- বইয়ের নামঃ ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে
আচমকা কুয়াশা-কাফন চকচকে দুপুরেই গিলে ফেলে
আমাকে চলিষ্ণু ভিড়ে। কয়েকটি হাত লুফে নেয়
আমার শরীর এক লহমায় পথের কিনার থেকে এবং ঠেলতে
শুরু করে কে জানে কোথায়। এ রকম আচানক ঘটনায়
ভীষণ বিব্রত, বলা যেতে পারে, বিপন্ন বোধের
দখলে আটকে পড়ি। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দু’টি চোখ জ্বালা করে।
কতিপয় মুণ্ডহীন অস্পষ্ট শরীর বয়ে নিয়ে
চলেছে আমাকে কোথায় যে, বোঝা দায়। জীবিত কি
আমি, নাকি লাশ হয়ে আজব কবন্ধদের কাঁধে
শুয়ে যাচ্ছি লাশকাটা ঘরে? এখানে উত্তর দাতা কেউ নেই।
আমি কি দেখছি পথে আমারই রক্তের ফুলঝুরি
সত্য ভাষণের অপরাধে? হায়, বেলা অবেলায় ক্রুশবিদ্ধ
প্রাণহীন শরীর আমার দেখছে কি কৌতূহলী নরনারী?
কে এক সুকণ্ঠী শিল্পী গান গেয়ে আসর মাতাতে গিয়ে খুব
বেসুরো আওয়াজ তুলে মূক হয়ে যায়। একজন খ্যাতিমান চিত্রকর
সুসময় ফুটিয়ে তোলার রঙে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে ফেলে।
পদে পদে ইচ্ছাকৃত ভ্রম ঘটে সমাজের বিভিন্ন সারিতে,
ফলত কান্নায় ভাসে অসহায় নরনারী। গোল টেবিলের
অট্রহাসি কনসার্ট হয়ে বাজে যখন তখন! আহা মরি!
অমূল্য কাগজে ঘন ঘন দস্তখত চলে নানা ছাঁদে আর
কুয়াশা-কাফন নামে, নামতেই থাকে জগতের
নানান অঞ্চলে। আমি কোথায় এখন? মার্গে? নাকি ধু ধু চরে?
১৭-০২-২০০২
আবুল হোসেন শ্রদ্ধাস্পদেষু
মনে পড়ে, সুদূরকালে এক সতেজ সকালে নাজিমুদ্দিন
রোডে বেতার ভবনে আমার সদ্য লেখা
কবিতা নিয়ে আপনার টেবিলের সামনে
দাঁড়িয়েছিলাম কবিতা পাঠের আমন্ত্রণে। আগেই
আপনার, আহসান হাবীব আর ফররুখ আহমদের
নানা কবিতার সঙ্গে ছিল পরিচয়।
কী করে ভুলব স্নেহময় সেই ডাক যা আমাকে
নিয়ে গিয়েছিল আজিমপুর কলোনির
ঝকঝকে ফ্ল্যাটে, যেখানে ছিল
আপনার জীবনযাত্রার আসর? হ্যাঁ, আপনার
আন্তরিক আমন্ত্রণ আমাকে বারবার
নিয়ে যেত বাইরে শান্ত, অন্তরে উদ্দাম
এক তরুণকে। সেই তরুণের শ্রদ্ধাঞ্জলি
উন্মীলিত ছিল আপনারই দিকে।
আজ এই সত্তর-পেরুনো আমার মনে
সেলুলয়েডে এক চিত্রমালা যেন
উদ্ভাসিত, দেখছি এক কামরায় আপনারা
কজন বন্ধু, প্রত্যেকেই মাঝবয়েসী-প্রায়, তাসের রাজা, রানী
আর গোলাম নিয়ে মশগুল আর এক তাজা তরুণ
অনুরুদ্ধ হয়ে আপনার পূর্ব-প্রকাশিত এলোমেলো ছড়ানো
অনেক কবিতা একটি পৃথুল খাতায় কপিরত নিবিষ্ট চিত্তে।
হঠাৎ স্তব্ধতা চিরে ডেকে উঠে দুপুরকে আরও বেশি
উদাস ক’রে তোলে আকাশে পাক-খাওয়া চিল। কলম থামিয়ে
জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে দেয় কবিতায়-পাওয়া সেই তরুণ।
শ্রদ্ধেয় করি, আপনি আজ এই আশি বছর বয়সে সেই
তরুণকে আবিষ্কার করতে পারবেন কি
এমন ভাঙাচোরা আমার ভেতরে, আপনার
আনন্দ, বেদনা, রোগ, শোক এবং
চলার পথে উদ্দীপনা, ক্লান্তি, পুরস্কৃত প্রহর, এমনকি
হতাশার অন্তত খানিক অংশীদার? আপনি কি বিশ্বাস করেন না
আমার এই প্রশ্নের ব্যাকুলতা? আপনি কি, হে আমার
অগ্রজ সার্থক কবি, মৃদু হেসে খারিজ করে দেবেন নিবেদিত এই কথামালা?
স্বজন-পরিবৃত, পুষ্পশোভিত ড্রইংরুমে মনে কি পড়বে না
সেই নিবেদিত-চিত্ত স্বপ্লভাষী, লাজুক,
স্বপ্ন-তাড়িত, কবিতা মাতাল তরুণের কথা?
১৩-০৮-২০০২
ইচ্ছেটাও মৃত
কে যেন ঠুকরে দিল খুব জোরে ঘুমন্ত আমাকে
আপাদ মস্তক। চোখ খুলতেই দেখি, একি পুবে ও পশ্চিমে,
উত্তর দক্ষিণে ভয়ঙ্কর দাঁত-নখ বের-করা অন্ধকার-
বসে আছে বিকট শকুন এক, যার
চঞ্চু থেকে ঝরছে শোণিত। ‘মানবতা
হয়েছে শিকার তার’, কারা যেন গলিপথে হেঁটে
যেতে-যেতে বলে গেল ভয়ার্ত গলায়। শয্যা ছেড়ে
উঠতে চেয়েও ব্যর্থ আমি, এক ফোঁটা আলো নেই কোনওখানে।
বহুদিন হ’ল শহরে ও গ্রামে, কোনওখানে কারও
ঠোঁটে হাসি নেই, এমনকি শিশুরাও হঠাৎ হাসতে ভুলে গেছে
যেন কোন্ অশুভ সংকেতে। আমি আজ
কলমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুনি হাহাকার,
খাতার সফেদ পাতা কেঁপে ওঠে নিরন্ত ফোঁপানি এবং
শৃংখলিত কারও ঝাঁকুনিতে যেন। কে আজ সহায়?
এই হিংস্র অন্ধকারে, হে বিদ্রোহী কবি, আজকাল
আপনাকে বড় বেশি মনে
পড়ছে আমার ক্ষণে ক্ষণে, আপনি তো ঢের আগে
কারার লৌহকপাট তুমুল ভাঙার,
লোপাট করার আর জোর সে হ্যাঁচকা টানে
গারদগুলোকে, ওহো, প্রলয় দোলায়
দুলিয়ে কঠোব কুশাসন সমাপ্তির মন্ত্র জপিয়ে ছিলেন
দেশবাসীদের দিকে দিকে শহরে ও পাড়াগাঁয়।
এই বুনো তিমিরে আপনি কবি পুনরায় সূর্যের মতোই
চোখ মেলে বাবরি দুলিয়ে ঝোড়ো বেগে এই জ্যৈষ্ঠে চলে এলে
ভণ্ডদের ক্রূর খেলা হবে শেষ, পশ্চাতগামীর ভুয়ো জয়ঢাক
যাবে থেমে তিমির-বিনাশী প্রগতির
দীপ্ত সুরে। আমরা এখনও ব্যর্থতার
কাদায় আকণ্ঠ ডুবে আছি, হয়ে যাচ্ছি ক্রমে কাদার পুতুল!
শুভবাদী পুষ্পগুলি ঝরে যায় অতিশয় দ্রুত,
জানি আজ জাঁহাবাজ দানোদের পায়ের টোকায়
বিচূর্ণ, বিধ্বস্ত কত বিদ্যাপীঠ, বোবা
কান্নায় ত্রিলোক কম্পমান!
মূঢ়, মূর্খদের থুতু, বাচালতা তাড়িয়ে বেড়ায়
বস্তুত ধীমানদের সর্বক্ষণ, পথে ও বিপথে
পড়ে থাকে লাশ, শুধু লাশ। কারও দিকে
কারও তাকাবার ইচ্ছেটাও মৃত।
১৭-০৫-২০০২
ইতিহাস মিথ্যার কুহক ছিঁড়ে
ভোরবেলা ঘুমছেঁড়া চোখে দেখি, এ কী
ঘোর অমাবস্যা-রাত, হায়,
আমার শহরটিকে রেখেছে গ্রেপ্তার ক’রে। তবে কি সকালে
আজ এই নিঝুম দিবসে সূর্য আর
দেখাবে না মুখ? প্রকৃতির বুক জুড়ে
মহররমের নিস্তব্ধ মাতম মাথা কোটে সর্বক্ষণ।
নেই, তিনি নেই, আর রাজধানী, শ্যামল পাড়াগাঁ,
মফস্বলে; জগতের কোথাও পাবে না
কেউ খুঁজে তাঁকে, যে পুরুষ
ছিলেন আকাশ-ছোঁয়া দীপ্ত অস্তিত্বের
অধিকারী। বাংলার কতিপয় শক্র তাঁর প্রাণ
করেছে হরণ তস্করের
ধরনের বিপথামী অস্ত্রধারী কুটিল আন্ধার। বুঝি তাই
অন্ধকার চতুর্দিকে বিষধর অজগর রূপে প্রতিষ্ঠিত!
এই যে কখনও স্বদেশের গাছপালা, নদীনালা,
পথ ঘাট, ষড়ঋতু বুক চাপড়ায়,
অশ্রুপাত করে তাঁরই জন্যে আজও, হয়তো অনেকে
বোঝে না, পায় না টের। কেউ কেউ পায়।
তিনি তো প্রশস্ত বুকে তাঁর প্রিয় বাংলাকে ধারণ
করেছেন আমৃত্যু, সেবায় তার ছিলেন সর্বদা ব্রতী, যেমন বাগান
গড়ে তোলে রোদে পুড়ে বৃষ্টি ধারায় প্রায়শ স্নাত
হয়ে নিবেদিতপ্রাণ বাগবান। তারই কী আশ্চর্য প্রতিদান
যীশুর ধরনে পেয়ে গেলে তুমি। তবে ইতিহাস
চিরকাল মিথ্যার কুহক ছিঁড়ে গাইবে সত্যের জয়গান।
০৮-০৮-২০০২
এ কি আমাদেরই দেশ?
পায়ের তলায় মাটি আজকাল বড় জাহাঁবাজ,
হিংস্র হয়ে উঠেছে, আকাশ
যখন তখন চোখ রাঙায় এবং মনে হয় এ রকম
ভয়াবহ অন্ধকার নামেনি কখনও চারদিক
লুপ্ত ক’রে রক্ত-পানি-করা হিম অর্থহীনতায় আর। মানবের,
মানবীর মুখচ্ছদ এইমতো নির্বিকার পাথর-স্বরূপ
দেখিনি কখনও আগে। হাটে, মাঠে, ঘাটে
হেঁটে যায় ওরা, যেন পুতুলের নিষ্প্রাণ মিছিল!
এ কি আমাদের দেশ, যে-দেশে একদা
জনসাধারণ শহরে ও গ্রামে শান্তির ছায়ায় বসবাস
করেছে, দেখেছে রূপের স্বপ্ন নির্বিঘ্ন নিদ্রার অপরূপ
কোমল উদ্যানে? এ কি সেই বাংলাদেশ, কণ্ঠে যার
দুলেছে গৌরবদৃপ্ত বিজয়ের মালা
মুক্তিযোদ্ধা, ত্যাগী নেতা, সাধারণ মানুষের অনন্য সাধনে।
শোণিত-সাগর থেকে জেগে-ওঠা স্বাধীনতা-পদ্মটিকে যারা
ছিঁড়ে-খুঁড়ে লাঞ্ছিত করার
খায়েশে মেতেছে ঠারে ঠোরে এমন কি
মাঝে মাঝে স্পষ্টতই, তাদের তোয়াজে মেতে থাকে
নানান পাড়ার নানা মোড়ল এখন। ফন্দি আঁটে ছদ্মবেশী
অস্ত্রাঘাতে প্রগতির তেজী ঘোড়াটিকে খোঁড়া ক’রে দেয়ার খায়েশে।
আমাদের কত না নিঝুম স্বপ্ন থেঁত্লে যাচ্ছে বুটের তলায়,
কত যে পদ্যের পঙক্তি বেঘোরে গুমরে মরে কবির খাতায়
প্রখর দুপুরে আর নিশীথের বিরান প্রহরে। শব্দমালা
কখনও করুণ ফোঁপানিতে কম্পমান, কখনও-বা নজরুলী
দুলে-ওঠা বাবরির ধরনে রাগী, আগুনের আলিঙ্গনে রাঙা।
আগুনের তাপ কমে এলে স্বদেশের বেদনার্ত মুখ ভেসে ওঠে।
যেন স্বপ্নে আমার চকিতে মনে হ’ল- দিব্যি পূর্ব ও পশ্চিম,
উত্তর দক্ষিণ, ডান-বাম সব দিকে উচ্চারিত
প্রগতির জয়বার্তা, ঐ তো ওড়ে আসমানে কল্যাণের প্রশান্ত পতাকা-
চারদিক থেকে নর-নারী,
শিশু ছুটে আসছে সবাই। দীর্ঘস্থায়ী অমাবস্যা পলাতক,
কোনও গ্রীক দেবীর মুখের মতো চাঁদ হাসে আকাশের নীলে।
০৮-১০-২০০২
এ কেমন কৃষ্ণপক্ষ
কে যেন আমাকে ডাকে আবছা দূরত্ব থেকে আজ,
চেনা কি অচেনা সেই আর্ত কণ্ঠস্বর
বোঝা দায়, সে কি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে?
নাকি তার অন্তর্গত বেদনা ভোগাচ্ছে বড় বেশি?
অস্থিরতা আমাকে দখল করে নেয়
মোহাবিষ্ট চেয়ে থাকি দিগন্তের দিকে।
কোথায় দিগন্ত এই আকাশকে চুমো-খাওয়া সব
উচ্চাকাঙ্ক্ষী দালানের ভিড়ে? হা, কপাল,
কী ক’রে অসুস্থ দৃষ্টি দিয়ে ছোঁব
হারানো দিগন্ত-রেখা, কে আমাকে বলে দেবে আজ?
কোথাও যাওয়ার মন নেই এই গুমোট প্রহরে, বসে আছি
অন্ধকার ঘরে একা। কাকে খুঁজে বেড়াব এখন
কোন পথে? কোন আস্তানায় গেলে পেয়ে যাব ঠিক
মনের মানুষ এই প্যাঁচা-ডাকা পরিবেশে? প্রবীণ আঁধারে
হঠাৎ উদিত হল চাঁদ,
ঠোকরে ঠোকরে তাকে কাচের পাত্রের মত গুঁড়ো
করে ফেলে হিংসুটে দানব এক, মৃত্যুগন্ধী অন্ধকার নেমে
আসে যেন ত্রিভুবনে। মানবিক হাহাকারে ডোবে সবদিক।
যে কাব্য রচনা ক’রে পাণ্ডুলিপি তার
লুকিয়ে রেখেছিলাম তাণ্ডবের কালে
ভূতলে একদা, হায়, হয়েছে তা’ কীটের ডিনার।
বস্তুত নিজেরই সৃষ্টি আজ স্মরণের অন্ধকার
কুঠুরির কালো ধুলোকণা।
এ কেমন কৃষ্ণপক্ষ করেছে ঘেরাও আমাদের
ইদানীং? কেউ কাউকেই আর পাচ্ছে না দেখতে,
ঘুরছি বিপথে শুধু নিঃসঙ্গ, অসুস্থ অস্তিত্বের
ভার বয়ে; যতদূর দৃষ্টি যায়, মানবের চিহ্ন নেই কোনও,
উপরন্তু এখানে সেখানে ফাঁদ পাতা আছে-
এই তথ্য জেনেও ফায়দা নেই, আজ
আমাকে যেতেই হবে বেলাবেলি যতটা এগিয়ে যাওয়া চলে।
এখনও কখনও পুরনো শ্যাওলায় বন্দী হয় মানবতা,
কখনও বা বেনোজলে ক্রমাগত ভেসে যেতে থাকে।
১০-০৪-২০০২
এই ডামাডোল, এই হট্রগোল
না, আমি মিনারবাসী নই কস্মিনকালেও, তবু
এই ডামাডোল, হট্রগোল, এই ঝগড়া ফ্যাসাদে
বড় বেশি বীতশ্রদ্ধ হয়ে
ঘন ঘন চুল ছিঁড়ি উত্তপ্ত মাথার।
কখনও কখনও ভারি ইচ্ছে হয় এই জমিনের
ধুলোবালি থেকে দূরে, বহুদূরে
উড়ে যাই। না, কোনও বিমানে
চেপে কিংবা ট্রেনের টিকিট কেটে নয়,
দূরগামী পাখির মতই মেঘ চিরে,
আকাশের নীলে উড়ে উড়ে, নক্ষত্র-পল্লীর খুব
কাছাকাছি চলে গিয়ে জমাই জম্পেশ আড্ডা আর
চুমো খাই চাঁদের অধরে।
আমি তো যেতেই পারি উড়ে বহুদূরে অন্বিষ্ট কোথাও;
আমার ঘরের কোণে অপরূপ দুটি ডানা আছে,
এক্ষুণি দেখাচ্ছি ব’লে গৃহকোণে যাই। হা কপাল,
কোথায় গায়েব হল ওরা? কোন্ সে রহস্যপুরী,
কোন্ সে কবন্ধ আস্তানায়,
হায়, লুপ্ত হল অনুপম ডানা দু’টি?
পাখা মেলে আর
মেঘে মেঘে দূরে
অনেক অনেক
দূরে পারব না
কোনও দিন যেতে
তারার মেলায়।
খেদ নেই, পারব তো হেঁটে হেঁটে যেতে বাংলার
পাড়াগাঁর, শহরের ঢের ঢের লুণ্ঠিত জনের
এবং ধর্ষিতা মা-বোনের খুব কাছে
দাঁড়াতে, জ্বালাতে দীপ ঘন অন্ধকারে।
ভাসমান মেঘ আর নক্ষত্রের রূপালি আসর,
চাঁদের বাসর থাক মানবের কাছ থেকে দূরে
অনেক অনেক দূরে। নাইবা গেলাম
সেখানে কখনও, এই আমি এখানেই
স্বদেশের সোঁদা মাটি আর
ঘাসের সুঘ্রাণ নিয়ে থাকি যেন আমরণ প্রিয় স্বদেশেই।
২৯-০৩-২০০২
একটি কুটিরের কাহিনী
পরিবেশ ছিল দৃষ্টিনন্দন সেখানে, চারদিকে মোলায়েম
দীপ্তি ছিল ঘাস আর গাছগাছালির। যুবতীর
হাসির মতোই প্রস্ফুটিত ছিল ফুল। নিরিবিলি
একটি কুটির যেন একাকী তাপস মগ্ন ধ্যানে বহুকাল।
কুটিরের দরজা জানালা বন্ধ সারাক্ষণ; কড়া নেড়ে নেড়ে
ক্লান্তি আর বিরক্তির গাঢ় ছায়া নিয়ে
ফিরে যায় ছায়ার মতোই অগণন পথচারী। এভাবেই
দিন যায়, রাত কাটে, নানা ঋতু এসে চলে যায়;
হায়, কত কাল লুপ্ত হয়, রাখে না হিসেব কেউ। সেই ঘর
প্রতীক্ষা-কাতর কোনও রূপসীর মতো
খাঁখা দৃষ্টি মেলে
পথের আরেক ধুধু সত্তা অবিরত হতে থাকে যেন।
অপরূপ সেই পরিবেশ কেবলি হারাতে থাকে
রূপ-বড় জীর্ণ শীর্ণ গাছ, মরা ঘাসের ফোঁপানি
চারদিকে, ফুল আর ফোটে না কোথাও
কিছুতেই, হাহাকার ছাড়া কোনও সুর নেই এখানে এখন।
কোনও এক নিশীথের প্রগাঢ় প্রহরে একজন শাদাসিধে
পুরুষের পদচ্ছাপ পড়তেই অমাবস্যা-রাতে আচানক
নিরুপম জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয় বিরান এলাকা। সহজেই
খুলে যায় কুটিরের রুদ্ধ দ্বার, বেজে ওঠে জীবনের সুর।
১৬-০২-২০০২
একটি সামান্য সংলাপ
‘আচ্ছা জনাব, আপনি তো হামেশা
মেঘের মুলুকে থাকেন, তাই না?’
‘মাফ করবেন জনাব, প্রায়শ এই অধম
জমিনেই থাকে, কী রোদে, কী বৃষ্টিতে; তবে হ্যাঁ,
সত্যি বলতে কি, কালেভদ্রে মেঘলোকে
কী করে যে চলে যাই, জানি না নিজেই।‘
‘মাফ করবেন, আমি ভাই অতসর বুঝি না।
লোকে বলে, তাঁরাও উঁচু কিসিমের মানুষ,
ইয়া মোটা মোটা কেতাব লিখেছেন
গহীন রাতের চেরাগ জ্বেলে বিস্তর। তাঁদের
কথা তো বানের পানিতে ভাসাতে পারি না,
মগজের খাস কামরায় জীইয়ে রাখি।‘
‘নয়, নয়, কস্মিনকালেও নয়। তাঁদের
কথামালা ধোঁয়ায় মিলিয়ে দেয়ার
মতো নয়, তাঁরা যা বলেন তা বাজারের
বেজায় কিমতি জিনিশ। আমাদের মানে
আমরা যারা মাঝে মাঝে মেঘে ভাসি, নীলিমায়
সাঁতার কাটি, ফুটফুটে তারা ছুঁয়ে দেখি,
তাঁদের নোস্খা ঠিক হজম হয় না,
হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলি অশ্লীল
বেয়াদবের মতো। আচ্ছা চলি, মাটিতে
বহুদিন পা রেখে চলাফেরা করেছি, বিস্তর
হোঁচটও জুটেছে। এখন খানিক দূরে, মানে
মেঘকন্যার চুমো খেতে যাই, ভাই। গুড বাই।‘
১৭-০২-২০০২
এতদিন যে-কবিতা আমার লেখা হয়নি
নির্ঘুম বসে ছিলাম একলা ঘরে,
হাত-ঘড়িতে তখন রাত তিনটা। বাইরে
অন্ধকার আদিম জন্তুর মতো মাথা গুঁজে জমিনে
ঘুমিয়ে আছে। অকস্মাৎ সেই জন্তু
মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে প্রসারিত ক’রে
ওর দাঁত-নখে কামড়ে ধরলো ঘুমন্ত শহরকে। কেঁপে
উঠলো চেয়ার, আমার লেখার টেবিল। ভূমিকম্প ভেবে
বাইরে ছুটে গিয়ে
চেয়ারেই আটকে থাকলাম, যেন কেউ আমাকে
আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে আমার চিরচেনা আসনে।
সেই মুহূর্তে, পরদিন প্রচারিত হলো লোকমুখে,-
সংবাদপত্রের পাতায়-আমার এই
জন্মশহরের ঐতিহ্যখচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রীনিবাসে রাত তিনটায় চলছিল হায়েনাদের তাণ্ডব,
নিদ্রাছুট ছাত্রীগণ পথ পাচ্ছিল না আত্মারক্ষার। আব্রু
হারানোর শঙ্কায় লুকোতে গিয়েও
ওদের অঙ্গবাসে পড়লো টান, আলুলায়িত বেণী,
খসে-পড়া খোঁপা পোশাক সজ্জিত জান্তব সন্ত্রাসে হলো লাঞ্ছিত।
সেই মুহূর্তে আশপাশের গাছপালা শাসন-না-মানা ক্রোধে
কাঁপতে কাঁপতে ছুটে যেতে চেয়েছিল
ছাত্রীনিবাসে, কিন্তু, হায়, ওদের শেকড় বন্দী কঠোর মাটিতে।
সেই মুহূর্তে শান্ত বুড়িগঙ্গা নদী ধিক্কারে ফুঁসে
উঠছিল খুব, অথচ বড় নাচার সেই জলধারা
তটে মাথা কুটেও পারলো না
ছুটে গিয়ে জালিমদের ভাসিয়ে
নিয়ে যেতে। নাগরিকগণ তখন ঘুমে অচেতন।
এ কেমন দূষিত, পচন-ধরা কালে নিঃশ্বাস নিচ্ছি? আমরা
সবাই কি ঠুঁটো জগন্নাথ হ’য়ে বসে থাকবো অষ্টপ্রহর?
আমরা কি আহারান্তে পান চিবিয়ে,
সিগারেট ফুঁকে, আড্ডায় গা ভাসিয়ে কাটিয়ে
দেবো সময়? আমরা কি ঘুমিয়ে থাকবো কালবেলায়?
আমরা কি আমাদের ভগ্নি কন্যাদের
বস্ত্রহরণ পর্বে নির্লজ্জের মতো নিষ্প্রাণ পুতুল হয়ে থাকবো?
আমরা কি তখনও ফেটে পড়বো না বিস্ফোরণে?
পাড়ায় পাড়ায় কখন কত কী-যে হারায়,
অনেকেই বোঝে না, কেউ কেউ বোঝে। তুমি কি তোমার
ভাঙা গালে হাত দিয়ে ব’সে ভাবতে থাকবে কারা কোথায়
কী লুটে নিলো, কারাই বা হলো বঞ্চিত? ভাবনারা
মৌমাছি হয়ে হুল ফোটাবে তোমার অস্তিত্বে,
তুমি ধৈর্য ধরে সইবে, সবই সইতে থাকবে
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তা হবে না, চলতে দেবো না
সেই খেলা ব’লে গর্জে উঠবে তারুণ্য, আগামীর নকিব।
এই জাঁহাবাজ, দাঁত-নখ-খিচোনো অমাবস্যার
আস্ফালন আমরা কি থামাতে পারবো না?
আমরা কি পারবো না ভয়ঙ্কর কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমা-চাঁদের পথ
সুগম ক’রে দিতে আমাদের
প্রতিবাদের ঝড়ে ঝেঁটিয়ে সকল বাধা? আমরা কি
পারবো না জন্ম দিতে তেমন নতুন যুগকে,
যে-কালে ছদ্মবেশী স্বৈর শাসকের হুঙ্কারে,
অঙ্গুলি হেলনে আজ্ঞাবহ বরকন্দাজদের তাণ্ডবে
ধুলোয় লুটোবে না মানবিক মূল্যবোধ, হিংস্র কাদায়
সমাহিত হবে না অগ্রসর তরুণ তরুণীর স্বপ্ন, আর্তনাদ করবে না সভ্যতা?
২৮-০৭-২০০২
এমন কুটিল অন্ধকারে
এমন কুটিল অন্ধকারে হঠাৎ কোথায় যাব?
জানোই তো রাগী শুয়োরের
মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে পরিবেশ সকল সময়। তবে আমি
কোথায় খুঁজব শান্তিনিকেতন?
এখন দেখছ না কি শুধু শীতাতপ- নিয়ন্ত্রিত
নতুন মোটরকারে জ্বলজ্বলে দুপুরে ঘুরছে
মাথায় মুকুট-পরা সাঙ্যাৎ খুনীর সঙ্গে? কান
খাড়া রাখলেই গলি কিংবা রাজপথ থেকে ঠিক
নিয়ত আসছে ভেসে জালিমের হুঙ্কার এবং
অসহায় উৎপীড়িত নরনারীদের আর্তনাদ।
দুপুরেও অমাবস্যা তুখোড় মোড়ল ইদানীং। অসহায়
কুমারীর সম্ভ্রম রক্ষাই দায়; শহরে ও গ্রামে
কত যে নারীর জীবনের আলো নরপশুদের
থাবার দাপটে নিভে গেছে, কে তার হিসেব রাখে?
তবুও মানুষ ঘর বাঁধে, আসমানে নক্ষত্রের মাইফেল
বসলে দেখতে চায়। শিশুকে জড়ায় বুকে আর
কান পাতে দূর থেকে ভেসে-আসা বাউলের গান
অথবা বাঁশির সুরে, ভালবাসে দয়িতাকে ডাগর জ্যোৎস্নায়।
১১-০৬-২০০২
ওরা তিনজন
গোধূলিবেলায় অকস্মাৎ আমার অভ্যন্তর থেকে একজন,
তার ভেতর থেকে অন্য একজন, ওর বুক ফুঁড়ে আরেকজন
বেরিয়ে এসে বসে চেয়ারে। যারা বেরিয়ে এলো ঈষৎ
প্রফুল্ল কায়দায়, অভিন্ন ওদের অবয়ব। ওরা পরস্পর
দৃষ্টি বিনিময় করে একই ধরনের হাসির আভাস ঠোঁটে
ফুটিয়ে। ওদের মুখে কোনও কথা নেই, শুধু তাকিয়ে থাকে
আমার দিকে। আমি ওদের অভিবাদন জানাবো কি
জানাবো না, মনস্থির করতে পারি না।
কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে ওঠে একজনের ধুধু
কণ্ঠস্বর, ‘আমাকে চিনতে পারছো না? তোমার তো না
চেনার কথা নয় আমাকে। আমি হলাম তুমি, যে-তুমি
ব্যর্থ হলে আমাকে চিনতে। তুমি আমার ভেতরে থেকে
একদা ছুটোছুটি করেছো শৈশবে, কৈশোরে সবুজ খোলা
মাঠে। আমার ভেতর মিশে ভোরবেলা গাছগাছালিময়
পাড়াগাঁর ছোঁয়ালাগা পথ পেরিয়ে দিঘিপারে বসে
ছিপে তুলে এনেছো সতেজ মাগুর। আমি সেই মৎস্য শিকারী।
দ্বিতীয় জন হাত নেড়ে চোখ ঠেরে বলে, ‘আমাকে চিনলে না তুমি?
আমি সেই লোক, যে প্রতিক্রিয়ার দুর্গ-কাঁপানো শব্দমালা
উপহার দিয়েছে সমাজকে তার যৌবনের মধ্যাহ্নে। তোমার সঙ্গে
এই আমি নানা মুণির হিংসা, দ্বেষ, চরম শক্রতার শরাঘাত সয়েছি।
জানি না বহুমুখী ভোগান্তি শেষ হবে কবে! তৃতীয় জন
নিজের চারদিকে নৈঃশব্দের পাহারা বসিয়ে কেবল হাসির আভা
ছড়িয়ে বসে থাকে এক পাশে। গোধূলি মিশে যায় গাঢ় সন্ধ্যায়।
ওরা তিনজন সুদক্ষ অভিনেতার মতো আমার ভেতরে প্রবেশ করে।
১৪-১০-২০০২
কখনও কোথাও
সেই কবে কাকে যেন কথা দিয়েছিলাম, আবার আসবই।
কখন কোথায় দেখা হবে, ছন্নছাড়া
এই আমি জানাতে পারিনি। সুকোমল
দুটি হাত ছেড়ে চলে গেছি নিরুদ্দেশে।
আমার তো আজও পথ চলার বিরাম
নেই, নানা দিকে যাত্রা করি,
হই মুখোমুখি কত চেনা,
অচেনা জনের, শুধু দেখি না দেখতে যাকে চাই।
নতুন পথের দিশা খুঁজে এগিয়েছি বহুবার,
কত না সকাল সন্ধ্যারাগে পরিণত
হয়েছে, কেটেছে রাত অজানা জায়গায়,
হিসাব রাখিনি।
সম্মুখে চলার দৃঢ় ভরসায় পথ হাঁটি,
দূর দিগন্তের দিকে চোখ
রেখে চলি, অথচ বিস্মিত
পথচারী আমি দেখি শুধু
ঘুরছি, ঘুরছি একই সীমানায়। কে পাখি পাখার
ঝাপ্টায় আহত করে আমাকে এবং
আওড়ায় বার বার, ‘শোনো হে পথিক,
প্রকৃত কোথাও কারও কোনও যাওয়া নেই’।
১০-০৫-২০০২
কলমের চুম্বন
‘আচ্ছা মানুষ তো ভাই আপনি, ভোরের
সূর্য পশ্চিমের আসমানে বুড়ো মানুষের মতো
ধুঁকছে, অথচ চুপচাপ বসে আছেন ঘরের
দরজার খিল এঁটে। দুপুরের আগেই আমার
দোকানে যাবেন বলে কথা ছিল আপনার। ঠিক বলুন তো
পাণ্ডুলিপি তৈরি নাকি আজও ফিরে যেতে হবে শূন্য হাতে?’
এসব কী বলছেন আপনি, সাহেব? কে আপনি? কার কী-বা
পাণ্ডলিপি, এসব জানি না কিছু। তা ছাড়া আমি তো
আপনাকে কখনও দেখিনি কোনও কালে। সব কিছু
ভোজবাজি বলে মনে হচ্ছে। আপনি নিশ্চিত ভুল
জায়গায় এসেছেন, আপনার অভীষ্ট মানুষ নই আমি;
আপনাকে ভিন্ন কোনও দোরের কলিংবেলে ধ্বনি তুলতেই হবে
বাঁচা গেল। আমি কি লেখক কোনও? নইলে কেন সম্পূর্ণ অচেনা
একজন পাণ্ডুলিপি করে দাবি আমার নিকট? ভদ্রলোক
ষোলআনা প্রকাশক বলেই হয়েছে মনে। ভ্রমবশত আমার
উদ্দেশেই অবেলায় হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন এখানে।
চিঠি আর আবেদনপত্র ছাড়া অন্য কিছু
কখনও লিখিনি, তবে কেন পাণ্ডুলিপির চাহিদা এত?
হায়, এ কেমন এলোমেলো ঠেকছে বেবাক কিছু; উল্টোপাল্টো
চতুর্দিকে; ফাঁকা, সব কিছু ফাঁকা, বড় ধুধু স্মৃতির এলাকা।
একটি বিশাল, ভয়ঙ্কর পশু গিলে খাচ্ছে আকাশ, জমিন।
অকস্মাৎ প্রশ্ন জাগে মনে, কখনও কি
সুদূর অতীতে কোনও কালে আমার খাতার শূন্য পাতাগুলি
উঠত কি ভরে নানা শব্দে কলমের চুম্বনের ফুল ঝরে?
আমি কি বিস্মৃতকালে রাত জেগে লিখেছি ঝাঁঝালো দলছুট
উপন্যাস? আমার লেখনী থেকে হয়েছে কি নিঃসৃত একদা
পাঠকনন্দিত কবিতার পঙ্ক্তিমালা? এই আমি
ছিলাম কি কাফে আর বইপাড়ার আড্ডার
শানানো জিভের মুখরোচক খোরাক? দিন যায়, রাত যায়, ভাবীকালে
এই অধমের কোনও বই থাকবে কি কাব্যপ্রেমী কারও হাতে?
২৯-০৪-২০০২
কাঙ্ক্ষিত অর্কেস্ট্রার প্রতীক্ষায়
আবহাওয়া দপ্তর প্রচার করেছে, ঝড়ের
তেমন কোনও সম্ভানাই নেই; তবু লেখার
টেবিলে কাগজ কলম নিয়ে ব’সে কেন জানি না
বার বার মনে হচ্ছে, তুমুল তুফান হঠাৎ
আসবে ধেয়ে চৌদিক থেকে প্রচণ্ড
ঝাঁকুনি দিয়ে। বাড়ির সবার জন্য আশঙ্কা
শাঁকচুন্নির মতা ভীষণ আঁকড়ে ধরেছে
আমাকে বুকে বড় বেশি চাপ কী করি? কী করি?
নিঃশ্বাস নেয়া ভার, এক ঝটকায়
খানিক মুক্তির জন্য হয়ে পড়ি বেপরোয়া, অথচ
দেখছি এক অন্ধকার কুঠুরির খড়বিচুলিতে গড়িয়ে
গড়িয়ে গোঙাচ্ছি। আচমকা চোখে পড়ল,
চৌদিকে পড়ে আছে অসহায়, নিস্তেজ
ক’জন লোক; এক ঝাঁক হিংস্র ছুঁচো আর ইঁদুর
তেড়ে আসছে আমাদের ছিঁড়ে খাওয়ার
অপ্রতিরোধ্য তাগিদে। পড়ি মরি বাঁচি দিই চম্পট।
দিনদুপুরে চেয়ারে বসেই কি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন
দেখছিলাম? নাকি আগামীর কোনও সম্ভাব্য
ঘটনার আভাস ফুটে উঠেছিল অলক্ষুণে সুদীর্ঘ
তন্দ্রায়? কে আমাকে বলে দেবে? হায়, এই পোড়া মাটিতে
কখনও কি দেখে যেতে পারব না এরকম বাগান,
অপরূপ, বিচিত্র পুষ্পরাজি যার সকল
মানব-মানবীর হৃদয়ের ক্ষত করে দিতে পারবে
নিরাময়? আমরা কি পাব না শুনতে নতুন সৃষ্টির অর্কেস্ট্রা?
২৩-০৩-২০০২
কৃষ্ণপক্ষে অসহায় পঙ্ক্তিমালা মহিমাবিহীন যীশু
এ কী? এই শহরের গাছগুলি ক্ষণে ক্ষণে রক্ত বমি ক’রে
প্রবল ভাসিয়ে দিচ্ছে পথ ঘাট, মাঝে মাঝে
থামছে খানিক, পরমুহূর্তেই ফের ফিন্কি দিয়ে
রক্ত ঝরে, যেন ওরা ভীষণ আক্রোশে ছুড়ে দিচ্ছে লাল থুতু।
শুধু কি আক্রোশ? নাকি ভয়ানক বিবমিষা আজ
করেছে দখল এই নগরের বৃক্ষসমাজকে! ইচ্ছে হল ছুটে যাই।
তাদের নিকট, সেবা শুশ্রূষায় মুছে ফেলি
রোগের মলিন ছায়া, বৃক্ষসমাজের বর্তমান অস্তিত্বের
ধূসরতা অকৃত্রিম সবুজে বদলে দিই, ডেকে আনি ফের
পলাতক কোকিলকে রোগমুক্ত সতেজ পাতার আস্তানায়।
আমি তো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল অথবা জীবনানন্দ নই, কেন
আমার নাছোড় আবেদনে পীড়িত গাছের পাতা
আবার সবুজ আভা ফিরে পাবে? কেন কোকিল আসবে ফিরে
নাগরিক বিপন্ন গাছের মজলিশে সুর ঝরাতে আবার?
মাথা নিচু ক’রে ফিরে যাচ্ছি শ্যামলীর অবসন্ন গলিমুখে;
অকস্মাৎ পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে, দেখি-
মাটি ফুঁড়ে আগুনের জ্বলজ্যান্ত ঢেলা
চৌদিকে ছিটিয়ে পড়ে, এ কী! নড়ে ওঠে সুপ্রাচীন
ডাইনোসরের মাথা, হিংস্র দাঁতগুলো
নিমেষে আমাকে গেঁথে ফেলে, যেন আমি মহিমাবিহীন যীশু!
২২-০৮-২০০২
কে যেন তরঙ্গ তুলে কুয়াশায়
এখন আমার যে বয়স সে বয়সে পৌষ, মাঘে
শীতের সুতীক্ষ দাঁত সহজেই ভেদ করে মাংসের দেয়াল
আর কেঁপে ওঠে খুব সত্তার চৌকাঠ। অন্ধকার
ঘরে একা বসে ভাবি, কী উদ্দাম ছিল
একদা আমার যৌবনের ফাল্গুনের পুষ্পময়
দিনগুলি, বৈশাখী ঝড়ের মতো আবেগের ঝাপ্টা
বয়ে শহরের অলিগলি চষে বেড়াবার দিনগুলি আর
কবিতায় মশগুল নিজের সঙ্গেই কথা-বলা রাতগুলি।
সেকালের শীতের সুতীক্ষ্ণ দাঁতে হতো না তেমন
শীতল শরীর এই সাম্প্রতিক বুড়ো লোকটার
কিছুতেই; বসন্ত বাহার রাগে নিয়ত উঠত বেজে সবই
নিমেষে তখন। আজ জবুথবু
পড়ে থাকি এক কোণে হৈ-হুল্লা, মিছিল থেকে দূরে। কোনও দিন
নব্য কোনও কবির বইয়ের
পাতায় উৎসুক চোখ পাতি, স্বাদ নিই, কখনও বা দেখি
কাছের গাছের ডালে বসে-থাকা পাখিটিকে-ওর শীত নেই?
সত্য, এখন তো এই শরীর শীতল অতিশয়
ঋতুর কামড়ে, কিন্তু হৃদয়ে আমার
ঝরে না তুষার আজও; কী আশ্চর্য, এখনও সেখান
প্রফুল্ল ধ্বনি হয় বসন্তের কোকিলের গান
প্রায় অবিরাম, সেই গানে প্রস্ফুটিত
হতে থাকে কারও কারও নাম। অকস্মাৎ চোখে পড়ে
কে যেন তরঙ্গ তুলে কুয়াশায় হেঁটে যায় একা
এবং পরনে তার অপরূপ মহীন লেবাস। সে রূপসী
তাকায় না পেছনে একটিবারও। তার হাত ধরে
নিবিড় যাচ্ছেন হেঁটে নিভৃত জীবনানন্দ প্রলম্বিত ছন্দে।
১০-০১-২০০২
কোথায় চলেছি?
যাচ্ছি, ক্রমাগত যাচ্ছি; সেই কবে থেকে
আজ অব্দি, বলো,
কোথায় চলেছি? বলা যায়,
এই অধমের আওতায়
যা-কিছু দেখার আর শোনার, ছোঁয়ার
সবই তো হয়েছে এ জীবনে-
বিনীত স্বীকার করি গোধূলিবেলায়,
তবু কেন মনোলোকে তুষারের স্তূপ?
আমার যাপিত জীবনের সঙ্গে কোনও
বিবাদ, ঝগড়াঝাঁটি নেই,
নেই কোনও বায়বীয় খেদের বালাই। এই মাটি,
হাওয়ার চুমোয় শিহরিত গাছের সবুজ পাতা,
রাঙা ফুল পথরেখা, নদীর রূপালি
নাচ, মোলায়েম মেঘে পাখির সাঁতার,
শিশুর অনিন্দ্য হাসি, নারীর প্রণয়,
তারুণ্যের কণ্ঠে জীবনের, প্রগতির গান আজও ভালবাসি।
অথচ কখনও ভোরবেলা চোখ থেকে
ঘুমের কুয়াশা মুছে গেলে,
অথবা রাত্তিরে কোনও কবিতা লেখার দীপ্র ক্ষণে দয়িতার
মুখশ্রী খাতার বুকে জেগে
ওঠার মুহূর্তে অকস্মাৎ মৃত্যুচিন্তা অতিশয়
কালো লেবাসের অন্তরালে ফিস্ফিস্ স্বরে বলে,-
“আমি আছি, বুঝেছ হে, কোন দিন কখন যে
হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটে নেব প্রাণ, জানবে না”।
শোন, এই পৃথিবীর রৌদ্রছায়া, জ্যোৎস্নামায়া
উপভোগ করে বহু জ্ঞানী বলে গেছেন, আখেরে
মরণ তো অবসান, অস্তিত্বের পরিণতি ‘মুঠো
মুঠো ধুলো।‘ এই যে গভীর রাতে জেগে
সাজিয়ে চলেছি পঙ্ক্তিমালা কিংবা অতীতে লিখেছি
কতই না গ্রন্থ, সেগুলো পাহাড়ে,
নাকি হায়, সুবিপুল বিস্ফোরণজনিত কণায়?
২৫-০৬-২০০২
ঘুড়ি
একটি নকশা-কাটা ঘুড়ি হাওয়া আর
মেঘে মেঘে উড়তে উড়তে
চকিতে লাটাই-লগ্ন গতিময় সুতো প্রতিদ্বন্দ্বী
লাটাবাজের তীক্ষ্ণ সুতোর আঁচড়ে
ভাসতে ভাসতে কোথায় যে কত দূরে
লীন হ’ল, জানতে পারেনি নকশা-কাটা সেই ঘুড়ির মালিক।
বেদনার্ত সেই লোক ভেবে, জেগে তিন দিনরাত
হারানো ঘুড়িটি সৃষ্টি করেছিল স্বপ্নাদ্য আদলে
হয়তো-বা, অপরূপ এক নকশা ছিল
ঘুড়ির সত্তায়। ঘুম নেই চোখে তার, নিরানন্দ
বসে থাকে এক কোণে, কী-যে ভাবে আকাশকুসুম,
নিজেও কি জানে সেই লোক? শুধু বয় হাহাকার।
নিজেকে পীড়িত করে প্রায়শ উপোসে, দিনরাত
কী-যে ভাবে মানুষটি, বোঝা দায়। কোনও এক
অমাবস্যা-রাতে, কী আশ্চর্য, নিরালোক ঘর তার
হয়ে ওঠে জ্যোৎস্নাময়, শিরায় শিরায়
ছন্দ নেচে ওঠে, হাত সৃষ্টির দোলায় মশগুল
এবং অনিন্দ ঘুড়ি জন্ম নিতে থাকে।
চিকিৎসকের চেম্বারে
চিকিৎসক এবং রোগী মুখোমুখি, যেন দুই গ্রহ। চিকিৎসক
রোগীর দিকে এক ফালি হাসি পেশ করে জানতে চাইলেন,
কি অসুবিধা খুঁড়ছে তাকে। ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছে কিনা, কিংবা
শরীরের কোন অংশ যন্ত্রণাকাতর কতটুকু, হজম হচ্ছে তো
ঠিক? চিকিৎসক রোগীর রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখলেন,
স্বাভাবিক। সব কিছুই তো ঠিকঠাক আপনার। কোথাও কোনও
উপসর্গ, গলদ লক্ষ গোচর হচ্ছে না। খামোকাই বিচলিত
আপনি। এবার নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যেতে পারেন।
রোগী চিকিৎসকের কথা শুনে তাজ্জব! কোথাও ভুল
করেন নি তো তিনি? রোগী চিকিৎসককে বললেন, চোখ দুটি
বুজলেই দৃষ্টিপথে হাজির হয় ভয়ংকর বিকৃত কয়েকটি মুখ।
কখনও একজন ডাকাবুকো লোক ছুরি চালাচ্ছে এক তরুণের
গলায় আমারই সামনে, সন্ত্রাসীরা সুশীল গেরস্তের ঘরবাড়ি
দেদার পোড়াচ্ছে, যত্রতত্র সম্ভ্রম লুটছে তরুণীদের। ধর্ষিতা
যুবতীরা গ্লানিতে ডুবে মাতে আত্মহননে। চকচকে
ছোরা, উপরন্তু রক্ষীরা সন্ত্রাসে দড়।
প্লীজ ডাক্তার আমাকে বাঁচান।
০৬-০৬-২০০২
জংধরা খাঁচার ভেতর
যতদূর জানি এক ঝাঁঝালো যুবক বুড়ো সুড়ো
এই ক্ষয়া আমার ভেতরকার নিভৃত বাসিন্দা
অনেক বছর ধরে। বসে থাকে, ঝাঁকায় দীঘল
কেশর শিং মাঝে মাঝে আমাকে থামিয়ে আওড়ায় পঙ্ক্তিমালা।
যুবকটি আমার গহন থেকে নিঝুম বেরিয়ে
সিঁড়ি বেয়ে গলিপথে নেমে
হেঁটে হেঁটে প্রধান সড়কে চলে যায়,
যেতে থাকে, যেতে থাকে উদ্দেশ্যবিহীন।
কখনও বাতাসে চুল ওড়ে তরুণের, কখনও বা
রোদের কামড়ে তার গায়ের চামড়া পুড়ে যায়, স্নেহ চায়
লাজুক জ্যোৎস্নার। নেই কোনও বান্ধবের
আস্তানা কোথাও কিছুক্ষণ জিরোবার।
তরুণ চলেছে হেঁটে পাথুরে রাস্তায়, যেতে যেতে
দেখছে দু’পাশে কত বাড়ি একরোখা তীক্ষ্ণ সাঁড়াশির মতো
নখের হামলা সয়ে দিব্যি টিকে আছে
প্রতিবাদহীন, রক্তধারা বয় দেয়ালে দেয়ালে।
এই কি আমার জন্মশহর?-যুবক ভাবে এবং চালায়
পদযুগ অযান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। ভেতরের সব
ক্ষয়ে-যাওয়া যন্ত্রের আসর কেঁপে ওঠে ভয়ানক,
তরুণ সতেজ হাওয়া টেনে নিতে চায়, নিতে থাকে
সোজা বাঁকা নানা পথে চলতে চলতে
যুবকটি দ্যাখে কোনও দিকে সবুজের চিহ্ন নেই,
ইতস্তত একটি কি দুটি গাছ মরে পড়ে আছে;
একটি পাখিও চোখে পড়েনি সন্ধানী তরুণের।
কী করবে? কোন্ দিকে যাবে আর? সিদ্ধান্ত গ্রহণে
ব্যর্থ সে তরুণ; অকস্মাৎ কে যেন প্রবল টানে
পেছনে ঠেলছে তাকে, অসহায় যুবা জংধরা
খাঁচার ভেতর দ্রুত ফিরে যেতে থাকে।
হায়, প্রত্যাবর্তনের পরেও কেমন ব্য্যাকুলতা জন্ম নেয়
জংধরা খাঁচার ভেতর, তরুণের ঘাড়ে নেমে-আসা স্ফীত
কেশরাশি ফুঁসে ওঠে ঘন ঘন, ঘুমন্ত যৌবন
অধীর বাড়ায় হাত অনুপম জাগৃতির দিকে।
০৪-০৭-২০০২
জীবন কেটেই গেল প্রায়
জীবন কেটেই গেল প্রায়, তবু এই স্বদেশের রৌদ্র ছায়া,
জ্যোৎস্নাধারা, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা নদীর তীর, আপনজনের
মধুর সংসর্গ ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা
কখনও দিইনি ঠাঁই এমনকি মনের গহন
কন্দরেও। কারও সাতে-পাঁচে নেই আমি, কখনও দিইনি ছাই
কারও বাড়া ভাতে, শুধু একাকী নিজের ঘরে লিখেছি কবিতা।
আমার অনেক প্রিয়জন উচ্চাশায় মজে জ্বলজ্বলে এক
জীবনের সন্ধ্যানে দিয়েছে পাড়ি ভিন্ দেশে, আমি
রয়ে গেছি এই প্রিয় বাংলায় আমার
বিপদের উদ্যত বর্শা, বন্দুকের মুখে, কাটিয়েছি
কত না বিনিদ্র থরথর রাত, এমনকি রক্তরাঙা ঢের
দ্বিপ্রহর। বিভীষিকা জীবনের গায়ে পড়া ইয়ার এখন!
বুক খুব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে হাঁটে পথে সিটি বাজাতে বাজাতে
সন্ত্রাসের জগতের কত যে মোড়ল,
কে তার হিসের রাখে? ধর্মের আড়ালে কত কট্রর সন্ত্রাসী
মাঠে ময়দানে, সরকারী ক্যামেরায়
দাপট দেখিয়ে বলে, ‘এক্ষুণি বিদায় হও, যাও জাহান্নামেঃ
তোমাদের ঠাঁই নেই আমাদের মুলুকে এখন।‘
যখন নিঝুম বিষণ্নতা আমাকে দখল করে, দু’পাশের
গাছপালা, গোলাপ, চামেলি কৃষ্ণচূড়া, চন্দ্রমল্লিকা এবং
বুড়িগঙ্গা, মেঘনা নদীর তীর, শ্যামলীর নীড়,
পাড়াতলী গাঁয়ের কাজল মাটি বলে সমস্বরে,-
‘আমাদের ছেড়ে প্রিয় কবি যেও না কোথাও, তুমি
আমাদের একান্ত আপন। আমি কাদের প্রস্তাব নেব মেনে?
০৯-০৪-২০০২
জীবন তো প্রকৃত খেলার মাঠ
(বন্ধু তওফিক আজিজ খানের স্মরণে)
জীবন তো প্রকৃত খেলারই মাঠ, আমরা সবাই
খেলে যাই যে যার মতোই। যতদূর
জানি তুমি শুরু থেকে শেষ অব্দি খেলেছ, বান্ধব,
নিজের ধরনে ক্রিকেটের দক্ষ ব্যাটস্ম্যানের
ভঙ্গিমায়। সাজিয়েছ আপন সংসার
সুচারু অভিনিবেশে, যেমন ব্যাটস্ম্যান তার
সফল ইনিংস। প্রতি পদক্ষেপে ছিল
নিষ্ঠা আর ভঙ্গিতে সুষমা। বিপরীত দিক থেকে
বল এলে কখনো ধৈর্যের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিয়েছে,
কখনো-বা ফুটিয়েছ চারের মারের ফুলঝুরি।
ফুলবাণে বিদ্ধ হয়ে যখন উতলা ছিলে খুব, তখন সে
কাঙ্ক্ষিতা তোমার প্রিয় জীবনসঙ্গিনী হয়ে বাঁধলো তোমাকে
আলিঙ্গনে। তোমরা দুজন গড়েছিলে
সুখের, শান্তির নীড়। প্রিয়ার চুম্বন আর সন্তানের খেলা
তোমার ক্লান্তির ছায়াটিকে সহজে দিয়েছে মুছে। জীবনের
মাঠে কখন যে কোন্ অঘটন ঘটে, কে তার হিশের রাখে?
তোমার প্রতিটি শটে ছিল শিল্পের বিভাস, তবে কেন
সেঞ্চুরী না হাঁকিয়ে হঠাৎ পরাজয় মেনে নিয়ে
ব্যাট মাঠে ঠুকে ঠুকে বিশ্রামের কুয়াশায় নাকি
ভবঘুরে মেঘদলে, পড়লে ঘুমিয়ে সেই শোকে,
হে বন্ধু, যেখান থেকে কেউ ফিরে
আসে না কস্মিনকালে। কেন চলে গেলে?
ছিল না নাছোড় স্তব্ধ অভিমান কোনো? যতদূর
চিনেছি তোমাকে, ছিলে তুমি দিব্যি হাসিখুশি,
বাস্তবের খেলাঘরে সমর্পিত। কোন্ সে খেয়ালি
আম্পায়ার আচমকা আঙুলের সংকেতে তোমাকে
পিচ ছেড়ে যেতে বললেন আর সেই জ্বলজ্বলে ইনিংসটি
পুরো না খেলেই তুমি হায়, মিশে গেলে অজানা কোথায়!
২৪-০১-২০০২
জীবিতের পাথুরে স্তব্ধতা
সংকীর্ণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কৃপণ আকাশের দিকে
তাকিয়ে কী যেন দেখতে পেয়ে ঢ্যাঙা যুবক চমকে
উঠলো তার অস্তিত্বের ঝাঁকুনিতে। ভীষণ কুৎসিত জন্তু এক
লাফাতে লাফাতে চৌদিকে বিদ্ঘুটে গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে
মিশে যায় মেঘমালায়। খানিক পরেই সেটা মেঘ ফুঁড়ে
সেই যুবাকে অধিকতর ভড়কে দিয়ে উগরে ফেলে কয়েকটি করোটি এবং হাড়ের ভগ্নাংশ। হঠাৎ যুবার পা টলতে থাকে, বুঝি-বা
ভয়ঙ্কর তেজী ভূমিকম্প ওকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতি
নির্বিকার আজরাইলের কাছে। কয়েকটি শতচ্ছিন্ন কামিজ,
ট্রাউজার ঝুলছে ফাঁসির লাশের মতো।
ঢ্যাঙা, আতঙ্কিত যুবক নিজেকেও লাশ ঠাউরে কাঠের
পুতুলের মতো পড়ে থাকে নিস্পন্দ এক কোণে। আলো,
আঁধার অথবা ধুলো কিংবা বৃষ্টি-কিছুই ফেরাতে পারে না তার
এক রত্তি কবোষ্ণ বোধ। বিধ্বস্ত বারান্দা, ঘরদোর, করুণ,
রক্ত-রঞ্জিত আসবাব, অভাবিত লাশের স্তূপের বড় নিঃশব্দ
আহাজারি, মুষ্টিমেয় জীবিতের পাথুরের স্তব্ধতার একঘেয়ে
বোবা আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছে অলিতে, গলিতে, বাজারে, বন্দরে;
ভাঙাচোরা, বিকৃত মামুলি পাড়ায়, অভিজাত আকাশ-ছোঁয়া
প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটের সারির হু হু হাহাকার, ধ্বংসের স্মৃতি
বয়ে বেড়ানো কী ক’রে সইবে পুরোনো বসতি?
৩০-০৯-২০০২
জুয়েলের জাদু
সন্ধ্যারাতে জুয়েল আইচ বহুদিন পর ফের
আমাকে মোটরকালে নিয়ে
আমাদের শ্যামলীর বাসায় এলেন
নক্ষত্রের পানে চেয়ে বেদনার পানে
বড় বেশি ঝুঁকে গিয়ে। তাকে দেখে আমাদের দীপিতা ত্বরিত
এল ছুটে। ছোট্র এই মেয়ে আগে জুয়েলের জাদু
দেখেছিল এক সন্ধ্যারাতে। সেই স্মৃতি
নিয়ে এল টেনে তাকে আমাদের আলাপের কাছে।
অনেকের মতো দীপিতাও জেনে গেছে মজাদার
গায়েবি ক্ষমতা-কত কিছু হাত থেকে আচানক
হয় যে উধাও, উহাদের খোঁজ পায় না ত কেউ,
যদি না জুয়েল তার কেরামতি খাটিয়ে সেগুলি
ফের নিয়ে আসে হাতে। জাদুকর
জুয়েল পায়রা কিংবা অন্য কিছু হাওয়ায় বিলীন ক’রে
আমাদের তাক লাগানোয় ছিলেন না
উৎসাহী তেমন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজের
কিছু কথা জানালেন গল্পচ্ছলে কৃতী কথকের মতো আর
আমরা ক’জন শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ যেন আগাগোড়া।
জুয়েলকে সে-রাতে বিদায় দিতে গিয়ে দীপিতার বাবা নিচে
নেমে যায় অন্ধকারে। দীপিতার জন্মদাত্রী টিয়া
ঠাট্রাচ্ছলে বলে তার মেয়েকে, ‘তোমার বাবা হওয়ায় মিলিয়ে
গেছে জুয়েলের ম্যাজিকের ছোঁয়ায় কোথায় যেন।‘
দীপিতা মায়ের কথা শুনে কেঁদে ফেলে। আমি তাকে
সান্ত্বানার কথা ব’লে থামাই ফোঁপানি ওর। ভাবি-
একদিন যখন আমার ক্ষয়া শরীর হঠাৎ
ভীষণ নিস্পন্দ শৈত্যে ছেয়ে যাবে, প্রাণপাখি উড়ে অজানায়
হবে লুপ্ত, চিহ্নহীন, সেই ক্ষণে জুয়েল অথবা
প্রবাদপ্রতিম হুডিনির চেয়েও অধিক খ্যাতিমান কোনও
জাদুকরও ব্যর্থ হবে ফেরাতে আমাকে এই সুন্দর ভুবনে।
০৫-০৪-২০০২
জয়ঢাক বাজাতে আগ্রহী আজও
ফাঁদ তো পাতাই থাকে নানাদিকে, পা হড়কে আটকে পড়াটা
অসম্ভব কিছু নয়। চৌদিকে ইঁদুর-দৌড় খুব
জমেছে দেখতে পাচ্ছি, কে কাকে কনুই
দিয়ে গুঁতো মেরে আচানক
নিজের জবর গলা সম্মুখে এগিয়ে দিয়ে বাজি
জিতে নেয়া, হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠা কেল্লা ফতে বটে।
কথাগুলো কোথায় কখন ঠিক কে যে
শুনিয়েছিলেন, মনে পড়ছে না। উচ্চারিত কথামালা কোন্
সন্ধ্যাবেলা দুলেছিল, খুঁটিনাটি সবই
বিস্মৃতির ডোবায় পচছে। আজকাল
মগজ বেবাক ফাঁকা, উপরন্তু অসংখ্য কাকের হাঁকডাকে
একান্ত নিভৃতচারী কোকিলের গান ডুবে যায়।
কে যে কোন্দিন মুখে চৌকশ মুখোশ এঁটে নিয়ে
দাঁড়াবে সম্মুখে এসে নিশ্চয়তা নেই, সেই মূর্তি দৃষ্টি পথে
পড়লেই নির্ঘাৎ ভড়কে উঠে মূর্চ্ছা যাব আর
প্রেতদের হাসি আঁধারকে অধিক আঁধার করে
তুলবে চৌদিক, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ওরা আর
মনুষ্যত্ব সম্ভবত দু’হাতে ঢাকবে মুখ অসহায় বালকের মতো।
রাত সাড়ে তিনটায় বুড়িগঙ্গা নদীটির নিদ্রিত যৌবন
অকস্মাৎ জেগে উঠে তীর ছাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পথে,
বেপরোয়া আবেগে রাস্তার পর রাস্তা বেয়ে ঠিক
প্রবল চুম্বন করে লালবাগের কেল্লাকে আর
ছুটে গিয়ে একুশের শহীদ মিনারে মাথা ঘষে,
আসমান নেমে এসে খুব নিচে মিনারকে করে আলিঙ্গন।
অপরূপ এই দৃশ্য কেউ দেখল কি দেখল না, এই সত্য
জানলো কি জানালো না-বুড়িগঙ্গা, কেল্লা অথবা শহীদ
মিনারের কাছে শাদা কাগজের মতো অবিকল।
আলোকিত এই দিন নয়তো নির্বাক;
কল্যাণ, প্রগতি আর চিরসুন্দরের জয়ঢাক
সবদিকে বাজাতে আগ্রহী আজও পঁচিশে বৈশাখ।
০২-০৫-২০০২
ঢের ঢের দিনরাত
এই যে এখন এই হাড়-কাঁপানো শীতের ভোরবেলা
কাঠের চেয়ারে ব’সে একটি কবিতা
রচনার কথা ভেবে কলম নিয়েছি হাতে, দেখছি বাইরে
ধূসর কুয়াশা তার বিছিয়েছে জাল, যখন বাড়ির
সবাই ঘুমের গাঢ় মখমলে ডুবে আছে,
আমি কিছু শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছি, যেমন
নাবিক তালাশ করে প্রকৃতির মায়াঘেরা দ্বীপপুঞ্জ দীপ্র
আগ্রহ-উন্মুখ চোখে। প্রকৃত সন্ধান জেগে আছে
আমার এখনও ঢের ঢের দিন রাত
মানস ভ্রমণে মগ্ন থাকার পরেও। ডাঁই ডাঁই
শাদা কাগজের বুকে হরফের ছবি
আঁকা হয়ে গেছে, তবু সৃজনের ক্ষুধায় কাতর আজও আমি।
কী হয়, কী হবে সারি সারি শব্দ সাজিয়ে কাগজে?
আমি তো খুঁজি অমরতা কোনওকালে
পঙ্ক্তিমালা কালের গলায়
সাগ্রহে ঝুলিয়ে দিয়ে। বিনীত ভঙ্গিতে যতটুকু
পেরেছি সঞ্চয় থেকে করেছি অর্পণ। বলা যায়,
দিয়েছি উজাড় করে সব, জানি না কিছুর তার
প্রকৃত গৃহীত হবে, নাকি, শুধু
হেলার কলঙ্ক নিয়ে লুটোবে ধুলোয়!
হোক যত অবহেলা, না পড়ার সপ্রশংস দৃষ্টি কাব্যনাম্নী
রূপসীর এই অভাজজনের ওপর, তবু তার
পলায়নপর কায়া কিংবা ছায়ার পেছনে যত পারি
তত ষড়ঋতু অবিরাম ছুটব তুমুল লোকালয়ে কিংবা
বিরানায় পর্বত চূড়ায় আর উদাস প্রান্তরে
দেখব সে কতটা নিঠুরা উদাসীন হতে পারে।
১৭-০১-২০০২
তট ভাঙার জেদ
বলতে ভাল লাগে, আমার পূর্বপুরুষগণ
মেঘনা নদীর তীরবর্তী পাড়াতলী গাঁয়ের
বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের ছোট বড় কুঁড়ে ঘর
এখন নিশ্চিহ্ন, কিন্তু পুকুর আর পাকা মসজিদটি
আজ অব্দি রয়ে গেছে সগৌরবে। আমার
পিতার সৃষ্ট একটি দালান আর ইশকুল এখনও
দাঁড়ানো মাথা উঁচু করে। দু’তিন বছর অন্তর
আমরা একবার যাই পূর্বপুরুষদের স্মৃতির মঞ্জিলে।
দাদাজান, নানাজান, আব্বা আর চার চাচা, আমার
এক সন্তানের এবং আরও কারও কারও কবর রয়েছে সেখানে। রাত্তিরে
নিষ্প্রদীপ সেই উদাস কবরস্থানে জোনাকিরা ছড়ায় আলো
আর ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা সুর হয়ে ঝরে চৌদিকে।
পূর্বপুরুষদের কদিমি পুকুর আত্মজকে আমার
গিলেছে সেই কবে। এক ভরদুপুরে। আজও স্বগ্রামে গেলে
অতীত এবং বর্তমানের প্রতি নির্বিকার পুকুরটির কিনারে
গিয়ে বসি। গাছ গাছালি ঘেরা এই
জলাশয় সাক্ষী, এখানেই একাত্তরে হিংস্রতার তাড়া-খাওয়া
সন্ত্রস্ত হরিণের মতো জন্মশহর থেকে ছুটে এখানেই
নিয়েছিলাম ঠাঁই। এই পুকুর আমাকে দেখলেই, মনে হয়,
হাসে বাঁকা হাসি; তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার।
আমাদের পাড়াতলী গাঁয়ে ইলেকট্রিসিটি এখনও
গরহাজির, অরণ্যের ঘোর অন্ধকার
বিরাজমান এখানকার রাতগুলো। নিশীথের
তিমির রোদেলা দুপুরেও অনেকের মনের
ডোবায় ভাসমান, অথচ গাভীর ওলান
থেকে নিঃসৃত দুধের ধারার মতোই সারল্য ওদের।
শহরে লালিত পালিত এই আমার সত্তায় পাড়াতলী গাঁয়ের
পূর্বপুরুষদের শোণিতধারা প্রবহমান
মেঘনার স্রোতের মত। বুঝি তাই সমাজের বহুমুখী নিপীড়ন,
নির্দয় শাসকদের সন্ত্রাস আমার ভেতর
মেঘনার উত্তাল তরঙ্গমালা হয়ে জেগে ওঠে প্রতিবাদ,
এগিয়ে চলার তেজ, প্রতিক্রিয়ার অনড় তট ভাঙার জেদ।
০৩-০৪-২০০২
তাকালেই চোখে পড়ে
কিছুদিন হল কী-যে হয়েছে আমার, কিয়দ্দূরে
তাকালেই চোখে পড়ে রঙ বেরঙের
নানা চৌকো নক্শা, কখনও বা শাদা অথবা ধূসর
গোলাকার বস্তু যেন। মাঝে মাঝে হঠাৎ আমার
কাছে ব’সে-থাকা কারও পরিচ্ছন্ন মুখে ফুটে ওঠে
গুটি বসন্তের মতো দাগ। এ আমার কী-যে হল!
চোখে সাম্প্রতিক অস্ত্রোপচারের পর আচানক
এই অঘটন বিষাদের জালে করেছে আটক
আমাকে, তবে কি এভাবেই বাকি পথ প্রায়শই
থমকে, চমকে পাড়ি দিতে হবে? এই বিভীষিকা
থেকে, হায়, নেই কি আমার মুক্তি? কখন কী ছবি
ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে, সে আতঙ্কে ডুবে থাকি বেলা অবেলায়!
আমি তো দেখতে চাই কদম ফুলের রূপ সজল আষাঢ়ে,
গোধূলির নরম আলোয় বারান্দার রেলিঙে খানিক ঝুঁকে
দাঁড়ানো তন্বীর শরীরের সৌন্দর্য-ঝরানো মুদ্রা,
মেঘের বাগান ছুঁয়ে-যাওয়া
পাখির ডানার সুকোমল সঞ্চালন,
এবং শুনতে চাই দূর থেকে ভেসে-আসা বাঁশির আহ্বান।
এমনই নসিব, আজকাল বার বার চোখে ভাসে
নদীর নিস্পৃহ বুকে কুমারীর লাশ; হন্তারক লাপাত্তা এবং
কন্যাহারা জনক জননী শোকে রুদ্ধবাক্, বুকে
হাহাকার। সন্ত্রাস মুকুট পরে রাজপথে ভ্রাম্যমাণ শিস্
দিতে দিতে; গেরস্তের ঘরে দীপ নিভে যায় যখন তখন,
আমার দু’চোখে ভেসে ওঠে ঘাতকের বিজয়ী মিছিল!
সম্প্রতি নিজেই আমি আমার চোখের আচরণে বড় বেশি
ক্ষুব্ধ, সর্বক্ষণ ওরা সম্পূর্ণ মুদ্রিত থাকলেও
দেখি নানা ভয়াবহ বিকৃত মুখের আনাগোনা,
রক্তময় দেয়াল এবং বিধ্বস্ত বিছানা
এই বিভীষিকা থেকে আমি কি পাবো আন মুক্তি? যদি
দু’চোখ উপড়ে ফেলি নিজ হাতে, তবুও কি নয়?
দর্পণে প্রতিফলিত
দর্পণে প্রতিফলিত এই মুখ কার? সত্যি কার?
এ আমারই নাকি অন্য কারও? যতদূর
মনে হয়, এ আমার নয়। এ রকম
অচেনা, বেগানা মুখ কী ক’রে আমার
হতে পারে? এই মুখমণ্ডলে কী গাঢ়
রেখাবলী প্রস্ফুটিত, চোখ দুটো স্লান অতিশয়।
এ কার চেহারা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি এখন? ইচ্ছে হয়,
এক্ষুণি বাতিল কাগজের মতো ছিঁড়ে
ফেলে দিই ডাস্টবিনে। হামেশা সাবানে ঘষলেও
কদাকার, জাঁহাবাজ, হিংস্র চিহ্নগুলি
কখনও যাবে না মুছে। ধিক, তোকে ধিক, ব’লে এক
পাখি উড়ে যায় ভাসমান মেঘে।
দর্পণে প্রতিফলিত এই মুখ কফিলের? নাকি অনিলের?
বড়ুয়ার? রিচার্ডের বুঝি? নয়, নয়,
এদের কারুর নয়। যদি বলি বনের পশুর,
তাহ’লে তারাও সমস্বরে প্রতিবাদে
ভীষণ পড়বে ফেটে, বলবে ‘কোনো না, অপমান
আমাদের। আমরা পারিনি হ’তে হিংস্র এই মতো’।
শ্যামলী, ঢাকা।
২৯-০৫-২০০২
দীর্ঘ আয়নায় নিজের ছায়া
দীর্ঘ আয়নায় নিজের ছায়া ঠোঁট নেড়ে স্তিমিত কণ্ঠস্বরে
প্রশ্ন করে, ‘বলতে কি পারো কে তুমি? ভড়কে গিয়ে ছায়াকে ছুঁই,
জানতে চাই কেন সে এমন সওয়াল করেছে ব্যাকুলতায় এই
গোধূলিবেলায়। ছায়া তাকায় আমার দিকে, কিছুক্ষণ থেমে
বলে, ‘আমি নিজেই জানি না কেন এই অবেলায় এমন প্রশ্ন ছুড়ে
দিয়েছি তোমার দিকে। তোমার মনের গভীরে কখনও কি
উঁকি দেয়নি এমন সওয়াল?’ মাথার সব কোণা হাতড়ে যাচাই
করি, কখনও ব্যাপারটি আমাকে প্রশ্নাতুর করেছে কি না। আবছা
কিছু মনে পড়ে, অথচ মুহূর্তেই গাঢ় কালো মেঘমালা দিয়েছে
ঢেকে অস্পষ্ট কথাকে। আয়নার ছায়া থেকে দূরে সরে গিয়ে
বসি পাশের ঘরে, যেখানে আমার তিনটি বুক-শেলফ্-ভরা নানা
বই রয়েছে হাতের স্পর্শের নীরব, ব্যাকুল প্রতীক্ষায়। আমার প্রিয় এই ঘরে
লেখার টেবিল, টেলিফোন সেট, কয়েকটি পুরোনো, নতুন
কলম, কছু সাদা কাগজের প্যাড, একটি টেবিলল্যাম্প, টেবিলের
শরীর-ঘেঁরা পুরোনো চেয়ার, অদূরে স্থিত খাট, মনে হয়,
অনুরক্ত, মায়াময় দ্যাখে।
কতকাল নিজের সঙ্গে বসবাস করছি, অথচ আজ অব্দি নিজের
প্রকৃত সত্তা অচেনা রয়ে গেল। বই পড়ি, টেবিলে ঝুঁকে লিখি, কখনও
দিনে, সর্বদা রাতে বিছানায় শুয়ে স্মৃতির জাল ফেলি, অচমকা
গুটিয়ে নিই, নিদ্রার কুয়াশায় হারাই। কখনও কখনও জেগে উঠে
অন্ধকারে চোখ মেলে তাকাই জীবনসঙ্গিনী, দেয়াল, দরজা জানালা,
বুক শেল্ফ-এর দিকে। ঘরের তিমির প্রশ্ন করে আমাকে, ‘কে তুমি?
বলতে পারো প্রকৃত কে তুমি? অস্থিরতায় বিছানায় এ-পাশ
ও-পাশ করি। দম বন্ধ হয়ে আসে যেন, হঠাৎ উঠে বসি, পাথুরে
অন্ধকার আমাকে গিলে খেতে চায়। বাতি জ্বেলে তাকাই চৌদিকে,
কিঞ্চিৎ স্বস্তি পাই, তবু প্রশ্ন জাগে, ‘কে আমি? আমার গন্তব্য
কোথায়? কে আমাকে বলে দেবে?’ ঘরের আলো নিভে গেছে যেন,
হাহাকারময় অন্ধকার গম্ভীর কণ্ঠস্বরে করে উচ্চারণ,
‘কোথায় যেতে চাও? বস্তুত চির-তিমির ছাড়া কোথাও যাওয়ার নেই।‘
২৭-০৯-২০০২
ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে
ভীষণ ঘুরছে মাথা, হাত-পা টলছে, যেন ঢেউয়ে
নৌকা, তবু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, উদ্যম হারালে
চলবে না। আমাদের চোখের সামনে চাঁদটিকে
গিলে খাচ্ছে দুরন্ত খবিশ, শহরের
সবগুলো বাগিচার নানাবিধ ফুল
কীটের সন্ত্রাসের নিমেষেই ঝরে পড়ছে লোলুপ মৃত্তিকায়।
যে-ভাবে কাঁপছে জমি, মনে হয়, নিমেষেই দরদালানের
কাতার পড়বে ধসে তাসের ধরনে। চেয়ে দ্যাখো,
কেমন নড়ছে সব-গাছ গাছড়া এবং খসে
পড়বে পাখির নীড়। অথচ অদূরে মেতে আছে বেপরোয়া
ক’জন জুয়াড়ি তিন তাসের খেলায়। কালবেলা
কী দ্রুত আসছে ধেয়ে বারবার, তবুও টনক নড়ছে না।
অতিদূর কোথাও কে যেন অতিশয়
নিবিড় করুণ সুর তুলছে বাঁশিতে, সেই সুরে
ভবিষ্যৎ কালের ধ্বংসের পূর্বাভাস সদ্য-বিধবার কান্না
হয়ে ঝরে যাচ্ছে অতিরত। পদতলে বারবার
মাটি কম্পমান আর কোন্ দিক থেকে যেন ঘন
ঘন ভেঙে-পড়া ফ্ল্যাটদের আর্তনাদ ভেসে আসে।
বিপদের কালো মেঘে ছেয়ে যাবে আমাদের সুনীল আকাশ-
কোনও কোনও জ্ঞানী বলেছিলেন আগেই,-
প্রাসাদ, কুটির সবই ভূগর্ভে বিলীন হবে, যদি না মানব
আগে ভাগে সুন্দর, কল্যাণ-প্রদর্শিত পথে হেঁটে
মহত্ত্বের সাধনায় মনে প্রাণে সদা
ব্রতী হয়। হিংসা, দ্বেষ ঘৃণা সৃষ্টি নয় ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে।
‘পাগলের প্রলাপ এসব,’ ব’লে হো-হো হেসে ওঠে
জুয়াড়ির ঝাঁক আর মদিরার স্রোতে ভেসে কোমর দুলিয়ে
রাস্তা সাম্ভা নেচে নিজেদের সমাজ সংসার মিছে সব ভেবে,
আপদ বিপদ ভুলে বস্তুত আপনকার পকেট হাতড়ে
শূন্যতাকে পেয়ে দিব্যি ঢলে পড়ে ইয়ারের কাঁধে আর হিন্দি
ফিল্মের চটুল সুর টেনে আনে জিভের ডগায়।
ওদিকে ক্ষুধার্ত জমি ‘খাদ্য চাই’ ব’লে ভায়ানক গর্জে ওঠে
চৌদিকে, পাখিরা নীড় ছেড়ে অতিদূর আসমানে উড়ে যায়।
১০-০৯-০২
নির্জন তরণী
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চিরচেনা নদীটির তীরে
এসে দেখি জনহীন ঘাট, হা কপাল,
একটিও নৌকা নেই। বুকের ভেতর হু হু হাওয়া
বয়ে যেতে থাকে, ব্যগ্র দৃষ্টি ঢেউদের ব্যাকুলতা করে পাঠ।
আমি তো ভেবেছিলাম, রঙিলা নায়ের মাঝি হাত
নেড়ে গলা ছেড়ে ডেকে নেবে
আমাকে নৌকায় তার, আমি হাসি মুখে
যাব সেই দিকে আর বসব বাদামি পাঠাতনে।
নদীতীরে নৈঃসঙ্গের হাত ধরে চলে পায়চারি
কিছুক্ষণ, অকস্মাৎ আমার আপনকার মাথার ভেতর
মসৃণ প্রবেশ করি-সে এক বেগানা
আশ্চর্য জগৎ বটে, নানাবিধ পাখি ওড়ে রঙধনুময় ঠিকানায়।
বেলা ক্লান্ত হয়ে এলে পর দিগন্তের আবছায়া ভেদ ক’রে
ভেসে ওঠে এক তরী, কে জানে কীসের
টানে ঠিক নদীতীর অভিমুখে খুব দ্রুত চলে
আসে, মাঝি নেই, কেউ নেই, তবু তরী আমন্ত্রণময়!
কী এক অপূর্ব ঘোরে উঠে পড়ি তাড়াতাড়ি রঙিলা নায়ের
যাত্রী রূপে। অচমকা কারা যেন বেঁধে ফেলে আমার দু’হাতে,
হো-হো হেসে ওঠে অন্তরালে, অসহায় আমি’ মন-মাঝি তোর
বৈঠা নে রে’ ব’লে সাড়া তুলি নায়ে, গতি পায় নির্জন তরণী।
১০-০৫-২০০২
পরস্পর হাতে হাত রেখে
সূর্যোদয় এখনও অনেক দূরে, অন্ধকার বটতলে
বসে থাকি অর্থহীন। বেশ কিছু পথ
চলা বাকি আছে হে আমার ভাই-বোন। চোখ খোলা
রেখে এ মুহূর্তে যাত্রাপথে পা বাড়াও দ্বিধাহীন।
রাহেলা, ফাতেমা, রাধা, অনিমা, নঈম, শাহরুখ,
অনিল গৌতম, শোনো, এখনই গা ঝাড়া দিয়ে পথে
নেমে পড়। মনে দ্বিধা, আতঙ্ক, নিরাশা
কিছুতেই কখনও দিও না ঠাঁই, পা চালাও দ্রুত।
তোমাদের প্রাণ হরণের পালা ওত পেতে আছে
নানা দিকে, পথে কাঁটা বিছানো বিস্তর-
এই তথ্য জানা আছে, তবুও সব অশুভের হিংস্র
থাবা ছিঁড়ে খুঁড়ে যেতে হবে উদ্দিষ্ট চাতালে।
মানবীকে দাসীরূপে দেখলে অপার উল্লাসিত যারা, তারা
যতই প্রবল হোক, হোক অমানুষ,
তোমরা রাশেদা, মরিয়ম, উর্মিলা, অঞ্জনা, বীথি,
বিমল, অতীশ, অবিনাশ, ফরহাদ, হালিম, রিয়াজ দ্রুত
পা চালাও পরস্পর হাতে হাত রেখে,
পৌঁছে যাও কাঙ্ক্ষিত মিলন-ক্ষেত্রে, যেখানে মানবী,
মানব সমান অধিকারে বসবাস করে আর
সাগ্রহে সানন্দে গড়ে নিরুপাম শান্তিনিকেতন।
২৬-০৩-২০০২
পূর্ণিমার জাগরণে
সমাজের বিভিন্ন কন্দরে কিংবা খোলামেলা ঘাটে
কীভাবে সম্পর্ক এই মনুষ্য সমাজে
ভীষণ হোঁচট খেয়ে পঙ্গু হয়ে যায়, অনেকেই
সহজে পায় না টের। কালো মেঘ গ্রাস করে সারা উজ্জ্বলতা।
কিছু কেঠো সামাজিকতার আবরণ
হয়তো-বা রয়ে যায় বাসি, পচা খাদ্যের ধরনে,
যেমন নদীর ঠোঁটে ঢেউগুলো চুমো খাওয়ার পরেও
ভেজা বালি রোদের ধমকে শুক্নো, ধুধু
অবয়বে টিকে থাকে। আন্তরিক পরিচয় পথ
ভুলে অমাবস্যার খপ্পরে পড়ে গেলে ঘটে বটে বিপর্যয়।
এই যে এখনও খুব চড়া রোদ ছায়াময় তিয়াত্তর
বছর বয়সে নিত্য পলায়নপর
কবিতা নামের নিরুপমার পেছনে
পেছনে আপ্রাণ ছুটি, সে কি নির্বুদ্ধিতা
আমার? খেয়াল শুধু? যখন অনেকে দ্বিপ্রহরে
কিংবা সন্ধ্যারাতে গল্প গুজবে বেজায় মেতে রাতে
গৃহিণীর আলিঙ্গনে সুখে ঘুমের চুমোয় মজে থাকে, আমি
তখন চেয়ারে বসে আকাশ পাতাল ভেবে চলি।
সমাজ সংসার সব ভুলে সুফী সাধকের মতো ধ্যানে,
মগ্নতায় সফেদ পাতায় পংক্তিমালা
সৃজনে মাতাল হই-জানি না এসব কিছু উন্মাদের স্বপ্ন
নাকি কিছু বেখাপ্পা প্রলাপ।
জানি, জীবনের নানা বাঁকে প্রচুর ভ্রুকুটি আর
বিষাক্ত সমালোচনা সাপের মতোই
প্রকাশ্যে কি অপ্রকাশ্যে আমাকে ছোবল
মেরেই চলেছে-নিয়তির এই আঁকিবুকি, বলো,
কীভাবে এড়িয়ে যাবো? তবু অমাবস্যার শক্রতা
কুটোর মতোই ভেসে যায় একদিন পূর্ণিমার জাগরণে।
১৯-০৮-২০০২
প্রণয়কৌতুকী তুই
প্রণয়কৌতুকী তুই, ওরে যদি বলি সরাসরি,
ছিনালি স্বভাব তোর, সুনিশ্চিত জানি
হবে না সত্যের অপলাপ। একদা দুপুরে তুই,
সে তো আজ নয়, যৌবনের জ্বলজ্বলে
ফাল্গুনে আমার থরথর
পিপাসার্ত ওষ্ঠে দিয়েছিলি এঁকে প্রগাঢ় চুম্বন।
অপরূপ আলিঙ্গনে সেই যে আমাকে বেঁধেছিলি,
অতীন্দ্রিয় সেই গাঢ় স্পর্শে করেছি ভ্রমণ দূর মেঘলোকে,
স্বর্গীয় হ্রদের তীরে শুয়ে
অচিন পাখির সখ্য, ঝুঁকে-পড়া নিরুপম গাছের পাতার
প্রাণঢালা মৃদু ছোঁয়া, নক্ষত্রের মদির চাউনি
পেয়ে গেছি বারবার, না চাইতে এখনও তো কিছু পেয়ে যাই।
তবে কেন হৈ-হুল্লোড়ে মজে তুই এক ঝটকায়
বেচারা সর্বদা-অনুগত এই ক্ষমা প্রেমিকের
সান্নিধ্যের উষ্ণতা হেলায় ঠেলে দূরে চলে যাস
মাঝে মাঝে? অকুণ্ঠ কবুল করি, জীবিকার চাবুকের ঘায়ে
বিব্রত, রক্তাক্ত হই, তবুও তো ভুলিনি তোমায়, ওরে তোর
সত্তার অনিন্দ্য ঘ্রাণ, আজও চাই, তোকেই তো চাই মায়াবিনী।
তোমার সন্ধ্যানে আজ চা-খানায়, অলিতে-গলিতে, পার্কে, মাঠে,
নদী তীরে হই না হাজির অসুস্থতা হেতু, তবে
গোপন আস্তানা আছে আমার হৃদয়
জুড়ে, যার আওতায় বেহেশ্ত-দোজখ,
দিঘির বুকের চাঁদ, তপ্ত রাজপথময় প্রতিবাদী দীপ্র
মিছিলের কলরব। তবুও কি ছেড়ে যাবে তোমার কবিকে?
২০-০৩-২০০২
প্রত্যাশা জেগে নয়
এখন রোদের যৌবনের তাপ নেই, এটাই তো
অনিবার্য পড়ন্ত বেলায়। প্রত্যুষের আনকোরা ক্ষণে মাথা
ক’রে হেঁটে চলা দীর্ঘকাল
ক্লান্তিকেই করে আলিঙ্গন, জানা আছে
যুগ যুগান্তের পথচারীদের। এই যে পথিক আমি
হেঁটেছি বিস্তর, সে-তো গোধূলি বেলায় পৌঁছে গেছে।
এ চলার পথে কত প্রিয় মুখ থুবড়ে পড়েছে
দিগ্ধিদিক, বেদনার্ত দাঁড়িয়েছি ক্ষণকাল, ফের অন্বিষ্টের
প্রলোভনে দ্রুত
করেছি চলার ভঙ্গি, হোঁচটে হোঁচটে
পায়ে ঢের দগদগে ক্ষত
ত্বরিত হয়েছে সৃষ্টি, তবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
অব্যাহত রেখেছি যাত্রার রীতি। হবে কি আখেরে
ক্লান্ত মাথা মুকুটে শোভিত?
বস্তুত চলার পথে ধূলিকণা জমেছে শরীরে ঢের আর
চোখ দুটো ক্লান্তির গহন কুয়াশায়
সমাচ্ছন্ন, তবু হেঁটে চলেছি দৌড়ের
করুণ, অস্পষ্ট, ব্যর্থ ভঙ্গিমায়। এ খেলায়
জয়ের প্রত্যাশা শুধু ধুধু মরীচিকা জানি, তবু
আখেরে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার প্রত্যাশা জেগে রয়।
১৯-০২-২০০২
প্রত্যাশার প্রহর
আমার চাতক-মন সেই কবে থেকে প্রত্যাশার
প্রহর কাটায় ধ্যানে, মাঝে মাঝে তার
কী খেয়াল হয়, টেলিফোন রিসিভার তুলে
বলে যায় এলেবেলে কথা,
যদিও ওপারে কেউ নেই শ্রবণের প্রতীক্ষায়। এই খেলা
কেন যে মাতিয়ে তোলে আমাকে প্রায়শ-এ বাধ্যতা।
আমি কি প্রকৃত কোনও শুভ সংবাদের
আশায় নিজের সঙ্গে কৃষ্ণকায় এই বর্তমানে
ক্রীড়াপরায়ণ হয়ে উঠেছি এমন? মাঝে মাঝে
শুনছি কলিংবেল, ছুটে যাই হন্তদন্ত হয়ে। দরজাটা
খুলে দাঁড়ালেই স্রেফ খাঁখাঁ শূন্যতার
দেখা পেয়ে কিছুক্ষণ খুব স্তব্ধ হয়ে থাকি।
সন্ত্রাসের ধ্বনি ভেসে আসে প্রতিদিন, চতুর্দিক
থেকে বাড়িঘর, ধুলো, মাটি, গাছগাছালি এবং
ল্যাম্পেস্ট, ওভারব্রিজ বমি করে হাহাকার আর
অমাবস্যা-রাতে অগণিত মৃতদেহ
মাথা নত করে হেঁটে যায়
কে জানে কোথায়! পথে বিকট গহ্বর!
এই অন্ধকার, এই হাহাকার থেকে, হায়, নেই কি নাজাত
আমাদের? কতবার টেলিফোন তুলে
কেবল নিজের সঙ্গে অভিনয় করে যাব? এভাবেই
আপন সত্তার সঙ্গে অভিনয় করে যাব আর কতকাল?
আমি চাই পথে আজ প্রাণবন্ত সব মানুষের
আসা-যাওয়া, গাছে গাছে কোকিলের সুরের মহিমা।
২১-০৫-২০০২
প্রত্যাশার বাইরেই ছিল
প্রত্যাশার বাইরেই ছিল ব্যাপারটি। রোজকার
মতোই টেবিল ঘেঁষে পুরোনো চেয়ারে
আরামে ছিলাম বসে, ঘড়িতে তখন
সকাল আটটা ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি কি না-লেখা কোনও কবিতার পঙ্ক্তি মনে-মনে
সৃজনে ছিলাম মগ্ন? একটি কি দুটি শব্দ হয়তো-বা ভেসে
উঠছিল আমার মানস-হ্রদে। আচমকা
চোখে পড়ে ঘরে একটি প্রজাপতির চঞ্চলতা।
বেশ কিছুকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ দিব্যি গিলে রেখেছে আমার,
আমাদের বসতিকে। আলো জ্বালাবার
প্রয়াস নিমেষে ব্যর্থ হয় জাহাঁবাজ
তিমিরবিলাসী ক্রূর হাওয়ার সন্ত্রাসে নিত্যদিন। তবুও তো
একজন রঙিন অতিথি ঘরটিকে দান করে অকৃপণ
সোন্দর্যের আভা, মুগ্ধ চোখে দেখি তাকে। মনে হয়,
একটি কবিতা যেন ওড়াউড়ি করছে এ-ঘরে,
অথচ দিচ্ছে না ধরা আমার একান্ত করতলে, যার ধ্যানে
দীর্ঘকাল মগ্ন ছিল কবিচিত্ত সম্ভবত অবচেতনায়
আধো জাগরণে কিংবা ঘুমের আংশিক এলাকায়।
২৩-০৮-২০০২
বিষাদের সঙ্গে সারাদিন সারারাত
বিষাদের সঙ্গে কাটিয়েছি সারাদিন সারারাত, ভোরবেলা
চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে দেখি, এ কী
কেমন নাছোড় বিষণ্নতা ভাসমান, কখন যে
চুমুকে চুমুকে সেই বিষণ্ন পানীয়
আমার নাচার জিভে ছেয়ে গেল আর আমি
নিজের কাছেই যেন কেমন বেগানা হয়ে যাই।
বুঝতে পারে কি কেউ কীভাবে ভেতরে তার কোন্
রিপু তাকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে
যায় সর্বনাশের কন্দরে? এই আমি অসহায়
চেয়ে চেয়ে দেখছি যাপিত জীবনের পাতাগুলি
কী দ্রুত গাছকে ন্যাড়া ক’রে ঝরে গেছে, এই আমি
অচিরেই হয়ে যাব কীট পতঙ্গের উৎসবের উপাদান।
হাহাকার তাড়া করে নিয়ত আমাকে আজকাল;
কারা যেন, বস্তুত কঙ্কালসার কতিপয় বুড়ো, ভয়ঙ্কর
ভঙ্গিমায় এগোয় আমার দিকে, তিমির-ছড়ানো
ছমছমে শ্মশানের কালো ছায়া আমার মানসে
ভীষণ দুলতে থাকে, পা দু’টো কে যেন
মাটিতে দিয়েছে পুঁতে, হায়, হয়ে গেছি স্বরহারা।
কিছুক্ষণ কেটে গেলে নিজেকে দেখতে পাই রক্তখেকো কিছু
অর্ধপশু অর্ধ-মানবের জটলায়। ওদের বীভৎস চোখ
ক্ষণে ক্ষণে করছে বমন নরকের অগ্নি-ঢ্যালা;-
পুড়ে যাচ্ছি, ছুটে যেতে চাই অন্য দিকে, অন্য কোনও
সুস্নিগ্ধ অভয়াশ্রমে, যেখানে দুঃস্বপ্ন নেই, নেই অর্ধপশু
অর্ধ-মানবের পৈশাচিক স্বৈরাচার, বন্য আইনের হাঁক।
শ্মশানের ছাই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে শহরে আমাদের,
বেয়াড়া অস্ত্রের ঝলসানি বারবার
নিরীহ চোখের জ্যোতি নেভানোর শপথ নিয়েছে
যেন, মাস্তানের জোট শ্রেয়বোধ তাড়ানোর,
কল্যাণের দীপ নেভানোর প্রতিযোগিতায় মেতে
উঠেছে বেদম আর শুভবাদী চেতনা হিংসার পদতলে পিষ্ট, ক্লিষ্ট।
সময় কি ফুরিয়ে এসেছে সত্যি? আমি কি এমন ভ্রষ্ট, নষ্ট
সমাজের বাসিন্দা হয়েই বাকি সময়ের ধ্বনি
শুনে যাবো? ধুধু গোরস্তানের স্তব্ধতা সারাক্ষণ
বয়ে যাবো? প্রায়শই মধ্যরাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম
থেকে কেঁপে জেগে উঠে বোবা হয়ে থাকবো কেবল? তখন কি
ত্বরিত পড়বে মনে একদা দুপুরে-শোনা কোকিলের গান?
০১-১১-২০০২
বড় দীর্ঘ সময়
পথ শক্ত অথচ মসৃণ ছিল অনেকটা, হেঁটে
যেতে যেতে যেতে অকস্মাৎ
পা দু’টি কাদায় ডুবে যায়। মনে হল সম্ভবত
ডুবে যাব আপাদমস্তক। দম বন্ধ হয়ে এল
প্রায়, কোনও মতে মাথা উঁচু রেখে শ্বাস নিতে থাকি,
সজোরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি।
আবার নতুন ছাঁদে পথ চলা সম্মুখে কায়েম
রাখি, আরও কতদূর যেতে হবে, কোন্ বিপদের
মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা
ওঁৎ পেতে আছে,
কে আমাকে বলে দেবে এই কৃষ্ণপক্ষে? পদযুগ
বিগড়ানো, মাথার উপর ঘোরে খাপছাড়া পাখি।
পাখিটা কি অশুভ সঙ্কেত কোনও? নাকি
ভীষণ বেয়াড়া মাংসভুক? অতিশয়
ক্লান্তি দুটি চোখ বুজলেই
অতিপয় অচেনা চেহারা
ভয়ঙ্কর বিকৃত আদলে দেখা দেয় বার বার,
কেড়ে নেয় স্বস্তি; দৃষ্টি জ্বেলে নিই ফের।
‘শোনও পথচারী, এখানেই এই বিয়াবানে যাত্রা
থামিও না, ওঠো, মুছে ফেলে ক্লান্তির কুয়াশা
যত পারও জোর কদমে এগোও’,-মেঘমালা
চিরে যেন কার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। গোধূলির
রঙ মুছে যাওয়ার আগেই
ত্বরিত কদমে হাঁটি স্বপ্নাদ্য স্বর্ণিল আস্তানার অভিমুখে।
১২-০৩-২০০২
ভরদুপুরেই অমাবস্যা
আকাশটা যেন ভাঙা বাসনের মতো
এক্ষুণি পড়বে ঝরে আমাদের ভয়ার্ত মাথায়-এ রকম
আশঙ্কায় কাটছে সময় অনেকের। মস্তিকের
ভেতরে বৃশ্চিক কখন যে ফের করবে দংশন
আচানক, বলতে পারি না। স্বস্তি নেই, শান্তি নেই
একরত্তি; আমি সদা সহবাসী যাদের, তাদের
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ রাখতে পারি না কিছুতেই, যেন এই
প্রিয়জনদের সঙ্গে কানামাছি খেলে যাচ্ছি যখন তখন।
পায়ের তলার মাটি কাঁপছে ভীষণ, দিকে দিকে
ঘরবাড়ি রূপান্তরে ভগ্নস্তুপ, অসহায় মাতম ধ্বনিত
পাড়ায় পাড়ায়, কত সংসার উজাড় হলো চোখের পলকে
এই কালবেলায় কাদের, কে আমাকে ব’লে দেবে? ‘মানবের,
মানবীর’, বলে গেল আতঙ্কিত পাখিদের উড্ডীন মিছিল,
দিগন্তের ছায়ায় জন্মন্ধ শিল্পী হয়ে যায় বেদনার্ত সুর।
দূর দিগন্তের সুরে আমার লেখনী নিমেষেই
টেবিলে স্পন্দিত হয়, গভীর সঙ্কেতে ডাকে কাছে মিলনের
আকাঙ্ক্ষায় চেনা ক’টি আঙুলের সঙ্গে। জানি না কী কথা তার
মনে মেঘ হয়ে জমে আছে,
আমার চৌদিকে শুধু বহু বিঘা পোড়ো জমি আর
ওদের হৃদয়-চেরা বিলাপের বিষণ্ন ফসল জেগে ওঠে!
মাটিতে একটি মৃত কাকের চৌদিকে উড়ে উড়ে কাছে এসে
কয়েকটি কাক প্রতিবাদী শোক করছে পালন,
লক্ষ করি আমার জানালা থেকে। অথচ নগরে
ও পল্লীতে আজকাল কী সহজে রোজ
সোল্লাসে মানুষ চুরি করে নেয় প্রাণ মানুষের
প্রতিদিন দেশপ্রেমিকেরা নিগৃহীত, নিপীড়নে
জর্জরিত। এখন তো আসমানে
চাঁদ বড় বিষণ্ন এবং চুর্ণ হতে চায় প্রতিবাদে।
দেখছি স্বচক্ষে আজ মহত্ত্ব বিচূর্ণি, পদদলিত নিয়ত
এই ভ্রষ্ট, নষ্ট কালে ন্যাঙটো রোশনিতে। এই মতো ভরদুপুরেই ঢের ঢের আগে, জানি,
অকস্মাৎ নেমেছিল ঘোর অমাবস্যা, তবু নানা যুগ করে
স্তব, গায় জয়গাথা কালজয়ী মহাপুরুষের।
০২-০৪-২০০২
ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে
মাথার ভেতর এক ঝাঁক ছোট পাখি
বেশ কিছু দিন থেকে কিচিরমিচির করে চলেছে হামেশা;
শুধু রাত্রিবেলা গাঢ় ঘুমে হয়তো-বা
নিঝুম নিশ্চুপ থাকে,-অনুমান করি। এভাবেই অস্বস্তিতে
কাটছে জীবন। কে আমাকে বলে দেবে
হায়, এই উপদ্রুত মাথায় ঝিঁঝির একটানা
ধ্বনি কবে হবে শেষ। আজ এটা, কাল সেটা আছে তো লেগেই
যেমন কৌতুকপ্রিয় বালকেরা বেড়ালের লেজে
ভারি ঘণ্টা বেঁধে দেয়। অকস্মাৎ চোখে পড়ে দূরে
ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো ক’রে ধুঁকছে ভীষণ, যেন এই
মুহূর্তেই মৃত্তিকায় খসে পড়ে যাবে। অকস্মাৎ
অকারণ কার স্মৃতি প্রস্ফুটিত হৃদয়ে বিধ্বস্ত বাগানে?
কোনও কোনও দিন একা ছোট ঘরে এক কোণে ব’সে
গোধূলি-বেলায় দরবেশী মন নিয়ে কেবলি ভাবতে থাকি,-
আকাশ পাতাল এক হয়ে যায়, কখন যে
নিজেকে দেখতে পাই ভ্রাম্যমাণ নিঃসঙ্গ পথিক, হেঁটে হেঁটে
পেরিয়ে চলেছি মাঠ, নদীতীর, উপত্যকা, উজাড় নগর, কখনও-বা
যত্রতত্র কঙ্কালের ঢিবি চোখে পড়ে। কবেকার এইসব
মূক গল্পময় ঢিবি, প্রশ্ন ছুড়ে দিই স্তব্ধ, দূর
আকাশের দিকে আর ধিক্কারে রক্তাক্ত করি নিজের স্মৃতিকে!
হাঁটতে হাঁটতে ধ্যানী আমি থেমে যাই। কী আশ্চর্য, চোখে পড়ে
কবেকার সুদূরের দাস-নেতা স্পার্টাকাস তার উৎপীড়িত
অথচ সুদৃঢ় সেনাদের চাবুকের
প্রহার-লাঞ্ছিত শরীরের গৌরবপ্রদীপ্ত অরুণিমা নিয়ে
দাঁড়ালেন আমার সম্মুখে, দীপ্তকণ্ঠে শোনলেন আশ্বাসের শুভবাণী;
আমি তার পৌরুষের অনন্য কান্তিতে প্রজ্বলিত
হতেই গেলেন মিশে নক্ষত্রের অনাদি জগতে। পিপাসায়
ভীষণ শুকিয়ে আসে জিভ, শিশিরের প্রত্যাশায় শূন্যে দৃষ্টি মেলি।
আচমকা মনে হয়, বিভ্রম আমাকে শুধু অর্থহীনতার
ধোঁয়াশায় টেনে নিচ্ছে, নিরুত্তর জিজ্ঞাসার হামলায়
রক্তাক্ত, বিহ্বলবোধ, অসহায় আমি
ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকি পানীয়ের ফতুর গেলাশে অন্তহীন।
কে আমাকে বলে দেবে গলাভর্তি অত্যাচারী বালি
আর কাঁটা থেকে মুক্তি পাওয়ার কসরৎ ঘোর অবেলায়?
এক্ষুণি শিখিয়ে দেবে কোন্ জাদুবলে? চারদিক
থেকে ধেয়ে আসছে শ্বাপদ ছিঁড়ে খেতে আমাকে মেটাতে ক্ষুধা।
এখন সহজে কেউ করে না বিশ্বাস কাউকেই। প্রত্যেকের
দুটি চোখ সন্দেহের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন এবং
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় মনে জাগে আশঙ্কা, হয়তো কেউ
অকস্মাৎ ঠেলে ফেলে দেবে বিশ হাত নিচে। সে মুহূর্তে
অন্য কারও অন্তরাত্মা ঘেমে ঘেমে কাদাময় হয়
বুলেটের বৃষ্টির আচ্ছন্নতায় ডুবে বিলুপ্তির হিম ভয়ে।
মরুর বালি
কেউ কি এসে কবির এমন ক্ষয়া জীবন-গোধূলিতে
গান গেয়ে আজ পুঁতবে খুঁটি কবির প্রাণের খোলা ভিতে।
কৃষ্ণপক্ষে আজকে যাদের জীবন কাটে স্মৃতি নিয়ে,
কে-বা চাইবে সুখী হ’তে স্মৃতির জালটি ছিঁড়ে দিয়ে?
ক’দিন ধ’রে মুষড়ে আছি একলা নিজের ছোট ঘরে,
ভুগছি আমি, কাঁপছি এবং পুড়ছি বেজায় কালো জ্বরে!
কেউ কি আমায় বলতে পারো শান্তি কোথায় পাবো কিছু?
কোথায় যেতে হবে না আর ক’রে আমার মাথা নিচু?
যেদিন থেকে ভাবি না আর তোমার মুখের হাসি, কথা
মনের গুহায় গুমরে মরে অনেক কথা, রাঙা ব্যথা।
হয় না বলা সেসব কথা কারো কাছেই ডেকে ডুকে,
তোমার কথা স্মৃতির পাতায় নিয়েছিলাম সুখে টুকে।
পরে যেদি আমায় হেসে প্রশ্ন করো, ‘গ্যাছো ভুলে?’
নীরব থেকে দৃষ্টি দেবো হরিণ-চোখে, কালো চুলে।
জানি আমি অনেক কথাই বলার জন্যে বলি শুধু,
হৃদয় জুড়ে অনেক সময় মরুর বালি করে ধুধু।
০৭-১১-২০০২
মহাকাশে ধ্বনিত বাংলার জয়গান
চারদিক থেকে ধুলোর বৃষ্টি; দু’হাতে মুখ ঢেকেও
দৃষ্টি খোলা রাখতে ব্যর্থতা পোহাচ্ছি। ব্যর্থতা যেন
গোর খোদকের মত নৈপুণ্যে চাপ চাপ ধুলোর কবর
তৈরি ক’রে আমাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ভেতরে। দম বন্ধ
হয়ে আসছে আমার। কঙ্কালেরা ঘিরে ধরেছে তাণ্ডবে,
হাল ছেড়ে মুখ ঢেকে পড়ে থাকি, করি মুর্দার অভিনয়।
হন্তারকের বিকট উল্লাস ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত এখানে
সেখানে; স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়া উচিত ছিল, অথচ
যেতে পারি না এই চেনা প্রকৃতির কোমল রূপ, মাটির
মাতৃসুলভ মমতা ছেড়ে। এই শহরের শ্বাস-প্রশ্বাস আমাকে
বাদ্যের মত বাজায়, নদীর ঢেউয়ের মত দোলায়। দুলতে
দুলতে স্নেহার্দ্রে চোখে তাকাই চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধার দিকে।
আমার বাঁচার আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র ধু্লোর
ঝাপটা, শোকবার্তা অনবরত কালো করতে থাকে শহর
আর গ্রামকে। ফরসা রোদের জন্য প্রতীক্ষায় ক্লান্ত হই,
অথচ অমাবস্যা নিজস্ব প্রতাপের প্রদর্শনী কায়েম
রেখেছে আলোর গর্দান ধরে বহুদূরে ঠেলে দিয়ে। ভীত
আমি কখনও সখনও মাথা ঝাঁকিয়ে হয়ে উঠি প্রতিবাদী।
ধুলোর সন্ত্রাসে অচেতন আবর্জনা স্তূপের নীচে করুণ
সমাহিত-প্রায় আমি প্রগাঢ় জ্বলজ্বলে এক কণ্ঠস্বরের
স্পর্শে, কে যেন বলছেন, ‘জেগে ওঠো কবি মায়াবী ঘুমের
জাল ছিঁড়ে, দ্যাখো চেয়ে কী প্রতীক্ষা করছে তোমাকে
অভিবাদন জানাবার আকাঙ্ক্ষায়। দেখি, অদূরে
নদীতীরে একটি সোনার তরী দুলছে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
এবং মাস্তুলে-গাঁথা পতাকা অপরূপ নর্তকীর মত
নৃত্যপর আর মহাকাশে ধ্বনিত বাংলার জয়গান।
০৮-০৪-২০০২
মহেঞ্জোদড়োর কণ্ঠস্বর
মহেঞ্জোদড়োর আসমান ফিসফিসে কণ্ঠস্বর কথা বলে
একালের উৎপীড়িত আকাশের কানে কানে
গোধূলিবেলায়। জঙ্গী বিমানের জাঁহাবাজ আওয়াজে কানের
পর্দা ফেটে যেতে চায় আর্ত আকাশের।
মহেঞ্জোদড়োর আসমান অতীতের প্রিয় কিছু
কথা ও কাহিনী বলে নীলিমার কানে কানে, ‘শোনো,
কী প্রভাতে, কী-বা দ্বিপ্রহরে অথবা নিশীথে মেঘ-প্রেয়সীর
ঠোঁটে কত এঁকেছি চুম্বন
নির্বিঘ্নে, করেছি আলিঙ্গন দ্বিধাহীন। এখন তো
যন্ত্রপাখি কান ঝালাপালা করে, ছিঁড়ে ফেলে বুক
মেঘেদের, ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে যায় মিলনবাসর,
কত যে সাধের, হায়, এনগেজ্মেন্ট।‘
মহেঞ্জোদড়োর সুপ্রাচীন আসমান ক্লান্ত স্বরে
তরুণী মেঘের কানে কানে বলে, ‘যখন নীচের
দুনিয়ার দিকে এই বুড়োটে দু’চোখ মেলে দেখি
নানা দেশে বেশ কিছু মানুষের কাণ্ড-কারখানা
পাড়ায় পাড়ায় খুনখারাবির খেল, পথেঘাটে
আদম সন্তানদের মানুষ পুড়িয়ে
মারার আ-মরি মহোৎসব, বনবাদাড়ের হিংস্র
পশুদের বড় বেশি সভ্য মনে হয়। ওগো মেঘমালা, শোনো,
আমার দু’চোখ বুজে আসছে, এই তো
এক্ষুণি আমাকে শূন্যে লীন হতে হবে।‘
১৯-০২-২০০২
রোদ আর জ্যোৎস্নাধারা কাঁদে
কেন এই ভোরবেলা দু’চোখে আমার
বস্তুত কিছুই ধরা পড়ছে না? কিছুকাল ধরে
দৃষ্টি ঘুণে-ধরা সত্য, তবু
অন্ধ তো হইনি আজও, তবে কেন ঘোর
অমাবস্যা এমন পাথুরে
পর্দা আজ ঝুলিয়ে দিয়েছে
চারদিকে? এখন কোথায় কোন দিকে
আন্দাজে বাড়াব দু’টি হাত, চালাব পা
ঠিকঠাক বিভ্রমের ঘাড় মট্কে দিয়ে?
কোন্ গান জোগাবে প্রেরণা সুন্দরের হাত ধরে যেতে?
তীরে তরী প্রতীক্ষাপ্রবণ, কিন্তু গায়েব যে-মাঝি,
কোথায় খুঁজব তাকে? আমাকে যে পাড়ি দিতে হবে মহানদী
সূর্যাস্তের আগে, ঘুমাঙ্কিত সুরে ঢুলে
নদীর ভেতর থেকে কে ডাকে আমাকে?
সেই সুরে সুপ্রাচীন শ্যাওলার রঙ,
বিলুপ্ত মাছের ঘ্রাণ ভাসমান-এ কেমন ঘোর
আমাকে রয়েছে ঘিরে অবেলায়? তরঙ্গে তরঙ্গে
অবিরাম ওঠে নামে এ কার কঙ্কাল?
এই খেয়া নায়ের মাঝির নাকি? তবে
কী ক’রে পেরুব মহানদী এখন কে দেবে বলে?
দেব কি তরঙ্গে ঝাঁপ? সাঁতার শিখিনি, ঝাঁপ দিলে
সলিল সমাধি সুনিশ্চিত; আমার করুণ লাশ
মহোল্লাসে ছিঁড়ে খাবে মাছের মিছিল
এবং কঙ্কাল হয়ে ভাসব নদীতে। জানবে না
কেউ সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠবার আগে
নদীতীরে ছিলাম প্রতীক্ষারত একা।
মুহূর্তেই স্থানান্তর, পৌঁছে যাই ছাদহীন ভাঙা দেয়ালের
নড়বড়ে ঘরময় এলাকায় মৃত অনেকেই, জীবিতরা অর্ধমৃত,
মূক ও বধির আর সর্বত্র গোঙানি, সারাদিন
রোদ আর সারারাত জ্যোৎস্নাধারা কাঁদে, শুধু কাঁদে।
১৯-০৩-২০০২
শহীদ মিনারকে ওরা গ্রেপ্তার করেছে
দাগী অপরাধী ঠাউরে নিয়ে
শহীদ মিনারকে ওরা গ্রেপ্তার করেছে, গোঁয়ার
শেকলে বেঁধেছে কোমর বজ্র-আঁটুনিতে,
আক্রোশে পরিয়েছে হাতকড়া।
যেখানে এখন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, বাউলগুরু
লালনের গান নয়, নয় প্রতিবাদী কবিকণ্ঠে
উচ্চারিত পঙ্ক্তিমালা, তেজী বক্তাদের
আগুন-ঝরানো ভাষণ, শান্তির বাণী।
এখন দিনরাত শহীদ মিনার ঘিরে ধ্বনিত
অগণিত বুটের কর্কশ আওয়াজ। শহীদ মিনারে
শত শত স্রোতার মিলন-মেলা নয়, বসেছে হুকুম বরদার
রাইফেলের বৈঠক। শহীদ মিনারে আজ ফুলের স্তবক
প্রগতি, কল্যাণ আর আশাবাদের পতাকা নেই; সেখান
এখন চোখ-রাঙানো উদ্ধত উর্দির ধমক।
হায়, এ কেমন কাল এলো জন্মভূমিতে আমার,
যখন নন্দিত ভাষা-সৈনিক,
কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক,
চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী-সবাই অবাঞ্ছিত
শহীদ মিনারের পবিত্র প্রাঙ্গণে! তবে কি
বায়ান্নোর ভাষা শহীদের আত্মা,
নিরস্ত্র অগণিত জীবিত মানুষ
প্রতিবাদে গর্জে উঠবে না ফের?
২৪-০৯-২০০২
শহুরে বাউল হাঁটে
না, আমি ইঁদুর-দৌড়ে শরিক হবো না, কারো কোনো
প্ররোচনা কিংবা ছলাকলা
পারবে না আমাকে নামাতে সেই হুড়োহুড়ি, সেই পড়ি-মরি
নির্লজ্জ খেলায়। হেঁটে যাবো
একান্ত নির্জন প্রতিযোগীহীন পথে। ভোলা মন যা চাইবে
যখন, করবো সেই কাজ মহানন্দে তখন-কখনো
বটের ছায়ার বসে দেখবো পাখির
কোমল প্রণয়লীলা, কখনো-বা ভাসমান দেঘ।
না, আমি ইঁদুর-দৌড়ে নেই। যে উদাস
বাউলের ডেরা
অন্তরে আমার, সে আমাকে একতারা
বাজিয়ে শোনাবে গীতিমালা, দেবে তুলে
আমার ইচ্ছুক হাতে অরূপ ছিলিম, চতুর্দিকে
চকিতে উঠবে নেচে আরশি নগর। কে আমার
মনের মানুষ ব’লে খোলা পথে হেঁটে যাবো একা,
ব্যাকুল ডাকবো তারে, পাবো না উত্তর। একতারা
বেজে চলে পথের ধুলোয় আর গাছের পাতায়, মেঘলোকে;
শহুরে বাউল হাঁটে একাকী নিজের পথে, যেতে হবে হেঁটে।
সত্যি, কোথাও যাওয়ার নেই
সত্যি কি জীবিত আমি? এই যে শ্যামলী পাড়াটির এক কোণে
একটি বাড়ির ছোট ঘরে প্রায়শই বসে থাকি,
ওল্টাই বইয়ের পাতা, তাকাই বাইরে, দেখি কাছের গাছের
পাতার চাঞ্চল্য মাঝে মাঝে, বাথরুমে মুখ ধুই, প্লেট পেতে
আহারাদি সেরে নিই, এখনও ঘুমিয়ে পড়ি, খাতার সফেদ
পাতাদের দিকে চেয়ে থাকি,-একি সত্যি?
কেটে গেল কতদিন, মাস আর কত না বছর
যেন এক লহমায়-এভাবেই যায়,
যেমন ভোরের আলো সন্ধ্যার আন্ধারে মিশে যায়।
বাসায় বেঁধেছি ডেরা, কাটিয়েছি কত ষড়ঋতু
আনন্দে, বিষাদে আর জীবনের নানা বাঁকে প্রিয়
বন্ধু আর বান্ধবীর মুখোমুখি হয়েছি চকিতে
ভাগ্যগুণে বহুবার। বুদ্ধিজীবী বন্ধুর ড্রইংরুমে দেশী কি বিদেশী
সাহিত্য-কেন্দ্রিক আলোচনা কিংবা ঘরোয়া আলাপে
কেটে গেছে কত না বিকেল আর কত মধ্যরাত আর নানা
প্রহর কেটেছে প্রেমিকার আলিঙ্গনে
চুম্বনের স্বর্গীর স্বাদের আভা নিয়ে-সত্যি কি এসব?
স্বদেশে, বিদেশে করে বসবাস ঘনিষ্ঠ স্বজন অনেকেই;
আমার নিকেট থাকে জীবনসঙ্গিনী, পুত্র, পুত্রবধূ আর
নয়নের মণি দুই পৌত্রী নয়না, দীপিতা। অকস্মাৎ
কখন যে চলে যাবো, নিশ্চিত বিলীন হবো মহাশূন্যতায়
শুধু ক’জনের স্মৃতিরূপে রয়ে যাবো, স্মৃতি বিলীন হয়
বিস্মৃতির অন্ধকারে। আমার পার্থিব বাড়িঘর, ব্যক্তিগত
গ্রন্থাগার, স্বরচিত পুস্তকাদি-ধুলো হবে সবই জনমের
আগে আর মরণের পরে শুধু শুধু
অস্তিত্বহীনতা, এ জগতে বটে এসেছিলাম একদা, অবশেষে
বস্তুত নিশ্চিহ্ন হওয়া ছাড়া সত্যি কোথাও যাওয়া নেই।
১৫-০৮-২০০২
সন্ত্রাসে বড় জর্জরিত
ছিলেন আটক তিনি এলোমেলো ভাবনার হিম কুয়াশায়;
উপমা, উৎপ্রেক্ষা কিংবা স্রেফ শাদাসিধা
বর্ণনার অবয়ব-এসব কিছুই নয়। মেঘদল থেকে
ভেসে-আসা নিঃসঙ্গ, রহস্যময় বলছে তাকেই
‘কবি, তুমি কলম টেবিলে রেখে নিষ্ক্রিয় থাকবে কতকাল?
তোমার চোখে কি পড়ছে না
পুঞ্জ পুঞ্জ হিংস্র অন্ধকার
গিলে খাচ্ছে তোমার আপনকার শহর ও গ্রাম?
‘কিব, তুমি আর কতদিন, বল, থাকবে এমন উদাসীন
এই অবিরাম তাজা রক্তঝরা, আর্তনাদময়
দিনগুলি, রাতগুলি, হানাদার ছোরা
আর বুলেটের তাণ্ডবের ক্রূর ঝড়ে?
‘কবি, তুমি শোনোনি কি ভাসমান মেঘদলে ধর্ষিতা, গ্লানির
কাঁটায় ভীষণ জর্জরিত আত্মঘাতী মহিমার
ম্লান মুখ ঝরায় নালিশ এই নিষ্ক্রিয়, বেজায়
মূক সমাজের দিকে? শোননি কি তুমি?
‘কবি, তোমার কি জানা নেই পুলিশী সন্ত্রাসে বড় জর্জরিত
প্রগতি ও কল্যাণের পথে অগ্রসর, প্রতিবাদী সেই
তরুণের অস্ত্রাঘাত-চিহ্নিত, নিষ্প্রাণ
শরীরের ভেসে-ওঠা জলাশয়ে, মা’র চোখে বান?’
কালো রাত প্রত্যুষে রূপান্তরিত হওয়া সঙ্গেই সেই মেঘবাসী
প্রশ্নকর্তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কবি যেন ঘোর
দুঃস্বপ্নের অরণ্য পেরিয়ে জেগে ওঠেন এবং
ফেলে-রাখা কলমটি প্রবল আবেগে তুলে নেন।
০১-০৬-২০০২
সুদূরের অনন্য প্রবাসী
শহীদ, বলো তো বন্ধু সেই সব দুপুর, গোধূলিবেলা আর
সন্ধ্যারাত, মধ্যরাত মার্কিন মুলুকে
ঢেউ হয়ে স্মৃতিতটে আছড়ে পড়ে কি
কখনও সখনও? বলো, পাতাল ট্রেনের কামরায়
তন্দ্রাচ্ছন্ন মুহূর্তে চকিতে জেগে ওঠো নাকি বিউটি বোর্ডিং
আর লক্ষ্মীবাজারের ঘ্রাণে?
যখন বস্টনে ঘন কুয়াশার কাফন জড়ানো সন্ধেবেলা
কাঙ্ক্ষিত আড্ডায় মেতে ওঠ কিংবা তুষারের আলিঙ্গন ছিঁড়ে
দীর্ঘক্ষণ কর্মস্থলে ডুবে থাকো, তখন কি আচানক
মনে পড়ে যায়, হায়, কোনও কোনও মৃত, অর্ধমৃত
ঢাকাবাসী বান্ধবের মুখ? কখনও মনে কি পড়ে
বুদ্ধদের বসুর কবিতাভবনের স্পর্শময়
‘কবিতা’-পত্রের জন্যে অধীর প্রতীক্ষা আমাদের? তখন কি
তোমাকে দখল করে অতীতের স্মৃতি-কাতরতা?
শহীদ, যখন তুমি হিম-রাতে বন্ধ দরজা জানালা, উষ্ণ
কামরার চারদিক নীরবে আবৃত্তি করো আর
কোনও কবিতার বই খুলে আঙুলের
ফাঁকে ধূমায়িত সিগারেট কোমল বুলিয়ে পাঠ
করো কোনও বিদেশি কবির তাজা কবিতা, তখন
তোমার পড়ে কি মনে সুকুমার, জাহাঙ্গীর, তাহের অথবা
বুড়ো কিংবা আখতার, খালেদ চৌধুরী
ফিল্মপ্রিয় দীর্ঘকায় বাচ্চু, সঞ্জীব, সৈয়দ হক, কায়সুল
আর এই সত্তর-পেরুনো অতিশয় ধূসর আমার কথা?
হে প্রিয় বান্ধব, বলো, মনে পড়ে নাকি?
কী আশ্চর্য, শহীদ তুমিও, হ্যাঁ, তুমিও
জ্বল জ্বলে একদা-কিশোর,
এ-ও সম্ভব ষাটে থরথর? যায় উচ্ছলতা,
ঔজ্জ্বল্য কী দ্রুত ক্ষয়ে ফিকে হয়ে যায়, হাহাকার
জেগে রয়; শুধু কি যৌবন অস্তাচলে
মিশে যায়? সৌহার্দের, সখ্যের গোধূলি লুপ্ত হয়
দীর্ঘশ্বাসে। কাদা থেকে উঠে-আসা অতিকায় জন্তুর জঠরে
যাচ্ছে চলে বাগান, পূর্ণিমা-চাঁদ, বাংলার মানব মানবী!
শহীদ, হে প্রিয় বন্ধু আমার, তুমি কি ফিরে এসে
ভূমিধসে অসহায়, দুঃস্বপ্ন-তাড়িত ভাঙাচোরা
মানুষের ভিড়ে মিশে অন্ত্রাঘাত মাটি-চাপা পড়ে
কোনও এক অজ্ঞাত কবির শোকগাথা হতে চাও? আপাতত
সুদূরের অনন্য প্রবাসী তুমি আর
এই অবসন্ন আমি শক্রময় নিজ বাসভূমে পরবাসী।
২৪-০৭-২০০২
সেই কখন থেকে খুঁজছি
সেই কখন থেকে খুঁজছি নিজের বাড়ি, দুপুর গড়িয়ে
বিকেল হল, গোধূলি ছুঁল সন্ধ্যাকে, তবু
খুঁজে পাচ্ছি না আপনকার বাড়ি। পাড়ায় পাড়ায়
প্রতিটি বাড়ির কলিংবেল টিপে, অথবা
দরজার কড়া নেড়ে ব্যাকুল জিগ্যেশ করি, বলতে পারেন
এই বাড়িটি কার? অমুক আমি, এটা কি আমার নিবাস?
বাড়ির মালিক অথবা ভাড়াটে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে চকিতে
দরজা বন্ধ করে দেয় মুখের উপর। নিরাশ
আমি এই পথ থেকে সেই পথে, এক গলি ছেড়ে আরেক
গলিতে রাম, রহিম, বড়ুয়া ডেভিডের
ঠিকানায় পৌঁছে নিজের বাড়ির হদিশ খুঁজি।
ঘুরতে ঘুরতে, এ বাড়ি সে বাড়ি করতে করতে বড়ই
ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার এই বেলা অবেলার অন্বেষণের জন্য
ঘুটঘুটে রাত্তিরে, এই ক্লান্তির জন্য ক্ষমা চাইব কার কাছে? হায়, অভাগা
আমার এমন কেউ কি আছেন
যার করুণাধারায় মুছে যাবে অবসাদ, সকল গ্লানি?
অভিভাবকহীন, অসহায় আমি ডুবে আছি অরণ্যরোদনে।
গোধূলিবেলায় পুরনো একটি বাড়ির দরজা থেকে
ব্যর্থতার মুঠো মুঠো অন্ধকার নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ
অমলকান্তি এক বালক এসে দাঁড়ায় সামনে এবং
কিছু না ব’লেই আমাকে পরিচালিত করে কোলাহল থেকে
দূরে আশ্চর্য নির্জনতায়, ঠেলে দেয় ঊর্ধ্বলোকে মেঘের
মহল্লায়, ডানাহীন আমি উড়তে থাকি নক্ষত্রের জলসায়।
০৯-০৪-২০০২
স্বপ্নে আমার মনে হলো
রাগী মোষপালের মতো ধেয়ে আসছে
আকাশজোড়া মেঘদল আর সেই কবে থেকে
আমি হেঁটে চলেছি কাঁটাভরা পথে, চলেছি
অভীষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। অবিরত
রক্ত ঝরছে অতিশয় ক্লান্ত দুটো পা থেকে। বেয়াড়া
ক্লান্তি আর অমাবস্যা-হতাশার
চোখ রাঙানিতে জব্দ হয়ে ত্বরিত
এই গাছতলায় লুটিয়ে পড়লে বেঁচে যাই।
অথচ একরোখা জেদ আমাকে ঠেলে দেয়
সামনের দিকে ঘুটঘুটি অন্ধকার, মেঘের
বাজখাঁই ধমক এক লহমায় অগ্রাহ্য ক’রে
এগোতে থাকি। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎপ্রবাহ আমাকে
পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। বিদ্যুল্লতাকে
ধন্যবাদ জানাতে থাকি প্রতিটি পদক্ষেপে।
অকস্মাৎ আমার ব্যাকুল দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত
অনন্য প্রকৃতি-শোভিত তপোবন। আমার
দু’চোখ সঙ্গীতধারায় রূপান্তরিত অপরূপ
নক্ষত্রে যেন, কী এক আমন্ত্রণ আমাকে
পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তপোবনের ভেতর। অভিভূত
দেখি একজন অনিন্দ্যসুন্দর তাপস
উপবিষ্ট উঁচু, দ্যুতি-ছড়ানো আসনে এবং
অদূরে তাঁর মুখোমুখি বেশ নিচু আসনে
বসে আছেন ক’জন তাপস। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি
তাকিয়ে থাকি সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের দিকে।
কারা যেন আমাকে সরিয়ে দিতে চাইলো
সেখান থেকে। উচ্চাসনে উপবিষ্ট তাপস
অঙ্গুলি নির্দেশে আমাকে এগিয়ে আসার সঙ্কেত জানিয়ে
দূরের একটি আসন দেখিয়ে দিলন। তাঁর ঔদার্যে
হতবাক আমি উজ্জ্বল সাহসে বললাম, ‘এই অধমকে আপনি
আপনার পদতলে ঠাঁই দিন গুরুদেব হে বিশ্বকবি।‘ অন্যান্য
আসনে উপবিষ্ট স্তম্ভিত কবিবৃন্দ চেয়ে থাকেন আমার দিকে,
চকিতে মুছে যায় দৃশ্য। আমি স্বপ্নহারা মেঘে ভাসতে থাকি!
০২-০৮-২০০২
হায়, এ কেমন জায়গায়
হায়, এ কেমন জায়গায় ডেরা আমার, যেখানে
গাছগাছালির চিহ্ন নেই, সবুজের জন্যে চোখ
পিপাসার্ত সারাক্ষণ। পিপাসা মেটে না
কিছুতেই; নীলিমায় চোখ দুটো রেখে কিছুক্ষণ
স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের ছোঁয়া পাব, তারও পথ বন্ধ। আসমান, সে-ও
বড় সঙ্কুচিত বহুতল কিছু বাড়ির সন্ত্রাসে
কোনও দিকে স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। বহুকাল যাবত প্রত্যহ
কানে খুব জোরে ধাক্কা দেয়্য স্কুটার, মোটরকার,
বাস আর দ্রুতগামী ট্রাকের ধমক। ভাবি, সারাক্ষণ কানে
তুলো গুঁজে রাখি কিংবা বিধি বাম হয়ে
আমাকে বধির করে দিলে রক্ষা পাই। কালেভদ্রে কান পেতে
রাখি, যদি কোনও যাদুবলে কোকিল অথবা
অন্য কোনও গায়ক পাখির অকৃপণ
সুরের স্বর্গীয় সুরসুধা, পদাবলী-সঞ্চারিত
মাধুর্যের প্রত্যাশা নির্বোধ স্বপ্ন ছায়া বৈ তো নয়!
২৩-০৮-২০০২