যখন তোমার সঙ্গে
যখন তোমার সঙ্গে কথা বলি টেলিফোনে, ভয়ে
ভয়ে থাকি, পাছে অকস্মাৎ ছেদ পড়ে
তোমার কথার ট্যাপেস্ট্রিতে।
বলা তো যায় না,
যন্ত্রের ব্যাপার, ক্ষ্যাপামির খ্যাতি তার
এ শহরে আজকাল বড়ই ব্যাপক।
টেলিফোনে ভেসে এলে কখনো তোমার
কণ্ঠস্বর, মনে হয় যোজন যোজন দূরে তুমি;
কথারা মেঘের মতো ছুঁতে গিয়ে ছোঁয় না আমাকে।
এ রকম ভঙ্গি ফোটে কথায় তোমার,
যেন কেউ আড়ি পেতে আছে, নিচ্ছে টুকে অন্তরালে
তোমার সকল কথা। আবীর তোমার গালে ছড়িয়ে পড়েছে,
ভেবে নিতে পারি; কখনো বা
অনুমান করি, ব্রত নিয়েছো নীরব থাকবার। মিনিটের
পর কত মিনিট নিথর কেটে যায়,
স্তব্ধতা ওঠে না বেজে এস্রাজের সুরে। অর্ন্তগত
হরিণকে বেঁধে
রেখেছো রজ্জুতে, তার খুরে উড়বে না
রাঙা ধুলো; ইচ্ছে হয় কথা দিয়ে তোমাকে সাজাই,
কিন্তু আমি নিজেও নির্বাক, ছন্নছাড়া
যন্ত্রের ভেতরে যদি পারতাম নিভৃতে চালানা
করে দিতে কিছু জ্যোৎস্না অথবা রোদ্দুর।
টেলিফোন রেখে বসে পড়বো ঠিক কবিতা লিখতে,
কেননা আমার মন নাছোড় খারাপ হয়ে যাবে।
রুক্ষ বৃক্ষ
শীতার্ত নিষ্পত্র বৃক্ষমূলে কে পাতে আসন, বলো?
ভুলে কেউ বসে, বয় দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলো ছলো।
হু হু ডাল; ঘন্টাধ্বনি বাজে কোথাও ধূসর দূরে,
রুক্ষ বৃক্ষ মর্মরিত অবচেতনের সুরে সুরে।
রেললাইনের কাছে
রোজ আমি রেললাইনের ধারে রেললাইনের কাছে যাই
সন্ধ্যেবেলা। খানিক দাঁড়াই,
আশেপাশে দৃষ্টি মেলে দেখি কী কী আছে-
বনকুসুমের শোভা, ঝোপঝাড়, কতিপয় গাছে
গহনতা কী নিবিড় উপবিষ্ট; এখানে এসেছি কতবার,
অথচ কখনো কোনো রেলগাড়ি আসা কি যাবার
সময়ে দেখি নি। শুধু রেললাইনের খাঁ খাঁ ভাব বুকে নিয়ে
ফিরে গেছি একা একা। জায়গাটা বিলিয়ে
যাচ্ছে ক্রমাগত স্তব্ধতার কাশফুল। একজন খর্বকায়
লোক স্যুটকেশ হাতে আস্তে হেঁটে যায়
রেললাইনের পাশে, পেছনে পেছনে কে রমণী রূপ
জ্বেলে পথ চলে কেমন নিশ্চুপ।
ভাবি, ওরা কে জানে কোথায়
যাবে, হয়ত কিছু পরে হঠাৎ হারিয়ে যাবে ঘন কুয়াশায়।
এখানে কে আসতে বলেছিল এ বেলাশেষে
এরকম জনহীনতায়, যেখানে প্রায়শ ভেসে
আসে পথ হারানোর সুর,
যেখানে নিঠুর
দরদী সে কবে চাবি ফেলে চলে গেছে অন্তরালে?
আমি মুক্তো খুঁজি মজা খালে।
পরকীয় প্রেমের মতই কষ্ট বুকে লেগে থাকে;
কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে, জলজ উদ্ভিদ যেন। আর্ত পাখি ডাকে
বারবার; আমার কি কোথাও যাবার নেই? ফিরে
আসা কাছে শুধু এক নির্জন কুটিরে,
যেখানে ক্ষতের মতো বাতি
জ্বলে, কারো পদধ্বনি শোনার আশায় কান পাতি
কী উদ্গ্রীব। একদিন ট্রেনের শব্দ কানে
আসে, ছুটে গিয়ে দেখি রেললাইনের চিহ্ন নেই কোনোখানে।
শুধু একা একা
এখানে এ জনশূন্যতায় বসা যায় কিছুক্ষণ। দ্যাখো, সূর্য
শ্মশানের মাতাল ডোমের মত ঝিমুচ্ছে এখন।
যখন এসেই তুমি পড়েছ এখানে,
তাহলে কী হবে বুকে দ্বিধার পাথর নিয়ে এমন নিশ্চুপ
হয়ে গেলে? এসো, বসি এই নদীতীরে।
কিছু কথা, কিছু নীরবতা আপাতত আমাদের ঘিরে থাক।
ভয় নেই, হে মেয়ে, তোমাকে ভোগ করার লালচে
এখানে আসি নি। যদি হাত ধরি আলগোছে, ছুঁই
স্তন কিংবা চুমো খাই, তাহলে কি তোমার ভাষায়
এ সব নিছক ভোগে অনূদিত হবে?
মনে হয়, এই বুঝি তুমি ছেড়ে ছুড়ে
তোমার সকল আবরণ জলকন্যা হয়ে নেমে
যাবে কালো গহন নদীতে
ভাষাহীনতায়, হতবাক চেয়ে থাকব দূরে,
ডাকব স্বরহীন কণ্ঠস্বরে, তুমি তাকাবে না ফিরে
একবারও। কুয়াশার জাল
সরিয়ে বিস্ময়ে দেখি, এখানে কোথায় কেউ নেই।
আমি শুধু একা একা বকে যাচ্ছি, চোখে লাগে শ্মশানের ধোঁয়া।
শুরু
জানালার বাইরে দৃষ্টি চালান করে
সে ভাবলো, একী কাণ্ড, বেলা তো কম হলো না,
এখনো তার শুরু করাই হয় নি
মাথায় জোর তুষার ঝড়, দাঁতে ক্ষয়,
হাতের শিরাগুলো মুখ ভ্যাংচায় লাগাতার,
অথচ সে আজো শুরুই করতে পারে নি।
হতাশা বাদুড় হয়ে ঝুলতে থাকে, খুঁজে নেয়
অন্ধকার; চুল ছিঁড়ে, হাত কামড়ে
কোনো সমস্যারই কূলকিনারা করতে না পেরে
সে ভীষণ একলা। ফলাফলের কোঠায়
শূন্য তাকিয়ে আছে
নিঝুম উদাসীনতায়। এবার কী করে
ঠিকঠাক শুরু করা যায়, এই ভাবনা
তাকে বসিয়ে রাখে
অনেকক্ষণ। কোত্থেকে কালবোশেখির
ঝড় হঠাৎ সব কিছু
ওলট পালট করে ফেলে, তরী তীরে এসে
পৌছুনোর আগেই হলো ভরাডুবি।
কোথাকার এক পাখি ঘরের কোণেই ছড়ায়
স্বর্গীয় সুর, অনেকদিন
অপেক্ষা করা হলো। কপাল ঠুকে শেষবারের মতো
চেষ্টা করা যাক, হয়তো পাখির গান শুনে
অথবা খাটে লুটিয়ে-পড়া
জ্যোৎস্নালতা দেখে সে এতদিনে পারবে
শুরু করতে। এখন তার স্বপ্ন আর বাস্তবের
টুকরো টাকরা সম্বল করে শুদ্ধতা-মোড়া
পাখি ওড়ানো; আজ গেল, কালও গেল,
কিন্তু শুরু করাটাই এখন বাকি।
সে আসুক
কতকাল আর ঠ্যাকা দিয়ে রাখা যায় ভীষণ পতনশীল
ঘরবাড়ি? এদিকটা সামলাও যদি,
সামলাতে পারো যদি,
সামলাতে পারো কায়ক্লেশে, অথচ ওদিক দ্রুত
হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। ক্ষয়গ্রস্ত
অতীতের ভিত, একালের পলাস্তারা ঝরা পাতা,
ভবিষ্যের খিলান অস্পষ্ট অতিশয়। বাসিন্দারা অনেকেই
উদাসীন; কেন তুমি নিরর্থক এই ভগ্নস্তূপে
বসে আছো গানহীন পাখির মতোন
কোন্ সে আশায়? দূরে কুয়াশায় কারা হেঁটে যায়?
ওরা কি শবানুগামী? কনকনে শীতে
জমে গেছে মাতমের ধ্বনি। কেউ কি পারে না ফের উৎসবের বোল তুলে
এ কাল সন্ধ্যায় জ্বেলে দিতে আলো?
কী করে বাঁচবে কেউ এভাবে এখানে,
যেখানে মেধার দ্যুতি নেই, গুমরানি আছে, গান নেই; দশদিকে
মূর্খের প্রলাপ শুধু, অবলুপ্ত জ্ঞানের প্রলেপ?
যে শতকে ঘরে ঘরে রিরংসার নৃত্য অবিরাম, ভালোবাসা
দরজার বাইরে দাঁড়ানো, আস্তে হাত থেকে খসে যায়
স্নিগ্ধতার উৎফুল্ল মুকুল,
চোর ডাকাতের সঙ্গে এক দড়িতেই ফাঁসি দেয় মহত্বকে
অত্যন্ত কর্কশ দস্যু এবং সত্যের গলা বার বার চেপে
ধরে কদাকার হাতে মিথ্যাচার, সে নিষ্ঠুর, বড় ভয়াবহ
শতকেও অসহায়, সন্ত্রস্ত মানুষ পথ হাঁটে,
খায় দায়, ভালোবাসা পেতে চায়, লুকিয়ে চুরিয়ে ধুলোমাখা
সেতার কী ব্যগ্র খোঁজে, বাঁচবার তীব্র সাধ বুকে লগ্ন তার।
কেউ কেউ ভগ্নকণ্ঠে বলে, ‘সে আসুক’। কে সে যার
প্রতীক্ষায় টেরাকাটা মূর্তির ধরনে সকলেই
স্তব্ধ হয়ে আছে দিগন্তের দিকে চেয়ে এমন উৎসুক? কারো
অন্য কোনো উৎসাহ, উদ্যম নেই যেন
বিরতিহীন এই প্রতীক্ষা ব্যতীত। তুমি, হ্যাঁ তুমিও গালে
হাত দিয়ে দেয়ালে ঠেকিয়ে পিঠ নিশ্চুপ, নিঃসাড়
হয়ে আছো, প্রায় বজ্রাহত। এদিকে তো পুনরায়
প্রাগৈতিহাসিক জন্তু, অতিকায়, ভয়ঙ্কর, মুখের গহ্বরে
তার নিচ্ছে পুরে একে একে
সৃজনের যাবতীয় উপাদান অকাতরে। তবু প্রেতজব্দ মানুষেরা
ভাবলেশহীন; ফিসফিসে কণ্ঠে বলে-
‘একটু অপেক্ষা করো, জ্বালো না প্রদীপ, সে আসুক’।
কে সে? কে সে? অলৌকিক কেউ? আসবে ময়ূরপঙ্খী
ভাসিয়ে গহীন গাঙে? সে কি
হাওয়াই জাহাজ থেকে প্যারাসুটহীন
নামবে জমিনে নীলিমার উল্কি নিয়ে রঙিলা সত্তায় তার? এ সওয়াল
কখনো উতলা করে কাউকে কাউকে,
অথচ জবাব নেই এখনো কোথাও। আছে শুধু স্থবিরতা,
জরাক্লিষ্ট রাজা যেন। হাতে দেশলাই
নিলে কেউ সকলেই বলে সমস্বরে, ‘শোনো, আরো
কিছুকাল দেখা যাক, সে আসুক’। বুঝি ওরা অন্ধকার
চাদরের মতো ব্যবহার করে যেতে ভালোবাসে।
না কি আজ হঠাৎ এদের কেউ প্রতীক্ষার গালে
চড় মেরে ফস্ করে জ্বেলে দেবে দীপ? নাচবে নক্ষত্রমালা।