছানার
শাদা চাদরে প’ড়ে থাকে
সুর্মা রঙের এক পালক-আলেফ। বন্ধ
দরজায় কে যেন ধাক্কা দেয়,
চমকে উঠি জোর করাঘাতে।
লেখা থামিয়ে শব্দ শুনি একবার, দু’বার, তিনবার,
বেশ কয়েকবার।
শব্দটি কালো, গাঢ় কালো,
কখনও খুব কাছে আসে, কখনও
কোথাও দূরে বিলীন।
১৫.৬.৯৭.
নাক্ষত্রিক আড্ডা
কোনও কোনও মধ্যরাতে ইচ্ছা হয় তারাদের রূপালি আড্ডায়
গিয়ে বসি, গল্প করি নক্ষত্র-পুরুষ আর কতিপয় দীপ্ত
নক্ষত্র-নারীর সঙ্গে। যেহেতু সর্বদা স্বল্পবাক আমি, তাই
চুপচাপ গা এলিয়ে দিয়ে
শুনব তাদের কথা, শুনব নিবিড় হ’য়ে কোনও কোনও তারা-কুমারীর
অনুপম ঝর্ণা-হাসি। তখন আমার কাছে তুমি
যদি চলে আসো, ডাকো আমাকে নির্ভয়ে ইশারায়,
তক্ষুণি তোমার হাত ধ’রে
চলে যাব নক্ষত্রের সুদূর ডেরায়। কত মধ্যরাত, হায়,
তুমিহীনতায় কাটে, কখনও আসো না ব’লে আমি
কেবলি হারাতে থাকি নাক্ষত্রিক আড্ডার সুষমা।
২৭.১১.৯৭
নীলুফারের গান
যখন তুমি তোমার কণ্ঠে সুরকে
ছন্দিত চাঞ্চল্যের নর্তকীতে রূপান্তরিক করো,
যখন তোমার কণ্ঠে ঝর্ণাধারা বয়, যখন
তোমার কণ্ঠে কখনও শারদ নীলাকাশ, অজস্র
কাশফুলের শুভ্রতা, বসন্তের পুষ্পল মহিমা
প্রকাশিত, যখন তুমি সুরে সুরে
ফোটাও জ্যোৎস্নার কুসুম, সারা দিনের
খাটুনির শেষে ঘরে-ফেরা আমি ক্লান্তি ভুলে
ভাসি অতুল সুর-সাগরে। তোমার গানের
ঢেউ আমাকে বানিয়ে তোলে এক উৎসব।
তোমার গান আমাকে নিয়ে যায়
খোলা প্রান্তরে, ফসলের
ঢেউ-খেলানো মাঠে, ছায়াচ্ছন্ন
দীঘির ঘাটে, বাড়ির পাছদুয়ার দিয়ে আসা
গ্রামীণ তরুণীর হাসিঝলসিত
বাঁশঝাড়ের নিচে। সাঁঝ-নামা
বিষণ্ন কুয়োতলায় ঝুঁকে-পড়া
চাঁদকে তুমি গানে গানে বানাও তৃষ্ণার্ত পথিক।
তুমি যখন সুরের স্বপ্ন বুনে দাও চারদিকে,
তোমার জল ছল ছল সুরে পা ফেলে
রাধা তার শ্যামের সঙ্গে
মিলনের জন্যে যায় নীল যমুনায়।
তুমি যখন গান গাও সুন্দর অতিথি
এসো এসো ব’লে, তখন কে যেন
আসতে থাকে অনেক দূর থেকে অথবা
যখন যাক না নিশি গানে গানে গুঞ্জরিত হয়
তোমার কণ্ঠস্বরে, তখন
নিশীথ অধিকতর নিশীথ হ’য়ে ওঠে।
তোমার গান নববধূর প্রাণে নাইওরের
ইচ্ছাকে প্রবল পুষ্পিত ক’রে তোলে।
১২.৮.৯৭
পাগলা বাবুলের গান
গেরুয়া বসনধারী পাগলা বাবুল
যখন বাউল গান গায় গভীর তন্ময়তায়
একতারা বাজিয়ে, আঙুলে
ফুটিয়ে সুরের বনফুল
নেচে-নেচে, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে
পাগড়ি-বাঁধা মাথা
ছেঁউড়িয়া, ফরিদপুরের গঞ্জ-গ্রামে,
শহর ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি
আর রমনার বটমূলে
আবার লালন সাঁই আসরে নামের পুরোদমে।
পাগলা বাবুল গলা ছেড়ে গান গাইলেই আমার অন্তরে
দীঘির বৈকালী ঘাটে গ্রাম্য বধূটির
কলস ভাসানো,
নতুন শস্যের ঘ্রাণ, ক্ষেতের আইল,
পথের রঙিন ধুলো, নিঃসঙ্গ লোকের পথ হাঁটা,
ডুরে শাড়ি-পরা কিশোরীর কাঁচা আম খাওয়া,
ভাসমান নৌকা আর ঘুঘুর উদাস
ডাক জেগে ওঠে। মনে হয়,
নিঝুম মহীন শাহ ভরা নদীর ধরনে মাথা নাড়ছেন।
এবং পাগলা বাবুলের একতারা
যখন সুনীল আকাশকে ছুঁতে চায়,
ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মাথা আর নেচে-নেচে
যখন সে অগণন মানুষের মাঝে মানুষের গান গায়
আমি শুদ্ধ আলোর ভিতরে যাত্রা করি।
৯.৯.৯৭
পুতুল
এক মুঠো মাটি নিয়ে, একটু পানি মিশিয়ে
ছোট্র একটা পুতুল গড়তে সারা দিন সারা রাত
ছটফটিয়ে কাবার ক’রে দিলাম, অথচ
কিছুতেই পুতুলের মুখের কোনও ছাঁদ-ছিরি ফোটেনি।
অসম্পূর্ণ পুতুলটিকে নানা কোণ থেকে দেখার
চেষ্টায় কেটে গেল ঝাড়া কয়েক ঘন্টা; তৃপ্তি
হয় না। ভাঙার তুমুল নেশা পেয়ে বসে আমাকে;
হঠাৎ টুকরোগুলো আমার নিষ্ঠ আঙুল আর
নরুনের যুগলবন্দীতে আবার
পুতুল একটা আদল পেয়ে যায় আখেরে
সবার অলক্ষ্যে। আমি সারিন্দা হই, হই আতশবাজি।
বসন্ত-হাওয়া, গাছের পাতা, চার দেয়াল করে নান্দনিকতার নান্দীপাঠ।
গভীর রাতে, যখন চাঁদের হাত নদীকে নাচায়,
সেই পুতুল আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে
ফিসফিসিয়ে, শোনাতে চায় প্রাচীন এক
দ্রাবিড় কন্যার কাহিনী, যে পুতুলের
মতো সুন্দর হ’তে চেয়েছিল অমাবস্যা রাতে
বিরূপ প্রেমিকের শুভ দৃষ্টিতে স্নাত হাওয়ার জন্যে।
১২.৫.৯৭
বস্তুত এ নির্বাসন
ক্রুদ্ধ রাজহংসীর ধরনে গতকাল গোধূলিতে
আমাকে কঠোর স্বরে বলেছিলে ‘তোমার কবিতা
শুনব না, পড়ব না কোনওদিন আর। শব্দগুলো
অগ্নিকণা, পুড়ছিল কান মন। কী ছিল আমার অপরাধ?
আমার কবিতা কেন জাগাল এমন
বিতৃষ্ণা তোমার মনে? আমার নিরীহ শব্দাবলি
অঞ্জলি উজাড় করে তোমাকেই বিস্তর করেছে
নিবেদন পুষ্পদল, ছড়িয়েছে সৌরভ তোমার দেহমনে।
তুমি ক্রুদ্ধ রাজহংসী হ’লে,
চঞ্চুর আঘাতে ভালবাসা আমার লুটিয়ে পড়ে
ধুলোয় রক্তাক্ত, অসহায়। একদিন প্রমাদের
মরীচিকা অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল
আমার একটি পদ্য এবং তোমার
মধ্যে, ফলে অভিমানে, ক্ষোভে
আমার সকল কবিতাকে তুমি সরিয়ে রেখেছ
দৃষ্টি আর শ্রুতি থেকে দূরে, বহুদূরে।
বস্তুত এ নির্বাসন আমাকেই দিয়েছ সায়াহ্নে,
মেনে নিতে বড়ো কষ্ট হয়, যদি তোমার সিদ্ধান্তে
সর্বদা অনড় থাকো, তাহলে আমিও
আমার কলমটিকে পাঠাব গহন বনবাসে।
১২.৪.৯৭