আমার মানস-সরোবর
আমার মানস-সরোবর কয়েকটি পাখি ভাসে,
নরম সাঁতার কাটে, ডুব দেয়, ডানা ঝাড়ে আর
পিঠের পালকে মাথা গুঁজে নিদ্রা যায়
কখনও সখনও, দ্যাখে রৌদ্রছায়া, ঘাস,
গাছপালা, আকাশের উদার নীলিমা;
কখনওবা ভয়ার্ত তাকায় কাছে-দূরে।
কী-যে হয়, আচানক কতিপয় লোক,
উদ্ভট পোশাক গায়ে, খল দৃষ্টি, বড় হিংস্র ভঙ্গি;
কুৎসিত লোমশ হাত বাড়ায় কোমল
পাখিদের দিকে, টুঁটি চেপে
ধরার নাছোড় তাড়নায়। পাখিগুলো
প্রবল ঝাপ্টিয়ে ডানা উড়ে যেতে চায় শূন্যতায়।
আমি কি পারব এই বিবেকবর্জিত দস্যুদের
নিরস্ত করতে আজ রক্ত গোধূলিতে?
পারব কি উপদ্রুত কিন্তু অনুপম
পালক সজ্জিত প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখতে?
যদি ব্যর্থতার কালি আমার মুখের
রেখাবলিকেই আরও কালো এবং করুণ করে,
তাহ’লে মানস-সরোবর শূন্য আর দ্যুতিহীন
হয়ে যাবে, অপরূপ জল
হবে কর্দমাক্ত, আমি নিজে
ভীষণ নিষ্প্রভ এক উদ্ভিদে রূপান্তরিত হব!
কী ক’রে নীরবে নেব মেনে
নিজের এমন পরিণতি? এই ক্রূর দুর্বিপাকে
গোলাপ, ভ্রমর, কুন্দকলি, জোনাকি এবং শ্যামা
সবাইকে সৌন্দর্য-বিধ্বংসী
লোকদের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিরোধ
গ’ড়ে তোলবার দৃঢ় আহ্বান জানাব।
১২.৪.৯৭
আলোকপুরী
সর্বদা-ক্ষুধার্ত এক মাংসাশী পাখিকে প্রায়শ
আমি তো আপনকার মাংস কেটে কেটে খেতে দিই
একটু একটু ক’রে। ওর অনুমতি ছাড়া আকাঙ্ক্ষিত আলোকপুরীতে
প্রবেশ নিষেধ জেনে নিজের শোণিতধারা দিয়ে
কয়েকটি পঙ্ক্তি লিখে পাখিটির দিকে তুলে ধরি। হেলাভ’রে
দেখে নিয়ে একটু কেশে দেয় সে বাড়িয়ে
পাইপের মতো চঞ্চু তার। আমি মাংস কেটে খেতে দিয়ে ভাবি,
এভাবেই এই আমি এতদিনে হয়েছি কঙ্কাল।
কিয়দ্দূর থেকে এক অর্ধ-উজবুক অর্ধ-উন্মাদের হাসি
ভেসে আসে; আমার শরীরের আর মাংস অবশিষ্ট নেই দেখে
পাখি পথ ছেড়ে দেয় শেষে। আমি কিছু দূর
হেঁটে গিয়ে দেখি এক অন্ধকার সিঁড়ি
বহু নিচে নেমে গেছে, পাতালে বুঝি বা। সিঁড়িময় চামচিকা,
বৃশ্চিক, কাঁকড়া আর ইঁদুর, বাদুড়। মাঝে-মাঝে ক্ষণিক জোনাকি-জ্যোতি যেন
চোখে পড়ে; আখেরে আলোকপুরী যদি
না-ই দেখি, তাহ’লে কী হবে?
৯.৮.৯৭
আষাঢ়ের প্রথম দিনে
আমি নেই ঝর্ণাতলে দাঁড়ানো, কিংবা নেই ঘাসের
বালিশে শুয়ে কোনও বাগানে। আমার ওপর ঝরছে না
ফুলের সুগন্ধি পাপড়ি। আমার কাছাকাছি পাখিদের
নাচানাচি কেউ দেখতে পাবে না এখন। আমি নিজের
ছোট ঘরে বসে আছি কাঠের চেয়ারে। আষাঢ়ের প্রথম
দিন আজ, অথচ বাইরে রগচটা রোদের বাজখাঁই আওয়াজ।
বিকেলবেলা অথবা অভিমানী সন্ধ্যায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি
নামবে কিনা জানি না। ইলেকট্রিক তারে আটকে-পড়া হাওয়ায়
মৃদু কম্পমান কাটা ঘুড়ির মতো আমার হৃদয় তাকায়
শূন্যতায়। কিছুদিন আগেও তুমি এখানে আসতে রাত্রিকে
শাড়ির ঝলসানিতে উৎসুক ক’রে পরিবেশকে সোনালি
আভায় চমকে দিয়ে অবয়বের সৌন্দর্যে। তুমি এখানে পা রাখার
সঙ্গেই আমার সামান্য ঘর হয়ে উঠত অমরাবতী, নেমে-আসা
নক্ষত্রেরা বাজত নূপুর-রূপে। এখন তুমি আর আসো না ব’লেই
এই ঘর সন্ন্যাসীর নাঙাগুহা; ঘরের চার দেয়াল আর ছাদ ফুঁড়ে
ঝরতে থাকে কর্কশ ভস্মরাশি, মরুভূমির কংকালগন্ধি
বালি। এই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর হুহু কাঁদছে আষাঢ়।
১৫.৬.৯৭.
এই সড়কে অনেক হাত
এই সড়কে আমার দৃষ্টিপথে মুহূর্তে ঝলসে ওঠে
অনেকগুলো মুষ্টিবদ্ধ হাত। সেসব
হাত থেকে হীরকদ্যুতির মতো ঝরছে শপথ, যেন জীবন
সারি সারি হাতের ভেতর পুরে দিয়েছে
অপূর্ব এক বোধ, যা নিমেষে বদলে দেয় প্রাক্তন
দৃষ্টিভঙ্গি। রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর
বারান্দা থেকে ঝুঁকে-দাঁড়ানো সব মানুষ
বিস্মিত চোখে তাকায় সেসব উত্তোলিত হাতের দিকে।
এই হাতগুলোর নিপুণ চাঞ্চল্যে কলকারখানার চাকা ঘোরে,
এই খেটে-খাওয়া হাতগুলো অবিরত গড়ছে
চোখ-ধাঁধানো পুঁজি। এই হাতগুলো রোদ আর
জ্যোৎস্নার চুমোয় পাবলো নেরুদার কবিতা হ’য়ে দিনরাত
ঝলসাতে থাকে; ট্রাম্পেটের মতো।
এই সব হাত কখনও শ্রমের ক্লান্তি ভুলে থাকার জন্যে
দিশি মদে চুর হ’য়ে ঘরে ফেরে, কখনও
সপ্রেম ফুল গুঁজে দেয় নারীর খোঁপায়,
এই সব হাত সস্নেহে বুকে টেনে নেয় ছেলেমেয়েদের,
এই সব হাত সূর্যকে স্পর্শ করতে চায়, অন্ধকার রাতে
হ’য়ে উঠতে চায় কালপুরুষ।
এই হাতগুলো এখন প্রধান সড়কে, ওরা এখন
দ্রুত অগ্রসরমান পতাকা। ওরা আগেই জেনে গেছে,
একদা যাদের যন্ত্রণায় সড়ক, বস্তি, কলোনি,
অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবীর শান্তির নীড় ভেসেছে রক্তে,
যাদের আলখাল্লায় রক্তচিহ্ন, তারাই আজ মতলববাজ রাজনীতিকদের
দহলিজে কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছে, ধর্মের বুলি ঝেড়ে
মানুষকে কুসংস্কারের পিঁজরাপোলে ঢুকিয়ে
হিংস্র আর অমানবিক ক’রে তুলতে চায়। সড়কে উদ্ভাসিত
হাতগুলো প্রতারণার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেই
মুক্তিযুদ্ধের সূর্যোদয় অন্তরে নিয়ে মে-দিনের গৌরবদীপ্ত
ডাক হ’য়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই আছড়ে পড়ছে
প্রতিক্রিয়াশীলতার সব খোঁড়লে।
২৩.৪.৯৭
এক পালকের পাখি
বিবর্ণ হাতলহীন একটি চায়ের কাপ পাঁচ মুখে ঘুরে
চলটে-ওঠা বেশ নড়বড়ে টেবিলের
মাঝখানে স্থির হয়ে বসে। এক কাপের ইয়ার
পাঁচজন যুবক নরক গুলজার
ক’রে রাখে প্রায়শ দু’বেলা
নিজেদের পাড়ার ঘনিষ্ঠ চাখানায়।
এক পালকের পাখি ওরা; প্রত্যেকের
উশ্কো-খুশ্কো চুল ঘাড়ে নেমে আসা, গালে
ক’দিনের না-কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি,
নোংরা নোখ, হাতা-গোটানো ময়লা
শার্ট গায়ে, কারও ট্রাউজার্স,
কারও বা পাজামা, কেউ কখনও কখনও উচ্চৈঃস্বরে
ফিল্মি গান গায় টেবিলকে
তবলা বানিয়ে, কেউ কেউ নিপুণ বাজায় সিটি। রোজগারে
মন নেই কারও, যেন ওরা মেঘচারী, নিরুদ্বেগ
দিন যায়, রাত কাটে জনকের সরাইখানায় মাতৃস্নেহে।
একদিন সে পাড়ায় ছিমছাম ফ্ল্যাটে
একজন নবীনার আবির্ভার রূপবতী বসন্তের মতো
পাঁচ যুবককে তরঙ্গিত করে; রাতারাতি যেন যাদুবলে
বিন্যস্ত ওদের চুল, পরিচ্ছন্ন গাল,
জামা পরিপাটি, নবীনার দৃষ্টি কাড়বার লোভ
প্রত্যেকের মনে লকলকে হ’য়ে ওঠে,
এক পালকের পাখি ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে।
বিবর্ণ হাতলহীন একটি চায়ের কাপ আর
ঘোরে না এখন পাঁচ মুখে। চাখানায়
সহজে আসে না কেউ, কাঁধ ধ’রে হাঁটাহাঁটি নেই।
পাঁচজন যুবকের মধ্যে কেউ নবীনার মন
শেষে জয় করেছিল কিনা, জানা নেই। কিছুকাল পর সেই
তরুণী হঠাৎ কোথায় যে চলে গেল
অসমাপ্ত লিরিকের মতো। অনন্তর চাখানায়
ফিরে আসে ঢেউ, পুনরায়
বিবর্ণ হাতলহীন একটি চায়ের কাপ ঘোরে
পাঁচজন যুবকের ঠোঁটে, মাথাভর্তি অবিন্যস্ত চুল,
গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে
ইস্ত্রিহীন ম্লান জামা, মলিন পাজামা, ট্রাউজার্স,
অথচ কোথায় যেন একটি ফাটল রয়ে গেল।
১৮.৩.৯৭