আমার আঁজলা পূর্ণ হোক
এমন কুয়াশা আগে কখনও নামেনি চতুর্দিকে
আমার ঘনিষ্ঠ ছাঁদে। আজ বেলাশেষে
প্রতারক জালে বন্দী হ’য়ে
মোহগ্রস্ত চোখে দেখি কে এক অস্পষ্ট ছায়াবৃতা
ঘোড়ামুখী নারী দূরে একাকী দাঁড়িয়ে
কী মন্ত্রে আউড়ে দেয় মায়াবী সঙ্কেত। আমি সেই
ছায়ার পেছনে গিয়ে খাদের কিনারে
পৌঁছে যাই; ক’জন পিশাচ নীল নক্শা অনুসারে
আমাকে রক্তাক্ত ক’রে খাবলে খুবলে
জন্মন্ধ খাদের নিচে পশুর আহার্য ক’রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
ঘোড়ামুখী নারী, সমস্ত শরীরে বিষকাঁটা,
অতিকায় বাদুড়ের রূপে ওড়ে চক্রাকারে, আমি
অসহায় প’ড়ে থাকি কাঁটাবিদ্ধ, একা
ভীষণ দুর্গন্ধময় খাদে নিজ দোষে। হায়, যাকে
অন্ধকারে রেখে মোহে ম’জে
ছলনার পেছনে ছুটেছি
অকালে অন্ধের মতো, সে-ই তো উদ্ধার
আমার, অথচ তারই হৃদয় বিদীর্ণ ক’রে ছাই
উড়িয়েছি জীবনে আমার। কোন্ দোয়েলের গান
আবার করবে যুক্ত দু’জনের হাত?
২
কী এক দুর্মর ঘোরে দেখি বিষাদ আমাকে নেয়
সম্পূর্ণ দখল ক’রে। দেখি
মায়াকোভস্কির মেঘচারী ট্রাউজার্স,
জীবনানন্দের কাশফুল-ধুতি ওড়ে
গোধূলি মেঘের স্তরে স্তরে।
বিষণ্ন দস্তয়ভস্কি জুয়োর টেবিলে হেরে গিয়ে
বারবার শেষে জিতে নেন অমরতা,
এবং কীটস্-এর বুক-ছেঁড়া উষ্ণ রক্তধারা
ব’য়ে যায় ওডে ও সনেটে;
রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লাকে চুম্বন করে রিল্কের গোলাপ।
৩
যার শুদ্ধ ক্ষমাময় শুশ্রূষায় লহমায় সেরে যেতে পারে
আমার অসুখ, সে কি আমার শরীর থেকে বিষকাঁটা তুলে
নেবে নির্দ্বিধায়? তার হৃদয়ে আবার
ফুটবে কি ফুল প্রতি মুহূর্তেই আমার উদ্দেশে? তার ওষ্ঠে,
আর তার যমজ স্বর্গীয় ফলে পূর্ণ অধিকার
কখনও পাব কি ফিরে? স্খলনের ক্ষণিক তিমির
ধুয়ে মুছে যাবে নাকি উদার আলোয়? যদি নেপথ্যে ইয়েটস্
করেন নিবিড় সুপারিশ, তবে দয়িতার তীরে
সহজে ভিড়তে পারে পুনর্বার আমার আহত
ভ্রষ্টতরী; নেরুদা থাকেন চেয়ে সমুদ্রের দিকে। আমি তার
পাশে ব’সে দেখি দূরে রুমির আস্তিনে জ্বলে চাঁদ,-
আমার আঁজলা আজ পূর্ণ হোক মরমীর জ্যোৎস্না-মদিরায়।
২৯.১২.৯৭
আমার আপন টেলিফোন সেট
আমার আপন টেলিফোন সেটটিকে
প্রত্যহ সস্নেহ দেখি। কখনও আলতো তুলে নিই
রিসিভার, কখনও-বা নিবিড় আবেগে
চেপে ধরি; সর্বক্ষণ নয়,
কখনও কখনও
সে খুব কঞ্জুস হয়ে ওঠে।
টেলিফোন মাঝে মাঝে বড়ই ব্যাকুল
কণ্ঠস্বরে শোনায় আমাকে
বসন্ত বাহার কিংবা বিধুর বেহাগ, দরবারি। তার দূর
ব্যালকনিটি বাসনা আর স্বপ্নময়তাকে
নিভৃতে ফুটিয়ে তোলে এবং গাছের মর্মরিত
পত্রালি আমার হৃদয়ের ধ্বনি হয়ে
আর পাখিদের নাচানাচি
আমার আনন্দ রূপে সকাল বিকেলে
তার বুকে ঠাঁই পেয়ে যায় অগোচরে।
টেলিফোন কখনও আমাকে
ফাল্গুনের উদ্ভাসিত গৌরবে সাজায়
নিমেষে সাদরে, কখনও-বা মাথায় পরিয়ে দেয়
কাঁটার মুকুট, যন্ত্রণায় হৃদয়ের
তন্ত্রী ছিঁড়ে যেতে চায়। আমার আপন টেলিফোন
ভোরবেলা ভাঙায় গভীর ঘুম তার,
কখনও জাগিয়ে তোলে সুখস্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন
থেকে, কথা ঢালে কানে ষড়জে নিখাদে।
কখন যে টেলিফোন সেট নিজেরই অজ্ঞাতসারে
শুরু করে স্বপ্ন দেখা আর
দিব্যি মগ্ন হয় আত্মকথনে এবং
আমার সুন্দরী দয়িতা প্রেমে গলে
একজন কবির তুখোড় প্রতিদ্বন্দ্বী বনে যায় ঠারে-ঠোরে
ফুল্ল ফোয়ারার মতো; নক্ষত্র পাড়ায় ওর নিয়ত উড়াল।
১২.৩.৯৭
আমার একটি দুঃস্বপ্ন
ঘুমন্ত এই শহরের প্রতিটি দরজায়
আমি আজ বেপরোয়া করাঘাত করে চলেছি
বেখবর নাগরিকদের জাগিয়ে তোলার জন্য।
এখনও আমার শরীরে দুঃস্বপ্ন, কৃষ্ণ গহ্বর,
বন্য হিংস্র লতা, চোরাবালি এবং
গন্ধক আর গরম সীসার তীব্র গন্ধ।
দোহাই আপনাদের, এই গন্ধে ফিরিয়ে
নেবেন না মুখ; বন্ধ দরজা খুলে দয়া ক’রে
শুনুন আমার কথা। না, আমি কোনও
কৃপা ভিক্ষা করতে আসিনি, সামান্য খুদকুঁড়ো অথবা
সিকি-আধুলি প্রাপ্তির আশায় নয়
আমার এই ব্যাকুল করাঘাত। এই যে দেখছেন
আমাকে আলুথালু বেশ, উশ্কো খুশ্কো চুল;
না-কামানো খোঁচা দাড়ি, আমি অধীর
একজন বার্তাবহ ছাড়া কিছুই নই। দুঃস্বপ্ন
আমার ভেতর পুরে দিয়েছে এক ভয়াবহ বার্তা।
আপনারা কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন না
কোনও পদশব্দ? দেখতে কি পাচ্ছেন না
ভয়ঙ্কর একপাল না জন্তু-না মানুষ
তেড়ে আসছে চৌদিক থেকে? ওদের দাঁত-নোখে
লেগে আছে পুরনো আর নতুন রক্তচিহ্ন,
মানুষের হাড় দিয়ে ওরা পেটাচ্ছে কান-ফাটানো
ঢাকঢোল, ঘুরঘুট্রি অন্ধকারে ওদের
বসতি, আলোর ঝলকানিতে তিমিরবিলাসী
বাশিন্দাদের অস্তিত্ব ঝলসে যায় বলেই
ওরা আমাদের স্বাধীনতার অনন্য শিখাটিকে
নিভিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোঁট পাকাচ্ছে,
কিন্তু আমাদের হৃদয়ে সেই শিখা সূর্যোদয় হয়ে
জ্বলছে। ওরা কীভাবে নেভাবে
কোটি কোটি হৃদয়ের দেদীপ্যমান সূর্যোদয়?
দুঃস্বপ্নের সংবর্তে আমি শুনেছি
শকুনের মতো ওদের নখর বলছে, ওরা সাম্প্রদায়িক;
নেকড়ের চোখের মতো ওদের চোখ বলছে, ওরা হিংস্র ঘাতক;
মন্ডুকের মতো ওদের লাফালাফি বলছে,
ওরা কূপমন্ডুক আর কুসংস্কারের উপাসক;
ওদের পশ্চাদগামী অপযাত্রা বলছে, ওরা প্রগতি-বিরোধী।
দুঃস্বপ্নের ভেতরে আমি শুনেছি ওদের অশুভ নিঃশ্বাস,
ওদের দানবিক পদশব্দ। হে ঘুমন্ত নাগরিকবৃন্দ,
আপনাদের প্রতিটি দরজায়
করাঘাত করে চলেছি অবিরাম;
দোহাই আপনাদের, একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠুন,
আমার দুঃস্বপ্নকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবেন না।
১০.৪.৯৭