বাড়ি
নিজের বাড়িতে আমি ভয়ে ভয়ে হাঁটি, পাছে কারো
নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে। যদি কারো তিরিক্ষি মেজাজ
জ্বলে ওঠে ফস্ করে যথাবিধি, সেই ভয়ে আরো
জড়োসড়ো হয়ে থাকি সারাক্ষণ। আমার যে-কাজ
নিঃশব্দে করাই ভালো। বাড়িতে বয়স্ক যারা, অতি
পুণ্যলোভী, রেডিয়োতে শোনে তার ধর্মের কাহিনী।
মক্ষিরাণী। সংসারে কেবলি বাড়ে শিশুর বাহিনী।
মেথর পাড়ায় বাজে ঢাক-ঢোল, লাউডস্পীকারে
কান ঝালাপালা আর আজকাল ঠোঙ্গায় সংস্কৃতি
ইতস্তত বিতরিত, কম্তি নেই কালের বিকারে।
বুকে শুধু অজস্র শব্দের ঝিলিমিলি। যে-সুকৃতি
জমেনি কিছুই তার কথা ভেবে মাথা করি হেঁট,
ঘুমায় পুরোনো বাড়ি, জ্বলে দূরে তারার সেনেট।
বৃষ্টির দিনে
তখন ও চাঞ্চল্যে ক্ষিপ্র হয়নি শহর, ট্রাফিকের
কলতান বাজেনি প্রবল সুরে। টলটলে স্নিগ্ধশ্যাম ঐ
পার্কের শরীর ঘেঁষে যাচ্ছিলাম হেঁটে দ্রুত পায়ে
বর্ষাতিটা গায়ে চেপে। সহসা সরিয়ে
বৃষ্টির ঝালর একজন হাত রেখে
নিঃশব্দে আমার কাঁধে বললেন গাঢ় উচ্চারণেঃ
“কোথায় ছুটেছো তুমি হন্তদন্ত হয়ে পরিশ্রমী নাগরিক এমন বর্ষায় ?
বরং পার্কের বঞ্চে সময় কাটাই চলো কথোপকরনে,
চলো পার্কে বৃষ্টির আদর মাখি চোখে-মুখে, সেখানে তুমিও
সুম্নাত গাছের সখ্য পাবে, হাওয়ার অশ্রান্ত ম্যাণ্ডোলীন শুনে
বেঞ্চটাকে মনে হবে সাধের গণ্ডোলা।
“এবং তোমাকে বলি শোনো, বার বার
যূথীর সান্নিধ্যে যাওয়া ভালো; মাইল মাইল পথ
বেলা-অবেলায় হেঁটে দেখেছিতো শেষে
সে-পথ কোথায় নিয়ে যায়, কী কল্যাণ হাতে আসে! ট্রাম-লাইনের ধারে
সুকৌশলে হয়তোবা, অপঘাত যেখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকে
সিঁধেল চোরের মতো। ট্রাম-লাইনের ক্ষীণ ঘাসের সম্মোহ
ফুরোয়নি বলে আমি শুনলাম ডাক সেই রৌদ্রের নিশির,
এবং নিমেষে ভাসলাম কী রক্তিম সারোবরে!
“মাইল মাইল পথ হেঁটে দেখেছি তো অবশেষে
সে-পথ কোথায় নিয়ে যায়, কী কল্যাণ হাতে আসে!
পরিশ্রমী নাগরিক দাঁড়াও এখানে ক্ষণকাল স্তব্ধতায়,
বর্ষায় নিমগ্ন হও, নিসর্গকে করো তীর্থভূমি”
এই বলে প্রবীণ জীবনানন্দ পার্কের শরীর ঘেঁষে একা কোথায়
গেলেন দূরে।
জনশূন্য ফুতপাতে চির নিঃসঙ্গতা
মুর্হূতে চোয়াল দিলো মেলে আমন্ত্রণে; চতুর্দিকে
অনাসক্ত বৃষ্টি পড়ে, বর্ষাতির আড়ালে শরীর
সকল বিফল হলো ভেবে ফিনকি হয়ে
যেতে চায় মেঘদলে। দেহ ছাড়ি যেন মোর প্রাণ চলি যায়-
অকস্মাৎ বাতাসে এ কার হাহাকার?
ঝড়ের নদীতে একা টলমল নৌকোর মতোই ভেসে চলি
তিমির দুরন্ত ফুটপাতে। চলতেই শঙ্কিল পঙ্কিল বাট,
ঘন-ঘন ঝন-ঝন বজ্র নিপাত। আকাশের কাজল ট্যাঙ্কের থেকে
জল ঝরে অবিরল, বৃষ্টি পড়ে সমস্ত শহরে, বৃষ্টি পড়ে
অপরূপ স্বপ্নের চত্বরে। মনে হয় যুগ-যুগ ভিজে ভিজে
সত্তায় জমেছে দামী, অনুপম শ্যাওলার কারুকাজ, মৎস্য-ঘ্রাণ, আর
সহসা নিজেই যেন হয়ে যাই বৃষ্টিভেজা রাত্রির শহর!
অগ্রজ কবির মন্ত্রণায় নিসর্গকে তীর্থভূমি
জ্ঞানে দ্রুত যতোটা এগোই তারও বেশি
নিশ্চিত পিছিয়ে পড়ি বিতৃষ্ণায়, আর চিরকেলে
বর্ষার জানুতে মাথা রেখে রেখে বড়ো ক্লান্ত লাগে।
চোখে-মুখে একরাশ বৃষ্টির আঁচড় নিয়ে ঐ স্নিগ্ধশ্যাম
পার্ক ছেড়ে চলে যাই, বিরক্তিতে ভরপুর, অস্তিত্বের শীর্ষে ক্ষান্তিহীন
বৃষ্টি ঝরঝর ব’য়ে ইহুদির মতো
সর্বদাই ধাবমান, নৈঃসঙ্গ্যের কাঁটায় জর্জর।
ভেলায়
জনহীন শিল্পশালায় ভজেছি শূন্যতাকে।
ললাটে অভিশাপের নিদারুণ জড় ল বয়ে
চলেছি নিরুদ্দেশে অজানা জলের ডাকে।
প্লাবনের দামাল হাওয়া বয়ে যায় সত্তা জুড়ে।
স্মৃতিতে উদ্ভিদেরই মায়াবী পুরান ছায়া,
সাগরে যাচ্ছি ভেসে বুড়োটে ভেলায় চেপে।
কবে যে পালের ফালি নিমেষে উধাও হলো,
জানি না হঠাৎ কবে ছিঁড়েছে দাঁড়ের দড়ি।
অজানা সমুদ্দুরে কুহকী নারীর গানে
হারালো দিক্-নিশানা; শোণিতের রুদ্র ঝড়ে
মায়াবী পাহাড় ছুঁয়ে নিমেষে মজলো যারা,
তাদেরই হাড় ক’খানা জমেছে পাথর ঘেঁষে।
কে ঘোড়া মেঘের সাঁকো পেরিয়ে স্বপ্নে আসে?
বুঝি তার খুরের ঘায়ে নীলিমা হচ্ছে গুঁড়ো।
কে জাগায় তন্দ্রা তটে? বেঘোরে বৈঠা দেখি
অবেলায় শিথিল মুঠোয় সহসা উঠলো নড়ে।
নিয়ত লবণকণা ক্ষতকে কামড়ে ধরে।
কখনো ঢেউকে ভেবে রমণীর বক্ষচূড়া
মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ি নিরালা অতল জলে!
কখনো জলজ প্রাণী চকিতে মুখটি তোলে।
সবুজের আশায় জ্বলে একাকী পায়রাটাকে
ছেড়েছি মুঠোয় থেকে ধু-ধু সেই নীলাম্বরে।
নিয়ে তার তীক্ষ্ণ ঠোঁটে সুদূরের চিকন পাতা
ফেরেনি ভেলায় আজো, ফেরেনি পায়রা শাদা।
কিমিয়ার গোপন মায়া এখনো রক্তে নামে।
পুরানের ভগ্ন ছায়ায় বেদনায় পুতুল গড়ে
চলেছি নড়বড়ে এক বুড়োটে ভেলায় চেপে-
অবেলায় যাচ্ছি ভেসে, কেবলি যাচ্ছি ভেসে।
মিশ্ররাগ
খর রৌদ্রের নিথর প্রহরে
শ্রাবণের ঘন মেঘ দেবে বলেছিলে।
তৃষিত চোখের আর্তি ঝরিয়ে
চেয়ে থাকি দূর অসীম শূন্যে, নীলে।
ঘন সমারোহে পুঞ্জ পুঞ্জ
মেঘের জটলা দূর আকাশের পাড়ে;
যেন একপাল কালো মেঘ তেড়ে
লাফ দিয়ে পড়ে শুভ্র মেঘের ঘাড়ে।
হৃদয়ে মরুর বালি ওড়ে আজ,
দারুণ তৃষ্ণা রুক্ষ সত্তা জুড়ে।
ছায়া খুঁজে ফিরি পাথুরে মাটিতে,
কখন যে মেঘ বাতাসে গিয়েছে উড়ে।
দুপুর-রৌদ্রে তোমার ছায়ায়
নিজের ছায়াকে সহযে মিলাতে চাই।
কোন্ সে আগুন শুষে নিয়ে গেছে
স্নিগ্ধ ছায়াকে-পড়ে আছে শুধু ছাই!
হাজার যুগের প্রেমিকের কতো
বাসনা দগ্ধ হৃদয়ে বেঁধেছে বাসা-
সেই গুরুভার বই দিনরাত,
পথের ক্লান্তি ভোলায় ছায়ার আশা।
গৌরাঙ্গীর দেহের বাগানে
চোখের লুব্ধ ভ্রমরের জয়গান।
শিরায় শিরায় সেতারের ঝালা,
রক্তের প্রতি কণা চায় মহাদান।
জ্বলজ্বলে দুটি স্বর্ণ কুম্ভ
কানায় কানায় যৌবন-জলে ভরা।
জীবনের স্বরে ছলকিয়ে ওঠে,
সীমাহীন পথে সে-জল ক্লান্তিহরা!
স্নান সেরে এলে কুন্তল ধারা
ঝরতো একদা গুরু নিতম্ব’ পরে।
কালিয়া আঁধার কনক চাঁদার
শরণ নিতো যে-তা-ও আজ মনে পড়ে!
আমার প্রাণের খর বৈশাখে
মেঘে মেঘে আনো বিপুল বৃষ্টিধারাঃ
হৃদয়ের কূলে সিক্ত হাওয়ায়
কাশফুল হবে খুশিতে আত্মহারা।
কতকাল আর কাটাবো বিষাদে
দিনরাত শুধু স্মৃতি সম্বল করে?
মাঝ মাঝে তাই বিচ্ছেদ ভেবে
বেহুঁশ বেতাল নামি নরকের ঘরে।
দৈব দয়ায় বহুকাল পরে
হয়তো আসবে মিলনের মহাক্ষণ।
কিন্তু তখন কোন্ বনে, হায়,
হরিণ-ক্ষিপ্র তোমার সে যৌবন?