তোমার কবিতা
খোয়ানো কবিতা খুঁজে ভোরবেলা এলোমেলো করে
দিয়েছি টেবিল।
কোথায় যে গেল রক্ত গোলাপের ছায়া,
আকাশের এক মুঠো নীল।
তোমার আয়ত চোখ, মুখ, স্তনচূড়া,
মাথার চুলে ভেজা ঘ্রাণ
লিখিয়ে নিয়েছি সেই হারানো কবিতা,
সে তোমারই দান।
দুপুরে এগিয়ে দিলে নিজের কবিতা
আমার তন্ময় করতলে
নত হয়ে অক্ষরে অক্ষরে দেখি উন্মোচিত হৃদয় তোমার,
একূল ওকূল ভাসে নিভৃতির জলে।
তৃষ্ণার্ত পাখির মতো আমি চাই পানি
কণ্ঠে তুলে নিতে;
কবরস্থানের পুষ্পহাসি হয়ে তোমার কবিতা
জেগে থাকে আমার স্মৃতিতে।
দীর্ঘ ভ্রমণের পর
দীর্ঘ ভ্রমণের পর শ্রান্তি মোহিনীর মতো ভঙ্গি
অঙ্গে এঁকে অলস আঙুলে
দেখায় নিভাঁজ শয্যা, কানে কানে বলে, আর নয়,
এবার বিশ্রাম করো, কোনো কোলাহল
নেই কোনোখানে,
দায় আর ফুটে নেই গোলাপের মতো, যা তোমাকে
টেনে নেবে পথে সর্বক্ষণ, দরজাটা
বন্ধ থাক, এবার ঘুমাও।
সত্যি ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত আমি আজ, উদ্যম রহিত;
কোনো কা, এমনকি কারুকাজ করা
অত্যন্ত কঠিন মনে হয়, উৎসাহের
ভাণ্ডার উজাড় হলো অবশেষে? তাহলে নিঃসাড়
নিঃস্পন্দ থাকবো পড়ে এক কোণে একা
বৃদ্ধ অর্জুনের মতো হীনবল যে ভুলেছে গান্ডীবে টংকার
তোলার কৌশল? দেখ, দু’পায়ে আমার
ফুটেছে চুণির মতো রক্তবিন্দু। মুছে যাবে কবে?
শ্রান্তি কিংবা ভ্রান্তি দিক পেতে সিল্ক মসৃণ চাদর,
কাউকে জড়িয়ে আমি নিমজ্জিত হবো না নিদ্রায়।
দুর্ভোগ
তবে কেন সম্প্রতি এমন অবহেলা? কেন তুমি
আড়চোখে তাকিয়ে আমার দিকে দূরে সরে যাও,
ঝরে যাও, যেরকম মুঠো থেকে সহজে পিছলে
যায় মাছ বার বার? অদূরে দাঁড়িয়ে, হেসে ওঠো
ফিক করে, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা বলে আমার খাতার
কিছু পাতা ছিঁড়ে ফেলো কুটি কুটি। আমি তো তোমারই
মুখের আদল চির উর্বশী শরীর আজীবন
তন্নিষ্ঠ ফোটাতে চেয়ে নিজেকে মারাই নিত্যদিন।
তবু কেন এমন রহস্যময় ব্যাভার তোমার
প্রায়শ প্রত্যক্ষ করি? কখনো সহজে দাও ধরা,
আবার কখনো মনে হয় যোজন যোজন দূরে
বর্ণিল অলিন্দে হেঁটে যাও ক্লিওপ্যাট্রার ধরনে।
পায়নি নিস্তার কেউ তোমার অদ্ভুত ছলনার
নির্দয় ছোবল থেকে, ভুগিয়েছো জীবনানন্দকে।
দেয়ালে আমার পিঠ
দেয়ালে আমার পিঠ, আর সরে দাঁড়ানো
কিছুতে সম্ভব নয়; দেখছো না খর
জ্যোৎস্না আর গোলাপের ওপরেও হয়েছে চাপানো
ভারী আয়কর!
নিশ্চুপ শাদায়
সাধ জাগে, এ দেয়ালটার আড়ালে কী আছে, দেখি।
কেউ কি এলিয়ে চুল বসে আছে একা-নাকি কেউ
গুমরে গুমরে কাঁদে বাদামি দু’হাতে মুখ ঢেকে?
কেউ কি সরোদে সুর তুলে নিজেকে আনন্দ ধ্বনি
করে কিংবা লেখার টেবিলে ঝুঁকে মন ছেড়ে দেয়
কত শব্দ-হরিণের গলায় বুলিয়ে দিতে হাত।
ভাবি, হয়তোবা নারী ও পুরুষ তুচ্ছ-সুমধুর
কথোপকথনে মেতে আছে, কিছু মান-অভিমান,
অকস্মাৎ অস্তিত্বের আঁশ খাড়া করে ফুঁসে ওঠা,
তা-ও আছে, আছে চুম্বন এবং আলিঙ্গন।
বুঝি শিশু হামাগুড়ি দিয়ে সুপ্ত বেড়ালের দিকে
ক্রমশ এগোয় নাকি কেউ কারো গলা কেটে ফেলে
নির্বিকার চিত্তে ধুয়ে নেয় হাত সফেদ বেসিনে?
মনে হয়, অন্তরালে কারা যেন দেশ উজাড়ের
নক্শা আঁকে চুপিসারে, অবরুদ্ধ পালাবার পথ;
বোঝা দায়, নজর আটকে থাকে নিশ্চুপ শাদায়।
পুরানো কবরস্তান
কোনো কোনো জিনিশ রয়েছে, যা অত্যন্ত অনিশ্চিত,
হিশেবে পড়ে না, আগে থেকে বলবার কিছু নেই।
পুরানো কবরস্তান মাঝে মাঝে হানা দেয় মনে,-
তার মাটি আর ঘাস, গোরখোদকের প্রাত্যহিক
খাঁটুনি আমাকে টানে; কোনোদিন সেখানে আমার
গোর হবে কিনা আমি বলতে পারি না। রাত্রিবেলা
জোনাকিরা বংশপরস্পরা রক্ষা করে; অন্ধকারে
ভিখিরিরা ভিড় করে, আগরবাতির ধোঁয়া, ঘ্রাণ
পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠে আসমানে; ডানা-অলা কেউ
ছুঁয়ে যায় আলতো আমাকে, দিগন্তের কানে ঝরে
অস্পষ্ট গুঞ্জন আর বড় স্তব্ধ মৃতের বাজার।
ক্ষুধার আগুন নেই, নেই ধার কর্জের কার্যক্রম;
পুরানো কবর চায় নতুন বারিন্দা স্থানাভাবে,
অকস্মাৎ বৃষ্টিধারা মুছে ফেলে কিছু কিছু স্মৃতি।
পুরুষানুক্রমে
প্রায় পনের-ষোল বছর ধরে
সে দেখে আসছে নিজিশটাকে দেয়ালে টাঙানো।
গরিব ঘরের পুরানো অলংকার ভেবে
সে এতকাল ছুঁয়েও দেখে নি।
একদিন সে বস্তুটিকে নামিয়ে আনল মাটিতে।
ওর মনে হলো, মর্চে-পড়া
এক অস্ত্র তার মুঠোয়। ঘষে ঘষে
খসিয়ে ফেলল জং। চকচকে
হয়ে ওঠে সে কোন দূর পূর্বপুরুষের হাতিয়ার, যা হাতে নিয়ে
সে নাচে পূর্ণিমা-রাতে ঢাকের তালে তালে।
ওর দিন কাটে মাঠের কাজে। লাঙল ঠেলে
চিরে ফেলে মাটির বুক, বীজ বোনে,
সে, রৌদ্রর আঁচে ভাজা ভাজা,
নিড়ায় আগাছা আর দ্যাখে ওই আসছে আল বেয়ে
গামছা-বাঁধা ডাল-ভাত টুকটুকে লঙ্কা নুন নিয়ে নথ-পরা বউ।
ভাবে, কখন আসবে পূর্ণিমা রাত, যখন সে
নাচবে ঢাকের তালে তালে আর হস্তধৃত হাতিয়ারের
ফলা ক্ষণে ক্ষণে ঝলসাবে বন্য প্রাণীর চোখের মতো?
বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা
তুমি কি আমাকে এই মুহূর্তে ডাকছো খুব কাছে?
এখন তোমার কণ্ঠ থেকে বেরুচ্ছে না
কোনো শব্দ কিছুতেই। ওরা জালে আটকে রেখেছে
তোমার শব্দের পাখিদের, চোখ বেঁধে
রেখেছে আড়ালে, পাছে তুমি দেখে ফ্যালো
হঠাৎ আমার মুখ। এইতো কয়েক ঘণ্টা আগে দেখা হলো,
অথচ তোমাকে কত যুগ
দেখিনি। আমার
হৃদয় মাড়িয়ে যাও, তবু আমি আর্তনাদ করি না কখনো
ভুলেও, স্বপ্নেরা কলকলে আগুনের স্পর্শ লাগা
মৌচাকের মৌমাছির মতো
মরে থাকে চারদিকে। দ্যাখো আমাদের ভালোবাসা
নাম্না গাছটিকে আষ্টেপৃষ্টে
জড়িয়ে রেখেছে এক সাপ চক্রান্তের
কুণ্ডলীর মতো। বলো দেখি,
কী করে বাঁচাই একে ছোবলের বিষক্রিয়া থেকে?
এখানে আসবে তুমি শেষবেলা গায়ে
মেখে, চোখে নিয়ে
হরিণীসুলভ কবিতার খুব গাঢ় কোমলতা, বলেছিলে।
কী করে আসবে বুকে নক্ষত্রের মৃত্যু, নির্ভরতা,
নিরাপত্তাহীনতার করোটির জানাজার স্মৃতি
বয়ে, এ সড়ক বেয়ে? এতো দূর পথ, বারুদের গন্ধময়,
টিয়ার গ্যাসের জ্বালা সর্বত্র ছড়ানো,
পুলিশের হুইসিল, ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া,
কী করে আসবে তুমি পথচারীদের চোখে-মুখে
নাচিয়ে শাড়িরে জয়োল্লাস?
গোলাপ মুঠোয় দ্রুত ম্লান হয়ে যায় বলে
গোলাপ অনিনি। তুমি আসবে কি আসবে না, এই
দ্বিধা বার বার
কামড়ে ধরেছে, তাই রজনীগন্ধার পরিবর্তে আমি একা
হতাশা কিনেছি আর উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি সন্ত্রাস,
কতবার আমরা চালান হয়ে গেছি
গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে শ্বাপদের
মতো অন্ধকারে; আমাদের বেচে দেয়
ওরা অগোচরে
সামাজ্যবাদের কাছে। পুনরায় ঘাতকেরা শান্তির নিবাসে
ধানমণ্ডি লেকের এপারে।
বুলেটের ঝড় তোলে; ঘৃণা দিয়ে ওদের তাণ্ডব
থামানো যাবে না। বেচে আছি অস্ত্রহীন অসহায়,
ফ্যাসিবাদীদের মুখোমুখি। ফুল আর জ্যোৎস্না দিয়ে
বেপরোয়া ঘাতকের সঙ্গে আজ লড়াই করবো,
ওদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে কল্পনায়
সাজাবো রঙিন সেনা, কী করে সম্ভব?
এ সড়কে যেতে যেতে ভাবি,
কতবার এখানে চলেছে নির্যাতন পাশবিক,
কতবার বয়ে গ্যাছে রক্তস্রোত, তর তাজা ঘ্রাণ
এখনো ফোটায় গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত গোলাপ এখানে।
এ সড়কে কতবার পিতার বুকের হাহাকার,
থেঁতলানো সন্তানের মাথা নিয়ে বুকে
আর্তনাদ করেছেন মাতা,
স্বামীকে হারিয়ে কত বিপন্ন মহিলা হয়েছেন
উন্মাদিনী জীবনের প্রখর দুপুরে, কতবার অগণিত
বিশ্বাসঘাতক এ সড়কে ইশারায় আশ্রয়ের
একাগ্র আশ্বাস দিয়ে কত জীবনকে অঙ্গারে হাঁটিয়ে নিয়ে
পৌঁছে দিয়েছ খুনীদের আস্তানায়। এ সড়কে বেঈমান
সময়ের ধূর্ত ঘাড় মুচড়ে দিয়েছে রোদে-পোড়া সব হাত।
চলো না আমরা হাঁটি এ সড়কে পাশাপাশি, একটু দাঁড়াই,
চোখ ভরে দেখে নিই, শুনি
অশ্রুত অনেক গাঁথা বীরত্বের। রক্তাক্ত পায়ের ছাপ রেখে
সাজাই ফুলের তোড়া শহীদের পবিত্র উদ্দেশে।
যদি ওরা ডালকুত্তাদের
ভীষণ লেলিয়ে দেয় আমাদের দিকে, পরস্পর
চুম্বনে চুম্বনে মুছে দেবো ভয় ডর
সকল হিংস্রতা, এ রকম আলিঙ্গনে
মৃত্যু অনেক শ্রেয় নির্যাতিত মানুষের বর্ণনা করার
মতো শিল্প আমরা দু’জন
রেখে যাবো, বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা উত্তরাধিকার,
তুমি আসবে তো? দ্যাখো, সূর্য তার শেষ বর্ণচ্ছটা
তোমার আসার পথে বিছিয়ে দিয়েছে, যেন পারস্য গালিচা।
মানুষের মহামিলনেই মুক্তি, তুমি আসছো তো?
আমাকে দেখিয়ে ওরা বলবে সবাই, দ্যাখো যায়,
স্মৃতি স্বপ্ন বিলিয়ে বেড়ানো কবি যায়, মাথার ভেতর যার
হিরন্ময় লতাগুল্ম, গোলাপের বন, কণ্ঠস্বর কী স্পর্ধায়
আকাশকে ছোঁয়, যায় মানুষের হাটে,
কবি গিয়ে মিছিলের কাতারে দাঁড়ায়। মড়কের
ব্যাপক ভৌতিক হাহাকারে
তবকের মোড়কে নিঃশব্দে প্রেম এসে
থতোমতো খেয়ে ঠাঁই খোঁজে আমাদের হৃদয়ের ঝর্ণাজলে।
মানব বন্ধনে ভালোবাসা পেয়ে যাবে
প্রগতির সমঅধিকার, তার চোখে তৃষ্ণা, নক্ষত্রের গান।
এ সাহস পেলে হে কোথায়, অনেকেই প্রশ্ন করে। হেসে বলি,
আমার বুকের মুধ্যে ঘুমন্ত সিংহের মতো ছিল। চতুর্দিকে
আগ্নেয়াস্ত্র বড় বেশি ধমকাচ্ছে বলে
সে-ও চোখ পাকিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে এখন।
উন্মত্ত নির্মম ঝড়ে শৃংখলিত হতে পারে ক্ষণকাল, তবু
থামবে না তার মৃত দিনরাত্রি ঝাঁকানো গর্জন।
নিশ্চুপ থেকো না আর চলে এসো, অন্য কোনো পথ
নয়, এ পথেই চলে এসো হাওয়ায় উড়িয়ে চুল
জোর কদমের তালে তালে দুলবে তোমার স্তনভার, তুমি
মাধুর্যের নদী হয়ে বয়ে যাবে, যা আমার খুব
ভালো লাগে, যতোক্ষণ তুমি ছুঁয়ে না যাও আমাকে, ততোক্ষণ
পোড়া-খাওয়া মানুষের ভিড়ে ঝোড়ো হৃদপিণ্ড এবং
প্রতীক্ষা থরোথরো।