একজন যুবকের কথা
গভীর রাতের নেশা চটে গেলে ভোরের হাওয়ায়
যুবক ধরায় সিগারেট, অলিগলি
পেরিয়ে হঠাৎ কী-যে মনে এলো তার, ঢুকে পড়ে
খানকা শরীফে,
যেখানে লোবান পোড়ে, জ্বলে সুগন্ধি আগরবাতি
দিনরাত, ব’সে অনেকের সঙ্গে এক কোণে সময় কাটায়।
এওতো খোঁয়ারি এক, ভাবে সে যুবক
শীতল দেয়ালে দিয়ে ঠেস, এখনও নিজেকে লাগে
কী ভীষণ ফাঁপা আর ফাঁকা। তাহ’লে কোথায়
খুঁজব মনের মুক্তি-এই প্রশ্ন পাখির মতোই
ঠোকরায় তাকে বারবার; জিজ্ঞাসু, অস্থির যুবা
ছায়াচ্ছন্ন খানকা শরীফ ছেড়ে রোদালো রাস্তায় উঠে আসে।
পথে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরে যুবক
কতিপয় লম্বা চুল দাড়ি গোঁফধারী
কেমন মস্তিতে চুল লোকের উন্মুক্ত আস্তানায়
যোগ দেয় ভক্তির তন্ময়তায় ম’জে, ওদের জিকির চোরা টানে
তাকে এ ভবের হাট থেকে কোথায় ভাসিয়ে
নিয়ে যায়, বোঝে না সে কিছুই ব্যাপক ধোঁয়াশায়!
জিকির নিস্তব্ধ হ’লে ছিলিমের ধোঁয়ার সুতীব্র গন্ধে ফের
যুবকের সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা জেগে ওঠে
ছায়াঢাকা বটমূলে। উজাড় পকেট,
ছিলিমে দেবে কি টান? এখানে কি মনের মানুষ
আছে কোনওখানে-যুবা প্রশ্ন করে মনে মনে আর
নিজেকেই লাগে পুনরায় বড় শূন্য, বড় ফাঁপা।
অনন্তর আস্তানায় ধোঁয়াজাল ছিঁড়ে
যুবক আশ্রয় নেয় শহরের নিভৃত উদ্যানে; পুরু ঘাসে
মাথা রাখে, গোধূলি বুলায় হাত ওর
অশান্ত মাথায়, হাওয়া চুলে বিলি কাটে, ভেসে আসে
ফুলের সুঘ্রাণ, যুবকের মন মুক্তির সন্ধান পেয়ে যায়
কবিতায়, নারীর হৃদয়ে আর মানুষের আনন্দমেলায়
২২.৩.৯৭
একটি কবিতাসন্ধ্যা এবং তুমি
আজ সন্ধ্যেবেলা যাদুঘরের ছোট মিলনায়তনে
আমার কবিতাপাঠ ছিল। কবিতা খুব ভালবাসো,
অথচ তুমি আসো নি। বলার মতো বলতে পারি নি ব’লেই
অভিমানের গাঢ় নীল শিখা জ্বেলে অন্তরে
ব’সে রইলে অন্ধকার ঘরে নিঃসঙ্গতাকে আঁকড়ে ধ’রে। আমি
ডানাভাঙা একটি দোয়েলকে
কংক্রীটে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখলাম
ধোঁয়াশায়। আম্র খুব কষ্ট হ’তে থাকে; আকাশ থেকে
খ’সে পড়লে কয়েকটি তারা, চাঁদকে
একটা হিংস্র শকুন ছিঁড়তে শুরু করে। আকাশজোড়া আর্তনাদ।
সেই আর্তনাদে মিলনায়তন কাতর; তুমি আসো নি,
চতুর্দিক কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন। অথচ কোনও
বিদ্যুৎবিভ্রাট ছিল না। কবিতা পড়তে গিয়ে
হোঁচট খেলাম বারবার, যেমন খঞ্জ
বিব্রত হয় পথ চলতে। চেনা শব্দগুলো মনে হ’ল অচেনা।
তুমিহীনতায় মঞ্চে ব’সে একটিও প্রেমের কবিতা পড়তে পারি নি
কবিতাসন্ধ্যায়; আমার হস্তধৃত
বইয়ে পাতাগুলো, বিশ্বেস করো, পোড়োবাড়ি হ’য়ে গেল। আমার
নিজেরই কবিতা চাপা ক্ষোভ আর অভিমানে আসর ছেড়ে
চলে গেল যেন মহরমের মিছিলে বুক চাপড়াতে!
এরপর কেটে যাবে বহুকাল। আমাকে কখনও
কোনও কবিতাসন্ধ্যায় দেখা যাবে না আর;
হয়তো তুমি কোনও এক অলস বিকেলে বইয়ের দোকান থেকে
উপন্যাস আর কাব্যগ্রন্থ কিনে ছিমছাম বেরিয়ে আসবে, তখন
আমার হতচ্ছাড়া, বেঢপ একটি কবিতা
তোমাকে বিনীত জিগ্যেশ করবে,
‘কিছু মনে করবেন না প্লিজ, অনেকদিন পর দেখা, কেমন আছেন আপনি?
আঁচল গোছাবে, তারপর তোমার মধুর কিন্তু বিস্মিত কণ্ঠের প্রশ্ন, ‘কে তুমি?’
আমার কবিতা তার মলিন ফতুয়ার আলগা-হ’য়ে-আসা
বোতাম ঠিক করতে করতে দিনান্তের ভিড়ে করুণ মিলিয়ে যাবে।
২৪.৫.৯৭.
একটু আরো কষ্ট স’য়ে
একটু আরও কষ্ট স’য়ে কাছে গেলে পৌঁছে যাব,
একটু আরও হাঁটলে পরে পেয়ে যেতাম যা চেয়েছি।
যাত্রারম্ভে সঙ্গী ছিল অনেকজনই দলেবলে;
অনেক হেঁটে, খেটে খুটে এতটা পথ
পেরিয়ে এলাম। সদর রাস্তা, অলিগলি,
নদীতীরে, বনবাদাড়ে ঘুরে ফিরে লক্ষ্য খুঁজি।
সঙ্গী ছিল অনেক তেজী সজীব তরুণ,
পথের মাঝে পা দিল কেউ মোহন ফাঁদে;
কেউ কেউ দূরে জলাভাবে ছলাকলার মায়াহ্রদে
ঝাঁপিয়ে প’ড়ে কোথায় যেন ডুবে মরে।
কাউকে কাউকে চোরাবালি হঠাৎ পুরো গিলে ফেলে,
বাঁকা বিপথ কারও কারও দিশা ভোলায় বেলাশেষে।
পথের শেষে না পৌঁছেই মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে,
ক্লান্ত লাগে, আমার বড়ই একা লাগে;
ব’সে পড়ি পথের ধারে, ঘুমের আঠায় বুজে আসে
চোখের পাতা। পথের শেষে না পৌঁছেই
এদিকে হায় আমার নিজের রসদ ফুরায় অবশেষে।
তবু আমি ভয় পাই না, ফুরায় না তো মনোবল।
ফলমূল আর গাছের পাতা খেয়ে টেয়ে, কচি কচি
ঘাস চিবিয়ে, ঘামের ফোঁটা চেটে চুটে
ক্লান্তি মুছে সাতসকালে, দিনদুপুরে, গোধূলিতে,
আঁধারে আর জ্যোৎস্নারাতে চলব পথে শেষ অবধি।
পৌঁছে গিয়ে হাত বাড়াব অভীক্ট সেই বীণার দিকে, যদি পারি
তারে তারে সুর জাগাতে দেহমনে চিরঅমা নামার আগে।
বাকি আছে একটু আরও হুমড়ি খেয়ে না গড়ালে
খাদের নিচে, দেরী হলেও পেয়ে যাব হাতের মুঠোয় যা চেয়েছি।
আখেরে হায় সিসিফাসের শ্রমের মতোই যদি আমার
সকল কষ্ট বিফলে যায়, তবু মনে উড়বে না কো খেদের ছাই;
এ ব’লে এই আলাভোলা মনকে কিছু প্রবোধ দেব-
ভবের হাটে কতজনাই ঘোরে ফেরে, ক’জনা পায় আসল রতন?
২৮.৩.৯৭
কবি ব’লে বড়ই বিরক্ত
এ আমার কী হয়েছে আজকাল? যেদিকে তাকাই
মনে হয় অন্ধকার দাঁত নোখ বের ক’রে চোখ
পাকায় কেবল, বুঝি একটু পরেই
আমাকে ফেলবে গিলে। রাস্তার দু’পাশে
বাড়িগুলি অশ্রুপাত করে আর আমি
অশ্রুজলে ভিজে সপসপে এক বিষণ্ন ধীবর,
যার ছেঁড়া জালে কোনও মাছ ধরা পড়ছে না আর,
উঠে আসে শুধু কিছু বিষলতা, হাড়ের ভগ্নাংশ।
আসলে এই যে আমি একজন কবি-
বিষয়টি ভীষণ বিরক্তিকর এখন আমার
কাছে, যেন কুকুরের লেজে ঢ্যাঁড়া বেঁধে
দিয়েছে পাড়ার দুষ্ট বালকেরা মজা লুটে নিতে।
কবি ব’লেই তো
আমার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে বিপন্ন বসন্ত আর
উজাড় বাগান, সারি সারি ভয়াবহ
কংকালের জিন্দাবাদ ধ্বনি,
পুরাতন ঘাতক দলের হিংস্র লাঠির মিছিল।
কবি ব’লেই তো, অনেকের
সহাস্য মতানুযায়ী খামোকা শিউরে উঠি ক্ষণে
ক্ষণে রজ্জুকেই সর্প ভেবে, আমার নিজস্ব কিছু
পূর্বাভাস শুনে উপহাসে মেতে
ওঠেন আপনজন, পাড়াপড়শিরা থাকে খুব উদাসীন।
যখন সবাই রাতে ঘুমায় গভীর নিজ নিজ
বিছানায়, ভাসে স্বপ্নে, স্বপ্নহীনতায়;
আমি নিজে প্যাঁচার মতন জেগে থাকি প্রায়শই,
হিজিবিজি আঁকি শূন্যে, দেখি
কোন্ দূরে বিধবা বালিশ সিক্ত করে অশ্রুজলে,
জানালার ব্যথিত পর্দায় প্রস্ফুটিত
হাহাকার। কোথা ক্ষুধার্ত শিশু কেঁদে ওঠে, বেকার পুরুষ
কামে তপ্ত হ’য়ে আলিঙ্গনে বাঁধে
আপন নারীকে তার, চাঁদখেকো ছায়া
স্ফীত হ’তে হ’তে পুরোপুরি গ্রাস করে শহরকে।
স্পষ্টত বলতে গেলে, এই আমি কবি ব’লে নিজে
বড়ই বিরক্ত হই ইদানীং নিজেরই উপর; একা-একা
পথ হেঁটে গেলে মনে হয়
কে যেন ছায়ার মতো আমাকে অনুসরণ করে
সারাক্ষণ, আড়ি পেতে শোনে
যা আমি আবৃত্তি করি মনে-মনে, সুচতুর জাল
পেতে রাখে সম্মুখে আমার;
দাড়িতাকে গোপনে চুম্বন করি যখন, তখন
সে ঈর্ষায় জ্ব’লে যুগ্মতার চিত্রটিকে কখনঅ ছিঁড়তে
কখনও পুড়িয়ে ছারখার ক’রে দিতে চায় আর
এই কবি যন্ত্রণাকাতর প্রায় ক্রুশবিদ্ধ কবি
শব্দের পেছনে ছোটে বনবাদাড়ে, খাদের পাড় ঘেঁষে
ঢুকে পড়ে নরখাদকের কালো গুহায় এবং
জেনেশুনে বাড়ায় নিষ্কম্প হাত বিষধর সাপের খোঁড়লে।
১১.৪.৯৭