মদ্যপদের মধ্যে
মদ্যপদের মধ্যে বসে আছে সে চুপচাপ
অনেকক্ষণ ধরে। হাত দু’টো টেবিলে ন্যস্ত, মাথা নিচু।
অন্যেরা কেউ কারো কথায় কান না দিয়ে
বেজায় হৈ হল্লা করছে, খিস্তি খেউড়ের
ডেকেছে বান। দূর থেকে কেউ দেখলে ওকেও
মনে হবে মদে চুর, ঝিম মেরে বসে আছে।
অথচ নেশাভাঙ কিছুই করে নি সে। শুধু সঙ্গ দিচ্ছে
ঘন্টার পর ঘন্টা ইয়ারবক্সিদের।
রাত এগারোটায় চেয়ারে ঠায় বসে অন্য এক মস্তিতে
নিমজ্জিত। তবে কি সে ফেরেশ্তাদের সঙ্গে মনে মনে
তর্ক জুড়ে দিয়েছে পারিপার্শ্বিকের প্রতি
সম্পূর্ণ উদাসীন? নাকি ভাবছে হুরপরীদের
স্তন স্পর্শ করলে একজন মানুষ
কীরকম অনুভূতির সরোবরে কাটতে পারে ডূবসাঁতার?
না, সে এরকম কিছুই ভাবছে না এখন।
ওর মাথায় বন বন ঘুরছে সাঙাতদের কথা,
যারা নেশায় বুঁদ।
ওদের সে ঘেন্না করে না; ওরা, সে ভাবে,
প্রত্যেকে পাথরে ছিট্কে-পড়া
বিন্দু বিন্দু রক্ত। মিথ্যার তুবড়ি-ছোটানো কতিপয়
চেনা মুখমণ্ডলের অশ্লীল ভঙ্গি দেখে দেখে,
নিত্যদিন প্রবঞ্চনার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
প্রত্যক্ষ করে, হাড়-ফাটানো জুলুমের প্রতি দর্পিত
শিরস্ত্রাণের সায় লক্ষ করে
ওরা হতাশা ও বেদনায় ক্রমাগত লগি ঠেলতে ঠেলতে
এগোচ্ছে সর্বনাশের মোহনায়।
ওরা নীড়পোড়া পাখির ঝাঁক, কালবেলায়
জড়ো হয়েছে এই হতচ্ছাড়া আসরে। কেউ বিড় বিড় করে
কী যেন একটা বলতে চাইছে, কেউবা ঘুমের ঢুলু ঢুলু।
সে ওদের ভালোবাসে; কিছুতেই ছেড়ে যেতে
পারে না, প্রতীক্ষায় থাকে-
যদি কখনো হঠাৎ নেশার রঙিন কুয়াশা
অপসৃত হবার পর ওরা দেখতে পায় ওদের সামনে
সুন্দরীর মতো উন্মোচিত ভবিষ্যৎ।
এক সময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, আঙুল চালায়
লম্বা চুল, মনে হয় একজন গেরিলা
তৈরি হচ্ছে নতুন কোনো
অ্যামবুশ্-এর উদ্দেশ্যে। ওর চোখ দু’টো মণিরত্নের মতো
জ্বলজ্বলে; এমন কান্তিমান পুরুষ
কোথাও কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
যতই ভাবি
ভাঙাচোরা পথের ধারে একটি গাছকে বললাম-
তার কথা ভেবে ভেবে আর দগ্ধ হবো না।
গাছ আমার কথায় কান না দিয়ে
ঝাঁ ঝাঁ রোদে আরো বেশি পুড়তে দিলো নিজেকে।
দূরের এক পাখিকে মনোযোগের চাতালে এনে জানালাম-
ওর উদ্দেশে গান গেয়ে আর ভেজাবো না চোখের পাতা।
পাখি আমার কথাকে উদাসীন ঝাপটায়
ঝেড়ে ফেলে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে একাকী।
আমার চারপাশে জড়ো হওয়া অক্ষরগুলোকে
শোনালাম, তোমাদের রূপকল্পে
তাকে আর কস্মিনকালেও সাজাবো না।
অক্ষরগুলো হো হো হেসে করতালি বাজায় ক্রমাগত।
যতই ভাবি আমার স্মৃতির চৌহদ্দি থেকে
রাখবো ওকে বনবাসে,
ততই সে নিজেকে মূল বিষয় করে দৃশ্যের পর দৃশ্য
তৈরি করতে থাকে আমার চোখের সামনে প্রহরে প্রহরে।
যেখান থেকে সরে এসেছি
কী এক অস্বস্তি আর অস্থিরতা
কাল সারারাত ঘুমোতে দেয় নি আমাকে। অনেকক্ষণ
বই নিয়ে বসে থাকলাম, বুটিদার আকাশ
দেখলাম, ভাবনার নানা পাকদণ্ডীতে
ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ভোর রঙরেজের মতো
আমার ঘরে লাগালো পোঁচড়া, খেয়াল ছিল না।
হাতের কাছেই ধোঁয়া-ওগরানো চায়ের পেয়ালা,
কবিতার বইয়ের অক্ষরগুলো
নানা ধরনের মঞ্জরী, আজ রাস্তায় না মোটর কারের
হর্ণ, না রিকশার টুংটাং আওয়াজ, না ফেরিঅলার ডাক।
কল্পনার বীজতলা থেকে কিছু কণা নিয়ে নাড়াচাড়া করি
ডায়েরির পাতায়
রোপণ করার জন্যে। নোনাধরা অসংস্কৃত দেয়ালে
কখনো কখনো যে গুলিবিদ্ধ মানচিত্র দেখি, তা ফুঁড়ে যেন
বেরিয়ে আসতে চায় বলিভিয়ার জঙ্গল
আর চে গুয়েভেরার মুখ।
তৃপ্তিতে টইটম্বুরে
কয়েকটি মুহূর্ত আমার ভেতরে এক
অপরূপ ঐকতান। অনেকক্ষণ ধরে
চৌদিক খুব সান্নাটা; যাকে দেখার জন্যে আমার
ব্যাকুলতা আহত ঈগলের আর্তনাদ,
হয়তো সে এখন চুল এলিয়ে ইন্দ্রজাল-ছাওয়া দ্বীপে
মিরান্ডা নতুন পৃথিবীর দিকে
তার মুখ কী উন্মুখ। আজ আমি বাইরে পা বাড়াবো না।
সুন্দরবনের বাঘের গর্জন ভেসে এল কী করে
পৌরপথে? চমকে উঠে দেখি
হঠাৎ রাস্তায় অকুল সমুদ্র, আকাশ-ছোঁয়া
কল্লোল আমাকে ঘর থেকে টেনে
ছুঁড়ে দিলো সেই সমুদ্রে, আমি তরঙ্গে তরঙ্গে
ভাসমান দুরন্ত সাহসী প্রদীপ,
যে কোনো চোরা টান কিংবা ঘূর্ণির তোয়াক্কা না করে
ক্রমাগত অগ্রসরমান।
যেখান থেকে সরে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়ার পথ
আমি নিজেই রাখি নি।
লড়ছি সবাই
মিশমিশে ঘোর অন্ধকারে
কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে,
রহিম পড়ে রামের ঘাড়ে,
কেউবা দেখি চুপিসারে
অন্য কারুর জায়গা কাড়ে,
পাচ্ছি তা টের হাড়ে হাড়ে।
লাইন থেকে সরছি ক্রমে সরছি।
জল খেয়েছি সাঁতটি ঘাটে,
ফল পেয়েছি বাবুর-হাটে,
কিন্তু সে ফল পোকায় কাটে,
ঘুণ ধরেছে নক্শি খাটে,
কানাকড়ি নেইকো গাঁটে,
চলছি তবু ঠাঁটে বাটে,
রোজানা ধার করছি শুধুই করছি।
পক্ষিরাজের ভাঙা ডানা,
রাজার কুমার হলো কানা।
দিনদুপুরে দৈত্যপানা
মানুষগুলো দিচ্ছে হানা,
নিত্য চলে ঘানি টানা,
জগৎ-জোড়া খন্দখানা-
হোঁচট খেয়ে পড়ছি কেবল পড়ছি।
ফসল ক্ষেতে পোকা পড়ে,
ঘর উড়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ে,
মাতম ওঠে ঘরে ঘরে।
কত ভিটায় ঘুঘু চরে,
কংকালেরা এই শহরে
বাঁচার জন্যে ধুঁকছে মরে।
বাঁচার লড়াই লড়ছি সবাই লড়ছি।
শীতদুপুরে প্রথম দেখা
শীতদুপুরে হঠাৎ
হৃদয় আমার লাফিয়ে উঠলো তরুণ মাছের মতো,
যখন তুমি সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে
সাবলীল প্রবেশ করলে রেস্তোরাঁয়। নদীতীরে ভিড়লো
ময়ূরপঙ্খী। সেই মুহূর্তেই
আমার ভেতরে রূপান্তর। বছরের পর বছর
প্রাচীন অধীরতা নিয়ে
প্রতীক্ষায় ছিলাম যার, সে-ই কি তুমি?
আমার প্রৌঢ়ত্বের ধূসরতায়
এক রাশ শ্যামলিমা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ, অথচ কী ক্ষণস্থায়ী সেই সময়,
আমরা বসেছিলাম মুখোমুখি। চারপাশের প্রতিটি বস্তু এবং
ব্যক্তিকে দৃষ্টি থেকে নিয়ে গেল আড়ালে
এক বেপরোয়া উদাসীন মনোভঙ্গী আর
আমার সকল একাগ্রতা শুধু তোমাকে ঘিরেই খেয়ালের আলাপ।
নেকড়ে রঙের পুলওভারের অন্তরালে মেষশাবকের মতো
তোমার উজ্জ্বল স্তনের ওঠানমা,
রঞ্জিত পবিত্র ঠোঁটে স্বপ্নঝালরের ঝিলিমিলি,
তোমার রহস্যঘন চোখের আধ্যাত্মিক ঘাট থেকে
যে নৌকো ছেড়ে গেল ঢউয়ের ওপর
নাচতে নাচতে, তার গলুইয়ে আমার আকাঙ্ক্ষা সওয়ার হয়ে চলেছে,
দেখতে পেলাম।
তুমি যখন আমার প্লেটে সাজিয়ে দিলে
ক্লাব স্যান্ডুইচ, তোমার আঙুল আমার দিকে
একজন ব্যালে নর্তকীকে এগিয়ে দিলো। যদি তাকে আচম্বিতে
চুমো খেতে পারতাম, তাহলে
কার সাধ্যি আমাকে বঞ্চিত করে
অমরতার আলিঙ্গন থেকে? পেয়ালায়
কফি ঢালতে ঢালতে
এভাবে চোখ রাখলে আমার চোখে, মনে হলো
তুমি লহমায় পাঠ করে নিয়েছো
আমার মনের দেয়ালের লিখন। তোমার চোখের
তারায় কি ফুটে উঠেছিল মৃদু তিরস্কার না কি
এক ধরনের পুষ্পল প্রশ্রয়? হয়তো কিছুই নয় আমি নিজেই
রঙিন কুয়াশা দিয়ে চটজলদি
তৈরি করে নিচ্ছিলাম এমন এক বাড়ি,
যার কোনো দেয়াল নেই, নেই ছাদ;
আছে শুধু রঙধনু-সিঁড়ি, অন্তহীন, নীলিমাভিসারী।
এ-ও এক বিস্ময়, তুমি তাকালে আমার দিকে, আমাকে
নাওয়ালে তোমার অপরূপ হাসির নিরিবিলি ঝর্ণাধারায়,
অথচ্চ আমার হৃৎস্পন্দন, থেমে গেল না,
হাড়, মাংস আর ত্বক ফুঁড়ে আমার হৃৎপিণ্ড
বেরিয়ে এসে ছিটকে পড়লো না টেবিলে। কেবলি
ঝংকৃত হচ্ছিলাম রেয়াজ-সিদ্ধ ওস্তাদের হাতের বাদ্যের মতো।
যা বলতে চেয়েছি, অকথিক থেকে গেল আর
তা নিয়েই সারাক্ষণ বাক্ বাকুম বাক্ বাকুম করে
কাটিয়ে দিলাম যার প্রায় ষোল আনাই অবান্তর।
এভাবেই হয়তো তুচ্ছের ভিড়ে
বিড়ম্বিত হয় অসামান্য। স্পল্পভাষী বলেই
আমি পরিচিত। আমার এই হঠাৎ
প্রগল্ভতার উৎস খুঁজতে যখন আমি ব্যস্ত,
তখন দ্বিপ্রাহরিক স্বপ্নকে খানিক সরিয়ে বললে তুমি,
‘এবার উঠতে হয়। সব ভালো জিনিষেরই
কখনো না কখনো শেষ হবার কথা,
মনে মনে আওড়ালাম। যখন তুমি টেবিল থেকে
হ্যান্ডব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ালে,
ভাবলাম, এই তো সেই দ্যুতিময় কবিতা
যা এতকাল ধরে লিখতে চেয়েছি,
কিন্তু আজো লেখা হয়ে ওঠে নি। আমার
অব্যক্ত প্রশ্ন তোমার তরঙ্গিত
শরীরকে স্পর্শ করলো আলতো,-
কোনোদিন কি সেই না-লেখা কবিতাকে নিজস্ব করে পাবো?