ঘড়ি
আমার চরম শক্র ঘড়ি, সময়কে অবিরল
প্রবল শাসন করে টিক টিক্ ধ্বনি
দিয়ে আর আমাকে কেবলি
ঠেলে দেয় মরু শেয়ালের গায়ের রঙের মতো
অন্ধকারে। অসহায় আমি
গড়িয়ে চলেছি শোকে ঢালু বেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া নুড়ির ধরনে।
‘চটপট উঠে পড়’, বলে ঘড়ি আমার উদ্দেশে প্রহরীর
কায়দায়, ‘তোমার সময় হলো এ ড্রইংরুমের
নিবিড় আশ্রয় ছেড়ে যাবার। এবার
পথে নেমে যাও, আর কত কাল তার মুখোমুখি
থাকবে বসে? খানিক তাকিয়ে
তোমার মুখের দিকে পথ চলি, সুসময় ঝরে যায় পথে।
এখন আমার বুকপকেটে তোমার হাতচিঠি
দোয়েলের শিস, বেবি ট্যাক্সির জঠরে
বসে ভাবি, আমার জীবন যেন তোমার নিকট
অলিখিত তমসুক। ঘড়ি
আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জানায়, তোমার
জীবন ফুরিয়ে এলো, ওহে, এ সামান্য কথা ভুলে বসে আছো?’
কী করে যে সারা মাথা চকিতে সাজানো
হয়ে গেল কাশফুলে, কাঁকড়ার প্রখর
পদচ্ছাপে ভরে গেল মুখ
কিছু তো জানি না। অগোচরে প্রৌঢ়ত্বের
চিতা পুড়ে হলো ছাই, তবুও তোমাকে খুব কাছে
পাবার বাসনা আজো কিছুতে নেভে না।
সব কিছু এত দ্রুত অস্তাচলে যায়,
ঠাওর হয়নি আগে। কব্জিতে কৌতুকপ্রিয় ঘড়ি
চোখ মেলে মিটি মিটি হাসে
ভাঁড়ের ভঙ্গিতে; তার মুখ
ভীষণ পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। অভিমানে দূরে
ছুঁড়ে ফেলে দিলে বুঝি স্বস্তি বোধ হবে?
প্রকৃত গেরস্ত নই, অথচ নাছোড় শক্র নিয়ে দিনভর
রাতভর চলে গেরস্থালি।
সে যত রাঙায় চোখ, আমি তত বিষণ্নতা থেকে,
ভয় থেকে দূরে থাকি একা হেমন্তের
মধ্য দিয়ে যেতে যেতে। হৃদয়ের পবিত্র আগুনে
মদির আলস্যে ঘড়ি গলে গলে যায় গোধূলিতে।
চলে যাওয়া যার রীতি
কখনো তোমার দেহ বেজে ওঠে,
যেন অনিন্দ্য বীণা।
ছুঁতে গেলে একি চোখের পলকে
হয়ে যাও মেঘলীনা।
আমার স্বপ্ন যাচ্ছে জড়িয়ে
তোমার কৃষ্ণ চুলে;
কিছু লেগে থাকে, কিছু ঝরে যায়
চুল দাগ যবে খুলে।
মেঘের ছায়ায় রেখেছি মনের
গোপন ইচ্ছে গুলি।
মেঘ উড়ে গেলে মুঠো মুঠো শুধু
ভস্মের কণা তুলি।
বয়স এখন দস্যুর মতো
পরমায়ু দ্রুত কাড়ে
হৃদয় আমার গলে পুড়ে খাক
তোমার স্বৈরাচারে।
একটু দাঁড়াও, মুদ্রিত হোক-
মনে কিছু কিছু স্মৃতি
কেন তার পথ আগলে দাঁড়াই,
চলে যাওয়া যার রীতি?
মুখস্থ বলি তোমাকে এখনো
একেবারে ক্রটিহীন।
কিন্তু তবুও শরীরে আমার
ঢেলে দাও কেরোসিন।
অবমাননার শেকলে বন্দি
পড়ে আছি এক কোণে।
জাঁহাবাজ শিখা চাটুক আমাকে
এ ছিল তোমার মনে।
মনের কোটরে কেউটে ঘুমায়,
কখন জাগাবে তাকে?
তোমার দু’চোখ লেগে থাকে দেখি
ঝাউবৃক্ষের শাখে।
বিশ্বেস করো, তোমাকেই ভাবি,
ভাবছি অহর্নিশ।
অমৃত চেয়েছি তৃষ্ণা মেটাতে,
উগরে দিয়েছো বিষ।
পারবে কি কেউ আমার মতোন
পোড়াতে নিজের ঘর?
পারবে ছিন্ন করতে নিজেরই
মুণ্ডু এবং ধড়?
চলো ফিরে যাই
সদর রাস্তায় নিয়ে এসেছি তোমাকে;
আসতে চাও নি তুমি, আমার নাছোড়পনা দেখে
দিয়েছো সম্মতি, কিন্তু এত নির্যাতন
হবে, হবে এমন হেনস্থা চারদিকে, যদি জানতাম আগে
তোমাকে বেআব্রু করে হাটে
দাঁড় করাবার সাধ শুকনো মঞ্জরীর মতো ঝরে
যেতো অগোচরে, যদি আস্থার দেয়ালে
ফুঁটো তৈরী এখনো না হয়ে থাকে, বলি,-
যখনই তোমার গায়ে পড়েছে আঁচড় কারো, আমি
হয়েছি আহত ভয়াবহ ভাবে, আরোগ্যশালায়
এমন ওষুধ নেই, যার প্রভাবে জখম
সেরে যাবে তাড়াতাড়ি। চেয়ে দ্যাখো, তারা মণ্ডলীর
নিচে দূরে কদমতলায়
বসেছে গোপন সভা, সেখানে তুমিই সভানেত্রী; জুঁই ফুল
হয়ে জ্যোৎস্না ঝরে যায় কার্পণ্য-রহিত ব্যবস্থায়;
চলো ফিরে যাই।
চুপ
চুপ,
চুপ, চুপ,
চুপ, চুপ, চুপ,
কোনো শব্দ নয়, কথা নয়।
এমনকি ফিসফিসানিও
চলবে না। চুপ থাকো ইঁদুরের চেয়েও
শতগুণ বেশি, সব চুপচাপ,
একেবারে নিঝুম, নিশ্চুপ।
গাছ, তুমি একটিও পাতা নাড়াবে না,
মাছ, তুমি কাটবে না কোনো বুড়বুড়ি
অথবা দেবে না লাফ, সাফ বলা হচ্ছে দিনরাত।
দোয়েল, তোমার শিস মুলতবি রাখো,
ভ্রমর, তোমার গুনগুনিয়ে
ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। বৃষ্টি তুমি
বাজাবে না ঘুঙুর কখনো, লেখকের বেয়াদব
লেখনী স্থবির হোক, কেউ কোনোখানে
রা কাড়ার সুযোগ পাবে না। জোরে শোরে
বিশ্বস্ত কুলুপ এঁটে দেয়া হয়েছে অনেক আগে
সকলের মুখে; বাছা-বাছা
কজন স্বনামধন্য ছাড়া কারো মুখ খুলবার
অধিকার নেই।
চুপ, চুপ,
কালবৈশাখীও চুপ থাকবে এখন।
চুপচাপ গোরস্থান আরো বেশি নিথর, নিশ্চুপ
থাক; চুপ, চুপ।
যে যাই বলুক,
সুদূর দিগন্ত-চেরা ঝড় শোনে না বিষেধ,
কেউ কোনোকালে
পারে না নিষিদ্ধ করে দিতে
আকাশের ডাক আর
উদ্দীপ্ত মানুষ চিরকাল
মুখ বুজে থাকবে না, গর্জনের তরঙ্গে তরঙ্গে
নিমেষে পড়বে ধসে দুর্ভেদ্য দেয়াল,
কেউ চুপ থাকবে না আর।
জন্মদিন হাসে
যে রোদ আমাকে চুমো খেয়েছিল সুদূর মাটির ঘরে,
প্রথম বারের মতো, তার কোনো রূপান্তর নেই;
কেবল নিজেই আমি কী দ্রুত বদলে যাচ্ছি, খেই
কোথাও পাচ্ছি না খুঁজে। কোনো কোনোদিন চরাচরে
বেদনার বুক চিরে আনন্দ বেরিয়ে আসে, জন্মদিন হাসে;
হঠাৎ আয়নায় কোন্ অচেনাকে দেখে মিশে যাই দীর্ঘশ্বাসে!
কোত্থেকে একটি স্বপ্ন-বিতরণী পাখি কানে কানে
বলে যায়, পালিও না, ভগ্নকণ্ঠ হলেও সাজাতে হবে পৃথিবীকে গানে।