যেমন সালিম আলি
শুরুতে অন্ধকারে উঁকিঝুঁকি,
পরে অস্থির ডানা-ঝাপটা,
শেষে কাগজে এসে ব’সে পড়া;
কখনও একটু আধুট
নড়াচড়া,ঈষৎ ওলোট পালট। নিজের লেখা
পঙ্ক্তিমালার দিকে ব্যাকুল
তাকিয়ে থাকি, যেমন সালিম আলি
গভীর নিরীক্ষণ করতেন পাখিদের
আমি চাই না আমার কবিতা
শুধু আটকে থাকুক বইয়ের
পাতায়, আমার প্রবল সাধ,-
রচিত পঙ্ক্তিমালা
উড়াল দিক দূর দিগন্তে,
স্পর্শ করুক মেঘমালা; গাছপালা এবং
পাখপাখালির সঙ্গে কথা বলুক, কোকিল
হ’য়ে ডাকুক মানুষের অন্তরে প্রহরে প্রহরে।
আমি চাই আমার কবিতা প্রজাপতি রূপে
চুম্বন করুক প্রিয়তমাকে,
নিঃসঙ্গ মানুষের মন থেকে
সরিয়ে দিক
বেদনার গহন ছায়া,
ক্ষুধার্তদের সানকিতে ঝরুক
রকমারি খাবার হ’য়ে
হারিয়ে-যাওয়া শিশুকে ঠিক
পথ দেখিয়ে নিয়ে যাক মায়ের আলিঙ্গনে।
আমি চাই কবিতা মিছিলের যুবার
সাহসের দীপ্তি হ’য়ে ছড়িয়ে যাক সবখানে,
শহীদের মাথার পেছনে আমার কবিতা হোক জ্যোতির্বলয়।
এ-ও তো হয়, হঠাৎ কোনওদিন পথের পাশে
আহত পাখির ছিন্নভিন্ন পালকগুচ্ছ দেখে আমার
কবতার খাতার কাটাকুটিময় কয়েকটি
মৃত পঙ্ক্তির কথা মনে প’ড়ে যায়। নিশ্চয়ই
কোনও জখমি কিংবা মুমূর্ষু পাখি দেখে
সালিম আলি শিউরে উঠতেন।
৩০.৫.৯৭.
শাদা শূন্য পাতা
সেই কখন থেকে আমার লেখার টেবিলে
লম্বা চওড়া একটা শাদা কাগজ অনিকেত, রুক্ষ
সন্ন্যাসীর মতো অলস শুয়ে আছে খাঁ খাঁ অক্ষরহীন;
আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে যেন। সকাল ও দুপুরকে
এক কাঠঠোকরা ঠোকরাতে ঠোকরাতে
ঠেলে দেয় প্রগাঢ় গোধূলিতে। এমন হ’তে থাকলে
তোমার কাছে প্রার্থনা করি কবিতা। যখন আমি তোমাকে
বলি, ‘কবিতা দাও’, তুমি বিস্ময়ে খানিক বাক্যহারা
তাকাও আমার দিকে, ভাবো ঠাট্রা মশ্করা
করছি। আমার কাতরতা উপেক্ষার ধূসরতায় গড়ায়।
‘এই আমি কী ক’রে কবিতা দেবো তোমাকে’, তুমি প্রশ্ন করো।
গাছের পাতা থেকে পিছলে-পড়া রোদ, যাযাবর মেঘ, বৃষ্টিভেজা
গলিপথ, দেয়ালে ব’সে লেজ-দোলানো
মসৃণ পাখি আমাকে কবিতা দেয় কখনও কখনও, তাহ’লে
তুমি কেন তোমার অমন ঐশ্বর্যকে পাঠাবে না এই অপেক্ষমাণ
বন্ধ্যা পাতায়? আমার ব্যাকুলআত কি তৃষিত
পাখির মতো চঞ্চু গুঁজে প’ড়ে থাকবে কাঁকড়াময় নিঃসাড় বালিতে?
আমার শূন্য শাদা পাতা মেলে ধরেছি তোমার সামনে, সাড়া দাও।
আমার ব্যাকুলতা তোমাকে স্পর্শ ক’রে অনন্তের
কিছু বদ্বুদ তুলে নিতে চায় করতলে;
আমার ব্যাকুলতা তোমার ঠোঁটের কাছে এগিয়ে যায়
চুম্বনকে অমরতায় অনূদিত করার আশায়। আমার
এই-আমিকে উন্মোচিত করেছি
তোমার ঘনিষ্ঠ উষ্ণতায়। এমন উন্মোচনকে তুমি কি
শাদা পাতায় গৌরবহীন মূকে ভিখারী ক’রে রাখবে সকল সময়?
৬.৭.৯৭
শিকার
একটি সোমত্ত নৌকা, দক্ষ মাঝি দু’জন আরোহী, থরথর
পানির উপরিভাগে ঢেউয়ের আঘাতে
ক্ষণে ক্ষণে। বন্দুকের নলে
মৃত্যু চোখ পিটপিট করে চরমুখী
এক ঝাঁক পাখি দেখে। অকস্মাৎ গুলির ধমকে
স্তব্ধাতার বুক কাঁপে, চরে রক্তলেখা
সাপের ধরনে এঁকে বেঁকে যায়, বাঁকানো টুপির
পাশে জাগে পালকের মসৃণ উল্লাস।
রক্তাপ্লুত পাখিগুলি যাবে শহরের
কিচেনে সুখাদ্য হ’তে। যে মহিলা আমাকে নন্দনতত্ত্ব খুব
সহজে শিখিয়েছেন চোখে
কখনও নিবিড় বনজ্যোৎস্না ডেকে এনে
কখনও বা কী সুদূর বৈজয়ন্তী রূপটান এনে,
তিনি অবলীলাক্রমে রন্ধনশিল্পের
সেরা নিদর্শন
সযত্নে পরিবেশন করবেন টেবিলে, তখন
প্লেটে হত পাখিদের প্রণয়ের ভাষা
আর্তনাদ হ’য়ে উঠবে কি লহমায়?
৭.১০.৯৭
সর্বত্র সে আগন্তুক
বুঝি না কেন যে কোনও কোনওদিন মনে হয়, যেন
বহুকাল পর ফিরে এসেছি নিজেরই
নিবাসে বেগানা আগন্তুক একজন। এটাই কি
ঠিক বাড়ি? ভুল করিনি তো? দ্বিধান্বিত
বাজাই কলিংবেল; মনে হ’ল কাজের লোকটি
গেট খুলবে কি খুলবে না, ইতস্তত করছিল।
আখেরে আমার পরিচিত কেউ ভেবে
প্রবেশাধিকার দেয় আমাকে নীরবে। যারা ছিল
আমার আপনজন, তারা এল চোখে মুখে নিয়ে
সংশয়ের ছায়া, ওরা কেউ
বস্তুত চেনে না এই অতিথিকে, যদিও আমার
কোণের পড়ার ঘরে ঢোকার আবছা
অনুমতি দেয় ইশারায়। এই যে চেয়ার, এই
লেখার টেবিল, বই, খাতা
আমারই তো? না কি অন্য কারও? বুক শেলফ
থেকে বই টেনে নিয়ে খুলে দেখি আমার নিজেরই
স্বাক্ষর বাদামি পাতাটির এক কোণে উপস্থিত
তারিখ সমেত আর বিষণ্ন দেয়াল যেন অশ্রুপাত করে।
এ বাড়ির সবার কাছেই
কেমন অচেনা আমি এবং আমিও
স্মৃতি বিস্মৃতির গোধূলিতে ব্যথিত দাঁড়িয়ে একা
অচেনার ভিড়ে আর দেয়ালে ঝোলানো
ফটোগ্রাফে ঐ যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে মধুর
হাসছেন, তিনিও আমাকে
অপরিচয়ের রুক্ষ বলয়ে রাখার অকম্পিত
শপথ আউড়ে চলেছেন নিত্যদিন!
এখন আপন ঘরে বই হাতে বেগানার মতো
বসে আছি, তবু মনে হয়-
ধ্বনিহীন অগণিত ভায়োলিন-বিছানো পথের
মাঝখানে থেমে দূর দিগন্তের দিকে
বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি; হঠাৎ শ্যাওলা-ঢাকা এক
পথচারী আমার নিকটে এসে জেনে নিতে চায়
জটিল ঠিকানা, নিরুত্তর
আমি শ্যাওলার ঘ্রাণে কেমন সবুজ হতে থাকি।
আমার নিজেরই কোনও ঠিক
ঠিকানা নেই যে জানা কী ক’রে বোঝাই লোকটিকে?
মুখের ভেতর নিশান্তের হাওয়া খেলা করে আর
গিলে ফেলি নক্ষত্রের কণা; বিবমিষা জাগে, বমি করি কিছু
রঙধনু-রেণু, আর বিস্তর বমিতে ভাসি, কারা
হেসে ওঠে দিকগুলি বিপুল ফাটিয়ে। আমি এই শহরের
কোথাও কাউকে আদৌ চিনি না এবং
আমাকেও হাটে বাটে ঘরে বাইরে চেনে না কেউ।
১৮.৪.৯৭