তবুও মানব
অর্ধপশু, অর্ধনর প্রাণীদের বহ্নুৎসবে লক্ষ লক্ষ টন
জ্ঞান বিজ্ঞানের বই হ’ল ভস্মীভূত,
তাণ্ডবে লাঞ্ছিত গুণী, অনেকে নিহত, সভ্যতার চিহ্নগুলি
লুপ্ত একে-একে অতি দ্রুত।
তবুও মানব থেকে যায় কোথাও আড়ালে আবডালে,
সংখ্যায় যদিও বেশি নয়। পূর্ণিমার
আশ্রয়ে পুরুষ তার রমণীর হাতে হাত রাখে,
শোনায় কবিতা তাকে, টেনে নেয় বুকে
মানবিক বোধে, ঘর বাঁধে
পৃথিবীকে সুন্দরের মহিমায় নিয়ে যাবে ব’লে।
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে মানুষের বার্তা রটে যায়
ক্রমান্বয়ে; সুচারু নিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা শারদ অগাধ রোদে হাঁটে
মরালের মতো। মানুষের শান্তি আর
কল্যাণের জন্যে কত মানব শান্তির বাণী লেখে।
১৬.৯.৯৭
তার খাতা
লোকটার ঢের বয়স হয়েছে, শরীরে দু’তিনটে রোগ বেশ
জাঁকিয়ে বসেছে। থাকে সে এই শহরের একটি গলির
ভেতর এক কোণে, নিরিবিলি। সামাজিকত টানে না তাকে।
পাড়ার কারও সঙ্গেই ওঠা বসা নেই। সে যে আছে
এখানে, এ-কথা পাড়ার পাঁচজন দিব্যি ভুলে থাকে।
মাঝে-মাঝে দূর থেকে অবাক হ’য়ে দেখে লোকটাকে।
হয়তো ওকে নিয়ে কখনও সখনও ওদের মধ্যে খুচরো আলাপ
চলে কিছুক্ষণ। সে কান পাতে না কারও কোনও কথায়।
লোকটা নাকি ভাসমান মেঘ, গাছের সবুজ পাতা,
ঘাস, পিঁপড়ে, পাখি, মধ্যরাতের রাতা, রোদ্দুর
আর বৃষ্টিধারার সঙ্গে কথা বলে। একবার একজন
তরুণীকে সে নাকি আচমকা বলেছিল, ‘আপনার
শরীরের নিম্নাংশ অবিকল মৎস্যকন্যার মতো।‘
তরুণী চমকে উঠে দূরে সরে গিয়েছিল। তারপর
সারা ঘরে ফিসফিস, হাসির হুল্লোড়। ব্যাপারটা
হাসির খোরাক হবে, লোকটা ভাবেনি। একজন
তরুণীর শরীরে মাছের লেজ ঝলসে উঠলে সে কী
করতে পারে। কেউ-কেউ তাকে মানসিক হাসপাতালে
যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছে দু’একবার। সে
নির্বিকার তাকিয়ে রয়েছে দেয়ালের দিকে।
লোকজনের কথা অথবা আচরণে ক্ষুব্ধ হয় না সে।
আজকাল প্রায় সারাক্ষণ নিজের ডেরাতেই থাকে নিজের
সঙ্গে। পথের কিছু কুড়ানো নুড়ি নিয়ে খেলা করে
আপন মনে আর নুড়ির ভেতর দেখে নেয় গোটা এক বিশ্ব।
মাঝে-মাঝে একটা মোটা খাতায় খুব রাত জেগে কী সব
যেন লেখে। সেসব কারও চোখে পড়েনি কোনওদিন।
তার মৃত্যুর পরে কোনও উৎসুক ব্যক্তি জিনিসপত্তর
ঘাঁটতে-ঘাঁটতে খাতাটার রহস্য উদ্ঘাটন করতেও পারেন।
৯.১০.৯৭
তিনি বলবেন
অনেকগুলো গোলাপ এসে জড়ো হয়
একটি বিষণ্ন সিঁড়িতে, বলে, আমরা ফুটিনি কোনও বাগানে
অথবা ঝিঁ ঝিঁ-ডাকা বিরানভূমিতে,
আমরা প্রস্ফুটিত একটি উদার, সহিষ্ণু বুকে,
যে-বুকের বিশালতা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের
চেয়েও অধিক বিশাল;
যে-বুকের গভীরতা সঙ্গোপসাগরের চেয়েও অধিক গভীর।
আমাদের জন্ম হয়েছে বুকের ক্ষতরূপে সেজে ওঠার জন্যে।
সেই গোলাপগুচ্ছ বলে, আমাদের চোখে অশ্রুধারা নেই,
আমাদের দৃষ্টিতে ভরা আগুনের ফুলকি,
যা সর্বক্ষণ জ্বালা ধরাবে ঘাতকদের পিটপিটে চোখে,
আমাদের পাপড়িতে কোনও পেলবতা নেই,
ওরা প্রত্যেকে একেকটি লাল পাথর, যাদের বৃষ্টিতে দিশেহারা
ঘাতকেরা মৃত্যু ভিক্ষা করবে
প্রতি মুহূর্তে মরণের কাছে। পৃথিবীর সবচেয়ে হীন,
কুৎসিত জীব ব’লে লানতের বকলেস ঝুলবে ওদের গলায়।
তিনি সেই বিশালকায় পুরুষ, এক-বু
গোলাপ নিয়ে দাঁড়াবেন, তাঁর মাথা ছোঁবে মেঘমালা,
গলায় বাজকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলবেন,-
হায়, ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেয়নি দেখতে
গ্রীষ্মের আমবাগানের ছায়া, বৈশাখী ঝড়;
হায়, ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি
বর্ষার ভরা নদী আর কদম ফুল;
হায়, ওরা আমাকে ভালো ক’রে দেখতে দেয়নি শরতের
নীল আকাশের নিচে হাওয়ায়-দোলানো কাশফুল;
ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি
হলুদ হেমন্তের ফসল, মেঠো ইঁদুর, আর কুয়াশার বিষণ্ন জাল;
ওরা একুশ বছর আমাকে ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি
বাংলার শীতের পাখি আর রকমারি নক্শি পিঠা,
হায়, ওরা আমাকে একুশ বছর ভাল ক’রে দেখতে দেয়নি বসন্ত-পলাশ,
শহীদ মিনারের অগণিত পুষ্পার্পণ,
এবং একুশের ছায়ানটের অনুষ্ঠান, বইমেলা।
তিনি তাঁর ইতিহাসচিহ্নত তর্জনী উঁচিয়ে বলবেন-
আমার চামড়া, হাড়, মাংস, মেদ, মজ্জা সমেত ফিরে এলাম কি
এলাম না, সেটা কোনও কথা নয়। আমি তোমাদের মধ্যে ছিলাম,
আছি, থাকব কৃষকের হাসিতে, শ্রমিকের পেশীর ঝলকে, মেঘনার
মাঝির গুণ টানায়, শঙ্খচিলের উড়ালে, পদ্মার ইলিশের
ঝলসানিতে, ছাত্রছাত্রীর উৎসবে, রাজনৈতিক কর্মীর অঙ্গীকারে,
কবির স্বপ্নকাননে পথ চলায়, প্রত্যূষের বৃষ্টিভেজা পথের দিকে চেয়ে থাকায়,
হঠাৎ ভাতশালিখ দেখে নেচে-ওঠা শিশুর জল্লাসে।
১২.৮.৯৭
তোমার না-আসাগুলো
তোমার না-আসাগুলো ক্রুশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণা
হ’য়ে ঝরে মনে নিশিদিন। এ-ও জানি
অনেকেই নানা যন্ত্রণায় ভোগে দিনরাত আর
নিজেদের ভাগ্যকে অভিসম্পাতে করে
জর্জরিত; কেউ কঠিন অসুখে
ভুগে ভুগে হতাশার নিশিডাকে অন্ধ বিলে ডোবে,
অনেকেই জঠর-জ্বালায় বকে প্রায়শ প্রলাপ,
কেউ কেউ ক্ষোভে
মাথা ঠোকে বধির দেয়ালে, কেউ কেউ
কী জানি কিসের ঘোরে করে বিষ পান, ঝোলে ফাঁসির দাড়িতে!
কাউকে কাউকে লালসার আগুনের লকলকে
জিভ প্ররোচিত করে কুমারীর স্নিগ্ধ মুখে ছুঁড়তে এসিড,
কারও কারও অন্তর্গত উলঙ্গ সন্ত্রাস
শান্তিপ্রিয় মানুষের ঘরে বোমা মারে,
লাগায় আগুন আর তোমার না-আসা
অবিরত পোড়ায় আমাকে
অথচ যখন কেউ আমাকে কখনও প্রশ্ন করে,
স্বদেশে আমার সবচেয়ে প্রিয় কী, তখনই
নির্দ্বিধায় করি উচ্চারণ অন্তরের সবটুকু ভাল-লাগা
মিশিয়ে তোমারই নাম। তোমার না-আসাগুলো এই
মুহূর্তে স্মরণে আনে তোমার হাসির
আভা যা নতুন চরে ভোরবেলাকার
নরম রোদের মতো ছড়ানো কখনও, কখনও-বা
জ্যোৎস্না-ধোঁয়া মেঘনার রূপালি মৃদু ঢেউ।
এই তো ক’দিন আগে তোমার ব্লাউজ নাকি ত্বক
বিলিয়েছে সুঘ্রাণ আমাকে,
তোমার স্তনের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমাকে মাতাল
করেছে, তোমার ঠোঁট প্রজাপতির স্পন্দন হয়ে
ছুঁয়েছে আমাকে আর আজ
সেই তুমি কীভাবে যে আছো আমার বিষণ্ন ঘাটে
নৌকা না ভিড়িয়ে, বলো? কতকাল আর তোমার না-আসাগুলো
এভাবে আমার দেহমনে ঠুকে যাবে কালো পেরেক কেবল?
৮.৪.৯৭