ভোরবেলা এবং একজন মৃতা
ভোরবেলা চেয়ারে রয়েছি ব’সে বড় একা, মৃদু
ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যায় বয়েসী শরীর। কাল রাত
কেটেছে আমার ক্ষ্যাপা জাগরণে।
কবিতা লিখব ব’লে কখনও টেবিলে
থেকেছি নিঝুম ঝুঁকে, কখনও করেছি পায়চারি
ঘরে আর বারান্দায়, অকস্মাৎ একটি লাইন
মগজে ঝিকিয়ে উঠে কেমন বেগানা হ’য়ে আঁধারে হারায়।
বস্তুত ক’দিন ধরে এই মতো হচ্ছে, খাতা কবরস্তানের
নিশুত রাতের শূন্যতায় মাখা আর
আমার ওপর ঝড়ঝাপ্টা যাচ্ছে ব’য়ে।
ভোরবেলা যখন তোমার কথা ভাবি, সব কিছু কি রকম
ওলট পালট হয়ে যায়, কবিতা লিখতে না পারার হা-হুতাশ
নিমেষে গায়েব হয়। অথচ তোমার সঙ্গে কখনও আমার
কোথাও হয়নি দেখা, শুধু
এইটুকু জানি, হে তরুণী, একজন
কর্মিষ্ঠ সৈনিক ভেঙে-পড়া দালানের হা-হা ধ্বংসস্তূপ থেকে
সযত্নে তুলেছে টেনে ফেলে-যাওয়া প্রাণহীন শরীর তোমার।
তুকি কি কলেজ ছাত্রী? তুমি কি আগের দিন গোধূলিবেলায়
আকাশের দিকে
তাকিয়ে ভেবেছ প্রেমিকের কথা নাকি
পরীক্ষার ফল নিয়ে ছিল দুর্ভাবনা? এমন ক্ষুর্ধাত ছিল
সুঠাম দালান, তুমি পেয়েছিলে টের কোনওদিন?
২৩.১১.৯৭
মানুষের এই মেলায়
এমন তো হয়, কোনও কোনও সময়
নিজেকে দেখি এক টানেলে নিঃসঙ্গ হেঁটে চলেছি
ক্রমাগত। অন্ধকার আমার সারা শরীরে
দাঁত বসাচ্ছে ডালকুত্তার মতো। চিৎকার করতে চাইছি
মেঘফাটানো স্বরে, অথচ কে যেন গলা চেপে
ধরেছে। আমার নিজের পায়ের জুতোর সন্ত্রস্ত আওয়াজ ছাড়া
অন্য কোনও শব্দ পশে না কানে। আমার
সামনে অথবা পেছনে কেউ নেই; আমি
বাস্তবিক এগোচ্ছি নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি,
বোঝা দায়। এভাবে কি পৌঁছে যাব কোনও বধ্যভূমিতে?
গোধূলিবেলায় নিজেকে কেমন বেকুব
দাঁড়ানো পাই ফায়ারিং স্কোয়াডে; অনেকগুলো রাইফেল
তাককরা আমার দিকে; ভাবলেশহীন আমি
দেখি অদূরে অনেক পিঁপড়ে এগিয়ে যাচ্ছে
একটি মৃত পাখির অনাড়ম্বর সৎকারের উদ্দেশে।
চকিতে বন্দুকের ঝাঁক
রজনীগন্ধার ঝাড় হ’য়ে দুলতে থাকে
চোখের সামনে এবং আমাকে সাদর বরণ ক’রে নেয়
কাঠবিড়ালি, ময়ূর, মাছরাঙা, বৃক্ষশ্রেণী,
পলাশ, নীলপদ্ম, ঘুঘু, ডাহুক আর বুলবুল।
এখন আমি অনেক শিশু, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ় আর
প্রাণবন্ত বৃদ্ধের সংসর্গে আছি। বিস্মিত দেখি
আমাদের ঘিরে নাচছে অনেক নক্ষত্র; মানুষের
এই মেলার কখনও আমি নক্ষত্র, কখনও
সরোদ-বাজতে থাকি উত্তর দক্ষিণে এবং
পূর্ব-পশ্চমে। কে আমাকে আটকে রাখতে পারবে?
৬.৭.৯৭
মার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে
কী ক’রে যে তোমাকে শুইয়ে দিতে পেরেছি এখানে
শীতল মাটির নিচে? মা, তুমি নিথর নিদ্রা মুড়ি
দিয়ে আছো; ফাল্গুনের রোদ
বিছানো কাফন-ঢাকা শরীরে, তোমার
উন্মোচিত মুখ স্পর্শ করি শেষবারের মতন।
বজ্রের আওয়াজ কর্জ ক’রে
যদি ডাকি বারবার, তবু তোমার এই ঘুম
ভাঙবে না কোনওদিন, কোনওদিন আর।
নির্বিকার গোরখোদকের কোদালের
মাটি-খোবলানো ঘায়ে দ্বিপ্রহরে আমার পাঁজর
বোবা আর্তনাদ করে। নিঃসীম অনন্তে
তোমার নিঃসঙ্গ যাত্রা করেছি ধারণ অনুভবে
প্রত্যেকের অগোচরে। হঠাৎ কবরস্তানে ব্যাকুল কোকিল
ডেকে ওঠে রৌদ্র চিরে, নিঝুম দুপুর
আরও বেশি স্তব্ধতায় সমাহিত। মার কবরের
পাশে ব’সে এবং দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ
মার আদরের মতো প্রশান্তির স্নেহ পাই; মাটি
ক্রন্দনের প্রতি উদাসীন বুকে টেনে নেয় তাঁকে।
মানুষের কী স্বভাব! এখানেও কতিপয় লোক কিয়দ্দূরে
তুমুল বচসা করে না জানি কী নিয়ে!
টাকাটাড়ি? দলাদলি? কবর-বাঁধানো বিষয়ক
জটিলতা? মাঝে মাঝে নিভৃত কোকিল ডেকে ওঠে।
বলতে বুক পোড়োবাড়ি হ’য়ে যাচ্ছে, তবু
বলছি মা, তোমার আমার দেখা হবে না কোথাও
কোনওকালে; আমিও তোমারই মতো অস্তিত্ববিহীন
হয়ে যাব কোনওদিন, শুধু
মাঝে মাঝে ধুধু স্মৃতিকণারূপে ছুঁয়ে
যাব কি যাব না কারও কারও ভুলো মন!
মা তোমার শিয়রে গোলাপ রেখে হৃদয়ে সায়াহ্ন
নিয়ে পথ হাঁটি, প্রাণে ঝরে মরা পাতা,
মৃদু হাওয়া বন্দিনীর শীতল ফোঁপানি,
চোখ বড় বেশি জ্বালা করে।
৭.৩.৯৭
যিনি শয্যাগত
জানালায় প্রত্যুষের হাত; একটি অচিন পাখি লেজ নেড়ে
আসে আর যায়। সারা ঘরে দীর্ঘস্থায়ী
ব্যাধির প্রবীণ গন্ধ; যিনি শয্যাগত,
তার শালে কয়েকটি মাছি আফিমখোরের মতো
ধূসর ঝিমোয়। বিছানার
পাশে কছু কবিতা, দর্শন আর সমাজতত্ত্বের বইপত্র।
নড়ে চড়ে উঠে চোখ খুলে তাকাতেই
যেন ক্রমে রুয়োর বিষণ্ন রাজা স্পষ্ট হয় সংকীর্ণ শয্যায়;
বলেন না কিছুই, কেবল
আলগোছে তাকিয়ে দেখেন চারদিকে, একপাশে
প’ড়ে থাকা বিশীর্ণ অলস তার হাত বুঝি কোনও
বিরল সম্মানে ঝলসিত হ’তে প্রতীক্ষা-কাতর!
প্রতিভার মতো রোদ ঘরে আসে, শয্যাগত যিনি
তার কণ্ঠনালী পান করে রোদ, যেন কিছু সতেজ বীয়ার।
প্রতিভা এবং ব্যাধি কণ্ঠলগ্ন হয়ে পরস্পর
করে বসবাস,
এ-কথা কতটা সত্য জানা নেই, তবু তিনি ব্যাধির শেকলে
বন্দী বহুকাল, ব্যাধিক্ষেত্রে ধুঁকে ধুঁকে
নিজেকে দর্পণ ক’রে আলোয়, তিমিরে
কত যে কুসুম তিনি ফোটালেন মোহন মেধায়।
মাঝে মাঝে তিনি ঘুমঘোরে
দেখেন বিজন মাঠে এক পাল পাগলা কুকুর
তাকে লকলকে জিভ বের ক’রে তাড়িয়ে বেড়ায়,
কখনও আবার কতিপয়
ক্ষুধার্ত মানুষ,
শতচ্ছিন্ন কোর্তা-পরা, ছিঁড়ে খাচ্ছে তাকে জয়োল্লাসে।
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবেন-
এই তো এখনই কাদা খ’সে খ’সে পড়বে, হাতের
বদলে কাদার টুকরোগুলো ইতস্তত
খাকবে ছিটানো, আঙুলের স্থানে কিছু
পাটখড়ি দেখা যাবে হয়তো বা, তবে কি কেবল
কবিতাই পরিত্রাণ, এই প্রশ্নে নিবিড় জড়িয়ে গিয়ে তিনি
জানালার বাইরে রোদ্দুরে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে নেন।
২৭.৯.৯৭