- বইয়ের নামঃ বিধ্বস্ত নিলীমা
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপচয়ের স্মৃতি
“দেখে নিও আমি মহাপুরুষের ভূমিকায় ঠিক
উৎরে যাবো একদিন। হবো তথাগত কিংবা যীশু,
দগ্ধীভূত আত্মায় ফেলবে ছায়া কোনো বোধিদ্রুম।
ফন্দিবাজ জনরবে কান দিয়ে, জিঘাংসায় মেতে
চেনা দেশে করবো না প্রতারিত শান্তির পাখিকে
চতুর মিলিত ফাঁদে। পথে হাঁটে জীবিত মানুষ,
ভালবাসে পৃথিবীর তাপ, রাত্রিবেলা পুত্র ভয়ে
চেঁচিয়ে উঠলে ঘুমে জোরে বুকে চেপে ধরে তাকে-
ঘৃণার ত্রিশূলে তাকে কী করে বিঁধবো অকাতরে?
“হে পিতৃপুরুষবর্গ তোমাদের মিলিত শোণিত
বিষণ্ণ বংশের রক্তে জাগায় প্রতীকী শিহরণ
মতবাদ-পীড়িত যুগের গোধুলিতে। সংবর্ধনা
পায় তারা নষ্ট বাগানের স্তব্ধতায়, বিষাদের
ইন্ধন জোগায় নিত্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সময়ের
কাৎরানি মূঢ়তা আর মিথ্যাচার, যা-কিছু নিশ্বাসে
অগোচরে সহজে মিশিয়ে দেয় বিন্দু বিন্দু বিষ।
“যে স্মৃতি ভ্রাতৃহননে প্ররোচিত করে বার বার
প্রেতায়িত মন্ত্রণায়, সে-স্মৃতির কর্কশ চিৎকারে
কেঁপে ওঠে গৃহস্থালি ভয়-পাওয়া পায়রার মতো,
বন্ধু হয় জানালা কপাট, তাড়া খেয়ে দিন ঢোকে
রাত্রির গুহায়, অমঙ্গল খিল খুলে আঁধিঝড়ে
সদম্ভে বেরিয়ে পড়ে চৌরাস্তায়-আমি সুনিশ্চিত
দায়ভাগী তার। চিরন্তনী অপচয় আমাদের
সব স্বপ্ন নষ্ট করে, চোখ জুড়ে থাকে কিমাকার
জন্তুর কংকাল কোনো। ধ্বংসস্তূপ ফুলে ঢেকে আমি
বিষাদের গাথা লিখি শ্রীযুক্ত বিষণ্ণ পরিমল।
“খাবার টেবিলে বসে মেজাজ খারাপ করে আমি
সান্ত্বনাদায়িনী মাকে বলি শিশু নই, কাঁহাতক
খোকা সেজে থাকা যায় অবিচল স্নেহের নকশায়!
আমার অনেক কাজ। পৃথিবীটা দৃশ্যকাব্য হলে
ছিল না ঝামেলা মোটে, মহিমার শিরস্ত্রাণ পরে
বস্তুপুজ্ঞে দিতাম মিশিয়ে ঢের রহস্যময়তা।“
“বাচাল প্রিন্টিং প্রেস জয়োল্লাসে দিচ্ছে জন্ম আজ
যে-উচ্ছিষ্ট সভ্যতাকে আমি তার ম্লান, স্বরহীন
ক্রীড়নক হবো শুধু? আমার মগজে সারাক্ষণ
প্রকাণ্ড, উজ্জ্বল এক রাজহাঁস পাখা ঝাপটায়,
কেবলি হোঁচট খায় দেখি স্বপ্নলোকের চৌকাঠে।
ধাতুর চত্বরে বসে অজস্র পেরেক ঠোকে কারা
শক্ত কাঠে সর্বক্ষণ, স্বপ্নে দেখি, নৈরাজ্যে অস্থির
প্রসিদ্ধ গ্রন্থের সব মহান হরফ মুছে যায়,
চতুর্দিকে মুণ্ডহীন মানুষের অখণ্ড স্বরাজ!
ফুটপাথে হন্তারক হাওয়ার শাসানি পরিমল
বোঝেনি বস্তুত তাই যখন পৈশাচী অন্ধকারে
ভায়ের উৎকট গন্ধ নেকড়ের মতো হিংস্রতায়
শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দৃষ্টি-অন্ধ-করা রক্ত দেখে
থমকে চায়, চোখ জুড়ে থাকে স্থির এক অবিশ্বাস,
(রাজহাঁস মুখ থুবড়ে পড়ে নর্দমায়) পৃথিবীতে
সম্প্রতি কোথাও নেই শ্রীযুক্ত বিষণ্ণ পরিমল!
আত্মজৈবনিক
যুদ্ধবাজ সাইরেনে উচ্চকিত কৈশোর আমার
গলির বিধ্বস্ত ঘরে। গুলির শব্দের প্রতীক্ষায়
কেটেছে ভুতুড়ে রাত্রি অন্ধকারে এবং তামার
মতো দিন খাকির প্রতাপে কাঁপে শান্তির ভিক্ষায়।
যৌবন দুর্ভিক্ষ-বিদ্ধ, দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভাঙে দেশ,
এদিকে নেতার কণ্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি
ভাষা খোঁজে। আদর্শের ভরাডুবি, মহাযুদ্ধ শেষ,
মঞ্চ তৈরিঃ কে হবে নায়ক তবে? করি কার স্তুতি?
সগৌরবে ঢাক-ঢোল বাজালো সে ধ্বংসের উৎসবে
যারা তারা কেউ পেলে শিরোপ, কেউবা পতনের
ঝাঁ-ঝাঁ স্মৃতি; বহু মাঠ গেলো ভরে নামহীন শবে।
পচা মাংস দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বেশ্যার স্তনের
উষ্ণতার মনস্তাপ মাখে যে- লোকটা মগজেই
ঘোরে তার শবাধার, একগাছি দড়ি কিংবা ক্ষুর-
যা-কিছু হননপ্রিয়, যা-কিছু অত্যন্ত সহজেই
জীবনকে করে তোলে অর্থহীন জীর্ণ আস্তাকুঁড়।
চতুর বক্তৃতাবলী, প্রচারণা, সংঘের ধূর্তামি
ছাড়া কল্কে পাওয়া ভার! বুক বেঁধে নির্বোধ সাহসে
বিবর্ণ স্যাণ্ডেল পায়ে ঘুরেছি ধুলোয় রোজ আমিঃ
হা-ঘরে বন্ধুর খোঁজে কতদিন বেড়িয়েছি চষে
সারাটা শহর। অন্ধকারে কতো আনোরারা, বামী
ইতস্তত গেছে ডুবে- দেখেছি স্বচক্ষে আর কষে
দিয়েছি বিড়িতে টান একাকিত্বে যখন তখন।
স্বরণের আঠা দিয়ে হতাশ প্রেমের জলছবি
সেঁটেছি সত্তার ফ্রেমে। মধ্যপথে কেড়েছেন মন
রবীন্দ্রঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি।
কখনো শুনিনি পার্কে বসে হরিণের ডাক কিংবা
পরীর আশ্চর্য স্তন আনেনি মোহের জ্যোৎস্না চোখে,
জানালার শক্ত শিকে কোনোদিন। নিজেকে প্রতিভা-
বান ভেবে ঘেঁটেছি নন্দনতত্ত্ব, যা বলুক লোকে
স্বপ্নে শুধু হাঁসের ঝাপট দেখি কশাইখানায়ঃ
মনে হয় স্ট্রেচারের ক্যানভাসে পড়ে আছি একা,
কানে আসে কানাঘুষো, যেতে যেতে কে যেন জানায়ঃ
এইতো বেজেছে ঘণ্টা, হবে না কখনো আর দেখা।
বতিচেলী নারী নয়, মাতিসের রমণীর মতো
তেমন কাউকে নয়, যে-হোক সে-হোক নারীকেই
পাশে নিয়ে রাস্তায় হাঁটবো ভেবে সুখে অবিরত
হঠাৎ নিজেরাই পায়ে মেরেছি কুড়াল। মেরে খেই
হারিয়েছি জীবনের। মধ্যে মধ্যে ইচ্ছে হয় বলি
জীবন, থামোহে বাপু, শুনেছি তোমার বাচালতা
অনর্গল বহুদিন; এবার দিয়েছি জলাজ্ঞলি
মেরুদণ্ডহীন, ক্লীব আশাকে তোমার। যে ব্যর্থতা
আমাকে শাসায় নিত্য, আমি তারই অগ্নিকুণ্ডে জ্বলি।
তোমরা আসবে কেউ? খোঁজো যারা ক্ষিপ্র সার্থকতা!
যেহেতু যথেষ্ট নই ভদ্রলোক তাই জবুথবু
সমাজের মোড়লেরা যথারীতি করেছে বিদায়
ওহে অর্ধচন্দ্র দিয়ে। কোনোমতে সামলে নিয়ে তবু
প্রতিবাদ করবো কি করবো না, পড়েছি দ্বিধায়।
একদিন নিত্যসঙ্গী ছিল যারা তারা ডানে বামে
সরে পড়ে, আমি শুধু যাইনে কোথাও। চোখে ভ্রম,
আরেক যুদ্ধের ছায়া যৌবনের অপরাহ্ণে নামে
এবং জীবন জানি সারাক্ষণ সিসিফস-শ্রম।
আমার ছেলেকে
খবদ্দার খোকা তুই কোনোদিন শিল্পের মৃগকে
দিবিনে ঘেঁষতে ত্রিসীমায়। বরং ডিঙিয়ে বেড়া
ভাষ্য, টীকা, দর্শনের মহানন্দে নিশ্চিন্দির ডেরা
বাঁধিস মনের মতো। জীবনকে সঁপে দিয়ে ছকে
বাজাবি ঢোলক নিত্য; চাকরির চরম নাটকে
সাজলে বিখুঁত হুঁকোবরদার, সমাজের সেরা
মুরুব্বির তল্পি বয়ে সামলালে নথিপত্র ঘেরা
অস্তিত্বকে, পৌঁছে যাবি উন্নতির প্রশস্ত সড়কে।
অক্ষান্তরে শিল্পের আঁতুড়ঘরে আছে কালকূট
হতাশার। রাত্রিদিন বিষাক্ত হাওয়ায় শ্বাস টেনে
কী পাবি অবুঝ তুই? অন্তহীন যন্ত্রণা, বিষাদ
অথবা পতন শুধু। সাফল্যের বিখ্যাত মুকুট
ক’জনের ভাগ্যে জোটে? তার চেয়ে স্থুলচর্ম বেনে,
বীমার দালাল হওয়া ভালো, ভালো ফুর্তির আস্বাদ।
একজন পাইলট
আকাশকে ধন্যবাদ। এ শূন্যতা, এই নীল আমাকে বাঁচায়,
রইলাম চিরঋণী। এনামেল-মসৃণ উধাও মেঘদল
ছুঁয়ে যায় এরোপ্লেন; ক্রমাগত উঠছি উপরে,
যাচ্ছি চলে দূরে ফেলে বিন্দু
বিন্দু মাঠ,
গাছ পালা,
সরু নদী,
দপ্দপে
লোকালয়, সব কিছু দূরে ফেলে। আমার সত্তায়
বাজে নীলিমার স্তব; আকাশের অকূল সাহারা
চষে চষে কী বেল কী জুঁই
প্রত্যহ ফোটাতে চাই বুঝি না কিছুই। নীলিমায়
প্রপেলর গুজ্ঞনে মৃত্যুকে ভুলে থাকি প্রহরে প্রহরে।
না, আমি কখনও আর নিচে নামবো না,
নামবো না, নামবো না।
মনে পড়ে কৈশোরের সতেজ সকালে কতদিন
আকাশে দিয়েছি ছেড়ে ঘুড়ি আকাঙ্ক্ষার। মেঘমালা
কখনও হয়েছে ফুল, কখনও বা এজ্ঞেলের পুণ্য ডানা হয়ে
দৃশ্যলোভী বালকের হৃদয় করেছে জয় ক্ষণে ক্ষণে, ফের
মুহূর্তে বদলিয়ে রঙ হয়ে গেছে মিকেলেজ্ঞেলোর
আদমের মুখ, দীপ্ত, প্রসারিত হাত, দৃষ্টি খোলা।
বুঝি তাই আজীবন আকাশ-মাতাল আমি, তাই
পরিণামে হলো হবার-
নীলিমাকে করেছি সুহৃদ
রত্রিদিন
উপরে উঠছি বলে চক্ষুশূল হবো কি সবার?
না, আমি কখনও আর নিচে নামবো না,
নামবো না, নামবো না।
নিচে নর্দমার গন্ধ। অজস্র পিচ্ছিল কেঁচো বিষাক্ত জজ্ঞাল।
ভালবেসে কেবলি বর্ধিত করে অস্তিত্বের ঢিবি, চতুর্দিকে
অস্তিচর্মসার মানুষের ভিড় আর পথে পথে অধঃপাত
দাঁত বের করে হাসে। নগরে জঙ্গলে ভেদচিহ্ন লুপ্তপ্রায়,
সবাই ঘাঁটছে নোংরা আবর্জনা উৎসবের উত্তেজনা নিয়ে ।
প্রেম তো সুদীর্ঘ
পত্রের-মার্জেন-ঘেঁষা পুনশ্চের মতো সংকুচিত, ক্ষণজন্মা
শিল্পীরা জলের দরে বিকোয় বাজারে, প্রগতির চাকা দেখি
অবিরত পাঁকে আট্কে যায়; স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা, উদরতা,
করুণা নামক কিছু বিখ্যাত বিষয় আগাগোড়া শোকাবহ
বিশাল কাফনে মুড়ে লোকগুলো মহানন্দে বগল বাজায়,
ঘৃণাকে আনন্দ ভেবে শান্তিকে তর্জমা করে হিংসার কাঁটায়!
বরং আমার এরোপ্লেন শূন্যতায় হযে যাক
খান্ খান্, তবু আমি নিচে নামবো না।
ক্ষধার চিৎকার থেকে, নর্দমার তীব্র গন্ধ থেকে
দারিদ্রের দাঁত নখ থেকে, আতঙ্কের থেকে দূরে,
সমস্ত কাঙালপনা, ক্ষুদ্রতার থেকে
আর কিনু গোয়ালার গলি থেকে দূরে,
নীলিমার নহবত শুনে-শুনে যাবো ঊর্ধ্বে যাবো,
আরো ঊর্ধ্বে আরো
না, আমি কখনো আর নিচে নামবো না,
নামবো না,
নামবো না……
একজন বেকারের উক্তি
যদি হতে পারতাম কোনো হিন্দী ফিল্মের নায়ক
পুণ্যবলে, তবে আমি ডুগডুগি বাজিয়ে ঠিক কৃতী
পুরুষ হতাম জানি। প্রেমের দেবতা যথারীতি
মেঘের আড়াল থেকে দিত ছুঁড়ে পুষ্পিত শায়কঃ
হস্তিমুর্খ ধনী দুলালী সে-ও নির্ঘাত শৌখিন
প্রেমে খেতো হাবুডুবু। মধ্যপথে বাড়াভাতে ছাই
পড়লেও, শেষ দৃশ্যে বিসমিল্লা খানের সানাই
বাজবে মধুর সুরে, হেসে খেলে কেটে যাবে দিন।
অতএব চাকরি বিনে কস্মিনকালে ও ফুটপাত
হতো না চষতে আর পরিশ্রমী কুকুরের মতো
একটি হাড়ের খোঁজে ক্রমাগত গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
হতাম না ক্লান্ত শুধু। আপাতত এই শীর্ণ হাত
করি সমর্পণ দুস্থ জ্যোতিষীর কাছে, ভাগ্যহত-
রুপালি পর্দার লীলা অবিরত থাকে চোখ জুড়ে!
একটি টিনের বাঁশি
যখন ছিলাম সাত বছরের খেয়ালি বালক,
মধ্যদিনে বিছানাকে রত্নদ্বীপ ভেবে সযতনে
খুঁজতাম গুপ্তধন। শিকারের খোঁজে ঘুরে বনে
দিতাম মাথায় গুঁজে সাতরঙা পাখির পালক
রেড ইণ্ডিয়ানদের মতো আর উটের চালক
সেজেছি তো সাহারায়। সে-সব দুপুরে ক্ষণে ক্ষণে
চিরচেনা বাঁশি-অলা বাজাতো টিনের বাঁশি, মনে
জ্বালাতো আতশবাজি, গলিময় সুরের আলোক।
আজ এই জীবনের মধ্যদিনে ভাবি যদি সেই
বাঁশি-অলা ফিরে আসে, এ-গলির মোড়ে ঘুরে ঘুরে
বাজায় টিনের বাঁশি, তা হলে আনাড়ি তার সুরে
পাবো কি আনন্দ আর? ডেকে এনে নিজের পাশেই
আবার বসাবো তাকে? অসম্ভব, সে পৃথিবী পড়ে
হয়ে গেছে ছাই আর সে-বালক অনেক আগেই!
কখনো আমার মাকে
কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কিনা আজ মনেই পড়ে না।
যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর
সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টাপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধাবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কিনা
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।
যেন তিনি গান দুঃখ জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের
প্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!
কবিতার অস্তঃপুরে
যেতে চাই, আকৈশোর মগ্নতায়, অতি সন্তর্পণে
স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে
কবিতার অন্তঃপুরে যেতে চাই। হয়তো সেখানে
রহস্যের ফটক পেরিয়ে
দেখবো আছেন সেই আমর বাগানে
নয়জন ভুবন-মোহিনী;
নয়টি নিবিড় নীল চেয়ারে হেলান দিয়ে বুনছেন কিছু
অন্তহীন সোনালি সূতোয়।
ফুলগুলি (হল্দে, লাল, সুনীল, বেগুনি)
বাতাসে নর্তকী যেন। কেবলি হোঁচট খাই, সার্চ লাইটের
ঝাঁ-ঝাঁ আলো দেখাবো না পথ জানি, তবু যেতে চাই
উজিয়ে সকল বাধা প্রেমিকের মতো।
হয়তো সেখানে
দেখবো রাস্তার ধারে চিতাবাঘ সূর্যমুখী ফুলে
মুখ রেখে বাঘিনীর স্মৃতি আনে ডেকে
কিংবা কাকাতুয়া কোনো দাঁড়টাকে তার
বানিয়ে চাঁদের নৌকো আহলাদে দুলছে সর্বদাই।
রঙিন ধুলোর পথে মনে হবে বিকেলের আলো
সুন্দরবনের
তরুণ জ্বলন্ত বাঘ হয়ে ফের নেমেছে নদীতে!
দেখবো চকিতে,
কয়েকটি ঘোড়া দ্রুত কাকে যাচ্ছে নিয়ে,-
বৃষ্টির সুরের মতো আরক্ত কাঁকরে খুর বাজে,
খুর বাজে শুধু।
সুবচনী হাঁস নিয়ে খেলছে বালক, জানালার
অনেক বাইরে ঝুঁকে ডাকছে মা বেলা গেলো বলে।
বারান্দায় একা বসে কে এক প্রবীণ ভদ্রলোক
নিমগ্ন দান্তের কাব্যে, সূর্যাস্তের গাঁদা ফুল-রঙ
বিশুষ্ক ফলের মতো মুখে পড়ে; জানু বেয়ে তার
একটি চঞ্চল শিশু উঠছে নামছে বার বার।
ইহুদীটা শহরের বাড়িগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে উড়ে,
থলি কাঁধে, জীর্ণ টুপি নড়ছে মাথায়। কোনোমতে
কাকের চোখকে দিয়ে ফাঁকি
কেউবা ছিঁড়ছে রুটি, ক দিনের বাসি, নড়বড়ে
পাঁচিলের ধার ঘেঁষে। কাকগুলি পাখা ঝাপটায়
নগরের সুবিশাল নীলপক্ষ ঘড়ির আয়নায়।
ছাদের চূড়োয় বুঝি একা কেউ বাজায় বেহালা
ভুল সুরে। মধ্যরাতে উলঙ্গ গাধার পিঠে কেউ
গান গায় তারস্বরে। কী যেন পুড়ছে ভয়ানক
শব্দ করে, সভ্যতার বিশ্বস্ত দলিল হয়তোবা।
নিমেষেই সমস্ত শহর
দেখবো কী করে হয়ে যায় ফণিমনসার বন
-এইতো মিশ্রিত চিত্র (সব নয়) সেখানে ছড়ানো।
মেঘ রৌদ্র, এভেনিউ টেলিগ্রাফ তার ইত্যাদির নাম ধরে
ডেকে-ডেকে যাবো চলে ঐ কবিতার অন্তঃপুরে।
কমা সেমিকোলনের ভিড়ে
বিচিত্র হিংসুক ভিড় শিল্পকে প্রচণ্ড লাথি মেরে,
তীব্র কোলাহল করে বোধগুলি আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে
ফেলে দিলো, যেন ছেঁড়া হলুদ কাগজ। ক্রমাগত
সময় তাড়িত তারা, ঘোরে ঘূর্ণিপথে, বাঁশিগুলি
তাদের রোমশ হাতে গুঁড়ো হয়, চতুর্দিকে শুধু
বেজে ওঠে ক্যানাস্তারা। জীবন দু’হাতে ঢাকে কান!
কমা সেমিকোলনের ভিড়ে এ জীবন কখনো বা ঢ্যাঙা এক শূন্যতায়
ভীষণ হাঁপিয়ে ওঠে, পালাই পালাই বলে রোজ
প্রহর হত্যার দায়মুক্ত হতে চায়, মুখ থুবড়ে পড়ে দেখি
কেমন খুঁড়িয়ে হেঁটে স্মরণীয়ভাবে গলি আর এভেনিউ
নিঃসঙ্গ পেরিয়ে যায়, বেলাশেষে হয়তোবা ঝুলে থাকে বাসে।
ডানে কিংবা বামে লতাগুল্ম, তৃণদল
কিছুই পড়ে না চোখে, নিরুপায় রক্তচক্ষু মেলে
দূর নীলনবঘনে।
“এ-ও ভালো শুকনো ডালে ঝুলে ঝুলে তুমি
প্রতিদিন রাজহাঁস হওয়ার রুটিন-বাঁধা স্বপ্নে মশগুল,
এ-ও ভালো রঙরেজিনীর কিছু রঙ ধার নিয়ে কদাচিৎ
নিজের আত্মার চিত্র মনোহারী করার নিখুঁত
প্রয়াসে নিমগ্ন থাকা, ছুঁড়ে ফেলে দেয়া দূরে নিরঙ বুরুশ-
এ-ও ভালো; ভালো এই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা মরজগতের
শিল্প সব, চেয়ে দেখা যা-কিছু লুকানো
রহস্যের রুপালি আধারে, ভালো কমা সেমিকোলনের ভিড়ে
“নিমজ্জন। অতঃপর নানান ফুলের ডাঁটা নিয়ে শূন্য বুকে
বেপরোয়া নিদ্রা যাওয়া ভালো, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পালা
এলেই নিশ্চিত জেনো চুকে যাবে সব পাট। দ্যাখো
সারাক্ষণ কারা যেন সুন্দর পাখির ঝাঁক প্রত্যহ দু’বেলা
পোড়াচ্ছে ফার্ণেসে” বলে এ জীবন ভাঙ্গা হাঁটু গেড়ে
বসে গৃহকোণে আর মাথা রাখে স্বপ্নহীন ক্ষুধিত দেয়ালে।
কাননবালার জন্যে
একদা তোমার নাম হাটে মাঠে ঘাটে, সবখানে
গুজ্ঞরিত হতো জানি। বড়ো মিঠে তোমার সংলাপ
মুখস্থ করতো যারা রাত্রিদিন, তাদের উত্তাপ
জোগাতে মোহিনী রূপে-এ দশকে আজ তা কে জানে!
বিজয়িনী তুমি, তাই সেলুনে কি পানের দোকানে
রবীন্দনাথের পাশে ঝুলতো তোমার ফটোগ্রাফ,
দেখতাম; সে আশ্চর্য বাবুবিলাসের যুগে-সাফ
মনে পড়ে-ছিলে বহু যুবকের বিনিদ্র শিথানে।
কাল তার ত্র্যালবামে কিছুতে রাখে না সব ফটো,
দেয় ঠেলে আস্তকুঁড়ে; সময় বেজায় জাঁহাবাজ।
বুঝি তুমি তাই লোকলোচনের আড়ালে, মলম
পারে না রুখতে আর জরার আঁচড়। বড়ো-ছোটো
পানের দোকানে ঝোলে অন্যান্য বালার ছবি আজ,
নেপথ্যে জীবনী লেখে পুরোদমে ভৌতিক কলম।
কেমন ক’রে শেখাই তাকে
কেমন করে শেখাই তাকে
ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে
জ্বাল্তে তারার বাতি,
যখন কিনা আমরা নিজ
অন্ধকারে শুধুই ভিজে
কাদা ছোঁড়ায় মাতি!
কেমন করে শেখাই তাকে
ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে
বলতে সত্য কথা,
যখন কিনা মিথ্যা থেকে
আমরা নিজে শিখছি ঠেকে
চতুর কথকতা!
কেমন করে শেখাই তাকে
ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে
বাসতে শুধুই ভালো,
যখন কিনা রাত্রিদিন
আমরা নানা অর্বাচীন
হচ্ছি ঘৃণায় কালো।
কেমন করে বলি তাকে
ছোট্ট অবুঝ শিশুটাকে
‘আস্থা রাখো ওহে’!
যখন কিনা বিশ্ব জুড়ে
আমরা শুধু মরছি ঘুরে
নাস্তিকতার মোহে।
কোথাও কেউ নেই
আকাশে চঞ্চল মেঘের কারুকাজ,
বর্ষা সেতারের বাজালো ঝালা আজ।
একটি সুর শুধু শুনছি ঘুরে ফিরে-
সে সুর বাজে যেন আঁধার চিরে চিরে।
বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।
বজ্রে কেঁপে উঠি, বিরহ মেলে দল;
হৃদয়ে ঝরে জল কেবলি অবিরল।
কৌতূহলে হাত বাড়াই ডানে বামে,
আঁধারে শূব্যতা, হতাশা বুকে নামে।
বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।
আমার পৌরুষ অবুঝ পাখি হয়ে
আঁধারে মুখ রেখে কাঁদে না লোকালয়ে।
তবুও মেঘেদের অকূল হুতাশনে
স্মৃতির লোকালয়ে পড়ছে কাকে মনে?
বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।
আকাশ ঢেকে গেছে নীলাম্বরে আজ,
ভাবছো কোন ছলে করবে তুমি সাজ?
আপন অঙ্গ তো চেনাই হলো দায়।
কী মেঘে বিদ্যুৎ লুকিয়ে ভীরু পায়?
কেমন করে বলো নামবে তুমি পথে!
পারতে যদি সেই নীলাম্বরী হতে!
আমার অঙ্গনে সিক্ত এলোচুলে
আঁচলে মুছে মুখ দাঁড়ালে নাকি ভুলে?
আমার অঙ্গন আঁধারে হলো বন,
নিয়েছি বুক পেতে জলের দংশন!
বাইরে কিছু যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।
কোথাও পারি না যেতে
(টি , এস এলিয়টকে নিবেদিত)
আমরা ভেবেছিলাম খড়ে-ঠাসা মাথা নিয়ে শুধু
হবে না ঘুরতে আর সাত পুরুষের
বিধ্বস্ত ভিটায় কিংবা জনশূন্য অলিতে গলিতে
প্রলাপের ঝোঁকে
হবে না কুড়াতে বুঝি সময়ের সুতীব্র ধিক্কার।
যাত্রারস্ত হয়েছিলো মনে,
তোমাকে সুদূর কোনো পিতামহ ভেবে
মহানন্দে বাড়াবো পা নতুন যুগের চৌমাথায়।
হা কপাল! তোমারই গণ্ডিতে
এখনও রয়েছি বাঁধা, জানি
চুকানো যায় না ঋণ বুড়ো মোড়লকে
কানাকড়ি দিয়ে।
অস্তিত্বের চতুর্দিকে কখন দেয়াল
হয়ে গেছে গাঁথা,
এখন সেখানে মাথা ঠুকে
কী ভীষণ অর্থহীন অলীক ভাষায়
পরস্পর কথা বলি, ঘেন্নায় দেখি না মুখ কারো।
যখন-তখন ভয় পাই, চমকাই
নিজের বিকৃত ছায়া দেখে
আর মনে হয়
সবকিছু মেরামত সাপেক্ষ এখনো,
তাই ‘মিস্তিরিকে ডাকো’বলে
ভীষণ চেঁচিয়ে উঠি
সামনের সিঁড়ির পাশে
ধ্বংসের রাজধানীতে!
আমাদের চতুর্দিকে রাস্তা খোলা, তবু
কোথাও পারি না যেতে। কে এক চতুর
বাজিকর শস্তা কিছু আলোর খেলায়
সর্বদা মাতিয়ে রাখে, স্ফুর্তি জাগত!
বন্ধুর কামিজ কোর্তা অকাতরে নিজের বলেই
হামেশা চালিয়ে দিচ্ছি, আমি খাঁটি নবীন যুবক।
শস্তা নভেলের খালে চালাই নিরুদ্ধ কামনার
বেসামাল নৌকোটিকে। আমার ভোটাধিকার নেই
জীবনের নির্বাচন কেন্দ্রে আমি ব্যালট পেপার
হারিয়ে ফেলেছি যেন, পাতিপাতি করে খুঁজি তবু
পাই না হদিস তার। পক্ষান্তরে জীবনকে বলিঃ
কী খেল দেখালে ভায়া, বেধড়ক বসিয়েছো পথে
এবং নিয়েছো কেড়ে ছলে বলে সব পুঁজিপাটা।
প্রত্যহ বন্ধুরা বলেঃ “কেন শুধু আগুনের ঝড়ে
বল তো কিসের মোহে রাত্রিদিন পাখা পোড়াচ্ছো হে?
চেয়ে দ্যাখো কয়েকটি যুবা,-বাক্সর্বস্বের দল-
হাঁটু মুড়ে বেপরোয়া দুরাশার মহান চত্বরে
রাত্রিকে করছে পান ক্রমাগত চাঁদের গেলাশে!
তুমি শুধু ভয় পাও, যেন আর্ত হরিণের চোখে
জটিল লতার ছায়া, অথবা বাঘের থাবা কাঁপে।
উপদ্রুত কেরানীর বিশুষ্ক মুখের মতো যাচ্ছেতাই এক
অন্ধকারে আমরা স্বপ্নের
গলা টিপে নানাবিধ হত্যাকাণ্ডে মাতি,
কখনো আবার
জীর্ণ হোটেলের
টেবিলে চিবুক রেখে বলি, আমাদের মনীষাকে
বয়স্ক করেছো ভরে আমাদের সংকীর্ণ আকাশ।
জনাকীর্ণ পথে হাঁটি, আওড়াই ধ্যানমগ্নতায়ঃ
হতশ্রী জীবনে
কিছুটা পালিশ দাও প্রভু, জানতাম
একদা ফ্লেবস ছিল সুকান্ত পুরুষ, দীর্ঘকায়।
কোনো অশ্বারোহীকে
মধ্যযুগের পুরু মৃত্তিকা ফুঁড়ে
হঠাৎ এসেছো, শরীর বীরের ঢং।
পাথুরে জমিতে আলোর ফুলকি ওড়ে,
বর্ম তোমার অনেক জবরজং।
ঘোড়ার খুরের শব্দে চমক লাগে,
নগরবাসীর জিজ্ঞাসু চোখ জ্বলেঃ
“অবেলায় এলো এ কোন্ অশ্বারোহী”
প্রাক্তন ঘোড়া ভড়কালো কোলাহলে।
কারুকাজময় গবাক্ষে হাত রেখে
দয়িতা তোমার দাঁড়াবে না ব্রীড়াভরে,
দেখাবে না পথ ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে;
এখন সে লোটে নিয়ন-দীপ্ত ঘরে।
জয়ের নেশায় রক্তগোলাপ দেখে
তুমি বিবিক্ষু একেলে বিসংবাদে?
স্বেদাক্ত ঘোড়া দ্বিধায় দুলকি চলে,
অজানা পথের চিহ্ন বুঝতে বাধে।
তুমি কি বোঝো না ডুয়েলের দিন গত?
তবে কেন বৃথা উঁচিয়ে নগ্ন অসি
তেড়ে আসো আজো একালের পোড়ো মাঠে?
প্রাচীন জরিতে ছড়ায় কালের মসী।
ড্রাগন হননে সুবেশ অশ্বরোহী
এসেছো উড়িয়ে অনেক যুগের ধুলি?
তোমার সুনীল ঘোড়ার খুরের ঘায়ে
পালকের মতো উড়ছে মড়ার খুলি!
ড্রাগনের দিন হয়নিকো অবসিত,
কিন্তু তোমার বর্শা অকেজো আজ।
দ্যাখো ভীষণের নৃত্যনাট্য দ্যাখো,
দ্যাখো জনপথে জন্তুরা জাঁহাবাজ।
তোমার বর্ম অথবা অশ্ব দেখে
উঠবো কি মেতে অর্বাচীনের মতো?
ভুলিনি ভীষণ রক্তবমন আজো,
এখনো কাঁদায় মহাসমরের ক্ষত।
লুপ্তি ঘনায় সব দিগন্ত জুড়ে,
পাঁজর-খাঁচায় পিশাচের তাল গুণি।
কার নিঃশ্বাসে ফুলেরা ভস্মীভূত?
নিরুপায় শুধু ধ্বংসের কাল শুনি।
এ যুগের আঁধি রুখবে কি দিয়ে বলো?
লুকা ও বরং অতীতের কোনো গড়ে।
বল্লম আর সাধের শিরস্ত্রাণ
শোভা পাক আজ ঘুমন্ত যাদুঘরে।
খেলনা
আমার মেয়েকে দেখি বাড়িটার আনাচে কানাচে
বেড়ায় আপন মনে, ফ্রক-পরা। খেলাঘরে তার
রকমারি খেলনা নিয়ে সকাল-বিকাল মেতে আছে।
দেখি রোজ ঘটা করে পুতুলের বিয়ে দেয় আর
ছোটায় কাঠের ঘোড়া তেপান্তরে, সমুদ্রে ভাসায়
সপ্তডিঙা। মায়ের গজ্ঞনা কিংবা পিতার নিষেধ
মানে না কিছুই, শুধু পুতুল-ভাঁড়ের তামাশায়
হাসে, নাচে ছড়ার ঘরোয়া ছন্দে, নেই কোনো খেদ।
আমারও খেলার শখ আশৈশব, খলনার রূপক
স্বকালে করেছে ভিড়, তাই দৃশ্যান্তরে খলনাগুলি
কতিপয় শস্তা বুলি আর নষ্ট ধারণার ছক
মনে হয়। সংসার-জলার কাদা ঘেঁটে ছেঁকে তুলি
রঙচটা ভাঙা মূর্তি-মন আর বসে না খেলায়,
খেলনা ফেলে বসে থাকি নিরুপায় আজ অবেলায়।
ঘৃণায় নয়
অতীতের মায়াবী পাহাড় থেকে এ বর্তমানের
নিবিড় উপত্যকায় এসে দেখি জীবন ফিরিয়ে
আছে মুখ অন্ধকারে। একজন বৃদ্ধ গাঢ় স্বরে
বললেন হাত ছুঁড়েঃ “সৌন্দর্য, মহত্ত্ব সত্য আর
সদ্গুণ ইত্যাদি রক্ষা করো, রক্ষা করো এ বাগান-
যেখানে পাখির গান শিল্পের প্রতীক খোঁজে প্রতি
লাল নীল ফুলে স্তব্ধ পাথরে মনের অস্তরাগে,
যেখানে হাতের মুঠো ভরে যায় সোনালি পালকে।“
অন্ধকার জীবনের বাগানে নিগ্রোর মতো শুধু
আর্তনাদ করে ওঠে, মহত্ত্ব পিছল নর্দমায়
ভেসে যায়, সৌন্দর্য কবরে পচে, সত্য অবিরাম
উদ্ভ্রান্ত ভিখিরী হয়ে ঘোরে মনীষার মন্বন্তরে।
আমার শয্যায় দেখি অজস্র মৃত্যুর ছায়া আর
হাজার হাজার ঘোড়া খুরের আঘাতে, কেশরের
আন্দোলনে আবার জাগাতে চায় মৃত শতাব্দীকে
আমার শরীরে, চোখে। আমি ছিন্নভিন্ন অন্ধকারে।
একমুঠো তারা দিয়ে যদি কেউ আমার পকেট
ভরে দেয় কিংবা কতিপয় জনপ্রিয় খেলনা দেয়
হাতে তুলে-তবু আমি হাতের শিকড় দেব মেলে
জীবনের সমৃদ্ধ মাটিতে, স্বর হবো আশ্চর্যের।
ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাকে কাগজের মতো
যদি গুঁজে দেয় কেউ হাতে, টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে
এক ফুঁয়ে পারবো না হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে সব।
কেননা শিখিনি ঘৃণা, বস্তুত ঘৃণায় নয় জানি,
প্রেমেই মানুষ বাঁচে। চিরদিন বিমুগ্ধ নিষ্ঠায়
তাই শাদা চাঁদ কাফ্রি-রাত্রির প্রেমিকা পৃথিবীতে।
চতুর্দশপদী
মনে পড়ে কোনোদিন আমাদের আবদ্ধ জলায়
চিলে তুমি রাজহংসী। শ্যাওয়ার পিছল সবুজে
কখনো হয়নি ম্লান শাদা পাখা, আলো খুঁজে খুঁজে
গ্নণ্ডি ছেড়ে চলে গেছো বহু দূরে। তোমার চলায়
এ-কাল মেলেছে দল। প্রতারণা কি ছলাকলায়
আনোনি বিভ্রম কোনো মগ্ধ চোখে; স্বপ্নের গম্বুজে
বাধোনি সুখের বাসা মসৃণ আরামে চোখ বুজে
এবং হওনি বিদ্ধ শিকারীর তীরের ফলায়।
জলার কাদায় আজো আমাদের চঞ্চু, পাখা ডোবে,-
মজে থাকি অধঃপাতে। মধ্যে-মধ্যে হাই তুলি, ভাবি
এখন কোথায় তুমি? বুঝি না দারুণ সর্বনাশ
পেতেছে জটিল ফাঁদ আমাদের অস্তিত্বের লোভে।
উড়ো কথা কানে আসেঃ মেটাতে এ জীবনের দাবি
ইতিমধ্যে এমন কি তুমিও হয়েছো পাতিহাঁস।
জনৈক সহিসের ছেলে বলছে
ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ
ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে, আমি একা
খড়ের গাদার শুয়ে ভাবি
মুমূর্ষু পিতার কথা, যার শুকনো প্রায়-শব প্রায় অবাস্তব
বুড়োটে শরীর
কিছুকাল ধরে যেন আঠা দিয়ে সাঁটা
বিছানায়। গতায়ু হবেন যিনি আজ কিংবা কাল,
অথবা বছর ঘরে, আপাতত ভাবছি তাঁকেই,
তাঁকেই ভাবছি যিনি ঘোড়াকে জরুর মতো ভালোবেসেছেন
আজীবন। মুমূর্ষু পিতার চোখে তরুণ ঘোড়ার
কেশরের মতো মেঘ জমে প্রতিক্ষণ। মাঝে-মাঝে
তাঁকে কেন যেন
দুর্বোধ্য গ্রন্থের মতো মনে হয়, ভাষা যার আকাশ-পাতাল
এক করলেও, মাথা খুঁড়ে মরলেও
এক বর্ণ বুঝি না কখনও।
“জকির শার্টের মতো ছিল দিন একদা আমারও,
রেসের মাঠের সব কারচুপি নখের আয়নায়
সর্বদা বেড়াতো ভেসে। প্রতিদিন গলির দোকানে
ইয়ার বন্ধুর সাথে চায়ের অভ্যস্ত পেয়ালায়
দিয়েছি চুমুক সুখে। বিড়ির ধোঁয়ায় নানারঙ
পরীরা নেচেছে ঘুরে আর অবেলায়
কোথাও অশেষ স্বপ্ন ভাড়া পাওয়া যাবে ভেবে কতো
অলিগলি বেড়িয়েছি চষে আর রাতের বাতাসে
উড়িয়ে রুমাল হেসে শক্রতা, ব্যর্থতা ইত্যাদিকে
কাফন পরিয়ে
আপাদমস্তক
‘বলোতো তোমরা কেউ স্বপ্ন ভাড়া দেবে’-
বলে তীব্র কণ্ঠস্বরে মাথায় তুলেছি পাড়া, ভাগ্যদোষে পাইনি উত্তম।
“রাজা-রাজড়ার দিন নেই আর ছাপার হরফে
কত কিছু লেখা হয়, কানে আসে। ছোটো-বড়ো সব
এক হয়ে যাবে নাকি আগামীর সখের নাটকে!
বর্তমানে এ দেশের স্ত্রী-পুরুষ সাপের পাঁচ পা
হঠাৎ দেখেছে যেন। দিনগুলি হিস্টিরিয়া রোগী”-
কখন ও মুমূর্ষু পিতা ঘোড়ার উজ্জ্বল পিঠ ভেবে
সস্নেহে বুলোন হাত অতীতের বিস্তৃত শরীরে।
মাঝে-মাঝে গভীর রাত্তিতে
দেখেন অদ্ভুত স্বপ্নঃ কে এক কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়া উড়িয়ে কেশর
পেরিয়ে সুদূর
আগুন রঙের মাঠ তাঁকে নিতে আসে।
অথচ আমার স্বপ্নে রহস্যজনক ঘোড়া নয়,
কতিপয় চিম্নি, টালি, ছাদ, যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্টরির
ধোঁয়ার আড়ালে ওড়া পায়রার ঝাঁক
এবং একটি মুখ ভেসে ওঠে, আলোময় মেঘের মতোই
একটি শরীর
আমার শরীর মেশে, আমি স্বপ্নে মিশি,
রুপালি স্রোতের মতো স্বপ্ন কতিপয়
আমার শরীরে মেশে, আমি মিশি, স্বপ্ন মেশে, আমাকে নিয়ত
একটু একটু করে স্বপ্ন গিলে ফেলে।
তিনটি ঘোড়া
তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ,
বন্য কেশরের জ্বলছে বিদ্যুৎ।
চোখের কোণে কাঁপে তীব্র নরলোক,
তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ।
আকাশে মেঘদল সঙ্গ চায় বুঝি,
মাটির নির্ভর উঠছে দুলে শুধু।
বাতাসে ঝলমল মুক্ত তলোয়ার,
তিনটি তলোয়ার আঁধারে ঝলসায়।
স্বপ্নহীনতায় স্বকাল হলো ধু-ধু,
স্বস্তি নেই খাটো মাঠের মুক্তিতে।
খুরের ঘায়ে ওড়ে অভ্র চৌদিকে,
তিনটি শাদা ঘোড়া স্বপ্ন তিনজন।
শূন্যে মেঘদল যাচ্ছে ডেকে দূরে,
মেঘের নীলিমায় দেয় না ধরা তারা;
লক্ষ গোলাপের পাপড়ি ওঠে ভেসে,
অন্ধকারে যেন মুখের রেখাগুলো।
তিনটি ঘোড়া বুঝি সাহস হৃদয়ের,
ত্রিকাল কেশরের শিখায় জাগ্রত।
শূন্য পিঠে ভাসে মুকুট উজ্জ্বল,
তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ।
তিনটি হাঁস এবং পিতামহ
রাস্তার লোকটা সেই তিনটি নিস্তব্ধ হাঁস রেখে
চলে গেলো, প্রায় কিছু না বলেই লম্বাটে পা ফেলে
অন্তর্হিত; যেন বোবা, ক্ষমাপ্রার্থী হয়তোবা। দেখি
স্কুটার-দলিত শাদা-লাল হাঁসগুলো বারান্দার
কংক্রীটে নিঃসাড় চঞ্চু রেখে নির্বিকার পড়ে আছে
মূক বেহালার মতো।
তাদের শরীর ছুঁয়ে বুঝি
বহু যুগ বয়ে গেছে প্রবল হাওয়ার। কে বলবে
ওরা তিনজন মৃদু ঘুরতো বাগানে, খেতো খুঁটে
খুদকুঁড়ো, তুলতো গুগলি কিছু পুকুরে ফুলের মতো ভেসে
কোনে দিন? এখন তো তারা শুধু তিনটি স্তব্ধতা
বারান্দায়, আমাদের স্নেহের ওপারে। ছায়াচ্ছন্ন
বারান্দায় দৃষ্টি মেলে জেদী পিতামহ
তাঁর অন্ধকার ঘরে একা
সমুদ্রের ঢেউয়ের ফেনার মতো চূল নেড়ে নেড়ে
-যেন সেই ঝড়ের রাতের রাজা, উন্মত্ত লীয়ার-
চতুর্দিক আর্তনাদে দীর্ণ করে বললেনঃ “ওরে
ফিরিয়ে আনলি কেন শীতল কংক্রীটে?
এখ্খুনি নিয়ে যা তোরা, আমার স্বপ্নের শবগুলি
ফিরিয়ে আনলি কেন? নিয়ে যা, নিয়ে যা!”
দাগ
“না, আমি কস্মিনকালে তোমার এ নৈঃসঙ্গ্য ঘোচাতে
পারবো না”, বলে তুমি সেই ছোট ঘরটি গোছাতে
মন দিলে। এটা-সেটা নেড়ে চেড়ে তুলে নিলে দুল
বালিশের নিচে থেকে, পরলে আবার। এলোচুল
সহযে বিন্যস্ত হলো; পরিচিত গন্ধমাখা ঘরে
বিধ্বস্ত স্নায়ূর রাজ্য, বন্দী আমি ভয়ের নিগড়ে!
বুঝি তাই অকস্মাৎ বুকে টেনে নিলাম তোমাকে
সংক্রামক হতাশায়। বললামঃ “হত্যা করো তাকে,-
আমার এ নৈঃসঙ্গ্যকে; তোমার স্বপ্নের পাটাতনে
তুলে নাও হাত ধরে। বাকল-বঞ্চিত গাছ বনে
যেমন দাঁড়িয়ে থাকে তেম্নি তুমি থাকে আজ পাশে,
আলিঙ্গনই জানি রক্ষাকবচ এমন সর্ব নাশে।“
নৈঃসঙ্গ্য হত্যায় মেতে খুলে নিলে দুল, নিরুত্তাপ
বালিশে নামলো কালো উচ্ছল প্রপাত। কার ছাপ
খুঁজি তবু সবখানে? উন্মীলিত তোমার দু’চোখ
আমার চোখের নিচে, যেন দুটি সভ্যতার শোক
ভ্রষ্টলগ্নে শুধু কাঁপে পাশাপাশি। দু’চোখের তটে
সে মুহূর্তে দেখি মহাপ্লাবনের দাগ জেগে ওঠে।
নিজের কবিতার প্রতি
কবিতা আমার ধমনীকে তোর
জোগাই নিত্য রক্তকণা।
হায় রে তবুও তোর জন্যেই
পদে পদে জোটে প্রবঞ্চনা।
হেঁটেছিস পথ গুরুজনদের
শত গজ্ঞনা মাথায় করে।
কাটা ঘুড়ি তুই, বাতাসের লেজ
শাসাচ্ছে তোকে অবুঝ ওরে।
হায় রে দুস্থ কবিতা আমার
তুলে নিলি কোন্ জোয়াল কাঁধে!
কিসের তাড়ায় এখানে যে তোর
চক্ষুলজ্জা খোয়াতে বাধে!
ছেঁড়া কাঁথাটাকে সম্বল করে
কতকাল আর ঘুরবি বল?
নির্বোধ নারী, বাতুল পুরুষ
তোর কাছে চায় সুখের ছল।
অনাবশ্যক মুক্তো ছড়ালি
ফোটালি অলীক কথার খই।
যোগ্য মূল্য দেবে যে তেমন
উলুবনে বল ক্রেতারা কই?
পয়ারে কিংবা মাত্রাবৃত্তে
আঁধারকে দিলি আলোর ধার।
বিশ্বজোড়া সে সন্তাপ ছেঁকে
এনেছিস বটে সত্যসার।
প্রতি পক্ষের বাছা বাছা চাঁই
নিন্দা রটায় কাব্যলোকেঃ
রোগজর্জর এক দশকেই
দারুণ শনিতে পেয়েছে তোকে
খ্যাতির দ্রাক্ষা নাগালে পাসনি
বলেই দিবি কি গলায় দড়ি?
তোর দর্পণে চিরন্তনের
প্রতিবিম্বকে ঈষৎ ধরি।
নিরুদ্দেশ দেয়াল
মুহূর্তে মুহূর্তে ভীতি, বদ্ধ কালা চার দেয়ালের
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মগজের কোষে। এমন কি
মস্তিষ্কে দেয়াল গেঁথে হো-হো হেসে ওঠে বহু লোক,
কোপন স্বভাবী লোক। “কী দরকার দেয়াল-পেরুনো
দৃষ্টির দিব্যতা দিয়ে” বলে তারা অভ্যাসের বশে
সত্তার চৌদিকে তোলে পাথুরে দেয়াল ঝোড়ো হাতে।
যতই নিরেট হোক, দেয়ালটা থাকুক আমাকে
ঘিরে পাহারায়,
দৃষ্টি তবু যায় দূরে, দরজা-জানালা
থাকে পড়ে। পা’দুটো কী করে ব্যস্ততায় খোঁজে পথ
গর্তের ভিতর, যাকে বলি ঘর। ডুসেলডর্ফের
পোড়-খাওয়া পথপ্রান্তে যেতে চাই, অস্ট্রিয়ান বাড়ির বাগানে
যে তরুণী ফুল তোলে, নোয়ায় কম্পিত ডাল, যার
স্তনভারে সূর্যগন্ধী ফলের সোনালি-অন্য মনে
গভীর গোলাপটিকে হাওয়ায় দুলিয়ে জীবনের
মানে বলে বাক্যের অতীত- তারই কাছে সারাবেলা
কেবলি পৌঁছুতে চাই।
কায়রোর কফির দোকানে
এক কোণে বসে বসে দৃশ্য গাঁথি, মিনারের মতো প্রবীণ যে ভদ্রলোক
খাচ্ছেন সুগন্ধ কফি, ইচ্ছে হয় বলি তাঁকে, “কেমন আছেন?”
ন্যুইয়র্কে যে বালক বল নিয়ে লাফাতে লাফাতে
ঘোরানো সিঁড়িতে ওঠে, ছায়া দেখে ভয় পায়, তাকে বুকে নিয়ে
হরবোলা সেজে জেনে নিতে চাই কী যে তার নাম। ক্যাথিড্রাল
বড়ো রাস্তাটার ডান দিকে রেখে ইচ্ছে হয় গ্র্যাণ্ড ক্যানালের
গণ্ডোলায় দুলি কিছুক্ষণ, দু’দণ্ড বিশ্রাম নিই
প্যারিসের বুলেভারে কিংবা বুদোয়ারে। হাঙ্গেরির
শাদা বাড়িটার
সুদৃশ্য কার্ণিশ ঘেঁষে ভোরের আলোয় মাখা যে পায়রাগুলো
উড়ে যায়, শূন্যতাকে চেয়ে বার বার,
মাদ্রিদের লিরিক জ্যোৎস্নায় আধ-পাগলা যে লোকটা
গত শতকের ঢের কুহক সঞ্চারী শোকগাথা করছে রচনা আর
গীটার ধ্বনিতে এলদেরাদোর ছবি চৈতন্যে জাগায়,
ছন্নছাড়া তাকে, সেই পায়রাগুলোকে
চোখ ভরে দেখবার, সবখানে পৌঁছুবার, রেড স্কোয়ারের
মিশ্র ভিড়ে, পিকিং-এর প্রাণের মেলায়, সবখানে
পৌঁছবার খোলা রাস্তা চাই।
টপকে প্রাক্তনী চোরাবালি হঠকারী যে মদ্যপ
অমিত্রাক্ষরের মায়ামন্ত্রে সেই ঊনিশ শতকে
সমুদ্রে ভাসালো পোত, আমি তার উত্তরাধিকারী-
শিরায় শব্দের ঝোড়ো গান, চৈতন্যের নীলিমায়
সারসের পক্ষধ্বনি শুনি, কী আবেগে অকস্মাৎ
দেয়াল চাহিদ হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।
পিতলের বক
(আবুল হোসেনকে)
এতদিন আছি তার কাছাকাছি তাই দুটি চোখে
দেখেছি কৌতুক শ্লেষ, টকরো হাসি। স্তব্ধতায় ঠায়
টেবিলে দাঁড়িয়ে আছি আঠারো বছর এক পায়
ধ্যানী আলো-অন্ধকারে। প্রতিদিন তার প্রাণলোকে
কতো কী-যে ঘটে দেখি, ঘোরালো তর্কের তীক্ষ্ণ নখে
ছেঁড়ে ঢের জটিল তত্ত্বের সূত্র, কাটায় হেলায়
সময় শব্দের প্রেমে, বুদ্ধির দেউড়ি আগলায়
সারাক্ষণ। বাষ্পাকুল হয় না সে আনন্দ কি শোকে।
কিছুতে পাই না ভেবে কৌচে বসে কী-যে বলে অত
বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের সঙ্গে রোজ। না খাদ্য, না ঘুম
কিছুই পারে না তাকে বাধা দিতে; হয়তো নিছক
বাজে কথা, গা ভাসায় তবু সেই স্রোতে অবিরত।
যদিন মেয়েটা গেলো, কাঁদলো সে নিশ্চুপ নিঝুম
পুরাণ
হে পিতৃপুরুষবর্গ তোমরা মহৎ ছিলে জানি,
রূপদক্ষ কীর্তির প্রভাবে আজো পাতঃস্মরণীয়,
সে কথা বিশ্বাস করি। যে-প্রাসাদ করেছো নির্মাণ
প্রজ্ঞায় অক্লান্ত শ্রমে, জোগায় তা কতো ভ্রাম্যমাণ
চোখের আনন্দ নিত্যঃ অতীতের ডালপালা এসে
চোখে-মুখে লাগে আর ফুটে ওঠে সৃষ্টির বিস্ময়।
আরো গাঢ় অন্ধকারে ভিজিয়ে শরীর পেঁচা, কাক
অথবা বাদুড় আসে শূন্য কক্ষে বিশাল প্রাসাদে
উত্তরাধিকারী খোঁজে, কিন্তু কিছুতেই কোনোখানে
মানবের কণ্ঠস্বর হয় না ধ্বনিত। অলিন্দের
অন্ধকারে ওড়ে শুধু কয়েকটি দারুণ অস্থির
চামচিকে। লেপ্টে থাকে দুর্বোধ আতঙ্ক স্তব্ধতায়।
দূরত্ব বজায় রেখে দেখে সব খিলান, গম্বুজ
ইত্যাদিতে জমেছে শ্যাওলা আর সিংহ দরজায়
হিংসুক সময় তার বসিয়েছে থাবা। প্রশংসিত
কীর্তিস্তম্ভে ঝরে যাচ্ছে বহু প্রতিবিম্ব পুরাণেরঃ
বিধ্বস্ত ভাঁড়ার ঘরে অতীতের সারসত্য, সব
ভাবনাকে আনায়াসে খুঁটে খায় ইঁদুর, আরশোলা।
হে পিতৃপুরুষবর্গ আমাকে ভেবো না দোষী যদি
এ প্রাসাদ বসবাসযোগ্য মনে না-হয় আমার,-
কেন না এ-সৌধ আর মরচে-পড়া তালার বাহার
করে না বহন কোনো অর্থ অন্তত আমার কাছে।
তোমাদের কারুকাজে শ্রদ্ধা অবিচল, কিন্তু বলো-
কী করে পিতার শব কাঁধে বয়ে বেড়াই সর্বদা?
আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন,
তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পরাণে।
প্রতীতি আসেনি
প্রতীতি আসেনি আজো, শুধু গৃহপালিত স্বপ্নের
তদারকে বেলা যায়। অস্তিত্বকে ভাটপাড়া থেকে
টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে, চিকণ কথার বিদ্যুল্লতা
থেকে দূরে উল্টো পাল্টা চিত্রকল্পে দিয়েছি পা মেলে।
বশংবদ নক্ষত্রেরা আত্মায় জানায় দাবি, দেখি।
সবসুদ্ধ কয়েক শ’, তারও বেশি সুকণ্ঠ কোকিল
হত্যা করে, বহু লক্ষ প্রজাপতি ছিঁড়ে, পাপিয়াকে
সোৎসাহে নির্বংশ করে, লোকটা সদর্পে হেঁটে গেলো
রোমশ ছত্রিশ ইঞ্চি ঠুকে ঠুকে। সময়ের ছাদ
ধসে যেতে চায়, দেখলাম ভূতগ্রস্ত নগ্নতায়।
শতাব্দীর ফসিল জমানো কতো কবির পাঁজরে।
মধ্যে মধ্যে হাতড়াই স্বর্গের চৌকাঠ, বসে বসে
দিনের উদ্বেল স্তন খুঁটি; ভাবি, নিস্তাপ সন্ধ্যার
মেঘমালা, ফুলের নিশ্বাস, বৃক্ষ ছায়া, দাঁড়বন্দী
পাখিটার টলটলে চোখগুলো আমাকে কবিতা
দেবে কিছু? দশটি আঙুলে খুঁটি নিজেরই পাঁজর।
প্রতীতি আসেনি আজো, প্রেম আসে মরালের মতো,
ডানা ঝাপটিয়ে বসে চিত্তহারী প্রচ্ছন্ন মাস্তুলে।
ভাটপাড়া থেকে দূরে ভালবাসা তুমি থাকবে কি?
মেলবে কি পাখা এই ভূতগ্রস্ত কলঙ্কী পাঁজরে?
প্রভুকে
প্রভু, শোনো, এই অধমকে যদি ধরাধামে পাঠালেই,
তবে কেন হায় করলে না তুমি তোতাপাখি আমাকেই?
দাঁড়ে বসে-বসে বিজ্ঞের মতো নাড়তাম লেজখানি,
তীক্ষ্ণ আদুরে ঠোঁট দিয়ে বেশ খুঁটতাম দানাপানি।
মিলতো সুযোগ বন্ধ খাঁচায় বাঁধা বুলি কুড়োবার,
বইতে হতো না নিজস্ব কথা বলবার গুরুভার।
বন্ধুদের প্রতি
সময়ের প্রশংসা করবো বলে আমরা ক’জন
খুজি কিছু বাছা-বাছা চিত্রকলা, উপমা প্রতীক
মগজকে হুকুম খাটিয়ে। কল্পনার জামেয়ারে
সত্তা ঢেকে দেখি ক’টি অপোগণ্ড পোকা ইতিমধ্যে
রূপক করেছে নষ্ট। দর্শনের মেরাপ-বাঁধানো
প্রাঙ্গণ কয়েক বিঘা জুড়ে আছে, একটি জিজ্ঞাসা
ভেঙে চুরে হাজার জিজ্ঞাসা আড়চোখে চেয়ে থাকে
দ্বিধান্বিত নীলিমার দিকে। আমরা চেঁচিয়ে মরি
সমস্বরে- ইতিহাস লেখে কতো কাকের ছা বকের ছা-
পাই না স্তুতির ভাষা। কয়েক পুরুষ অপেক্ষায়
স্থিত হলে হয়তো উজ্জ্বল লোকভাষা জন্ম নেবে,
কবিত্বের শৃঙ্গারে বাড়বে জানি কালের জৌলুস।
আমরা কয়েকজন আমোদ প্রমোদ ক্লান্ত হয়ে
আত্মপরিচয় ঢেকে ব্যক্তিগত বিকারী ধোঁয়ায়
দুশ্চিন্তার উপদ্রবে ছিঁড়ে ফেলি শিল্পের জটিল
অন্তর্বাস, পণ্ড করি, কনাব, তারার শুদ্ধ খেলা।
কী ভ্রান্তিবিলাসে দেখি ধাতুর প্রাসাদে কয়েকটি
অন্ধ ঘোড়া রাত্রিদিন ঘোরে এক অর্থহীনতায়ঃ
তাদের আরোহী নেই, মালিকানা জানা নেই কারো
ত্রিধাতু নির্মিত সেই প্রাসাদের। অন্ধ ও বধির
ঘোড়াগুলি নক্ষত্রে বমন করে, লেজের দাপটে
তাড়িয়ে বেড়ায় খোজা ক্রীতদাস, নগ্ন ক্রীতদাসী
সর্বক্ষণ একই বৃত্তে। অবিবেকী সুরে স্তূপীকৃত
শব হলো ছিন্নভিন্ন, চতুর্দিক নক্ষত্র, বিষ্ঠায়
মতিচ্ছন্ন একাকার। আশেপাশে যা-কিছু চোখের
চাওয়ায় এখনো স্পষ্ট, জোবজগতের সেই সব
আনন্দ সঙ্কট ত্রাস প্রতিক্রিয়া খোঁজে মননের
তীব্র সত্যে, স্বচ্ছতায়। কিন্তু আজো ক’পা বাড়ালেই
পণ্ড হয় চৈতন্যের নব্য নাট্য, মনন গোঙায়!
আমাদের পিতৃপুরুষের চেনা রূপলোক আজ
ব্যঙ্গচিত্র বর্ণাভাসে চৈতন্যের বিনিদ্র নিষ্ঠায়,
জীবন যাত্রার নাটে। যখন বাতিকগ্রস্ত আলো
গাধার চিৎকার হয়ে ফেটে পড়ে ধাতুর চত্বরে,
আমরা কয়েকজন একচ্ছত্র ভীষণ পিতলে
নীলিমা মিশিয়ে কিছু, মানবিক গলিঘুঁজি ঘেঁটে
ভুলে যেতে চাই এই শতকের জলাতঙ্ক, দূর
সমাজের সুখসঙ্গ, ভুল রূপকের খেসারৎ!
সমস্ত আকাশে চাঁদ পিটিয়ে রুপালি কানাস্তারা
আস্তাকুঁড়ে ভাবুককে বেকুব বানায়। অবসাদে
হাই তোলে ইতিহাস। হরিণ এবং খচ্চরের
সংগমে নিতেছে জন্ম অদ্ভুত বেখাপ্পা জন্তু সব।
পৃথিবীকে বদলাতে পারি না আমরা, পারবো না
ওষুধবিষুধ দিয়ে কিংবা ঝাড়ফুঁকে পৃথিবীর
শুশ্রূষা করতে। শুধু কিছু উপমা প্রতীক আর
চিত্রকল্পে শিল্পের শুদ্ধতা দেব ভাষার গতিকে।
বন্ধুর জন্যে
কৌচের কোমলে ডুবে গৃহিণীর গানের বাগানে
হরেক ফুলের শোভা দ্যাখো চোখ বুজে সবখানে,
প্রহর বদলায় রঙ গানে; বন্ধু তুমি প্রেমে
জল হয়ে যাও গলে। হঠাৎ বহতা সুর থেমে
গেলে তুমি “হৃদয় বুড়িয়ে যায় গ্রন্থিল পেশীর
সবলতা ক্রমশ শিথিল হলে? শুধু বিদ্বেষীর
মতো ক্রোধে সহসা ফেলবো খুলে নিজেরই পাঁজর
হাড়ে নিয়ে?”-এইসব প্রশ্ন নেড়েচেড়ে যথারীতি
ক্লান্ত হও, মাঝে-মাঝে শব্দের গন্ধের কিছু স্মৃতি
জিভের ডগায় তুলে হুইস্কির মতো করো পান।
তারপর সবান্ধব রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান
কবিতায় আধুনিক মানুষের আত্মার সন্ধানে
জটিল অরণ্যে করো মৃগয়া প্রচুর! ভিন্ন ধ্যানে
তোমার ছেলেটা দেখি চকখড়ি চকখড়ি চক
ছড়া কেটে ঘরের মেঝেতে বসে নড়বড়ে বক
আঁকে আঁকাবাঁকা টানে (মানে না আঁকার ব্যাকরণ)
হঠাৎ বকের মুখে গেঁথে দেয় তারা অকারণ।
খাঁচার পাখিটা রাগী, নিজেরই নরম ডানা দুটি
করেছে রক্তাক্ত শিকে, কী সুন্দর দুর্বিনীত ঝুঁটি
ক্রমাগত যাচ্ছে ক্ষয়ে ক্ষত হয়ে-তবুও অবুঝ
কেবলি ক’দিন থেকে যেতে চায় বনের সবুজ
পাতায়, রোদ্দুরে, মেঘে।
তুমিও ফিরিয়ে নাও চোখ,
সে কোন অদৃশ্য মোহনায় দ্রবীভূত দুই শোক
অভিন্ন ধারায় বয়। যেহেতু তুমিও জানো বিষ
দিয়ে বিষ ক্ষয় হয়, জীবনতো অন্ধকারে শিস
দিয়ে চলা, ইত্যাদি পাঁচালি,-বুঝি তাই অকাতরে
দুঃখের ফসিলগুলি প্রত্যহ সাজাও থরে থরে।
পেরিয়ে অনেক রাস্তা নাম ধরে ডাক দিই, সাড়া
দাও তুমি, কতোবার আমার অস্থির কড়া নাড়া
শুনে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামো, প্রীত, নিয়ে যাও ঘরে,
আমিও প্রসন্ন হেসে পোষমানা ঘরের আদরে।
প্লাস্টিকের ফুল, মূর্তি কফি সেট- হয় না বিশ্বাস-
থাকবে না চিরদিন। ভয় হয়, সমস্ত নিশ্বাস
শুষে নেয় যেন কেউ। বড়ো ভয় হয়, যদি আর
প্রাণপণে ডেকেও কোথাও না পাই তোমার!
বাংলা কবিতার প্রতি
এসো সখি’বলে বহু যুবরাজ তোমাকে সর্বদা’
তেপান্তরে, নদীতীরে, কাশবনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
ছায়াচ্ছন্ন শাল তাল তমালের ভিড়ে টেনে এনে
মধ্যদিনে শুনিয়েছে রাখালের বেণু। বড়ো বেশি
জলজ কণিকা ফুসফুসে জমেছিলো বলে তুমি
ভুগেছো সর্দিতে খুব, এত ছিঁচকাঁদুনে হয়েছো
আদরিণী কাব্যলক্ষ্মী আমাদের, এত আলুথালু!
তোমাকে বালিকা ভেবে অনেক চটুল মান্যবর
অক্লান্ত বাজিয়েছেন ঝুমঝুমি আর লজেজ্ঞুস
সেধেছেন, কেউ কেউ রঙিন রিবনে বাঁধা কিছু
মনোহারী বাক্স-তুমি হাসিমুখে করেছো গ্রহণ।
(মাঝে-মাঝে ক’জন ঐন্দ্রজালিক নালিমার থেকে
ছিনিয়ে হাঁসের মালা দিয়েছে তোমার কোলে ছুঁড়ে)
দেখেছি তো কতিপয় বিদূষক সাতপুরুষের
কাহন কাহন সোনারূপো দিয়ে নাকছাবি আর
কেয়ূর, পায়ের মল দিয়েছে গড়িয়ে, তুমি গর্বে
গরবিনী, বেড়িয়েছো পাড়া সেই কিঙ্কিণী বাজিয়ে।
না, আমি নিন্দুক নই। তুমিতো জানোই কী আনন্দে
তোমার সান্নিধ্য চাই, একনিষ্ঠ প্রেমিকের মতো
বসে থাকি তোমারই বাগানে। বেল জুঁই কি টগর
ইত্যাদি বটেই, এমনকি মরাপাতা নিই তুলে
ব্যগ্র হাতে। যখন উধাও সব পুষ্পল স্বপ্নেরা
তখন ও তোমার তীব্র আধিপত্য চৈতন্যে আমার।
না, আমি নিন্দুক নই। আপাতত অসহ্য তোমার
চটকসর্বস্ব মুখ-এতকাল একই অঙ্গরাগ
দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। যখন ঝুলন্ত বারান্দায়
দাঁড়াও, বাড়াও মুখ আর হৃদয় দুয়ার খুলে
উঁকি মারো জনপথে, কিংবা নিশীথ টেবিলে রেখে
অলংকার, বিবর্ণ দস্তানা তুমি শস্তা হোটেলের
কামরায় ভাসমান প্রমোদ হিল্লোলে, অনেকটা
বুক-পেট দেখিয়ে দুপুরে ত্রভিনিউ ঘুরে ঘুরে
যখন উত্তাল ঢেউ তুলে হাঁটো নিতম্ব দুলিয়ে,
লজ্জা কি পাও না তুমি? আমি মুখ নিচু করে থাকি।
একই প্রসাধিত মুখ, একই ছলাকলা দেখে দেখে
আলোড়িত অন্ত্রতন্ত্র-বিবমিষা, শুধু বিবমিষা!
বারোয়ারী যে মালা পরেছো সেতো পচে পচে আজ
এক স্তূপ দুর্দশার মতো আর অভিনবত্বমাতাল
কিছু যুবা তোমাকে নামালো পথে, বনেদী জরির
শাড়ি সাতফালা করে ছিঁড়ে গুঁড়ো এলাচের মতো
নক্ষত্রখচির সার্বভৌম অন্তর্বাস কুটি কুটি
করলো সখেদে। তুমি ধুলোয় উবুড় হয়ে রইলে
লাস্যময়ী! স্বেচ্ছাসেবকের দল প্রবল উদ্যমে
তোমার মরালকণ্ঠে দিলো পুরে কতো দুর্ভিক্ষের
বিশীর্ণ পাঁচালি। পচা মাখনের মতো দুর্বিষহ
গন্ধ-প্রসবিনী শরীরে তোমার ভনভনে মাছি
এক ঝাঁক। বলো, বিদ্যাধরী, বলো ন্যক্কার, নেইকি
কিছুতেই? ঘেন্না, বড়ো ঘেন্না, বড়ো বেশি ঘেন্না লাগে-
কালের মন্দিরা বাজে ডানে বাঁয়ে দুই হাতে, শোনো,
এসো ভিন্ন সাজে বিদ্যাধরী ওগো ঘেন্না-জাগানিয়া!
বামনের দেশে
মেঘম্লান চন্দ্রালোকে ক’জন বামন শুদ্ধাচারী
যাজকের জোব্বা গায়ে মহত্তম যুগের স্মরণে
জুটেছে রাস্তার মোড়ে। “দ্যাখো এই পৃথিবীকে দ্যাখো,
আমাদের কীর্তিমান অগ্রজেরা জোগালেন যাকে
স্মরণীয় দিনের মহিমা, যাকে নাটকের শেষ
দৃশ্যের বিক্ষুব্ধ নায়কের মতো শোকে ত্যাগ করে
কালান্তরে করলেন নিঃশব্দে প্রস্থান, তাকে নোঃরা
করেছে অজস্র জন্তু, পবিত্রতা বিগত সুদূর
শতাব্দীর মতো অনাত্মীয়। মোট কথা, ইতিমধ্যে
সযত্নে লালিত সেই পৃথিবীর কতটুকু আর
অবশিষ্ট ধ্যাননেত্রে? হাসি পায়, যখন সম্প্রতি
দেখি কনিষ্ঠেরা শুধু অবিশ্বাস্য ছলে সরাসরি
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে জীবনকে পরায় মুকুট।
অথচ জানে না তারা তাদেরও নিস্তার নেই সেই
ধ্বংসের প্রহার থেকে, হবে শবাগার জীবনের
সমস্ত বৈভব। সে বিপুল অর্থহীন অপচয়ে
তারাও নিশ্চিত লিপ্ত আজীবন। তারাই ইন্ধন”
বলে সেই বামনেরা বাজালো ভ্রান্তির ডুগডুগি।
দূর হ হতাশা,
যা তুই নচ্ছার! জীবনের ত্রিসীমায়
দেখাবিনে মুখ আর, যা তুই ফিরে যা!
মৃত্যুর গোলামি করগে যা, আমরাতো সর্বক্ষণ
জীবনের স্তবে আন্দোলিত,
মজ্জাগত উৎসবের উজ্জ্বল চিৎকার।
সময়ের স্বগতকথনে বার বার
কান পাতি, প্রাজ্ঞ পদাবলী, প্রতীকের উচ্চারণ, রূপাভাস,
গাঁথি মগজের কতো শাণিত ফলকে!
সাধারণ হলেও অন্তত
অতিশয় লঘুমতি যুবা নই, অলৌকিক মন্ত্রের মায়ায়
কবরের ধুলিকে বানাই
নক্ষত্রের ফেনা, যত পারি দূরে রাখি
অনুশোচনার মলময়
কীটের স্বৈরিতা! অমরত্ব কাকে বলে জানি না তা,
সে-জ্ঞানে উৎসাহ কম, বাছা-বাছা ভাষ্যকার তার
দিয়েছেন যে-ব্যাখ্যা তাতেও
কখনো ওঠেনি মন। পিতৃপুরুষেরা
ধারণার যে ক’বিঘে জমিতে লাঙল চষে কিছু
শাক-সবজি, সাধের আনাজ
তুলেছেন ঘরে, সেগুলো রোচেনি মুখে।
আমরা নতুন শব্দ ছুঁড়ে দিই সময়ের মুখে,
সেই শব্দে মুগ্ধ হয়ে কোনো স্থির সহজ সিদ্ধান্তে
না-এসেই আমরা অনেকবার সাগ্রহে হয়েছি পার কতো
স্বল্পজীবী নালিমার সাঁকো!
বলা যায় না করে অধিক বাক্যব্যয়
বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের সঙ্গে ক্রমাগত
বিখ্যাত বসন্ত শুধু করছে বিশ্বাসঘাতকতা।
ভুলেছে স্বধর্ম তার, আমাদের আকাঙ্ক্ষার ডালে
দেয় না ফুলের গুচ্ছ, পক্ষান্তরে চৈতন্যের আনাচে কানাচে
সর্বদা দিতেছে ছুঁড়ে তিরস্কার। নষ্ট বাগানের
ভ্রষ্ট কিছু পাখি।
কবরখানার গান গেয়ে-গেয়ে নিজেরাই ছায়া হয়ে যায়।
এ শহরে চতুর্দিকে ভিড়, চতুর্দিকে
বামনেরা জটলা পাকায়
এবং চাঁদের নখ উপড়ে আনবে ভেবে তারা
গুটিয়ে জোব্বার হাতা এলাহী রগড় করে শেষে
থুতু ছুঁড়ে দেয়
আকাশের মুখে।
মহামান্য বামনেরা সময়ের বিবাহ-বাসরে
অতিথির ভূমিকায় ক্লান্ত হয়ে কন্যাপক্ষ সাজেঃ
অনেক মোড়লি করে-গাঁয়ে না মানুক
তাতে কী বা এসে যায়
সভায় আনতে গিয়ে কনে
আলমারি থেকে টেনে আনে সম্পন্ন ফরাসে এক
প্রাচীন কংকাল!
তারপর বনেদি কেতায় হেসে ওঠে,
যেন তীব্র ফুর্তির প্রগল্ভ পিচকারি
ছুঁড়ে দিলো দুঃস্বপ্নের সংখ্যাহীন বিন্দু,
অন্দরে-বাহিরে
লণ্ডভণ্ড সব,
পণ্ড হলো বিবাহ-বাসর।
বাদ দাও শৃগালের বিখ্যাত ধূর্তামি,
মুখোশের বিচিত্র কল্পনা বাদ দাও।
তুমি কি মিথ্যার জালে পারবে ধরতে
অতর্কিতে উল্লিখিত সত্যের ঈগল
কোনোদিন? পারবে কি সময়ের ত্বক
ছিঁড়ে ফুঁড়ে জন্ম দিতে সোনালি আপেল-
মাংস যার জানবে না অবক্ষয়, শুধু
চৈতন্যের নিঃসংশয় প্রভাবে সে-ফল
চেনা পরিবেশে পাবে শিল্পের মহিমা!
পথে ছুটি দিশাহারা, ফতোবাবুদের
ভিড় দেখি ছত্রভঙ্গ। বিভ্রান্তি চৌদিকে
প্রত্যহ ছড়িয়ে পড়ে প্রবাদের মতো।
পিকাসের গার্নিকা ম্যূরাল মনে পড়ে-
ক্রুদ্ধ সেই ঘোড়াটার আর্তনাদ যেন
আমাদের কাল। আমরা ভয়ার্ত চোখে
ধূর্ত মর্ত্যজীবীদের করুণা কুড়াই
অহর্নিশ। অগোচরে স্বপ্নের ঘোড়াকে
ঝোঁটিয়ে বেড়াই, ভাবি তাকে তাড়ালেই
থাকা যাবে নিশ্চিন্তির সম্পন্ন কোটরে।
অথচ অবাক লাগে যখন স্বপ্নের গলিঘুঁজি
পেরিয়ে ব্রোজ্ঞের তপ্ত চত্বরে দাঁড়াই,
বাঁচবার চেষ্টা করি তীব্র বক্তব্যের
অন্তরঙ্গতায়,
সামনে তাকিয়ে দেখি পরিবর্তনের
টগবগ ঘোড়া
থমকে দাঁড়ায় নৈঃশব্দ্যের ক্ষণস্থায়ী প্রাঙ্গণের
এক কোণে, এবং মাথায় তার স্বপ্নের কিরীট
সম্মোহনে একান্ত নির্ভর।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ে সুতীক্ষ্ণ বাতাসে
এবং তখন
ক্ষুধার্ত চোয়ালে তার বাস্তবের খড়কুটো নড়ে!
যেদিকে তাকাই
নিশ্চয়তা কিছু নেই। দুর্যোগের দিনে
মাদুলি তাবিজ তুকতাক নিয়ে মেতে আছে যারা,
সর্বক্ষণ যারা
পশুদের দাসত্বে বিলীন,
যাদের আত্মায় শুধু পশুদের বিষ্ঠা স্তূপীকৃত-
ভদ্রমহোদয়গণ, তাদের নিষ্ঠায়
তিলমাত্র করি না সন্দেহ,
অথচ নিশ্চিত তারা লোকালয় ছেড়ে
কবরখানায় খোঁজে স্বেচ্ছা নির্বাসন
বস্তুত নিজেরই অগোচরে।
চতুর্দিকে যে বিচিত্র চিত্রশালা দেখি রাত্রিদিন
তাতে সবি ব্যঙ্গচিত্র। চোখ জুড়ে আছে কিমাকার
জীবনমথিত দৃশ্যঃ বিশিষ্ট প্রতিভাবানদের
আত্মার সদগতি করে সম্মিলিত শৃগাল ভালুক
ফিরে আসে ময়লা গুহায়। নির্বোধেরা সারাক্ষণ
গড়ছে এমন সিঁড়ি যা-দেখে শিউরে ওঠে দূরে
ভূশণ্ডীর কাক। দুঃস্বপ্নের জোড়াতালি দিয়ে-দিয়ে
লিখেছে প্রাচীরপত্র সর্বনাশ বড় জাঁক করে।
পৃথিবীর সব কিছু ধোপানীর গালগল্প ভেবে
পথে বসে হতবুদ্ধি হয়ে যাই বামনের দেশে।
বাড়ি
নিজের বাড়িতে আমি ভয়ে ভয়ে হাঁটি, পাছে কারো
নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে। যদি কারো তিরিক্ষি মেজাজ
জ্বলে ওঠে ফস্ করে যথাবিধি, সেই ভয়ে আরো
জড়োসড়ো হয়ে থাকি সারাক্ষণ। আমার যে-কাজ
নিঃশব্দে করাই ভালো। বাড়িতে বয়স্ক যারা, অতি
পুণ্যলোভী, রেডিয়োতে শোনে তার ধর্মের কাহিনী।
মক্ষিরাণী। সংসারে কেবলি বাড়ে শিশুর বাহিনী।
মেথর পাড়ায় বাজে ঢাক-ঢোল, লাউডস্পীকারে
কান ঝালাপালা আর আজকাল ঠোঙ্গায় সংস্কৃতি
ইতস্তত বিতরিত, কম্তি নেই কালের বিকারে।
বুকে শুধু অজস্র শব্দের ঝিলিমিলি। যে-সুকৃতি
জমেনি কিছুই তার কথা ভেবে মাথা করি হেঁট,
ঘুমায় পুরোনো বাড়ি, জ্বলে দূরে তারার সেনেট।
বৃষ্টির দিনে
তখন ও চাঞ্চল্যে ক্ষিপ্র হয়নি শহর, ট্রাফিকের
কলতান বাজেনি প্রবল সুরে। টলটলে স্নিগ্ধশ্যাম ঐ
পার্কের শরীর ঘেঁষে যাচ্ছিলাম হেঁটে দ্রুত পায়ে
বর্ষাতিটা গায়ে চেপে। সহসা সরিয়ে
বৃষ্টির ঝালর একজন হাত রেখে
নিঃশব্দে আমার কাঁধে বললেন গাঢ় উচ্চারণেঃ
“কোথায় ছুটেছো তুমি হন্তদন্ত হয়ে পরিশ্রমী নাগরিক এমন বর্ষায় ?
বরং পার্কের বঞ্চে সময় কাটাই চলো কথোপকরনে,
চলো পার্কে বৃষ্টির আদর মাখি চোখে-মুখে, সেখানে তুমিও
সুম্নাত গাছের সখ্য পাবে, হাওয়ার অশ্রান্ত ম্যাণ্ডোলীন শুনে
বেঞ্চটাকে মনে হবে সাধের গণ্ডোলা।
“এবং তোমাকে বলি শোনো, বার বার
যূথীর সান্নিধ্যে যাওয়া ভালো; মাইল মাইল পথ
বেলা-অবেলায় হেঁটে দেখেছিতো শেষে
সে-পথ কোথায় নিয়ে যায়, কী কল্যাণ হাতে আসে! ট্রাম-লাইনের ধারে
সুকৌশলে হয়তোবা, অপঘাত যেখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকে
সিঁধেল চোরের মতো। ট্রাম-লাইনের ক্ষীণ ঘাসের সম্মোহ
ফুরোয়নি বলে আমি শুনলাম ডাক সেই রৌদ্রের নিশির,
এবং নিমেষে ভাসলাম কী রক্তিম সারোবরে!
“মাইল মাইল পথ হেঁটে দেখেছি তো অবশেষে
সে-পথ কোথায় নিয়ে যায়, কী কল্যাণ হাতে আসে!
পরিশ্রমী নাগরিক দাঁড়াও এখানে ক্ষণকাল স্তব্ধতায়,
বর্ষায় নিমগ্ন হও, নিসর্গকে করো তীর্থভূমি”
এই বলে প্রবীণ জীবনানন্দ পার্কের শরীর ঘেঁষে একা কোথায়
গেলেন দূরে।
জনশূন্য ফুতপাতে চির নিঃসঙ্গতা
মুর্হূতে চোয়াল দিলো মেলে আমন্ত্রণে; চতুর্দিকে
অনাসক্ত বৃষ্টি পড়ে, বর্ষাতির আড়ালে শরীর
সকল বিফল হলো ভেবে ফিনকি হয়ে
যেতে চায় মেঘদলে। দেহ ছাড়ি যেন মোর প্রাণ চলি যায়-
অকস্মাৎ বাতাসে এ কার হাহাকার?
ঝড়ের নদীতে একা টলমল নৌকোর মতোই ভেসে চলি
তিমির দুরন্ত ফুটপাতে। চলতেই শঙ্কিল পঙ্কিল বাট,
ঘন-ঘন ঝন-ঝন বজ্র নিপাত। আকাশের কাজল ট্যাঙ্কের থেকে
জল ঝরে অবিরল, বৃষ্টি পড়ে সমস্ত শহরে, বৃষ্টি পড়ে
অপরূপ স্বপ্নের চত্বরে। মনে হয় যুগ-যুগ ভিজে ভিজে
সত্তায় জমেছে দামী, অনুপম শ্যাওলার কারুকাজ, মৎস্য-ঘ্রাণ, আর
সহসা নিজেই যেন হয়ে যাই বৃষ্টিভেজা রাত্রির শহর!
অগ্রজ কবির মন্ত্রণায় নিসর্গকে তীর্থভূমি
জ্ঞানে দ্রুত যতোটা এগোই তারও বেশি
নিশ্চিত পিছিয়ে পড়ি বিতৃষ্ণায়, আর চিরকেলে
বর্ষার জানুতে মাথা রেখে রেখে বড়ো ক্লান্ত লাগে।
চোখে-মুখে একরাশ বৃষ্টির আঁচড় নিয়ে ঐ স্নিগ্ধশ্যাম
পার্ক ছেড়ে চলে যাই, বিরক্তিতে ভরপুর, অস্তিত্বের শীর্ষে ক্ষান্তিহীন
বৃষ্টি ঝরঝর ব’য়ে ইহুদির মতো
সর্বদাই ধাবমান, নৈঃসঙ্গ্যের কাঁটায় জর্জর।
ভেলায়
জনহীন শিল্পশালায় ভজেছি শূন্যতাকে।
ললাটে অভিশাপের নিদারুণ জড় ল বয়ে
চলেছি নিরুদ্দেশে অজানা জলের ডাকে।
প্লাবনের দামাল হাওয়া বয়ে যায় সত্তা জুড়ে।
স্মৃতিতে উদ্ভিদেরই মায়াবী পুরান ছায়া,
সাগরে যাচ্ছি ভেসে বুড়োটে ভেলায় চেপে।
কবে যে পালের ফালি নিমেষে উধাও হলো,
জানি না হঠাৎ কবে ছিঁড়েছে দাঁড়ের দড়ি।
অজানা সমুদ্দুরে কুহকী নারীর গানে
হারালো দিক্-নিশানা; শোণিতের রুদ্র ঝড়ে
মায়াবী পাহাড় ছুঁয়ে নিমেষে মজলো যারা,
তাদেরই হাড় ক’খানা জমেছে পাথর ঘেঁষে।
কে ঘোড়া মেঘের সাঁকো পেরিয়ে স্বপ্নে আসে?
বুঝি তার খুরের ঘায়ে নীলিমা হচ্ছে গুঁড়ো।
কে জাগায় তন্দ্রা তটে? বেঘোরে বৈঠা দেখি
অবেলায় শিথিল মুঠোয় সহসা উঠলো নড়ে।
নিয়ত লবণকণা ক্ষতকে কামড়ে ধরে।
কখনো ঢেউকে ভেবে রমণীর বক্ষচূড়া
মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ি নিরালা অতল জলে!
কখনো জলজ প্রাণী চকিতে মুখটি তোলে।
সবুজের আশায় জ্বলে একাকী পায়রাটাকে
ছেড়েছি মুঠোয় থেকে ধু-ধু সেই নীলাম্বরে।
নিয়ে তার তীক্ষ্ণ ঠোঁটে সুদূরের চিকন পাতা
ফেরেনি ভেলায় আজো, ফেরেনি পায়রা শাদা।
কিমিয়ার গোপন মায়া এখনো রক্তে নামে।
পুরানের ভগ্ন ছায়ায় বেদনায় পুতুল গড়ে
চলেছি নড়বড়ে এক বুড়োটে ভেলায় চেপে-
অবেলায় যাচ্ছি ভেসে, কেবলি যাচ্ছি ভেসে।
মিশ্ররাগ
খর রৌদ্রের নিথর প্রহরে
শ্রাবণের ঘন মেঘ দেবে বলেছিলে।
তৃষিত চোখের আর্তি ঝরিয়ে
চেয়ে থাকি দূর অসীম শূন্যে, নীলে।
ঘন সমারোহে পুঞ্জ পুঞ্জ
মেঘের জটলা দূর আকাশের পাড়ে;
যেন একপাল কালো মেঘ তেড়ে
লাফ দিয়ে পড়ে শুভ্র মেঘের ঘাড়ে।
হৃদয়ে মরুর বালি ওড়ে আজ,
দারুণ তৃষ্ণা রুক্ষ সত্তা জুড়ে।
ছায়া খুঁজে ফিরি পাথুরে মাটিতে,
কখন যে মেঘ বাতাসে গিয়েছে উড়ে।
দুপুর-রৌদ্রে তোমার ছায়ায়
নিজের ছায়াকে সহযে মিলাতে চাই।
কোন্ সে আগুন শুষে নিয়ে গেছে
স্নিগ্ধ ছায়াকে-পড়ে আছে শুধু ছাই!
হাজার যুগের প্রেমিকের কতো
বাসনা দগ্ধ হৃদয়ে বেঁধেছে বাসা-
সেই গুরুভার বই দিনরাত,
পথের ক্লান্তি ভোলায় ছায়ার আশা।
গৌরাঙ্গীর দেহের বাগানে
চোখের লুব্ধ ভ্রমরের জয়গান।
শিরায় শিরায় সেতারের ঝালা,
রক্তের প্রতি কণা চায় মহাদান।
জ্বলজ্বলে দুটি স্বর্ণ কুম্ভ
কানায় কানায় যৌবন-জলে ভরা।
জীবনের স্বরে ছলকিয়ে ওঠে,
সীমাহীন পথে সে-জল ক্লান্তিহরা!
স্নান সেরে এলে কুন্তল ধারা
ঝরতো একদা গুরু নিতম্ব’ পরে।
কালিয়া আঁধার কনক চাঁদার
শরণ নিতো যে-তা-ও আজ মনে পড়ে!
আমার প্রাণের খর বৈশাখে
মেঘে মেঘে আনো বিপুল বৃষ্টিধারাঃ
হৃদয়ের কূলে সিক্ত হাওয়ায়
কাশফুল হবে খুশিতে আত্মহারা।
কতকাল আর কাটাবো বিষাদে
দিনরাত শুধু স্মৃতি সম্বল করে?
মাঝ মাঝে তাই বিচ্ছেদ ভেবে
বেহুঁশ বেতাল নামি নরকের ঘরে।
দৈব দয়ায় বহুকাল পরে
হয়তো আসবে মিলনের মহাক্ষণ।
কিন্তু তখন কোন্ বনে, হায়,
হরিণ-ক্ষিপ্র তোমার সে যৌবন?
যন্ত্রণা
আমার ছেলেটা জ্বরে ধুঁকছিলো,জ্বলছিলো তার
চোখ দুটো, টকটকে কৃষ্ণচূড়া। কী ভেবে নিলাম
ছোট হাত মুঠোর ভিতর আর ছুঁয়ে দেখলাম
কপালটা যাচ্ছে পুড়ে, হাঁপাচ্ছে সে এবং মাথার
ব্যথায় কাতর খুব। শুকনো ঠোঁট পাখির ছানার
দুরু দুরু বুক যেন, টের পাই। বাইরে উদ্দাম
হাওয়া, দরজায়, জানালার দিচ্ছে হানা অবিরাম।
কেবলি শিউরে উঠি ডাক্তারকে ডাকবো আবার?
কৃষ্ণচূড়া তাকালো আমার চোখে। “খুব বেশি তোর
কষ্ট হচ্ছে খোকা? মাথাটা বুলিয়ে দিই, ঘুমো তুই”
বললাম। সাড়া শব্দ নেই কোনো, বেড়ালটা হাই
তোলে বসে এক কোণে। নিদ্রোহীন ভাবি, হায় ভোর
কি হবে না আর? পারবো না ওর যন্ত্রণা কিছুই
নিতে আমি! যন্ত্রণায় আমরা নিঃসঙ্গ সর্বদাই।
যে আমার সহচর
যে আমার সহচর
আমি এক কংকালকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটি, প্রাণ খুলে
কথা বলি পরস্পর। বুরুশ চালাই তার চূলে,
বুলোই সযত্নে মুখে পাউডার, দর্জির দোকানে নিয়ে তাকে
ট্রাউজার, শার্ট, কোট ইত্যাদি বানিয়ে ভদ্রতাকে
সঙ্গীর ধাতস্থ করি; দু’ বেলা এগিয়ে দিই নিজে
প্রত্যহ যা খাই তাই। কখনো বৃষ্টিতে বেশি ভিজে
এলে ঘরে মাথাটা মুছিয়ে তপ্ত চায়ের পেয়ালা
রাখি তার টেবিলে সাজিয়ে আর শোনাই বেহালা
মধ্যেরাতে বন্ধ ঘরে। মাঝে –মাঝে তাকে হৈ-হৈ রবে
নিয়ে যাই বন্ধুদের গুলজার আড্ডার উৎসবে।
সেখানে সে বাক্যবীর, দর্শনের অলিগলি ঘুরে
শোনায় প্রচুর কথামৃত, সাহিত্যের অন্তঃপুরে
জলকেলি করে তার বেলা যায়, কখনো যা ফের
“শোনো বন্ধুগণ, আত্মাটা নিশ্চয় দামী পাথরের
বাক্স নয়,—সংশয়ের কালো জলে পারবে কি ভেসে
যেতে এই আত্মার পিছল বয়া চেপে নিরুদ্দেশে?
পাবে তীর কোনোদিন?”-ইত্যাকার চকিত ভাষণ
দিয়ে সেও প্রগল্ভ আড্ডাকে করে প্রভূত শাসন।
গলির খেলুড়ে ছেলে যে আনন্দে কাগজের নৌকো
ছেড়ে দেয় রাস্তা-উপচানো জলে কিংবা কিছু চৌকো
ডাক টিকিটের লোভে পিয়নের ব্যাগের ভিতর
দৃষ্টি দেয়-তারই খুশি কংকালের দুটি যাযাবার
চোখ ধরে রাখে। তারপর অকস্মাৎ, “মনে আছে
হাতের বইটা ফেলে রেখে বারান্দায় খুব কাছে
টেনে নিয়েছিলে কাকে? মনে পড়ে সে কার ফ্রকের
অন্তরালে উন্মীলিত হিরণ্ময় মসৃণ ত্বকের
অন্তরঙ্গতায় তুমি রেখেছিলে মুখ? মনে পড়ে
গোধূলিতে কৌমার্য হরণ সেই কৈশোরের ঘরে?”
-বলে সে কৌতুকী উচ্চারণে, যে আমার সহচর,
রয়েছে যে রৌদ্রজলে পাশাপাশি ছত্রিশ বছর।
আমি এক কংকালকে সঙ্গে নিয়ে চলি দিনরাত
অসংকোচে, আতংকের মুখোমুখি কখনো হঠাৎ
তাকে করি আলিঙ্গন, প্রাণপণে ডাক নামে ডাকি
দাঁড়িয়ে সত্তার দ্বীপে নি-শিকড়, একা, আর ঢাকি
ভীত মুখ তারই হতে। যে কংকাল বান্ধব আমার
তাকে নিয়ে গেছি নিজের প্রিয়তমার কাছে আর
অকাতরে দয়িতার তপ্ত ঠোঁটে কামোদ চুম্বন
আঁকতে দিয়েছি সঙ্গীটিকে! কী যে নিবিড় বন্ধন
দু’জনের অস্তিত্বের গ্রন্থিল জগতে, বুঝি তাই
ঘৃণায় পোড়াই তাকে, কখনো হৃদয়ে দিই ঠাঁই!
শুধু একটি ভাবনা
দেখি প্রত্যহ দুঃখের তটে
ভাসে স্বপ্নের রুপালি নৌবহর।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
কী করে বাঁচাই স্বপ্নের মায়াতরী?
পথের প্রান্তে দেখি দিনরাত
একটি বৃক্ষ-পিতৃপুরুষ যেন।
মাথা নেড়ে নেড়ে বলেন সদাই-
“বাচো, সুখী হও, তোমাদের ভালো হোক।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
দিগন্ত-জোড়া প্রলয়ের ঝড়ে
কী করে বাঁচাই প্রবীণ বৃক্ষটিকে?
আজকাল লোকে যায় না বাগানে,
তবু তো ধুলায় গোলাপ বাগান বাঁচে।
সেখানে পাখির কণ্ঠে ধ্বনিত
হৃদয়-মথিত কতো মানবিক গান।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
ফাগুনের স্মৃতি ঝলকিত ফুল
কী করে বাঁচাই বারুদের ঘ্রাণ থেকে?
আমার মায়ের প্রশান্ত চোখ
জেগে রয় রোজ সংসারে নানা কাজে।
প্রসারিত তাঁর হাতের মায়ায়
অন্ধকারেও জ্বলে ওঠে দীপাবলি।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
দিগন্ত-জোড়া প্রলয়ের ঝড়ে
কী করে বাঁচাই পুণ্য সে দীপাবলি?
পুতুলের মতো আমার মেয়েটা
সারাদিনমান পুতুল খেলায় মাতে।
ডাকলে কেবলি দৌড়ে পালায়,
লাল জুতুয়াটা কোথায় যে পড়ে থাকে।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
হিংসুক সেই দৈত্যের থেকে
কী করে বাঁচাই খুকির পুতুলগুলি?
শৈশবের বাতি-অলা আমাকে
সর্বাঙ্গে আঁধার মেখে কো করছো এখানে খোকন?
চিবুক ঠেকিয়ে হাতে, দৃষ্টি মেলে দূরে প্রতিক্ষণ
কী ভাবছো বসে?
হিজিবিজ়ি কী আঁকছো? মানসাঙ্ক কষে
হিসেব নিচ্ছো? দেখছো কি কতটুকু খাদ
কতটুকু খাঁটি এই প্রাত্যহিকে, ভাবছো নিছাদ
ঘরে থাকা দায়, নাকি বইপত্রে ক্লান্ত মুখ ঢেকে
জীবনের পাঠশালা থেকে
পালানোর চিন্তাগুলো ভ্রমরের মতো
মনের অলিন্দে শুধু ঘোরে অবিরত?
থাক, থাক-
মিথ্যে আর বাজিও না দুশ্চিন্তার ঢাক।
নীলের ফরাশে দ্যাখো বসেছে তারার মাইফেল আজো, শোনো
কী একটি পাখি ডেকে ওঠে না-না হয়নি এখনো
অত বস্তাপচা এই সব। লজ্জার কিছুই নেই,
দ্যাখো না খুঁটিয়ে সব আর দ্যাখো এই
লণ্ঠনের আলো, সম্মোহনে যার কল্পনার ওড়াতে ফানুস,
পোড়াতে আতশবাজি আনন্দের খুব,
আশ্চর্যের হ্রদে দিতে ডুব!
করেছো কামনা যাকে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা, আমি সেই আজব মানুষ
তোমার পাড়ায় আজ বড়ো অন্ধকার। সম্ভবত
বাতিটা জ্বালাতে ভুলে গেছ, আমি অভ্যাসবশত
কেবলি আলোর কথা বলে ফেলি। মস্ত উজবুক
এ লোকটা-বলে দাও দ্বিধাহীন। ভয় নেই, দেখাবো না মুখ
ভুলেও কস্মিকালে। তোমরা কি অন্ধকার-প্রিয়?
চলি আমি, এই লণ্ঠনের আলো যে, চায় তাকেই পৌছে দিও।
সংবাদপত্রে কোনো একটি ছবি দেখে
তুমি ও ঘুমিয়ে ছিলে ছোট খাটে, পাছে ঘুম-দ্বীপে
ঝড় ওঠে, পাছে বানচাল হয় চাঁদের মতোই
স্বপ্নের মোহন নৌকো, হাঙরের দাঁত ছিঁড়ে ফেলে
শান্তির রুপালি মাছ কিংবা অপদেবতার ক্রূর
দৃষ্টি পড়ে কচি মুখে, ঘুমের মোমের ডানা পুড়ে
হয় ছাই, পাছে ভয় পাও তাই মায়ের প্রার্থনা
একা ঘরে সারাক্ষণ ছিল জেগে তোমার শয্যার
চতুষ্পার্শ্বে; উদ্ভিদের মতো তুমি ঘুমে ভাসমান।
কে এক ভীষণ দৈত্য তোমার ঘুমের দ্বীপটিকে
অকস্মাৎ দিল নেড়ে প্রাণপণে, অভ্রের প্রাসাদ
হলো গুঁড়ে, বিচূর্ণিত প্রবালের সিঁড়ি। সান্তিয়াগো
উঠলো নড়েঃ দরদালানের ভিতে কে বলবে আজ
কী ঘুণ লুকিয়ে ছিল? এবং তোমাকে কী আক্রোশে
স্বপ্ন দেখে দুঃস্বপ্নের গোলকধাঁধায় দিলো ছুঁড়ে!
সান্তিয়াগো, যেন সে তাসের ঘর, এক ফুঁয়ে হলো
আস্তাকুঁড়; শহরের কণ্ঠ হলো তীব্র হাহাকার।
তোমার বিভ্রান্ত চোখ কী যেন খুঁজছে প্রতিক্ষণ,
কাকে খোঁজো ধ্বংসস্তূপে? মাকে? নাকি বিমর্ষ পিতাকে-
যিনি রোজ শূন্য ঘরে বাজাতেন রাত্তিতে বেহালা,
বিকেলে তোমার ছোট হাত ধরে নিজেরই বাগানে
বেড়াতেন অন্য মনে, শুনতেন পাতার মর্মর।
মাঝে মাঝে “দ্যাখো চেয়ে কী সুন্দর পাখি, ওরা ডালে
শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে,” বলে যিনি সূর্যাস্তের দিকে
দু’চোখ দিতেন মেলে-বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে খোঁজো তাঁকে?
সেখানে যেও না আর। কেউ নেই, কিছু নেই, কালো
একটি বেড়াল শুধু বসে আছে হলুদ জজ্ঞালে।
ছেঁড়া কাগজের টুকরো উড়ে এসে তোমার পায়ের
কাছে থামে। না, সেখানে নেই কোনো রঙিন পুতুল-
যা আছে দেখলে বড়ো ভয় পাবে, যেও না সেখানে।
কে এক বর্বর তার সর্বনাশা খেলার নেশায়
ভেঙেছে তোমার শান্ত খেলাঘর। হে দুঃস্বপ্নচারিণী
আমার হৃদয় হলো তোমাদের বিধ্বস্ত শহর!
সম্পাদক সমীপেষু
আমরা বাগান চাই আমরা ক’জন অকপট,
শান্তিবাদী ক্লান্ত নাগরিক এমন বাগান চাই
যেখানে ফুলের কাছে সহজে পারবো যেতে, ঘাসে
চিৎ হয়ে শুয়ে দিব্যি পা দুটো নাড়বো অকারণ
মাঝে মাঝে। কী কী ফুল থাকবে বাগানে তার সুদীর্ঘ তালিকা
বলোতো পাঠাতে পারি পৌর সমিতির কাছে। ভদ্রমহোদয়,
আমরা বাগান চাই, আমরা ক’জন হতচ্ছাড়া,
যারা মাঝরাস্তা দিয়ে ভাগ্যের ছ্যাকড়া গাড়ি হাঁকাতে হাঁকাতে
বড়ো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সম্প্রতি, আমরাই
শহরে বাগান চাই লিরিকের প্রসন্নতা-ছাওয়া;
এবং বিশ্বেস করো আছে আজো চাওয়ার সাহস।
২
চেতনপুরে ফুলের চারায় ধরলো নতুন কলি;
ছেঁড়া জামায়, জুতোর গর্তে করছি স্বপ্ন জড়ো।
স্বপ্ন-আভায় স্বর্গ হলো চেনা ময়লা গলি,
হিংসুটে সব মত্ত পথিক সরো তোমরা সরো।
আমরা কিছু দুর্বিনীত বাগান বাগান বলে
কান করেছি ঝালাপালা মানী-গুণীর বটে।
ফুলবাগানের অলীক মালী শুনছি সে কোন্ ছলে
মস্ত বাগান সাজিয়ে দেবে, দৈবে কতোই ঘটে!
শিল্পকর্মে আস্থা ছিল বলেই ক্ষুধার দাঁতে
দীর্ণ হয়ে ক্লিন্ন প্রাণে পোড়াই আতশবাজি।
ঘুমাক তারা ঘুমাক সুখে নিদ্রা এলে রাতে,
ঝুলিয়ে কাঁধে মরা পাখি আমরা ঘুরতে রাজি।
৩
এমন বাগান চাই যেখানে গেলেই নির্বিবাদে
লতাপাতা জড়ানো ঘোড়ার মূর্তি দেখে অচিরাৎ
ভুলবো দুঃসহ শোক, বস্তুত বাগানে এসে কোনো কোনো দিন-
বুধবার, শুক্রবার, কিংবা রবিবার, হোক না যে কোন দিন,
খুঁজবো অদৃশ্য আরোহীকে লোহার ঘোড়ার পিঠে!
দেখবো বেঞ্চিতে বসে অচেনা কে লোক চুরুটটা
ফুঁকে ফুঁকে ইতস্তত স্মৃতির খোলামকুচি ছড়াচ্ছে প্রচুর।
বুঝি নিঃসঙ্গতা কালো সহোদর তার!
আমাদের রমণীর মুখে ফুলের স্তবকগুলি
মেলুক আরক্ত ডানা, আমাদের শিশুদের মুখে
দয়ালু বাতাস দিক চুমু ঘন ঘন, ফুলবাগানের ডাল
মাতাল কবিকে দিক কবিতার পংক্তি উপহার।
এবং সেসব ডালে বিষ পিঁপাড়েরা কখনো সদলবলে
বাঁধতে না পারে যেন বাসা; যদি বাঁধে
তাহলে কি করে যাবো বাগানের পথে? কী করে ছেলেরা ডাল
বেয়ে বেয়ে কেবলি হারিয়ে যাবে পাতার জঙ্গলে?
ভদ্রমহোদয়! বারো মাস তের পার্বণ-কাতর
লাজুক আত্মাকে বসতিতে যথাযথ
রাখার প্রয়াসে নিত্য উচাটন আমরা কখনো
গুহাকে করিনি ঘর, রাখিনি পানীয় করোটিতে,
আঁকিনি স্বর্গের নক্সা বাঘছালে, তুকতাক মন্ত্রের প্রাচীন
কোনো পুঁথি ছিল না সম্মুখে সর্বক্ষণ। হল্দে
পুঁথির তুলোট পাতা আকাঙ্ক্ষার শবটাকে কখনো পারে কি
দিতে চাপা? একদিন লক্ষ্যে পৌছে যাবো নিরাপদে
আমরা তেমন কেউ নই; দূরে ও নিকটে
প্রকৃতই লক্ষ্য কিছু আছে কিনা সেও তো জানি না।
নানান ফুলের গাছে সুশীতল জল দেবো বলে
দু’বেলা অসীম ধৈর্যে ঝারি হাতে সবাই প্রস্তুত,
অথচ বাগানই নেই, কোথাও বাগান নেই আজ।
সময়
সময় ক্ষধার্ত বাঘ। পশু, পাখি, উদ্ভিদ, মানুষ
গ্রাম আর জনপদ যা প্রায় গোগ্রাসে গিলে ফেলে
এবং প্রত্যহ খোঁজে নতুন শিকার। চোখে মেলে
চেয়ে থাকে রাত্রিদিন, হিংস্রতায় প্রখর, বহুঁশ।
অশেষ ধ্বংসের কালি মুখে তার মেখেছে কলুষ
যুগে যুগে। জঠরে কি দাঁতে অবাস্তব ক্ষুধা জ্বেলে
ছুটে যায় লোকালয়ে, সভ্যতায়, গেলে অবহেলে
সব কিছু; মহানন্দে ওড়ায় সে জয়ের কানুস।
আমাকে ও প্রতিক্ষণ খাচ্ছে আঘাটায়, আমি তার
জ্বলন্ত চোয়ালে বিদ্ধ, যেমন উদ্ধার অসম্ভব
জেনে ও পথিক কোনো পাহাড়ের খোঁচে প্রাণপণে
পাথর আঁকড়ে ঝুলে থাকে। আর যে মানবতার
দায়ভাগ বয়ে চলি তারই টানে করে যাই স্তব
অমৃতের, যদিও বিরাম নেই কালের হননে।
সেই কণ্ঠস্বর
“নারে খোকা আজ তুই যাসনে বাইরে, দ্যাখ চেয়ে
বাইরে ভীষণ ঝড়। অন্ধকার রাত্তিরে যেসব
ভয়াল দৈত্যের কথা বলি তোকে লালকমলের
সেই গল্পে তারা আজ দলে দলে শক্ত মাটি ফুঁড়ে
এখানে এসেছে তেড়ে-ঘরবাড়ি, টেলিগ্রাফ তার
যা পাবে সম্মুখে তারা তছনছ করবে নিশ্চয়।
“বাইরে এখন বড়ো অন্ধকার, ডাইনীর চুল
ওড়ে চতুর্দিকে আর হাজার হাজার হিংস্র মোষ
ফেনায়িত মুখে ছোটে দিগ্বিদিক, খুরের আঘাতে
আকাশ ভাঙলো বুঝি-দাঁড়া, দরজাটা ভেজিয়ে দি’,
আয় ওরে বুকে আয়, বাইরে ভীষণ অন্ধকার;
না তুই যাসনে আজ যাসনে বাইরে, কথা রাখ”-
এ বলে মায়ের বুক নিত টেনে তার সে খোকাকে
কবেকার ঝোড়ো দিনে, আমি ভয়ে লুকাতাম মুখ।
অথচ এখন আমি ভয়ানক দুর্যোগে একাকী
বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ঝোড়ো হাওয়া তাঁবুর বনাত
কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে আজ হিংসার ফুৎকারে।
ছিঁড়ে-খুড়ে খাবে বলে দৈত্য-দানো চক্রান্তের টানে
আসে তেড়ে পৌরপথে। সম্মিলিত নেকড়ে হায়েনা
রক্তমাখা কাপড়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে চক্রাকারে
ঘোরে, আমি নিরুপায়। ইতিমধ্যে আমার শরীর
ছিন্নভিন্ন গণ্ডারের বৈরিতায়। সময় উজিয়ে
আসেনাকো কানে আর উৎকণ্ঠিত সেই কণ্ঠস্বরঃ
“নারে খোকা আজ তুই যাসনে বাইরে, কথা রাখ”
-মায়ের চকিত কণ্ঠ লিপ্ত এ-কালের কলরোলে।
সেই হাত
যে-হাত যুগল স্তনে খোঁজে চাঁদ-শাদা
স্বপ্নের মদির পথ, খোঁজে ক্ষেত্র প্রীতি কর্ষণের,-
ভাবতে অবাক লাগে, সেই একই হাত
সহজেই কাগযে নির্দেশ লেখে বোমা বর্ষণের!
স্টেজে
আর কী রয়েছে বাকি? সবি তৈরী, গোটা মঞ্চটাই
সুসজ্জিত নানা ছাঁদে। ইতিমধ্যে মাইক লাগানো
হয়ে গেছে আর সামনে শ্রোতাদের চেয়ার সাজানো
সারি সারি, বস্তুত কোথাও নেই তিলমাত্র ঠাঁই।
মঞ্চে বক্তা দু’চার কদম হেঁটে দিচ্ছেন মহড়া
নির্ধারিত বক্তৃতার, বাছা-বাছা বাক্যের শায়ক
অস্থির স্মৃতির তূণে, কিন্তু তবু সভার নায়ক,
পাদপ্রদীপের আলো, মনে হয় সবই মনগড়া!
প্রস্তুত প্রধান বক্তা, সাড়স্বরে সভা উদ্বোধন
করা গেলো যথারীতি, কিন্তু একি শ্রোতারা কোথায়?
তারা তো আসেনি কেউ, স্বস্তি কই এমন সভাতে
যেখানে বক্তার হাঁকডাক সবই অরণ্যে রোদন!
আমরা সবাই সেই বক্তার মতোই শূন্যতায়
কেবলি চলেছি হেঁকে প্রাণপণে মালাহীন হাতে।
স্বর্গে গেলাম দর্শক হিসেবে
(দান্তের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা পূর্বক)
মোল্লা-পুরুত এখনো রটায়
স্বর্গলোকের বিজ্ঞাপন।
নানা মুনি তার নকশা আঁকেন,
ব্যাখ্যা করেন বিজ্ঞজন।
দৈব দয়ায় একদিন ঠিক
পৌঁছে গেলাম স্বর্গলোকে।
স্বর্গতো নয়, আমার শহর
দেখতে পেলাম চর্মচোখে।
সেখানে ও লোক রাস্তা খুঁড়ছে,
মন্ত্রী হচ্ছে, কিনছে নাম।
চৈত্রদুপুর পুড়ছে সেখানে,
গলছে রাতের মধ্য যাম।
ইলেকট্রিকের হঠাৎ-আলোয়
ঘরের জানলা খুলছে কেউ।
ব্যস্ত মানুষ, মন্থর গাড়ি,
বড়ো রাস্তায় ভিড়ের ঢেউ।
এয়ারপোর্টে প্লেন নেমে আসে,
ট্রেন চলে যায় শেষ রাত্রে।
সেখানেও দেখি তর্কের থীম
ফকনার কামু কিবা সাত্রে।
বক্তা ছড়ান ধরতাই বুলি,
রাজায়-রাজায় বাঁধে লড়াই।
টগবগ করে ফুটছে নিত্য
জটিল মতামতের কড়াই।
দোকানে সাজানো বিদেশী কবির
আনকোরা বই দিচ্ছে উঁকি।
ঘটি-বাটি বাঁধা রেখে কেউ
ফটকা বাজারে নিচ্ছে ঝুঁকি।
ডাক্তার এলে ভিজিট চুকিয়ে
গৃহী মোছে তার চোখের খড়খড়ি,
রোগীর শিয়রে শুকনো ফল।
তরুণী টেবিলে খাবার সাজায়,
খবর পড়েন বুড়ো হাকিম।
মুড়মুড়ে দুটি টোস্টের ফাঁকে
নিবিড় হলুদ সোনালি ডিম।
কফির গন্ধে উন্মন মন,
কাজ্ঞিভেরাম কৌচে লোটে।
প্রেমিকের চোখ বালবের মতো
দীপ্ত ভাষায় ঝলসে ওঠে।
রাতের আঁধারে ফুটপাতে আসে
ভিখিরিণী তার নি-ছাদ ঘরে;
ঘাগড়া দুলিয়ে কুষ্ঠরোগীর
ঠোঁট চেপে ধরে কামের জ্বরে!
অক্ষর গুণে পংক্তি মেলায়
রাগী যুবকের দলের চাঁই,
ক্ষিপ্রকলায় চিত্র আঁকছে
রঙ ছুঁড়ে দিয়ে আচ্ছেতাই!
রবিঠাকুরের গান ভেসে আসে,
হেঁটে যায় লোক সুরের টানে।
পিকাসোর ছবি ড্রইংরুমের
দেয়ালকে দেয় অন্য মানে।