সে
একটি তরুণী দেখি গলিটির দুপুরে অগাধ রোদ্দুরের নিস্তব্ধ ভিতর দিয়ে
একা হেঁটে চলেছে, কোথায় যাবে, জানলার শার্সি ধ’রে
ভাবি; অচেনা সে
আমার তবুও কেন জানি অজানা শ্যামলী সেই
তরুণীর জন্যে প্রাণে মমতার সোঁদা ছায়া নামে। ভাবি, সে কি
এভাবেই হেঁটে হেঁটে কোনওদিন পিচ্ছিল আন্ধারে
করবে প্রবেশ, না কি অগাধ পূর্ণিমা
করবে বর্ষণ তাকে গাঢ় অনুরাগের পরাগ
ছিটিয়ে সত্তায়? আপাতত
সে থাক আমার এই কিছু হরফের সেবাশ্রমে।
৮.৯.৯৭
সে এক বাঁশিঅলা
এই যে এখন গভীর রাতে প’ড়ে আছি
বেঘুম খাটে বড়ই একা, কিসের জন্যে? চতুর্দিকে
দেখছি কেন কাদামাখা অনেক হাড়ের নাচানাচি?
কেন আমার চোখের ভেতর এলোমেলো কাঁটা গজায়
এই প্রহরে? দেয়াল জুড়ে কত কী-যে উঠছে ফুটে-
কিছু চিনি, কিছু আমার অচেনা খুব। ছায়াবাজি চলছে যেন
বন্ধ ঘরে মধ্যরাতে। বুকের মধ্যে কালো জালে
আটকে-পড়া ব্যথিত এক পাখি কাঁদে নিঝুম সুরে।
এই তো দেখি আমার দিকে হাত বাড়াল নিরিবিলি
কে যেন খুব স্নেহভরে; কিন্তু এ কী হাতের কোমল
মুদ্রা উধাও সাইকেডেলিক গোধূলিতে। আমার কথা
করুণ স্বরে ইতস্তত ঘোরে ফেরে; হাতের চেটোয় নেচে ওঠে
আশরফিরা, হারায় আবার ধূলিঝড়ে, জানালাটায়
বাদুড় এসে ঝুলে থাকে, ক্যাকটাসে হায় আগাগোড়া
ঘর ছেয়ে যায়। উড়োপুড়ো মনে আমার এক্কেবারে
কয়লা খনির আঁধার-ছেঁড়া হীরে জ্বলে যখন তখন।
এই তো আমি বয়েসী এক কেমন মানুষ মনে প্রাণে
সমর্পিত পদ্য লেখায়, মনপাতালে
পুরোপুরি ছন্নছাড়া, স্বপ্ন কত গড়ি ভাঙি, আবার গড়ি।
পাহাড়ে কেটে নয়া নহর সৃষ্টি করি, খোলামেলা
সাঁতার কাটি গহীন গাঙে, পাতাল থেকে তুলে আনি
মুঠোয় ভ’রে রত্ন কিছু। সমুদ্দুরের জল ছিটানো
রূপসীদের সঙ্গে কত ফিস্ফিসিয়ে কথা বলি,
প্রায়শ এই ছোট ঘরে জ্বরের ঘোরে হিজিবিজি কীসব বকি।
লোকে বলে, আমার মাথায় বিপজ্জনক ভাবনাগুলো
বসত করে মৌমাছিদের মতই আজো। কুয়োবাসী সবার কাছে
আমি বটে চোখের বালি, ওরা কেবল কুৎসা রটায়
আমার নামে হাটে মাঠে। যে বাঁশিতে ফুঁ দিলে রোজ তরুণেরা
ঢেউয়ের মতো ছুটে আসে আমার দিকে, সে বাঁশিটা
শক্র ওদের ব’লেই সেটা বিনাশ করার ঘন কালো যজ্ঞে মাতে।
আমার বাঁশি ঘাসে ঘাসে রোদের ঝিলিক, মেঘনা নদীর
ঝোড়ো বুকে ঢেউয়ের গান, আমার বাঁশি আকাশ জোড়া রঙের সাঁকো।
২.৫.৯৭
সৌন্দর্য আমার ঘরে
সৌন্দর্য আমার ঘরে চলে আসে কখনও সখনও
চুপিসারে, বসে মুখোমুখি,
মাঝে মাঝে ঠারে-ঠোরে কথা
বলে কিনা, সহজে যায় না বোঝা, আর
কখনও তাকায় যেরকম ঝিল থেকে
মুখ তুলে পরিতৃপ্ত তরুণী হরিণী।
সৌন্দর্যের কোনও মান-অভিমান নেই, নেই উষ্মা
তর্কের ঊর্ধ্বেই থাকে সর্বক্ষণ, কলহে মাতে না
কোনওদিন। তার আসা-যাওয়া
সর্বদা নিভৃতে অমাবস্যা, পূর্ণিমায়, অকস্মাৎ
চৈত্রের দুপুরে কিংবা শারদ সন্ধ্যায়, মধ্যরাতে; বস্তুত সে
কখনও ধারে না ধার বাঁধা-ধরা কোনও
প্রহরের অথবা ঋতুর,
এমনই খেয়ালী তার আগমন অথবা প্রস্থান।
নিরর্থক সব কিছু জেনেও যখন দেখি খরখরে দুপুরে
গাছতলা ছায়ার প্রলেপে মুগ্ধতায়
নিমজ্জিত, বিকেলে পাখির ঝাঁক আকাশে আল্পনা
হ’য়ে ওঠে, পরিচিত ব্যালকনিটিতে
কেউ এসে বসে, রবিশঙ্করের সেতারের সুর
ভেসে আসে কিয়দ্দূর থেকে, মনে হয়
সুন্দর নাস্তির ছায়া ঈষৎ সরিয়ে
অন্তত রচনা করে ক্ষণকাল নিজস্ব আবছা ব্যাকরণ!
কী ব্যাকুল প্রতীক্ষায় থাকি প্রতিক্ষণ,
কখন সুন্দর এসে দাঁড়ায় এখানে নিরিবিলি
পোড়-খাওয়া আমার সত্তায়
চকিতে জাগিয়ে দিতে ঝর্ণাধারা। তাই
দরোজা উন্মুক্ত রাখি সর্বদাই, যদি
সব পাখি ঘুমিয়ে পড়ার পরে আমার এ ঘরে
নিস্তব্ধ প্রহরে ফের কাউকে কিছু না ব’লে স্বপ্ন উড়ে গেলে
নয়টি বীণার সুরসভা ব’সে যায় অমলিন কুয়াশায়।
১৮.৩.৯৭