- বইয়ের নামঃ বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ মাটিগন্ধা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অবশেষে আসে ওরা
শেষ অব্দি ওরা আসবে কি আসবে না এ অঞ্চলে
দলে দলে, এ নিয়ে তুমুল তর্ক চলে পথে ঘাটে,
গ্রামেগঞ্জে এবং খেলার মাঠে, চা-খানায় আর
দপ্তরে দপ্তরে, আদালতে। কারা ওরা? কী রকম
আচরণ করবে প্রত্যাশা জনগণ অস্ত্রধারী
সেসব লোকের কাছে? ওরা কি বর্বর হুনদের
মতো নাকি নব্য সভ্যতার অগ্রদূত? পতাকার
সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেবে বন্দি মানবের মুক্তিদাতা?
জল্পনার অন্ত নেই। অনেকের মনে উল্লাসের
বান ডাকে, কেউ কেউ আশংকার কালো চোরা টানে
কেবলি তলিয়ে যায়। তবে সকলেই প্রতীক্ষায়
কাটায় প্রহর অকস্মাৎ কবে ওরা এসে পড়ে।
অনেকে প্রস্তুত থাকে ফুলের স্তবক, মালা নিয়ে
সগর্বে চুকিয়ে দিতে বীরদের প্রাপ্য হাতে হাতে।
অবশেষে আসে ওরা, যেন আকাশ আঁধার করে
নামে দিকে দিকে পঙ্গপাল ভরা ফসলের ক্ষেতে।
চকচকে অস্ত্রের আঘাতে যত্রতত্র মনীষার
কাটা মাথা ধুলায় গড়ায়, শুভবুদ্ধি তড়িঘড়ি
চলে যায় নির্বাসনে। বাকি থাকে যারা, তারা সব
পড়িমরি কোথাও লুকায়। বর্বরের ঘোড়াদের
শাণিত ক্ষুরের ধূলিঝড়ে মধ্যযুগী অন্ধকার
নেমে আসে সারা দেশে। ক্রুশবিদ্ধ বোধির বিলাপ,
এবং আড়ালে আবডালে অসহায় চেয়ে থাকে
কতিপয় লোক, যারা গড়ে নি কখনো প্রতিরোধ।
অমাবস্যার চাঁদ
তুমি কি আমার উদ্দেশে নারী
পথ চেয়ে থাকো কোথাও দূরে?
আমি ঘুরে মরি নিদারুণ ঘোরে,
আর্তি বেরোয় হৃদয় ফুঁড়ে।
বাতাস রটায়, আমার জন্যে
ফুল তুলে রাখো সন্ধ্যেবেলা।
সে-ফুল শুকায় শূন্য প্রহরে,
এ-ও কি তোমার নিছক খেলা?
তোমার ফুলের সুগন্ধ জানি
কেউ কেউ পেয়ে ধন্য হয়।
শুধু অভাজন বঞ্চিত আজো,
অথচ ঘ্রাণের ঘটে নি ক্ষয়।
তোমার কাছেই পৌঁছুতে চাই
কায়ক্লেশে আমি নিত্যদিন।
এসে গেছি ভেবে প্রফুল্ল হই,
কিন্তুএ-পথ অন্তহীন।
বেলা ক্ষয়ে যায় দ্রুত ঘর্ষণে,
সময় কাটাই সংঘ বিনা,
সাধকের মতো নির্ঘুম ধ্যানে
তোমাকেই ভাবি প্রসার্পিণা।
রহস্যময় স্বভাব তোমার,
আমাকে ভোগায় অভাববোধ।
আঁধার চিবিয়ে খাচ্ছে সত্তা,
কখন জাগবে রূপসী রোদ?
রিক্ত শাখায় আওড়ায় শুক-
কিছুই তোমার হলো না শেখা,
যাকে খোঁজো তুমি সকালসন্ধ্যা,
প্রত্যহ তার পাবে না দেখা।
অসুস্থতায় বকছি প্রলাপ,
কারা চারপাশে পেতেছে ফাঁদ?
আমাকে জাগিয়ে রাখে সারা রাত
অমাবস্যার খেয়ালি চাঁদ।
আত্মা ছুঁড়ে দিই
কোনো মহামান্য আদালত নয়,
গোলাপ, বনদোয়েল, পূর্ণিমা-চাঁদ,
লালিত্যময় পদ্য, রূপসীর চোখের ঝিলিক, সুগন্ধী সাবান
আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কাঠগড়ায়।
সম্প্রতি তাদের কাছ থেকে
আমার আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিয়েছি,
এই অভিযোগে ওরা আমাকে
জেরা করছে বার বার, বলছে যেতে হবে ভাসানে।
কার কাছে জানাবো ফরিয়াদ?
কী করে খণ্ডন করবো ওদের বাছা বাছা যুক্তি?
স্বীকার করি, ছিঁচকাঁদুনে পদ্য দেখলেই আমার মাথায়
ইদানীং খুন চড়ে যায়, ইচ্ছে হয় এক থাপ্পড়ে
ফেলে দিই নর্দমায় এবং
যেসব পদ্যরাশি হিজড়ের মতো অঙ্গভঙ্গী করে,
দাঁত দিয়ে আঙুল চেপে ধরে পাছা দুলিয়ে
চোখ মারে, তাদের
রঙবেরঙের ছৈলছবিলা ঢঙ দেখলে
আমার ভীষণ বিবমিষা জাগে।
যেসব পদ্য সস্তা প্রসাধনে ঝকঝকে হয়ে
অশ্লীল ইশারায় জোটায়
দু’ঘণ্টার নাগর, তাদের মুখে
থুতু ছিটোতে পারলে স্বস্তি পাই।
যখন ওরা বলে নন্দনতত্ত্বের গলায় পা রেখে
চটকাচ্ছি তাকে, যেমন
সিগারেটখোর আধপোড়া সিগারেটটাকে
পিষে ফেলে জুতোর তলায়,
তখন আমি সাক্ষী মানি রজনীগন্ধা এবং কোকিলকে।
আমি কি কখনো বন্দনা করি নি রজনীগন্ধার?
রক্তচক্ষু কোকিল বলবে নির্দ্বিধায়,-
লোকটা আমারই মতো গলায় রক্ত তুলে গান গায়’
এবং মেঘের গর্জন
আমার সপক্ষে সাক্ষ্য দেবে এই বলে,
কী করবে সে গোলাপ, বনদোয়েল আর
পূর্ণিমা চাঁদ নিয়ে যখন ক্যালেন্ডারের প্রায়
প্রত্যেকটি তারিখ থেকে বয়
হাভাতের দীর্ঘশ্বাস, সাহসী মানুষের রক্তধারা,
ঝরে এতিমের অশ্রুকণা?
এই আপাদমস্তক বাণিজ্যিক উটকো সমাজে, গোঁজামিল দেয়া
বেঢপ সাংস্কৃতিক চন্ডীমণ্ডপে
আমাকে বোঝে না কেউ। যখন হাতে
তুলে নিই বলপেন, আমার কব্জিতে
স্পন্দমান চিতাবাঘের হৃদপিণ্ড। বিগতযৌবন
সামন্ততান্ত্রিক পরিপার্শ্বে বিদুষকের মতো অনবরত
ঘুর ঘুর করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় কখনো।
আমি আমার আত্মা ছুঁড়ে দিই ডুমুরের ডালে,
মজে-যাওয়া খালে, স্বপ্নের চাতালে, শৌচাগারের
অকথ্য বুলিভর্তি দেয়ালে আর
তোমাদের অভিযোগের নাকের তলায়।
আমরা দু’জন দু’দিকে
আমরা দু’জন দু’দিকে বন্দি,
মাঝখানে এক দেয়াল।
দেয়াল-ফাটলে জাগলো ঝর্ণা,
দৈবের কী-যে খেয়াল।
সেদিন রাত্রে না-দেখা তোমাকে
শুনি টেলিফোনে হঠাৎ;
অভিভূত আমি অঞ্জলি ভরে
তুলে নিই আবেহায়াত।
যখন বলেছি, ‘দেখা হবে কবে’,
হেসে উঠে দিলে জবাব-
‘হতাশ হবেন,’ বলি উত্তরে,
‘সে হবে আমার সওয়াব।
তুমি কাছে এসে দাঁড়ালে দুপুরে,
দু’ চোখে আমার চমক,
তুমিই আমার নিয়তি রূপসী,
হৃদয়ে গুণীর গমক।
পেঙ্গুইনের বই নেড়ে চেড়ে
ছড়ালে আয়ত দৃষ্টি,
তোমার মুখের আদলে ফুটলো
চিত্রকরের সৃষ্টি।
অনন্য এই দৃশ্যকাব্যে
অন্যেরা সাঁটে আঁচিল;
সুন্দরীতমা, এসো ভেঙে ফেলি
মধ্যিখানের পাঁচিল।
যদি হাত ধরে হেঁটে যাই পথে,
ঢি ঢি পড়ে যাবে পাড়ায়,
কে কোথায় ফের ছিট্কে পড়বো
নেকড়ে-দলের তাড়ায়!
আজ আমাদের চারপাশে শুধু
ফণিমনসার প্রলাপ,
চলো পাথরের ধু ধু চত্বরে
আমরা ফোটাই গোলাপ।