পোড়া দাগ
মাছভাজা হচ্ছি জ্বরে; অনেক কিছুই, খুঁটিনাটি,
ভুলে গেছি; এ ঘরে বিকেলে
কারা এসেছিল, কবিসভায় প্রস্তাব
করা হলো কি না, খিস্তি খেউড়, আড্ডায়
প্রচণ্ড বাদানুবাদ, কাফকার চিঠি
কিছুতেই পড়ে না মনে। গৃহিনী মাথায়
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঢেলেছিল পানি শুশ্রুষার
নির্ভুল মুদ্রায় তা-ও ভুলে বসে আছি। শুধু মাথার ভেতরে
ভ্রমরের মতো ক্রমাগত
কবিতার পংক্তিমালা তোলে গুঞ্জরন,
অক্ষরবৃত্তের পর্ব, স্বরবৃত্তের প্রধান্ন ঝোঁক
ভুলি না কিছুতে।
আমার এ ঘরে তুমি আসো নি কখনো। বিছানার
চারপাশে ঘেঁটু ফুল, ভুল সুরে বুলবুল গায়
গান দেখি কিছু ছায়া ঘোরে
আর কিছু বিকৃত মুখোশ-পরা মুখ
ঝুঁকে আছে আমার মুখের
ওপর এবং ছেলেবেলাকার উম্মাদিনী উদোম শরীরে
ঘোরে ঘরময়; মনে হলো,
চুপিসারে এসে তুমি রেখেছো তোমার
হাত তপ্ত আমার কপালে,
নিমেষেই পাই পানিপট্রির আরাম।
আমি তো স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি কতকাল, রাত্রিদিন
অত্যন্ত বিষাদে আছি। কম্বল জড়ানো
স্মৃতিখেকো ফকিরের মতো কারো লম্বাটে আঙুল মাঝে মাঝে
চুল ধরে টানে,
আমারই চেয়ারে বসে চিমটা বাজিয়ে
শোনায় প্রাচীন শোকগাথা।
কথা ছিল অপরাহ্নে তোমার আসার?
দেখা হবে কাল, কিছু কথা আর হাসির ঝিলিক
খেলে যাবে ঠোটে, যদি না আসো আমার প্রতীক্ষাকে
ব্যঙ্গ করে তোমার অনুপস্থিতি পোড়া দাগ
হয়ে থাকবে ব্যথিত স্মৃতিতে।
অবশ্য আসো নি তুমি; যদি মরে যাই
হঠাৎ, তবুও
পড়বে না পদচ্ছাপ তোমার এ ঘরে।
শুধু মরীচিকা নিয়ে করে ছটফট
জ্বরতপ্ত শরীর আমার;
কখন দুপুর হয়, কখন গভীর রাত, থাকে না খেয়াল।
প্রথম উপহার
ডাকটিকেটে নেই, কোনো ব্যাঙ্কনোটে, সরকারি
কিংবা বেসরকারি দপ্তরেও নেই। ক্যালেন্ডারেও থাকার
কথা নয়। আছে একান্ত আমার কাছে
তোমার রঙিন ফটোগ্রাফ,
যা’ তুমি আমাকে দিয়েছিলে
প্রথম উপহার হিসেবে।
মুখস্থ হয়ে গ্যাছে ফটোগ্রাফস্থিত তোমার
বসবাস আঙ্গিক, হাসির ছন্দ আর স্তনের ডৌল।
যখন ভাবি, তুমি বসে আছো।
আমার পাশে অথবা মুখোমুখি, তখন
যুগপৎ মৃত্যুভয় আর বাঁচার অগাধ সাধ
আমাকে নাচায় এবং
রক্ত মাংসের প্রতিমার তুলনায়
ফটোগ্রাফটিকে, রঙিন হওয়া সত্ত্বেও, কেমন নিষ্প্রভ
মনে হয়। কী করবো এই ছবি নিয়ে
যা’ আমাকে স্পর্শ করে না একবারও, বাঁধে না আলিঙ্গনে
অথবা আচ্ছন্ন করতে পারে না
চুম্বনে চুম্বনে?
উপহার-পাওয়া সেই ফটোগ্রাফ সযত্নে রয়েছে
আমার প্রিয় এক বইয়ের ভেতর,
এবং তোমার অন্য এক ছবি সমাসীন আমার হৃদয়ে,
যা কোনো স্বৈরাচারী শাসকই
নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না কোনোদিন,
যেমন করেছে নন্দিত পটুয়া কামরুল হাসানের চিত্রপ্রদর্শনীকে।
বকুলের মালা
আসলে কেনার ছলে মাঝে-মধ্যে সেসব বালক বালিকাকে
ভিক্ষা দিই, যারা থাকে
রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক পাশে, ছোটে ডানে কিংবা বামে, ভান করে
বকুলের মালা বিক্রয়ের, হয়তো ঘরে
অসুস্থ মা ভুখা-ফাঁকা আছে। বাধ্যতামূলকভাবে
মালা কিনে ফ্ল্যাট বাড়িটায় ফিরি, ঘ্রাণের প্রভাবে
অতীত নিকটে আসে হরিণের মতো,
মুখ রাখে ঝিলে, শিঙ তার ক্রমাগত
কেমন জড়িয়ে যায় সূর্যাস্তের রঙ-লাগা লতাগুল্মে। যদি
তোমাকে এ মালা দিই, তবে কি তোমার পাশে বয়ে যাবে নদী,
রঙধনু জাগবে সত্তায় নিরিবিলি? তুচ্ছ মালা
আমার টেবিলে পড়ে থাকে, হো হো হাসে পর্দাঢাকা কাচের জানালা।
চকিতে নীলিমা চিরে উড়ে যায় অতিকায় প্লেন।
ক্ষীণায়ু কীটস বলেছেন
একটি চিঠিতে তাঁর-‘প্রকৃত কল্পনা
আদমের স্বপ্নতুল্য, জেগে উঠে সত্য খুঁজে পাওয়া। জানবো না
কখনো পেয়েছি কিনা সত্যের সন্ধান। কল্পনাকে
পাখা মেলবার দিই মহলত। দূরে পাখি ডাকে,
নাকি ভুল শুনলাম? তোমার ড্রইংরুমে, মনে
হয়, কত স্বর্গসন্ধ্যা কাটে যেন স্বপ্নে জাগরণে।
কিছু কথা, কিছু নীরবতা যেন ফুলের স্তবক।
প্রাত্যহিকতার রূঢ় ছক
থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কতটা আলাদা
হয়ে ভিন্ন সুর তুলে সামাজিক থেকে যেতে পারি? বাঁধা ছাঁদা
এখনো রয়েছে বাকি; ‘চলি
ঢের রাত হলো বলে হৃদয়ে লুকানো ঝর্ণা আর বনস্থলী
নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠি কল্পনায়; ভাবি
তোমার নিকট নেই দাবি
আমার কিছুই আজ, এখনই কি বিদায়ের পালা?
মনে পড়ে, আমার টেবিলে আছে পড়ে বিশুষ্ক ফুলের মালা,
আনিনি যা’ বিহ্বল সংকোচে, মেয়ে, পাছে
তোমার স্বাস্থ্যল খোঁপা বেঁকে বসে; শুকনো মালাটিতে লেগে আছে,
মনে হয়, দুঃস্থ বালিকার ছলছলে দু’টি চোখ,
আমার ভেতরে জমে শ্রাবণ মেঘের মতো শোক।
বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়
সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও
শিশিরের মতো
জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়
জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ
বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে
ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,
কখনো অত্যন্ত ক্ষিপ্র জাগুয়ার তাকে
প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে
চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,
এতটুকু ঘুমোতে দেয়নি।
কাল রাত ঢাকা ছিল প্রেতের নগরী,
সবাই ফিরেছে ঘরে সাত তাড়াতাড়ি। চতুর্দিকে
নিস্তব্ধতা ওৎ পেতে থাকে,
ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি
কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক।
মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃশব্দ্যকে
আরো বেশি তীব্র করে তোলে
প্রহরে প্রহরে, নূর হোসেনের চোখে
খোলা পথ ওর
মোহন নগ্নতা নিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দুর্বার। অন্ধকার
ঘরে চোখ দু’টো অগ্নিঘেরা
জানালা, কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যৎ।
এমন সকাল তার জীবনে আসোনি কোনোদিন,
মনে হয় ওর; জানালার কাছে পাখি
এ রকম সুর
দেয়নি ঝরিয়ে এর আগে, ডালিমের
গাছে পাতাগুলি আগে এমন সতেজ
কখনো হয়নি মনে। জীবনানন্দের
কবিতায় মায়াবী আঙুল
তার মনে বিলি কেটে দেয়। অপরূপ সূর্যোদয়,
কেমন আলাদা,
সবার অলক্ষ্যে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে
আঁকা হয় যায়,
যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে।
উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠ
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।