Site icon BnBoi.Com

বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় – শামসুর রাহমান

বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় - শামসুর রাহমান

অবশেষে আসে ওরা

শেষ অব্দি ওরা আসবে কি আসবে না এ অঞ্চলে
দলে দলে, এ নিয়ে তুমুল তর্ক চলে পথে ঘাটে,
গ্রামেগঞ্জে এবং খেলার মাঠে, চা-খানায় আর
দপ্তরে দপ্তরে, আদালতে। কারা ওরা? কী রকম
আচরণ করবে প্রত্যাশা জনগণ অস্ত্রধারী
সেসব লোকের কাছে? ওরা কি বর্বর হুনদের
মতো নাকি নব্য সভ্যতার অগ্রদূত? পতাকার
সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেবে বন্দি মানবের মুক্তিদাতা?

জল্পনার অন্ত নেই। অনেকের মনে উল্লাসের
বান ডাকে, কেউ কেউ আশংকার কালো চোরা টানে
কেবলি তলিয়ে যায়। তবে সকলেই প্রতীক্ষায়
কাটায় প্রহর অকস্মাৎ কবে ওরা এসে পড়ে।
অনেকে প্রস্তুত থাকে ফুলের স্তবক, মালা নিয়ে
সগর্বে চুকিয়ে দিতে বীরদের প্রাপ্য হাতে হাতে।

অবশেষে আসে ওরা, যেন আকাশ আঁধার করে
নামে দিকে দিকে পঙ্গপাল ভরা ফসলের ক্ষেতে।
চকচকে অস্ত্রের আঘাতে যত্রতত্র মনীষার
কাটা মাথা ধুলায় গড়ায়, শুভবুদ্ধি তড়িঘড়ি
চলে যায় নির্বাসনে। বাকি থাকে যারা, তারা সব
পড়িমরি কোথাও লুকায়। বর্বরের ঘোড়াদের
শাণিত ক্ষুরের ধূলিঝড়ে মধ্যযুগী অন্ধকার
নেমে আসে সারা দেশে। ক্রুশবিদ্ধ বোধির বিলাপ,
এবং আড়ালে আবডালে অসহায় চেয়ে থাকে
কতিপয় লোক, যারা গড়ে নি কখনো প্রতিরোধ।

 অমাবস্যার চাঁদ

তুমি কি আমার উদ্দেশে নারী
পথ চেয়ে থাকো কোথাও দূরে?
আমি ঘুরে মরি নিদারুণ ঘোরে,
আর্তি বেরোয় হৃদয় ফুঁড়ে।

বাতাস রটায়, আমার জন্যে
ফুল তুলে রাখো সন্ধ্যেবেলা।
সে-ফুল শুকায় শূন্য প্রহরে,
এ-ও কি তোমার নিছক খেলা?

তোমার ফুলের সুগন্ধ জানি
কেউ কেউ পেয়ে ধন্য হয়।
শুধু অভাজন বঞ্চিত আজো,
অথচ ঘ্রাণের ঘটে নি ক্ষয়।

তোমার কাছেই পৌঁছুতে চাই
কায়ক্লেশে আমি নিত্যদিন।
এসে গেছি ভেবে প্রফুল্ল হই,
কিন্তুএ-পথ অন্তহীন।

বেলা ক্ষয়ে যায় দ্রুত ঘর্ষণে,
সময় কাটাই সংঘ বিনা,
সাধকের মতো নির্ঘুম ধ্যানে
তোমাকেই ভাবি প্রসার্পিণা।

রহস্যময় স্বভাব তোমার,
আমাকে ভোগায় অভাববোধ।
আঁধার চিবিয়ে খাচ্ছে সত্তা,
কখন জাগবে রূপসী রোদ?
রিক্ত শাখায় আওড়ায় শুক-
কিছুই তোমার হলো না শেখা,
যাকে খোঁজো তুমি সকালসন্ধ্যা,
প্রত্যহ তার পাবে না দেখা।

অসুস্থতায় বকছি প্রলাপ,
কারা চারপাশে পেতেছে ফাঁদ?
আমাকে জাগিয়ে রাখে সারা রাত
অমাবস্যার খেয়ালি চাঁদ।

আত্মা ছুঁড়ে দিই

কোনো মহামান্য আদালত নয়,
গোলাপ, বনদোয়েল, পূর্ণিমা-চাঁদ,
লালিত্যময় পদ্য, রূপসীর চোখের ঝিলিক, সুগন্ধী সাবান
আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কাঠগড়ায়।
সম্প্রতি তাদের কাছ থেকে
আমার আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিয়েছি,
এই অভিযোগে ওরা আমাকে
জেরা করছে বার বার, বলছে যেতে হবে ভাসানে।

কার কাছে জানাবো ফরিয়াদ?
কী করে খণ্ডন করবো ওদের বাছা বাছা যুক্তি?
স্বীকার করি, ছিঁচকাঁদুনে পদ্য দেখলেই আমার মাথায়
ইদানীং খুন চড়ে যায়, ইচ্ছে হয় এক থাপ্পড়ে
ফেলে দিই নর্দমায় এবং
যেসব পদ্যরাশি হিজড়ের মতো অঙ্গভঙ্গী করে,
দাঁত দিয়ে আঙুল চেপে ধরে পাছা দুলিয়ে
চোখ মারে, তাদের
রঙবেরঙের ছৈলছবিলা ঢঙ দেখলে
আমার ভীষণ বিবমিষা জাগে।
যেসব পদ্য সস্তা প্রসাধনে ঝকঝকে হয়ে
অশ্লীল ইশারায় জোটায়
দু’ঘণ্টার নাগর, তাদের মুখে
থুতু ছিটোতে পারলে স্বস্তি পাই।

যখন ওরা বলে নন্দনতত্ত্বের গলায় পা রেখে
চটকাচ্ছি তাকে, যেমন
সিগারেটখোর আধপোড়া সিগারেটটাকে
পিষে ফেলে জুতোর তলায়,
তখন আমি সাক্ষী মানি রজনীগন্ধা এবং কোকিলকে।

আমি কি কখনো বন্দনা করি নি রজনীগন্ধার?
রক্তচক্ষু কোকিল বলবে নির্দ্বিধায়,-
লোকটা আমারই মতো গলায় রক্ত তুলে গান গায়’
এবং মেঘের গর্জন
আমার সপক্ষে সাক্ষ্য দেবে এই বলে,
কী করবে সে গোলাপ, বনদোয়েল আর
পূর্ণিমা চাঁদ নিয়ে যখন ক্যালেন্ডারের প্রায়
প্রত্যেকটি তারিখ থেকে বয়
হাভাতের দীর্ঘশ্বাস, সাহসী মানুষের রক্তধারা,
ঝরে এতিমের অশ্রুকণা?

এই আপাদমস্তক বাণিজ্যিক উটকো সমাজে, গোঁজামিল দেয়া
বেঢপ সাংস্কৃতিক চন্ডীমণ্ডপে
আমাকে বোঝে না কেউ। যখন হাতে
তুলে নিই বলপেন, আমার কব্জিতে
স্পন্দমান চিতাবাঘের হৃদপিণ্ড। বিগতযৌবন
সামন্ততান্ত্রিক পরিপার্শ্বে বিদুষকের মতো অনবরত
ঘুর ঘুর করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় কখনো।
আমি আমার আত্মা ছুঁড়ে দিই ডুমুরের ডালে,
মজে-যাওয়া খালে, স্বপ্নের চাতালে, শৌচাগারের
অকথ্য বুলিভর্তি দেয়ালে আর
তোমাদের অভিযোগের নাকের তলায়।

আমরা দু’জন দু’দিকে

আমরা দু’জন দু’দিকে বন্দি,
মাঝখানে এক দেয়াল।
দেয়াল-ফাটলে জাগলো ঝর্ণা,
দৈবের কী-যে খেয়াল।

সেদিন রাত্রে না-দেখা তোমাকে
শুনি টেলিফোনে হঠাৎ;
অভিভূত আমি অঞ্জলি ভরে
তুলে নিই আবেহায়াত।

যখন বলেছি, ‘দেখা হবে কবে’,
হেসে উঠে দিলে জবাব-
‘হতাশ হবেন,’ বলি উত্তরে,
‘সে হবে আমার সওয়াব।

তুমি কাছে এসে দাঁড়ালে দুপুরে,
দু’ চোখে আমার চমক,
তুমিই আমার নিয়তি রূপসী,
হৃদয়ে গুণীর গমক।

পেঙ্গুইনের বই নেড়ে চেড়ে
ছড়ালে আয়ত দৃষ্টি,
তোমার মুখের আদলে ফুটলো
চিত্রকরের সৃষ্টি।

অনন্য এই দৃশ্যকাব্যে
অন্যেরা সাঁটে আঁচিল;
সুন্দরীতমা, এসো ভেঙে ফেলি
মধ্যিখানের পাঁচিল।

যদি হাত ধরে হেঁটে যাই পথে,
ঢি ঢি পড়ে যাবে পাড়ায়,
কে কোথায় ফের ছিট্‌কে পড়বো
নেকড়ে-দলের তাড়ায়!

আজ আমাদের চারপাশে শুধু
ফণিমনসার প্রলাপ,
চলো পাথরের ধু ধু চত্বরে
আমরা ফোটাই গোলাপ।

আমাকে দাও

ক’দিন থেকে দু’চোখ নির্ঘুম,
জাগিয়ে রাখো আমাকে রাতভর।
শয্যাময় দোজখী অঙ্গার;
ঘুমাবো, দাও একটি চুম্বন।

নজর রাখি যেদিকে, সেদিকেই
তোমাকে ছাড়া দেখি না কিছু আর।
ব্যাকুল স্বর হৃদয়ে বাজে শুধু,
আমাকে দাও একটি চুম্বন।

এখন তুমি আমার পাশে নেই,
অথচ শুনি বলছো মৃদু স্বরে,
‘আমার কাছে কী চাও বলো কবি?’
‘জবাবে বলি, একটি চুম্বন।

তোমার হাতে তপ্ত হাত রেখে
নিজেকে ভাবি রাজাধিরাজ এক।
প্রবল দাবি মুকুট হয়ে জ্বলে-
‘আমাকে দাও একটি চুম্বন।
হে মনোলীনা তোমার করতলে
আমার আয়ু রেখেছি গচ্ছিত,
সত্যি সেই পুঁজিপাটার সুদ
বাড়াবো, দাও একটি চুম্বন।

 উজানে

ওরা তোর অলৌকিক পাখা ছেঁটে দেয়ার উদ্দেশে
সর্বদা পাকাচ্ছে ঘোঁট, তবু কেন তুই
এমন নিঃসাড় একা একা
গৃহকোণে নিমগ্ন থাকিস ওরে চৌদিকে এন্তার
দপদপে অক্ষরের নাচ
দেখে, কারো আসার ব্যাকুল প্রতীক্ষায়?

সুযোগ পেলেই ওরা ভীমরুল হ’য়ে
ছেঁকে ধরে তোকে,
তবু কেন তুই মুখ বুঁজে সহ্য করে যাস সেই
কুটিল দংশন? কেন এক ঝটকায়
দিস না তাড়িয়ে
ওদের নিমেষে? তাড়া খেয়ে যাক ভেসে নর্দমায়।

ঘুমন্ত সিংহকে মৃত ভেবে
অগাধ আহ্লাদে
শেয়াল কুকুর যে রকম ঘুরঘুর করে তার
আশেপাশে, ওরাও তেমন বারংবার
তোকে ঘিরে ফিচেল চক্কর কাটে; ওরে কেন তুই
হঠাৎ গর্জন করে দিস না কাঁপিয়ে দশদিক?
তোকে স্থির লক্ষ্য করে চোরাগোপ্তা হামলা চালায়
ওরা,প্রায়শই ছোড়ে তীর,
হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দিতে চায় ছোরা, বিষাক্ত বল্লম,
তবু কেন অস্ত্র তোর ক্ষিপ্র ঝলসে ওঠে না ক্রোধে?
‘সত্য ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র নেই আমার এবং
আমি প্রতীক্ষায় আছি, বুঝলে হে, তার উত্থানের’
দিলো সে উত্তর হেসে। সত্য আজ গেছে বনবাসে,
বলি তাকে। ‘সত্যের জুলফিকার করবে মিথ্যার
শিরশ্ছেদ একদিন সুনিশ্চিত,’ বলে সে আবার
দ্বেষহীন, উদাসীন, একা
ঘাট ছেড়ে নৌকা দিলো ভাসিয়ে উজানে
নিরুদ্দেশে; এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি সঙ্গ নেয় লোকটার।

একজন শহীদের মা বলছেন

যাকে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছি, এখন
সে কোথায়? পুড়িয়ে আমার বুক এই
পোড়া দেশটিকে ভালোবেসে,
ভালোবেসে শাপলা শালুক, খালবিল, মাছরাঙা,
সোমত্ত নদীর বাঁক, দোয়েলের শিস,
দিগন্ত সবুজ-করা টিয়েদের ঝাঁক,
যৌবনের প্রফুল্ল সকালে
ঝরে গ্যাছে। এখন কোথায় ওর হাড়গোড় সার
হচ্ছে ক্ষেতে স্বপ্নময় শস্য হবে বলে
আমি তা’ জানি না।

সময় কাটতো ওর রাশি রাশি বই পড়ে, খুব
রাত করে ঘুমোতে সে, কখনো কখনো
কণ্ঠে ওর নক্ষত্রের মতো
ফুটতো কী সব কথা, যা ছিল আমার
বোধের ওপারে। বলতো সে
মাঝে-মাঝে, রাতে স্বপ্নে দেখি
ফুটেছে গোলাপ এক বুকের ভেতরে
মা, তোমার মমতার মতো। তোমার মুখেই দেখি
প্রতিদিন স্বদেশের মুখ এবং যখন তুমি
ঘর ঝাঁট দাও, ভাবি সরাচ্ছো জঞ্জাল এ দেশের
মৃত্যু তার, বলে ওরা, করেছে আমাকে মহীয়সী,
আরো কত কথা বলা হয়
যা’ শুনে আমার মাথা গর্বে দূরের আকাশ ছুঁতে
পারে লহমায়।

নিজস্ব দুঃখের চেয়ে গৌরব অনেক বড়, এই
অলংকৃত ভান নিয়ে দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া
কী দুঃসহ, আমি ছাড়া বুঝবে কে আর পৃথিবীতে?
আমার এ শূন্য বুক পোড়ো বাড়ি, যাতে
লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডেকে ওঠে ঘোর মধ্যরাতে, ক্লান্ত লাগে,
দেয় না ঘুমোতে কিছুতেই ফণিমনসার খোঁচা।
যে তম্বীকে ভাবতো সে স্বপ্নের একান্ত সহচরী,
তার দু’টি হাতে মেহেদির ছোপ লাগার আগেই
একটি শিকারি বাজ ওকে
করেছেন হনন,
কেননা সে চেয়েছিল গণতন্ত্র মুক্তি পাক লিখে
বুকে, স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘোষণা করে
হেঁটে যাবে রাজপথে, মাথা তার ছোঁবে
আকাশের মেঘলা খিলান। এখন সে জীবনের সাজ-পরা
কিংবদন্তী; কিন্তু আমি কী করবো এই
কিংবদন্তী নিয়ে? স্বপ্নে-দেখা কী নির্দয়
গোলাপ ফুটেছে দ্যাখো, দ্যাখো দেশবাসী
তরতাজা যৌবনের বুকে!

হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই
তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর
করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ
ওর নাম, হোমরা চোমরা তারা, যারা
তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ
জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে
জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,
ওদের মুখোশ-আঁটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুঁড়ে থুতু শুধু থুতু।

একটি এলিজি, কাদেরের জন্য

বড় ধুধু মধ্যবয়সের প্রান্তরেখা,
সহজে মেলে না পান্থপাদপের দেখা
কোথাও; উজাড় হৃদয়ের গুলবাগে দিশেহারা বুলবুল
হয়তো গায় ভুল
গান, তার দোষ ধরা সাজে না, বরং
ধরে রাখা ভালো জীবনের হাত গলে যখন যেটুকু রঙ
লেগে থাকে প্রাণে আর এখানে যেভাবে হোক থাকা,
কাউকে কাউকে কাছে ডাকা
হৃদয়ের স্বরে,
কী যে ভালো লাগে বসবাস স্মৃতির আপন ঘরে।

অকস্মাৎ গৃহিনীর,সন্তানের হাসি মুছে ফেলে
এত দ্রুত কেন চলে গেলে?
ঊর্ধাশ্বাসে এরকমভাবে
গেলে, যেন ইস্টিশান থেকে ট্রেন ছেড়ে যাবে
এক্ষুণি এবং গার্ড বাঁশি
বাজিয়ে দিয়েছে; বুঝি তার ‘আচ্ছা আসি’
বলে তুমি বিদায় নেয়ার কোনো পাওনি সুযোগ। মনে পড়ে,
পুরানো ঢাকার পথে কিংবা দেওয়ান বাজারে হাসানের ঘরে
আমাদের যৌবনের ঊষা
কেটেছে; যদিও অতি সাধারণ ছিল বেশভূষা
কতিপয় তরুণের, তবু রত্নদ্বীপ নিয়ে মনে
উদ্ভাসিত মেধা ও মননে
নির্ভীক হেঁটেছে ওরা। প্রগতির সাধক হাসান
মধ্যপথে মরালের গান
গেয়ে সঙ্গীদের এ কেমন ভাসান দেখালো আর
তুমিও ভীষণ অন্ধকার
পথে হলে তার অনুগামী, কী এমন হতো ক্ষতি, যদি
আরো কিছুকাল মৃদু কলরবে বইতো তোমার প্রাণের নদী?

 একেই কি বলবো?

রাত্তির এগারোটায় টেলিফোন বাজে ভুলে করে,
আমাকে ঘুমের গুহা থেকে টেনে আনে তড়িঘড়ি
লেখার টেবিলে, রিসিভার তুলে কাঁপা স্বরে ‘হ্যালো’
বলতেই অন্য প্রান্ত থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে আসে-
‘ঘুম ভাঙালাম না কি? কী আশ্চর্য, এরই মধ্যে ঘুম
আপনাকে করেছে দখল! মাফ করবেন; যদি
এত তাড়াতাড়ি বিছানায় ঘুমে ঢলে পড়েন তাহলে কবি
আপনি লেখেন কবে? মধ্যরাতে যে-মায়াবী গাছ
ডালপালাসহ জাগে মাটি ফুঁড়ে, তার পল্লাবের
আড়ালে কবিতা মিশে থাকে, জানা নেই আপনার?

স্তম্ভিত, বিব্রত আমি খানিক নিশ্চুপ থেকে বলি,
‘কে আপনি? এত রাতে অকস্মাৎ কী এমন কথা
বলুন আমার সঙ্গে বলবার প্রয়োজন বোধ
করলেন?’ ‘কেন, আপনার ভেতরে হঠাৎ কোনো
কবিতা লেখার ইচ্ছা লাফিয়ে ওঠে না ধলেশ্বরী
নদীর মাছের মতো?’ কণ্ঠস্বর তার আমাকে আদর করে,
যেন জ্যোৎস্না চুমো খায় গাছের শরীরে। কিছুক্ষণ
নীরবতা জমে থাকে অন্ধকার ঘরে, নিজেকেই
কেমন অচেনা লাগে। আমি কি সত্তায় আদিমতা
নিয়ে একা দাঁড়িয়ে রয়েছি, দ্বিধা দ্বন্দ্বে কম্পমান?

হৃদয় ধোঁয়াচ্ছে খুব, আবার ওপার থেকে তার
কণ্ঠস্বর জেগে ওঠে, ‘আপনার সঙ্গে ঝগড়া আছে,
অনেক কিছুই আমি স্বীকার করি না। আর সব
কৌতূহল থেকে যবনিকা সরে যাবে, এরকম
আশা না করাই ভালো। আরো কিছু খুঁটিনাটি কথা
আমাকে জিগ্যেস করে শুভরাত্রি বলে যোগাযোগ
দিলেন বিচ্ছিন্ন করে। আমি কি স্বপ্নের ঘোরে আছি?
না কি এই মধ্যরাতে বাগ্ধেবী আমাকে জাগালেন?
স্তব্ধতায়, মনে হলো, কেউ কিছু ফুল কবরের
শিয়রে গচ্ছিত রেখে চুপিসারে বিদায় নিয়েছে।
সে রাতে এল না ঘুম আর কিছুতেই। সারাক্ষণ
ছটফট করতে করতে দেখি ভোর ঘরটির
চেনা সাজ ক্রমশ ফিরিয়ে দিচ্ছে। সারাদিন নানা
খুচরো কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখে গত রাত্তিরের
কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করি, অথচ কিছুতে আমি
তার সেই কণ্ঠস্বর ভুলতে পারি না। দিন যায়,
রাত আসে, প্রতীক্ষায় জেগে থাকি, যদি তার ফের
ইচ্ছে হয় টেলিফোনে কথা বলবার? যদি সাড়া
না পেয়ে কখনো রেগে আমার উদ্দেশে ডিজিটের
খেলা বন্ধ করে দেয়? একেই কি বলবো অনুরাগ?

 ওদের ঘুমোতে দাও

ওরা ঘুমিয়ে আছে, ওদের ঘুমোতে দাও।
ওদের কবরে এখন গজিয়ে উঠেছে ঘাস,
যেমন যুবকের বুকে ঘন রোমরাজি।
ওরা ঘুমিয়ে আছে আমরা জেগে থাকবো বলে।

এখন ওদের কোনো ঝুটঝামেলা নেই,
নেই ঋণ কিংবা ব্যাঙ্ক ত্র্যাকাউন্টের ভাবনা,
প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া মেটানোর
দুশ্চিন্তা-কুশ ওদের রাতের ঘুমে চিড় ধরায় না আর;
ওরা বড় শান্তিতে নিদ্রিত এখন,
ওদের শান্তি ভঙ্গ কোরো না।
ওরা ঘুমিয়ে আছে, নিথর পাথর;
সেই পবিত্র পাথরে আঁচড় কেটো না।
ওরা রাইফেলের গর্জে-ওঠা মুখে পেতে দিয়েছিল বুক,
যাতে আজ আমাদের হৃৎপিণ্ড নির্বিঘ্নে স্পন্দিত হতে পারে।

ওরা ঘুমিয়ে আছে, ওদের ঘুমোতে দাও।
একদিন ওরা আমাদেরই মতো হেঁটে যেতো দীর্ঘ পথ দিয়ে,
আড্ডা দিতো কাফেটেরিয়ায়, চা-খানায়,
পেঙ্গুইন সিরিজের বই পড়তো, দেখতো নাটক,
নারী ও নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা ছিল প্রবল,
বলতো দেশের ললাট থেকে দুর্দশার মেঘ মুছে ফেলবার কথা,
ওরা কাল ওদের কণ্ঠ স্তব্ধ হতে দিয়েছে,
আজ আমাদের কণ্ঠে আগামীর গান ঝংকৃত হবে বলে

ডাল ভাতের ক্ষুধার চেয়েও তীক্ষ্ম এক ক্ষুধায় জ্বলে
পানির তৃষ্ণার চেয়েও গভীর তৃষ্ণায় কাতর
ওরা ছুটে বেরিয়েছিল পথে,
ওদের সাধ আর স্বপ্ন বুলেটে ঝাঁঝারা হয়ে গিয়েছিল
আমাদের নানা রঙের
স্বপ্নের পাখায় আকাশ ছেয়ে যাবে বলে।

কারো মা তার সন্তানের মুখে পুরে দিয়েছিল
নারকেলের নাড়ু,
কারো জামার বোতামের ঘরে
টাটকা গোলাপ সাজিয়ে দিয়েছিল বোন,
বিদায়ের কালে কাউকে চুম্বন উপহার দিয়েছিল প্রিয়তমা।
প্রত্যাবর্তনের কথা বলে
ওরা কেউ ফিরে আসে নি,
আমরা আজ তাদের রক্তরঞ্জিত পথ ধরে এগিয়ে যাবো বলে।

যাবতীয় গোলাপ, রজনীগন্ধা, বকুল, চন্দ্রমল্লিকা,
কোকিল, দোয়েল, চন্দনা,
পায়রা, ময়ূর, শস্যরাশি এবং আবাল-বৃদ্ধবনিতাকে
গিলে খাচ্ছিল সোৎসাহে
কিম্ভুতকিমাকার এক জন্তু; ওরা সেই জানোয়ারকে
বাধা দিতে গিয়ে ঢলে পড়লো সূর্যাস্তের
জাফরানি গালিচা-বিছানো পথে,
আমাদের জীবনে সূর্যোদয় জয়োল্লাস ব্যাপক ছড়িয়ে দেবে বলে।

ওরা ঘুমিয়ে আছে, ওদের ঘুমোতে দাও।
পথশ্রান্ত ওরা, নিদ্রার গহ্বরে ওদের বিশ্রামের দরকার;
ওরা চেয়েছিল যেন ভয়ংকর দানবেরা মুখ খুলতে না পারে কখনো,
ওরা চেয়েছিল প্রাণীভূক উদ্ভিদ না জন্মায় এখানে,
ওরা পুতেছিল এমন একটি গাছ
যা কখনো বিকৃত হবে না রোমশ হাতের ঝটকায়,
আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে
ওরা ওদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিল অসীম সাহসিকতায়।
ওরা ঘুমিয়ে আছে, ওদের ঘুমোতে দাও;
আমাদের চোখের পাতা কোনো কুহকে বুজে এলে চলবে না আজ।

 কবন্ধের এলোমেলো পোঁচে

কবন্ধের এলোমেলো পোঁচে
শুভচিহ্ন মুছে যাচ্ছে একে একে, অমাবস্যা আরো
গাঢ় হয়ে নামে চরাচরে।
কুঠার শানায় ওরা, ঘন ঘন ফুল্‌কি ওড়ে, ফলে
অন্ধকার অধিক আঁধার
বলে মনে হয়, মধ্যযুগ কাফনের মতো আপাদমস্তক
মুড়ে ফেলে দশাদিক। তবুও মানুষ
হাঁটুতে ঠেকিয়ে মুখ বসে থাকে, যেন সে পাথর।

এখন মানুষ নয়, বেবুন এবং অশ্বতর
যাবতীয় মঞ্চে ঘোর শোরগোলা তুলে কুড়ায় বাহবা আর
মুঢ়তার উলঙ্গ নর্তনে
তর্জনে গর্জনে জ্ঞান বিমূঢ়, বিহ্বল, অসহায়।
উল্লুকের বিশদ বিধানে
বিদ্বানেরা চোখ-বাঁধা বলদের মতো ঘানি টানে!

কবিস্মৃতি

নক্ষত্রের তৈরি পাল্‌কি দাঁড়ানো গলিতে, জীর্ণ বেশে
ক্ষুৎকাতর চেহারার বৃদ্ধ এক বসলেন এসে
রাজসিক ভঙ্গিমায়। ‘কে আপনি? মীর তকী মীর?’
সওয়ারী অভিজ্ঞ চোখ তুলে বলেন অত্যন্ত ধীর
কণ্ঠে, ‘আমি সেই সমুদ্রের তীর, যাতে ঢেউগুলি
ভীষণ আছড়ে পড়ে; এই হাতে মুঠো মুঠো ধূলি
নিমেষে হয়েছে স্বর্ণরেণু, আমি সেই ধ্বনি যার
সুরে সুরে একদা হয়েছে গুঞ্জরিত প্রাসাদ, পাহাড়।
আমি সেই লোক যাকে গুজেস্তা জামানা চেষ্টাশীল
উপেক্ষায় অপমানে করেছে শিকার রুক্ষ ঢিল
ছুড়ে ছুড়ে। ক্ষোভে আর অভিমানে দিল্লীর সিঁড়িতে
ছিলাম অপেক্ষমাণ কী উৎসুক গ্রীষ্ম কিংবা শীতে
খালিশ ভাষার টানে। দেখেছি আমার প্রিয়তম
শহরে বিধ্বস্ত বস্তি শত শত, ধ্বংসস্তূপ। যম
খেলেছে মড়ার খুলি নিয়ে কত বেরহম খেলা;
মানুষ তো নয়, যেন সব মাটির বিবর্ণ ঢেলা।
কখনো করিনি নত মাথা শত বিপর্যয়ে আর
ঘুরেছি ফকির হ’য়ে পথে পথে শুধু অহঙ্কার
ছিল এক অলঙ্কার।উজাড় হৃদয়, ছলছল
চোখ নিয়ে বিষাদে করেছি সৃষ্টি আজর গজল।
অথচ এ-ও তো ঠিক আমার প্রদীপ নেভানোর
জন্যে অনেকেই করেছিল অতিশয় তোড়জোড়।

 কিচ্ছু বুঝি না, কিচ্ছু বলি না

(সমর সেনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে)


আমাদের খুদে পড়ুয়া খুকুমণিদেরও
মুখস্থ সেই
মুকুটপর! ঘাসের ভেতরকার সাপের নাম ধাম।
সুঠাম শরীর, মুখে চিঁড়ে-ভেজানো মধুর বুলি
এবং প্রায়শই তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন চমৎকার ভঙ্গিতে
তাঁর লেজের ওপর।
দুধদাঁত যাদের পড়েনি তারাও জানে
সর্পমহাশয় কত সহৃদয়; নানা আঙ্গিকে
কী করে ভালোবাসতে হয়
খরগোশ, ব্যাঙ আর তাবৎ সম্মোহিত মানুষকে,
তিনি তা রপ্ত করেছেন অবলীলায়
আর বেজির সঙ্গে লড়াই করতেও বেজায় দড়।


ফুটপাতে, ওভারব্রিজে
ছিঁচকে চোর, পকেটমার, বাটপাড়, চুল-ফাঁপানো
লম্পট, পানরঞ্জিত দাঁতের
বেশ্যার দালাল, ব্যর্থ প্রেমিক, বেকার যুবকের দল,
সদ্য ছাঁটাই-হওয়া কর্মচারী,
নতুন টেকনিক-সন্ধানী গোবেচারী কবি আর পুরানো
টাঙ্গাইল শাড়িপরা যৌবন যায় যায় অনূঢ়া,
তাড়ি-টানা খামোকা উৎফুল্ল প্রৌঢ়, কিস্তি টুপি-পরা,
চাপ দাড়িঅলা মুসল্লি, খাপখোলা তলোয়ারের মতো
কাঁধে ঝোলা বামঘেঁষা, নিষ্ঠাবান
রাজনৈতিক কর্মীর আনাগোনা।
মাঝে-মাঝে ওরা মুকুটপরা সাপের কথা বলাবলি করে।


বেপাড়া-ফেরত বেহেড মাতাল রাত্রির শেষ বাসে
চেপে নেমে পড়ে বিরান সড়কে, আসে
মেঘের মধ্য দিয়ে হেঁটে নিজের বাসায়
বেধড়ক বউকে পেটায়, বমি করে মেঝে, বিছানা ভাসায়।
ঘুমভাঙা শিশুর কান্নায়
ঘুমন্ত মহল্লা ঈষৎ চমকে উঠে পাশ ফিরে শোয়।

বিপর্যস্ত পাড়ার জীর্ণ ঘরবাড়ি, পোস্টার ছাওয়া
পড়ো পড়ো দেয়াল,
খাটাল শৌচাগার আর ঝাঁপবন্ধ দোকানে
ভোর কলপ বুলায়; চালচুলোহীন ঘোর
অস্তিবাদী, বিনিদ্র কবি টানা গদ্যে যুগসংকটে
করেন বিলাপ, পায়রা খুশি ছড়ায় আসমানে।

আমাদের দেশে আছেন একজন,
যিনি নিকারগুয়ার সমোসার মতো কীর্তিমান।
আকাশছোঁয়া তাঁর জ্ঞানগম্যি, ফলত তিনি
জনপথের মহাকল্লোলকে
স্রেফ পোকা মাকড়ের গুঞ্জরন জ্ঞান করেন।
স্বপ্নে অথবা
জাগরণে কোনো বিভীষিকা তাঁকে তাড়িয়ে
বেড়ায় কিনা, এ প্রশ্নের
সদুত্তর কারো জানা নেই। বরং উড়ো খবর পাই
তাঁর খাব্‌-এর রঙ বেহদ সাইকেডেলিক।


আমাদের সেই মেহেবান
ঝড়তুফান এবং বান অগ্রাহ্য করে ছুটে যান
দুর্গতদের অত্যন্ত কাছে,
দরাজ হাতে এদিক ওদিক হৈ হৈ বিলিয়ে বেড়ান
ত্রাণসামগ্রী রাঙা ধানের খৈ।
ওহো খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি;
এলোকেশী কপালকুণ্ডলা এগিয়ে আসে ছিন্ন বেশে
ভিক্ষাপাত্র হাতে। রহমদিল
তাঁর হাঁটুঢাকা গামবুটে চুমু খায় দেশডোবানো পানি।
জানি, টেলিভিশন সাক্ষী, আমরা জানি।


চাল ডাল তেল নুন লাকড়ি আর কাফনের কাপড়ের
দাম যদি আকাশমুখো
লাফাতে থাকে, আল্লার গজব পড়ে,
তিনি কী করতে পারেন? মাশাল্লা, তাঁর ধৈর্য অপরিসীম।
কোনো বেতমিজ যদি হঠাৎ
চেঁচিয়ে ওঠে, কী আনন্দ পাও তুমি শাসনদণ্ড ধারনে, তবে
তিনি নতুন চাল দিয়ে দাবার ছকে
নিজস্ব তখত্‌টি সামলে নেন।
আমরা কিছু বুঝি না, কিচ্ছু বলি না,
শুধু বোবা হয়ে থাকি।


পুতুল খেলার ভারি শখ তাঁর,
পেছন থেকে সুতো নেড়ে, সুতো ছেড়ে
তিনি হরহামেশা নিজের মেজাজটাকে শরীফ রাখেন
পুতুলগণ তাঁর চারপাশ
মুড়ে দিয়েছেন শুভেচ্ছা, অনলস খেদমত আর অন্তবিহীন
তোষামোদে। তাঁর শাসনামল, একজন
পুতুলের জবানিতে, একটি নিখাদ স্বর্ণযুগ।
আরেকজন পুতুল, যিনি মিথ্যার তুবড়ি ফোটানোর
খেলায় গোয়েবলসকেও
তুড়ি মেরে সাকরেদ বানাতে পারেন, এমত সুবচন
ছাড়েন যে, পুতুল খেলার প্রযোজকের
মুখের মতো পবিত্র মুখ ইহজগতে নেই।
আমরা কিচ্ছু বুঝি না, কিচ্ছু বলি না
শুধু বোবা হয়ে থাকি।
এইসব পুতুল পরিবৃত খেলোয়াড়
যে আসনে সমাসীন, তাতে কোনো মুৎসুদ্দি, ভাঁড়, নেকড়ে,
তালুক, উল্লুক, বেবুন, ঘোড়া অথবা
খচ্চর উড়ে এসে জুড়ে বসলেও আমরা টু শব্দটি করবো না।
তাঁর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে,
চিচিঙা, মিষ্টি কুমড়ো আর বেগুনের মতো
মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীগণ বাকায়দা নতুন করে শপথবাক্য উচ্চারণ করবেন,
তাঁর অমোষ নির্দেশে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিগ্ধিদিক মুড়িমুড়কির মতো
ছিটিয়ে দেরে রাষ্ট্রদূত!
আমরা কিচ্ছু বুঝবো না, কিচ্ছু বলবো না,
শুধু বোবা হয়ে থাকবো।

 কী এমন ক্ষতি হতো?

“This but thy name that is my enemy…”
-Shakespeare

কখনো কখনো অবসরে হয়ে উঠি প্রশ্নাকুল-
যদি কোনোদিন কবিতায় তোমার প্রকৃত নাম
ব্যবহার করি, তবে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে
যাবে? নাকি ভূমিকম্পে ধসে যাবে শহরের সব
ঘরবাড়ি, ভীষণ জখম হবে বেশুমার লোক?
অ্যাম্বুলেন্সে ছেয়ে যাবে পথ ঘাট? শোকার্ত কান্নায়
উঠবে কি ভরে অলিগলি? এ প্রশ্ন যখন তুলে
ধরি কথাচ্ছলে হেসে তোমার নিকট, তুমি কী নিশ্চুপ।

তুমিই আমার প্রিয়তমা, এবং তোমার নামও
খুব প্রিয়, অথচ করি না উচ্চারণ কারো কাছে,
পাছে কেউ কেউ সাত কাহন কাহিনী ফেঁদে বসে
তোমাকে আমাকে ঘিরে। তুমি নও, তোমার যে-নাম
সে-ই শক্র আমার; বলো তো কী এমন ক্ষতি হতো,
যদি অন্য কোনো নামে পেতাম তোমার পরিচয়?

কী জানতে চাও?

কী জানতে চাও তোমরা এখন? কোন্‌ কথা
কবুল করিয়ে নিতে চাও?
সব কোলাহল থেকে দূরে সরে অচিন ডেরায়
সময় কাটাবো কিনা কিংবা
নিসর্গের কথা ভেবে, দোয়েলের শিসের ভেতরে
নিশ্চুপ প্রবেশ করে জীবন যাপনে
মগ্ন হবো কিনা
এসব জানার কৌতূহলে
আমাকে খুঁচিয়ে তুলে দিব্যি মজা পেতে
চাও, যে রকম
চিড়িয়াখানায় লোকগুলো
পশুকে উত্যক্ত করে। পলাতক অপবাদ নিয়ে
চুপচাপ আছি।

আপাতত ফিরে যাচ্ছি, যাচ্ছি একান্ত গোপনে একা
স্বেচ্ছায় অজ্ঞাতবাসে, তবে
আবার আসবো ফিরে তোমাদের মাঝে
সত্তায় লতা গুল্মের, শ্যাওলার ঘ্রাণ
নিয়ে, হাতে থাকবে একটি পাণ্ডুলিপি,
যার ভাঁজে ভাঁজে
নক্ষত্রের সম্পন্ন ঝিলিক আর গহন নদীর
জোয়ারের গান,
প্রৌঢ় বয়সের ভালোবাসা,
নিটোল, গভীর
এবং অনেক কিছু যা আমি এখন
বলবো না।

 কেশো রোগীর ভাবনা

তাহলে আমি কি শেষ তক কেশো রোগী
হয়ে গেছি, অচিকিৎস, হতাশার কোটরে আবদ্ধ রাত্রিদিন?
দমকে দমকে কফ পিকদানে জমা হয়। কখনো কখনো
ভাবি, এই বুঝি
আমার ভেতরকার সবকিছু আসবে বেরিয়ে,
বাসার সবাই
ভীষণ ভড়কে যাবে, আমি নিজে তাকাবো এমন,
যেমন বিধ্বস্ত ট্রেঞ্জে আহত সৈনিক
দ্যাখে তার নাড়িভুঁড়ি গ্রেনেডের ঝাঁঝালো ধমকে
নির্গত ধোঁয়াটে এলাকায়।

কে এসে বসেছে পাশে? প্রাচীন কালের মিশরের
বন্দনীয় দেবতার মতো দীর্ঘ তার
ধড় মানুষের বটে, মাথাটা জন্তুর। কী-যে বলে
হড় হড় করে সারাক্ষণ,
বুঝি না কিছুই; একজন অতিশয় কৃশকায়,
তোবাড়ানো গাল, হাসে দন্তহীন হাসি, তরুণীকে টানে বুকে,
করে খুনসুটি;
বাজে-পোড়া ডালে ঝোলে বিপন্ন কবির বেশভূষা।

দিনরাত কেশে কেশে ক্লান্ত হয়ে গেছি
অনেক আগেই; মাঝে-মধ্যে মনে হয়,
আমার নাছোড় কাশি প্রায় মৃত এই
শহরকে প্রবল ঝাঁকিয়ে ফের জাগিয়ে তুলতে পারে নাকি?

ছড়ার আদলে

সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ গেলাম শঙ্খ ঘোষের বাসায়;
সমাজ আলতো পেখম মেলে সম্ভাষণের ভাষায়।
কবিকণ্ঠে গহনতা, চোখে পাতাল-ছায়া,
সত্তা জুড়ে উপার্জিত নান্দনিকের মায়া।

ড্রইংরুমের দেয়াল-জোড়া নানা শ্রেণীর বই;
মুগ্ধতাকে বশে রাখি, হারায় কথার খই।
হঠাৎ আবার কথা জোটে প্রাণ খুলে ফের হাসার,
বিশ্লেষণে তফাৎ ফোটে সোনা এবং কাঁসার।

স্নিগ্ধতাকে নাচিয়ে ঠোঁটে অল্প কিংবা বেশি
মনের ভেতর দুঃখ মুড়ে আমার প্রতিবেশী
অনিন্দ্য এক টিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাটে করেন বাস।
তাঁর আকাশে ওড়ে কত ছন্দে-গড়া হাঁস।
মানবেতর জীবন কেন মানুষ করে যাপন?
সর্বশ্রেণীর সকল মানুষ হয় না কেন আপন-
এই ভাবনা ঘোরায় তাঁকে ভিন্ন পথের বাঁকে,
যখন তখন পদ্ম ফোটান বুক ডোবানো পাঁকে।

মেধা-মনন জুড়ে কবির রবিঠাকুর আছেন,
উপরন্তু বস্তুবোধের শিল্পসহ বাঁচেন।
প্রগতিকে মান্য করে ঋন্ধ পথিক যিনি,
তাঁর প্রকৃতির বিশিষ্টতা হয়তো কিছু চিনি।

প্রশ্ন করি, যোগাযোগের সেতু ভেঙে গেলে,
একটি হাতের স্পর্শ তখন অন্য হাতে মেলে?
বিচ্ছিন্নতা এখন শুধু মনকে দখল করে,
আমির মধ্যে আমি বসে বিবাগী সুর ধরে।

বাগমারিতে জোনাক দেখি, একি আমার দোষ?
সঙ্গে ছিলেন রূপদর্শী, পদবী যাঁর ঘোষ।
শঙ্খ যখন বিদায় দিলেন একটি নমস্কারে,
সালাম বলে ট্যাক্সি ধরি ছিঁচ্‌কে অন্ধকারে!

টেন্ডার

সত্যি বলতে কী, ব্যাপারটা ঘটেছিল নিকারাগুয়ায়
প্রেসিডেন্ট সমোসার শাসনামনে।
পরাক্রমশালী সামরিক হর্তাকর্তাগণ টেন্ডার
ডাকলেন টুপি, উর্দি আর বুটজুতোর জন্যে।
যে ঠিকাদার দেখালো সবচেয়ে কম দর,
তাকেই দেয়া হলো অর্ডার।
যে কোনো হাঁদারামও জানে
এটাই দস্তুর।

টুপি, উর্দি আর বুটজুতোর স্তূপ সরবরাহ
করার পর দেখা গেল-
সবগুলো ইয়া বড় আর ঢিলেঢালা যে, একটি
টুপির ভেতর সাতটি মাথা ঢুকে যেতে পারে,
মুখসুদ্ধ ঢেকে যায়, নেমে যায় কাঁধে।
একটা উর্দির ভেতর তিনজন তাগড়া
জওয়াকে সেঁধিয়ে দেয়ার পরেও ঢের
জায়গা থেকে যায়।
বুটজুতোগুলো এত বড় যে সেগুলো পরে
কুচকাওয়াজ করা তো দূরস্থান, হাঁটাই মুশকিল।

ঠিকাদার বেচারীর কোনো দোষ নেই।
তার নজরদারি তো হামেশা লাভের দিকেই, যত কম
কাপড় আর চামড়া
খরচ করা যায় ততই তার লাভ।
কিন্তু সামরিক হর্তাকর্তাগণ ব্যাপার স্যাপার দেখে
বেজায় খাপ্পা, তেতে-ওঠা স্টেনগান।

আবার ডাকা হলো টেন্ডার।
অর্ডার নিয়ে গেল নতুন এক ঠিকাদার।
কী আশ্চর্য, এবারও সেই একই
ঘটনার পুনরাবৃত্তি। টুপি, উর্দি আর বুটজুতো।
ভয়ানক বড়,
অথচ ঠিকাদারের প্রাণপণ চেষ্টা হলো
ঠিকঠাক মাপজোক মাফিক জিনিশ সরবরাহ করা,
যাতে পান থেকে চুনটি না খসে। কামানের মতো গর্জে-ওঠা
সামরিক প্রভুগণ ঠিকাদারটিকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে
বিদায় করলেন ছাউনি থেকে।

আবার নতুন টেন্ডার,
আবার নতুন ঠিকাদার,
আর তাজ্জব ব্যাপার,
আবার সেই একই ঘটনার
পুনরাবৃত্তি! জাঁদরেল জেনারেলদের আক্কেল গুডুম বার বার!

 তবুও লোকটা

এখনই যেও না তুমি, আমার শয্যার চারপাশে
যে পাখিরা বানিয়েছে নীড়
স্বপ্নচারী খড়কুটো দিয়ে,
আঁধার তাদের গিলে খাবে, থাকবে পড়ে
রক্তিম পালক কিছু, বলে তার অর্ধাঙ্গিনী
বিষণ্ন তাকালো।

তুমি চলে গেলে আমার এ খেলাঘরে কোনোদিন
রঙধনু জাগবে না, আমার পুতুলগুলি মুখ
ভার করে আড়ি
দেবে সাত তাড়াতাড়ি, এখনই যেও না,
বলে তার পাঁচ বছরের মেয়ে চাদরের খুঁট
ধরে রাখে মুঠোর ভেতর।

এ কেমন সময়ে আমাকে যাচ্ছো ফেলে,
তুমি না থাকলে ছায়ার অভাবে
পুড়ে পুড়ে আমি
গাছ হয়ে যাবো, যাকে খোঁচালে কেবলি
কয়লার গুড়ো ঝরে যাবে, বলে তার
তরুণ শিক্ষার্থী পুত্র পিতার ললাটে
সূর্যোদয় দেখে নিতে চায়
বই ফেলে রেখে।

তবুও লোকটা নিরুত্তর, খুব তাড়াহুড়ো করে
আয়োজনহীন হেঁটে যায় কুয়াশায়।

তবুও হলো না

কী বিপুল আয়োজন আজ
চতুর্দিকে, মানুষে মানুষে থই থই পথ, গাছের ভেতর থেকে
গান আসে ভেসে; নীলিমার আমন্ত্রণ
জাগায় আমার কাঁধে
শিহরণ, বহু শতাব্দীর চঞ্চলতা
পাখির মুখোশ নিয়ে ক্রীড়াপরায়ণ।
কাঁধ ফুঁড়ে এক জোড়া ডানা, অভ্রময়,
প্রকাশিত, চকিতে উদ্ভট। আশপাশ
মনুষ্য-বর্জিত, তবু কী-যে কোলাহল। সদ্যজাত
ডানা মাটি ছোঁয়,
চোখ ঘোরে মেঘমেঘালিতে,
যেখানে নানান স্তরে ফুটে আছে অনিন্দ্য কুসুম, ঘুম আনে,
নান্দনিক শেকড়ে পরাগ
ছড়ায় নিয়ত, ছুঁতে চাই। মাটি ছেড়ে
সেদিকে যাবার সাধ মঞ্জরিত পালকে; প্রয়াস,
কোনো দূর প্রজাতির সঞ্চয়ের উপহার, বৈফল্যে বিমূঢ়।
আমার সত্তার চেয়ে ঢের বেশি ভারী
একজীড়া ডানা শৈশবের মতো খুব
উড্ডয়নপ্রিয়,
আমার স্বপ্নের ভেতরেও নীলিমাকে স্পর্শ করে,
দেখে নেয় বিস্ময়ের ঘোরে বেহেস্তের উদ্ভাসন,
তবুও হলো না ওড়া, হলো না এখনো

তার কথা

অবশেষে তার প্রিয় মধ্যরাতে হলো অবসান।
ভুগেছে সে বহুকাল রক্তচাপ, হাঁপানি ও বাতে;
প্রায়শ হতো না ঘুম এক ফোঁটা বড় দীর্ঘ রাতে,
অথচ দুঃসহ শ্বাসকষ্টে অন্তর্গত চোরা টান
তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে তারাজ্বলা হু হু গান
মাঝে-মধ্যে। কখনো জেগেছে তীব্র সাধ কারো হাতে
হাত রাখাবার; কখনো বা কিছু লুকানো আঘাতে
সকাতর নিষেধ সত্ত্বেও করেছে সে মদ্যপান।

যখন সে গেল, কত লোক কত কিছু বলাবলি
করলো গয়লার মতো দুধে পানি মিশিয়ে প্রচুর-
কখন কাকে সে কটু কথা বলেছিল, পার্টি, গলি
ছিল তার মৃগয়ার ভূমি, গিলে পিপে পিপে মদ
ভাসিয়েছে সংসার বানের জলে, লোকটা বেহদ
বাজে; বললো না ছিল তার অস্তিত্বে স্বর্গীয় সুর।

তোমরা শাসন করো

তোমরা শাসন করো, আমরা শাসিত হই আর
তোমরা শোষণ করো, আমরা শোষিত জেরবার।
তোমরা ভাষণ দাও, আমরা শ্রবণ করি রোজ,
করি না হিসেব তাতে থাকে অসত্যের কত ডোজ।
আমাদের ঠেলে দাও বারবার ধূলোয়, কাদায়;
তোমরা ঘোরাও ঘুরি অসহায় গোলক ধাঁধায়।
আমরা ঘানির প্রাণী সর্বক্ষণ চোখে ঠুলি-আঁটা,
তোমরা নায়ক সুচতুর এবং আমরা কাটা
সৈনিকের মতো পড়ে থাকি মঞ্চে এক কোণে; দিন
যায়, দিন যায়, রৌদ্রে ঝলসিত উদ্যত সঙ্গীন
তোমাদের। তোমরা চালাও গুলি মিছিলে, সভায়
নির্বিচারে, আমাদের রক্তে রাজপথ ভেসে যায়।
তোমরা পাঠাও জেলে আমাদের যে কোনো ছুতোয়,
সানন্দে রগড়ে দাও মাথাগুলো নবাবী জুতোয়।
তোমরা সগর্বে ভাবো এভাবেই কেটে যাবে কাল
অগণিত সেপাই সান্ত্রীর পাহারায় আর খাল
কেটে মস্ত শাসালো কুমির আনলেও কারো সেই
সাড়ম্বর প্রচেষ্টায় বাধা দেবার মুরোদ নেই।
কিন্তু জেনে রাখো রুদ্র জনতার পুঞ্জীভূত ক্রোধ
দাবানল হলে টলে উঠবে তোমাদের মসনদ।
পালাবার পথ খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হবে না,
যেখানেই যাও শেষে শোধ করে যেতে হবে দেনা।

নিজেকে বন্ধক তুমি রেখেছো

নিজেকে বন্ধক তুমি রেখেছো মৃত্যুর কাছে, ফলে
মৃত্যুর শিয়রে নিত্য জমে
তোমার হাতের ফুল। অথচ অদূরে, একজন
দাঁড়িয়ে তোমাকে লক্ষ্য করে অগোচরে প্রায়, বলা যায়,
প্রত্যহ, যেমন
খগোলাবিজ্ঞানী নক্ষত্রের
গহন রাত্তিরে; ফিরে যাও নিজের নিবাসে একা
তোমার শাড়িতে চোরকাঁটা লেগে থাকে,
মৃত্যুর প্রচ্ছন্ন গন্ধ রুয়ে দেহমনে বিষাদের
বীজ, তুমি ফসলের প্রত্যাশায় থাকো অহর্নিশ।

বীজ নষ্ট হতে থাকে ক্রমাগত, বরং ভেতরে
ডেকে নাও তাকে,
যে দাঁড়িয়ে আছে হিমেল বাহিরে, যার
হৃদয়ে মন্দিরা বাজে, লাগাতার বৃষ্টির পরের
ঝকমকে রৌদ্রের আবীর
বিশদ ছড়ানো থাকে বেনারসী শাড়ির ধরনে।

পরিবর্তন

এইতো ক’দিন মাত্র তুমি নেই এ শহরে, অথচ আমার
মনে হয়, অনেক আলোকবর্ষ তোমাকে দেখি না,
কত যে সভ্যতা লুপ্ত হলো, তারপরও
শুনি না তোমার কণ্ঠস্বর
এবং তোমার
আশ্চর্য হাসির জলতরঙ্গ বাজে না
যুগ যুগ ধরে।

কী যে হলো এ শহরে, একটি পাখিও
পড়ছে না চোখে
তুমি চলে যাবার পরেই। গাছপালা
কোথায় উধাও হলো? সারি সারি বাড়ি,
সকল দকানপাট, সুপার মার্কেট,
বিউটি পার্লার আর রঙিন সিনেমাহল, সাকুরা এবং
ক্যাথে, কোহিনূর, যাবতীয় স্ন্যাকবার
মিষ্টান্ন ভাণ্ডার উবে গ্যাছে অকস্মাৎ
যেন কোনো ঐন্দ্রজালিকের ফুঁয়ে।
বাগানে ফোটে না ফুল এ শহরে বস্তুত কোথাও।

কোথাও বাধেনি যুদ্ধ, অথচ শহর নিষ্প্রদীপ সন্ধ্যেবেলা
থেকে, যানবাহনের শব্দ লুপ্ত, দমকলবাহিনী অলস,
এমনকি অ্যাম্বুল্যান্সও অচল ক’দিন
যাবত, শিশুরা খেলা ভুলে প্রিয় পুতুলের বিয়ে
করেছে বাতিল, বাস্তবিক প্রেমালাপ থেমে গেছে
সবখানে; তরুণী গাঁথে না মালা, সংগ্রামী তরুণ
লাগায় না পোস্টার দেয়ালে রুদ্র তেজে, আসমানে
মড়ার খুলির মতো চাঁদ রোষে ডেকেছে হরতাল।

এ কেমন শহরে এখনো বেঁচে আছি? হিংস্র, ধুধু মরুভূমি
ঢাকাকে করেছে গ্রাস, প্রেতায়িত অলিগলি। যায়,
দিন যায়, রাত কাটে ছায়াময়তায়, চতুর্দিক
কী নিশ্চুপ, এমনকি কুকুরের ডাকে
সীমাহীন নৈশ নিস্তব্ধতা একবারও
চমকে ওঠে না।

চারদিন নয়,
কয়েক শতাব্দী পর হঠাৎ সকালবেলা টেলিফোন, একি
আবার তোমার কণ্ঠস্বর
আমাকে মধুর চুমো খায়।
পরিপার্শ্ব কেমন বদলে যায় লহমায় আর
গাছপালা, পাখি, মেঘমালা, ফুল, হাওয়া-
সবাই রটিয়ে দেয় দিকে দিকে, ‘এসেছে সে ফিরে।
এ খবর পেয়ে সমস্ত শহর
অলৌকিক কলরব করে। এ শহর এর আগে
এরকম সজীব হয় নি মনে কোনোদিন। মিনতি আমার,
কখনো এভাবে আর এ শহর ছেড়ে
যেও না কোথাও।

পোড়া দাগ

মাছভাজা হচ্ছি জ্বরে; অনেক কিছুই, খুঁটিনাটি,
ভুলে গেছি; এ ঘরে বিকেলে
কারা এসেছিল, কবিসভায় প্রস্তাব
করা হলো কি না, খিস্তি খেউড়, আড্ডায়
প্রচণ্ড বাদানুবাদ, কাফকার চিঠি
কিছুতেই পড়ে না মনে। গৃহিনী মাথায়
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঢেলেছিল পানি শুশ্রুষার
নির্ভুল মুদ্রায় তা-ও ভুলে বসে আছি। শুধু মাথার ভেতরে
ভ্রমরের মতো ক্রমাগত
কবিতার পংক্তিমালা তোলে গুঞ্জরন,
অক্ষরবৃত্তের পর্ব, স্বরবৃত্তের প্রধান্ন ঝোঁক
ভুলি না কিছুতে।
আমার এ ঘরে তুমি আসো নি কখনো। বিছানার
চারপাশে ঘেঁটু ফুল, ভুল সুরে বুলবুল গায়
গান দেখি কিছু ছায়া ঘোরে
আর কিছু বিকৃত মুখোশ-পরা মুখ
ঝুঁকে আছে আমার মুখের
ওপর এবং ছেলেবেলাকার উম্মাদিনী উদোম শরীরে
ঘোরে ঘরময়; মনে হলো,
চুপিসারে এসে তুমি রেখেছো তোমার
হাত তপ্ত আমার কপালে,
নিমেষেই পাই পানিপট্রির আরাম।

আমি তো স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি কতকাল, রাত্রিদিন
অত্যন্ত বিষাদে আছি। কম্বল জড়ানো
স্মৃতিখেকো ফকিরের মতো কারো লম্বাটে আঙুল মাঝে মাঝে
চুল ধরে টানে,
আমারই চেয়ারে বসে চিমটা বাজিয়ে
শোনায় প্রাচীন শোকগাথা।

কথা ছিল অপরাহ্নে তোমার আসার?
দেখা হবে কাল, কিছু কথা আর হাসির ঝিলিক
খেলে যাবে ঠোটে, যদি না আসো আমার প্রতীক্ষাকে
ব্যঙ্গ করে তোমার অনুপস্থিতি পোড়া দাগ
হয়ে থাকবে ব্যথিত স্মৃতিতে।

অবশ্য আসো নি তুমি; যদি মরে যাই
হঠাৎ, তবুও
পড়বে না পদচ্ছাপ তোমার এ ঘরে।
শুধু মরীচিকা নিয়ে করে ছটফট
জ্বরতপ্ত শরীর আমার;
কখন দুপুর হয়, কখন গভীর রাত, থাকে না খেয়াল।

প্রথম উপহার

ডাকটিকেটে নেই, কোনো ব্যাঙ্কনোটে, সরকারি
কিংবা বেসরকারি দপ্তরেও নেই। ক্যালেন্ডারেও থাকার
কথা নয়। আছে একান্ত আমার কাছে
তোমার রঙিন ফটোগ্রাফ,
যা’ তুমি আমাকে দিয়েছিলে
প্রথম উপহার হিসেবে।

মুখস্থ হয়ে গ্যাছে ফটোগ্রাফস্থিত তোমার
বসবাস আঙ্গিক, হাসির ছন্দ আর স্তনের ডৌল।
যখন ভাবি, তুমি বসে আছো।
আমার পাশে অথবা মুখোমুখি, তখন
যুগপৎ মৃত্যুভয় আর বাঁচার অগাধ সাধ
আমাকে নাচায় এবং
রক্ত মাংসের প্রতিমার তুলনায়
ফটোগ্রাফটিকে, রঙিন হওয়া সত্ত্বেও, কেমন নিষ্প্রভ
মনে হয়। কী করবো এই ছবি নিয়ে
যা’ আমাকে স্পর্শ করে না একবারও, বাঁধে না আলিঙ্গনে
অথবা আচ্ছন্ন করতে পারে না
চুম্বনে চুম্বনে?

উপহার-পাওয়া সেই ফটোগ্রাফ সযত্নে রয়েছে
আমার প্রিয় এক বইয়ের ভেতর,
এবং তোমার অন্য এক ছবি সমাসীন আমার হৃদয়ে,
যা কোনো স্বৈরাচারী শাসকই
নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না কোনোদিন,
যেমন করেছে নন্দিত পটুয়া কামরুল হাসানের চিত্রপ্রদর্শনীকে।

 বকুলের মালা

আসলে কেনার ছলে মাঝে-মধ্যে সেসব বালক বালিকাকে
ভিক্ষা দিই, যারা থাকে
রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক পাশে, ছোটে ডানে কিংবা বামে, ভান করে
বকুলের মালা বিক্রয়ের, হয়তো ঘরে
অসুস্থ মা ভুখা-ফাঁকা আছে। বাধ্যতামূলকভাবে
মালা কিনে ফ্ল্যাট বাড়িটায় ফিরি, ঘ্রাণের প্রভাবে
অতীত নিকটে আসে হরিণের মতো,
মুখ রাখে ঝিলে, শিঙ তার ক্রমাগত
কেমন জড়িয়ে যায় সূর্যাস্তের রঙ-লাগা লতাগুল্মে। যদি
তোমাকে এ মালা দিই, তবে কি তোমার পাশে বয়ে যাবে নদী,
রঙধনু জাগবে সত্তায় নিরিবিলি? তুচ্ছ মালা
আমার টেবিলে পড়ে থাকে, হো হো হাসে পর্দাঢাকা কাচের জানালা।

চকিতে নীলিমা চিরে উড়ে যায় অতিকায় প্লেন।
ক্ষীণায়ু কীটস বলেছেন
একটি চিঠিতে তাঁর-‘প্রকৃত কল্পনা
আদমের স্বপ্নতুল্য, জেগে উঠে সত্য খুঁজে পাওয়া। জানবো না
কখনো পেয়েছি কিনা সত্যের সন্ধান। কল্পনাকে
পাখা মেলবার দিই মহলত। দূরে পাখি ডাকে,
নাকি ভুল শুনলাম? তোমার ড্রইংরুমে, মনে
হয়, কত স্বর্গসন্ধ্যা কাটে যেন স্বপ্নে জাগরণে।

কিছু কথা, কিছু নীরবতা যেন ফুলের স্তবক।
প্রাত্যহিকতার রূঢ় ছক
থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কতটা আলাদা
হয়ে ভিন্ন সুর তুলে সামাজিক থেকে যেতে পারি? বাঁধা ছাঁদা
এখনো রয়েছে বাকি; ‘চলি
ঢের রাত হলো বলে হৃদয়ে লুকানো ঝর্ণা আর বনস্থলী
নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠি কল্পনায়; ভাবি
তোমার নিকট নেই দাবি
আমার কিছুই আজ, এখনই কি বিদায়ের পালা?
মনে পড়ে, আমার টেবিলে আছে পড়ে বিশুষ্ক ফুলের মালা,
আনিনি যা’ বিহ্বল সংকোচে, মেয়ে, পাছে
তোমার স্বাস্থ্যল খোঁপা বেঁকে বসে; শুকনো মালাটিতে লেগে আছে,
মনে হয়, দুঃস্থ বালিকার ছলছলে দু’টি চোখ,
আমার ভেতরে জমে শ্রাবণ মেঘের মতো শোক।

বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়

সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও
শিশিরের মতো
জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়
জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ
বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে
ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,
কখনো অত্যন্ত ক্ষিপ্র জাগুয়ার তাকে
প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে
চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,
এতটুকু ঘুমোতে দেয়নি।

কাল রাত ঢাকা ছিল প্রেতের নগরী,
সবাই ফিরেছে ঘরে সাত তাড়াতাড়ি। চতুর্দিকে
নিস্তব্ধতা ওৎ পেতে থাকে,
ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি
কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক।
মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃশব্দ্যকে
আরো বেশি তীব্র করে তোলে
প্রহরে প্রহরে, নূর হোসেনের চোখে
খোলা পথ ওর
মোহন নগ্নতা নিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দুর্বার। অন্ধকার
ঘরে চোখ দু’টো অগ্নিঘেরা
জানালা, কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যৎ।
এমন সকাল তার জীবনে আসোনি কোনোদিন,
মনে হয় ওর; জানালার কাছে পাখি
এ রকম সুর
দেয়নি ঝরিয়ে এর আগে, ডালিমের
গাছে পাতাগুলি আগে এমন সতেজ
কখনো হয়নি মনে। জীবনানন্দের
কবিতায় মায়াবী আঙুল
তার মনে বিলি কেটে দেয়। অপরূপ সূর্যোদয়,
কেমন আলাদা,
সবার অলক্ষ্যে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে
আঁকা হয় যায়,
যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে।

উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠ
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।

মদ্যপদের মধ্যে

মদ্যপদের মধ্যে বসে আছে সে চুপচাপ
অনেকক্ষণ ধরে। হাত দু’টো টেবিলে ন্যস্ত, মাথা নিচু।
অন্যেরা কেউ কারো কথায় কান না দিয়ে
বেজায় হৈ হল্লা করছে, খিস্তি খেউড়ের
ডেকেছে বান। দূর থেকে কেউ দেখলে ওকেও
মনে হবে মদে চুর, ঝিম মেরে বসে আছে।
অথচ নেশাভাঙ কিছুই করে নি সে। শুধু সঙ্গ দিচ্ছে
ঘন্টার পর ঘন্টা ইয়ারবক্সিদের।
রাত এগারোটায় চেয়ারে ঠায় বসে অন্য এক মস্তিতে
নিমজ্জিত। তবে কি সে ফেরেশ্‌তাদের সঙ্গে মনে মনে
তর্ক জুড়ে দিয়েছে পারিপার্শ্বিকের প্রতি
সম্পূর্ণ উদাসীন? নাকি ভাবছে হুরপরীদের
স্তন স্পর্শ করলে একজন মানুষ
কীরকম অনুভূতির সরোবরে কাটতে পারে ডূবসাঁতার?

না, সে এরকম কিছুই ভাবছে না এখন।
ওর মাথায় বন বন ঘুরছে সাঙাতদের কথা,
যারা নেশায় বুঁদ।
ওদের সে ঘেন্না করে না; ওরা, সে ভাবে,
প্রত্যেকে পাথরে ছিট্‌কে-পড়া
বিন্দু বিন্দু রক্ত। মিথ্যার তুবড়ি-ছোটানো কতিপয়
চেনা মুখমণ্ডলের অশ্লীল ভঙ্গি দেখে দেখে,
নিত্যদিন প্রবঞ্চনার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
প্রত্যক্ষ করে, হাড়-ফাটানো জুলুমের প্রতি দর্পিত
শিরস্ত্রাণের সায় লক্ষ করে
ওরা হতাশা ও বেদনায় ক্রমাগত লগি ঠেলতে ঠেলতে
এগোচ্ছে সর্বনাশের মোহনায়।

ওরা নীড়পোড়া পাখির ঝাঁক, কালবেলায়
জড়ো হয়েছে এই হতচ্ছাড়া আসরে। কেউ বিড় বিড় করে
কী যেন একটা বলতে চাইছে, কেউবা ঘুমের ঢুলু ঢুলু।
সে ওদের ভালোবাসে; কিছুতেই ছেড়ে যেতে
পারে না, প্রতীক্ষায় থাকে-
যদি কখনো হঠাৎ নেশার রঙিন কুয়াশা
অপসৃত হবার পর ওরা দেখতে পায় ওদের সামনে
সুন্দরীর মতো উন্মোচিত ভবিষ্যৎ।

এক সময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, আঙুল চালায়
লম্বা চুল, মনে হয় একজন গেরিলা
তৈরি হচ্ছে নতুন কোনো
অ্যামবুশ্‌-এর উদ্দেশ্যে। ওর চোখ দু’টো মণিরত্নের মতো
জ্বলজ্বলে; এমন কান্তিমান পুরুষ
কোথাও কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

যতই ভাবি

ভাঙাচোরা পথের ধারে একটি গাছকে বললাম-
তার কথা ভেবে ভেবে আর দগ্ধ হবো না।
গাছ আমার কথায় কান না দিয়ে
ঝাঁ ঝাঁ রোদে আরো বেশি পুড়তে দিলো নিজেকে।

দূরের এক পাখিকে মনোযোগের চাতালে এনে জানালাম-
ওর উদ্দেশে গান গেয়ে আর ভেজাবো না চোখের পাতা।
পাখি আমার কথাকে উদাসীন ঝাপটায়
ঝেড়ে ফেলে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে একাকী।

আমার চারপাশে জড়ো হওয়া অক্ষরগুলোকে
শোনালাম, তোমাদের রূপকল্পে
তাকে আর কস্মিনকালেও সাজাবো না।
অক্ষরগুলো হো হো হেসে করতালি বাজায় ক্রমাগত।
যতই ভাবি আমার স্মৃতির চৌহদ্দি থেকে
রাখবো ওকে বনবাসে,
ততই সে নিজেকে মূল বিষয় করে দৃশ্যের পর দৃশ্য
তৈরি করতে থাকে আমার চোখের সামনে প্রহরে প্রহরে।

 যেখান থেকে সরে এসেছি

কী এক অস্বস্তি আর অস্থিরতা
কাল সারারাত ঘুমোতে দেয় নি আমাকে। অনেকক্ষণ
বই নিয়ে বসে থাকলাম, বুটিদার আকাশ
দেখলাম, ভাবনার নানা পাকদণ্ডীতে
ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ভোর রঙরেজের মতো
আমার ঘরে লাগালো পোঁচড়া, খেয়াল ছিল না।

হাতের কাছেই ধোঁয়া-ওগরানো চায়ের পেয়ালা,
কবিতার বইয়ের অক্ষরগুলো
নানা ধরনের মঞ্জরী, আজ রাস্তায় না মোটর কারের
হর্ণ, না রিকশার টুংটাং আওয়াজ, না ফেরিঅলার ডাক।

কল্পনার বীজতলা থেকে কিছু কণা নিয়ে নাড়াচাড়া করি
ডায়েরির পাতায়
রোপণ করার জন্যে। নোনাধরা অসংস্কৃত দেয়ালে
কখনো কখনো যে গুলিবিদ্ধ মানচিত্র দেখি, তা ফুঁড়ে যেন
বেরিয়ে আসতে চায় বলিভিয়ার জঙ্গল
আর চে গুয়েভেরার মুখ।
তৃপ্তিতে টইটম্বুরে
কয়েকটি মুহূর্ত আমার ভেতরে এক
অপরূপ ঐকতান। অনেকক্ষণ ধরে
চৌদিক খুব সান্নাটা; যাকে দেখার জন্যে আমার
ব্যাকুলতা আহত ঈগলের আর্তনাদ,
হয়তো সে এখন চুল এলিয়ে ইন্দ্রজাল-ছাওয়া দ্বীপে
মিরান্ডা নতুন পৃথিবীর দিকে
তার মুখ কী উন্মুখ। আজ আমি বাইরে পা বাড়াবো না।

সুন্দরবনের বাঘের গর্জন ভেসে এল কী করে
পৌরপথে? চমকে উঠে দেখি
হঠাৎ রাস্তায় অকুল সমুদ্র, আকাশ-ছোঁয়া
কল্লোল আমাকে ঘর থেকে টেনে
ছুঁড়ে দিলো সেই সমুদ্রে, আমি তরঙ্গে তরঙ্গে
ভাসমান দুরন্ত সাহসী প্রদীপ,
যে কোনো চোরা টান কিংবা ঘূর্ণির তোয়াক্কা না করে
ক্রমাগত অগ্রসরমান।

যেখান থেকে সরে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়ার পথ
আমি নিজেই রাখি নি।

লড়ছি সবাই

মিশমিশে ঘোর অন্ধকারে
কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে,
রহিম পড়ে রামের ঘাড়ে,
কেউবা দেখি চুপিসারে
অন্য কারুর জায়গা কাড়ে,
পাচ্ছি তা টের হাড়ে হাড়ে।
লাইন থেকে সরছি ক্রমে সরছি।
জল খেয়েছি সাঁতটি ঘাটে,
ফল পেয়েছি বাবুর-হাটে,
কিন্তু সে ফল পোকায় কাটে,
ঘুণ ধরেছে নক্‌শি খাটে,
কানাকড়ি নেইকো গাঁটে,
চলছি তবু ঠাঁটে বাটে,
রোজানা ধার করছি শুধুই করছি।
পক্ষিরাজের ভাঙা ডানা,
রাজার কুমার হলো কানা।
দিনদুপুরে দৈত্যপানা
মানুষগুলো দিচ্ছে হানা,
নিত্য চলে ঘানি টানা,
জগৎ-জোড়া খন্দখানা-
হোঁচট খেয়ে পড়ছি কেবল পড়ছি।

ফসল ক্ষেতে পোকা পড়ে,
ঘর উড়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ে,
মাতম ওঠে ঘরে ঘরে।
কত ভিটায় ঘুঘু চরে,
কংকালেরা এই শহরে
বাঁচার জন্যে ধুঁকছে মরে।
বাঁচার লড়াই লড়ছি সবাই লড়ছি।

শীতদুপুরে প্রথম দেখা

শীতদুপুরে হঠাৎ
হৃদয় আমার লাফিয়ে উঠলো তরুণ মাছের মতো,
যখন তুমি সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে
সাবলীল প্রবেশ করলে রেস্তোরাঁয়। নদীতীরে ভিড়লো
ময়ূরপঙ্খী। সেই মুহূর্তেই
আমার ভেতরে রূপান্তর। বছরের পর বছর
প্রাচীন অধীরতা নিয়ে
প্রতীক্ষায় ছিলাম যার, সে-ই কি তুমি?
আমার প্রৌঢ়ত্বের ধূসরতায়
এক রাশ শ্যামলিমা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে রইলো।

বেশ কিছুক্ষণ, অথচ কী ক্ষণস্থায়ী সেই সময়,
আমরা বসেছিলাম মুখোমুখি। চারপাশের প্রতিটি বস্তু এবং
ব্যক্তিকে দৃষ্টি থেকে নিয়ে গেল আড়ালে
এক বেপরোয়া উদাসীন মনোভঙ্গী আর
আমার সকল একাগ্রতা শুধু তোমাকে ঘিরেই খেয়ালের আলাপ।
নেকড়ে রঙের পুলওভারের অন্তরালে মেষশাবকের মতো
তোমার উজ্জ্বল স্তনের ওঠানমা,
রঞ্জিত পবিত্র ঠোঁটে স্বপ্নঝালরের ঝিলিমিলি,
তোমার রহস্যঘন চোখের আধ্যাত্মিক ঘাট থেকে
যে নৌকো ছেড়ে গেল ঢউয়ের ওপর
নাচতে নাচতে, তার গলুইয়ে আমার আকাঙ্ক্ষা সওয়ার হয়ে চলেছে,
দেখতে পেলাম।

তুমি যখন আমার প্লেটে সাজিয়ে দিলে
ক্লাব স্যান্ডুইচ, তোমার আঙুল আমার দিকে
একজন ব্যালে নর্তকীকে এগিয়ে দিলো। যদি তাকে আচম্বিতে
চুমো খেতে পারতাম, তাহলে
কার সাধ্যি আমাকে বঞ্চিত করে
অমরতার আলিঙ্গন থেকে? পেয়ালায়
কফি ঢালতে ঢালতে
এভাবে চোখ রাখলে আমার চোখে, মনে হলো
তুমি লহমায় পাঠ করে নিয়েছো
আমার মনের দেয়ালের লিখন। তোমার চোখের
তারায় কি ফুটে উঠেছিল মৃদু তিরস্কার না কি
এক ধরনের পুষ্পল প্রশ্রয়? হয়তো কিছুই নয় আমি নিজেই
রঙিন কুয়াশা দিয়ে চটজলদি
তৈরি করে নিচ্ছিলাম এমন এক বাড়ি,
যার কোনো দেয়াল নেই, নেই ছাদ;
আছে শুধু রঙধনু-সিঁড়ি, অন্তহীন, নীলিমাভিসারী।

এ-ও এক বিস্ময়, তুমি তাকালে আমার দিকে, আমাকে
নাওয়ালে তোমার অপরূপ হাসির নিরিবিলি ঝর্ণাধারায়,
অথচ্চ আমার হৃৎস্পন্দন, থেমে গেল না,
হাড়, মাংস আর ত্বক ফুঁড়ে আমার হৃৎপিণ্ড
বেরিয়ে এসে ছিটকে পড়লো না টেবিলে। কেবলি
ঝংকৃত হচ্ছিলাম রেয়াজ-সিদ্ধ ওস্তাদের হাতের বাদ্যের মতো।

যা বলতে চেয়েছি, অকথিক থেকে গেল আর
তা নিয়েই সারাক্ষণ বাক্‌ বাকুম বাক্‌ বাকুম করে
কাটিয়ে দিলাম যার প্রায় ষোল আনাই অবান্তর।
এভাবেই হয়তো তুচ্ছের ভিড়ে
বিড়ম্বিত হয় অসামান্য। স্পল্পভাষী বলেই
আমি পরিচিত। আমার এই হঠাৎ
প্রগল্‌ভতার উৎস খুঁজতে যখন আমি ব্যস্ত,
তখন দ্বিপ্রাহরিক স্বপ্নকে খানিক সরিয়ে বললে তুমি,
‘এবার উঠতে হয়। সব ভালো জিনিষেরই
কখনো না কখনো শেষ হবার কথা,
মনে মনে আওড়ালাম। যখন তুমি টেবিল থেকে
হ্যান্ডব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ালে,

ভাবলাম, এই তো সেই দ্যুতিময় কবিতা
যা এতকাল ধরে লিখতে চেয়েছি,
কিন্তু আজো লেখা হয়ে ওঠে নি। আমার
অব্যক্ত প্রশ্ন তোমার তরঙ্গিত
শরীরকে স্পর্শ করলো আলতো,-
কোনোদিন কি সেই না-লেখা কবিতাকে নিজস্ব করে পাবো?

সংশয়

তোমার সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটিয়ে এসে মনে হয় তুমি
ভাবো দিনভর, রাতভর-
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রজ্যোৎস্নাময় আমার হৃদয়
সেই সর্বনাশ জলাভূমি
যেখানে যায় না বাঁধা ঘর,
যেখানে পা রাখলে তলিয়ে যেতে হয়, দুঃসময়
ব্যেপে আসে চতুর্দিক থেকে,
যেখানে কস্মিনকালে জন্মে না কহল্লার
বিশ্বাসের। অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে ক্লেদ মেখে
বাজাবো ডম্বরু দূরে গিয়ে,
ভাবো তুমি। কোন্‌ শ্বেতচন্দনের প্রলেপে তোমার
সংশয়ের সব কালো মুছে দিতে পারি,
বলো দূরত্বের দীর্ঘ সাঁকোয় দাঁড়ানো
হে রহস্যময়ী নারী?

অসহ্য অসহ্য জানি, মনোনীতা, তোমাকে হারানো।
যদি থাকো পাশে আজীবন, তবে সাক্ষী এ চন্দনা,
অন্য কোনো নারীকে কখনো নৈঃশব্দ্যের ঘাটে নিয়ে
বসন্ত বাহার শোনাবো না।

সদ্যলেখা এই পদ্য

সদ্যলেখা এই পদ্য আমার পাবে না কল্কে কস্মিনকালেও
কবিতার নাক উঁচু সমঝদারের
কাছে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যাপনারত সাহিত্যের বুধমন্ডলী তামাশা
করবেন, কাটবেন টিপ্পনী বিস্তর
প্রসাধনবর্জিত পংক্তির খোলামেলা ভঙ্গি দেখে।
এ পদ্য হবে না ছাপা অভিজাত পত্রিকায়, রম্য
সাপ্তাহিকে। মাননীয় সম্পাদক বলবেন, ‘এতে
গোলাপ, চামেলী, জুঁই, মল্লিকার ঘ্রাণ
কোথায়? কোথায় মেঠো বংশীধ্বনি, নারীর চোখের
কুহক অথবা কিউবিক
বাহার? না, এই পদ্য, বুঝতেই পারছেন, সাহিত্য পত্রের যোগ্য নয়।

নিমেষে ফেরত আসে পাণ্ডুলিপি আমার মুঠোয়-
শব্দ্যাবলী ব্যাপক ছড়ায়
শ্রমিকের ঘেমো গন্ধ, পুষ্টিহীনতায়
জীর্ণ বালকের
চোখের ক্ষুধার্ত নিভু নিভু আলো আর জ্যোৎস্নাপ্লুত
ধর্মঘঢী মানুষের লাশের ওপর খুব ঝুঁকে-থাকা নারীর বিলাপ।

শব্দ্য বলে, ‘আমি পথ আর আমি সত্য ও জীবন।
সদ্যলেখা এই পদ্য আমার শহুরে
দেয়ালে দেয়ালে, গ্রাম্য হাটে পথে ঘাটে
পেলে ঠাঁই হৃদয় আমার হয়ে যাবে
রবীন্দ্রনাথের নৃত্যপর
ময়ূর এবং হেঁটে যাবো একা দিকে দিগন্তরে।

সাপ্তাহিক ‘দেশবন্ধু’ নিষিদ্ধ হবার পরে

যদি থাকতো আ মরি
বেহদ ন্যাকা পদ্য আর ছৈলছবিলা গদ্যের ছড়াছড়ি,
যদি থাকতো টপ নায়িকার দিলতড়পানো
ফিনফিনে ব্লাউজের পাহারা-টপকানো
উদ্ধত বুকের বাহার, মারদাঙ্গা ফিল্মের নায়কের কেচ্ছা আর
কখনো সখনো জেল্লাদার
কুকুর কিংবা পুষ্পপ্রদর্শনী, রোটারি ক্লাবের ধুম ভোজসভা
অথবা
ঝকমকে অনুষ্ঠানে কর্তাব্যক্তিদের ফিতে-কাটা ইত্যাদি ছবিসম্বলিত
বিলকুল রাজনীতি-বিবর্জিত
প্রতিটি পৃষ্ঠা কিংবা মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীমহোদয়দের
একতরফা তারিফের
আতরে ভুর ভুর বশম্বদ পুরো চার ফর্মা তাহলেই ছিল সব সিদ্ধ,
হতো না ‘দেশবন্ধু’ কস্মিনকালেও ক্রুশবিদ্ধ!

Exit mobile version