কথা ছিল না
কথা ছিল না
কথা ছিল না এখানে এভাবে এসে দাঁড়াবার।
কথা ছিল না এখানে দাঁড়িয়ে নিজস্ব ভাবনাগুলোকে
নিপুণ অশ্বারোহীর মতো বাগ মানিয়ে
খেলা দেখাবার। খুব যে একটা কসরৎ করেছি,
বলা যাবে না। যেখানে রৌদ্র দরকার, সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছি
বিকেল বেলার রোদ আর যেখানে
ছায়া জরুরি, সেখানে মেঘ থেকে কর্জ এনেছি ছায়া।
একটু হাওয়া বইয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল,
বৃষ্টির শব্দ মিশিয়ে ভাবনাগুলোকে
মুখর করে তোলার উদ্যম থেকে বিরত থাকার
কোনো চেষ্টাই করিনি।
আমার কথা ছিল ঝরে-যাওয়া নক্ষত্র কুড়িয়ে এনে
মনের মতো একটি মালা গেঁথে তাকে পরিয়ে দেবার,
আমার তো কথা ছিল ঝর্ণাতলার আহত হরিণের আর্তনাদ শুনে
চমকে ওঠা, যেখানে রঙ বেরঙের পাখি
খুঁটে খুটে খায় স্বপ্নবীজ। কথা ছিল অতল জলরাশির ফেনা
ছেড়ে
উঠে আসা জল কন্যার ভাষাহীন ভাষা
শোনার আশায় সমুদ্র তীরে ছুটে যাবার। স্বপ্নে বুঁদ হয়ে
বস্তু জগতের প্রতি উদাসীনতার ডিঙি ভাসিয়ে
ভাটিয়ালী গাওয়া অথবা বনবাদাড়ে
একা-একা ঘুরে বেড়িয়ে গোধূলির ঘণ্টাধ্বনি শোনার কথা
ছিল আমার।
অথচ আমি জল পায়রার ডানার অজস্র ঝাপটানি,
বন দোয়েলের শিস, স্থলপদ্মা আর
পাতার মর্মর আর ডাঙার পাথরে হেলান দেয়া
জলকন্যার চাউনি, যা শুনিয়ে ফেলে আত্মা, বহু যুগের
ঘোড়ার কংকাল দু’পায়ে মাড়িয়ে
আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি স্পন্দিত বুকে তোমাদের
মাঝখানে।
আজো কিছুতেই একথা আমার কাছে স্পষ্ট নয়,
সে কোন শক্তি আমাকে অসুস্থতার নাছোড় বেষ্টনী থেকে,
মধ্যরাতের পাখির বিলাপ,
নক্ষত্ররাজির কুহক, স্তব্ধতার ঢলাদি আর
আকাশের বুক থেকে মাটির দিকে ঝুঁকে-থাকা আধখানা
চাঁদের ঢুলুনি থেকে মুক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এখানে।
এখন আমার আর ফেলার পথ নেই। অঙ্গারের
উপর দিয়ে হলেও
হেঁটে যেতে হবে আমাকে, জীবন যত রক্ষ্ণতা বিছিয়ে দিক
পথে, এগিয়ে যেতেই হবে, যত নারকীয় হোক
পায়ে চলার পথ, থামতে পারবো না কিছুতেই।
যে আমার সর্বক্ষণের ভাবনায় জেগে থাকে
ফুটন্ত গোলাপের মতো,
যে আমার হীরের ঝালর সাজানো ঘোড়ার পিঠে
সওয়ার হয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘনীভূত করে
সান্নিধ্যের মধুধারাকে,
যে পছন্দ করে আমার নির্জনতায় হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে,
ভয় পায় জনসমুদ্রে আসতে,
তাকে আমি দ্বিধার টিলা থেকে নামিয়ে
নিয়ে এসেছি এখানে।
আগুন, আগুন, আগুন বলে সবাই
চিৎকার করে উঠেছে দশ দিক কাঁপিয়ে; অনেকে দুঃস্বপ্ন থেকে
জেগে উঠে ঝাঁপ দিয়েছে নদীতে,
অনেকে ভৌতিক স্তব্ধতাকে আলিঙ্গনে করে,
ভেসে গেছে কোথায়, আগুনের ঝড়ে পুড়ে খাক হয়ে গেছে
ঘাটে-বাঁধা নৌকো, রাশি রাশি
শস্যদানা, শত শত কবুতর, গাছের সবুজ পাতা।
আগুনের তাপে ঝলসে যাওয়া মুখ নিয়ে,
জিঘাংসার কুণ্ডলী এক লাফে পরিয়ে
ছুটে এসেছি এখানে।
হন্তারকের ঝাঁক যখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে
চতুর্দিকে, তখন কিছু লোক
তা তা থৈ থৈ নাচের চূড়ায় তুলে দিয়েছে
ওদের উল্লাসকে, নিরন্নের দল যখন হাহাকারের সমুদ্রে
হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন কিছু লোক স্বৈরাচারের অঙ্গের চাদর
আহলাদের সঙ্গে খানিক স্পর্শ করার জন্যে বেজায়
হুটোপুটি জুড়ে দিয়েছে। যখন শহীদদের মা-বোনেরা
উজাড় বুকের শূন্যতা নিয়ে বসে আছেন
মর্মর মূর্তির মতো, তখন কিছু লোক
খুনীদের বিলানো বকলেস গলায় এঁটে
একালের মহত্ত্বকে কামড়ে চকচকে চোখ তুলে দেখছে
কেউ ওদের উদ্দেশে জয়ডঙ্কা বাজাচ্ছে কিনা।
যখন অত্যাচারীর হিস হিস চাবুকের ছোবলে
নীল হয়ে যাচ্ছে আমার শহরের পিঠ,
যখন জালিমের সাঁড়াশি উপড়ে ফেলছে
আমার শহরের চোখ, যখন পালিশ করা বুটের লাথিতে
ভেঙে যাচ্ছে আমার শহরের পাঁজর,
তখনও কি আমাকে ভাবতে হবে বিশুদ্ধ কবিতার
আবৃত স্তনের কথা? এ শহরের বুক যখন ছিঁড়ে যাচ্ছে শ্বাপদদের
নখরের হিংস্রতায়, তখনও কি আমাকে বাঁশিতে তুলতে হবে,
বসন্তবাহার?
স্বদেশ, তুমি তোমার বীর সন্তানদের মরতে দেখেছো
ধুলো-ওড়া প্রান্তরে, নদীতীরে, রাজপথে।
স্বদেশ তুমি দেখেছো কী করে গরম রক্ত টপকে পড়ে
তোমার সন্তানদের বুক থেকে আঙুরের রসের মতো।
স্বদেশ তুমি গোলাপবনে রক্তবন্যা বয়ে যেতে দেখেছো।
স্বদেশ, মা আমার, মাগো,
আর কত শহীদ চাও তুমি আর কত রক্ত ঝরলে
তোমার উদরে জন্ম নেবে সবার ক্ষুধা মেটানো শস্যকণা?
মা আমার, মাগো,
এই পবিত্র স্থানে আমাদের সবার মাথার উপর
হাত রাখো তুমি, যেন ভয়ে আমরা পিছিয়ে না যাই
রণে ভঙ্গ দিয়ে, যেন আমাদের
কোনো মুহূর্তেই মনে না হয় নিঃসঙ্গ আমরা,
বৃথা পচবে না আমাদের শরীর
কবরের বিষণ্ন অন্ধকারে। স্বদেশ, মা আমার,
আজ এই আশ্বাস তুমি আমাদের দাও।
কী করে অন্য কোথাও
কী চমৎকার এই রাত। ভিড় এড়িয়ে, অনেকগুলো
কনফেকশনারি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, অষুধের দোকান আর
রেস্তোরাঁ পেরিয়ে একা একা পথ হাঁটতে
লাগছিল ভালো। আলোর চ্যাঁচামেচিতে উচ্চকিত রাস্তার
ধার ঘেঁষে আমার চলা। কখন যে
ছায়াচ্ছন্ন, পরিচ্ছন্ন চওড়া গলিতে ঢুকে পড়েছি, ঠাওর
হয়নি, কোনো কোনো বাড়ির ফুলের গন্ধে বাতাস ঈষৎ
মাতাল, আকাশ ধানমণ্ডির লেকে ঝুঁকে
দেখছে নিজের মুখ, আর্ত ইতিহাসের আবছা আদল। ঝিনুক
খুঁজতে এখানে আসে না কেউ। ঢিল ছুঁড়ে ছোট ছোট
ঢেউ দ্যাখে কখনো ঘুরে-বেড়ানো বালক। কী যেন
খুঁজতে খুঁজতে হাওয়ার ঠোকর-খাওয়া কিছু পালক
কুড়িয়ে নিই আলগোছে। কী দ্রুত বুড়িয়ে
যাচ্ছি, তবুও আজকাল বুকের ভেতর মদির
আগুন, পলাশ রাঙানো ফাল্গুন, আত্মাকে
চমকিয়ে-দেয়া স্বপ্নপোষ্য, গানে-পাওয়া কোকিল।
ঘামে ভেজা কার্তা হ্যাঙারে ঝুলিয়ে জড়িয়ে
ধরি বিশ্রামের আঙুরলতা। কোথাও একটি কথা নেই,
কপালে হাত বুলিয়ে দেয় না কেউ,
মাথার ওপর শ্বেতবসনা হুরির মতো সিলিং ফ্যান
নাচছে ঘুর্ণিনাচ! রক্তচাপ তেজী না-লেখা কবিতার কণাসমূহ
রাগী বেজীর দাঁতে বিদ্ধ হচ্ছে ক্রমাগত। সাপের ফণা
সেগুলো পুনরুদ্ধারের স্পৃহায় বিকশিত।
এই চমৎকার রাতে তোমাকে মনের চোখে দেখতে পাই
বলে আমাকে সারাক্ষণ
এক গুঞ্জরণ ঘিরে রাখে; তুমি ভালোবাসো আমাকে-
এই ভাবনা পালতোলা জলযান হয়ে
আমার হৃদয়ের নির্জনতম নদীর বুক চিরে চলমান।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে মোগল আমলের
বুলবুলের গজলছাওয়া গুলবাগ; সেখানে তোমার
আয়ত চোখের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দেয়া চাওয়া,
ত্রস্ত ভঙ্গিতে ছুটে যাওয়া ফোয়ারার কাছে। ঝাউগাছে
হাওয়ার ঝলক। করে যেন তুমি আর আমি
পূর্ণিমা চাঁদের নিচে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম হাতে হাত ধরে।
হঠাৎ দুজনের মাঝখানে
এসে দাঁড়ায় স্বপ্নভঙ্গের ঢ্যাঙা ছায়া।
কার ঘাড় ধাক্কা খেয়ে প্রবেশ করছি দুঃস্বপ্নে?
মাংস আর ত্বকহীন কতিপয় আঙুল
সাঁড়াশির মতো বসে যাচ্ছে গলায়, হঠাৎ এক ঝটকায়
সরিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস
নিতে চাই, কে যেন লোহার নখে ছিঁড়ে খুঁড়ে
বের করে আনছে দপ্ দপানো কলজে। বাতাসে
তোমার কণ্ঠস্বর একবার বেজে উঠে
দুমড়ে-মুচড়ে কোথায় হারিয়ে যায়। তার পেছনে
ছুটতে ছুটতে এমন পথে পৌঁছে যাই,
যার কোনো আরম্ভ নেই, শেষও নেই। কিছু প্রতিধ্বনি
কেবল মাথা কোটে শ্যাওলা ঢাকা প্রাচীনতায়।
বন্ধ দরজা থেকে বন্ধ দরজায় দৌড়ে গিয়ে ক্রমাগত
কড়া নাড়ি শব্দহীন। সাড়া দেবে কে?
কে খুলে দেবে কপাট
এই বেগানার জন্য, যার সারা শরীরে ঝুলছে জলপায়রা
আর দোয়েলের গলিত নাড়ি-ভুঁড়ি আর শত শত মৃত চোখ?
ওরা কয়েকজন আমার ঘরে হুড়মুড়িয়ে
ঢুকে শোনালো সুবচন-
‘এই দুনিয়া সরাইখানা,
আজ আছো তো কাল নেই। তোমার পাপের ঘড়া
কানায় কানায় উঠেছে ভরে। এবারে
কপাল পুড়বে তোমার’।
আমাকে ওরা শোনালো কবরের কথা,
থুতু ছিটোতে ছিটোতে বললো গোর-আজাবের কথা, মাটির
নিচের কিলবিল-করা
পোকা-মাকড়দের কথা। একটানা ঘ্যানর ঘ্যানর
বলে গেল মৃত্যুর কথা, মৃত্যুর কথা, মৃত্যুর কথা। এটা
ওদের বোধের বাইরে, যে তোমার স্পর্শ পেয়েছে,
পেয়েছে তোমার বুকজোড়া সপ্তবর্ণ ভালোবাসা
সে কেন মৃত্যুর পাঁচালি শুনতে চাইবে।
আমার পরিমাপহীন গুনাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে
ওরা বললো, ‘তোমার ঠাঁই হবে
হাবিয়া দোজখে’।
এক ঝাঁক মৌমাছি,
সোনালি মাতাল, ওদের গঞ্জনা গুঞ্জরণে ডুবিয়ে
শুনিয়ে গেল তোমার মধ্যরাত্রির মেঘময় কথা, ভোরবেলার
শিশিরস্নিগ্ধ কথা আমার কানে কানে। মনে পড়লো
তোমার ঠোঁট, যার মধু শতাব্দীর পর শতাব্দী
পান করলেও নিঃশেষিত হবে না। ভাবি,
যে দেখেছে সন্তের পুণ্যের মতো তোমার কালো গভীর চোখ
আর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ঝর্ণাধারার মতো
হাসি, অনিন্দ্য মুখের আদল, মৃত্যুর পরে
সে কী করে বেহেশত ছাড়া অন্য কোথাও যাবে?