- বইয়ের নামঃ ভগ্নস্তূপে গোলাপের হাসি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্তরের গহন পাতালে
একদিন হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম অনেক দূর
বিয়াবানে অভীষ্ট বস্তুর খোঁজে। হঠাৎ সবুজ
গাছগাছালির মধ্য থেকে ভেসে এল গাঢ় এক
কণ্ঠস্বর, ‘কিয়দ্দূরে একটি প্রাচীন কূপ আছে
তোমারই ব্যাকুল প্রতীক্ষায়, তার কাছে চলে যাও। কিছু পথ
হেঁটে ঠিক প্রাচীন কূপের কাছে গেলে, ‘এসো, এসো
আমার ভেতরে ডুব দাও। সেই ধ্বনি মেনে নিয়ে বারবার
ডুব দিয়ে শূন্য হাতে ফিরে এসে ফের হেঁটে চলি।
হেঁটে যেতে যেতে অনুভব করি, ক্লান্তির কুয়াশা
আমাকে ধরেছে ঘিরে। বৃশ্চিকের দংশনের কাতর, তবু হেঁটে
যাব যত পারা যায়। একটি নদীর কাছে পৌঁছতেই নদী
উজ্জ্বল জলজ কণ্ঠে বলে, ‘আমার গভীরে ডুবে দ্যাখো,
তুমি যা খুঁজছে পেয়ে যেতে পারো হে ক্লান্ত পথিক। বহুক্ষণ
নদীর গভীরে ডুবে বারবার শূন্যতা নিয়েই
ফিরে আসি। এ বঞ্চনা, এই প্রতারণা আর কত
সওয়া যায়? মনে হলো, চাঁদকে খুবলে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত নেকড়ে।
অবসন্ন সত্তা গাঢ় নিদ্রায় ডোবার বাসনায়
কেমন উন্মুখ হয়ে ওঠে। চকিতে একটি ধ্বনি
আমার অন্তরে জেগে ওঠে, বেজে ওঠে, ‘ওহে ক্লান্ত পথচারী,
ইতস্তত ঘোরাঘুরি ছেড়েছুড়ে খুব নিরালায়
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফজুল বচসা থেকে গাঢ়
ডুব দাও, বারবার ডুব দাও অন্তরের গহন পাতালে;
সন্ধানে টেনো না ছেদ কিছুতেই, তোমার অভীষ্ট
ঝলসে উঠবে চিদাকাশে, উদ্ভাসিত হবে তুমি।
অন্য দৃষ্টি
আমার চোখের আলো ক্ষীণ থেকে ক্রমে
ক্ষীণতর হচ্ছে, দিনে রাতে
অসুস্থ দু’চোখে নিয়মিত কমপক্ষে
ছ’বার ওষুধ দিতে হয় সাত বছরের কিছু অধিক সময় ধ’রে। টিয়া
নিয়মতি এ দায়িত্ব করছে পালন। কোনওদিন
বিরক্তির ঈষৎ কুঞ্চনও মুখে তার
দেখিনি, বরং চোখ দু’টো দৃষ্টিময় রাখার প্রয়াসে সুখী।
ওষুধ দেয়ার পরে চক্ষুদ্বয় ক’মিনিত বুজে
রাখতেই হয় প্রতিবার। খোলা চোখে সবকিছু
ক্রমশ আবছা হয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া
অনেক কঠিন বর্তমানে ক্ষুদ্রাক্ষর দেখি না মোটেই, লিখি
ঢের কষ্ট সয়ে; চোখে ওষুধের ফোঁটা
পড়লেই ক’মিনিট দৃষ্টিহীনতায় কেটে যায়।
তখন কিছুই আর বন্ধ দু’টি চোখে
তেমন ধোঁয়াট নয়। সাময়িক দৃষ্টিহীনতায়
দেখে ফেলি দু’টি রাঙা ফুলের মিলন। স্পষ্টতায়
সৃষ্টি হয় নানা দৃশ্য, চোখের পড়ে তরুণ-তরুণী
পরস্পর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে
সুস্পষ্ট মিলিত হয় মহাদিগন্তের প্রতিভায়।
অমাবস্যা ছিঁড়ে জাগে
পালাও, পালিয়ে যাও,
পালাও, পালাতে থাকো,
পালাও, তোমার না পালিয়ে
রক্ষা নেই। দেখতে পাচ্ছ না, চারদিক থেকে ওরা
তোমাকে ধরবে ঘিরে, পালাও, পালাও।
পেছনে লোমশ হাত, খড়্গ এক্ষুণি পালাও।
এখন যেদিকে পারো আকাশে, পাতালে
প্রাণপণে ছুটে যাও, দড়ি যদি না-ও জোটে, হাত
সাপের দিকেই দ্রুত বাড়াও, এখন মানুষের চেয়ে জেগে
ওরাই অধিক নিরাপদ। অনর্থক
দেয় না ছোবল সাপও। অথচ হিংসার ব লল্গাহীন
খেলায় হেলায় মেতে ওঠে মানুষের তক্মা-আটা জীবগুলো!
গ্রামে-গঞ্জে শহরতলীতে, নারায়ণ, দীপঙ্কর, অরুণিমা
শঙ্কায় কাটায় দিনরাত; বনলতা, অরুন্ধতী
বস্ত্রহরণের ভয়ে কম্পমান অমাবস্যা রাতে। এখন তো
দ্বিপ্রহরই মধ্যরাতে হাহাকারে, অসহায় কান্নায় কুমারী
লুটায় মাটিতে ব্যাভিচারী নরপশুদের ক্লেদজ থাবার
স্পর্শে মূর্চ্ছা যায় আর চারদিক থেকে অকস্মাৎ রহমত, নুরুদ্দিন,
নির্ভীক মানুষ ছুটে আসে ভায়ের বোনের
লজ্জা নিবারণে আর তাড়াতে পশুর ঝাঁক শান্তিনিকেতন
থেকে, বুকে টেনে নেয় নারায়ণ, দীপঙ্কর, অসীমকে, হাত
রাকেহ বনলতা, প্রমীলার হাতে। অমাবস্যা ছিঁড়ে জাগে পূর্ণিমার চাঁদ।
আর কতদিন থাকব
এ পাড়ায় দশ বছর ধরে আছি
আর কতদিন থাকব, জানা নেই। দশ বছর
খুব কম সময় নয়, অথচ দুষ্টি বালকের মতো
হুট করে কীভাবে যে উধাও হলো
বলতে পারব না।
দশ বছর ধরে বাড়ির একটি কোণে একটি
ছোট ঘরে আমার দিনরাত কাটে। অথচ
কী অবাক কাণ্ড, আজ অব্দি একবারও
কোনো কোকিলের ডাক শুনিনি। কত যে কান পেতে
রয়েছি, শুধু বিড়ম্বনাই হয়েছে সার আর
আমাকে উপহাস করার জন্যেই যেন রোজ
আশেপাশে ক্রমাগত ডেকেছে কাক। তবে
খুব ভোরবেলা কোনও কোনও
পাখির কিচির-মিচির শুনেছি, এখনও শুনতে পাই।
এক যেন সেদিন বলল, এ পাড়ায় কোকিল দেখেছে।
বিশ্বাস করতে পারিনি, তা’হলে
দশ বছরে কোনও বসন্তেই কোকিলের গান কেন
ভেসে এল না আমার কানে, হৃদয়ে?
বৃক্ষ হন্তারকদের নির্দয়তা কোকিলদের
বিশ্রামকুঞ্জ ধ্বংস করে ফেলেছে। এ আমার গভীর বেদনা,
তবে কীটস-এর ‘ওড টু নাইটেঙ্গল’- এর মতো
কালজয়ী কবিতা কোকিলের গান বিষয়ে
না লিখেই মিশে যাব ধুলোয়, এই গভীরতম
বেদনা হৃদয়ে পুষে রাখতে হবে সকল সময়।
এ এক আজব খেলা
এ এক আজব খেলা দুনিয়াদারির
খেলার আড়ালে কত খেলা
কত ঝকমারি।
হুটোপুটি, লুটোপুটি চলে সারা বেলা,
নানাদিকে লাঠালাঠি চলে এক কাঠা
জমি নিয়ে, প্রাণ ঝরে গাছের পাতার মতো ধূলিঝড়ে।
এ খেলার অন্তরালে অন্য খেলা চলে,
এক কাঠা জমি, তেল নুন লাকড়ি যেখানে
অবান্তর। নিরিবিলি সে খেলা অধম
আমার মাথার অন্তঃপুরে চলে। সম্ভবত তার
একরত্তি দাম নেই কারও কাছে।
পেয়েছি কত যে দাগা, হাবিজাবি কত বেচাকেনা
চলে চারদিকে দেখি-এক কানা কয়,
বলেন লালন শুনি, আরেক কানারে,
চল দেখি যাই ভবপারে,
নিজে যে চেনে না পথ, অপরকে ঘন
কুয়াশায় দেখায় পথের দিশা অন্ধ ভরসায়।
নিজেকে চিনি না আজও, অথচ অন্যের
অন্তরের নির্ভুল খবরদারি করার ভড়ং
হাট-বাজারের ভিড়ে করছি জাহির। অকস্মাৎ
নিজের ভেতরে একজন ঘুমভাঙা কণ্ঠস্বরে
বলে কানে কানে-
অন্যদের ধোঁয়াশায় না রেখে বান্ধব
মরো বাঁচো নিজেকেই চুপিসারে সহি কথা বলো।
শোনো হে নজর দাও, তোমার মাথার সরোবরে
জ্যোৎস্নাময় জেল একজন রাজহাঁস
কাটছে সাঁতার, আর পাখা থেকে মুক্তো আর কত
অপরূপ নক্ষত্র ঝরছে অবিরাম, হে কবি অঞ্জলি ভরে নাও তুমি,
বৃথাই মরছ ঘেঁটে ধূলিকণা আর
ডাস্টবিন-উপচানো দুর্গন্ধ-ছড়ানো এঁটো কাঁটা!
এ কেমন কাল এল
এ কেমন কাল এল? দিনদুপুরেই নানা পাড়ায় ডাকাত
হানা দেয়, জাঁহাবাজ আগুনের জিভ চেটে খায়
শত গেরস্তের ঘরবাড়ি। অনুসূয়া, সুতপা, অরুণ, নিমাই পোড়া
বাস্তুভিটা ছেড়ে জীবনের ঘ্রাণ পেতে
ছোটে, ছোটে প্রাণপণে। হায়, এ কেমন
কাল এল উজাড় করতে শত শান্তিনিকেতন? খটখটে
রোদ কী করে যে হয়ে যায়
মানবমানবী-খেকো অমাবস্যা! শিশুরা লুকায়
নিরীহ, নীরক্ত মুখ মায়ের ভয়ার্ত বুকে। মৃত্যুতাড়িত আদম-
সন্তানেরা ছোটে বনবাদাড়ে, ভাগাড়ে।
তমাল গাছের ডাল, পাতা, ছায়া আজ বড়
শোকার্ত এখানে
বাঁশের বাঁশির সুর পলাতক-এখানে বসে না
যুবক যুবতী হাতে হাত রেখে; পাখিরা গায় না
আর গান, ক্রুর অস্ত্রবাজদের হুঙ্কারে আহত
শুভবোধ এবং শান্তির শুভ্র পতাকা পাশব পদাঘাতে
ধুলোয় গড়ায়, চারপাশে বোবা হাহাকার। যদি
পারতাম বুকে ঠাঁই দিতে লুণ্ঠিত, বিপন্ন এই
অসহায় আপনজনকে, যদি পারতাম
আমার ধর্ষিতা বোনদের বেদনার গাঢ় কালি মুছে দিতে।
দেব না মর্যাদা, প্রীতি, আশা, ভরসাকে
অশ্লীল উল্লাসে পুঁতে ফেলতে কাদায়
অথবা পাঠাতে কোনও ধূসর শ্মশানে-
জানি ফের পতাকা সুনিশ্চিত বিজয়ী মানবতার।
এই আর্ত বর্তমান
আমাদের আর্ত বর্তমান পাঁড় মাতালের মতো বক-বক
করছে, উঠেছে মেতে বে-ধড়ক মারপিটে, খুনখারাবিতে
প্রায়শই। কী-যে হয়, ফুটন্ত গোলাপ দেখলেও
আনন্দের তরঙ্গ জাগে না মনে, চোখ
চকিতে বিদ্রোহ করে; সাত তাড়াতাড়ি প্রায় দৌড়ে
অন্তরালে চলে যাই। নক্ষত্র কি ভাসমান মেঘ
কনওটাই জাগায় না অন্তরে আবেগ; মনে হয়,
দেখিনি কিছুই বেলা-অবেলায়, গাছের পাতার
কম্পন বেজায় ব্যর্থ হৃদয় দোলাতে, এমন কি
সুন্দরীতমার মুখ নিমেষেই পারে না ফোটাতে ফুল শোণিতে ফুল শোণিতে আমার!
আজকাল যখন ঘুমোতে চেষ্টা করি মধ্যরাতে
বাতিটা নিবিয়ে, ঘরময় কবন্ধেরা নেচে ওঠে, কেউ কেউ
টলতে টলতে আসে বিছানার অতি কাছে। কী করব ভেবে
পাই না, কেবল চোখ দু’টো বন্ধ করা রাখি ভীষণ নির্ঘুম
রাতে, ভোর আসে খুব দেরিতে, নিষ্প্রভ চারদিক।
কারা যেন ডাকছে আমাকে দূর দূরান্তের কুয়াশায় মিশে,
ডাকছে ব্যথিত কণ্ঠস্বরে; কথাগুলো
অস্পষ্ট বেজায়, শুধু পাথরের স্তূপে
চাপা দীর্ঘশ্বাস আর কম্পিত ফোঁপানি
আমাকে জড়িয়ে ধরে, যেন আমি প্রবাসী আপনজন। কী-যে
করি, ভেবে পাই না কিছুতে। কানে আসে, ‘বলতো কবি দা’, কেন
প্রলয়ের স্বেচ্ছাচারে বারবার আমাদের বাস্তুভিটা পুড়ে
ছাই হবে? কেন বীথি আর মেনকাকে ধর্ষিতার
টিকলি কপালে বয়ে বেড়াতেই হবে? কেন দেবনাথ আর
গৌতমের তাজা রক্তে ভেসে যাবে নিকানো উঠোন? হায়, শত
বর্ষাতেও মুছবে না এই রক্তধারা, মুছবে না
কস্মিনকালেও। বল কবি দা’ কী হবে আমাদের?’ পাথরের
মতোই নিশ্চুপ থাকব কী? হৃদয়ের ছোঁড়া তন্ত্রী
নিয়ে বলি, ‘শোনো বীথি, তোমাদেরই এই মাটি এই গাছপালা।
এক পাল পশু ধেয়ে আসছে
গোধূলি-স্নাত বারান্দায় খয়েরি পাখিটাকে দেখে
ভালো লাগল না কি মনের
গহনে ভয়ানক হিম হাওয়া বয়ে গেল, বুঝতে
পারিনি। মনে হলো, কারা যেন অত্যন্ত
তাড়াহুড়ো করে আমাকে মলিন স্ট্রেচারে শুইয়ে ঠেলে
নিয়ে চলেছে ঢিমে তালে। ডুবু-ডুবু সূর্য হিংস্র জন্তুর মুখ!
আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে জোড়া-তালি-দেওয়া
আনাড়ি ব্যান্ডেজ ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে দেখছে চারপাশের
রুক্ষ গাছগুলোকে। কী একটা করুণ সুর
ভেসে আসে কে জানে কোত্থেকে। আমার শরীর থেকে টুকরো
টুকরো কি খসে পড়ছে স্টেচারে? মাটিতে? এ আমি
কোথায় চলেছি? স্ট্রেচার-চালকদের প্রশ্ন করতে গিয়ে
ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। তবে কি আমার গলা থেকে কোনও
আওয়াজ বেরুচ্ছে না? না কি ওরা কানে তুলো গুঁজে
রেখেছে ঢের আগে থেকে! এক রত্তি শক্তি নেই শরীরে,
অথচ লাফ দিয়ে মাটিতে দাঁড়াতে ভারি ইচ্ছে করছে।
একপাল পশু ধেয়ে আসছে স্ট্রেচারের দিকে, স্ট্রেচার
চালকরা নির্বিকার, মূক, চৈতন্যরহিত। ভেসে
চলেছি মেঘে, অনেকগুলো নখর আর দাঁত ছিঁড়ে খাচ্ছে
আমাকে। আমি এক লহমায় মেঘ হয়ে, পাখি হয়ে
স্পর্শ করতে চাইছি পূর্ণিমা-চাঁদকে। আমার হাতে ভয়ানক
গরম, পোড়া রুটি, মুখে এক টুকরো পুরতেই বালির মতো
ঝুরঝুরিয়ে পড়া যায়। দূরের মেঘ থেকে নষ্ট ফলের মতো
পড়ছি, পড়ছি, পড়ছি। কে যেন আমার পতন
রুখতে চাইছে তার সোনালি হাত বাড়িয়ে, সেই হাত
ছুঁতে পারছি না কিছুতেই। পড়ছি, পড়ছি, পড়ে চলেছি।
একজন শ্যামলের উক্তি
এখানে ভালোই আছি, বেশ ভালো আছি নানাবিধ
কীটপতঙ্গের মাঝে। কখনও কখনও
গা বেয়ে মসৃণ ওঠে তারা, ইচ্ছে হলে কেউ কেউ
হঠাৎ কামড়ে ধরে। তেমন কিছুই নয়, জ্বালা করে কয়েক মিনিট।
ছোট বড় গাছপালাদের স্নিগ্ধ, নিঃশর্ত সবুজ
মায়ায় ভালোই আছি ইদানীং। কোনও কোনও বন্য প্রাণী দূর
থেকে লক্ষ্য করে এই আহত আমাকে, কেউ কেউ
গা চেটে আমার ফিরে যায় প্রিয় সঙ্গীদের কাছে।
তোমাদের বান্ধব শ্যামল আমি, ভীরু এক নিরস্ত্র যুবক
এ দেশের, পলাতক পুর্বপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে, যেখানে রয়েছে
নিঃস্পন্দ, নিষ্প্রাণ পড়ে বিধবা মা, হিংসা আর লালসা-তাড়িত
নরপশুদের সমবায়ী নিপীড়নে
আমার কুমারী বোনটির কলঙ্কিত, প্রতিবাদী লাশ-এই দৃশ্য
দেখে কাঁপে আকাশ এবং ভাঙা চাঁদ কান্নায় লুকায় মুখ!
এখানে ভালোই আছি গাছপালা, ঝোপঝাড় নানা
কীটপতঙ্গের, পাখি আর পশুদের
দয়ালু সংসারে। না রহিম, না বশির, না আমিন
তোমরা আমাকে আর ফিরে যেতে বলো না সেখানে,
আমি সেই শ্মশানে যাব না। এই ঘোর অবেলায়
যা বলছি, তার উৎস নয় কণ্ঠ। আমার দু’চোখ, লাঠিপিষ্ট
দশটি আঙুল, ভাঙা নাক আর থ্যাতলানো বুক
বিশ্বস্ত কথক এই নিরালায়। প্রিয় বন্ধুগণ, ফিরে যাও
আপন নিবাসে, নইলে তোমরা এখানে
আবিষ্কৃত হলে দ্রুত বনে যাবে পশুদের সহজ শিকার। কোন পশু?
তোমাদেরই প্রতিবেশী, মুখের আদলে
কিছু মিল থাকলেও আচরণে ওরা ঠিক নিখুত জল্লাদ।
যাও, ফিরে যাও ঘরে। তোমাদের প্রতি
নেই কোনও অভিমান, অনাস্থাও নেই। এখানে থাকব শুয়ে
একা রঙধনুর শয্যায়, আহ্লাদিত প্রজাপতি
নাচবে আমাকে ঘিরে, সুকোমল পাখির পালকে
মুছে যাবে খেদ, ক্লান্তি, দু’চোখের জলধারা আর
ভবঘুরে মেঘ গান শোনাবে ঈষৎ দূরে থেকে রয়ে সয়ে
এবং উঠবে সেরে আস্তেসুস্থে আমার বুকের
ক্ষতগুলি, এখানেই গড়ে নেব নিরালা সংসার।
কবন্ধ তাণ্ডব
আজকাল প্রায়শই অনিদ্রা-পীড়িত রাত কাটে। মাঝে-মাঝে
ধু ধু ক্লান্তি দু’চোখ বিছিয়ে দেয় কুয়াশার জাল
বিলম্বিত নিদ্রায় এবং দেখি আমি ভ্রাম্যমাণ
কাঁটাবনে বড় একা। আমার শরীর থেকে রক্ত
ঝরছে তো ঝরছেই আর পর মুহূর্তেই আমার মাথাটা
খাচ্ছে গিলে অর্ধেক- নেকড়েরূপী জীব।
আচমকা দুঃস্বপ্নের ধোঁয়া ছিঁড়ে জেগে
উঠেছি বলেই মনে হয় নাকি প্রকৃতই কোনো ঘোরে বন্দি
হয়ে আছি? সুতপা চাঞ্চল্যে তুমি সুললিত কৈশোরের বেড়া
ডিঙিয়ে যৌবনে পৌঁছে বুনেছিলে কত না স্বপ্নের অত্যুজ্জ্বল
মায়াজাল, ছিলে মগ্ন অপরূপ ঘোরে। সুতপা, তোমার আর
প্রমীলার পূর্বপুরুষেরা অবিরল
ঝরিয়েছে ঘাম এ দেশের শ্যামল মাটিতে। রোদে পুড়ে
অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ফলিয়েছে সোনালি ফসল। অবিনাশ,
তোমার জনক এই এলাকায় সুশৃঙ্খল বিদ্যানিকেতনে
মানুষ গড়ার কারিগর রূপে কাটালেন সারাটি জীবন
তবু, অবিনাশ, নিজ বাসভুমে নিজ চোখে তোমাকে দেখতে হলো
সহোদরা সুতপা এবং প্রমীলার কুমারীত্বহরণের
পৈশাচিক লীলা আর রক্তাপ্লুত বাবা মা’রে নিঃসাড় শরীর
বিধ্বস্ত বাস্তুভিটায়, ক্ষণকাল আগেও ছিল যা ছিমছাম,
রুচিশীল। প্রতিরোধ ভঙ্গুর, নিষ্ফল ছিল। সুতপা, প্রমীলা
পাথরের মতো ছিল নিথর, নিশ্চুপ; অবিনাশ, তুমি নিজে
ভীষণ আহত, প্রতিবেশীগণ ভীত, পলাতক। আমরাও
অতিশয় ব্যর্থ, অসহায়, যোজন-যোজন দূর থেকে ছুটে
এসে ঠিক পারিনি দাঁড়াতে তোমাদের পাশে
বাড়িয়ে মৈত্রীর হাত রুখে দিতে কবন্ধ তাণ্ডব। এ ব্যর্থতা
প্রেতচ্ছায়া হয়ে প্রায়শই জুড়ে দেবে বিভীষিকাময় নাচ,
আমরা ধিক্কারে বিদ্ধ করব নিয়ত নিজেদের।
কবির রক্ত
কখনও দূরের নীল, ভাসমান মেঘ, উড়ে-যাওয়া
পাখির ধূসর পঙ্ক্তি, সতেজ সবুজ
ফ্লাটের রেলিং ধরে দাঁড়ানো কিশোরী কিংবা পথের ভিখিরি
লোকটার মাথার জটিল কুঞ্জে সাড়া জাগায় এবং
রং-বেরঙের শব্দমালা তৈরি হয়। তবে তার
পায়ের তলার মাটি সবচেয়ে বেশি অর্থময় এবং গভীর পঙ্ক্তি
কে জানে কেমন গূঢ় রসায়নে সৃষ্টি করে কখনও নিমেষে
কখনও-বা সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে।
বারবার শুধু শব্দমালা তৈরি করা ছাড়া বিফল সে
অন্যসব কিছুতেই। প্রায়শ লোকটা
ঠেকায় আপন মাথা মৃত্তিকায়, কোনও কোনওদিন
চেয়ে থাকে ধূলিকণাদের দিকে-পথচারীদের
চোখে পড়ে কখনও সখনও। কেউ কেউ তাকে ঘোর
উন্মাদ ঠাউরে হেসে যে যায় গন্তব্যে চলে যায়,
কেউ-বা প্রলুব্ধ হয় ঢিল ছুঁড়ে দিতে। আপন গহনে সেই
অক্লান্ত ডুবুরি উদাসীন খুব হাসি-মশ্করার প্রতি।
এমন মৃত্তিকালগ্ন সত্তার সতেজ রক্তধারায় দেশের
মাটি ভাসাবার হিংস্র ফিকিরে মাতাল
কিছু লোক, এ-কথা জেনেছে কবি। কবিতার সিঁড়ি গড়বার
ফাঁকে ফাঁকে ভাবে সে বিষণ্নতায়, ‘যদি মাতৃভূমি
ভীষণ তৃষিত, তবে সেই ধূ ধূ পিপাসা মিটুক
শোণিতে আমার আর ফুটুক গোলাপ তার বুকে।‘
কিংবদন্তির কথা বলে যাবে
আখেরে চলেই গেলে কী শীতল নিস্তদ্ধতা একটি বছর
আপন নিবাসে রেখে মিলে গেলে মেঘে
অলীক পাখির মতো অনন্তের সীমাহীনতায়।
একটি কথাও তুমি বলোনি তোমার প্রিয়তমা
মণির উদগ্রীব কানে, কাকাতুয়া, তনয়া তোমার,
শোনেনি তোমার প্রিয় ডাক, শুনবে না কেউ আর।
না হয় ক’জন অর্বাচীন তোমার পবিত্র পোশাকের নাম
ধুলোয় লুটিয়েছিল, গিলে ছিল থোকা থোকা কাদা,
নিজেরাই করেছিল অপমান নিজেদের, কেন
তুমি উহাদের তুচ্ছ ভেবে ক্ষমাই করোনি তুচ্ছতর? কেন
নিজেকেই দিলে শাস্তি ক্রাইস্টের মতো?
আজ মেঘে মেঘে নিজে মেঘ দেখছো বান্ধব,
তোমার একান্ত প্রিয় খাতা কবিতা বিহনে আজ
কী ভীষণ ধূ ধূ! তোমার আপন ঘরটিতে
ভ্রমর এবং প্রজাপতি এসে ঘুরে ঘুরে ফিরে যাবে, তবু
হবে না কবিতা আর তোমার হাতের স্পর্শে,
কলমের কালির আভায়
মেঘে মেঘে ভেসে তবু তুমি
এ দেশের অগণিত মানুষকে কিংবদন্তির কথা বলে যাবে।
কেন যে উন্মাদ হয়ে যাইনি
সত্যি বলতে কী, এই উপসর্গ সাম্প্রতিক বটে-একাকীত্বে
ডুবে প্রিয় পুস্তকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কিংবা
কৃপণ আকাশে চোখ রেখে কিছু ভাবলে অথবা
কাঙ্ক্ষিত ইয়ার-বন্ধুদের মজলিশে মশগুল
থাকার কালেও আচমকা মনে হয়,
কেন যে উন্মাদ হয়ে যাইনি এখনও!
ভোরবেলা সংবাদপত্রের দিকে তাকালেই দু’চোখে কেমন
উদ্ভট সার্কাস, বিভীষিকা পাক খেতে থাকে
অবিরাম; অস্ত্রের বেলেল্লা জয়োল্লাস, যাদের সিঁথিতে আজও
সিঁদুরের ছোঁয়াটুকু লাগেনি, তাদের
সম্ভ্রম লুটেছে যারা সগৌরবে তারা
মুহূর্মুহু করে জয়ধ্বনি লুণ্ঠিত, আহত পাড়াগাঁয়।
এই যে প্রত্যহ আমি একালে কামাই দাড়ি, গোসলখানায়
পানি ঢালি গায়ে, নাস্তা খাই যথারীতি,
দিব্যি উপভোগ করি গাছের পাতার মৃদু নাচ-হায়, আজ
এসব কি সাজে আর? কেন যে উন্মাদ হয়ে যাইনি এখনও,
দেখছি ব্যথিত মানবতা যাচ্ছে হেঁটে, পায়ে যার
লোহার শেকল আর হাতে
হ্যান্ডকাফ, মাথা উঁচু কণ্ঠে শেকল ছেঁড়ার এক স্তিমিত প্রয়াস?
কোকিল মূক হয়ে থাকে
অতিশয়োক্তি হবে না, যদি বলি সময়টা ছিল
মাতাল, অন্তত আমার জন্য। সদর স্ট্রিটের
ল্যাম্পপোস্টে বসে-থাকা পাখি, পথের ধারে
ধুলোর ঘর-বানানো বালকের ঠোঁটের ভঙ্গি, মাটি
আর মামুলি তারের তৈরি ছোট্র বেহালায়
ফিল্মি গানের সুর-বাজানো পথিক শিল্পীর হাঁটার ছন্দ
আমাকে মুগ্ধ করতে খুবই। চা-খানায় ইয়ার-বন্ধুদের
আড্ডায় রোজানা শরিক হওয়া, নানা স্বপ্নের ফানুস ওড়ানো,
দূরের আসমানে মেঘে মেঘে সাঁতার কাটা
ছিল আমার নিত্যকার কাজ। আধুনিক কবিতায় নিয়ত
বুঁদ হয়ে থাকতে পেরেছি বলেই
পেয়েছি স্বর্গসুখ এবং প্রায়শ বেদনাবোধ দখল করেছে
আমাকে। সেই উদ্দামকালে যৌবনের দুপুরে
একজন তরুণী আমার দু’চোখে, হৃদয়ে ছড়িয়েছিল সাতরঙা স্বপ্নাভা।
প্রণয়-নিকুঞ্জে মিলিত হয়েও তরুণী সৃষ্টি করল উপেক্ষার মুদ্রা,
আমার অনাবিল স্বপ্ন ভেঙে-পড়া কাচের পাত্রের মতো
আর্তনাদ করে উঠলো। আজ এতকাল পরে হঠাৎ
কখনও মনে হয়, আমার জীবনের অতি সংক্ষিপ্ত সেই অধ্যায়
কত বছর আগেকার সমুদ্রতলে নিমজ্জিত নৌযানের মতোই
অতিশয় ক্ষয়া, বাতিল। হয়তো কালেভদ্রে
ভাবনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে উঠবে আর নিজের
প্রাচীন আহাম্মকির কথা মনে করে হাসিতে ফেটে পড়বে হৃদয়।
তারপর জীবনের নানা বাঁকে কত না মোহিনী-মুখ চকিতে
চন্দ্রিমা হয়ে মিশেছে অমাবস্যায়; শুধু গৌরীর
নিরুপম সত্তার আভা আজও বসন্তবাহার হয়ে প্রহরে
প্রহরে সুর বিস্তার করে। সত্যি-সত্যি জীবন
দেখিয়েছে কত না খেল, নেচেছি বানর কিংবা
ভালুকের মতো পাকা খিলাড়ির হাতে। মাঝে মাঝে
হঠাৎ বেঁকে বসেছি বটে। ফলত কিছু ব্যর্থতা কিছু সাফল্য
হেঁটে গেছে পরস্পর হাত ধরাধরি করে। এখন
আমার জীবন ঝুঁকেছে অস্তাচলে না, কোনো
হাহাকারকেই দেব না আমল, মাথা রাখব উঁচু সারাক্ষণ।
হিসেব নিকেশে দড় নই কোনওকালেই। কী খরায়,
কী স্নিগ্ধ বর্ষণে রয়েছি অবিচল জীবনের এই গোধূলি-লগ্নে
গৃহিণীর দিকে তাকিয়ে লক্ষ করি, একদা রূপকোমল মুখ
এখন কেমন এবড়ো-খেবড়ো জমির মতো। হঠাৎ কখনো
ইচ্ছে হয় হাত বুলিয়ে মসৃণ করে দিই। ঝড়-ঝাপটা তো
কম হয়নি ওর ওপর। ভাবি, যদি এই মুখ কোনো ইন্দ্রাজালে
সেই কবেকার বিকেল-ছোঁয়া বারান্দায় অথবা
বাসর-রাতের প্রস্ফুটিত চেহারায় রূপান্তরিত করতে পারতাম।
আজো কোনও কোনও রাতে আলো আঁধারিতে ওর গালে,
ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিই ব্যর্থ শিল্পীর ধরনে।
ঘুমে ভাসমান শরীরী যুগ্মতায় তুষার ঝরে, পাতাহারা
রুক্ষ গাছে কোকিল ডেকে উঠতে চেয়েও মূক হয়ে থাকে।
কোথায় চলেছি
কোথায় চলেছি এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে? জানি না
কতটা
পথ আরো বাকি; এদিকে তো পথিকের
পাথের ফুরিয়ে এল প্রায়। নাছোড় তেষ্টায়
শুকিয়ে এসেছে গলা, এক ফোঁটা পানি নেই এখানে
কোথাও।
খানিক জিরিয়ে নেব, তার জো গায়েব। পড়ি মরি
কদম বাড়াতে হবে প্রতি মুহূর্তেই। যতক্ষণ
বুকে জীবনের ধুকধুকি আছে, ভবিষ্যৎ পাশা
খেলবে চালিয়ে যেতে হবে নিত্যদিন, মুখে হাসি
ফুটিয়ে রাখার রঙচঙে ভড়ং সাজিয়ে আজও।
কীসে যেন হঠাৎ ঠোকর খাই, মানুষের হাড়
নাকি অন্য কিছু আচমকা
আমাকে দেখতে চায় ভয়। মনে হয়, চারদিকে
থেকে মাতালের মতো টলতে টলতে
আসছে আমার দিকে কতিপয় সফেদ কঙ্কাল। জেগে উঠি,
মেরুদণ্ডে ভীষণ শীতল জলধারা বয়ে যায়।
মাথা ঘোরে প্রচণ্ড গতিতে, খাবি খাই খরাপীড়িত
মাটিতে।
কখন যে চেতনা পেলাম ফিরে, বলা মুশকিল;
জেগে দেখি
অপরূপ আসমান সস্নেহে আমাকে
করাচ্ছে কোমল স্নান সত্তায় জ্যোতিধারা মেখে।
এই যে বলছি স্মিত কথা, এসব কি সত্য নাকি
স্বপ্নের ভগ্নাংশ কোনও? অথবা পাঁচালি
কাল্পনিক?
খুঁজছি সেই যুবাকে
খুঁজছি সেই যুবাকে, যে এক প্রসন্ন বিকেলে
আমাকে দেখিয়েছিল হারিয়ে-যাওয়া আমার
সদ্য-কৈশোরের ঈষৎ ঝলক। একা একা
হাঁটছিলাম, বয়সের ভারে ক্লান্ত, কিন্তু কী এক প্রত্যাশার
তাড়নায় ঘুরে বেড়াচ্ছি দৃষ্টিকে জাগ্রত রেখে।
কিছুক্ষণের জন্যে পাওয়া সেই যুবককে
পুনর্বার হারিয়ে ফেলার ব্যর্থতা
বয়ে বেড়ানো আমার সাধ্যাতীত। নিষ্প্রাণ হয়ে যাব।
যখন দেখেছি কোনও ঝকঝক তরুণকে, তাকে
এভাবে পরখ করছি যে, সে আমাকে কোনও
তালেবর গোয়েন্দা ঠাউরে নিতে পারত! লজ্জিত আমি
দ্রুত পালিয়ে মান বাঁচাই।
আমি যে তরুণের খোঁজে আজ এমন দিশেহারা,
সে তার অজান্তে আমার স্মৃতিকে
মোহন চঞ্চল করে তুলেছে, এমন এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে,
যা আমার হৃদয়ে অতি-পুরাতন রৌদ্র-জ্যোৎস্নাকে
নব্য রূপায়ণে ঢেলে সাজিয়েছে। ওর
তরুণ কণ্ঠস্বরে ছিল যমজ সৌন্দর্যের রূপকথা!
সে আমাকে গুনিয়েছিল গাছপালাময়
দীর্ঘ এক গলির কথা, অপরূপ প্রশন্ত এক
দাওয়ার কথা, দুই যমজ সুন্দরী বালিকার কণ্ঠস্বরে
আরবী শব্দাবলীর সুর, ওস্তাদজীর গম্ভীর আবৃত্তি
আর একজন কৌতূহলী বালকের মুগ্ধ, সতেজ দৃষ্টি। নিষ্পাপ
নৈকট্যের যমজ আভা আজও এক প্রায়-বৃদ্ধকে
কোনো ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুরের মতো
আলিঙ্গন করে। সেই প্রায়-বুড়ো লোকটা
উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে সত্য ঘটনাবলীর
বর্ণনাকারী তরুণকে, যে কোথায় হারিয়ে গেল, কে জানে!
গাঁও গেরামের লোক
গাঁও গেরামের এক লোক
শহুরে বাজার থেকে কেনে
ছোট ফ্রক, লুঙ্গি, নীল শাড়ি,
পাশ ঘেঁষে দূরন্ত মিছিল
নানান স্লোগান হেঁকে যায়,
গাঁও গেরামের লোক কিছু
না বুঝেই ভিড়ে মিশে যায়
এলোমেলো ভাঙচুর, গুলি
রাতে গাঁও গেরামের লোক
এক মর্গে শীতল ঘুমায়।
ঘরবাড়ি
এ শহরে আমার একটি ছোটখাটো, শাদাসিধা
আস্তানা রয়েছে, যাকে লোকে
প্রথামতো বাড়ি বলে থাকে। সেখানে আমার এক
জীবনসঙ্গিনী, একজন পুত্র, পুত্রবধূ
এবং দু’জন পৌত্রী আছে। উপরন্তু বুড়োসুড়ো
আমিও বাসিন্দা বটে। কোনওমতে দিন কেটে যায়;
ক’বছর আগে কল্যাণী ছায়ার মতো
উপস্থিতি ছিল জননীর। মাঝে মাঝে
আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুবান্ধব আসেন, কথাবার্তা চলে
যথারীতি; স্বল্পভাষী আমি বেশি চুপচাপ থাকি।
কোনও কোনও দিন মনে হয়, একজন
করুণ উদ্বাস্তু আমি, সম্বলবিহীন। ঘোর অমাবস্যাময়
চতুর্দিক, ভয়ানক শূন্যতা এবং স্তব্ধতার হাহাকারে
শুধু এক মুঠো ধুলো হয়ে আছি ধূ ধূ পরিচয়হীনতায়।
ঘরে-ফেরানো গানের জন্যে
আমি কোনও দিগ্বিজয়ী সম্রাট নই, নই তো কোনও পরাক্রান্ত
ভূ-স্বামী, একম কি জাঁদুবেল কোনও রাজনীতিবিদ অথবা
দাপট-দেখানো আমলাও আমাকে বলা যাবে না, তবু সমুদ্র
প্রায় অষ্টপ্রহর চামর দোলাচ্ছে আমারই উদ্দেশে যেন আরাম
আয়েশে কাটে আমার সময়। শুধু তাই নয়, এইমাত্র সমুদ্রের
বুক ছেড়ে পূর্ণিমা-চাঁদ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তার নিরুপম মুখ
বাড়ালো চেন্নাইস্থ আমার অস্থায়ী আস্তানা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অতিথিশালার উঁচু ঘরের দরাজ জানালায়। ‘স্বাগতম’ বলে
চমকে ওঠে আমার দু’চোখ আর হৃদপিণ্ড। এমন মুহূর্তে ওকে
চন্দ্র নয়, চন্দ্রা, বলে ডাকতে ভারি সাধ হলো। তার স্বর্গীয়
রুপোলি চুম্বন আমি গাঢ় অনুভব করলাম আমার তৃষ্ণার্ত
ওষ্ঠে, যেন একটি গীতিকবিতা জন্ম নিল মহা মুহূর্তে।
চাঁদ ডুবে গেলে চাঁদিনীর স্মৃতি জেগে রয়। এখন এই
মুহূর্তে আমার মনে কয়েকটি প্রিয় মুখ চাঁদের চেয়েও অধিক
প্রাধান্যে ভাস্বর-এই তো দু’জন শিশু নয়না আর দীপিতা আমাকে
জড়িয়ে ধরেছে আনন্দর ঝর্ণা ঝরিয়ে। আমি ব্যাকুল চুমোয়
আচ্ছন্ন করি ওদের হঠাৎ কী-যে হলো, অকস্মাৎ জ্যোৎস্নাকে
খুন করে অন্ধকার ছেয়ে যায় চতুর্দিকে সন্ত্রাসীর মতো। কবে
আবার খুঁজে পাব অভীষ্ট রোদ্দুর কিংবা জ্যোৎস্নাধারা
যেখানে আজ যেতে চাইছি প্রবল ব্যাকুলতায়, সেই গন্তব্যের
দিকচিহ্ন খুঁজে পাচ্ছি না কেন? সমুদ্রের জ্যোৎস্নাময় ঢেউগুলি মুছে
গেছে, কয়েকটি কঙ্কালসার গাছ দাঁড়িয়ে আছে নিষ্কম্প,
দরিদ্র। সরে যাচ্ছি দূরে, কোন্ সুদূরে? তোমরা যেতে দিওনা
আমাকে। আমার হাত ধরো, গাও ঘরে-ফেরানো গান।
ঘাসের সবুজ ঘ্রাণ
এ রকমই হয় নাকি? হঠাৎ দরজা
বন্ধ হয়ে যায় জোরে মুখের ওপর। এভাবেই
কাটে বেশ কিছুকাল। মনে পড়ে কত কথা, কত
নিবিড় ঘটনা বারবার পুরনো সুরের মতো।
কিছু স্মৃতি মুছে যায়, কোনও কোনও স্মৃতি
বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো কিছুতেই যায় না কোথাও সরে,
সঙ্গ দেয় সুখে দুঃখে, রুক্ষ রোদে, তুমুল বৃষ্টিতে
ছাতা মেলে ধরে।
আবার ডেকেছ তুমি সব উম্মা ঝেড়ে ফেলে, দিয়েছ দুয়ার
খুলে, যেন চলে আসি দ্বিধাহীন, অথচ এখন কয়েকটি নিষ্ঠুর বাদুড়
দরজা আগলে রাখে রক্ত চোষার আশায়; তবু
তোমার নিকট যেতে বড় সাধ হয়। প্রতীক্ষার
কাল বড় দীর্ঘ, কাঠ ঠোকরার মতো রক্ত মাংস ছিঁড়ে নেয়।
পারি না তোমার কাছে যেতে। মনে পড়ে,
গুরুজনদের দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা
কতদিন চলে গেছি গোধূলি বেলায় দূরে কোনও
জনহীন মাঠে আর নিয়েছি সবুজ ঘ্রাণ সতেজ ঘাসের,
কতকাল দেখি না তোমাকে, ইচ্ছে হয় একবার
দেখে আসি পরমুহূর্তেই ইচ্ছে উবে যায়; শুধু
দু’টি চোখ, শাদা হাত, ডুরে শাড়ি
এবং মাঠের নম্র ঘাস মনে পড়ে।
ঘুরতে ঘুরতে
ঘুরতে, ঘুরতে,
ঘুরতে, ঘুরতে
ঘুরতে, ঘুরতে
যাই, চলে যাই-যেতে থাকি,
কোথায় যে যাই
নানা অলিগলি, খোলা রাস্তা
দরদালানের ভিড় পেরিয়ে অনেক
দূরে বিয়াবানে, নদীতীরে
চলে যাই, যাই হেঁটে হেঁটে। ঘাম মুছি,
বসে পড়ি বটমূলে। পাখিরা ভীষণ বোবা, সাঁই সাঁই হাওয়া।
আমার ভেতরে একজন নড়ে ওঠে,
কথা বলে, ভাষা তার কিছু বুঝি, কিছু বা বুঝি না; আচমকা
বাইরে বেরিয়ে আসে, হাত পাতে। আজব লোকটা
কী চায় আমার কাছে? আমার কিছুই
নেই, অল্পস্বল্প স্বপ্ন ব্যতীত এখন।
আমার স্বপ্নে কি তার ক্ষুধাগ্নি নিভবে?
খরখরে লোকটা জ্বলজ্বলে দৃষ্টি তার
গভীর স্থাপন করে দু’চোখে আমার
‘তোমার স্বপ্নই করো দান, আমি কিছু
স্বপ্ন চাই, আর্তনাদ, হাহাকার চাই
আর হু হু দীর্ঘশ্বাস-প্রসূত সঙ্গীত
চাই, বড় বেশি চাই;
‘নিজেকে উজাড় করে দাও, বলে সে চকিতে নেচে
ওঠে, পড়ে থাকি নিশ্চেতন, একা, পরিচয়হীন।
চর তাকে ডেকে আনে
চর তাকে ডেকে আনে, নদীর সজল হাওয়া তার
যৌবনের ঘ্রাণময় প্রফুল্ল শরীরে, ছলছল
জল তার নগ্ন পদতলে
ক্রমাগত অপরূপ চুমো খায়। তরুণী ছিল না
চরে একা, নিকটের ছিল কয়েকটি পাখি আর
সঙ্গে ছিল তিনজন চটুল তরুণ। অকস্মাৎ, কী-যে হলো
উচ্ছল তরুণ ওর সঙ্গীগণ বনের পশুর
রূপ ধরে সন্ত্রস্ত নারীর
সম্ভ্রম লুণ্ঠনে মাতে। নখরের, সুতীক্ষ্ম দাঁতের
দংশনে কোমল সৌন্দর্যকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে আর
গোধূলি, নদীর ঢেউ, পাখি, চর, ক্ষোভে, তীক্ষ্ম ক্রোধে,
বেদনায় স্তম্ভিত ভীষণ।
চেন্নাইয়ের এক প্রত্যূষে
চেন্নাইয়ের প্রত্যূষের সুনীল আকাশ সাবলীল
মিশে যায় সকালে ঢাকার নিভে-ব্লু আসমানে। মনে পড়ে,
শ্যামলীর বাড়িতে এখন
ওরা ঘুমে অচেতন; সম্ভবত টিয়া রান্নাঘরে
প্রাতরাশ তৈরি করে জিরোচ্ছে খানিক। দীপিতা কি বিছানার
ওমটুকু ছেড়ে চোখ কচলাতে কচলাতে খুঁজছে মায়ের
কোলের আশ্রয়? এইমাত্র গলিপথে কেউ কেউ
বেরিয়েছে বাড়ি ছেড়ে স্বাস্থ্যের সন্ধানে সুবাতাসে।
জানিনা কখন কোন্ ক্ষণে ঘরে ফিরে
যাব এই নীল সমুদ্দুর, এই অটো-অধ্যুষিত
পথ, এই জরুরি শঙ্কর নেত্রালয়, অপারেশানের
উদ্বেগমথিত প্রহরের অবসানে। এই অতিথিশালায়
ঘুম থেকে জেগে শুনি কাকের কোরাস,
কখনও কখনও ভেসে আসে যেন কোকিলের গান
প্রত্যূষের নিঝুম প্রহরে। এ আমার
বিভ্রম হ’লেও ক্ষতি নেই, শুয়ে শুয়ে ঘরে ফেরার মুহূর্তে গুণি।
অকস্মাৎ মনে হয়, ভেলা আমি ভাসিয়েছি সমুদ্রের বুকে,
গন্তব্য অজানা আর পাথেয় কিছুই নেই, শুধু
এক সংজ্ঞাহীন চঞ্চলতা বাইরে এনেছে টেনে
ভেঙে চুরমার হলে ভেলা, ভোজ্য হবো কিছু জলজ প্রাণীর।
জনৈক পথচারী
একজন পথচারী বটবৃক্ষতলে
কাপড়ের থলেটা গচ্ছিত
রেখে গেল দিঘির কিনারে দ্রুত পায়ে
পিপাসা মেটাতে, যেন তার পথ
চলাতেই গভীর আনন্দ পুনরায়।
বিকেলের আলো মুছে সন্ধ্যা
কী দ্রুত দখল করে বটবৃক্ষটিকে।
অনুপস্থিত সে পথিকের ছিন্নভিন্ন পুঁটলিটি
প্রায় শূন্য, কিছু মুড়ি, একটি পুতুল
পড়ে থাকে শোকগাথা হয়ে।
জন্মদিনে ভেজা চোখ
এখন আমার ঘরে সমুদ্রের ঢেউ নৃত্যপর, ফিসফিসে
কথা বলে সুন্দরবনের গাছপালা, নানারঙা
পাখি রয়ে সয়ে সুর ঝরায় এবং
টেবিলে ঘুমিয়ে থাকা কবিতার খাতা
অকস্মাৎ জেগে উঠে লাজনম্র আমন্ত্রণ জানায় উৎসুক
কলমকে। একজন প্রজাপতি ‘জন্মদিন শুভ হোক’ বলে
হেসে উড়ে দূরে চলে যায়; অনুপস্থিত মায়ের
কল্যাণী হাতের স্পর্শ থেকে মহরুম পুত্রের দু’চোখ ভেজা।
জ্যোৎস্নাময়ী
ইদানিং কী-যে হয় ঘন ঘন, বুঝে
উঠতে পারি না কিছুতেই। আসমানি
পূর্ণিমা-চাঁদের মুখ চোখ পড়লেও অকস্মাৎ
চারদিকে ঘোর অমাবস্যা ছেয়ে যায়।
পূর্ণিমা শব্দটি শাদা কাগজে লেখার ভাবনায়
চকিতে উল্লাপাড়ার পূর্ণিমার মুখ
দৃষ্টিপথে এসে পড়ে। পূর্ণিমা, হে বোন আমাদের
নরপশুদের বন্য থাবা।
তোমার সত্তায় কালো ছড়ালেও, ঘোর আঁধারেও
তুমি পরিস্ফুট পুষ্প, জ্যোৎস্নাময়ী।
ডুবে যেতে যেতে
অন্তর্গত নৈঃসঙ্গে আমার দিন যায়, তুমুল ভিড়েও আমি
নৈঃসঙ্গের তুষার-তুফানে ডুবে থাকি। কখনও নেকড়ে টুঁটি
চেপে ধরে; দিন তো যাবেই চলে, যেভাবেই হোক কেটে যাবে,
কখনও হয়তো চক্রাকার ঘুরে ঘুরে
কখনও-বা ধুঁকে ধুঁকে। স্বস্তি নেই, শান্তি নেই, মাথার উপর
সর্বদা ঝুলবে তৈরি মনে, ঘরে থাকা
হবে দায় আতঙ্কের থাবার সন্ত্রাসে।
তবুও তোমার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে অতীত দিনের
ঝলমলে কত না প্রহর কাটিয়েছি
আমরা দু’জন স্বর্গতুল্য স্থানে, যেখানে পাখিরা গানে
সাজিয়ে দিয়েছে অনুরাগে আমাদের
অনন্য মিলনক্ষেত্র। তোমার চুম্বনে
অমরতা পেয়ে গেছি ভেবে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধেছি তোমাকে।
চকিতে কে যেন ভেংচি কেটে আমাদের অপরূপ
বাসর গুঁড়িয়ে হো হো হেসে ওঠে, আমি
ভীষণ জখমি এক সৈনিকের মতো পড়ে থাকি এক কোণে
কর্কশ ধুলোয় আর বিপন্ন আমাকে
ঘিরে কতিপয় নৃত্যপর অর্ধেক মানুষ আর
অর্ধেক ভয়াল পশু। চারপাশে অগণিত হাড়,
করোটি ছড়ানো। নাচ থেকে গেলে অর্ধপশু আর
অর্ধ-মানুষেরা দাঁত নখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসে
আর আমি ভীষণ প্রমাদ গুণে হাল
ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করি, প্রখর দুর্গন্ধে ডুবে
যেতে যেতে শুনি অসহায়, ভীত গোপার করুণ
আর্তনাদ, চারদিকে হাতড়াই, যদি হাতিয়ার পেয়ে যাই।
তবুও বাঁচতে চাই
ক’বছর কেটে গেছে, পথের নিস্পৃহ ধুলোকণা
ছোঁয়য় না আমার পদযুগ। আমার শুভর্থীগণ
খোলাপথে হেঁটে যেতে করেন বারণ বারবার।
কেননা তাদের মতে, বহুরূপী বিপদের ঝুঁকি
ফাঁদ পেতে আছে
আমার উদ্দেশে চারদিকে। ধাবমান মোটরের
গুহা থেকে রাইফেল অথবা কুঠার
কিংবা আচমকা কোনও পথচারীর ভীষণ চকচকে
ছোরা বড় বেশি রক্তপায়ী হয়ে উঠবে আমার
কোনও নীলনকশার নির্দেশে
তাহ’লে কি মেঘে মেঘে হাঁটব একাকী? সন্ধ্যারাতে
উঠব আড্ডায় মেতে অতিদূর নক্ষত্রপাড়ায়
মধ্যবিত্ত জীবন রক্ষার অসম্ভব তাড়নায়? কিন্তু এই
বিপন্ন মানুষ আমি কীভাবে থাকব প্রিয়জন
আর এই শিশুদের ছেড়ে যাদের কাঙ্ক্ষিত সান্নিধ্যের স্নিগ্ধ
তাপ নিত্য করি উপভোগ? খাঁটি বন্ধুদের মুখ
দেখতে পাব না, বুদ্ধিদীপ্ত কথা শ্রুতির বাইরে
থাকবে সর্বদা, ভাবাটাই মুশকিল। এখানেই
এই হট্রাগোলে, এই হাঙ্গামায়, প্রিয়জনদের
ভালোবাসা, আন্তরিকতার অপরূপ সুঘ্রাণে বাঁচতে চাই।
তেজি পতাকা
কেন যে বার বার হোঁচট খাচ্ছি, যাচ্ছি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
ভুল পথে? কেন আমার সকল স্বপ্ন
দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়? আনন্দের কলি ফুল হওয়ার আগেই ঝরে যায়
ধুলোয়, ঝরার মুহূর্তে ভুল হয়ে
কীটদলকে আমন্ত্রণ জানায়। পাথরে
ঠোকর খেতে খেতে দু’পা ভীষণ জখমি। মরা জ্যোৎস্নায়
রক্ত বিন্দুগুলো নক্ষত্র হওয়ার ভড়ং-এ মশগুল, আমি
রক্তপিপাসু মাকড়সার জালে আটকে পড়ে থাকি।
ইচ্ছে হয় এক ঝটকায় হিংস্র জাল ছিঁড়ে
বেরিয়ে আসি খোলা হাওয়ায়, সতেজ সবুজে
আঁজলা ভরে পান করে ঝর্ণাধারা মেটাই তৃষ্ণা,
ধুয়ে ফেলি সকল ক্ষত, ভোরের তাজা আলোয়
রূপান্তরিত হই নব্য মানবে। যার হাত পাহাড়
টলিয়ে জর্জরিত জমিনে ফলাবে ফসল এবং
হতাশায় নুয়ে পড়া, ঘুমে বিহ্বল পথিকদের জাগিয়ে তুলবে।
অথচ আমার সময় বড় কম। উপহাস, ধিক্কার, চরম ঘৃণা
আমার উদ্যামের অঙ্করটিকে ছিঁড়ে ডাস্টবিনে
ছুঁড়ে দেয় ক্ষুধার্ত কুকুরের খাদ্য হওয়ার জন্যে! আমার
ব্যাকুল আবেদন, আমার স্বপ্নের মহিমার কথা,
যুগবদলের ব্যাকুলতা আগ্রাহ্য থেকে যায় অনেকের কাছে;
আমার স্বপ্ন ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো মুখ থুবড়ে
পড়ে থাকে ধুলোয়। চকিতে ক্লান্ত চোখে পড়ে, তিনজন
আগ্রহী কিশোর আমার স্বপ্ন কুড়িয়ে নিয়ে তেজি পতাকা বানায়।
তোমরা পালিয়ে যাবে?
পালাবে? পালিয়ে যাবে? আখেরে পালিয়ে যেতে চাও?
ভাবছো কি না পালিয়ে রক্ত রক্ষা নেই আর
নিজ বাসভূমে? হায়, এই
ঘরদোর, নিকানো উঠোন, স্নিগ্ধ বাগানের শোভা,
দোলনা, পুকুর-ঘাট এবং শিশিরভেজা ঘাস
আর বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ ফেলে
কোথায় পালাবে তুমি? জানি আতঙ্কের ডামাডোলে
দড়ি ভেবে সাপের দিকেই তুমি বাড়াবে কম্পিত দু’টি হাত।
কী করে ভাবছ তুমি, তোমরা করছ ভুল এই
ভিটেমাটি ছেড়ে অজানার দিকে ছুটে গিয়ে? আমি
নিজেই বিশদ জেনে গিয়েছি এখন বিষধর
সাপ কিছু কিছু মানুষের চেয়ে ঢের বেশি নিরাপদ। সাপও
অনর্থক দেয় না ছোবল কাউকেই,
অথচ হিংসার বল্গাহীন
খেলায় হেলায় মেতে ওঠে মানুষের তক্মা-আঁটা
জীবগুলো। বলো শ্যাম, বলো অনিমেষ,
তোমরা পালিয়ে যাবে? আমার মিনতি শোনা, তোমরা যেও না,
এখনই দাঁড়াও রুখে দলে দলে। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা এই
দেশ তোমাদের। চেয়ে দ্যাখো, এইসব গাছপালা,
নদি-নালা, পথঘাট শুভবাদী তোমাদের উপস্থিতি চায়।
দিগন্তের অন্তরালে
বড় ম্লান বেশ দেখে আমার মুকুন্দরাম হেসে
বললেন, ‘শোনো হে, নাও এই ফতুয়া আমার’ এই
দান সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে পথ চলি ফের সূর্যাস্তের
দিকে মুখ রেখে; অদূরেই ছিলেন অপেক্ষমাণ উৎফুল্ল ভারতচন্দ্র,
এগিয়ে দিলেন যিনি উত্তরীয় তাঁর
দীন পথিকের হাতে। আমি করজোড়ে করি নিবেদন-
আমি এ দানের যোগ্য নই, কবি। দাতা গুটিয়ে নিলেন হাত।
রৌদ্রের চুম্বনে পথ লাজরাঙা হয়।
খানিক পরেই দেখি, পদ্মপুকুরের ধারে সুললিত সুরে
তন্ময় আউড়ে চলেছেন পদাবলি বিদ্যাপতি। হতদরিদ্র আমাকে
দেখে ধ্যান ভেঙে গেলে, তিনি গলার মুক্তোর হার
আমাকে করেন দান অকাতরে। একান্ত কৃতার্থ আমি বলি,
এ হার আমার কণ্ঠে কখনও পাবে না শোভা কবি,
এ দান ফিরিয়ে নিন, বলে পুনরায় যাত্রা করি
সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে। তাড়াতাড়ি
উড়িয়ে প্রচুর ধুলো দিগন্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকি।
তবে কি সাগরদাঁড়ি আমার দৃষ্টিতে
‘স্বাগতম’ পোস্টার এঁকে দিয়েছে চকিতে? চোখে পড়ে
কপোতাক্ষ তীরে মাইকেল প্রগাঢ় অমিত্রাক্ষর ছন্দে
স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছেন, হাতে তাঁর মদিরার
রঙিন পেয়ালা আর আমাকে দেখেই আমন্ত্রণ
জানালেন, ‘ওকে ফেলো, সতত যে সুরা পান করি,
তার কিছু করবে কি টেস্ট? হ্যাভ সাম, দিচ্ছি আমার ফরার্সি স্কার্ফ,
হ্যাভ দিস্ স্মল গিফ্ট। নো, থ্যাঙ্কস স্যার, আপনার
সঙ্গে হ্যান্ডসেক করলেই ধন্য হবো বলে নিজ পথ ধরি।
হেঁটে হেঁটে পরিশ্রান্ত, অথচ মঙ্গলালোকে পৌঁছে
যাই, দেখি রবীন্দ্রনাথের মুখ উদিত সূর্যের মতো। তাঁর
মেটে রঙ আলখেল্লাটিকে চুম্বন করার সঙ্গে কবিকণ্ঠ জাগে-
‘কী প্রার্থনা তোমার পথিক? কবি সার্বভৌম; শুধু আপনার
খানিক চরণধূলি ছাড়া আর চাই না কিছুই।
আখেরে অপরিসীম নগ্নতার আভায় প্রোজ্জ্বল
দীনবেশী আমি যাত্রা করি দিগন্তের অন্তরালে দিগন্তরে।
দুই প্রান্ত
সে ট্রাউজারের খোলা খোলা যমজ পকেটে হাত পুরে
চকচকে মোকাসিন পায়ে হেঁটে যাচ্ছে দিব্যি শিস
দিয়ে প্রিয় আজিজ সুপার মার্কেটের দিকে। সূর্য ঘুমে ঢলে পড়ে।
(বয়স্ক জনক সে যুবার লাঙলে জমিন চষে ঘর্মাক্ত শরীরে আর
জননী জাঙলে খোঁজে উনুন তাতানো সরঞ্জাম।)
সে যুবা নিশ্চিত শাহবাগ ভালোবেসে, এক তার
অপরূপ ঝুলন্ত উদ্যান মনে হয়, কখনও সুদূর অতীতের কোনও
ঝলমলে কাঙ্ক্ষিত সরাইখানা ঢের ভ্রমণের পর। এই
বইয়ের দোকানপাট, ফটোগ্রাফ, রেকর্ড ক্যাসেট ইত্যাদি
জনপ্রিয় পসরা সাজিয়ে বসা সব আয়োজন
যুবকের চেতনায় বস্তুত আরব্য রজনীর
রূপ-রহস্যের ঘ্রাণ নিয়ে আসে কখনও সখনও।
(যুবকের পিতা প্রতিদিন সাত-সকালে ঘুমের
বাজারে গরুর দুধ বিক্রি করে পুত্রের খরচ
চালাতে শহরে। ছেলেটির শিক্ষার আলোয় স্লাত
করবার সাধনায় নিরক্ষর জনক এবং জননীর
নিরস্তর কী প্রাণান্তকর ধীর নীরব সংগ্রাম।)
সে যুবক ল্যাম্পপোস্টে আয়েশে হেলান দিয়ে দ্যাখে
পূর্ণিমা চাঁদকে দ্রুত চেটে-পুটে খাচ্ছে অতিকায়
বুভুক্ষু বেবুন। যুবা যায় কবিদের উতরোল
আড্ডায় এবং দিশি মদের বস্তিতে
ক্রমশ নরক গুলজার। রাত গাঢ় হলে যুবা
নির্বিঘ্ন পল্লীতে গিয়ে বেছে নেবে যে-কোনও রঙিন তরুণীকে।
(তখন গেরামে তার শ্রমশ্রান্ত জনক জননী সন্তানের
ব্যয়বহনের ভাবময় নিষ্প্রদীপ ঘরে ঘুমে ঢলে পড়ে।)
দূর্মর আকাঙ্ক্ষা
আমি তো আপনকার ডেরা থেকে দূরে, বহুদূরে,
শতশত ক্রোশ দূরে চলে
এসেছি তখন এই সমুদ্র কিনারে,
যেখানে তরঙ্গগুলি প্রবল ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্মির ধরনে-
যে সমুদ্রতীরে মাইকেল মধূসূদন একদা রেখেছেন পদযুগ
ধূসর অতীতে, মনে পড়ে। আমি আজ অবেলায়
এলাম অসুস্থ দু’চোখের নিরাময় আশা করে। তারাহারা
আকাশ কি একেবারে বাতিল কাগজ? অবান্তর, মূল্যহীন?
আমিই তো বলেছি সেদিন,
‘শিশুকে রেখো না দূরে, কাছে টেনে নাও’,
অথচ আমারই কাণ্ড দ্যাখো, বড় প্রিয়
দু’টি শিশুকেই বড় দূরে ফেলে রেখে
এসেছি এখানে, বসে আমি একা, আমাকে জড়িয়ে
রয়েছে বিষণ্ন নীরবতা।
কাঁকড়ার মতো ভয় কী হিংস্র দখল করে নেয়,-
যদি দৃষ্টি নিভে যায় একেবারে, যদি কাউকেই
দেখতে না পাই আর, যদি
আখেরে না ফিরে যেতে পারি আপন ডেরায় তবে
কী হবে? কী হবে? দৃষ্টি ফিরে পাই আর না-ই পাই,
নিজের ডেরায় গিয়ে শিশুদের বুকে নিতে চাই।
ধীমান কিষান
দুপুরে পাড়াগাঁর শোকার্ত উঠোনে একজন জননীর
লাশ আর প্রতিহত, রুদ্ধ ক্যামেরার নূর রসায়ন
মাতৃহারা যুবকের অন্তর্গত গহনে আবার
জন্ম দেয় আরেক সন্তান-একই শরীরে দু’জন বসবাস
করে ক্রমান্বয়ে একজন হতে থাকে। জেনে যায়,
বহু বাধা নিশ্চিত ডিঙোতে হবে ঝরিয়ে বিস্তর স্বেদকণা।
দূর পাড়াগাঁর মাটি চিরে ফসল ফলায় আর
গ্রন্থাগারে নানা গ্রন্থ থেকে সু-প্রচুর বীজ করে আহরণ,
প্রত্যহ মনের জমি চষে সত্যের সন্ধানে মাতে
অবিচল ধীমান কিষান আর বাঁধার দেয়াল
তাসের ঘরের মতো ঝরে যায়; অমাবস্যা রূপান্তরে
কখনও চাঁদের আলো, কখনও রোদ্দুর।
কখনও দেখিনি তাকে, তবু মনে হয়, সে সন্ধানী
আলোকিত পুরুষ আমার
আত্মার আত্মীয়; আজ এই সর্বগ্রসী
সঙ্কটে দেখছি একজন যাচ্ছে হেঁটে লামচরি
গাঁয়ের বিজন পথে নদীর তীরে, হাটে-মাঠে, নগরে-বন্দরে
সেই ঋদ্ধ হিংস্র অন্ধকার গুহায় হানছে
ক্রমাগত আলোর কুঠার, হেনে যাবে বহুকাল। তাকে আজ
স্যালিউট করে গুণী, মানসিক খরায় পীড়িত নরনারী।
নিঃসঙ্গ খনন
প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতায় সময়কে বয়ে যেতে দেয় বহুক্ষণ
লোকটা গাছের নিচে। দেখছে না নীল
ঘাসের কুসুম, ভাসমান মেঘমালা, পাখির উড়াল, শুধু
নিজের ভেতরে সুগভীর
তাকিয়ে রয়েছে, দ্যাখে একজন লোক অবিরাম
খুঁড়ছে অন্তর তার। মাঝে মাঝে অন্তর্গত
কাজল মৃত্তিকাখণ্ড করছে পরখ দূরে
সুতীক্ষ্ম অভিনিবেশে শেষে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে।
খুঁড়ছে, খুঁড়ছে নিজেকেই অন্বিষ্ট হীরকখণ্ড সুনিশ্চিত
করতলগত করে নিতে; সময়ের জাল তাকে
ঘিরে ধরে, নিরুপায় খোদক কেবলি
খননে ভীষণ মেতে থাকে। চোখে তার
ক্লান্তির কুয়াশা জমে, হিম
ঘুমের চাদরে সমাচ্ছন্ন নিঃসঙ্গ খননকারী, কী নিথর
শরীর, মগজ আর নিস্তব্ধ হৃদয়। কিয়দ্দূরে
অনন্যা হীরকখণ্ড হাসে শুধু কৌতুকমিশ্রিত হাসি।
নিত্য বেশি টানে
আজকাল কেন যে এমন হয় প্রায়
আমার অজ্ঞাতে, বোঝা দায়। জন্ম এই শহরেই,
তবু মনে পড়ে ঘন ঘন প্রজাপতিময় ক্ষেত,
একটি পুকুর, ভেজা ঘাট, বাঁশবাগানের গাঢ়
ঘোমটার ফাঁকে লাজনম্র রূপসী বধূর মুখ-
মণ্ডলের মতো চাঁদ, প্রবীণ চাচার
মধুর আজান দাদাজানের বানানো মসজিদে
নিবিড় দাঁড়িয়ে আর কোনও পথিকের চলে যাওয়া
পুকুরের পাড় ঘেঁষে। শহরে আমার ছোট ঘরে
পাড়াতলী গেরামের স্মৃতিজাগানিয়া বংশীধ্বনি ভেসে আসে।
মনে পড়ে, খুব বেশি মনে পড়ে মেঘনাতীরের
পাড়াতলী, তবু বছরের পর বছর যাই না সেই গাঁয়।
আমার এ জন্মশহর ঢাকা আর পিতা,
পিতামহদের রৌদ্র-জ্যোৎস্না-ছায়াময়, আজও বিদ্যুৎবিহীন
প্রগাঢ় রহস্যছাওয়া পাড়াগাঁর দোটানায় বাঁচি। ইদানীং
পাড়াতলী পুরানো স্মৃতির মতো নিত্য বেশি টানে।
নীরব অতিথি
নিজের অসুস্থ শরীরটাকে কোনও মতে বিছানা থেকে
সরিয়ে নিয়ে রাখলাম টেবিল-ঘেঁসা চেয়ারে।
টেবিলে গচ্ছিত খাতা আর কলম
তাকাল আমার দিকে। ওদের চোখে জিজ্ঞাসা,-‘ক’দিন
কেন পাইনি তোমার হাতের স্পর্শ? কেন তুমি নিশ্চুপ?’
কলমটিকে হাতে নিয়ে
খেলায় মেতে উঠি। না, শব্দরচনার খেলা নয়, ওকে
স্পর্শের সামান্য উষ্ণতা দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য। কলমের
অভিমান ঝুলেই থাকে ওর মুখমণ্ডলে, খাতা
নিশ্চুপ, শীতল লাশের মতো শুয়ে থাকে এক পাশে।
হঠাৎ একটি ফুটন্ত গোলাপ নর্তকীর ধরনে নাচের মুদ্রা
রচনা করে আমার কানে রাঙা ঠোঁটে
ছুঁইয়ে বলে, ‘কবি, তুমি আমার সঙ্গিনী হারাবার বেদনাকে
প্রস্ফুটিত করো তোমার খাতায়। পাখির কথা ফুরোতেই
একটি ছুটে-আসা নক্ষত্রের রুপালি বায়না
ঝলসে ওঠে, ‘কবি, তুমি আমার স্পন্দিত সৌন্দর্যকে
দীর্ঘজীবী করো তোমার সৃষ্টিতে।
প্রত্যেকের উক্তি আমাকে আন্দোলিত করে, আমি
দুলতে থাকি গোলাপের আনন্দিত নৃত্যের আভায়,
হলদে পাখির বিষণ্নতার ছায়ায়, নক্ষত্রের
সৌন্দর্যের স্পন্দনে! ওদের স্বপ্ন, সাধ
প্রবল আলোড়িত করে আমাকে। জানালার বাইরে
তাকিয়ে আসমানের অপরূপ নগ্নতায়
মিশে যেতে যেতে গোলাপের উচ্ছ্বসিত যৌবন, হলদে পাখির
বিষণ্নতা, নক্ষত্রের স্পন্দিত রূপ আমাকে
অতিশয় চঞ্চল করে। মনে হয়, এই মুহূর্তে
ওদের নিয়ে পৌঁছে যাব কবিতার কাঙ্ক্ষিত ঘাটে।
কে আমার দরজায় এসে দাঁড়ায়? একজন কঙ্কালসার
প্রৌঢ়, পরনে যার ছোঁড়া পিরাণ, ক্ষুধা-জ্বলজ্বলে
দু’টো চোখ, ভয়ানক ক্লিষ্ট অনাহারে,
নিশ্চুপ, অপেক্ষা-কাতর। অসুস্থ আমি
চেয়ার ছেড়ে মানিব্যাগ খুঁজি। দশ টাকার একটি নোট
বের করেই দেখি, সেই নীরব অতিথি উধাও।
তৎক্ষণাৎ কবিতার খাতা টেনে নিয়ে লিখতে
শুরু করি দ্রুত ভূতগ্রস্ততায়। গোলাপ, পাখি, নক্ষত্র
হারিয়ে যায় কোথায়, শুধু নেই হঠাৎ গায়েব-হয়ে যাওয়া
কঙ্কালসার অতিথির উপস্থিতি রূপায়িত খাতার পাতায়।
নেহারের জন্যে
নেহার, ছোট্র বোন আমার, বহুকাল পর
তোকে আবার মনে পড়ল। মনে পড়ল, তুই
আমার পেন্সিল আর কলম নিয়ে
মেতে উঠতি খেলায়। আমার খাতার পাতা
কী সব এঁকে ভরিয়ে তুলতি। জানি না তোর সেই
আঁকিবুকি অনেক পরে আমার খাতায়
পদ্যের পঙ্ক্তিমালা সাজানোর প্রেরণা জোগাত কিনা।
নেহার, তোর অমন সৌন্দর্য-ছড়ানো মুখটি
ফুল হয়ে ফোটার আগেই একটি কলিকে সংহার
করল মৃত্যু বড় আক্রোশে। তোকে ছিনিয়ে
নেয়া হলো আমার সান্নিধ্য থেকে।
আজ একটি উঁচু দরের পুরস্কার পাওয়ার সময়
বারবার তোর কথা মনে পড়ছিল আমার।
খেলায় মগ্ন হতি, সেই কমলেই আমি প্রথম
লিখতে শুরু করি তোর চলে যাওয়ার কথা। আমার
কেন জানি মনে হয় নেহার, তোর হাতের স্পর্শময়
কলম দিয়েই সবসময় কবিতা লিখছি। সেই কলম
আমার ওপর ভর করে, দেয় প্রবল ঝাঁকুনি।
রাত্রি আর প্রত্যুষের মিলন-মুহূর্তে যেন তোর
মধুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘শোনো ভাইয়া, তুমি যে
এত বছর পরেও আমাকে মনে রেখেছ, এ আমার
মস্ত পাওয়া। জানো ভাইয়া, তুমি যখন আশ্চর্য-সুন্দর
কবিতার একটি পঙ্ক্তি রচনা করো, তখন আমি
সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আলো ছড়াই। তোমার একটি
নতুন উপমা আমাকে হাওয়া বানিয়ে তোমার গালে
চুমো দিতে পাঠায়। তুমি যখন কোনও ব্যর্থ পঙ্ক্তি
লেখো, তখন আমার অশ্রু শিশিরবিন্দু হয়ে ঝরে
পোড়ো জমিতে। লিখে যাও ভাইয়া, আমাদের
সিএ কলমকে বিসর্জন দিও না কোনওদিন।
পারেনি খুবলে খেতে সৌন্দর্যকে
এইতো কিছুদিন ধরে কী-যে হয়েছে আমার, পাড়ার
না, না, শুধু পাড়ার নয়, প্রিয় এই শহরের সব একতলা, দোতলা
বাড়ি, দশতলা, এগারো তলা ফ্ল্যাট মুখ থুবড়ে
পড়েছে এখানে-সেখানে। অগণিত ধ্বংসস্তূপ
এবং বৃক্ষবিরল এই শহরের প্রতিটি গাছ
ভীষণ ক্রুদ্ধ কঙ্কাল যেন। নিজেকেই কেমন
অদ্ভত খাপছাড়া মনে হয়, যেন আমি সুদূর
কোনও শতাব্দী থেকে আচমকা এসে পড়েছি এখানে।
পুড়ে যাচ্ছে কেশরপ্রায় আমার চুল, পুড়ছে ভীষণ
আমার চোখ, মুখ, সারা শরীর
পুড়ছে, পায়ের তলার ন্যাংটো জমিন
আগুন-ঝরানো দগদগে ঘায়ের মতো তামা। পুড়ে যাচ্ছি,
আবার সেই সুদূর হাজার শতাব্দী আগের এক দুপুরে
অগ্নিবৃষ্টিতে ভস্মে রূপান্তরিত হয়েছিলাম যেমন। দৃষ্টি
থেকে মুছে গেছে দু’ দেশের সীমানায় অস্ত্রের ধমক, গায়েব
জাতিসংঘের নানা জাতির ভাষণ, ক্ষুদে দেশের বিলাপ।
এইতো নতুন শতাব্দীর শুরুতেই দেখছি আধপোড়া আমার
দিকে আবার তেড়ে আসছে ডাইনোসর, এক্ষুণি
গিলে ফেলবে আমাকে। আমি কি ছুটে যেতে পারবো
কোনও নিরাপদ গুহায়? দেখতে পাবো কি সেখানে কোনও
কোমল আলিঙ্গনের মোহিনী মুদ্রা? এইতো পায়ের তলায়
মৃত্তিকা কম্পমান, অদূরে পর্বত মুহুর্মুহু উগরে দিচ্ছে
আগুন; ফাঁক-হয়ে-যাওয়া জমিন গিলে ফেলছে
অগণন নর-নারীকে। প্রলয়ের কী উন্মত্ত নাচন!
ছুটছি আমি, ছুটছি প্রাণপণে নতুন মৃত্যুর দাঁত-নখের
সন্ত্রাস এড়ানোর আশায়। ছুটছি ছুটছি ভীষণ একা,
নিঃশ্বাস দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, তবুও ছুটছি ছুটব। হঠাৎ দেখি,
কাছেই ভস্মস্তূপে কী তাজ্জব, তিনটি গোলাপ দুলছে
হাওয়ার চুমোয়, হাসছে নির্মল
অথচ রহস্যময় হাসি। জন্মান্ধ তাণ্ডবের
উৎকট চিৎকার, অপ্রতিরোধ্য ঝোড়ো ঝাপ্টা পারেনি
সেই হাসি মুছে ফেলতে, পারেনি খুবলে খেতে সৌন্দর্যকে।
প্রাত্যহিক
পটল বেগুন আলু আর ঝিঙা আর ফুলকপি
দেখছি
বরফকাতর বড় মাছ মাংস পেঁয়াজ মরিচ
দেখছি
মোটা মিহি কণ্ঠস্বর ক্রেতার কাকের
গুনছি
মাঝ মাসে মাইনের শেষ ক’টি টাকা
গুনছি
গোধূলিবেলায় ক্লান্ত চোখে
ঝিমুনি
আর রাতে স্তব্ধতার অমাবস্যা তাঁবু
খাটায়
বিপন্ন বিশ্বে নতুন সভ্যতার জন্যে
এমন মনেই হয়, হতে থাকে-দূর থেকে এক যেন আমাকে
ডাকছে ব্যাকুল। কে ডাকবে এই ঘোর অবেলায়
দিগন্ত ঝাঁকিয়ে খুব? একরত্তি শব্দ নেই, তবু
অস্তিত্ব-কাঁপানো কিছু শব্দহীন প্রবল গর্জন
আমাকে ভয়ার্ত করে, ঠেলে দেয় তীক্ষ্ম দাঁত-নখ অধ্যুষিত
অরণ্যের দিকে।
তা হ’লে কী করি, বলো? চোখ, কান বন্ধ করে নিজস্ব বালিশে
মুখ গুঁজে গৃহকোণে থাকব কি পড়ে
হতাশাপীড়িত বিষপান করে মানুষের মতো? অকস্মাৎ
গেস্টাপোর ধরনে আমার দরজায় যদি কেউ
কড়া নাড়ে জোরে কিংবা বাজায় কলিংবেল, তবে
কি করব, কেউ কি আমাকে যে করেই হোক বলে
দেবে ঠারেঠোরো? স্বস্তি শান্তি নেই সেই কবে থেকে
ঘরের ভেতর কাগজের খস্ খস্ শুনে কারও পায়ের অশুভ শব্দ ভেবে
কেঁপে উঠি
শীতার্ত পাতার মতো। গলা জুড়ে বালির সন্ত্রাস।
ভোরবেলা কারা এসে ঘরে ঢুকে পড়ে; চোখ দু’টি
কচলাতে কচলাতে দেখি,-কয়েকটি রুক্ষ পশু
মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে, ‘এক্ষুণি বেরিয়ে যাও
এই ঘর ছেড়ে,
এখানে থাকার অধিকার বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে,
তুমি বনবাদাড়ে আস্তানা খুঁজে নাও।
বিভ্রান্ত, নির্বাক আমি চেয়ে থাকি হাবার ধরনে, ভয়ঙ্কর
ভূমিকম্প ভীষণ দুলিয়ে
এবং ঘুলিয়ে দেয় সবকিছু; তাসের ঘরের
মতো ধসে পড়ে চতুর্দিকে, ‘গীতবিতান’ এবং
গালিবের গজল নিমেষে মুছে যায়
থাবার আক্রোশে, সবখানে অশ্লীল চিৎকার আর
আমি নিজে ডুবে যাচ্ছি অতল বিষ্ঠায়। মনে হয়,
যুগযুগান্তর কাটে অথবা নিশ্চল সবকিছু।
এমন মনেই হয়, হতে থাকে আজকাল। তবু মাঝে মাঝে
একটি কি দু’টি পাখি রেলিঙে নিশ্চিন্ত বসে দোল
খেতে-খেতে আমাকে শুনিয়ে যায় গান। কী আশ্চর্য,
জানি না কোত্থেকে ভেসে আসে বাঁশির অমর্ত্য সুর
অন্তর্লোকে। চতুর্দিকে অনাচার, ভ্রষ্টাচার, হিংসার ফোঁসানি;
হায়, কবে আসবে বিপন্ন বিশ্বে নতুন সভ্যতা?
ভাটিয়ালি সুর হয়ে বেজে ওঠে
ও আমার রঙিলা নায়ের মাঝি, গহীন গাঙের ভাটিয়ালি
সুরপ্রিয় মাঝে, নাও বাইয়া কোথায় যাও? কোন্ সে গাঁয়ের
ঘাটে তুমি ভেড়াবে সাধের নাও? ওরে
গাড়িয়াল ভাই, রাঙাধুলি গায়ে নিয়ে যাবে তুমি
দুলা আর দুল্হিন নিয়ে কোন্ ঠিকানায়? হায়, আমি এই
খোলা পথে দাঁড়িয়ে রয়েছি বড় একা, আমাকেও সঙ্গে নাও।
ও আমার রঙিলা নায়ের মাঝি, তোমার গানের
শিল্পীকে খুঁজছ তুমি কোথায় এখন? গোধূলিতে কান পেতে
আছো যে সুরের জন্যে, তাঁর অপরূপ
প্রতিধ্বনি গুঞ্জরিত পদ্মা আর মেঘনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে,
উত্তরবঙ্গের লাল মাটির অন্তরে। অতীতের দিনগুলি,
রাতগুলি মঞ্জরিত মৃত্যুঞ্জয় গায়কের সুরের নির্ঝরে।
ওহে গাড়িয়াল ভাই, যার গানের মোহন সুরে
দুলত গাড়ির চাকা, যুগল গরুর
পথ চলা, তাঁর
সুরের মায়ায় মুগ্ধ আজও নদীনালা, বাঁশবন,
প্রান্তর, পাহাড় আর শহরতলি
শান্তিনিকেতন আর রাজধানীর সুরম্য বহুতল বাড়ি।
কার গীত, কার সুর এমন সর্বত্রগামী, কে সেই মহান
প্রামীণ সুরসাধক? কার সুরের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে আজও
সঙ্গীতপিপাসু প্রাণ? কার সুরে ধূলি-ধূসর পথের ধারে
নিমেষেই ফোটে ফুল, হৃদয় ব্যাকুল হয় দূর
দিগন্তের না-দেখা দৃশ্যের জন্যে, কে তিনি? কে তিনি? ভাটিয়ালী
সুর হয়ে বেজে ওঠে তাঁর নাম-আব্বাসউদ্দীন তিনি আব্বাসউদ্দীন।
মেরীর পুত্র
এরা তোমার অবসন্ন মেষপাল।
প্রত্যূষ এলে
রাত্রি ওদের ছুঁড়ে দেয় মাটির বুকে,
ওরা তাড়িত হয় ওদের নিত্যকার গেরস্থালির
টুকিটাকি কাজে
বাজারে, দপ্তরে, ফ্যাক্টরিতে,
যেখানে ওরা কাজ করে।
চলার পথে ওরা জিরোতে পারে না-
এমনকি আহত হ’লেও ওরা থামতে পারে না,
তুমি কি-ই বা প্রত্যাশা করতে পারো ওদের কাছে?
নেকড়েরা এখন মিশে যায় মেষপালের সঙ্গে।
তুমি তাকিয়ে আছো এই পথের দিকে;
এখানে সমাহিত অগণিত কাহিনী,
অনেক মানুষের হারানো যৌবন,
একই পথে হেঁটে যায়।
ধনী আর নির্ধন।
প্রায়শ আমি অবাক হয়ে ভাবি কার জন্যে
অপেক্ষা করছ তুমি!
এই আমাকে দ্যাখোঃ
আমি সে-জন
যে ছিল শৃঙ্খলিত তার ক্ষেতে
এবং ছিল সেই ক্ষেতেরই অঙ্গ।
যখন দুর্দশায় বেচে দেয়া হলো জমিন;
বিকিয়ে গেলাম আমিও
যেন আমি কিছুই নই। শুধুমাত্র আগুনের জ্বালানি।
এই আমাকে দ্যাখোঃ
আমি সে-জন
মেশিনের মালিকরা এখন আমাকে
ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ওদের চাকার ভেতর।
আমাকে দ্যাখোঃ
আমি ক্লান্ত আর দিশেহারা,
শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে ভবঘুরে আমি
তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো,
সেই বেদীমূল থেকে যদি সরে যাও, তাহলে
এখানে আমি ঘুমোতে পারি।
দোহাই ঈশ্বরের এখান থেকে চলে যাও তুমি,
চলে যাও ভিয়েতনামের সেইসব জঙ্গলে,
সেইসব বিধ্বস্ত শহরে,
জখমি গ্রামগুলিতে-
যেগুলি ওরা, যারা পাঠ করে তোমার ধর্মগ্রন্থ,
পায়ে মাড়িয়ে, দাউ-দাউ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে।
যুগ-যুগ ধরে ওরা ডাকছে তোমাকে।
যাও আমাদের জন্যে আরও একবার তুমি যাও,
আবার এফোঁড়-ওফোঁড় বিদ্ধ হও গে ক্রশকাঠে।
(উর্দু কবি কাইফি আজমরি কবিতার অনুবাদ)
মৎসসমাজের কথা
জল তো ছিলই সুপ্রচুর, টলটলে, ঝলমলে
নদীটির দু’কুল-ছাপানো। তরঙ্গের
খেলা ছিল, ছিলাম সাঁতারপ্রিয় প্রায়শই, এখনও রয়েছি
কখনও কখনও ডুব দিয়েছি গভীরে
দুর্লভের খোঁজে, মৎস আমি ছোট বড় মাছের বাহার ছিল
চারপাশে আমি সঙ্গী ছিলাম ওদের।
মাঝে মাঝে ডুব-সাঁতার করেছে
ধন্য পূর্বসূরীদের মতো। আরো
কেউ কেউ সফলতা পেয়েছে এবং মৎসদের
সমাজে উল্লাসধ্বনি তরঙ্গে
উঠেছে তুমুল বেজে। হায়, কেউ নেই আজ,
কেউ কেউ স্থবিরতা নেয় মেনে, মজে আলস্যের মিহি স্তবে!
নিয়ত আমার ডুবসাঁতারের কালে দেখি কত
নিষ্প্রাণ, বেরঙ মাছ ভাসে আশেপাশে,
এক ঝাঁক নির্বুদ্ধিতা-কবলিত মাছ অতিশয়
ফরফরে; আকারে যদিও ক্ষুদে, হামেশা ভড়ং
বিশালের, ফাঁপা ওরা। মরা, পচা, ভাসমান মাছের দুর্গন্ধে
এবং ক্ষুদ্রের ধামালিতে টেকা দায়। ফলত গভীরে
ডুব দিয়ে সত্য, সুন্দরের, কল্যাণের
সাধনাই শ্রেয় ভাবি; ওপরে বাজুক ডঙ্কা ক্ষুদের, ফাঁপার।
যতদূর যেতে হয় যাব
পড়ে আছি নিঃসঙ্গ এখানে এই ধূ ধূ বিরানায়
কী জানি কখন থেকে, কবে থেকে। ঠিক মতো
চোখ খুলতেও অপারগ; কিছু কিছু
ধোঁয়াশার মতো প্রতিভাত আর অনেক কিছুই
বিলুপ্ত বেখাপ্পা অন্ধকারে। কয়েকটি বিটকেল মাছি খুব
বিরক্ত করছে, তাড়াবার ইচ্ছা মৃতপ্রায়। কী যেন পড়ল।
অদূরে, অদ্ভুত শব্দ যেন ভেসে আসে; পারব কি ফের উঠে
দাঁড়াতে গা ঝাড়া দিয়ে আর এই জনহীনতায়?
যদিও এখানে হিংস্র তিমির দাপট
দেখিয়ে চলেছে পুরোদমে, যদিও জ্যোৎস্নার প্রলম্বিত চুমো
মিলবে না শিগ্গির, যদিও কোনও পাখি
মুক্তকণ্ঠে গাইবে না গান, তবু পড়িমরি করে
হলেও আমাকে উঠি দাঁড়াতে হবে, পেতে হবে
আরাধ্য পথের দিশা; পারব তো গন্তব্যে পৌঁছুতে?
হেঁটে যেতে হবে বহুদূর প্রতারক সব পথপ্রদর্শকদের
ভ্রমচক্র ভেদ করে। একটি সোনালি পাখি বেদনার্ত গান
গেয়ে গেয়ে নিয়ে যাবে, মনে হয়, পোড়া বাস্তুভিটার কঙ্কাল
দেখাতে লুণ্ঠিত পাড়াগাঁর, ধর্ষিত নারীর
অমাবস্যাময় মুখ! আমি কি পারব আলো জ্বালাতে আবার
সেই সব মুখে? পারব কী কাঠগড়ায় করাতে দাঁড়
মানুষের ভেকধারী পশুদের? পারব কি ফুল ফোটাতে আবার বিরান বাগানে? যাব,
যতদূর যেতে হয় যাব।
রবীন্দ্রনাথ সমীপে খোলা চিঠি
(আবৃত্তিশিল্পী কাজী আরিফকে)
রবীন্দ্রনাথ, আজ পঁচিশে বৈশাখ, আপনার
জন্মদিন, এই অনুপম সত্য কোন্ প্রকৃত
বাঙালির অজানা? এই দিবস তাদের প্রত্যেকের
হৃদয়ে সূর্যকিরণের মতো, চরাচর-ভাসানো
পূর্ণিমার মতোই উদ্ভাসিত।
রবীন্দ্রনাথ, আপনি, হ্যাঁ আপনিই তো আমাদের
জানিয়েছে আনন্দলোক মঙ্গলালোকের অপরূপ স্তোত্র।
কিন্তু, হা কপাল, কোথায় সেই আনন্দলোক, কোথায় মঙ্গলালোক?
শান্তির ললিতবাণী আপনি শুনিয়েছেন
বিশ্ববাসীকে। এই আমরা, একবিংশ শতাব্দীর বাঙালিরা
অসহায়, থরথর দৃষ্টিতে দেখছি-
অরণ্যের শ্বাপদের চেয়েও অধিক ভয়ঙ্কর, হিংস্র সেই সব
মানুষের খোলসের আড়ালে বসবাসকারী পশুদের
থাবায় ছিন্ন ভিন্ন সেই বাণী।
রবীন্দ্রনাথ, আপনার জন্ম মাসের পয়লা তারিখে আমরা প্রকৃত
বাঙালিরা চারপাশে আনন্দের ফুল ছড়িয়ে
বরণ করি নববর্ষকে আপনারই অমল, আনন্দময়,
শান্তি-বিলানো গানের ডালা দুলিয়ে। সুরে সুরে
সবুজ ঘাস-ছাওয়া মাটি, বটমূল, গাছপালা, আকাশ
আমাদের অপরূপ হৃদয়-উদ্যান
ছেয়ে যায়। আমাদের করতলে চকিতে নৃত্যপর আনন্দলোক।
অথচ এই প্রথমবারের মতো আপনার গান কেন
রক্তপিপাসু হয়ে উঠল আমাদের রমনার বটমূলে?
নববর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্যেই কি
আপনার অনুপতম গীতধারা বয়ে আনল পাশবিকতা?
বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা, রবীন্দ্রনাথ,
আপনার গানের চেতনা সমৃদ্ধ করার
অপরাধেই তো ঘাতকদের বোমা উড়িয়ে দিল
কারো মাথার খুলি, ছিন্ন ভিন্ন করল কারও নিরপরাধ
শরীর, দুঃখের বানে ভাসিয়ে দিল কয়েকটি সংসার!
রবীন্দ্রনাথ, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে
ক্রোধে, ঘৃণায়, আপনি বৃটিশরাজের দান নাইট উপাধি
ছুঁড়ে ফেলেছিলেন দিল্লীর দরবারের ধুলোয়। আজ
আপনি কী করবেন রবীন্দ্রনাথ? আপনার গীতবিতান কি
ছুঁড়ে দেবেন ঈশ্বরের দরবারে? জানি,
তা কস্মিনকালেও হবার নয়। আজ আপনার ক্রোধ, ধিক্কার ঘৃণা
কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আমরা মাথা খুঁড়ে মরলেও আপনি
আজ আমার অন্তর্জ্বালা, ক্রোধ
এবং প্রতিবাদের ঝড়ে শরিক হতে পারবেন না রবীন্দ্রনাথ।
রোগশয্যা থেকে
হাসপাতালের বেডে কার হাত অপরূপ ছায়া
হয়ে এই জীর্ণ রুক্ষ শরীরে আমার
গাঢ় চুমো হয়ে
গান গায়, যেন বসন্ত বাহার।
যন্ত্রণা নিমেষে পলাতক, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন
বড় অবান্তর লাগে, অস্ত্রোপচারের তীব্র দাহ
কী করে উধাও হলো, বোধের বাইরে চলে যায়।
আমি রাঙা মেঘে, ফুলশয্যায় একাকী।
২
মধ্যরাতে এ কেমন হট্ররোল? হাটবাজারের এলোমেলো
সপ্তকণ্ঠ হাঁকে, বচসার শুরু, সাদা আলখাল্লা-পরা
গুরু একা হেঁটে যান ভিড়ের উজান ঠেলে, হাতে
একতারা, এক্ষুণি সুরের ঝর্ণাধারা
করবে প্লাবিত হাটবাজারকে, তবু
উদাসীন সাঁই চলেছেন ধূলিসিদ্ধ পায়ে কোন্
বিরানায়, পারে না হানতে কেউ। তাঁর
গোধূলি রঙিন মুখে মরমিয়া হাসি।
৩
হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণাকাতর রোগী কাকে
খোঁজে মধ্যরাতে? কোমরের ব্যাণ্ডেজ শিথিল কেন?
যে তাকে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে চুম্বনে
শান্তির হ্রদের তীরে নিয়ে যায়,
আলিঙ্গন করে নীলপদ্মের ভেলায়, প্রায়শই পদ্যে
পলাতক শব্দের সন্ধান দিয়ে ঠিক
পঙ্ক্তিমালা সাজায় কাগজে, সে কি তবে
উত্তপ্ত কপালে তার রাখবে না হাত অবেলায়?
শহীদবাগ
তিরিশ, হ্যাঁ তিরিশ বছর আগে জায়গাটা ছিল
স্রেফ বেনামি। তবে এখানে ছিল জেদী মানুষের মতো
মাথা-উঁচু-রাখা কয়েকটি গাছ আর কিছু বুনো ঝোপঝাড়।
তিরিশ বছর আগে এই বিয়াবান বুনো জায়গায়
অগোচরে আস্তানা গেড়েছিল সাতজন যুবক। ওদের
শরীরের গড়ন মামুলি, স্বভাব নয় মোটেই জঙ্গি, যেন
হাওয়ার ঝটকায় মাটিতে গড়িয়ে পড়বে শরীর। কিন্তু
ওদের চোখ ছিল খুব জ্বলজ্বলে; হাওয়ার ঝটকায় হয়ে উঠত
আরও চকচকে। ওরা খেত কি খেত না, সহজে জানতে
পারত না কেউ। গা ঢাকা দিয়ে চলাতেই ওদের আনন্দ।
তিরিশ বছর আগে কী কাণ্ডটাই না ঘটাল
সাতজন টিঙটিঙে আজব জোয়ান। আগুণতি পাকি জাঁহাবাজদের
ঘাড় মটকে দিয়ে নিজেদের স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করল সেই
বুনো ঝোপঝাড়ে। বেনামি জায়গাটা পবিত্র হয়ে উঠল
ওদের রক্তধারায়।
এখন সেই বেনামি জায়গা হৃদস্পন্দন হয়ে অজস্র ফুলের মতো
অবিরত ফোটে এক কবিয়ালের একতারায়। এরপর
থেকেই বেনামি বুনো একখণ্ড মাটি হয়ে ওঠে শহীদবাগ।
শাহরিয়ার কবিরের জন্যে পঙ্ক্তিমালা
শাহরিয়ার কবির, কী গভীর ভালোবাসা তোমার হৃদয়ে
এ দেশের জন্যে, তা’ জানে সবুজ ঘাস,
লতাগুল্ম, সুগন্ধি ফুল, উদার প্রান্তর, নদীর
উদ্দাম স্রোত, পাখা-ঝাপটানো
নানা রঙের পাখি, সবচেয়ে বেশি হাজার
হাজার সংগ্রামী মানুষ। তোমার বোধে দীপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
হাতকড়া পরা তোমাকে যে মুহূর্তে জড়িয়ে
কাঁদছিল কারাগারের সামনে
তোমার মেয়ে, তখন বাংলার আকাশের কালো মেঘ থেকে
ঝরে পড়েছিল অশ্রুকণা।
শাহরিয়ার, তোমাকে ওরা এক অন্ধকার কুঠুরিতে
বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু ওদের জানা নেই,
তোমার অন্তর্গত আলোয় উদ্ভাসিত,
আশ্চর্য মুক্ত হাওয়ার তরঙ্গিত সেই কৃপণ, জন্মান্ধ ঘর!
কারাগারের প্রাচীর খুব উঁচু, আমরা জানি। অথচ তুমি
এই কঠিন, কালো দেয়ালের চেয়ে অনেক
অনেক বেশি দীর্ঘকায়। তোমার প্রকৃত সত্তার
নাগাল পাওয়ার যোগ্যতা ওর নেই,
কারারক্ষীদের কাছেও তোমার উচ্চতা
মাপার কোনও যন্ত্র নেই, নেই কোনও পদ্ধতি।
তুমি তো ডাকাত নও, নও কোনও তস্করও, তোমার
কোনও প্রাচীন টপকে বেরিয়ে আসার
মনোবৃত্তি থাকতে পারে না। বীর তুমি, তোমার
ধরন রণজয়ী যোদ্ধার মতোই।
শাহরিয়ার, তুমি যখন বীরোচিত পদক্ষেপে,
প্রশস্ত বুকে কুটিল মিথ্যাকে ধুলোয় লুটিয়ে সত্যের মুকুট
মাথায় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবে, তোমার গলায়
অনেক আগ্রহী আনন্দিত হাত পরিয়ে দেবে
অজস্র জয়মালা, দূর থেকে মনশ্চক্ষে তোমাকে দেখব এবং
আমার হৃদয়মথিত পঙ্ক্তিমালা তোমাকে স্পর্শ করতে চাইবে।
শুষে নেয় পোড়া মাটি
হঠাৎ আমার পায়ের তলার মাটি ভয়ঙ্কর
কম্পমান এবং আসমান চিরে ভেসে আসে
প্রদীপ কাকাবাবুর আর্তনাদ, শোভা কাকি-মার কান্না,
বোন ললিতার গোঙানি। হৃদয়-বিদারক
ধ্বনি সম্প্রদায় বলছে, ‘কোথায় তুমি আজিজ?’ স্তম্ভিত,
ত্বরিত ছুটে গেলাম প্রদীপ কাকার বাড়ির দিকে।
এ কোন দৃশ্য দেখতে হলো আমাকে? প্রৌঢ় প্রদীপ কাকা
মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন আঙিনায়,
রক্তাক্ত শরীর, ভস্মাভূত বসতবাড়ি, শোভা কাকি-মা পাশেই
মুখ থুবড়ে পড়ে গোঙাচ্ছেন। বোন ললিতা কোথায়? অদূরে
ঝোপঝাড়ে ওর অচেতন শরীর। পূর্ণিমা লুপ্ত
হিংস্র অমাবস্যার যৌনাচারে!
কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই আজিজ, এই পাথর-আমি, পাথরের
চোখ ফেটে বেরুনো ক’ফোটা পানি শুষে নেয় পোড়া মাটি।
সভ্যতার কাছে এই সওয়াল আমার
কী এক আত্মা-কাঁপানো ভয়ের কামড় হামেশা
খেয়েই চলেছি। বুঝি না কোন্ অপরাধে ছুঁচো, ইঁদুর, এমনকী
লাল পিঁপড়েও অস্তিত্বে দিচ্ছে হানা, যেন খেল-তামাশা
পেয়ে গেছে নিখরচায়। পাঁচ মিনিটও শান্তি দোলায় না হাতপাখা,
স্বস্তি ভুলেও রাখে না অধর ওষ্ঠে আমার। কেউ কি
আমাকে বলে দেবে কোন মোড়লের বাড়া ভাতে
ছিটিয়েছি ছাই? কোনও গেরস্তের ভিটায়
ঘুঘু চরাবার কল্পনাও তো ঘেঁষেনি মনের কোণে।
যদি নারী, শিশুর হাসি, ইয়ার বন্ধু, শান্তিপ্রিয়
মানবসমাজকে ভালোবাসা অপরাধ হয়,
যদি দুপুরের চকচকে ধারালো রোদ্দুর, চরাচর স্নিগ্ধ-করা জ্যোৎস্না,
শ্রাবণের মেঘ, জলধারা, মুক্তাঙ্গনের পুষ্পবিকাশ, পাখির উড়াল
আমাকে পুলকিত করে, আমার হবে কসুর গুনাহ্?-
হাজার বছরের সভ্যতার কাছে এই সওয়াল আমার।
তবে কেন আমাকে কাফকার নায়কের মতোই।
কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে যখন তখন,
লুকিয়ে বেড়াতে হবে দিগ্ধিদিক? কেন হিংস্র আঙুলগুলো
দহলিজে বসে ফরমান রটিয়ে
টিপে মারতে চাইবে আমার পরান-ভোমরাকে?
আমার স্বপ্ন, সাধ, কলম কেড়ে নিতে চাইবে এক ঝটকায়?
সূর্যোদয়, গোধূলিময় আকাশ, নদী আর নক্ষত্রসমাজকে
ব্যাকুল প্রশ্ন করি, আর কত রাত নির্ঘুম
কাটাব লাল চোখ নিয়ে? কখন বইবে অপরূপ
নহর খরা-পীড়িত জমিনে? কখন আসবে সেই প্রহর;
যখন অশুভের হুঙ্কার স্তব্ধতায় হবে লীন,
যুদ্ধবাজদের হাতে রাইফেলের বদলে থাকবে
সুরভিময় ফুলের তোড়া? মিলনের বাঁশি? অভ্যাসবশত স্বপ্নে
ভেসে বেড়াই আবছা ময়ূরপঙ্খি ভেলায়।
স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস দীর্ঘ অতিশয়, তবুও
মহাপুরুষদের বাণী থেকে শান্তির আভা বিচ্ছুরিত হয়, হতে
থাকবে চিরকাল। দেখি, অবাধ প্রান্তরে প্রশান্ত আলোয়
বালক বালিকারা হরিণ হরিণীর গলায় লগ্ন, মগ্ন খেলায়।
এটাই সত্য হলে, তবে কেন ঢিল খাব, ক্রুশবিদ্ধ হব?
হাজার বছরের সভ্যতার কাছে এই সওয়াল আমার।
হাই মিস্টার রাহমান
হাই মিস্টার রাহমান, ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত অব্দি
আকাশ পাতাল এক করেও আপনার
সাধের কবিতার খাতার পাতায় একটি নতুন পঙ্ক্তিও
বসাতে পারলেন না। অথচ জনাব ঘুম থেকে
জেগে উঠেই তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপ নিয়ে
বসলেন; ধোঁয়ার লতিয়ে ওঠার দিকে খানিক নজরও
দিলেন না, দেখলেন না পেয়ালার রূপ। একবারও
তাকালেন না জানালার বাইরের ফুলের ঐশ্বার্যে
নুয়ে-পড়া গাছটির দিকে। অদূরে
পাখা কাঁপানো পজাপতিটাও
আপনার দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেল, স্যার। আপনি কিছু
মনে করবেন না, নিষ্প্রাণ প্রস্তরমূর্তিবৎ ছিলেন!
জানি, একটি কবিতা লেখার তাড়া ছিল আপনার
অথচ কোনও কোনও ভোরবেলা ধূমায়িত
চায়ের পেয়ালার রূপ আপনার অনেক সময় কী সুন্দর
আদায় করে নিয়েছে, কবি। একটি গুবরে-পোকার ধীর গতি
আপনাকে কোনও নতুন ছন্দের সন্ধান দিয়েছে।
খুব সহজেই যেন খেলা হয়ে গেছে একটি প্রকৃত নতুন কবিতা।
আজ কেন কবিতার খাতার পাতা ধু ধু মরুভূমি?
জনাব রাহমান, এ এক জবর তেলেসমাতি সওয়াল!
অকূল দরিয়া বয়ে চলেছে নানারূপে পাতালে
অপরূপ রত্ন কত বিরাজ করে, কে কখন কী নিয়ে যায়,
বলতে পারে না কেউ। আপনিও ডোবান ঘড়া, কবি।
হয়তো গহন পাতাল ছোঁবে বার বার সেই ঘড়া,
ছড়াবে আলোর ছটা।