কী এমন ক্ষতি হতো?
“This but thy name that is my enemy…”
-Shakespeare
কখনো কখনো অবসরে হয়ে উঠি প্রশ্নাকুল-
যদি কোনোদিন কবিতায় তোমার প্রকৃত নাম
ব্যবহার করি, তবে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে
যাবে? নাকি ভূমিকম্পে ধসে যাবে শহরের সব
ঘরবাড়ি, ভীষণ জখম হবে বেশুমার লোক?
অ্যাম্বুলেন্সে ছেয়ে যাবে পথ ঘাট? শোকার্ত কান্নায়
উঠবে কি ভরে অলিগলি? এ প্রশ্ন যখন তুলে
ধরি কথাচ্ছলে হেসে তোমার নিকট, তুমি কী নিশ্চুপ।
তুমিই আমার প্রিয়তমা, এবং তোমার নামও
খুব প্রিয়, অথচ করি না উচ্চারণ কারো কাছে,
পাছে কেউ কেউ সাত কাহন কাহিনী ফেঁদে বসে
তোমাকে আমাকে ঘিরে। তুমি নও, তোমার যে-নাম
সে-ই শক্র আমার; বলো তো কী এমন ক্ষতি হতো,
যদি অন্য কোনো নামে পেতাম তোমার পরিচয়?
কী জানতে চাও?
কী জানতে চাও তোমরা এখন? কোন্ কথা
কবুল করিয়ে নিতে চাও?
সব কোলাহল থেকে দূরে সরে অচিন ডেরায়
সময় কাটাবো কিনা কিংবা
নিসর্গের কথা ভেবে, দোয়েলের শিসের ভেতরে
নিশ্চুপ প্রবেশ করে জীবন যাপনে
মগ্ন হবো কিনা
এসব জানার কৌতূহলে
আমাকে খুঁচিয়ে তুলে দিব্যি মজা পেতে
চাও, যে রকম
চিড়িয়াখানায় লোকগুলো
পশুকে উত্যক্ত করে। পলাতক অপবাদ নিয়ে
চুপচাপ আছি।
আপাতত ফিরে যাচ্ছি, যাচ্ছি একান্ত গোপনে একা
স্বেচ্ছায় অজ্ঞাতবাসে, তবে
আবার আসবো ফিরে তোমাদের মাঝে
সত্তায় লতা গুল্মের, শ্যাওলার ঘ্রাণ
নিয়ে, হাতে থাকবে একটি পাণ্ডুলিপি,
যার ভাঁজে ভাঁজে
নক্ষত্রের সম্পন্ন ঝিলিক আর গহন নদীর
জোয়ারের গান,
প্রৌঢ় বয়সের ভালোবাসা,
নিটোল, গভীর
এবং অনেক কিছু যা আমি এখন
বলবো না।
কেশো রোগীর ভাবনা
তাহলে আমি কি শেষ তক কেশো রোগী
হয়ে গেছি, অচিকিৎস, হতাশার কোটরে আবদ্ধ রাত্রিদিন?
দমকে দমকে কফ পিকদানে জমা হয়। কখনো কখনো
ভাবি, এই বুঝি
আমার ভেতরকার সবকিছু আসবে বেরিয়ে,
বাসার সবাই
ভীষণ ভড়কে যাবে, আমি নিজে তাকাবো এমন,
যেমন বিধ্বস্ত ট্রেঞ্জে আহত সৈনিক
দ্যাখে তার নাড়িভুঁড়ি গ্রেনেডের ঝাঁঝালো ধমকে
নির্গত ধোঁয়াটে এলাকায়।
কে এসে বসেছে পাশে? প্রাচীন কালের মিশরের
বন্দনীয় দেবতার মতো দীর্ঘ তার
ধড় মানুষের বটে, মাথাটা জন্তুর। কী-যে বলে
হড় হড় করে সারাক্ষণ,
বুঝি না কিছুই; একজন অতিশয় কৃশকায়,
তোবাড়ানো গাল, হাসে দন্তহীন হাসি, তরুণীকে টানে বুকে,
করে খুনসুটি;
বাজে-পোড়া ডালে ঝোলে বিপন্ন কবির বেশভূষা।
দিনরাত কেশে কেশে ক্লান্ত হয়ে গেছি
অনেক আগেই; মাঝে-মধ্যে মনে হয়,
আমার নাছোড় কাশি প্রায় মৃত এই
শহরকে প্রবল ঝাঁকিয়ে ফের জাগিয়ে তুলতে পারে নাকি?
ছড়ার আদলে
সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ গেলাম শঙ্খ ঘোষের বাসায়;
সমাজ আলতো পেখম মেলে সম্ভাষণের ভাষায়।
কবিকণ্ঠে গহনতা, চোখে পাতাল-ছায়া,
সত্তা জুড়ে উপার্জিত নান্দনিকের মায়া।
ড্রইংরুমের দেয়াল-জোড়া নানা শ্রেণীর বই;
মুগ্ধতাকে বশে রাখি, হারায় কথার খই।
হঠাৎ আবার কথা জোটে প্রাণ খুলে ফের হাসার,
বিশ্লেষণে তফাৎ ফোটে সোনা এবং কাঁসার।
স্নিগ্ধতাকে নাচিয়ে ঠোঁটে অল্প কিংবা বেশি
মনের ভেতর দুঃখ মুড়ে আমার প্রতিবেশী
অনিন্দ্য এক টিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাটে করেন বাস।
তাঁর আকাশে ওড়ে কত ছন্দে-গড়া হাঁস।
মানবেতর জীবন কেন মানুষ করে যাপন?
সর্বশ্রেণীর সকল মানুষ হয় না কেন আপন-
এই ভাবনা ঘোরায় তাঁকে ভিন্ন পথের বাঁকে,
যখন তখন পদ্ম ফোটান বুক ডোবানো পাঁকে।
মেধা-মনন জুড়ে কবির রবিঠাকুর আছেন,
উপরন্তু বস্তুবোধের শিল্পসহ বাঁচেন।
প্রগতিকে মান্য করে ঋন্ধ পথিক যিনি,
তাঁর প্রকৃতির বিশিষ্টতা হয়তো কিছু চিনি।
প্রশ্ন করি, যোগাযোগের সেতু ভেঙে গেলে,
একটি হাতের স্পর্শ তখন অন্য হাতে মেলে?
বিচ্ছিন্নতা এখন শুধু মনকে দখল করে,
আমির মধ্যে আমি বসে বিবাগী সুর ধরে।
বাগমারিতে জোনাক দেখি, একি আমার দোষ?
সঙ্গে ছিলেন রূপদর্শী, পদবী যাঁর ঘোষ।
শঙ্খ যখন বিদায় দিলেন একটি নমস্কারে,
সালাম বলে ট্যাক্সি ধরি ছিঁচ্কে অন্ধকারে!
টেন্ডার
সত্যি বলতে কী, ব্যাপারটা ঘটেছিল নিকারাগুয়ায়
প্রেসিডেন্ট সমোসার শাসনামনে।
পরাক্রমশালী সামরিক হর্তাকর্তাগণ টেন্ডার
ডাকলেন টুপি, উর্দি আর বুটজুতোর জন্যে।
যে ঠিকাদার দেখালো সবচেয়ে কম দর,
তাকেই দেয়া হলো অর্ডার।
যে কোনো হাঁদারামও জানে
এটাই দস্তুর।
টুপি, উর্দি আর বুটজুতোর স্তূপ সরবরাহ
করার পর দেখা গেল-
সবগুলো ইয়া বড় আর ঢিলেঢালা যে, একটি
টুপির ভেতর সাতটি মাথা ঢুকে যেতে পারে,
মুখসুদ্ধ ঢেকে যায়, নেমে যায় কাঁধে।
একটা উর্দির ভেতর তিনজন তাগড়া
জওয়াকে সেঁধিয়ে দেয়ার পরেও ঢের
জায়গা থেকে যায়।
বুটজুতোগুলো এত বড় যে সেগুলো পরে
কুচকাওয়াজ করা তো দূরস্থান, হাঁটাই মুশকিল।
ঠিকাদার বেচারীর কোনো দোষ নেই।
তার নজরদারি তো হামেশা লাভের দিকেই, যত কম
কাপড় আর চামড়া
খরচ করা যায় ততই তার লাভ।
কিন্তু সামরিক হর্তাকর্তাগণ ব্যাপার স্যাপার দেখে
বেজায় খাপ্পা, তেতে-ওঠা স্টেনগান।
আবার ডাকা হলো টেন্ডার।
অর্ডার নিয়ে গেল নতুন এক ঠিকাদার।
কী আশ্চর্য, এবারও সেই একই
ঘটনার পুনরাবৃত্তি। টুপি, উর্দি আর বুটজুতো।
ভয়ানক বড়,
অথচ ঠিকাদারের প্রাণপণ চেষ্টা হলো
ঠিকঠাক মাপজোক মাফিক জিনিশ সরবরাহ করা,
যাতে পান থেকে চুনটি না খসে। কামানের মতো গর্জে-ওঠা
সামরিক প্রভুগণ ঠিকাদারটিকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে
বিদায় করলেন ছাউনি থেকে।
আবার নতুন টেন্ডার,
আবার নতুন ঠিকাদার,
আর তাজ্জব ব্যাপার,
আবার সেই একই ঘটনার
পুনরাবৃত্তি! জাঁদরেল জেনারেলদের আক্কেল গুডুম বার বার!