আমাকে দাও
ক’দিন থেকে দু’চোখ নির্ঘুম,
জাগিয়ে রাখো আমাকে রাতভর।
শয্যাময় দোজখী অঙ্গার;
ঘুমাবো, দাও একটি চুম্বন।
নজর রাখি যেদিকে, সেদিকেই
তোমাকে ছাড়া দেখি না কিছু আর।
ব্যাকুল স্বর হৃদয়ে বাজে শুধু,
আমাকে দাও একটি চুম্বন।
এখন তুমি আমার পাশে নেই,
অথচ শুনি বলছো মৃদু স্বরে,
‘আমার কাছে কী চাও বলো কবি?’
‘জবাবে বলি, একটি চুম্বন।
তোমার হাতে তপ্ত হাত রেখে
নিজেকে ভাবি রাজাধিরাজ এক।
প্রবল দাবি মুকুট হয়ে জ্বলে-
‘আমাকে দাও একটি চুম্বন।
হে মনোলীনা তোমার করতলে
আমার আয়ু রেখেছি গচ্ছিত,
সত্যি সেই পুঁজিপাটার সুদ
বাড়াবো, দাও একটি চুম্বন।
উজানে
ওরা তোর অলৌকিক পাখা ছেঁটে দেয়ার উদ্দেশে
সর্বদা পাকাচ্ছে ঘোঁট, তবু কেন তুই
এমন নিঃসাড় একা একা
গৃহকোণে নিমগ্ন থাকিস ওরে চৌদিকে এন্তার
দপদপে অক্ষরের নাচ
দেখে, কারো আসার ব্যাকুল প্রতীক্ষায়?
সুযোগ পেলেই ওরা ভীমরুল হ’য়ে
ছেঁকে ধরে তোকে,
তবু কেন তুই মুখ বুঁজে সহ্য করে যাস সেই
কুটিল দংশন? কেন এক ঝটকায়
দিস না তাড়িয়ে
ওদের নিমেষে? তাড়া খেয়ে যাক ভেসে নর্দমায়।
ঘুমন্ত সিংহকে মৃত ভেবে
অগাধ আহ্লাদে
শেয়াল কুকুর যে রকম ঘুরঘুর করে তার
আশেপাশে, ওরাও তেমন বারংবার
তোকে ঘিরে ফিচেল চক্কর কাটে; ওরে কেন তুই
হঠাৎ গর্জন করে দিস না কাঁপিয়ে দশদিক?
তোকে স্থির লক্ষ্য করে চোরাগোপ্তা হামলা চালায়
ওরা,প্রায়শই ছোড়ে তীর,
হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দিতে চায় ছোরা, বিষাক্ত বল্লম,
তবু কেন অস্ত্র তোর ক্ষিপ্র ঝলসে ওঠে না ক্রোধে?
‘সত্য ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র নেই আমার এবং
আমি প্রতীক্ষায় আছি, বুঝলে হে, তার উত্থানের’
দিলো সে উত্তর হেসে। সত্য আজ গেছে বনবাসে,
বলি তাকে। ‘সত্যের জুলফিকার করবে মিথ্যার
শিরশ্ছেদ একদিন সুনিশ্চিত,’ বলে সে আবার
দ্বেষহীন, উদাসীন, একা
ঘাট ছেড়ে নৌকা দিলো ভাসিয়ে উজানে
নিরুদ্দেশে; এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি সঙ্গ নেয় লোকটার।
একজন শহীদের মা বলছেন
যাকে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছি, এখন
সে কোথায়? পুড়িয়ে আমার বুক এই
পোড়া দেশটিকে ভালোবেসে,
ভালোবেসে শাপলা শালুক, খালবিল, মাছরাঙা,
সোমত্ত নদীর বাঁক, দোয়েলের শিস,
দিগন্ত সবুজ-করা টিয়েদের ঝাঁক,
যৌবনের প্রফুল্ল সকালে
ঝরে গ্যাছে। এখন কোথায় ওর হাড়গোড় সার
হচ্ছে ক্ষেতে স্বপ্নময় শস্য হবে বলে
আমি তা’ জানি না।
সময় কাটতো ওর রাশি রাশি বই পড়ে, খুব
রাত করে ঘুমোতে সে, কখনো কখনো
কণ্ঠে ওর নক্ষত্রের মতো
ফুটতো কী সব কথা, যা ছিল আমার
বোধের ওপারে। বলতো সে
মাঝে-মাঝে, রাতে স্বপ্নে দেখি
ফুটেছে গোলাপ এক বুকের ভেতরে
মা, তোমার মমতার মতো। তোমার মুখেই দেখি
প্রতিদিন স্বদেশের মুখ এবং যখন তুমি
ঘর ঝাঁট দাও, ভাবি সরাচ্ছো জঞ্জাল এ দেশের
মৃত্যু তার, বলে ওরা, করেছে আমাকে মহীয়সী,
আরো কত কথা বলা হয়
যা’ শুনে আমার মাথা গর্বে দূরের আকাশ ছুঁতে
পারে লহমায়।
নিজস্ব দুঃখের চেয়ে গৌরব অনেক বড়, এই
অলংকৃত ভান নিয়ে দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া
কী দুঃসহ, আমি ছাড়া বুঝবে কে আর পৃথিবীতে?
আমার এ শূন্য বুক পোড়ো বাড়ি, যাতে
লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডেকে ওঠে ঘোর মধ্যরাতে, ক্লান্ত লাগে,
দেয় না ঘুমোতে কিছুতেই ফণিমনসার খোঁচা।
যে তম্বীকে ভাবতো সে স্বপ্নের একান্ত সহচরী,
তার দু’টি হাতে মেহেদির ছোপ লাগার আগেই
একটি শিকারি বাজ ওকে
করেছেন হনন,
কেননা সে চেয়েছিল গণতন্ত্র মুক্তি পাক লিখে
বুকে, স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘোষণা করে
হেঁটে যাবে রাজপথে, মাথা তার ছোঁবে
আকাশের মেঘলা খিলান। এখন সে জীবনের সাজ-পরা
কিংবদন্তী; কিন্তু আমি কী করবো এই
কিংবদন্তী নিয়ে? স্বপ্নে-দেখা কী নির্দয়
গোলাপ ফুটেছে দ্যাখো, দ্যাখো দেশবাসী
তরতাজা যৌবনের বুকে!
হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই
তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর
করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ
ওর নাম, হোমরা চোমরা তারা, যারা
তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ
জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে
জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,
ওদের মুখোশ-আঁটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুঁড়ে থুতু শুধু থুতু।
একটি এলিজি, কাদেরের জন্য
বড় ধুধু মধ্যবয়সের প্রান্তরেখা,
সহজে মেলে না পান্থপাদপের দেখা
কোথাও; উজাড় হৃদয়ের গুলবাগে দিশেহারা বুলবুল
হয়তো গায় ভুল
গান, তার দোষ ধরা সাজে না, বরং
ধরে রাখা ভালো জীবনের হাত গলে যখন যেটুকু রঙ
লেগে থাকে প্রাণে আর এখানে যেভাবে হোক থাকা,
কাউকে কাউকে কাছে ডাকা
হৃদয়ের স্বরে,
কী যে ভালো লাগে বসবাস স্মৃতির আপন ঘরে।
অকস্মাৎ গৃহিনীর,সন্তানের হাসি মুছে ফেলে
এত দ্রুত কেন চলে গেলে?
ঊর্ধাশ্বাসে এরকমভাবে
গেলে, যেন ইস্টিশান থেকে ট্রেন ছেড়ে যাবে
এক্ষুণি এবং গার্ড বাঁশি
বাজিয়ে দিয়েছে; বুঝি তার ‘আচ্ছা আসি’
বলে তুমি বিদায় নেয়ার কোনো পাওনি সুযোগ। মনে পড়ে,
পুরানো ঢাকার পথে কিংবা দেওয়ান বাজারে হাসানের ঘরে
আমাদের যৌবনের ঊষা
কেটেছে; যদিও অতি সাধারণ ছিল বেশভূষা
কতিপয় তরুণের, তবু রত্নদ্বীপ নিয়ে মনে
উদ্ভাসিত মেধা ও মননে
নির্ভীক হেঁটেছে ওরা। প্রগতির সাধক হাসান
মধ্যপথে মরালের গান
গেয়ে সঙ্গীদের এ কেমন ভাসান দেখালো আর
তুমিও ভীষণ অন্ধকার
পথে হলে তার অনুগামী, কী এমন হতো ক্ষতি, যদি
আরো কিছুকাল মৃদু কলরবে বইতো তোমার প্রাণের নদী?