তবুও লোকটা
এখনই যেও না তুমি, আমার শয্যার চারপাশে
যে পাখিরা বানিয়েছে নীড়
স্বপ্নচারী খড়কুটো দিয়ে,
আঁধার তাদের গিলে খাবে, থাকবে পড়ে
রক্তিম পালক কিছু, বলে তার অর্ধাঙ্গিনী
বিষণ্ন তাকালো।
তুমি চলে গেলে আমার এ খেলাঘরে কোনোদিন
রঙধনু জাগবে না, আমার পুতুলগুলি মুখ
ভার করে আড়ি
দেবে সাত তাড়াতাড়ি, এখনই যেও না,
বলে তার পাঁচ বছরের মেয়ে চাদরের খুঁট
ধরে রাখে মুঠোর ভেতর।
এ কেমন সময়ে আমাকে যাচ্ছো ফেলে,
তুমি না থাকলে ছায়ার অভাবে
পুড়ে পুড়ে আমি
গাছ হয়ে যাবো, যাকে খোঁচালে কেবলি
কয়লার গুড়ো ঝরে যাবে, বলে তার
তরুণ শিক্ষার্থী পুত্র পিতার ললাটে
সূর্যোদয় দেখে নিতে চায়
বই ফেলে রেখে।
তবুও লোকটা নিরুত্তর, খুব তাড়াহুড়ো করে
আয়োজনহীন হেঁটে যায় কুয়াশায়।
তবুও হলো না
কী বিপুল আয়োজন আজ
চতুর্দিকে, মানুষে মানুষে থই থই পথ, গাছের ভেতর থেকে
গান আসে ভেসে; নীলিমার আমন্ত্রণ
জাগায় আমার কাঁধে
শিহরণ, বহু শতাব্দীর চঞ্চলতা
পাখির মুখোশ নিয়ে ক্রীড়াপরায়ণ।
কাঁধ ফুঁড়ে এক জোড়া ডানা, অভ্রময়,
প্রকাশিত, চকিতে উদ্ভট। আশপাশ
মনুষ্য-বর্জিত, তবু কী-যে কোলাহল। সদ্যজাত
ডানা মাটি ছোঁয়,
চোখ ঘোরে মেঘমেঘালিতে,
যেখানে নানান স্তরে ফুটে আছে অনিন্দ্য কুসুম, ঘুম আনে,
নান্দনিক শেকড়ে পরাগ
ছড়ায় নিয়ত, ছুঁতে চাই। মাটি ছেড়ে
সেদিকে যাবার সাধ মঞ্জরিত পালকে; প্রয়াস,
কোনো দূর প্রজাতির সঞ্চয়ের উপহার, বৈফল্যে বিমূঢ়।
আমার সত্তার চেয়ে ঢের বেশি ভারী
একজীড়া ডানা শৈশবের মতো খুব
উড্ডয়নপ্রিয়,
আমার স্বপ্নের ভেতরেও নীলিমাকে স্পর্শ করে,
দেখে নেয় বিস্ময়ের ঘোরে বেহেস্তের উদ্ভাসন,
তবুও হলো না ওড়া, হলো না এখনো
তার কথা
অবশেষে তার প্রিয় মধ্যরাতে হলো অবসান।
ভুগেছে সে বহুকাল রক্তচাপ, হাঁপানি ও বাতে;
প্রায়শ হতো না ঘুম এক ফোঁটা বড় দীর্ঘ রাতে,
অথচ দুঃসহ শ্বাসকষ্টে অন্তর্গত চোরা টান
তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে তারাজ্বলা হু হু গান
মাঝে-মধ্যে। কখনো জেগেছে তীব্র সাধ কারো হাতে
হাত রাখাবার; কখনো বা কিছু লুকানো আঘাতে
সকাতর নিষেধ সত্ত্বেও করেছে সে মদ্যপান।
যখন সে গেল, কত লোক কত কিছু বলাবলি
করলো গয়লার মতো দুধে পানি মিশিয়ে প্রচুর-
কখন কাকে সে কটু কথা বলেছিল, পার্টি, গলি
ছিল তার মৃগয়ার ভূমি, গিলে পিপে পিপে মদ
ভাসিয়েছে সংসার বানের জলে, লোকটা বেহদ
বাজে; বললো না ছিল তার অস্তিত্বে স্বর্গীয় সুর।
তোমরা শাসন করো
তোমরা শাসন করো, আমরা শাসিত হই আর
তোমরা শোষণ করো, আমরা শোষিত জেরবার।
তোমরা ভাষণ দাও, আমরা শ্রবণ করি রোজ,
করি না হিসেব তাতে থাকে অসত্যের কত ডোজ।
আমাদের ঠেলে দাও বারবার ধূলোয়, কাদায়;
তোমরা ঘোরাও ঘুরি অসহায় গোলক ধাঁধায়।
আমরা ঘানির প্রাণী সর্বক্ষণ চোখে ঠুলি-আঁটা,
তোমরা নায়ক সুচতুর এবং আমরা কাটা
সৈনিকের মতো পড়ে থাকি মঞ্চে এক কোণে; দিন
যায়, দিন যায়, রৌদ্রে ঝলসিত উদ্যত সঙ্গীন
তোমাদের। তোমরা চালাও গুলি মিছিলে, সভায়
নির্বিচারে, আমাদের রক্তে রাজপথ ভেসে যায়।
তোমরা পাঠাও জেলে আমাদের যে কোনো ছুতোয়,
সানন্দে রগড়ে দাও মাথাগুলো নবাবী জুতোয়।
তোমরা সগর্বে ভাবো এভাবেই কেটে যাবে কাল
অগণিত সেপাই সান্ত্রীর পাহারায় আর খাল
কেটে মস্ত শাসালো কুমির আনলেও কারো সেই
সাড়ম্বর প্রচেষ্টায় বাধা দেবার মুরোদ নেই।
কিন্তু জেনে রাখো রুদ্র জনতার পুঞ্জীভূত ক্রোধ
দাবানল হলে টলে উঠবে তোমাদের মসনদ।
পালাবার পথ খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হবে না,
যেখানেই যাও শেষে শোধ করে যেতে হবে দেনা।
নিজেকে বন্ধক তুমি রেখেছো
নিজেকে বন্ধক তুমি রেখেছো মৃত্যুর কাছে, ফলে
মৃত্যুর শিয়রে নিত্য জমে
তোমার হাতের ফুল। অথচ অদূরে, একজন
দাঁড়িয়ে তোমাকে লক্ষ্য করে অগোচরে প্রায়, বলা যায়,
প্রত্যহ, যেমন
খগোলাবিজ্ঞানী নক্ষত্রের
গহন রাত্তিরে; ফিরে যাও নিজের নিবাসে একা
তোমার শাড়িতে চোরকাঁটা লেগে থাকে,
মৃত্যুর প্রচ্ছন্ন গন্ধ রুয়ে দেহমনে বিষাদের
বীজ, তুমি ফসলের প্রত্যাশায় থাকো অহর্নিশ।
বীজ নষ্ট হতে থাকে ক্রমাগত, বরং ভেতরে
ডেকে নাও তাকে,
যে দাঁড়িয়ে আছে হিমেল বাহিরে, যার
হৃদয়ে মন্দিরা বাজে, লাগাতার বৃষ্টির পরের
ঝকমকে রৌদ্রের আবীর
বিশদ ছড়ানো থাকে বেনারসী শাড়ির ধরনে।
পরিবর্তন
এইতো ক’দিন মাত্র তুমি নেই এ শহরে, অথচ আমার
মনে হয়, অনেক আলোকবর্ষ তোমাকে দেখি না,
কত যে সভ্যতা লুপ্ত হলো, তারপরও
শুনি না তোমার কণ্ঠস্বর
এবং তোমার
আশ্চর্য হাসির জলতরঙ্গ বাজে না
যুগ যুগ ধরে।
কী যে হলো এ শহরে, একটি পাখিও
পড়ছে না চোখে
তুমি চলে যাবার পরেই। গাছপালা
কোথায় উধাও হলো? সারি সারি বাড়ি,
সকল দকানপাট, সুপার মার্কেট,
বিউটি পার্লার আর রঙিন সিনেমাহল, সাকুরা এবং
ক্যাথে, কোহিনূর, যাবতীয় স্ন্যাকবার
মিষ্টান্ন ভাণ্ডার উবে গ্যাছে অকস্মাৎ
যেন কোনো ঐন্দ্রজালিকের ফুঁয়ে।
বাগানে ফোটে না ফুল এ শহরে বস্তুত কোথাও।
কোথাও বাধেনি যুদ্ধ, অথচ শহর নিষ্প্রদীপ সন্ধ্যেবেলা
থেকে, যানবাহনের শব্দ লুপ্ত, দমকলবাহিনী অলস,
এমনকি অ্যাম্বুল্যান্সও অচল ক’দিন
যাবত, শিশুরা খেলা ভুলে প্রিয় পুতুলের বিয়ে
করেছে বাতিল, বাস্তবিক প্রেমালাপ থেমে গেছে
সবখানে; তরুণী গাঁথে না মালা, সংগ্রামী তরুণ
লাগায় না পোস্টার দেয়ালে রুদ্র তেজে, আসমানে
মড়ার খুলির মতো চাঁদ রোষে ডেকেছে হরতাল।
এ কেমন শহরে এখনো বেঁচে আছি? হিংস্র, ধুধু মরুভূমি
ঢাকাকে করেছে গ্রাস, প্রেতায়িত অলিগলি। যায়,
দিন যায়, রাত কাটে ছায়াময়তায়, চতুর্দিক
কী নিশ্চুপ, এমনকি কুকুরের ডাকে
সীমাহীন নৈশ নিস্তব্ধতা একবারও
চমকে ওঠে না।
চারদিন নয়,
কয়েক শতাব্দী পর হঠাৎ সকালবেলা টেলিফোন, একি
আবার তোমার কণ্ঠস্বর
আমাকে মধুর চুমো খায়।
পরিপার্শ্ব কেমন বদলে যায় লহমায় আর
গাছপালা, পাখি, মেঘমালা, ফুল, হাওয়া-
সবাই রটিয়ে দেয় দিকে দিকে, ‘এসেছে সে ফিরে।
এ খবর পেয়ে সমস্ত শহর
অলৌকিক কলরব করে। এ শহর এর আগে
এরকম সজীব হয় নি মনে কোনোদিন। মিনতি আমার,
কখনো এভাবে আর এ শহর ছেড়ে
যেও না কোথাও।