কবিতার প্রতি
আজকাল যখন তখন তুমি চকিতে ফিরিয়ে নাও মুখ;
আমি কি করি নি স্তব প্রত্যহ তোমার? করি নি কি
তোমারই উদ্দেশে যাত্রা অবিরত তুচ্ছ
করে পথশ্রম কিংবা ক্লান্তি? অজস্র সুতীক্ষ্ণ কাঁটা
ফুটেছে আমার দু’টি পায়ের পাতায়,
সারা পথ সেজেছে রক্তের আল্পনায়
বারবার এবং ঝলসে গেছে মুখ অগ্নির ছোবলে আর
নিষ্করুণ দৃষ্টি-বর্শা বুকে পেতে নিয়েছি স্বেচ্ছায়।
কেবল তোমার দেখা পাওয়া
ছাড়া অন্য কিছুর প্রত্যাশা
কখনও করি নি কোনওদিন, উন্নতির
মই বেয়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টায় কাটে নি
আমার সময় আর নিজেকে সরিয়ে
রেখেছি ইঁদুর-দৌড় থেকে,
বিত্তের বৈভব লুটে নিতে
হুজুগে মাতি নি আমি কস্মিনকালেও। তোমাকেই
আমার সকল স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, উদ্যম শুধু করেছি অর্পণ;
প্রতিক্ষণ তোমার আসার প্রতীক্ষায়
ব্যাকুল হৃদয়ে পথ চেয়ে থাকি ষড়ঋতু জুড়ে।
তবু কেন তোমার এরূপ নিরূপতা ক্ষণে ক্ষণে?
ঠায় বসে থাকি না নিজের ঘরে সকল সময়,
মাঝে মাঝে পথে, মাঠে, বনবাদাড়ে, প্রান্তরে,
নদীর কিনারে হাঁটি একা একা, যদি
প্রকৃত তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কোনওখানে।
২৪.৩.৯৭
ক্রিসমাস ট্রি
বেশ কদিন ধরে ছিলাম ত্রঁটেল মাটিতে
আপাদমস্তক লেপ্টে-থাকা কচ্ছপ যেন।
ঈষৎ নড়তে চড়তে চাই,
চাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে,
অথচ থকথকে কাদা
আটকে রাখে, পেয়ে বসে স্থিবিরতার ঝিমুনি।
তোমার আমার চুক্ষমিলনের জন্মবার্ষিকী আজ। চকিতে
ভোরবেলার আলোঝর্ণার স্পর্শে কাদামাখা পিঠ
চড় চড় করে, গাছের পাতা কানে ঢালে
সবুজ ধ্বনি, পাখির গান চোখ থেকে
সরায় শুকনো কাদার ভগ্নাংশ। কাদার টুকরোগুলো
স্বপ্নকণা হ’য়ে জ্বলতে থাকে। সবার অলক্ষ্যে দিনটি
লাল চঞ্চুতে নীল পদ্ম নিয়ে আমার ছোট ঘরের
সরোবরে এক রাজহাঁস; আহ্, এ কী আনন্দধারা ধমনী জুড়ে!
কেউ না জানুক, গোধূলিজড়ানো আকাশ আর হৃদয় জানে-
তোমার আমার প্রথম দেখার মুহূর্তটির
জন্মবার্ষিকী আজ। নিঃশ্বাস-কাড়া ডিজেলের কালো ধোঁয়া,
যানজটের দমবন্ধকরা গুমোট আর সন্ত্রাসীর অন্ত্রের ধমক
উজিয়ে কোত্থেকে
কয়েকটি প্রজাপতি উড়ে এলো এই নীরব, বড় নির্জন জন্মোৎসবে
আমার ঠোঁটে মিলনবেলার চুম্বন আঁকতে। কখন যে
ধমনী থেকে ঝংকার, একমুঠো চকচকে মুদ্রার মতো শব্দ, টের পেলাম
শরীর থেকে কাদার শক্ত খোলস জয়োল্লাসে
ফেটে চৌচির হওয়ার পর।
আমাদের প্রথম দেখার জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা
জানায় তরুণ রোদ, তরুণী জ্যোৎস্না,
স্বর্ণচূড়া তোমার জন্যে উপটৌকন পাঠায়
নিজের হাতেবোনা লাল চেলী; কালপুরুষ ছড়িয়ে দেন
তার বিখ্যাত সুদূর হাসি এই অখ্যাত জন্মোৎসবে।
জীবিকার নাছোড় ত্র্যালবাট্রস গলায় নিয়ে
ঘেমো রাস্তায় ঘোরাঘুরি, হুমকি আর
বিদ্রূপের কাঁটা-ছড়ানো পথে হাঁটাহাঁটি সেরে নিজের
লেখার টেবিলের নির্জনতাকে আলিঙ্গন ক’রে
সত্তায় চকিতে হ’য়ে ওঠা এই আমিকে দেখে
অন্তঃপ্রেরণার ঝর্ণাটানে আমাদের নিবিড় প্রথম দেখার
জন্মবার্ষিকীকে সাজাই অপরূপ অদৃশ্য সাজে।
আমাদের প্রথম দিনের মুহূর্তগুলোকে জ্যোৎস্নাস্নাত
জলকন্যাদের মতো সাঁতার কাটতে দেখে বিস্মিত
তাকিয়ে থাকি। আমি হই ক্রিসমাস ট্রি এবং
আমাকে জড়িয়ে থাকে অনেক আশ্চর্য রঙিন বাল্ব।
আমার দিকে ছুঁড়ে-দেওয়া সব ইটপাটকেলকে
পুষ্পসার বানিয়ে হাসি; আহ্ কী আনন্দধারা জগৎ জুড়ে!
১৫.৫.৯৭
ঘর ছেড়ে
ঘর ছেড়ে কদাচিৎ বাইরে বেরোন ভদ্রলোক,
কী ক’রে যে সর্বক্ষণ একই ঘরে নীরবে থাকেন
শুয়ে-ব’সে; মাঝে মাঝে চলে পায়চারি
কয়েক মিনিট আর তাকান বাইরে,
জানালার কাছে গিয়ে চোখে
পড়ে তার-যাচ্ছে হেঁটে একটি কি দু’টি
লোক, কার কোথায় যে ঠিকানা, কে জানে! দূর থেকে
ভদ্রলোক কাছে টেনে নিতে চান যেন নিসর্গকে।
বহুদিন পর অকস্মাৎ
গহন সন্ধ্যায় এক সেই ভদ্রলোক তার রক্তের ভিতর
করেন চাঞ্চল্য অনুভব;
অজানা অপ্রতিরোধ্য টানে বেরিয়ে পড়েন তিনি
ঘর ছেড়ে, হেঁটে যান তারাদের চাঁদোয়ার নিচে
গন্তব্যবিহীন, ফেরেননি ঘরে কোনওদিন আর।
৬.১১.৯৭
চক্ষুবিশেষজ্ঞ ব’লে দেননি
এসব কিছু যে হবে, ঘন ঘন ঘটতে থাকবে চক্ষুবিশেষজ্ঞ ব’লে
দেননি আমার চক্ষু পরীক্ষা করার পর। এখন কী-যে
হয়েছে, গরগর-করা গ্রীষ্ম দুপুরে দেখি ঘরের ভেতর
শ্রাবণের মেঘ নেমেছে। বুকশেলফের বইগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ
ভূর্জপত্র, দুলছে পাঠশালার শিক্ষার্থী যেন; বাল্ব কদম ফুল।
এক চিলতে বারান্দায় বাগদাদের নিগৃহীত দার্শনিক
ইবনে রুশদ মোড়ায় ব’সে তন্ময় শুনছেন লালন সাঁই-এর
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। দরজায় দিকে আবছা
তাকাতেই চোখে পড়ে আফ্রেদিতি, যার প্রস্ফুটিত
নগ্নতায় সামুদ্রিক ফেনার ফুরফুরে চাদর,
চকিতে দুর্গার
সংহারমূর্তি ধারণ ক’রে তেড়ে আসে আমার দিকে।
জ্বালাধরা চোখ বন্ধ করতে পারি না। একজন ডাকপিয়ন
ঘরের ভেতর ঢুকে প’ড়ে হাতে গুঁজে দেয় হরফবিহীন চিঠি এবং
সেই চিঠি তক্ষুণি পড়ার জন্যে শাসাচ্ছে নাছোড়,
জাঁহাবাজ এক সান্ত্রী; পড়ার ভান ক’রে আওড়াই
এমন একটি কবিতা যা’ কস্মিনকালেও দেখিনি কোথাও কিংবা
পড়িনি। এই দৃশ্য মুছে যেতেই আমাকে লক্ষ্য ক’রে পাথর
ছুঁড়ছে কাবিল, আমার বুক চিরে বেরোয়া আর্তনাদ।
কখন যে রাত হয়, টের পাই না। আসমানের চাঁদটাকে
খুবলে খুবলে খায় নেকড়ের পাল আর বেদনার্ত দৃষ্টি
মেলে সক্রেটিস কম্পিত হাতে আমার দিকে এগিয়ে দেন
হেমলকের ভয়ঙ্কর-নীল পেয়ালা। চতুর্দিক থেকে অনেকগুলো
কাঁসার বাটির ধুন্ধুমার আওয়াজের মতো বহু লোকের
হাসি আমাকে বিঁধতে থাকে। সুফি মনসুর হাল্লাজের
রক্তের জাগ্রত বুদ্বদে দেয়ালে মুদ্রিত হয় সত্য শব্দটি
সত্যের মতোই ভাস্বর। রক্তাঙ্কিত সত্যকে অগণিত নোংরা নোখ
আঁচড়ে আঁচড়ে তুলে ফেলতে চায় তুমুল হিংস্রতায়।
ছন্নছাড়া দাবদাহ আমাকে পোড়াচ্ছে অষ্টপ্রহর, আমি
ঝর্ণাধারার কোমল ধ্বনি শোনার জন্যে অঝোর বর্ষণে স্নাত
হওয়ার জন্যে উন্মুখ, প্রতীক্ষা-কাতর আমার এই ছোট ঘরে।
১৭.৬.৯৭