- বইয়ের নামঃ শূন্যতায় তুমি শোকসভা
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্য কেউ
আমার উদ্দেশে কেন এই স্তব, এই শোভাষাত্রা?
আমিতো দীনাতিদিন, আমার সুকৃতি নেই কোনো।
আমি কি দিয়েছি ডাক যে তোমরা করো ভিড়
এখন আমাকে ঘিরে? তোমাদের চন্দনের ফোঁটা,
বরমালা গ্রহণের যোগ্যতা আমার নেই, আমি
যে গান বানাই তার সুর তরঙ্গিত ব্যর্থতায়।
তোমাদের জন্যে হাঁটি দীর্ঘ পথ, কত রাত্রি আজো
নির্ঘুম কাটাই, দ্যাখো, কেবলি আমার রক্ত ঝরে
পথের নুড়িতে, নদীতীরে, কাঁটাবনে তোমাদের
উদ্দেশেই, কিন্তু নই পরিত্রাতা। বস্তুত আমার
মাথার পেছনে নেই আলোর মন্ডল। আমি শুধু
বিজন প্রান্তরে এক দুঃখিত, নিঃসঙ্গ কণ্ঠস্বর।
তোমাদের অভ্যর্থনা আর প্রতীক্ষার যোগ্য যিনি,
অমাবস্যা ফুঁড়ে তিনি স্বপ্নেশ্বর আসবেন পরে।
আমিও তোমারই মতো
আমিও তোমারই মতো রাত্রি জাগি, করি পায়চারি
ঘরময় প্রায়শই, জানালার বাইরে তাকাই,
হাওয়ায় হাওয়ায় কান পাতি, অদূরে গাছের পাতা
মর্মরিত হ’লে ফের অত্যন্ত উৎকর্ণ হই, দেখি
রাত্রির ভেতরে অন্য রাত্রি, তোমার মতোই হু হু
সত্তা জুড়ে তৃষ্ণা জাগে কেবলি শব্দের জন্যে আর
মাঝে মাঝে নেশাগ্রস্ত লিখে ফেলি চতুর্দশপদী,
শেষ করি অসমাপ্ত কবিতা কখনো ক্ষিপ্র ঝোঁকে।
কোনো কোনোদিন বন্ধ্যা প্রহরের তুমুল ব্লিজার্ডে
ভুরুতে তুষার জমে, হয়ে যাই নিষ্প্রাণ, জমাট
রাজহাঁস যেন, দিকগুলি আর হয় না সঙগীত।
অবশ্য তোমার তটে উজ্জ্বল জোয়ার রেখে গেছে
রত্নাবলী বারবার। যখনই তোমার কথা ভাবি,
প্রাচীন রাজার সুবিশাল তৈলচিত্র মনে পড়ে।
তোমার অমিত্রাক্ষর হিরন্ময় উদার প্রান্তর,
তোমার অমিত্রাক্ষর সমুদ্রের সুনীল কল্লোল,
তোমার অমিত্রাক্ষর ফসলের তরঙ্ঘিত মাঠ,
তোমার অমিত্রাক্ষর ধাবমান স্বপ্ন-অশ্বদল,
তোমার অমিত্রাক্ষর উন্মথিত ঊনিশ শতক,
তোমার অমিত্রাক্ষর নব্যতন্ত্রী দীপ্র বঙ্ঘভূমি।
হেনরিয়েটার চোখে দেখেছিলে কবিতার শিখা?
না কি কবিতাই প্রিয়তমা হেনরিয়েটার চোখ?
হাসপাতালের বেডে শুয়ে সে চোখের অস্তরাগে
তুমি কি খুঁজেছো কোনো ট্রাজেডীর মেঘ? হয়তোবা
অভ্যাসবশত বেডে অসুস্থ আঙুল ঠুকে ঠুকে
আস্তেসুস্থে বাজিয়েছো ছন্দ মাঝে-মাঝে বাষ্পাকুল
চোখে ভেসে উঠেছিলো বুঝি দূর কাব্যের কানন।
কখনো দেয়ালে ক্লান্ত চোখ রেখে হয়তো ভেবেছো-
কি কাজ বাজায়ে বীণা? এ আঁধারে কিবা মাইকেল
কি মধুসুদন কার প্রকৃত অস্তিত্ব অনন্তের
নিরুদ্দেশে রেণু হ’য়ে ঝরে, কে বলে দেবে, হায়?
আমিও তোমারই মতো প্রাদেশিক জলাভূমি ছেড়ে
দূর সমুদ্রের দিকে যাত্রা করি, যদিও হোঁচট
খেয়ে পড়ি বারংবার। রক্তে নাচে মায়াবী য়ূরোপ,
ইতালি ভ্রমণ ক’রে, সুদূর গ্রীসের জলপাই
পল্লবে বুলিয়ে চোখ, বুলেভার ছেড়ে ফিরে আসি
সতত আপন নদে তোমার মতোই কী ব্যাকুল-
আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কপোতাক্ষ আছে।
একজন কবির উদ্দেশে
একটি পংক্তির মধ্যপথে অকস্মাৎ কবেকার
দীর্ঘ গাছ ফেলে ছায়া, কার আত্মহত্যা গান গায়;
একটি শব্দের শেষে বসিয়ে কোমল কমা তুমি
দেয়ালে কী যেন খোঁজে বারবার; কিছু পথরেখা
স্মৃতিরুপ ভেসে ওঠে, কোনো কোনো রাস্তার কি নাম
কিছুতে পড়ে না মনে। একটি পংক্তির মধ্যপথে
মনে পড়ে যায় পার্কে দেশলাই ধার চেয়ে তুমি
আঁধারে ধরিয়ে ছিলে সিগারেট। একটা সন্ধ্যায়
পথে যেতে যেতে দূর থেকে দেখেছিলে পথপ্রান্তে
পুরোনো বর্ষায় কী নিসঃঙ্গ ভিজছে নতুন গণিকা
তেঁতুল গাছের নিচে, প্রসাধন তার মুছে গেছে
ব’লে তাকে বড়ো বেশি বালিকার মতো লেগেছিলো।
বাক্যের শুরুতে কিছু ডোরাকাটা প্রাণী ধেয়ে আসে,
অর্ধযতি টেনে ভাবো তোমার টাইপরাইটার
নেই, ঘরে ইঁদুরের বড়ো উপদ্রব, বর্ষাকালে
শোবার ঘরের ছাদ ভীষণ প্রস্রাব করে, ভাবো
তোমার একটি ঘড়ি চাই, শ্যার্টে বোতাম লাগানো
দরকার, তা’ছাড়া জুতোজোড়া পাল্টে নিলে ভালো হয়।
কখনো একটি পংক্তি খুব বেঁকে বসলে ভীষণ
বিরক্তিতে তড়িঘড়ি দাঁড়াও চেয়ার ছেড়ে যাও
বারান্দায়, যেন বুনো ঘোড়াটিকে বাগ মানানোর
সরঞ্জাম আছে সেখানেই; নিজেকেই প্রশ্ন করো-
তোমার জীবন কি রকম মূল্যবান? কতটুকু
প্রকৃত জীবন তুমি যাপন করেছো? কখনোবা
কলম সরিয়ে রেখে ভাবো ক্লান্ত তোমার গৃহিণী
রাঁধে বাড়ে, কোনো কোনোদিন কাঁদে অভ্যস্ত বালিশে
মাথা রেখে, যথারীতি সন্তান পালন করে, তুমি
পার্টিতে চুমুক দাও স্বপ্নের মতন গ্লাশে, শিল্প
সমালোচকের সঙ্গ ছেড়ে কথা বলো সুসজ্জিতা
মহিলার সঙ্গে, করো মুখস্থ মুখশ্রী কারো কারো।
রাত্রির পার্টিতে তুমি রাত্রির মতোই হয়ে যাও;
কখনো দাঁড়িয়ে একা এক কোণে এলেবেলে শব্দ
তুলে নাও কারো চোখ চুল কিংবা ঘরের দেয়াল
থেকে অগোচরে ধীরে সুস্থে স্বপ্নাংশ রচনা করো।
এই আসবাব, এইসব মুখ, এসবের সঙ্গে
সম্পর্ক আছে কি কিছু সরাসরি তোমার শিল্পের?
এই বাড়ি, যা বয়স্ক, বেশ জীর্ণ বটে, যা তোমার
আপন নিবাস, এই বাড়ি প্রতিদিন তোমাকেই
লক্ষ্য করে তীক্ষ্ম গুপ্তচরের নিষ্ঠায়, এ বাড়ির
থেকে ঝরে এক রাশ রঙিন পালক, পালকেরা
তোমার স্বপ্নের অভ্যন্তরে ঝরে, হয়ে যায় ফের
শিল্পের শিশির; এ বাড়ির অতিশয় নোনাধরা
দেয়ালে দেয়ালে ঠোকরায় প্রাচীন স্বপ্নের লোভে
রুক্ষ কাগজের মতো পাখি ঠোকরায় বারংবার।
টেবিলে তোমার হাত পড়ে থাকে স্তিমিত কখনো,
অলস কলম যেন; ভাবো চাঁদ উঠলেই হাতে
আবার জাগবে স্রোত প্রখর রূপালি। কোনো কোনো
মুহূর্তে একটি বাক্য লেখা হ’লে দ্যাখো সবিম্পয়ে
বৃষ্টিপাতে ডোবে চক্ষুময় নৌকা, বনস্থলী, সেতু
রত্নসম্ভারের মতো জলকন্যা, যুদ্ধের জাহাজ।
অকস্মাৎ মধ্যরাতে একটি পংক্তির মধ্যপথে
মনে পড়ে সেই কবে কারো কাছে কি যেন চাইতে
ভুলে গিয়েছিলে; অনন্তের শুভ্রতায় এ তোমার
কেমন ভিখিরিপনা? অন্ধকারে কাঙালের হাত
তোমাকে মুদ্রার মতো তুলে নিতে চায়। ফুল ফোটে
তোমার মুখের হাড়ে, বারংবার ধ্বনিপুঞ্জ তুমি।
একজন মানুষকে নিয়ে
একজন মানুষকে নিয়ে কত গল্প করা যায়
চায়ের আসরে।
যে মানুষ খায় দায় এবং ঘুমায়, ক্যামেরায়
ছবি তোলে, দিনে
অন্তর কয়েকবার চুল আঁচড়ায়, রাত জেগে বই পড়ে,
একা একা বারান্দায় করে পায়চারি, ঘন ঘন
ডাকঘরে যায়, কথা বলে পাথরের কানে কানে,
তার হাতে গোধূলির রঙ ক্রীড়াপরায়ণ হ’লে
চকিতে নিজস্ব হাত তার ভিন্ন হাত হ’য়ে যায়,
কবিতা সহজে মেলে চোখ।
একজন মানুষকে নিয়ে এরকম কিছুউ গল্প হ’তে থাকে।
অথবা আলাদাভাবে বললে দাঁড়ায় এইমতো-
একজন মানুষের মগজের কোষে নিরিবিলি
ফুলের কেয়ারি থাকে, থাকে
পলকে কোমল ঢেকে মুখ পাখির সুনিদ্রা,
চেয়ারে বৃদ্ধের ব’সে-থাকা,
তরুণীর চুল-মেলে-দেয়া, তরুশ্রেণী, বনশোভা,
আবছায়া থাকে, যা’ সৃজনে উন্মুখর।
একজন মানুষের মগজের কোষে থাকে প্রাচীনকালের
চিত্রিত সুনীল জালা, জালার ভেতরে মৃতদেহ।
করিণের মাথা
ভেসে আসে তার কাছে কোন্ দূর থেকে, বালিহাঁস
আঁধারে উদ্ধৃতি দ্যায় চরের জ্যোৎস্নার,
তার প্রত্যাবর্তনের পথে গেট খুলে রাখে স্বপ্নমগ্ন বাড়ি।
একজন মানুষের এরকম কিছু গল্প থাকে এলেবেলে।
এরকম গল্প থেকে নিভৃতে বেরিয়ে এসে একটি মানুষ
বারবার নগ্ন হয় নিজের কাছেই, কখনো সে
নীলকাশে গর্ত খোঁড়ে নখে,
কখনো আবার মেঘে মেঘে
কতিপয় কালো
পুরোনো কবর দ্যাখে, হাতের লোমের মতো ঘাস
দীপ ঢেকে দ্যায়,
স্বপ্নে দ্যাখে বৃষ্টিপাত, দ্যাখে
ছুরির মতন
একটি আঙুল দ্রুত কী নগ্ন প্রবেশ করে মাথার ভেতয়ে।
একজন মানুষের মগজের কোষে জেগে থাকে
অন্তহীন ধূলিরঙ পথ, নাম যার ‘মনে রেখো।
একজন রূপালি কবির কাছে
একজন কী সুদূর রূপালি কবির কাছে আমি
প্রায়শ যেতাম অগোচরে, যন্ত্রণা গভীর হ’লে
হৃদয়ের; দেখতাম রাজহাঁস তাঁর অনুগামী
মোহন অভ্রের কুটিরের কাছাকাছি; কথাচ্ছলে
পাখিকে ডাকার মতো ডাকতেন কবিতাকে, তাঁর
পায়ের তলার নুড়ি কী আনন্দে হতো হৃৎস্পন্দন।
নক্ষত্রের বাক্সে পায়রার মতো ব্যালট পেপার
ফেলেছেন বারবার। ছিঁড়ে-খুঁড়ে রীতির বন্ধন
নিজের ভেতরে তীব্র দিয়েছেন ভেটো সর্বদাই
ধ্বংসের বিপক্ষে, রেখেছেন বাক্য অর্ধবাক্য আর
বিশেষ্য ও বিশেষণ শুইয়ে দিঘিতে, ঘাসে ঘাসে।
কখনো চালান মেঘে মেঘে মেরুন মোটরকার
এবং জুতোর নাকে জ্বলে স্বপ্ন সুদূর নিশ্বাসে
তাঁর প্রান্তরের আর সুপ্ত পাতালের ঘ্রাণ পাই।
অন্তরালে থাকা ছিলো সে রূপালি কবির স্বভাব।
নিভৃত আস্তানা থেকে তাঁর দূরে চলে গেলে কানে
মধুর বাজতো সুর, স্পন্দমান অদৃশ্য রবার।
বয়স বুঝিনি তাঁর, এমনকি তাকেও বুঝিনি
কোনোদিন; সবুজ আয়ত তাঁর চোখে কী যে আছে,
কী যে আছে হাতে, ক্ষিপ্র পারেন লাগাতে ছিটকিনি
অন্তর্গত দরজার। চৈতন্যের অত্যন্ত গহনে
অক্লান্ত সাঁতারু তিনি, নিজেই নিজের অন্তর্যামী।
মাঝে মাজেহ মনে হয়, সত্যি কি গিয়েছি তার কাছে?
বলতেন, তুমি ঐ হরিণের পেছনে পেছনে
ছুটে যাও, তার স্পর্শ যদি পাও, বিশুষ্ক বাগানে
জাগবে বর্ণিল শোভা, আমি পথ ছেড়ে বনে নামি-
সর্বত্র বেড়াই ছুটে, অথচ হরিণ পলাতক
সে কোন অরণ্যে। হরিণের পদধ্বনি যত দূরে
যায় তত স্পষ্ট হয় আপনার সমাধি ফলক।
একটি জীবন বাজে ক্রমাগত হরিণের খুরে।
এমন থাকতে পারি
কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আমি দীর্ঘকাল অপেক্ষায়
এমন থাকতে পারি অবিচল। ক্লান্তি করবে কি
আহার আমাকে কোনোদিন? কিংবা আমাকে ভীষণ
ম্রিয়মান, সদ্য মৃত ভেবে আকাশে রচিত হবে
পক্ষীচক্র? পোকা-মাকড়ের ঝাঁক অসেবে কি ধেয়ে
নিষ্পলক চোখ আর ওষ্ঠের উদ্দেশে? নাভিমূলে
ঘুরবে পিঁপড়ের দল? চাঞ্চল্য আমাকে আর বেশী
ঘোরায় না চোরা পথে, দীর্ঘ বন-বাদাড়ে অথবা
বলে না দেখতে মুখ সারাক্ষণ স্বচ্ছ নগ্ন জলাশয়ে।
ব্যস্ততার পরপারে আমি দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকি।
কী এক পাখির গানে তরঙ্গিত হৃদয়ের ঝোপ,
চোখ বিস্ফারিত, সুরে সুরে অতীত ও বর্তমান
বড় বেশি মেশামেশি করে; কাল টুকরো টুকরো হয়ে
ঝরে চারপাশে আর কেমন মদির ঘ্রাণ হয়
দিকগুলি অকস্মাৎ কোত্থেকে একটি নীল ঘোড়া
মন্থর বাড়ায় গ্রীবা ডেরায় আমার প্রতি, যেন
ভালোবাস চায় শান্ত এখানে আশ্রয় কিছুকাল।
ভয় হয়-এ অতিথি হবে না তো উধাও এক্ষুণি?
গোলাপ গন্ধের মধ্যে স্মৃতি, স্মৃতির ভেতরে কিছু
মুখচ্ছবি, পদধ্বনি হাতের ঈষৎ নড়া, সাঁকো
এবং ঝর্নার পাশে নিদ্রাতুর নিরালা শরীর।
স্বপ্নেরা স্মৃতিরই অন্তর্গত, বুঝি তাই স্বপ্নস্থিত
আমার শরীর কোন বিশাল উদ্যান, শূন্য বাড়ি,
মৃত পাখি, স্বর্ণরেণু বিবর্ণ বেহালাসহ স্মৃতি।
শূন্যে হাত ছুঁড়বো না অথবা মাটিতে এলোবিলি
করবো না পদাঘাত। এমন থাকতে পারি আমি…
দীর্ঘকাল এই মতো অস্থিরতা-রহিত সর্বদা
অবচেতনায় ঘরে অপেক্ষায় বুদ্ধমূর্তি প্রায়।
এয়ারপোর্ট বিষয়ক পংক্তিমালা
প্রায় চোখ-মুখ বুঁজে ছুটছি, ছুটছি ঊধ্বর্শ্বাসে,
এক্ষুণি পৌঁছুতে হবে বিমান বন্দরে। রাস্তাঘাট
কেবলি পিছলে যাচ্ছে পায়ের তলায়। গাছপালা,
ভিখিরী, দোকানপাট, রিক্সঅলা, আইসক্রীমের
বাক্স, হকারের মুখ এবং বিজ্ঞাপনের ফুল্ল
ব্রা-পরা তরুণী গ’লে যাচ্ছে ক্রমাগত এলেবেলে
আমার চোখের মধ্যে; আমি শুধু ছুটছি ছুটছি
কুকুর ট্রাফিক আইল্যান্ড, নারী স্মৃতি হয়ে যায়।
এইতো আমার মুখ আমার মুখের কাছ থেকে
এবং আমার হাত আমার হাতের কাছ থেকে
এবং আমার চোখ আমার চোখের কাছ থেকে
বারবার সরে যাচ্ছে অতিদ্রুত, বড় নৈর্ব্যক্তিক।
দেখছি আমার মুখ একটি মৌচক হ’য়ে ভাসে,
এবং আমার হাত ছায়ার ক্ল্যারিওনেট হ’য়ে
বাজতে বাজতে শূন্যে লীন হয়ে যায়, মেঘ হয়
এবং আমার চোখ পাখি হ’য়ে হাওয়ায় উড্ডীন।
এয়ারপোর্টের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ,
এয়ারপোর্টের প্রতি ছুঁড়ে দিই গোলাপের তোড়া,
এয়ারপোর্টের সঙ্গে খুনসুটি ভালো লাগে খুব,
তার ওষ্ঠে ওষ্ঠ রাখি, তাকে নিয়ে ঘুমাই গভীর,
কখনো সাজাই তাকে স্বপ্নময় প্রধান ঝালরে,
কখনোবা গাঢ় গোধূলির মতো মনো-বেদনায়।
এক্ষুণি পৌঁছেতে হবে, কিন্তু পথ দীর্ঘ হ’য়ে যায়,
শুধু দীর্ঘ হ’য়ে যায়, তবু আমি ছুটছি ছুটছি।
প্লেনের সিঁড়ির কাছে ছিমছাম স্টুয়ার্ড অথবা
সুস্মিতা এয়ারহোস্টেসকে বলবো কায়দা ক’রে-
তোমার স্বাগত সম্ভাষণের প্রত্যাশী নই আর
আমার নিজস্ব সীট আমি নিজে খুঁজে নিতে জানি।
বস্তুত এয়ারপোর্ট হন্তদন্ত, ক্লান্ত পৌঁছে দেখি-
আমাকে ফেলেই প্লেন নীলিমায় ধাতব মরাল।
কবিতা আমার ওষ্ঠে
কবিতা আমার ওষ্ঠে চুম্বন এঁকেছে ব’লে আমি
কেবলি আপনকার অস্তিত্বের বালিতে (যা কষ্ট)
কাঁকড়ার মতন গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে কেমন একাকী
হয়ে গেছি অতিশয়। কী যে ভয় সর্বক্ষণ, পষ্ট
বোঝা দায়, কেন আমি নীল ঘোড়াটির অনুগামী
সেই ঘোড়া, যে কেশরে দুলিয়ে সময় দ্রুত পাখি
হয়ে উড়ে যায় দূরে, ঘাসে ঘাসে নক্শা রেখে যায়,
বলা মুশকিল খুব। কবিতা আমার অস্তিত্বের
প্রতি রেণু কী তুমুল উড়ায় হাওয়ায়, পুনরায়
বেদাগ সংহত করে। মুহূর্তে মুহূর্তে মাছ-পড়া
ছিপের মতন হই এবং প্রকৃত মানুষের
নিকটে আসার জন্যে স্নেহজাত নিভৃত ডেরায়
করি বাস, মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে থাকি।
কবিতা চৈতন্যে জন্ম-জন্মান্তর, পাতা, পাতা ঝরা।
কাতরতা বেড়ে যায়
কাতরতা বেড়ে যায়, মধ্যপথে বেড়ে যায় ব’লে
থমকে দাঁড়াতে হয় কিছুক্ষণ, এদিকে ওদিকে,
বিশেষত ছায়াচ্ছন্ন সুদীর্ঘ পেছনে কী উৎসুক
দৃষ্টি মেলে দিতে হয়। কত কিছু খসে হাত থেকে,
কী এক অস্পষ্ট কষ্ট অবশেষে শ্বাসকষ্ট হয়ে যায়
নিমেষেই, কুকুরের মতো কিছু দেখা যায় কিনা
আশে পাশে জনশূন্যতায়, দেখে নিতে চাই।
মধ্যপথে নিজেকেই দেখে আমি হয়েছি কাতর।
এখন পাথর বলে, এখানে মাথাটা রেখে তুমি
খানিক ঘুমাও, গাছতলা ডাকে ছায়া নেড়ে নেড়ে,
নদীতীর টলটলে আতিথেয়তার মখমল
হ’য়ে থাকে, পাখিগুলি ডানা মেলে বলে, পথচারী
এখানে ঘুমাও এসে কিছুকাল, পালকেরও আছে
স্বপ্ন বুননের শিল্প। মাথায় নিসর্গ গলে যায়।
মাথার ভেতর সূর্যোদয় ক্ষীয়মান, অস্তাচল
অত্যন্ত করুণ হ’য়ে আসে, একেকটি রাজহাঁস
আমার নিকট এসে গলে যযায় তুষারের মতো
পেছনে অনেক কণ্ঠ বেজে ওঠে, অলীক ঝংকার,
কখনো বা দীর্ঘশ্বাস, কান্না আমাকে স্বজন ভেবে
ঘিরে ধরে, বলে দূরে যেও না, সেখানে মিনারের
চূড়ায় শ্যাওলা আছে, শতাব্দীর কাতরতা আছে।
আমার বেবাক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলগা হ’য়ে আসে।
কোত্থেকে এমন ক্লান্তি উড়ে এলো? তবে কি আমিও
শূন্য, কাতরতাময় প্রান্তের তৃষ্ণায় পানি ভেবে
রুক্ষ মাটি খাবো শুধু? দেখবো ওপরে লোভাতুর
পাখিদের ক্রুর চক্র বারবার? এক্ষুণি আমাকে
আহত পাঁজর খুঁড়ে ফোয়ারা জাগাতে হবে আর
দশটি আঙুল থেকে ছেড়ে দিতে হবে শত পাখি।
কী ক’রে কেবলি স্বরময়ী
কী ক’রে কেবলি স্বরময় হ’য়ে যাও নিরালায়?
আমার মানসে তুমি মাঝে-মাঝে হ’য়ে ওঠো ধ্বনির প্রতিমা।
তোমার অমন কণ্ঠস্বরে একটি সামান্য যন্ত্র
কী মোহন পরীর খেলনা
হ’য়ে যায় নিমেষেই, কেমন সঙ্গীতময় হয় অগোচরে।
কম্পিত আঙুলে হ’য়ে, ঠোঁট হ’য়ে তোমার ব্যাকুল কণ্ঠস্বর
নিভৃত আমাকে ছোঁয় আমার এ ক্ষয়িষ্ণু বেলায়।
মুহূর্তের ঢেউগুলি তোমাকে অনেক দূরে সরিয়ে কোথায়
নিয়ে যায় ব’লেই আমার
এত কাছে এসে যাও। যখন হঠাৎ একা রুঢ় সমাজের
কাছ থেকে, তোমার নিজস্ব নাম থেকে নিজেকে লুকিয়ে তুমি
শুধু স্বর হ’য়ে
শুধু স্বর হ’য়ে
শুধু স্বর হ’য়ে
আমার অস্তিত্বে তুমি পূরবীর নির্জন সুরভি,
তখন আমিও লোকচক্ষুর আড়ালে গ্রন্থ আর
টেবিল চেয়ার থেকে, ডায়েরীর পাতা থেকে নিজেকে সরিয়ে
নিজস্ব চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার মতো
পান করি একটু সময়,
পান করি অবিরল তোমার শিশিরগন্ধী স্বর।
শুনেছি তোমার কণ্ঠস্বরে যেন কোনো একাকিনী
দূর কারাবাসিনীর কাতর প্রার্থনা
পাথরে পাথরে গুমরানো,
কখনো বা মধ্য সমুদ্রের
স্পর্শাতীত মৌনে জেগে ওঠা জলকিন্নরীর গান।
হে সুদূরতমা, শোনো, তুমি-ধন্য তোমার নিবাস
আমার আপনকার মৃত্যুহীন স্বপ্নের প্রদেশ।
ক্ষয়িষ্ণ, বেলায় একা বসে থাকি উৎকর্ণ, অধীর-
ফের বাজাবে কি সেই কণ্ঠস্বর স্বপ্নের জ্যোৎস্নায়?
কোনো একজনের কথা ভেবে
বুকের ভেতর মেঘের মতো
একটা কিছু বেড়ায় ভেসে,
অনেক আগে দেখা কোনো
গাছের পাতা স্বন হ’য়ে
কাঁপতে থাকে চোখের বনে-
এই কি আমার চাওয়া?
যখন তুমি কাছে আসো,
নগ্নতাকে প্রখর জ্বেলে
আমার পাশে শুয়ে থাকো,
শূন্যতারই ছায়া দেখি।
একলা মনে প্রশ্ন করি-
একেই বলে পাওয়া?
কিন্তু তুমি আমায় ফেলে
একটু শুধু দূরে গেলেই,
তোমার জন্যে হৃদয় জুড়ে
কেমন যেন তৃষ্ণা বাড়ে,
বুকের মধ্যে যায় ব’য়ে যায়।
মরুভূমির হাওয়া।
ক্লিষ্ট স্মৃতি
যখন তোমাকে পথে ছেড়ে ফিরে আসি, ফুটপাতে
কেবল আমার সঙ্গে আমি হাঁটি স্মৃতির ভিতর।
ভয়ানক একা লাগে, মনে হয় আমার শরীরময় ঘাস
গজিয়ে উঠেছে এক লহমায়। উদ্বেগ সর্বদা থরথর,
পথকে বান্ধব ভেবে একা হাঁটি তবু অন্ধ রাতে।
ফুরোতে চায় না পথ, প্রতি পদক্ষেপে জাগে খাদ;
চতুর্দিক থেকে ডাকে অবিরাম ক্ষুধিত পাতাল,
হঠাৎ তাকায় নিচে কটমট ঐ বৈরী আকাশ।
পুড়িয়ে বিস্তর স্বপ্ন জানালার কাছে ভাবি, সে কোন্ নিষাদ
অন্তরালে জেগে আছে? ভাবি, দূরের একাকী তালগাছটার
দিকে চোখ রেখে ভাবি, আবার হবে কি দেখা তার
সঙ্গে মানে তোমার সঙ্গেই? এই ব্যাপ্ত ঊর্ণাজাল
অতিশয় রূপময় হয় ক্রমান্বয়ে। ঠোঁটে পোড়ে শীর্ণ স্টার,
কিছু ক্লিষ্ট স্মৃতির মতন জেগে রয় কটু স্বাদ।
ভাবি যদি আর
কখনো না হয় দেখা, যদি ভোরে মৃত্যুস্পৃষ্ট শরীর আমার
পড়ে থাকে খাটে, যদি ভোরে
দুঃস্বপ্নের ঘোরে
জেগে উঠে পোকা-মাকড়ের রূপে শীতল পাটির খুব কাছে
ঘষি শুঁড়ে মেঝেতে যেমন কাফকার গল্পে আছে।
গাড়ল
কোন দেশী গাড়ল এ লোক? কোন দেশী?
গোত্র নেই, দেশ নেই তার। সে কি ছদ্মবেশী
শৃঙ্খলিত কিন্তু করজোড়ে তোতা পাখির মতন
ধন্যবাদ ধন্যবাদ বলে সারাক্ষণ।
কখনো বুকলতলা, নদী, ছেলেবেলা,
যৌবন মুখস্থ করে, কখনো দেখায় কত খেলা-
অতিশয় সরু
দড়ির ওপর হেঁটে যায় বারবার। বুকে মরু,
তবু শূন্যে গর্ত খুঁড়ে কী স্নিগ্ধ ফোয়ারা দ্যায় খুলে।
কখনো হোঁচট খেয়ে প’ড়ে গেলে, ভুলে
হঠাৎ বেরিয়ে এলে চক্ষুদ্বয়ে জল,
সকলের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চায় সে গাড়ল।
গোলাপের কাছে তার ঋণ আছে; সঙ্গীতে, সে জানে
ঋণের চেয়েও বেশি কিছু থাকে। রমণীর টানে
বেলাবেলি ঘরে ফিরে দেখেছে সে বস্তুত শূন্যতা সীমাহীন।
দক্ষ ত্র্যাক্রোবেটের মতই কতদিন
ঘূর্ণ্যমান গোলকের ভেতরে দিয়েছে লাফ আর
ঘোড়ার পেছনে ছুটে, স্বেচ্ছায় মাটিতে প’ড়ে গিয়ে বারংবার
বাড়িয়েছে ফুর্তি দর্শকের; এভাবেই বেলা যায়।
নিঃসঙ্গতা নিত্যসঙ্গী, বিষাদের পাশে ব’সে বেহালা বাজায়।
খেলা শেষ হ’লেই সে শৃঙ্খলিত পুনরায় কেউ তার
চুল ধরে টানে কেউ কেউ ছোঁড়ে লাথি, যন্ত্রণার
রেখাবলী ফোটে মুখে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে ভারি
মজা পায় নানা পথচারী,
ছুঁড়ে দ্যায় ছোলা কিংবা বাদামের খোসা কত ছলে,
সে শুধু ধ্যানীর মতো সর্বক্ষণ ধন্যবাদ ধন্যবাদ বলে।
গুপ্ত সেতু
একটু হাঁটলেই লুপ্ত পথ,
কোথাও সাড়া নেই, বন্ধ দ্বার।
এভাবে দিনগুলি ফুরিয়ে যাক,
ফুরিয়ে যাক রাত প্রতীক্ষার।
কবর খুঁড়ে নিজে সেখানে থাকি,
প্রেতের সহবাসে দুঃখ বই।
এভাবে দিন যায়, রাত্রি যায়,
স্মৃতির দাঁতে রোজ বিদ্ধ হই।
আমার রক্তের ফেনিলতায়
নৌকো হ’য়ে ভাসে দু’চোখ তার।
আমার সত্তার প্রান্তে বয়
মোহন নিশ্বাস কামুকতার।
তাকেই মুখস্থ করছি শুধু
উষ্ণ থরো থরো উচ্চারণে।
আমার ঠোঁটে তার নগ্ন ছোঁয়া
একদা নেমেছিলো, পড়লো মনে।
হঠাৎ তার কথা পড়লে মনে
ধড়মড়িয়ে উঠি জীর্ণ খাটে,
কী ঘোর অনিদ্রা রাত্রিভর
জ্বালার সাথে ষড়যন্ত্র আঁটে।
আমার চিন্তার ছিন্ন মেঘে
জরির মতো হাসি ঝলমলালো।
অকুল রিক্ততা করলে গ্রাস,
আমার কংকাল হয় কাতর।
গোপন নিশ্বাস লাগলে মুখে
দু’চোখ হ’য়ে যায় নীল পাথর।
সে যদি আসে তবে পাথর হবে
ঝর্না সাবলীল প্রাণের গানে।
কিন্তু তার আসা হবে না আর,
গুপ্ত সেতু ভেসে গিয়েছে বানে।
গোপনতা
সকলের মধ্যেই কিছু না কিছু গোপনতা থাকে-
নেত্রপাতে কারো, কারো মগজের কোষে, অন্ত্রপুঞ্জে,
শোণিত প্রবাহ্নে নববধূর দৃষ্টির মতো খুব
সংগোপনে গোপনতা ব’য়ে যায় সারা দিনমান।
গোপনতা ঘাতকের মারণাস্ত্র ডাগর আঁধারে,
কখনো প্রবল উত্তেজক স্রাব সত্তাময় আর
গোপনতা হিংস্র শ্বাপদের অগোচরে নম্রপ্রাণ
নিরীহ প্রাণীর জলাশয়ে অবতরণ যেন বা।
কবিরও সম্পদ বটে অফুরান, যখন আড়ালে
সে হাঁটে একাকী মনে বনভূমি, জনপদ নিয়ে,
পারস্পর্যহীন কত বস্তুতে বস্তুতে যোগাযোগ
রচনায় অনলস। গোপন্তা চুমু খায় তাকে।
চকিতে একটি বাক্য
চকিতে একটি বাক্য মগজের কোষ থেকে একা
সারসের মতো উড়ে গেলো ডালিম গাছের
শীর্ষ ছুঁয়ে দূরবর্তী ছাদের ওপারে, তারপর
কোথায় যে। শুধু ডানা ঝাপটানি স্মৃতি
এ মুহূর্তে; সেই বাক্যে নিশি ছিলো, সমুদ্র গর্ভের
লতাগুল্ম স্মৃতি-বিস্মৃতির অনুরণন, কিছু বা
ঢাকির কাঠির নৃত্য, জলকেলি, শোভাযাত্রা ছিলো।
সেই বাক্যে পূর্বপুরুষের মুখচ্ছবি, নারীঘ্রাণ,
সৈনিকের আর্তনাদ, প্রেমিকের হৃদয়স্পন্দন,
তিতিরের কীটাহারকালীন নজর, তৃষাতুর
সাপের চলন, দীর্ঘ পথ, সান্থশালা আভাসিত।
সেই বাক্য মধ্যরাত্রি, অকপট গহন বিহান।
সেই বাক্য অকস্মাৎ আমার নিজস্ব চোখ হ’য়ে
তাকায় আমার দিকে, বলে, চলো যাই, উড়ে উড়ে
বনস্থলী, যা’ শ্যামল অনুভূতি, শহরের সব
বাড়িঘর, যা’ প্রচুর স্মৃতিময়, মাথার ভিতর
নিয়ে চলো উড়ে যাই। সেই বাক্য ইশারায় ডাকে,
আমিও কী মোহাবিষ্ট পাখার আশ্রয় পেয়ে যাই।
আমরা দু’জন-আমি সেই মগজ উদ্ভুত বাক্য,
চন্দ্রালোকে শহরের অনেক উঁচুতে উড়ে উড়ে
দূর শতাব্দীর রূপরসগন্ধ পাই, অস্তমিত
শতাব্দী কখনো হই। সকালের নাবালক আলো
স্ফুরিত হাওয়ার আগে আমার কোমল পাখা দু’টি
কাষ্ঠবৎ ভয়ানক নিঃস্পন্দ, নিশ্চল। দিকগুলি
ভয়াবহ প্রতিধ্বনি, আমাকে গিলতে আসে, আমি
ভীষণ পতনশীল, তবু আমাকেই লুফে নেয়
নারীর বুকের মতো ফুলের কেয়ারি ভালোবেসে।
একা সেই বাক্য পরিযায়ী পখিদের ছন্দোময়
মালার একটি ফুল হ’য়ে উড়ে গেলো, উড়ে গেলো।
বাক্যটির জন্যে আমি কেবলি দুঃখিত হতে থাকি।
তার ঘুড়ি
সকালসন্ধ্যা বালক ঘুড়ির প্রতি ছুটে যায়, প্রায় উড়ে যায়,
কখনো দীর্ঘ সুতো ছেড়ে দিয়ে লাল নীল ঘুড়ি নিজেই ওড়ায়।
কখনো নিহত ঘুড়ির পেছনে দ্রুত ধাবমান কখনো বা শুধু
অপলক ধুধু
আকাশের দিকে চেয়ে থাকে কিছু রঙের ঈষৎ কম্পন হেতু।
হয়তো আকাশে দ্যাখে সরোবর, ফুলময় সেতু,
হারানো বোনের পরবের ফ্রক। বিস্মিত দেখি
শাদা চোখে একি
বালকের চোখ নাক কান মুখ ঘন চুল থেকে বেরোয়া কেবলি
সাতটি রঙের ঘুড়ি অবিরত-চমকিত ছাদ, বিকেলের গলি-
বংশাবলির স্মৃতির ভিতরকার স্মৃতিগুলি যেন ভাসমান।
রাত্রে ক্লান্ত বালক ঘুমোলে বেবাক রঙিন ঘুড়ি পাখি হয়,
ছায়া দেয় তাকে, স্নেহের মতন ঘোরে ঘরময়।
আচানক ওরা ভীষণ ঝাঁঝালো মেশিনগানের শব্দে পাগল;
ঘরের চালায়,
মেঝেতে, কাঁথায় প’ড়ে থাকে কিছু অধরা পালক।
ঘুমের ভিতর চম্কে উঠেও ঘুড়ির স্বপ্ন দ্যাখে সে বালক।
তুমি চলে গেলে
যখন আমার কাছে এসে বসো, করো পায়চারি,
কাতাও আমার দিকে আড়চোখে, গালগল্পে মেতে
কাটাও অনেক বেলা, কখনো ওল্টাও তাড়াতাড়ি
সাহিত্যপত্রের পাতা এলোমেলো অথবা মেঝেতে
রাখো চোখ, কী যে ভাবো-আমি অতিশয় নিরুত্তাপ
ঘড়িতে সময় পড়ি, যেন তুমি নেই কাছাকাছি,
যেন হৃদয়ের ঘরে পড়েনি তোমার পদচ্ছাপ।
নিজের আড়ালে আমি নিজের বৈরিতা নিয়ে বাঁচি।
তুমি চলে গেলে অস্থিরতা জেগে ওঠে, অকস্মাৎ
আমার ভিতরকার একাকী পুরুষ শব্দ নিয়ে
খেলা করে, অদৃশ্যের প্রতি ব্যগ্র বাড়ায় সে হাত,
লুকিয়ে নিশীথে মুখ কাঁদে খুব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
তোমাকেই ভাবে
আমার দরজা আমার জানালা তোমাকেই ভাবে
সারাদিনমান,
তোমার স্বপ্নে বিভোর আমার লেখার টেবিল।
কোনোদিন তুমি আসেনি এঘরে, দাঁড়াওনি হেসে
দরজার কাছে, র্যা ক থেকে তুলে নাওনি নতুন
কবিতার বই
কিংবা বসোনি কাঠের চেয়ারে, শরীর তোমার
দাওনি এলিয়ে এই শয্যায়। তোমাকেই ভাবে
আমার রুক্ষ জেগে-থাকা আর উচ্ছুংখল
রাত্রির ঘুম।
তোমাকেই ভাবে আমার উঠোন, সন্ধ্যালোকের
রক্তগোলাপ, রান্নাঘরের ফোকরে উষ্ণ
পায়রার বুক, শূন্য রেকাবি এবং আমার
কবিতার খাতা।
আমার আঙুল, আমার চোখের অভিজ্ঞ পাতা,
পাঁজরের হাড় প্রতি রোমকূপ তোমাকেই ভাবে।
কোনোদিন তুমি
আসোনি এখানে, বসোনি আমার পাশে কতকাল
তুমি আসো তবু মধ্যরাত্রি পেরুনো প্রহরে
চিত্রকল্পে,
হৃদয়ের কত অন্তরঙ্গ ধ্বনির মতন
শব্দমালায় স্বপ্নের মতো পংক্তিপুঞ্জে।
কে যেন সহসা বলে রাত্তিরে এভাই তুমি
এভাবেই থাকো-
নীরবতা ভালো, নীরবতা ভালো, নীরবতা ভালো।
কিন্তু তবুও পাথরের নিচে স্পন্দিত একা
টিকটিকিটার
মতো কিছু কথা সাবলীলভাবে জন্মাতে চায়।
সুনীল তোয়ালে ঢউয়ের মতন পড়ে আছে চুপ,
মুখস্থ করি তোমার মুখের রেখা কালো চুল,
যে-ফুল তোমার খুব ভালো লাগে, ভাবি তার কথা,
আমার ত্বকের
ভেতরে চকিতে কোমল পাপড়ি ঢুকে যেতে দেখি,
অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে ক্ল্যারিওনেটের
খুব পুরু সুর-
জান্লায় হাত রাখে দেবদূত, ঢেকে ফেলে মুখ-
বস্তুত স্মৃতি এক ধরনের জীবন যাপন।
তোমার নীরবতার কাছে
এ কেমন আচরণ? এ কেমন ধরন তোমার?
আমার ভেতরকার গেরস্থালি এক হলমায়
অলক্ষ্যে করেছো তুমি ওলটপালট।
অকস্মাৎ নিরিবিলি নিজস্ব নিবাস থেকে হু হু নিরাশ্রয়ে
চলে যাবে, কখনো ভাবিনি।
নিজের রহস্যে মজে আছো উদাসীন
আমার ব্যাকুলতার প্রতি।
আমার নিকট
একটি হেঁয়ালি হয়ে থাকতে কি চাও চিরদিন?
এ কেমন আচরণ? এ কেমন ধরন তোমার?
ম্যানিফেস্টো রচনার মতো দীপ্র মনোযোগে আমি
তোমাকে গড়েছি
রাত্রিদিন সুচেতন মনের ভুভাগে অনলস,
আমার নিকট থেকে তবু দূরে সরে যাচ্ছো শুধু।
তবে কি হঠাৎ কোনো বাসি পদ্য হয়ে যাবে তুমি
স্মৃতিতে আমার?
সেদিন তোমার তন্বী প্রহরের প্রতি
আমার নিজস্ব ব্যাকুলতা
ঝঁকেছিলো ভুল ক’রে, ভুল ক’রে নিজেরই অজ্ঞাতে
কিছুটা চটুল করেছিলাম নিজেকে,
তোমার কথার তাপে নিয়েছি হৃদয় সেঁকে বড়ো ভুল ক’রে।
তোমার সৌন্দর্য তুমি অন্ধকারে রেখেছো ব’লেই
আমিও সে আঁধারের অনুগত-তোমার ভাবনা
আমার রাত্তিরে অনিদ্রার ডাকটিকিট লাগায়
বিরামবিহীন।
সর্বদা তোমাকে ঘিরে ওড়ে প্রজাতির মতন
আমার স্বপ্নেরা,
এবং তোমার দিকে প্রসারিত আমার সকল পথরেখা।
তোমার গ্রীবার বাঁকে, তোমার চোখের
সুদীর্ঘ ছায়ায়
কেশর দুলিয়ে ছোটে অজস্র স্বপ্নাশ্ব দিগ্ধিদিক,
তোমার ঘুমের ঢেউয়ে সহস্র তরীর ভরাডুবি
হয় বারবার,
তোমার চুলের মেঘে অস্ত যায় হৃদয়ের সুর্য
শতবার,
বুকের চূড়ায় আকঙ্গক্ষার চন্দ্রোদয় শতবার,
তোমার ওষ্ঠের কাছে নত হয় দেবদুত কত,
তোমার নিশ্বাসে গলে যায় কত প্রাচীর, মিনার,
তোমার গোপন হ্রদে ঠোঁট রাখে শিল্পের সারস।
তোমার শাড়ির কাছে যেমন সহজ তুমি হও,
তেমনি সহজ আমি স্বপ্নের নিকট।
তোমার স্খলিত শাড়ি এক প্রস্থ স্বপ্ন হ’য়ে একা
আমার চৈতন্যে নেমে আসে।
স্বপ্ন ভেঙে গেলে
স্বপ্নের ভগ্নাংশ নিয়ে ছুটে যাবো কবিতার কাছে,
তোমাকে স্মৃতির মতো করবো লালন
গীতিকবিতায়।
আমার কবিতা এই শহুরে দেয়াল ভেদ ক’রে
উড়ে যায় ফ্যাক্টরীর চোঙে,
আমার কবিতা অন্ধকারে শিস দেয় ফুটপাতে,
আমার কবিতা মৃত্যুপথযাত্রীর অধর থেকে
অত্যন্ত রহস্যময় অনুভূতি ছেঁকে আনে,
আমার কবিতা দ্রুত নিউজপ্রিন্টকে অলৌকিক ব্যানার বানায়,
পাখিও কখনো।
আমার কবিতা গোরস্থানে চুমো খায় সাবলীল
ঘাসের ডগায়,
আমার কবিতা গূঢ় সংকেতে রূপালি এরোপ্লেনকে নামায়
বিমান বন্দরে,
আমার কবিতা রাস্তা এবং দোকানপাট, যান
ট্রাফিক পুলিশ, বাস টার্মিনাল, ব্যাংক আর পেট্রোল
পাম্প আর বাণিজ্যক এলাকাকে করে নৃত্যপর-
প্রতিটি বস্তুকে সহজেই অনুবাদ করে গানে।
তোমার নীরবতার কাছে আমার কবিতা বড়ো
অসহায়, কী দারুণ পতনপ্রবণ ইকারুস।
দেখার ধরন
কোনো কোনোদিন প্রাত্যহিক আচ্ছাদন কী প্রবল
বিস্ফোরিত হ’লে অস্তিত্বের কিছু খোসা ঝ’রে যায়,
অনেক গভীর থেকে ছবি উঠে আসে কতিপয়,
চোখের ভেতরে অন্য চোখ গান গায়, ওষ্ঠে ভিন্ন
দৃষ্টি ফোটে বসন্ত দিনের মতো, সব বড়ো বেশি
ওলট-পালট হয়ে যায়। মাথার ভেতরে কত
পেঁচানো জটিল দৃশ্য ভাসমান-আগুনের ধারে
যৌথ নৃত্য গাছে নড়ে অনেক মুখোশ, জলাশয়ে
বিম্বিত চুম্বন আর গোধূলি-জোয়ারে ভেজা এক
প্রাচীন প্রাসাদে কলরোল, নগ্ন পাত্রে সন্ন্যাসীর
কী দিব্য খন্ডিত মাথা, নর্তকী বিভ্রমে পাক খায়,
যেন সে লাটিম। কোনো কোনোদিন এরকমভাবে
অনেক গভীর থেকে ছবি উঠে আসে-মনে হয়
যেন আমি দূর গলগোথায় ছিলাম সেই ক্ষণে,
যখন মাধ্যাহ্নে দ্রুত সন্ধ্যা নেমেছিলো; মনে পড়ে
কোন্ সে নিশীথে সুরভিত ঘরে ম্যাগডালীনের
উত্তপ্ত অধরে আমি ওষ্ঠ রেখেছিলাম এবং
মনে পড়ে আমার বাঁশির সুরে পশু-পাখি এসে
জমতো আমার চতুষ্পার্শে কী বিহ্বল, নদীতীরে
আমার আপন ছিন্ন শিরে বয়ে যেতো গীতধারা।
নিজেরই অজান্তে এক দেখার ধরন জন্মে যায়
বেলাবেলি, স্বপ্নে হাঁটে গোধূলিতে দেখা
বৃক্ষশ্রণী, ভাসে বলাকার প্রেত, অভ্রের মতন
গুঁড়ো হ’য়ে নড়ে ক্লিওপেট্রার কবর, ফসলের
ক্ষেতে ওড়ে ডন জুয়ানের প্রস্তরিত ডান হাত;
পেছনে পেছনে আসে প্যানের স্পন্দিত কর্ণমূল।।
কোনো কোনোদিন প্রত্যহের অন্তরালে এরকম
মোহ তৈরি হয়, যেন আমার নিজের থেকে আমি
সহজে বেরিয়ে গিয়ে শজারুর মতো অন্ধকারে
করে ফেলি সাবলীল তারার আঞ্জাম। তাকালেই
দৃশ্যাবলি-আমার গতায়, পিতা আবরে বিছিয়ে
কোমল জায়নামাজ উদাস ভ্রমণকারী, তিনি
কী যেন আঁকেন আসমানে। তাঁর হস্তধৃত নীল
তশ্তরিতে সেজানের ফল। চকিতে কুকুরীগুলি
জলকন্যা হ’য়ে নামে শহুরে নদীতে; নিশীথের
শূন্য ডাকঘর বোধিদ্রুম যেন, আনন্দ, সুজাতা
চেয়ে থাকে অপলক। সুদূর শতক আজকের
রবিবার বুধবার হ’য়ে রাজহাঁসের গ্রীবায়,
বাস টার্মিনালে, কলোনীতে, তরুণীর ন্ত্রেপাতে
আর গিরগিটির নিশ্বাসে হু হু দীর্ঘ বয়ে যায়।
নকশা
নকশা আছে মনোব্যাপী, ছন্দোময় নিঝুম গড়ন-
প্রাচীন সুরাই যেন, যৌথ কারুকর্মে কান্তিমান।
এই নকশা জ্বলজ্বলে, প্রাণবান কখনো নিতান্ত
চেনা, কখনো বা মায়া, বহুমুখী রহস্যে অচেনা।
ফুলের কেয়ারি বুঝি এই নকশা, যেখানে পাখির
ছায়া পড়ে, রৌদ্রানন্দ ঘন হয়, জ্যোছনা গহন
গীতধারা, নিরিবিলি সৃজনপ্রবণ আর মালী
অলস অমনোযোগী হ’লে কেবলি উৎপন্ন হয়
রাশি রাশি পরগাছা, কোনো কোনো ঋতু ভয়ানক
নিষ্ফলা, রোরুদ্যামান দিনরাত্রি, পত্রপুষ্পহীন
ডাল কাঁপে বিরান হাওয়ায়। কারো কারো বেলা যায়
সুরাইয়ে একটি রেখা এঁকে, ভাগ্যবান হ’লে কেউ
মুখচ্ছবি আঁকে কোনো; নকশা বড়ো শোণিত পিপাসু,
ক্রমাগত সত্তার বিশদ ক্ষয়ে নকশা জায়মান।
অন্তর্গত এই নকশা বিশ্বপ্লাবী তুমুল আঁধারে
নিত্য প্রাণ জাগানিয়া সুগভীর সংকেত নিরালা-
সে সংকেতে একটি মানুষ অন্য মানুষের কাছে,
খুব কাছে চলে আসে, যদিও পরস্পরের দেখা
হয় না কখনো; এভাবেই অন্তরালে পরিচয়
প্রসারিত চিরদিন মানুষের মধ্যে দিকে দিকে।
সে এক আশ্রয় বটে ভ্রান্তিহীনরুপে মানসিক।
যেমন ওষ্ঠের সঙ্গে চুম্বনের, আপেলের সাথে
তার অন্তর্গত গুঢ় রসসিক্ত মাংসের সম্পর্ক,
বলা যায়, তেমনি এক সম্পর্ক মনের চিরকাল
নকশার সহিত। এই নকশা থেকে দূরে কেউ কেউ
সহসা পালাতে চায়, তছনছ করে দিতে চায়
তাকে, বড়ো বেশি এলোমেলো, তবু নকশা থেকে যায়
রূপান্তরে, অস্তিত্বের গীতময়তায় বন্দনীয়।
নিঃসঙ্গতা
মেঘে ঝুলে থাকা
তরঙ্গ-মা লায়
ভাসমান পুণ্য
দেবদুতগণ এই
স্তব্ধতাকে খুব
সস্মানিত ক’রে
সুস্পষ্ট বলুন
আমার হৃদয় কার কাছে তুলে ধরবো এখন দ্বিধাহীন
কার কাছে হৃদয় তো জামা নয় কোনো দড়িতে টাঙিয়ে দেবো
ক্লিপ এঁটে খোলামেলা হাওয়ায় দুলবে কাছে এসে কেউ কেউ
বিহ্বল তাকাবে কেউ মাথা নেড়ে চ’লে যাবে হেঁটে বহু দূরে
আমার হৃদয়
ভীষণ নৈঃসঙ্গ্যে
মোড়া প্রতিদিন
কম্পমান আমি
দুঃস্বপ্নের খুব
অভ্যন্তরে নিজে
একাকী দুঃস্বপ্ন
জন্মান্ধ পেরেক
মাথায় ঠুকবে
যারা তারা বন্ধ
ঘরে খেলে পাশা
তীব্র পচা মাছ
যন্ত্র ণা-কা ত র
মুখের রেখার
মতো রাস্তা শুধু
সস্মুখে আমার
উন্মাদের চোখ
দ্যায় সিগন্যাল
পাখিরে তুই
পাখিরে তুমি ডাকিস কেন আজ?
অমন ক’রে ডাকা তো ভালো নয়।
পাখিরে তোর জিগির ছায়াময়।
কেমনতরো দিলি যে সুর পেতে,
গেরস্তের হবে না ভালো এতে।
জিগিরে তোর ভয়ের ছায়া মেশে,
পাখিরে তুই উড়ে যা দূর দেশে।
দুঃখ হ’য়ে স্তব্ধতায় যদি
বেড়াস উড়ে এখানে নিরবধি,
তোর কী ক্ষতি? পারিস যদি তুই
ডাকের ফাঁকে ঝরিয়ে দেনা যুঁই।
পাখিরে তোর কেমনতরো কাজ?
শহরময় ছড়ালি কী বিলাপ,
অন্ধকারে মরুভূমির তাপ।
দিলি তো ছেড়ে বিভীষিকার ঝাঁক-
পাখিরে তুই দিসনে আর ডাক।
জিগিরে তোর মৃত্যু আসে ভেসে,
পাখিরে তুই উড়ে যা দূর দেশে।
পারিপার্শ্বিকের আড়ালে
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, যার
জন্যে মধ্যরাতে কোনো নদী,
মাছের মতন চকচকে কোনো স্বপ্নাবৃত প্রখর শবীর
বিছানায় একা
অপেক্ষা করছে কিনা, সে জানে না। কোথাও এখন
দরজা জানালা র্তার জন্যে খোলা আছে কিনা কিংবা
অন্ধের ইস্কুলে আলো জ্বেলে কেউ চক্ষুষ্মান খুব
ধৈর্য ভরে ব’সে আছে কিনা,
সে জানে না। জানে তার মনের নিভৃত ছায়াচ্ছন্ন
ঘাটে কী সুদূর
অরণ্যের প্রাণীর মতন পানি খেতে আসে স্মৃতি। জানে তাকে
সারারাত এলোমেলো জাগিয়ে রাখবে অলৌকিক হুইশিল।
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, নিজের কাছেই
বন্দী সর্বক্ষণ।
প্রতিদিন শহরের সবচেয়ে করুণ গলির মুখচ্ছবি
মুখের রেখায় নিয়ে হাঁটে ফুটপাতে,
সুনিবিড় রিশ্তা তার রহস্য নামক অতিশয়
লতাগুল্মময় প্রান্তরের সঙ্গে, কেমন অচিন
দৃশ্যাবলি সমেত বিপুল
অদৃশ্যের সাথে।
একদিন মরে যাবে ভেবে তার মনের ভেতরে
আবর ঘনায় একরাশ, মনোবেদনার রেখা
ফোটে মুখমন্ডলে গভীর,
কিছুকাল এভাবেই কাটে, ফের চকিতে আনন্দে নেড়ে দেয়
সময়ের থুতনি ঈষৎ।
বয়স বাড়ছে তার, বাঁচলে কার না বেড়ে যায়?
নিজেকে জপায় সে-ও প্রায়শই-হৃদয় সতেজ রাখা চাই,
নইলে কবিতার সুক্ষ্ম শিকড় কংকালসার হবে।
কবিতার জন্যে তাকে উন্মাদ হতেই হবে, আজো মানে না সে;
অবশ্য একথা ঠিক, কোনো কোনো কবি মানসিক
ব্যাধিতে ভুগেও কাগজের শূন্যতায় এনেছেন
পাখির বুকের তাপ, দুপুরের হলুদ নিশ্বাস,
তন্দ্রিল সঙ্ঘীতময় দ্বীপপুঞ্জ, বাঘের পায়ের ছাপ আর
প্রাচীন দুর্গের সিঁড়ি, দেবদূত, অজানার দ্যুতি;
জীবনকে দিয়েছেন বাস্তবিক স্বপ্নের গড়ন।
শৈল্পিক ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ঘোরে দিগ্ধিদিক;
নিজেকে লুকিয়ে রাখে স্বরচিত কুয়াশায় আর
করে সে উজাড় পাত্র বারবার ইয়ারের সাথে।
নিজের আড়ালে তার একজন স্বতন্ত্র মানুষ
স্বপ্নের রঙের মতো মুখ নিয়ে ব’সে থাকে একা,
জানে না কখন উঠে যাবে ফের আপন পুশিদা
আস্তানায়; জানে না সে কোথায় যে নিরাময় তার
হাসপাতালের বেডে নাকি কোনো নারীর হৃদয়ে।
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, যার
প্রতি ইদানীং
বিমুখ নারীর ওষ্ঠ, শিল্পকলা, বাগানের ফুল।
সবাই দরজা বন্ধ ক’রে দেয় একে একে মুখের ওপর,
শুধু মধ্যরাতে ঢাকা তার রহস্যের অন্তর্বাস খুলে বলে-
ফিরে এসো তুমি।
মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হ’য়ে যায়,
অতিকায় টেলিফোন নেমে আসে গহন রাস্তায়, জনহীন
দীর্ঘ ফুটপাত
ছেয়ে যায় উঁচু উঁচু ঘাসে আর সাইনবোর্ডের বর্ণমালা
কী সুন্দর পাখি হ’য়ে রেস্তোরাঁর আশেপাশে ছড়ায় সংকেত।
একজন্ন পরী হ্যালো ব’লে ডায়াল করছে অবিরাম,
মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হ’য়ে যায়
খোলা পথে ঝলসিত সরোবর, রাজহাঁস যেন
টুকরো টুকরো জ্যোৎস্না,
স্পর্শাতীত হাঁটে
ঝরিয়ে জটিল স্বপ্ন চতুষ্পার্শ্বে, একজন বামন চার্চের
চূড়ায় চুরুট ফোঁকে, দঙ্ঘা-হাঙ্ঘামায় খোয়া গেছে
একটি সপ্রাণ চোখ তার, মধ্যরাতে বুড়িগঙ্ঘা নদীটির বুকে
জলজ প্রাসাদ জাগে,
রেডক্রস চিহ্নিত বাড়ির ছাদে ফেরেশতামন্ডলী
অলীক কনফারেন্সে মাতে, ত্র্যাম্বুলেন্সে স্বর্গীয় মদ্যপ
গান গায়, নাচে
এবং টহলদার পুলিশ কখন অর্ফিয়ুস বনে যায় চমৎকার;
মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হ’য়ে যায়।
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, যার চক্ষুদ্বয়
কখনো কোমল হ’য়ে আসে হৃদ্স্পর্শে, কখনো-বা
শিরাপুঞ্জে কাঁটাঝোপ হ’য়ে কাঁপে বন্য নিষ্ঠুরতা!
মগজে প্রবেশ করে কালপুরুষের তলোয়ার,
চোখে তার গাঢ় হয় সম্রাজ্ঞীর আংটির ঝলক,
রুপবান সিংহ ডাকে বারবার চুলের জঙ্ঘলে,
বনদেবী ছুটোছুটি করেন নিভৃতে, ঝোপঝাড়ে,
বৃক্ষশ্রেণী চেয়ে থাকে অপলক, দেবীর বাকল
লুটায় গাছের নিচে। শামসুর রাহমান ব’লে
আছে একজন, যার পাশে হেনরী মুরের এক
সর্বদা এলিয়ে-থাকা নারীমূর্তি গুহার মতন
খুব ফাঁকা উদরসমেত শুয়ে থাকে, বাউলের
একতারা স্বপ্ন দ্যাখে নিরালা শিয়রে; চতুর্দিকে
পাখির মতন দৃষ্টি মেলে কিছু দেখে তাকে
অত্যন্ত নিকট থেকে বিষাদ, অসুখ, গৃহত্যাগ।
এবং আপনকার রক্তমাংসে লোভ আছে তার,
মানে সেই লোকটির, সহজেই ব’লে দিতে পারি।
পিঞ্জরে শরীর ঘ’ষে
চিন্তিত ব্যক্তি সে আজো, উদ্বেগের পীড়িত শিকার।
অতীত, আগামী ভাবীকাল-যেন কয়েকটি বল-
নিয়ে যারপরনাই ক্রীড়পরায়ণ সে সদাই।
তখনো নিদ্রার থেকে উত্থিত, ব্যথিত কথঞ্চিৎ,
দ্যাখে অপসৃয়মান স্বপ্ন তাকে দিচ্ছে টিট্রিকার।
পিঞ্জরে পাখায় ঘুন, ম্রিয়মান পাখিটির গীত
প্রবঞ্চিত সৌন্দর্যের মতো কথাও উধা; তাই
পিঞ্জরে শরীর ঘ’ষে হ’তে চায় কিছু শব্দোচ্ছল।
অপরাহ্ন হৃদয়েরও, নিঃসঙ্গতা এলানো মগজে-
সে ভাবে, শব্দের মায়া কতকাল এভাবে গীতের
বনস্থলী ব্যেপে খুব মধুরতা, কিছুবা অস্থির
বিষণ্নতা বওয়াবে? এখন তো সকলেই ভজে
সমুন্নত সিংহাসন। সে একাকী বেজায় শীতের
মরশুমে বুভুক্ষায় গরম রুটির মতো তাপ।
খোঁজে অসহায় শব্দের নিবাসে, কী অধীর
রৌদ্রের পরিখা আর জ্যোৎস্নার বাসর, লোকালয়,
মুখচ্ছবি গ’ড়ে যায়। চেনে না নিজেরই পদচ্ছাপ
রক্তচোষা সিঁড়ি আর পথে; হাঁটে কর্কশ আলোয়,
ছাড়িয়ে গাছের শীর্ষ নক্ষত্রের আড়ালে সে থাকে;
অকস্মাৎ গীত পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করে তাকে।
তার মনে প’ড়ে যায় সড়কে কিসের দাগ, ঘরে
কারা ছিলো গাছ তার মাথার ভিতর কিংবা মাথা
স্তব্ধ মনুমেন্টের ভিতর ঢুকে গিয়েছিলো আস্তে।
এখন প্রচুর দৃশ্য ভাসমান মনের নানান স্তরে
এলেবেলে, লুকাচুরি চলে। খাঁ খাঁ বাড়ি, বৃক্ষ পাতা,
তস্তরিতে জলপাই-সে আনত স্বপ্নের ওয়াস্তে।
স্বপ্নে কি পিঞ্জর থাকে? দীর্ঘ পথ চুর্ণ হয়? স্মৃতি
মৃত্যুর অনেক কাছে চ’লে যায়? ধ্বস্ত সেতু চোখে
নিয়ে কেউ কথোপকথন সারে কফিনের পাশে?
পিঞ্জরে শরীর ঘ’ষে ঘ’ষে অবরুদ্ধ শোকগীতি
বুকে পুষে ঠিকঠাক থাকা চুলে ভুতুড়ে আলোকে?
সে ভাবে, এখন স্মৃতি যাক ব’য়ে আপন নিশ্বাসে।
প্রজাপতি
প্রজাপতি সারারাত আমার ঘরেই ছিলো খুব
চুপচাপ দেয়ালের এক কোণে বিন্দুর মতন।
আমি তো না জেনে তাকে এই ঘরে দিয়েছি আশ্রয়।
সারারাত বই প’ড়ে কিছু লিখে এবং ঘুমিয়ে
কেটেছে আমার, আমি তাকে লক্ষ্য করিনি মোটেই।
আমরা পরস্পরের অস্তিত্ব বিষয়ে অচেতন
ছিলাম সমস্ত রাত একই ঘরে। অকস্মাৎ ভোরে
পিতার প্রাচীন ফটোগ্রাফের সান্নিধ্যে প্রজাপতি
তরঙ্গিত, দেখলাম; এখন সে আমার নিজস্ব
ভাবনায় অন্তর্ভুক্ত অতিশয় সাবলীলভাবে।
সে-ও কি আমার কথা সমস্ত শরীর দিয়ে তার
চিন্তা করে? প্রজাপতি নড়ে হৃৎস্পন্দনের মতো।
প্রতীক্ষা
এতদিনে জেনে গেছি, সে তোমার পরিহাস ছিলো
পুরোপুরি, হয়তো কোনোদিন
দেখা হবে,-কতবার ভেবেছি আবেগভরে আর
তোমার আসার পথে দিয়েছি বিছিয়ে স্বপ্নময়
বাসনার রক্তিম গালিচা।
কিন্তু অলিখিত কবিতার মতো তুমি থেকে গেছো
অদ্যাবধি চেতনায়। সে কোন্ রহস্যময় প্রাণী
পরম সোহাগে করে পান সারাবেলা
আমার আপন
হৃদয়ে জল, কোনো কোনো দিন বিছুবা শোণিত!
এখন তোমাকে দেখি (মনে হয় দেখি) পথে পথে,
গাছের ছায়ায় পার্কে, স্মৃতির মতন গোধূলির ছোপ-লাগা
বারান্দায়, বাস টার্মিনালে,
প্রত্যেক নারীর মধ্যে তোমাকেই দেখি, মানে খুঁজি
ইতস্তত বারবার। এখনো তোমার রূপ নিতান্ত অচেনা
আমার নিকট?
অস্পষ্ট ধারণা তুমি এক? স্বপ্নকুয়াশায় ঢাকা?
যখন তোমার মুখে চিবুকে গ্রীবায় স্তনমূলে
নামে জলধারা,
তখন তোমাকে কী রকম মনে হয়,
পারবো না বলতে কখনো;
যখন তোমার পিঠে শ্যাম্পুকরা চুল একরাশ
গীতিকবিতার মতো শুয়ে থাকে কোমল-উজ্জ্বল,
তখন তোমার মুখে কতটুকু তুমিত্ব বিরাজে,
জানি না, অথবা
কারো অভিযানপ্রিয় হাত তোমার স্তনের দিকে
অগ্রসর হ’লে তুমি কেমন বিহ্বল হ’য়ে যাও,
এবং তোমার ওষ্ঠে কেউ চুমু খেলে
তোমার চোখের পাতা অতি দ্রুত নেমে আসে কিনা-
আমি তা’ জানি না।
এখন তোমাকে খুঁজে বেড়ানোর অসুখ নিয়ত
ভোগাচ্ছে আমাকে।
যে কানো নারীর মুখ হঠাৎ দেখলে
ধুক ধ্বক ক’রে ওঠে-সে কি তুমি? হৃৎস্পন্দন, ওষ্ঠ, বাহু-
চোখ হয়ে যায় সবই একটি নিমেষে। সে কি তুমি?
কোনোখানে তোমাকে না দেখে বারংবার
কেবলি আমার মন ভীষণ খারাপ হ’য়ে যায়।
তবে কি স্বপ্নের ঘোরে আজীবন জ্বলন্ত রাত্তিরে
তোমার উদ্দেশে আমি বিষণ্ণ কবিতা লিখে যাবো?
এক্ষুণি আমাকে এসে ব’লে দাও সাফ-
তুমি আর প্রতীক্ষায় থেকো না নির্বোধ।
প্রশ্নোত্তর
যখন আড়ালে পথ চলি,
‘কি খবর, আরে, বলুনতো কী খবর’,
প্রশ্ন করে গাছপালা, পাখি, আমি বলি-
প্রেরণাবিহীন কবি রুদ্ধশ্বাস বন্ধ ডাকঘর।
প্রেমের কবিতা হ’য়ে যায়
কিছুদিন হলো ভারি বদরাগী ব’লে বদনাম
রটেছে আমার।
অথচ বন্ধুরা জানে যখন তখন
দেলশাইয়ের কাঠির মতন ফস ক’রে
বিযম ওঠে না জ্ব’লে আমার মেজাজ।
হঠাৎ সেদিন
আপিস ফেরত আমি ক্রোধের বিকারে সারা পথে
ছড়িয়ে এসেছি কাঁটা অবলীলাক্রমে। স্বপ্নে দেখি,
পথের বেবাক কাঁটা রাশি রাশি হ’য়ে সুখে
দোল খায় নিশীথের তন্দ্রিল হাওয়ায়।
কী-যে হয়, অকস্মাৎ আমার দু’হাত
কোত্থেকে মুখোশ এনে আমার নিজেরই মুখে ঠিক
দেয় সেঁটে, পরমুহূর্তেই,
কী অবাক কান্ড,
কালো সে মুখোশ
তন্বী হয়ে নেচে দূর স্বর্গপথে চ’লে যায়।
দুর্নিবার ক্ষোভে একরাশ অন্ধকার নিয়ে দ্রুত
বানাই আদিম গুহা চতুর্দিকে, অপদেবতার
মতো হাসি ক্ষণে ক্ষণে, শাবাস শাবাস ব’লে করি
প্রস্থান নিদ্রায়, জেগে দেখি উৎফুল্ল জ্যোৎস্নার তোড়ে
আঁধার গিয়েছে ভেসে, নিশ্চিহ্ন সে-গুহা
প্রেতের বদলে
বিপুল জ্যোৎস্নায় তৈরী রাজহাঁস হাঁটে প্রতিবেশে।
কেন যে এমন রেগে যাই বারবার? কেন দাঁতে দাঁত ঘষি?
লেখার টেবিলে ব’সে রাত জেগে সাজাই কেবলি
ঘৃণায় অক্ষরমালা, কী জাদুতে ওরা সহজেই
প্রেমের কবিতা হ’য়ে যায়।
ফুটপাত
সকালে দুপুরে কিংবা মধ্যরাতে এ ফুটপাতের কানে কানে
বলতে চেয়েছি কথা কিছুক্ষণ একা একা। ফুটপাতটির
সঙ্গে চেনা শোনা আছে বহুকাল, এই ফুটপাত দূরগামী
পথিকের মতো চলে গেছে ধীরে নদীর নিতান্ত নজদিক।
জ্যোছনাও জলধারা হ’য়ে ফুটপাতটিকে কিছু নিরিবিলি
কাহিনী শোনাতে চায়, আমি জ্যোছনায় মিশে যাই পক্ষীপ্রায়।
ফুটপাতটির সঙ্গে কথা বলি অনর্গল পারস্পর্যহীন-
দোলায় সে মাথা ঘন ঘন, কখনোবা ভ্রান্তিহীনরূপে
উদাসীন; ফুটপাত রূপকথা ভালোবাসে? তার পিঠ বারবার
কোমল বুলিয়ে দিই, যেন সে সৌন্দর্য ময়ূরের; কিন্তু এ কি
আমার নিজস্ব করতলে বহু মৃত শতাব্দীর বিষণ্নতা
জেগে ওঠে নিমেষেই ফুটপাত সোহাগ বোঝে না এতটুকু।
আমার অঢেল রক্তে চঞ্চু সে ডুবিয়ে নিতে চায় বারংবার!
বাস্তবিক লোকটাকে
বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি ন।
সাতরঙা পালকের টুপি তার মাথায়, দু’চোখ
ভীষণ অরুণবর্ণ; তার দিকে তাকালেই মনে হয়,
ভয়ংকর কিছু ব’য়ে বেড়ায় সত্তায় সারাক্ষণ।
আগুন আহার করে আর বিষলতার নির্যাস
করে পান। করো সঙ্গে কথা সে বলে না, এক ভিড়
মানুষের মধ্যে চুপ থাকবার তরিকা কেমন
আয়ত্তে রয়েছে তার। চুলের ডগায় সুর্যোদয়,
নখাগ্রে সুর্যাস্ত নিয়ে হেঁটে যায় একা ঔদাস্যের
ছায়ায় নিঃশব্দে হেঁটে যায় গোধূলিতে নেমে পড়ে
কোথায় গোপন নিচে, করে ওজু শোকের দিঘিতে।
মধ্যরাতে শহরের মধ্যপথে অভ্রের নদীতে
ভাসায় সুনীল নৌকো, রাশি রাশি বাঁশির স্থাপত্যে
বানায় সুদীর্ঘ সাঁকো সড়কে সড়কে সব দিকে।
বাতাসের, গোধূলির, নিঃসঙ্গ শহুরে কুকুরের,
পাখির ক্রীড়ার সায় আছে তার প্রতি। পাহাড়ের
কাছাকাছি থাকে, না কি হ্রদের কিনারে অতিশয়
নিরালা নিবাস তার? তাকে দেখে দৃষ্টি পুড়ে যায়।
হৃদয়ের বহুমুখী ক্ষত তার চোখ হ’য়ে জ্বলে
সর্বক্ষণ, বেড়ে যায়। ক্ষতের পাশেই স্মৃতিময়
উপত্যকা তৈরী করে লাগায় জাগর পাছপালা।
গভীর শিকড় নিমেষেই শুয়ে নেয় ক্ষতরস!
বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি না।
তবু সে প্রায়শ মধ্যরাতে আমার টেবিলে ব’সে
ছিটোয় বিস্তর কালি খাতার পাতায়, কখনো বা
ঘন ঘন করে পায়চারি কালো বারান্দায় কিংবা
খুপরিতে, মাথা নাড়ে, তাকায় আমার দিকে তীক্ষ্ম
ক্ষুধিত দৃষ্টিতে, বুঝি নেবে শুষে অস্তিত্ব আমার।
আমার শিয়রে রাখে তরবারি, আমি নিরুপায়,
রুদ্ধবাক প’ড়ে থাকি, যেন ক্লান্ত, শীর্ণ পথরেখা।
যত বলি চ’লে যাও স্বচ্ছাচারী, এখানে তোমার
প্রবেশাধিকার নেই, গেরস্থালি করো না বেবাক
তছনছ, ততবার আমাকে ভীষণ ফুঁড়ে একা
ঘরে ঢুকে প’ড়ে বসে আমার টেবিলে, খুব ভোরে
সহসা প্রস্থান করে মোরগ ডাকলে পরে। রৌদ্রে
ঘর নিরিবিলি হেসে উঠলে দেখি আমার টেবিলে
পড়ে থাকে পাতালের লতাগুল্ম, মৎস্যাকুমারীর
জলজ নিশ্বাস আর সুদূর নীলিমা এক রাশ,
প্রাচীন সোনালি তন্তু হাহাকার খানিক দিব্যতা।
যখন আমার মেধা রটে মুদ্রাক্ষরে দিগ্ধিদিক,
অথবা মাইক্রোফোনে আমার প্রতিভা আমি খুব
নিমগ্ন আবৃত্তি করি, মালা আসে, বাজে করতালি,
তখন সে ভাঙা কবরের ওপর নিঃসঙ্গ ব’সে
মড়ার খুলিতে দ্রুত তবলা বাজায়, চুমো খায়
মৃত্যুর ঘাগরা-পরা বারবণিতার ওষ্ঠময়।
বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি না।
বিষদ আমায় প্রতি
বিষাদ আমার প্রতি প্রবল আকৃষ্ট ব’লে তাকে
আমার নিকট দেখা যায় ঘন ঘন, তার সাথে
বড়ো বেশি মেশামেশি হয়। বিষাদ আমার হাতে
মধ্যরাতে অশ্রুপাত করে অবিরত, মুখ ঢাকে
আমার বুকের অভ্যন্তরে; মাঝে-মাঝে খুনসুটি
করে, যেন বিষণ্নতা ব’লে কিছু নেই, নেই কিছু
চোখের পানির মতো ব্যথাময়। কখনো বা ঘুঁটি
চেলে ব’সে থাকে সতরঞ্জে, আমি খুব মাথা নীচু
ক’রে ভাবি, এ কেমন খেলার পদ্ধতি? প্রতিদ্বন্দ্বী
স্বেচ্ছায় হারার ছলে আমাকে হারিয়ে দেয় শুধু।
বিষাদ চৌদিকে গন্ডি এঁকে আমাকে করেছে বন্দী,
হরিণের চোখ হ’য়ে ঘোরায়, প্রান্তর রুক্ষ, ধুধু।
বিষাদ আমার জন্যে পারস্য গালিচা কিনে আনে,
কিনে আনে বাঘছাল, সোনার গেলাশ, হাতপাখা
এবং গোলাপ-পাশ। বিষাদ আমাকে কাছে টানে,
সস্নেহে আমার মুখে কেমন আপেল দেয় পুরে,
নাইয়ে বিজন হ্রদে পরায় জরির আঙরাখা।
অথচ নিজেকে দেখি নগ্ন, পোশাক গিয়েছে উড়ে
কখন কোথায় কোন্ ঝড়ে। মুখে জ্বলে ধূলিরেখা।
বিষাদ আমাকে পোষে দীর্ঘকাল ধ’রে, কতকাল
একান্ত বাহন হ’য়ে তার ঘুরেছি ভীষণ একা।
বিষাদ আমাকে ব’লে, ‘তোমাকে দিয়েছি তাল তাল
স্বপ্ন, তুমি আড়ালে নির্মাণ করো অজর প্রতিমা।
বিষাদ আমাকে রাখে প্রহরায়, যেমন ড্রাগন
তার খুব জ্বলজ্বলে গোপন সম্পদ। চতুঃসীমা
গ’লে যায়, বিষাদ নিঃশব্দে হয় শিল্পের চবন।
বিষাদ আমাকে পোষে নাকি আমি বিষাদকে পুষি-
বিষাদই বলুক আজ স্পষ্ট ভাষায় তার যা’ খুশি।
মধ্যরাতে ঘুম ভাঙলে
ইদানীং রাত কাবার না হ’তেই
আমার ঘুম ফুরিয়ে যায়। অর্থাৎ মধ্যরাতে
প্রায়শই আমার নিদ্রা তার জাল গুটিয়ে নেয়।
আর মধ্যরাতে হঠাৎ জেগে উঠলে
এক ধরনের আদিমতা আমাকে আচ্ছন্ন করে বারবার।
বিছানায় শুয়ে দেখি, চারপাশে বিশেষ্যগুলি
স্থিরচিত্র, যেন এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে
অপেক্ষমাণ যাত্রী।
বিশেষণ এখন আয়নায়, সৌন্দর্য তার গ্রীবা বেয়ে
নামছে নাভিমূলে। বিশেষণের রঙ-করা চোখের পাতা
আমার ওপর নেমে আসে
(মনে পড়ে, একদা কেউ ঝুঁকেছিলো বনঘেরা নদীর জলে)
নেমে আসে আআর শরীরের মঞ্চে।
ক্সিয়া ডালিম গাছে বসে পা দোলাচ্ছে,
তার হাত লাল নীল বল ছুঁড়েছে অবিরাম।
দুটো বল দু’হাতে পড়ছে উঠছে,
তৃতীয়টি শূন্যে।
পাশ ফিরে দেখি, বাক্যবন্ধ জমাট
পরিযায়ী পাখির পংক্তির মতো আকাশে বিস্তৃত।
সংযোগী অব্যয়ের সাঁকো ঘোলা পানির ওপর
এবং, কিন্তু যদি, আওড়ে চলেছে আর
হঠাৎ কি খেয়ালে সে আমাকে ঘুমের ঝরনার সঙ্গে
যুক্ত করার জন্যে বাড়িয়ে দিলো হাত।
অথচ কিছুতের ঘুম আসতে চায় না আর।
মৃতাঞ্জলি
(আবুল হাসানের স্মৃতির উদ্দেশে)
মানুষ চ’লেই যায় শেষ অব্দি, তা’ ব’লে কি এ রকমভাবে
চ’লে যেতে হয়?
চলে গেলে, আমাদের বড়ো এলোমেলো ক’রে দূ’রে
মেঘের পালঙ্ক ভেসে ভেসে ভেসে তুমি চ’লে গেলে
আরো বেশি মেঘের ভেতরে।
মেঘে ছিলো রহস্যের হাওয়া, কী রকম স্বপ্নময় ভিন্ন বনস্থলী
কেমন নগর
ছিলো হয়তো বা।
তীরের বেবাক নৌকো ভীষণ পুড়িয়ে চলে গেলে।
কতিপয় শব্দের ভিতর বৃষ্টি আর হেমন্তের রূপ খোঁজা,
মুহূর্তের মধ্যে বহু শতাব্দীর বসন্তের শোভা,
জন্ম-জন্মান্তর দেখা খেলা ছিলো আমাদের। হঠাৎ খেলার
মাঝখানে ‘চললাম’ ব’লেই
তুমি অন্তর্হিত।
তোমাকে দিইনি বাধা, অভিভূত দেখেছি তোমার চ’লে যাওয়া-
বাধা দিলে তুমি শুনতে না।
জীবন যাপনে শিল্পে তুমি নিয়মের কাছ থেকে
স’রে গেছো বারবার, প্রস্থানেও নিয়ম মানোনি এতটুকু।
এই যাওয়া ঘরে ফেরা নয় আর, নয় নিসর্গের
অভ্যন্তর থেকে
ফিরে আসা নিরিবিলি। অনেক দশক মুছে যাবে
নিশীথের রেস্তোরাঁর আলোর মতন,
তবুও প্রত্যাবর্তন অতি গাঢ় কুয়াশায় ডুবে
থাকবে সর্বদা।
হঠাৎ এখন যদি দরজায় কড়া নাড়ো ঘন ঘন, যদি
দাঁড়াও একাকী
সন্ধ্যা-ঢাকা, খুব ফাঁকা উঠোনে, অথবা রঙচটা
কাঠের চেয়ারে
শরীর এলিয়ে দাও, অপ্রস্তুত হবো না মোটেই, ছমছমে
ভয়ে মুখ ঢাকবো না দু’হাতে আঁধারে;
বরং বাড়িয়ে দেবো হাত, সিগারেট, টলটলে
চায়ের পেয়ালা।
তখন ঘরের আর্ত আলোয় চকিতে
ভ্রান্তিহীনরূপে মনে হবে-
বসে আছি মৃত্যু নয়, ভিন্ন জীবনের মুখোমুখি; এ জীবন
গোলাপ গন্ধের মধ্যে,উদ্ভিদের রঙে,
ঝর্নার নুড়ির মধ্যে, পাতার ভেতর অন্তহীন ব’য়ে যায়।
তুমি এসে দেখে যাও রাত্তিরে বিষণ্ণ প্লাজা, ফাঁকা
ফুটপাত বুক পেতে রাখে দুঃখী কবির মন্থর
পদস্পর্শ পাবে ব’লে আর
কাতর এ শহরের চোখ ভাসে, অবিরল শোকার্ত ধারায়।
ব’সে থাকি চুপচাপ, কখনো মুখর হই চায়ের আসরে;
কখনো হঠাৎ ইচ্ছে হয়
তিন হাত মাটি খুঁড়ে, শত হাত মেঘ খুঁড়ে এক্ষুণি তোমার
মুখ দেখে আসি।
মৃত্যু
মৃত্যু যদি গন্ধ হ’য়ে ভাসে,
আমার তবে কী-ই বা যায় আসে?
মৃত্যু তুমি আলুফা নেশা নাকি
কিংবা কোনো গোপন রঙা পাখি?
আমাকে বুঝি ঠুকরে খেতে চাও-
এইতো আমি, তোমার ঠোঁটে নাও।
মৃত্যু তুমি রাঙাও কেন চোখ?
একটি নদী হবেই গাঢ় শোক।
মৃত্যু তুমি পাথরে, নীল জলে,
তৃণাঙ্কুরে বন্ধ্যা মেঘদলে
বেড়াও ব’য়ে কত যে গোপনতা-
মৃত্যু তুমি রাখো না কোনো কথা।
যে গেলো নগ্ন পায়ে
যে গেলো নগ্ন পায়ে এমনি গেলো,
কেমন নিঝুম শূন্য গেলো,
খুব একাকী উদাস গেলো।
শহরধুলো বনস্থলী, জুতো জোড়া,
কোমল মুঠি, নৈশ ভ্রমণ,
ছন্নছাড়া ঘরে ফেরা-
সবাই মাতে প্রত্যাহারে।
শব্দ শব্দ গেরস্থালি এলোবিলি
গুমরে ওঠে এলোমেলো।
প্রুফের তাড়া এলোমেলো।
যে গেলো সে নগ্ন পায়ে এমনি গেলো,
কেমন নিঝুম শূন্য গেলো,
খুব একাকী উদাস গেলো।
সত্তা কি তার ছিলো গোপন স্বপ্নমোড়া?
ছিলো কি সে রিক্ত শ্রমণ?
পৌঁছুলে সেই বিভূঁই ডেরায়
কেউ জেতে কি? কেউ কি হারে?
কেমন জেদী একরোখা সে; আগের মতো
তাকায় না আর পিছন ফিরে
ভালোবাসার গহন তীরে।
যেসব শব্দ সোহাগ ভরে ঘনিষ্ঠতায়
এসেছিলো তার নিকটে,
জ্যোৎস্নাধোয়া তীক্ষ্ম তটে,
এখন ওরা দেখছে আপন তীব্র ওড়া,
তেজী শাদা ঘোড়ার গমন,
এখন ওরা দুঃখঘেরা
মেঘের মতো ছায়ায় বাড়ে।
হেলায় ফেলে যৌবনেই দীপ্ত বছর-
নগ্ন পায়ে তবু গেলো,
খুব একাকী উদাস গেলো।
যে-কোনো দোকানে
সামগ্রী সৌন্দর্য; রাশি রাশি ওরা জগৎ সংসারে
জেগে আছে থরে থরে, কখনো বা খুব এলোমেলো,
চেতনার নানা স্তরে। এমনকি অবচেতনায়
সামগ্রীর গ্রীবা লীলায়িত; নৃত্যপর চোখ যৌথ
স্মৃতির আভায় জ্বলজ্বলে। অকস্মাৎ গুহাগুলি
জ্যোৎস্নার জোয়ারে ভেসে যায়। সুপ্রাচীন পান পাত্র,
চিত্রিত বাসন, কলসের কানা আর অলংকার
গভীর সংগীতময়। গুহাগাত্র ছায়া ধরে কত,
রাত্তিরে আগুন নিভে গেলে কেউ কেউ মাংস ছেড়ে
করে স্তব প্রত্যুষের। অনেকেই সামগ্রীর দিকে
পুনরায় ধাবমান জাগরণে নেশাগ্রস্ত প্রায়।
স্বপ্নেও সামগ্রী ঝরে, কতিপয় নান্দনিক ফোঁটা।
নানা সামগ্রীর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে বারবার
আমিও দোকানে যাই। এ রকম দেখাশোনা ভালো
লাগে ব’লে বহু ঘন্টা দোকানেই কাটে মাঝে মাঝে
এবং দোকানে গিয়ে দেখি খুব লোকজন আছে;
দোকান গুঞ্জনময়, দরাদরি চলে কমবেশি।
প্রতিটি শো-কেস যেন বর্নোচ্ছল ফুলের কেয়ারি।
দোকানে নানান দ্রব্য, প্রতিটি দ্রব্যক খুঁতখুঁতে
গ্রাহকের কাছে অতিশয় লোভনীয় করে তোলা
দোকানদারির তরকিব। আমি এক কোণে একা
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নিই এটা সেটা, কোনো কোনো
দ্রব্য হাতে তুলে, যেন নির্জন স্বপ্নাংশ নিচ্ছি তুলে,
খানিক পরখ করি; তারপর যথাস্থানে রাখি
অত্যন্ত নির্মোহভাবে। স্মিত মুখে ব্যস্ত, চটপটে
সেল্সম্যানের দিকে সলজ্জ তাকাই। পুনরায়
দৃষ্টি ঘোরে চারপাশে-প্রতিটি সামগ্রী থেকে কিছু
আভা বিচ্ছুরিত ক্ষণে ক্ষণে, দেখি তাদের অস্তিত্বে
অনেক সকালবেলা, দিগন্তের মেদুর ইশারা।
দ্রব্যের আড়ালে কিছু গোপনীয় মায়া সৃষ্টি হয়।
দোকানে অপেক্ষা করি। প্রতীক্ষা সুদীর্ঘ হ’লে বলি,
নিজেকেই বলি, তুমি এই কোণে জীবনানন্দের
হরিণ মুখস্থ করো, দ্যাখো এ দোকান নিমেষেই
আচ্ছাদিত আগাগোড়া ওডেসীর পাতায় পাতায়,
অথবা স্মরণ করো মার্বেল কুড়াতে গিয়ে দ্রুত
সে কখন খেয়েছিলো চুমো বাল্যসখিকে হঠাৎ।
কখন যে দোকানের অভ্যন্তরে আরেক দোকান
জেগে ওঠে সপ্তবর্ণ কলরব নিয়ে। সে দোকানে
কোনো দ্রব্য নেই, তবু কেমন প্রোজ্জ্বল প্রদর্শনী-
কিণ্ণরের কণ্ঠে শুনি সেলস্ম্যানের শব্দাবলী,
জলকন্যা কাউন্টারে মূল্য তালিকার চতুষ্পার্শ্বে
তোলে সমুদ্রের সুর। গ্রাহকেরা বন্দনা-মুখর।
সংকটে কবির সত্তা
সংকটে কবির সত্তা আরো বেশি চিন্তাশ্রয়ী হয়,
কতিপয় খর স্বপ্ন তাকে
বিচলিত করে খুব, বিশেষত মাথার বিষয়ে
ভাবে রাত্রিদিন-
শৈশবে জননী তার মাথার সতেজ ঘ্রাণ নিয়েছেন কত,
কখনো বা স্নেহভরে মাথার ওপর হাত রেখে,
মনে পড়ে, পড়েছেন দোয়া আর দরুদ অনেক,
এখনো তো মাঝে মাঝে পড়ন্ত বেলায় স্মৃতি জাগানিয়া স্পর্শে
বিলি কেটে দেন চুলে। দয়িতা মাথাটা তার কম্পিত দু-হাতে
নিয়ে বুকে কী বিপুল আবেগের খরস্রোতে ভেসে
জড়িয়ে ধরেছে কতবার।
প্রায় প্রতিদিন হয়তো বা সারাক্ষণ কোনো কোনো
নির্ঘুম রাত্তিরে কবি তার একা মাথার ভিতর
নিজেই ভ্রমণকারী; দ্যাখে সে মরাল কতিপয়
নীলিমার সঙ্গে রিশ্তা পাতে,
উড়ে চলে অন্তহীন আলাদা আকাশে, দ্যাখে দুঃস্থ
মাদারির দল হাঁটে, অদূরে বেদের ডেরা আর
জখমি শহরতলী হাবা গোবা ছায়া নিয়ে ভারি
অপ্রস্তুত, ভাঙা মঞ্চে বেজায় অপটু অভিনেতা,
স্মৃতিভ্রষ্ট, থেমে থেমে আওড়ায় পার্ট। কবি অন্যমনে তার
মাথার ভিতর করে ঘোরাফেরা-দ্যাখে এক কোণে
পুরোনো রূপালি তস্তরিতে
আধ-খাওয়া আম তার অন্তর্গত বাস্তবতা মেলে
ধরেছে হাওয়ায় রোদে। দুলছে একটি গাছ দ্রুত
ভিন্নতর বৃক্ষ হয়ে ওঠার ইচ্ছায়, একজন
রমণী অধিক রমণীয় হয়ে জেগে থাকবার
তীব্র আকাঙ্ক্ষায়
অলিন্দে অপেক্ষমাণ। কবি দ্যাখে, ভ্রমণকারীর
ওৎসুক্য নিয়েই দ্যাখে মাথার ভিতর মিছিলের
শেষাংশ, আকাশে দিগন্তের মতো ঠোঁট,
সবুজ এলিয়ে-থাকা মানবীয় ভাস্কর্য বিশাল।
সত্তার সংকটে দীর্ণ কবি দ্যাখে তার অগণিত
প্রতিধ্বনিময়
মাথার ভিতর অন্য এক দীপ্র মাথা শূন্যতায়
দ্বীপের মতোই দৃঢ়। নিজস্ব মাথাই বটে তার
ধুলোয় গড়ানো নয়, বেশ উঁচু, সোনালি থালায়
মখমলে রাখা,
যেন বা মুকুট এক। কবি তার মাথার চাদ্দিকে
কেবল চক্কর কাটে, শেষমেশ চুমো খায় খুব
ভালোবেসে মাথাটার গালে।
কবির মাথাকে ডেকে বলে বহুরূপী কারাগার,
তুইতো আমারই।
ঘাতকের হাত বলে, তোর প্রতি আমার প্রতিটি
রোমকূপ বিষম আকৃষ্ট।
বন্দুকের চোখ বলে, আয়, দাঁড়া এখানে নিথর
লাগুক চুলের স্পর্শ পাথুরে দেয়ালে, শেষ স্তোত্র
কর পাঠ, তুইতো আমারই।
জামিন কবির মাথা মেঘমালা আর পরিযায়ী
পাখি আর লতাগুল্মময় স্নিগ্ধ জমিনের কাছে,
জামিন কবির মাথা নক্ষত্রগুচ্ছের কাছে আর
পুশিদা পথের কাছে, ভিখিরী, উদাস পথচারী,
ভবঘুরে সার্কাসের ভাঁড় আর দুঃখিনী নর্তকী,
ক্লান্ত বাঁশি-অলা, পুষ্টিহীনতায় অতিশয় শীর্ণ
শিশুদের কাছে, শহরের উঁচু মিনারের কাছে,
জামিন কবির মাথা তৃষ্ণাদীর্ণ কবিদের কাছে।
সেই আজনবি
কোত্থেকে এলো সে কেউ বলতে পারে না, তাকে ঘিরে ভিড় জমে
সকালবেলার রোদে; কেউ
সম্মুখে এগিয়ে যায়, কিছুটা পেছিয়ে আসে কেউ।
পরস্পর কানাঘুষো চলে, কী সুন্দর কী সুন্দর বলে কেউ,
ফ্যালফ্যাল তাকায় কেউবা।
সবুজ শরীর তার স্নেহজাত সমর্থন পায়নি কখনো
গেরস্তের ঘরে;
বাতাসে সোনালি চুল ওড়ে নিরিবিলি চক্ষুদ্বয় পৃথিবীর
সম্পর্করহিত আর পদযুগ কস্মিনকালেও পাঁকে
ডোবেনি এবং
চিন্তা তার সারসের মতো ওড়ে আকাশে আকাশে, ফুলে ওড়ে,
পাখিদের চোখে চোখে, লতাগুল্মময় চিন্তা তার পাতালের
প্রতিবেশী।
বড়ো বেশি চুপচাপ কান্তিমান যুবা তবুও অস্তিত্ব তার
গীতধারা।
তাকে দেখে বোঝা যায় নিজে-নিজে খুশি থাকা বলে কাকে।
যখন বাড়ায় হাত ভালোবাসা মর্মরিত হয় গাছে গাছে,
মাটিতে কী যেন ফোটে ফুলের মতন, অনেক পায়রা ওড়ে
দুরের রোদ্দুরে।
কেউ তার চুল ছুঁয়ে দ্যাখে, কেউ আঙুল বুলোয় ঝলমলে
সবুজ শরীরে,
এ কোন অতিথি এলো আজনবি-সকলেই ভাবে।
কেউ বা বসাতে চায় বৈঠকখানায় তাকে, ভিতরমহলে’
কেউ নিয়ে যেতে চায়, কেউ তার সখ্য একান্ত কামনা করে
সকল সময়।
আজনবি থাকে তবু বাইরে সর্বদা চুপচাপ, একা-একা,
বলে না কারুর সঙ্গে কোনো কথা, বুঝি নীরবতা
একান্ত আরাধ্য তার। যখন সে হেঁটে যায় প্রতিটি সকাল
আরেক সকাল হয়, রাত্রি ভিন্ন রাত্রি, ফুলের কেয়ারি থেকে
জেগে ওঠে স্বপ্নময় গান, তার সঙ্গে চলে পশুপাখি আর
নক্ষত্রমন্ডল।
জানে না সে হিংসা বলে কাকে, কাকে ক্রোধ কিংবা ঘৃণা;
সর্বদা নিশ্বাসে তার বয়ে যায় ক্লান্তিহীন প্রেমের নিশ্বাস।
সকলেই তাকে চায়, কান্তি দ্যাখে, বিশ্লেষণী বোধ লোপ পায়
তার কাছে গেলে।
এভাবে সময় যায়। কেউ সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে, ভাবে ওরা-
কী করে এমন হয়? এ-ও কি সম্ভব এত ভালো কেউ
আমাদের মধ্যে তার খুঁজবে নিবাস? কেউ কেউ সুকৌশলে-
দারুণ হিংসুক ওরা, বড়ো
বেশি হিংস্র-
রটায় নানান কথা, বলে আমরা ফেরেবে প’ড়ে
একটি নকল স্বপ্নে বন্দী হয়ে আছি, এই আজনবি শুধু
অশুভের বীজ
কৌশলে ছড়াচ্ছে লোকালয়ে। একদিন সকলেই সমস্বরে
যেও না যেও না কেউ ওর নজদিক,
বন্দী করো তাকে ব’লে পথে পথে হলো জড়ো, তারপর
খাঁচায় পুরলো সেই কান্তিমান অচেনা যুবাকে।
আজনবি চিত্রবৎ, যেন রক্ত নেই তার শিরার গলিতে,
করেনি সে কোনো প্রতিবাদ।
বড়ো বেশি চুপচাপ খাঁচায় রইলো সে, শুধু তার চক্ষুদ্বয়
তখনো রহস্যময় খুব।
এভাবে সময় যায়। সবুজ শরীর তার ঝলমলে তবু,
নিরিবিলি চক্ষদ্বয় জ্বলজ্বলে।
অকস্মাৎ একদিন কৌতুকের তোড়ে এসে একলেই দ্যাখে
সকালবেলার রোদে দ্যাখে-
শূন্য খাঁচা, কী যেন হিংসার মতো শুধু কালো, অস্থিচর্মসার
পড়ে আছে একরত্তি, মৃত।
হ্যাঙওভার
(মাহমুদুল হক প্রিয়বরেষু)
কিছুই খাবো না আজ, যে-কোনো আহার্যে ভয়ানক
অরুচি আমার।
কাল সারারাত আমি তারাস্রোত আর এক একর অন্ধকার
আকণ্ঠ করেছি পান, রাত্রিকে নিয়েছি শুষে; আজ
আমাকে বিরক্ত করবার কোনো মানে নেই, দ্যাখো
স্বস্তিতে কোথাও ব’সে থাকা দায়। একটি রাত্তির
স্মৃতিতে কেবলি দিচ্ছে হানা, যে-সৌন্দর্য চেতনাকে
নিমেষে ঝলসে দেয়, তাকে পান ক’রে সংজ্ঞা প্রায়
লুপ্ত হয়েছিলো,
মনে পড়ে। মনে পড়ে কার শরীরের স্মিত অববাহিকায়
চাঁদ উঠেছিলো আমি কিরণ করেছি পান কাল সারারাত।
রাত্রি
গ্রীবা
চোখ
হাত
চুল
একটি কাচের পাত্রে তরলিত কেমন সোনালি, মনে পড়ে-
একটি চুমুকে সব পান ক’রে কোথায় দাঁড়িয়ে এলেবেলে
কি-যে
কাকে
সামনে
রেখে আস্তে
উচ্চারণ ক’রে আরেকটু জ্যোৎস্না, গাছগাছালির
সবুজাভ রেশমি ধারা পান করেছিলাম রাত্তিরে,
পুরোপুরি নয়, শুধু একটু একটু মনে পড়ে, মনে পড়ে।
কাল রাত বড়ো বেশি খাপছাড়া ছিলো নাকি? দাঁড়াও ইয়ার,
স্মরণ করতে দাও, এই তো পড়ছে মনে, চিত্রিত দেয়ালে
পিঠ রেখে
কাঁদ ছিলো কেউ, তাকে নারী ব’লে শনাক্ত করাটা
ছিলো না মুশকিল;
শুধু নারীরাই
অমন কাঁদতে জানে, তার
গভীর চোখের জল ঝর্নার মতন নেমে গেলো তৃষাতুর
মসৃণ আমার কণ্ঠনালী বেয়ে। দেখি ভীষণ কর্কশ
একদল লোক
গালমন্দ দিতে দিতে, খিন্তির প্রচুর থুতু ছিটোতে ছিটোতে
কবরে শুইয়ে দিলো হেলায় তাদের,
যাদের আস্তানা ছিলো আমার নিজের
হৃদয়ের কাছে।
নিমেষে সেসব সদ্য কবর চৌচির, লাশগুলি গুচ্ছ গুচ্ছ
নীল মুক্তো হ’য়ে ফের কেমন মদিরা হ’য়ে যায়,
পান করে বুঁদ হয়ে যাই।
পূর্বপুরুষের কিছু স্মৃতির অস্পষ্ট ঝোপঝাড়ে
নিঃসঙ্গতা বোধ বাড়ে। একটি রাত্তির
এখনো বুকের মধ্যে থরথর করে। একজন, তার মুখ
বিষণ্ণ সুন্দর,
আমাকে এড়িয়ে যেতে চেয়ে মোমবাতির মতন গ’লে যায়-
নিশীথসমেত
গলিত মোমের বিন্দু পান ক’রে বুঁদ হয়ে যাই, বিন্দুগুলি
এখনো বুকের মধ্যে থরথর করে। গ্লাস থেকে
শূন্যতা উপচে পড়ে, বুঁদ হয়ে থাকি, তার বসে-থাকা, তার
আসা-যাওয়া পান ক’রে বারবার বড়ো বেশি বুঁদ হয়ে যাই;
টলে পড়ে যেতে যেতে আবার সামলে নিই বিব্রত অস্তিত্ব।
রক্তিম কাদায় ক্রল করতে করতে হাঁটু আর
কনুই আহত, অবসন্ন;
বিশ শতকের প্রায় অন্তিম গোধূলি পান ক’রে
ক্ষয়ের ভাটিতে ভেসে যাচ্ছি ক্রমাগত বুঁদ হয়ে, নিরুপায়।
কিছুই খাবো না আজ, যে-কোনো আহার্যে ভারি অরুচি আমার।
ShuchiPotr